সোনালী আলোর ঘ্রাণ পর্ব-১২+১৩

0
498

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
মাগরিবের আগ মুহুর্তে মৌসুমী উঠুনে মুরগির খাবার ছিটানোর সময় আজমাইন এলো বাড়ির গেইট ঠেলে। মৌসুমী দেখা মাত্রই চাপা হাসলো। আজমাইনের চোখ চলতি পথে তার দিকে পড়লে সহজেই হাসিটা লক্ষ্যনীয় হলো। সে কি তাকে দেখে হাসলো নাকি, ঠিক বুঝতে পারলো না। তাই বুঝার জন্য সময় নিয়ে তাকিয়েই রইলো। দেখলো মৌসুমী তার দিকে আবার তাকিয়ে আবার হাসছে৷ সে থেমে গিয়ে ভ্রু কুচকে বললো,
“হাসোছ ক্যা?”
মৌসুমী মুখ চেপে ধরে আরও হাসছে। যেন মন খুলে মুখ ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। বারান্দার পাশেই কোদাল রাখা ছিলো। সে জবাব না দেওয়ায় আজমাইন কোদাল হাতে তুলে বললো,
“তুই হাসলি ক্যা আমারে দেইখা?”
“ও মা গো!”
কোদাল হাতে এগোতে দেখে দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো মৌসুমী। আজমাইন চলে গেলে আবার বেরিয়ে এলো। আবারও হাসি পাচ্ছে তার। তবে চাপা নয়, শরীর কাঁপিয়ে হাসলো এবার। মনটা ভীষণ ভালো আছে। ভালো মনেই হাসছে সে। চালের উপরে চোখ পড়তেই কবুতরগুলোকে নজরে পড়লো। বাকবাকুম ডাকছে। এদের মধ্যে সাদা রঙের কবুতর জোড়া তার ভীষণ ভালো লাগে। মৌসুমী দুই মুঠ গম চালে ছুড়ে মারলো তাদের জন্য। ঝাপাঝাপি করে সব লেগে পড়লো গম খেতে। দৃশ্যটা প্রাণ কাড়ে তার। তাই আরও দুই মুঠ ছুড়ে ফেললো সেদিকে। মরিয়ম তখনও এ বাড়িতেই ছিলো। হালিমা খাতুন ধরে বসেছে খেয়ে যেতে হবে তাকে। ভাইয়ের সাথে বেশ কিছুক্ষণ আলাপসালাপও করলেন। সন্ধ্যায় রান্নাবান্না শেষ হওয়ার পর খাবার দেওয়া হলো। থাকার জন্য বললেও থাকতে রাজি হলেন না বাড়িঘর ফাঁকা ফেলে রেখে। রাতেই আজমাইন এগিয়ে দিতে গেছে ফুপুর বাড়ি।
সবটা নির্ধারণের পর চিন্তায় জমে গেলেন সেলিনা বেগম। আয়োজন নাহয় না-ই করলো, মেয়ের বিয়েতে মেয়েকে কিছু দিবে না এটা কেমন হয়? কিছু তো দেওয়া দরকার। মেয়েকে খালি হাতে বিদায় করবে স্বামীর ঘরে? উহুম, মন মানছে না। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর এককভাবে মোয়াজ্জেম আলীর সাথে এই নিয়ে আলোচনা করছেন,
“মাইয়া খালি হাতে বিয়া দিলে কেমন দেখায় এইটা। খড় গুলা বিক্রি করলেও তো কিছু আইতো।”
“খড় না শুকাইলে বিক্রি করা যাইতো না। আর এই দিনে সবারই কমবেশি আছে, তাই চাহিদা কম। দাম কম যাইবো।”
“কিছু ধানই নাহয় বিক্রি করেন। ধান তো বেশি হয়ই বছর শেষে। কয়টা টাকা হইলে, আমার কাছে হাজার দুয়েক জমা আছে। আর মাইয়ার কানের রিং জোড়া ভাইঙ্গা একটা আংটি বানায় দেই। কচি হাতখান খালি থাকবো, কেমন দেখা যায় না? আজমাইনরেও তো পোশাক দেওয়া দরকার।”
“দেখি।”
“হু, তাড়াতাড়ি দেখেন। সময় কম। আর বাকি পাওনা যা আছে, তাগাদা দিয়া তুইলা নিয়েন। খরচ করবেন না বইলা একেবারে হাত গুটাইয়া বইসা থাইকেন না। বিয়ার পর দাওয়াত দিয়া একবেলা খাওয়াইবেন তো। নাকি এইটুকুও করতেন না?”
“তা তো করা লাগবোই। দেখি।”
ফজরের নামাজ আদায় করে প্রায়ই কুরআন পড়তে বসে রোজা। ঘরের দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায় এই গুনগুন শুনেন আহমদ আলী৷ শ্রব্য মনযোগ দিয়ে রাখেন ওদিকে। বাড়িতে আহমদ আলী ব্যতীত এই একটা মেয়েকেই নিয়মিত কুরআন পড়তে দেখেন। বাকিরাও পারে পড়তে, তবে তাদের কাজের তাড়ায় পড়া হয় না সেভাবে। মৌসুমীটা মাঝে মাঝে পড়ে। নিয়মিত নয়। মনযোগে শুনতে শুনতে একটা পর্যায়ে তিনি ভাবছেন, পরবর্তী শুক্রবার আল্লাহর হুকুম হয়ে গেলে নিয়মিত সকালে এই গলাটা আর শুনতে পাওয়া যাবে না। মরিয়ম খুব ভালো একটা রত্ন পেতে যাচ্ছে। প্রথমে অমর্জি করার কারণস্বরূপ পরবর্তীতে ভীষণ আফসোস করবে এইটুকুর জন্য। আফসোস করবে আর বলবে, “ভাগ্যিস! বিয়েটা করিয়ে যত্নময়ী রত্নখনি তুলে এনেছিলাম ঘরে।” সেদিন হয়তো মনে মনে ভীষণ গর্ববোধ করবে। ভীষণ শ্রদ্ধা জাগাবে বাবার প্রতি। হয়তোবা বাবা থাকবে না ততটা সময়ে। ভেবে ভেবে মৃদু হাসেন তিনি।
কুরআন পড়া শেষে ঘরদুয়ার ঝাড়ু দিলো রোজা। হালিমা খাতুন রান্না বসিয়ে দিয়েছেন চুলায়। সেদিকে তার কাজ নেই। রাতের জমা পাতিল গুলো মেজে নিলো বাথরুমে এসে। তারপর আজমাইনের ঘরে এসে কাপড়চোপড় নেড়েচেড়ে ময়লা কাপড় নিয়ে ভিজিয়ে রাখলো ডিটারজেন্ট দিয়ে। বাবার পাঞ্জাবিটাও নিয়ে গেলো। দাদার ব্যবহৃত পোশাক প্রতিদিনই গোসল শেষে ধুয়ে দেয়। জমে থাকে শুধু আজমাইনের গুলো৷ একেক সময় একেকটা পরে, যখন যেটা ইচ্ছে হয়। আবার ময়লাগুলো ধোয়া কাপড়ের সাথেই মিশিয়ে রাখে। তাই খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসতে হয়। সেলিনা বেগম আজ আবহাওয়া ভালো দেখে ধান সিদ্ধ বসিয়েছেন। মৌসুমীকে চুলার কাছে লাকড়ি ঠেলে দেওয়ার জন্য বসিয়ে পাশের বাড়ি থেকে গোবর এনে উঠুন লেপে দিচ্ছেন তিনি। সকাল সকাল লেপে দিলে রোদ পড়তেই ধান মেলে দিতে পারবেন এখানে। মৌসুমী মাকে ক্ষেপাতে অযথাই ওদিকে বসে থেকে থেকে “ওয়াক” শব্দ করে যাচ্ছে একটু পরপর। থু থু ফেলছে, নাকমুখ চেপে ধরে হাসছেও। ফলশ্রুতিতে একটু পরপর সেলিনা বেগম ক্ষেপে ঝাড়ু দেখাচ্ছে তাকে। রোজা বারান্দা দিয়ে আসাযাওয়া করতে করতে হাসছে তাদের কাণ্ড দেখে। এরইমধ্যে সিয়াম ছুটে এলো। শুধু এলোই না, উঠুনের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে গেলো আজমাইনের ঘরে। এদিকে আজমাইন ঘুমায়। ঘরে এসে চেচিয়ে যাচ্ছে,
“ওই, ভাই! ওই, ভাই! জলদি ওঠো। নদীতে মাছ মাইর পড়ছে। আব্বায় জাল নিয়া যাইতে কইছে। আমি গেলাম।”
চেঁচানোর কারণে আজমাইন বিরক্ত বোধ করলেও বিছানা ছাড়লো সাথে সাথেই। মুখও ধোয়া নেই, মাছ ধরতে প্রস্তুত সে। সিয়াম আবার বাইরে বেরিয়ে উঠুনের মাঝখান দিয়ে তাদের ঘরে দৌড় দিলো। মাত্রই এদিকটা লেপেছে সেলিনা। কাঁচা গোবরে পিছলে পড়ে সে চিৎপটাং! মৌসুমী হাসতে হাসতে বেহুশ আর সেলিনা বকতে বকতে। হালিমা খাতুন দৌড়ে বারান্দায় এলেন রান্নাঘর থেকে,
“আরে, ধর! ধর! কেমন আছাড়টা খাইছে, দেখছোসনি।”
পাগলের নেই মাথাব্যথা। সিয়ামের ওদিকে হুশ নেই। কারো ধরার অপেক্ষায়ও বসে নেই। এই গোবর মাখানো পায়েই ঘরে গিয়ে জাল আর পাতিল নিয়ে বেরিয়ে এলো। হালিমা খাতুন জিজ্ঞেস করলো,
“কই যাস এমন ছোটাছুটি কইরা?”
“মাছ মাইর পরছে, বড়মা। আব্বা কইছে জাল নিয়া যাইতে।”
এদিকে আজমাইনও বেরিয়ে যাচ্ছে জাল নিয়ে।
“মা, একটা পাতিল দেও তো।”
“ধান দেওয়া লাগবো রোদে। এখন মাছ ধরতে হইবো না।”
“ধুরো, দেও।”
সে নিজেই রান্নাঘর থেকে পাতিল নিয়ে চলে গেছে। মন মানছে না মৌসুমীর। দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে নদীর পাড়।
“মা, এইখানে বসো। আমি একটু দেইখা আসি।”
“এইখান থেইকা উঠবি মাইয়া, ঠ্যাং ভাইঙ্গা ফালামু। বাড়ির বাইরে একটা পা-ও রাখবি না কইলাম।”
মায়ের উপর অসন্তুষ্ট হলো মৌসুমী। ছটফটে মন নিয়ে চুপটি করে বসে রইলো। কিন্তু আর কতক্ষণ? সেলিনা বেগম কাজ শেষে ধানের কাছে এসে বসতেই সে দৌড়। ভাটার টানে পানি নেমে গেছে তীরের। মাছেরা উজিয়ে ওঠার জো ধরেছে। নদীর উপর শিকারী চোখে উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য চিল। সুযোগ পেলেই যেন থাবা মেরে যাচ্ছে একের পর এক। জলের উপরিভাগে তুলে দিচ্ছে থমথমে ঢেউ। পাড় ঘেঁষে ভীড় জমিয়েছে এলাকার লোকজন। কেউ নেমে গেছে কোমড় কিংবা হাঁটুজল পানিতে। কেউবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের। মৌসুমীও ছমছমে পায়ে ছুটে এসে যোগ দিয়েছে লোকেদের ভীড়ে। নারীপুরুষ সবাই আছে তবে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। বাবা ভাইদের খুঁজে সে ওপাশে পাড়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“আব্বা, মাছ পাইছো?”
মোয়াজ্জেম আলী ফিরে তাকিয়ে বললেন,
“তুই আইছোস ক্যা আবার? ওই যে, শার্টটা রাখছি ওই জায়গায়। নিয়া বাড়ি যা।”
“যাই। একটু দেইখা যাই।”
পরপরই কাদা ছুড়ে মারলো আজমাইন।
“কি দেখবি? মাছের রূপ জ্বালাইছে? বাড়ি যা।”
“এহ! তুমি এমন করো ক্যা?”
“আবার কথা কস! দৌড় দে! বেডাগো মধ্যে তুই কি করস!”
আবারও কাদা মারলো। সেভাবে পুরোটা লাগেনি শরীরে, তবে কাদা ছিটে এসেছে প্রতিবারই। সে কান্না ভঙ্গিতে বললো,
“আব্বা, কিছু কও তো ভাইয়ারে। ওইযে, বেডিরাও তো আছে।”
মোয়াজ্জেম কিছুই বললেন না। জাল ফেলায় ব্যস্ত। আজমাইন আবারও হাতে কাদা তুলে বললো,
“ওইগুলাও বেডা। বেডা দেইখাই আইছে। মাছ ধরতেও নেমে পড়ছে। তোর মা আইছে? আমার মা আইছে? তুই আইছোস ক্যা?”
পানিতে থেকে হাতের কাদা আরও জোরে নিক্ষেপ করতেই মৌসুমী পিছিয়ে গেলো। কান্না করতে ইচ্ছে করছে তার। এই বেয়াদব তাকে মাছ দেখতে দিবে না মোটেও। বাবার শার্ট তুলে নিয়ে চলে যেতে লাগলো সে। একটু যেতেই মাথায় দুষ্টুমি চাপলো। বেডি হওয়াতে যখন ভীড়ে দাঁড়িয়ে মাছ দেখা নিষেধ, হাতে শার্ট রেখে বেডা সাজতে আর কঠিন কাজ কি? বাবার শার্ট পরে নিয়ে সে অন্যপাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দেখে চোখ জুড়ানোর জন্য। এইবার খুব একটা খেয়াল না করলে বুঝার সম্ভাবনা কম।

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
আমজাদ আলীও গিয়েছিলেন নদীর পাড়। পানিতে নামেননি যদিও। ছেলে জাল নিয়ে তীরে উঠলে জাল থেকে মাছ ছাড়িয়েছেন। জেঠুকে দেখে মৌসুমী আর সেখানে নেই। শ্বশুর মশাই বলে কথা। যদি দেখে পুত্রবধূ শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে, কি লজ্জাটাই না পেতে হবে তাকে! সে শার্ট খুলে নিতে নিতে বাড়ির দিকে দৌড়। এমনিতেই বাড়ি থেকে দূরে থাকে বলে জেঠুকে একটু একটু লজ্জা পায়। বহুদিন পর বাড়ি এলে প্রথম দুতিনদিন তো সামনেই যেতে চায় না। পরে আবার ধীরে ধীরে লজ্জা হ্রাস পায়, কথাবার্তা ও দুষ্টুমি স্বাভাবিক হয়। বেলা গড়ালে নদীর জল ঘোলা হলে মাছের যোগান কমে গেলো। সকল জেলে জাল নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। মোটামুটি অনেক মাছ ই ধরেছে তারা। পাতিল প্রায় ভরো ভরো। সিয়ামকে দিয়ে কিছু মাছ মরিয়মের কাছে পাঠিয়ে দিলো হালিমা খাতুন। মোয়াজ্জেম আলীও দিয়েছেন কিছু। নদী থেকে নিজেদের ধরা মাছ সবাই-ই একটু শখ জাগিয়ে খায়। ছেলে মাঝে মাঝে ধরে বলে তারা তো প্রায়ই খায়। মরিয়মের ধরার লোক নেই বলে তেমন শখ করে খাওয়ার সুযোগ তার হয় না সচরাচর। তবে বেশি মাছ ধরতে পারলে ভাইয়ের বাড়ি থেকে পাঠানো হয়। এমনিতে নদী হোক আর সমুদ্রের হোক, সব মাছ কিনেই খায় বাজার থেকে। মরিয়ম মাছ পেয়ে খুশিই হয়েছে। আঁটি বেঁধে দুই ভাইয়ের জন্যই কিছু পুইশাক আর বড় সাইজের দুইটা চাল কুমড়া দিয়ে দিলেন নিজের ফলনের। ভাইপোকে নাস্তাও করালেন পরটা আর ডিম ভাজি দিয়ে। এমনিতে তো ছেলেপুলেরা আসেই না। যা-ই কারণবশত হুটহাট হাজির হয়, খেলাধুলার তাড়ায় ছুটে চলে যেতে চায়। একদম থাকতে চায় না বেশিক্ষণ। বেড়াতেও যায় না। যাবেই কি করে, ফুপির বাড়িতে তো তাদের সমবয়সী কেউ নেই। খেলার সাথী না পেলে কোথাও তাদের ভালো সময় কাটে না।
মাছ ধরার কারণে রোদে ধান মেলতে একটু দেরিই হলো তাদের। তারপর গল্পযোগে নিশ্চিন্তে ধানের পাশে গাছের ছায়ায় বসে বসে মাছ কাটতে লাগলো দুই জা। বাচ্চাদেরকে বাইরের দিকটায় খেয়াল রাখার জন্য পাঠালেন। পরদিন থেকে পরীক্ষা শুরু হলো রোজার। পরীক্ষা দিয়ে দুপুরে বাড়ি ফিরে ধান দেখতে এসে বসেছে বাড়ির বাইরে ধান শুকানোর সেই উঁচু জমিতে। এটাকেও তাদের আরেক বাড়িই বলা যায়। ফাঁকা বাড়ি। গাছের ছায়ায় শিকড়ে বসে বসে পরবর্তী পরীক্ষার কথাই ভাবছিলো। মনে মনে ঠিক করছিলো কাজ চাপিয়ে পড়ার সময়টা। এমনি একটা লোক এলো এখানে। লোকটা এলাকারই, পরিচিত একজন। দূর সম্পর্কের চাচা হয়। নিকটাত্মীয় না হলেও চেনাজানা আছে। পেশায় পোস্ট অফিসে কর্মরত আছেন। লোকটা এসেই বললেন,
“কি গো, মা। ভালোই আছো?”
“আরে, জাবেদ কাকা। আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
“আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোমার দাদার শরীরটা ভালোই না?”
“এই, আছে। ভালোমন্দ মিলেই। একটু অসুস্থ তো দাদাজান। বাসায় যান, দেখা করে আসুন।”
“গেছিলাম। দেখি নাই। তোমারেই দরকার ছিলো। ভাবি কইলো তুমি এইখানে। একটা চিঠি আইছে তোমার। একটা সাইন করো দেখি।”
তার আবার কিসের চিঠি? এক সময় বিদেশ থেকে বাবা পাঠাতো। এখন তো বাবা বাড়িতেই। আর দাদাকে ফোন কিনে দেওয়ার পর চিঠি দেওয়ার বিপরীতে বাবার সাথে সেই ফোনেই কথা হতো। একটু চিন্তিত হয়েই খাতায় সাইন করলো রোজা। ওদিকে ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে দিলেন জাবেদ কাকা। খাম হাতে নিয়ে কপালের চিন্তিত ভাবটা সরে গেছে রোজার। জাবেদ কাকা বললেন,
“আচ্ছা, যাই তাইলে। আরেকদিন আইসা দেখমু নে আহমদ চাচারে। চিঠিপত্র পাঠান লাগলে দিয়া আইসো। তোমার বাবার চিঠি ও তো দিতে যাও না অনেক দিন হয়।”
“আব্বা বিদেশ থাকলে এখন ফোনেই কথা হয় কাকা। তাই যাওয়া হয় না তেমন।”
“হো, বলছে ওইদিন তোমার আব্বা। আচ্ছা, যাই।”
চলে গেলেন তিনি। খামের উপরে মাহতাবের নামটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে মৃদু হাসলো রোজা। খুশি হয়েছে ভীষণ। কিন্তু কি লিখেছে, সেটা জানতে হবে এখন। হঠাৎ চিঠি কেন? রোজা খাম খুলে চিঠি পড়লো।

প্রিয়,
ঢাকা এসেই আগে একটা চিঠি লিখলাম। বিয়ে পাকাপাকি হওয়ার পরই করলাম শুরুটা। পরবর্তী সপ্তাহ হতে নিয়ম মাফিক সপ্তাহে এক টুকরো চিঠি পাঠাবো বউয়ের কাছে। আজকেরটা প্রস্তাব হয়ে গেলো তোমার হাতে। ডাকঘরে শেষ চিঠি পাঠিয়েছিলাম সেই কবে। মাকে ফোন কিনে দেওয়ার আগে। মায়ের চিঠি পড়তে সমস্যা হয় বিধায় এই যন্ত্রটা হাতে তুলে নিতে হয়েছে। নয়তো চিঠি লেখায় আমার অন্যরকম একটা নেশা কাজ করে। ব্যস্ততার মাঝেও আমি খুব উপভোগ করি ব্যাপারটা। পরবর্তী সময় থেকে তোমার জন্য নিয়মিত যাবো ডাকঘরে। তোমারও কি ফোন চাই? হাতে হাতে ফোন উঠে গেলে আমার উপভোগ্য বিষয়টা হারিয়ে যাবে। যে হারে গ্রামের মানুষজনের হাতে একে একে ফোন উঠছে, মনে হয় খুব শীঘ্রই ডাকঘর শূন্য হয়ে যাবে। একটু ভালো আয় হলেই ফোন কেনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সবাই। তোমার মনে আছে, মামা যখন মাস দুতিন পরপর চিঠি পাঠাতো, আমরা কত অপেক্ষা করতাম সবাই? কতবার পোস্ট অফিসে ডু মেরে আসতাম চিঠির সন্ধানে? সবাই একত্রিত হয়ে বসতো চিঠিতে লেখা কথা জানার জন্য। নানাজানের চিঠিটা আমাকে দিয়ে পড়াতেন জোরে জোরে? আমার মনে গেঁথে আছে দিনগুলো। আমি খুব মিস করি সেই সময়গুলোকে। যখন আমার শহরে চাকরি হলো, খুব আনন্দিত হয়ে উঠেছিলাম চিঠি লেখার ব্যাপারে। মাকে চিঠি লিখতাম, নানাজানকে লিখতাম। নানাজান মাঝে মাঝে তোমাকে দিয়েও পড়াতো সেই চিঠি। তাই না? বলেছেন আমাকে। এখন মামাও চিঠি দেয় না, আমারও লেখা হয় না। সবাই শুধু প্রত্যক্ষ যোগাযোগ চাই। আমি আবার লিখতে শুরু করেছি। জীবন যতই উন্নত হোক, তবুও এর শেষ না হোক। ডাকঘর নাহয় তোমার আমার জন্যই বেঁচে থাকুক। যতদিন আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে আছে আমাদের হাত। প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রয়োজন পড়লে নানাজানের ফোনে কল করবো, কথা বলো। তোমার ফোন লাগলে জানিয়ো। ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। কিন্তু চিঠি লিখবো রোজ সপ্তাহে। ভালো থেকো আমাদের জন্য।
আহমদ আলীর হবু নাতজামাই,
মাহতাব

ওষ্ঠ জোড়া মিটিমিটি হাসছে রোজার। কয়েকবার চিঠিতে চোখ বুলিয়ে কাগজটা ভাজ করে রাখলো খামে। কল্পনায় একটু আলাপসালাপও করলো মনে মনে। ঘরে ফিরে একটা বক্সে জমা রাখলো চিঠি। মাহতাব যখন তার জন্য নিয়মিতই ডাকঘরে যাবে, এটা তার নতুন চিঠিবক্স হলো তবে আজ থেকে। বাবা যখন চিঠি পাঠাতো, তখন আরেকটা বক্স নিয়েছিলো। বাবার সব চিঠি জমা আছে ওই বক্সে। এই বক্সটা আলাদা মানুষের জন্য আলাদা হয়েই থাকুক।
স্কুল থেকে ফেরার পথে আজমাইনকে কাঁধে ক্রিকেট ব্যাট ফেলে আইসক্রিম খেতে খেতে বাড়ির দিকে যেতে দেখলো মৌসুমী। সে একটু পেছনেই ছিলো। দৌড়ে এসে সমান সমান হলো।
“কি খাও, ভাই? দাও।”
“বরফ খাই। খাবি?”
“হো।”
“মা বোধহয় ফ্রিজ পরিষ্কার করবো, শুনলাম সকালে। মাছ মাংস বের করলে দেখবি এত্তো বরফ জমছে। খাইস, যা।”
মৌসুমী ভেঙচি কাটলো। পরক্ষণে বললো,
“তোমার কি এখনো এগুলা খাওয়ার বয়স রইছে? শুক্রবার বিয়া করবা। দুইদিন পরে বাচ্চাকাচ্চা আইসা হাত পাতবো, আব্বা টাকা দাও। আইসক্রিম খামু।”
আজমাইন আইসক্রিমের কাঠি মুখ থেকে নামিয়ে যেন বিস্ময়ের সাথে তার দিকে তাকালো ধীর গতিতে। বলে কি সে!
“শুক্রবার আমার বিয়া মানে? শুক্রবার আপুর বিয়া।”
মৌসুমী হে হে করে হেসে ঠাট্টা করলো,
“কোন দুনিয়ায় আছো তুমি? খালি কি আপুর বিয়া? তোমার সাথে আমারও বিয়া। দাদাজানের এক কথা। তোমার আউল বাউলের দিন শেষ।”
এবার আজমাইন হে হে করে পাল্টা হাসলো। আবারও আইসক্রিম খাওয়ার গতি স্বাভাবিক করে বললো,
“তোর আর আমার বিয়া? তুই কি স্কুল থেকে স্বপ্ন দেইখা আইছোস নাকি? তোরে বিয়া করবো কেডা? দূরে ভাগ!”
তুচ্ছতা প্রকাশে ক্ষিপ্ত হলো মৌসুমী। তাই বললো,
“তুমি করবা। তুমি, তুমি, তুমি। নইলে তোমার একদিন, আমার একদিন আর দাদাজানের একদিন।”
“তুই দাদাজানরেই বিয়া করগা।”
“ওইটা দাদাজানই ঠিক করবো। বেদ্দপ পোলা। সব কথায় হাসি তামাশা।”
হনহনিয়ে হেটে আগে চলে গেলো মৌসুমী। আজমাইন বাড়ি ফিরলে তাকে দেখে বাথরুমে কাপড়চোপড় ধুতে ধুতে হালিমা খাতুন বকবক করতে লাগলেন,
“সারাটাদিন রোদের মধ্যে গিয়ে খেলে। চেহারাটার যে কি অবস্থা করতাছে, কোনো হাল নাই।”
আজমাইন ব্যাট রেখে এসে বললো,
“সরো, সরো। গোসল করমু। আপুর বিয়া নাকি এই শুক্রবারে?”
“হো, ক্যা?”
“পরের শুক্রবারে দাও। নইলে আমি কাজেটাজে থাকতে পারতাম না। আমার ফাইনাল খেলা আছে শুক্রবার।”
“খেলামেলা চিরতরে বাদ।”
“হো, তুমি কইলেই হইবো।”
“হো, আমি কইলেই হইবো। এখনো খেলার বয়স রয় নাই। বড় হইছোস। জীবনের মানে বুঝ। পরীক্ষাটা দিয়াই কোনো কাজে লাগবি। শুক্রবার খালি আপুর বিয়া না। মৌসুমীর আর তোরও বিয়া।”
আজমাইন যেন এবার তব্দা খেয়ে বসলো সেকেন্ডের জন্য! দাদাজান তবে সত্যিই কাজ সেরে বসেছেন? সে তো ভাবছিলো মৌসুমী এমনিতেই বকবক করছে। তব্দা থেকে ফিরে এসে সে বললো,
“আমি বিয়া টিয়া করতাম না। না কইরা দিয়ো দাদাজানরে।”
“করবি আরও ভালো করে করবি। বালতিতে পানি দে।”
আজমাইন কল চাপতে চাপতে বললো,
“শুধু বালতি ক্যা, ড্রামে পানি নাও। সমস্যা নাই। বিয়া করতাম না, না-ই। আপুর বিয়া পরের সপ্তাহে দিলে দাও, না দিলে আমিও নাই কাজেকর্মে। আমার খেলা ফাইনাল। বহু কষ্টে ফাইনাল পর্যন্ত উঠছি।”
“কোনটা যে ফাইনাল আর কোনটা ফেইল, দেখমু নে। তোর বাপে খালি তোরে দেখতাছে। না আছোস কাজেকর্মে, না আছোস ভালো পড়াশোনায়। যেদিন ধরবো, ঠ্যাং ভাইঙ্গা বসায় রাখবো।”
“ধুর, ধুর! তাড়াতাড়ি যাও, গোসল করমু।”
“ধান তুলবো কেডা?”
“পরে তুলমু নে। আগে গোসল করি। গরম লাগতাছে।”
হালিমা খাতুন বের হলে ঝপাঝপ পানি ঢালতে লাগলো সে। এই ছেলে সব ব্যাপারেই একটু বাঁকা স্বভাবের। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর অধিকাংশই গুরুত্বহীন হয় তার কাছে। অথচ এর কারণস্বরূপ কোনো বিশ্লেষণ দিতে পারবে না। সে নিজেই জানে না, দিবে কোত্থেকে? গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভালো মতামত দেওয়ার মানসিকতা সে রাখেই না। তাই তাকে কোনো ব্যাপারে বিশেষ জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনও বোধ হয় না পরিবারের সদস্যদের। তার আচরণ তাদের মুখুস্ত। কোন কথার পর কেমন জবাব আসবে, তা ভালোই জানা। জীবন নিয়ে পাকাপোক্ত কোনো ভাবনা নেই তার। এই ছেলেটাকে নিয়ে যত চিন্তা বাবামায়ের।