“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩০
(নূর নাফিসা)
.
.
আজমাইন শহরে গেছে দেড় মাস হয়। এই দিনগুলোতে একটাবারও বাড়ির কারো সাথে কথা বলেনি। এমনিতে মাহতাবের মাধ্যমে খোঁজ রাখা হচ্ছে হালিমা খাতুনের। কিন্তু মাহতাব তার হাতে ফোন ধরাতে পারে না। বাড়ি থেকে কল এসেছে জেনেই সরে যায় মাহতাব থেকে। এমনিতে কাজকর্ম ভালোই করছে। দুষ্টুমি ফাজলামোর সময় নেই। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মাহতাবের সাথেই শহরের এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করছে। কখনোবা একা একাই যাচ্ছে, আবার নীড়ে ফিরে আসছে স্বল্প সময়ের মধ্যে। মায়ের মনটা বড্ড ভার হয়ে থাকে ছেলের গলা শুনে না বলে। মাঝে মাঝে মন অশান্ত হয়ে বলতে ইচ্ছে করে, লাগবে না ছেলের পরিশ্রম করা। চলে আসুক বাড়িতে। কিন্তু আবার ভয় এসে ঘিরে ধরে। সেভাবে চলতে থাকলে ছেলে অমানুষ হয়ে উঠবে। অপকর্মে লিপ্ত হবে, যা কখনোই কাম্য নয় বাবামায়ের কাছে। নাহয় দূরে থাকার কষ্টটাই বুকে পুষে বাঁচুক!
শীতের একদমই শেষ পথে। বসন্ত ছুঁইছুঁই হয়ে আছে প্রকৃতি। শীতের রিক্ততাকে পূর্ণতা দিতে একদমই প্রস্তুত বসন্ত। এখনই গাছের ডালে সকাল বিকাল কোকিল কণ্ঠ বেজে চলে। আহমদ আলীর শরীরটাও যেন আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগের তুলনায় বড্ড বেশিই কাঁপে শরীরটা। আগে বাড়ির উঠুনটায় একা একা হাঁটতে পারতো। এখন লাঠি ভর করে বিছানা ছেড়ে চৌকাঠ পর্যন্ত আসতেই বড্ড কষ্ট হয়ে যায়। পাড়ার ডাক্তার মাঝে মাঝে এসে দেখে যায় তাকে। ওষুধপত্র ঠিকঠাকই চলছে সব। তবুও মনটা ভীষণ ভালো কাটে সন্তানসন্ততির কথা ভাবলে। ভালো লাগে নিজের সোনামাখা সম্পত্তি ও আবাদের কথা ভাবলে। আবার কষ্ট হয় এই ভিটামাটি ছেড়ে যেতে হবে ভাবলে! মৌসুমীর পরীক্ষা শেষ হয়ে রোজার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। ফুপুর বাড়ি থেকেই পরীক্ষা দিচ্ছে রোজা। মাঝে মাঝে এখানে এসে ঘুরে যাচ্ছে। মৌসুমীর দিনকাল বড্ড অবসরেই যাচ্ছে। মায়ের এবং শ্বাশুড়ির কাজকর্মে নিজেকে মাতিয়ে রাখছে। বাড়ির বাইরে টুকটাক টইটইও করছে। একা ঘরে এলে আজমাইনকে বড্ড মনে করছে। প্রেমিক পুরুষের দূরত্ব তার মনে পোষা প্রেমকে আরও উতলা করছে। অপেক্ষা বাড়িয়ে তুলছে তাকে দেখার। রোজার কাছে আজই শুনলো, আগামী পরশু শুক্রবার মাহতাব গ্রামে আসছে সাপ্তাহিক ছুটিতে। আজমাইনকেও সাথে নিয়ে আসছে। খবরটা শুনতেই যেন তার মন ধেইধেই করে নাচতে শুরু করেছে। ওদিকে ক্ষেতের সরিষা পেকে গেছে। দুদিন যাবত তারাই অল্পস্বল্প করে তুলে নিয়ে আসছে বাড়িতে। সিয়াম ছেলেটাও আজমাইনের মতো বড্ড কাজের। বাঁদড়ামো করলেও সামর্থ্য অনুযায়ী কাজের হাত ভালো। আজমাইন আসবে শুনে বিকেলে তিড়িংতিড়িং করেই মমোর হাত ধরে সরিষা ক্ষেতে গেলো মৌসুমী। বাবা, ভাই সরিষা তুলছে। মা, বড় মা-ও আসছে শীঘ্রই। মুঠো মুঠো সরিষা গাছ টেনে তুলতে চকচকে সোনালী আলো গায়ে মেখে বসে পড়লো মৌসুমীও। ভারি আনন্দে কাজের গতিও যেন বেড়েছে খুব বেশি। শরীরের পোকামাকড়ের স্পর্শেও তার আনন্দ কাটেনি। মনযোগ এক দিকেই। আজমাইন আসবে, আসবেই। গায়ের পিলপিলটা হালকা শিহরিত করলে অতি সাধারণভাবে হাত দিয়ে কেচে সরিয়ে দিয়েছে ঠিক, কিন্তু মাটিতে বিছু পড়তে দেখে আর ঠিক নেই সে! চিৎকার করে সরে এসেছে। বাহুতে এতোক্ষণ বিছু পিলপিল করছিলো, খেয়ালই করেনি! এখন দেখার পর যেন পুরো শরীরেই বিছুর পিলপিল অনুভব হচ্ছে! মোয়াজ্জেম আলী বসা থেকে উঠে গেছে মেয়ের চিৎকারে! পরবর্তীতে বিছুর ব্যাপার বুঝতে পেরে আবার বসে গেছেন। ছোটখাটো ব্যাপারে মেয়ের ভয় পাওয়া ভারি দুর্বলতা হয়ে ঠেকলো তার কাছে। ওদিকে ভাইবোন হাসতে হাসতে খালাস! সিয়াম আরেকটা বিছু হাতে নিয়ে তার উপর ফেলার ভয় দেখাচ্ছে। মৌসুমী ছুটে গিয়ে অন্য ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে তাকে বকা দিচ্ছে। মোয়াজ্জেম আলীও সিয়ামকে ধমকাচ্ছেন। এমনি হালিমা খাতুনের সাথে সেলিনা বেগম এলেন। মেয়েকে ফুসতে দেখে বললেন,
“কি হইছে তোর? বলকাইতাছোস ক্যা?”
“তোমার পোলা আমারে বিছু নিয়া দৌড়ানি দিছে!”
“কষাইয়া একটা কানের নিচে দিলি না! উল্টা দৌড় দেস ক্যা? বিছা কি তোরে গিলা ফেলছে?”
“ক্যা, দিবোই ক্যা তোমার পোলা? এমনি একটা বিছু হাতে উঠছে! সারাটা শরীর আমার কিলবিল করতাছে মনে হইতাছে। আমার কেমন জানি লাগতাছে। কি করি আমি এখন!”
“যা, বাড়িতে যা। তোর কাজ করা লাগবো না। এতো বড় হইছে, এখনো একসাথে হইলেই খালি ঠোকরাঠুকরি লাগে। আক্কলজ্ঞান কিছু হয় নাই। আবার দাঁড়ায় রইছে! বাড়িত যা!”
“এহ!”
হালিমা খাতুন বললেন,
“বিছা উঠছে, কিছু হয় নাই। কাপড়চোপড় ঝাড়া দে, থাকলে পড়ে যাইবো। বাড়িতে চইলা যা, তোর দাদাজান একা ঘরে।”
“হু, যাইতাছি।”
বিছু উঠেছে হাতে, অথচ মৌসুমী সমস্ত শরীরের এদিক সেদিকই চুলকাতে চুলকাতে বাড়িতে চলে গেলো। তার মনে হচ্ছে সমস্ত শরীরেই বিছুদের দল পেকেছে। অথচ গাছে কিংবা মাটিতে দেখলে ততটাও ভয় হয় না বিছুকে। শরীরে স্পর্শ পেলেই অশান্তি! বাড়ি এসে আবার গোসল করতে গেলো সে। দিনের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে নিম্ন হয়ে পড়ায় ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। তুলনামূলক অল্প শীতেই কাঁপতে কাঁপতে সরিষার তেল মেখে যাচ্ছে শরীরে। দাদাজানের কাছে কতক্ষণ গল্প করে এলো, মুরগিগুলোকে খায়িয়ে খোঁয়াড়ে দিলো। আজমাইনের কবুতর গুলোরও ভালো যত্ন নিচ্ছে সকাল বিকাল খাবার দিয়ে। দুচারদিন পরপর বারান্দার চালে উঠে ডিম সংগ্রহ করে আনছে। আর ওদিকে মা কিংবা বড় মা তাকে উপরে উঠতে দেখলেই বকাবকি শুরু করে। কে শুনে কার কথা? তার ভালো লাগে গাছে চড়তে, সে চড়ে। এমনিতে কখনো কখনো হালিমা খাতুন সিয়ামকে তুলে দেয় ডিম নিয়ে আসার জন্য।
মাগরিবের পরপর তারা সরিষার আঁটি নিয়ে বাড়ি এলে মৌসুমীকে বমি করতে দেখলো বারান্দার খুঁটি ধরে বসে বসে। হালিমা খাতুন হাতের আঁটি ফেলে এগিয়ে এলেন দ্রুত।
“কি হইলো তোর? কি হইলো?”
বলতে বলতে মাথা চেপে ধরলেন। সিয়াম হাসতে হাসতে উপহাস করলো,
“বিছা খাইয়া ফালাইছে মনে হয়, বড় মা।”
সেলিনা বেগম তৎক্ষনাৎ লাঠি হাতে দিলেন তাকে দৌড়ানি। মৌসুমীও রেগেমেগে তাকালো। বমির বেগ কমে গেলে বড় মার জবাব দিলো,
“বিছু দেখে তখন থেকেই গা গুলাচ্ছিলো, বড় মা।”
“হায়রে পোলাপান! একটা পোকা দেখে এই কীর্তি করলে হয়? কামড় দিছে তোরে? অযথা এমন ভয় পাইলি ক্যা? মমো তো পাড়া দিয়াই চ্যাগব্যাগা বানায় ফালাইতে পারে। আর তুই ভয় পাস!”
“আমিও তো পাড়া দিয়া পিষতে পারি। তারপরও কেমন কেমন জানি লাগতাছে!”
“ওঠ! বিছা নিয়া বেশি ভাবতাছোস দেখেই এমন লাগতাছে। চোখেমুখে পানি দে। এই সন্ধ্যা বেলা আবার গোসল করছোস, না? সর্দিডা খালি লাগাইস। পোলাপান ডেকেডুকে অসুখ আনে! চুলগুলা মুছাও হয় নাই।”
মৌসুমী চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে এলো। হালিমা খাতুন হাতমুখ ধুয়ে রান্না বসানোর আগে তাকে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে দিলেন পেট ঠান্ডা হওয়ার জন্য। বমি করে যেটুকু অস্থির হয়ে পড়েছিলো, শরবত খেয়ে বেশ ভালো অনুভব করলো। হালিমা খাতুনের পাশে বসে সবজি কেটে দিয়ে ওই ঘরে গিয়ে মমোকে একটু পড়াশোনা করিয়ে এলো। পরক্ষণে আবারও বিলীন হলো আজমাইনের ফেরার আনন্দে। প্রতিক্ষার প্রহর যেন আরও দীর্ঘ হয়ে ঠেকে। পরবর্তী দিনটা যেন শেষ হতেই চাইছিলো না। শুক্রবার জুমার আগে আগেই শহরের ছেলে দুটো গ্রামে পা দিয়েছে। আজমাইন আসতেই চায়নি। তার জেদ উঠেছে কাজের প্রতি। কাজের জন্য পাঠিয়েছে, কাজই করবে শুধু! কিন্তু মাহতাব জোর করেই নিয়ে এসেছে। রোজা এবং মরিয়ম তাকে দেখে দুপুরের খাবার খায়িয়ে ছাড়তে চেয়েছিলো। এইটুকু অপেক্ষা সে করেনি। রাস্তা থেকেই দেখা করে চলে এসেছে। তাতে রোজার ততটাও মনখারাপ হয়নি। বুঝতে পেরেছে ভাইয়ের রাগটা কোথায়। মাহতাব তো এসেই বলতে শুরু করেছে আজমাইনকে টেনেটুনে নিয়ে এসেছে!
আজমাইন বাড়িতে প্রবেশ করেছে একদম নিরিবিলি কদমে। হাসি কাশি কিছু নেই কণ্ঠে। হালিমা খাতুন ওপাশের উঁচু জমিতে গেছেন গাছ থেকে ঝরা পাতা ঝাড়ু দিয়ে কুড়িয়ে আনতে। মৌসুমী গেছে গোসল করতে। মমো খেলছিলো উঠুনে। তার আজাম ভাইকে দেখে সে দরজা পর্যন্ত দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছিলো কয়েক সেকেন্ড। আজাম ভাই ভালোমন্দ কিছুই বলেনি। পোশাকাদি পাল্টাতে ব্যস্ত হয়েছে। মমো আবার গুটিগুটি পায়ে বারান্দা অতিক্রম করে যাচ্ছিলো আজমাইনদের ঘরের এপাশেই শেষ প্রান্তের দিকে। এমনি মৌসুমী ভেজা কাপড় হাতে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। আজ দাদিজানের লাল শাড়িটা পড়েছে। তার প্রেমিক পুরুষ আসবে, একটু সাজুগুজু না করলে কেমন হয়? মনে ঢের আনন্দ বিরাজ করছে যে! মৌসুমী কাপড়চোপড় রশিতে নেড়ে দেওয়ার সময় মমো তাকে বললো,
“আপু, আজাম ভাই আইছে।”
মৌসুমী থমকে গিয়ে বললো,
“কিহ! কখন?”
“এট্টু পরে।”
“এট্টু পরে না আগে? কই আজাম ভাই? কই আছে এখন?”
“ঘরে আছে।”
“সত্যি!”
মৌসুমী কোনোমতে কাপড়চোপড় লটকে দিয়ে দ্রুত পায়ে গেলো ঘরের দিকে। হ্যাঁ! ঠিকই এসেছে আজাম ভাই। নিরব আগমন ঘটেছে সেই অশান্ত লোকটার। আজমাইন শার্ট খুলে লুঙ্গি কাঁধে নিয়ে গোসলের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলো সবে। মৌসুমী তাকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।
“আ…! তুমি সত্যি আইসা পড়ছো!”
তার চিৎকার শুনে যেন রসকষহীন কাঠখোট্টা চেহারাটা একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো দরজার দিকে। মৌসুমী এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
“কখন আইছো? কার সাথে আইছো? আল্লাহ! আমি সকাল থেকে খালি রাস্তা বরাবর তাকাই কিন্তু মানুষ দেখা যায় না! তুমি আইছো, বড় মা দেখছে? বড় মা-ও খালি বলতাছিলো, তুমি আসো না ক্যা? আসো না ক্যা? আমি এক্ষুনি বড় মাকে ডাকতাছি!”
আবার ছুটে বেরিয়ে গেলো সে। আনন্দের বাতাস যেন তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির বাইরে। দৌড়ে এসে থেমেছে তাদের সেই ধান শুকানোর উপযোগী উঁচু জমিতে। এখন সরিষা গাছ শুকাতে দেওয়া হয়েছে। উঠুনে ছুটতে গেলেও একটু সাবধানে ছুটতে হয়। সরিষা রোদ দেওয়া আছে উঠুনেও। প্রতিবছরই এই সরিষায় পিছলে পড়তে দেখা যায় কাউকে না কাউকে। তার মধ্যে মৌসুমীর পড়ে যাওয়ার ঘটনাই বেশি। চলাফেরা ঠিক নেই, হুটহাট পিছলে পড়ারও ঠিক নেই। এবার মমো পড়েছে শুরুতেই। এদিকে উঁচু জমির ঢালেই ঝড়া পাতা ডালাতে তুলছিলো হালিমা খাতুন। মৌসুমী থেমেই জানালো,
“বড় মা, তোমার ছেলে আসছে। তাড়াতাড়ি আসো।”
“আজমাইন আইসা পড়ছে?”
“হো, হো। তাড়াতাড়ি আসো।”
ঝটপট পাতার ডালা তুলে হালিমা খাতুনও ঘনঘন পা ফেলতে লাগলেন বাড়ির দিকে। মৌসুমীও ছুটে যাচ্ছে। তাকে ছুটতে দেখে তিনি আবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ধীরে যাওয়ার জন্য বলছেন। কে শুনে কার কথা? সে সবসময়ই এমন। ছোটাছুটি চিরকালের অভ্যাস তার। আনন্দিত হলে সেই আনন্দ দমিয়ে রাখার সাধ্য কোনো মানবের নেই।
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩১
(নূর নাফিসা)
.
.
হালিমা খাতুন ফিরে এসে দেখলেন ছেলে গোসলে গেছে। তিনি এক ডালা ঢেলে রেখে আরেক ডালা পাতা তুলে আনতে গেলেন। মৌসুমী ঘরে খুঁজে বেড়াচ্ছে আজমাইন কিছু নিয়ে এসেছে কি না সাথে। কোনো কাপড়চোপড়ের ব্যাগও পাচ্ছে না। খালি হাতেই এসেছে তবে? কিন্তু কেন? অল্প দিনের জন্য এসেছে বলে? নাকি বাসায় কাপড়চোপড় কিছু আছে বলে? যাকগে, সে যে এসেছে এটাই বেশি। কতদিন পর দেখলো এই দুষ্টুরাজার মুখটা। ইশ! চোখেমুখে সেকি রাগ! তবুও সুন্দর দেখায়। তার রাগের উপরও মন প্রেমে পড়ে বারবার। মৌসুমী মাথার চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে নিলো। ঠোঁটে একটু লিপস্টিক লাগালো। চোখের ধারে কাজল টানা দিলো। আলতার কৌটাটা চোখে পড়তেই পায়ে তাকালো সে। বড্ড খালি খালি দেখাচ্ছে পা দুটো। একটু রঙিন করলে দোষ কি? দরজার সামনে বসে গেলো সে আলতা নিয়ে। তুলিতে আলতা মেখে পা রঙিন করে তুলছে বিন্দু বিন্দু ফোঁটায়। এরইমধ্যে আজমাইন বেরিয়ে এলো গোসল সেড়ে। উঠুনে কাপড় মেলে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরে গেলো। দরজা দিয়ে প্রবেশের সময় তাকে জায়গা করে দিতে মৌসুমী সরতে সরতেই সে ভেতরে এগিয়ে গেলো। পায়ের সামনে পড়ায় আলতার কৌটাটা পায়ের ধাক্কায় ফেলে দিলো। চাইলেই কিন্তু একটু সময় নিয়ে দাঁড়াতে পারতো, মৌসুমীকে সবটা গুটিয়ে ঠিকঠাক সরে যাওয়ার সুযোগ দিতে পারতো। এইটুকু অপেক্ষা সে করলো না। আলতাটুকু সব গড়িয়ে গেলো মেঝেতে। আলতা রঙে রঙিন হয়ে গেছে মেঝে। মৌসুমী তড়িঘড়ি করে কৌটাটা তুললেও রক্ষা করতে পারলো না। মুখটা ভীষণ মলিন হয়ে গেলো তার। বিষণ্ণ চোখজোড়া তুলে তাকালো আজমাইনের দিকে। আজমাইন কোনো পরোয়াই করলো না এদিকে। মৌসুমী মলিন কণ্ঠেই বিড়বিড় করলো,
“আমি তো সরাচ্ছিলামই। একটু দাঁড়ালে কি হতো?”
বিড়বিড় শুনে আজমাইন হাতে চিরুনি নিতে নিতে তার দিকে তাকাতেই মলিন চোখদুটো নামিয়ে নিলো মৌসুমী। পুরনো কাপড়ের টুকরো নিয়ে মুছে দিলো মেঝে। আলতার খালি কৌটাটা ছুড়ে ফেলতে হলো উঠুনের কোণে। হালিমা খাতুন পাতার ডালা নিয়ে বাড়ি এসে ছেলের মুখ দেখে চোখ জুড়ালেন। মনে প্রশান্তির ছোঁয়া পেলেন। কেমন আছে জিজ্ঞেস করতেই বিড়বিড় করে জবাব দিয়ে বেরিয়ে গেলো। জুমার নামাজ আদায় করে এলে মৌসুমীকে ভাত দেওয়ার জন্য বললেন হালিমা খাতুন। মৌসুমী প্লেটে ভাত দিলো। আজমাইন খেতেও বসলো চুপচাপ। মৌসুমী জিজ্ঞেস করলো,
“মাহতাব ভাইও আইছে?”
গম্ভীরমুখে আজমাইনের জবাব,
“হুম।”
“কয়দিন থাকবা তুমি?”
“এতো বেশি কথা বলছ ক্যা?”
ধমক এবং চোখ রাঙানোতে চুপ হয়ে গেলো মৌসুমী। বুঝলো তার মন ভালো নেই। বড্ড বিরক্ত হচ্ছে বোধহয়! রাগানোর প্রয়োজন নেই অযথা। সে বরং চুপই থাকুক। রইলোও তা-ই। তারপর আজমাইন ঘুমাতে গেলো ঘরে। সারাদুপুর ঘুমিয়ে সন্ধ্যার আগে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলো। তখন বারান্দায় বসে পাকা তেঁতুলের ভর্তা করে খাচ্ছিলো তারা তিন ভাইবোন। আজমাইনকে দেখে মৌসুমী উৎফুল্লতা নিয়েই জিজ্ঞেস করলো সে খাবে কি না। অনেক মজা হয়েছে। আগে তো দিতে না চাইলেও থাবা মেরে নিয়ে যেতো, মৌসুমীকে কাঁদাতো। এখন উৎফুল্লতার সাথে সেধেও কোনো প্রতিক্রিয়া পেলো না আজমাইনের কাছ থেকে। মৌসুমী তার বদমেজাজের উপর বিরক্ত হয়ে ভেঙচি কাটলো। হাতমুখ ধুয়ে আজমাইন আবার বাইরে হাটাহাটির জন্য বেরিয়ে যাওয়ার সময় হালিমা খাতুন ডেকে জিজ্ঞেস করছিলো রাতে কি খাবে? কোনো পিঠার আয়োজন করবে নাকি? কোনোই জবাব দিলো না ছেলে। মন খারাপ হলো তারও। ভালো রাগ ধরেছে! রাতে বুঝাতে গেলেও সময় হলো না। ফুপুর বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছে। ঘরে এসেই ঘুমানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে গেছে। খানিক বাদে ঘুমাতে এসে মৌসুমী প্রায় অনেকটা সময় বসেছিলো ঘুমন্ত আজমাইনের পাশে। মায়া ঢেলে তাকিয়ে ছিলো প্রেমিক পুরুষের মুখের দিকে। চোখের দৃষ্টি, মনের দৃষ্টি, সবটাই জুড়িয়ে নিচ্ছিলো বসে বসে। তবুও ভরে না মন, মেটেনা দেখার তৃপ্তি। কাজল চোখে অশ্রুরাও একটু অভিমান নিয়ে গড়িয়ে পড়লো। সে সাজলো, আজমাইন দেখলো না। সে অপেক্ষায় বসে রইলো, আজমাইন একবার তাকালো না। কিসের এতো রাগ তার? প্রেম কি সাড়া দেয় না মনে? কি দোষ তার? সকালে সেলিনা বেগম চুপিচুপি মৌসুমীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আজমাইন এমন কইরা রইছে ক্যা? কারো সাথে কথা কয় না। সামনে পড়লে ভালোমন্দ জিগায় না। কিছু জিগাইলে জবাবও দেয় না!”
মৌসুমী ক্ষেপা জবাব দিয়ে এলো,
“তার মুখে আলু পোড়া দিছি মা। এইজন্য শালায় কথা কইবো না।”
“থাপড়াইয়া দাঁত ফালায় দিমু মাইয়া। এগুলা কি কস!”
“কি কইতো আবার? যে যেমন, তারে তেমনই বলমু। ওই শালায় ভালা মানুষ?”
“আবার!”
চোখমুখ কুচকে চলে এসেছে মৌসুমী। দুপুরের পর মাহতাব এলো। বড় মামীকে দেখে সালাম দিলো। জিজ্ঞেস করলো,
“আজমাইন কোথায়, মামী?”
“এদিকে কোথায় যেন গেলো।”
“এখন আবার কোথায় গেলো! ঢাকা যেতে হবে না?”
“আজই চলে যাইবা?”
“হ্যাঁ, এখনই। কাল অফিস আছে না? আজমাইনেরও তো কাজে যেতে হবে কাল সকাল সকাল। কেন, চলে যাওয়ার কথা আজমাইন কিছু বলেনি?”
“কই, বললো না তো! কিছু জিগাইলে জবাব দেয় কোনো? যা শুরু করছে পোলা! দেখো খালি কারবার! আমি আগে জানলে কি কিছু রান্নাবান্না কইরা দিতাম না? আমি ভাবছি দুচারদিন থাকবো।”
“না, এতো সময় আছে নাকি। সাপ্তাহিক দুদিন ছুটি পেয়ে ঘুরে গেলাম। ভাবলাম নানাজানকেও একটু দেখে যাই যাওয়ার আগে।”
“যাও, ঘরে। আমি খাবার পাঠাই।”
“না, না। আমি খেয়ে এসেছি। এখন কিছুই না। রওনা দিতে হবে।”
হালকা নাস্তারই ব্যবস্থা করলো হালিমা খাতুন। আজমাইন তখনই এসে পড়েছিলো। হালিমা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে, আজ নাকি চলে যাবি। আগে বললি না?”
কোনোই জবাব দিলো না। হালিমা খাতুনের কষ্টে রাগ হলেও এখন রওনা হবে তাই কিছুই বললেন না। সাথে থেকে মাহতাব বিদায় নিলেও এই গোমড়ামুখো একদম বিদায় নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না কারো কাছে। চলে গেলো এভাবেই, যেমন এসেছিলো নিরবে ঠিক তেমনই নিরবতা পুষে মনে!
মৌসুমীর বড্ড কান্না আসছিলো সময়টাতে। লোকটা এলো, অতি অল্প সময়ে আবার চলেও গেলো। একটা কথাও বললো না তার সাথে। অথচ কত অপেক্ষায় বসেছিলো সে, কত আনন্দ জাগিয়েছিলো তার আগমনে। সবটাই কয়লা হয়ে জ্বলতে লাগলো ভেতরে ভেতরে। সে বাড়ির সীমানা অতিক্রম করলেই চোখদুটো গাল ভিজিয়ে দিলো একা ঘরে। মায়ের বুকটাও জ্বলতে লাগলো খাঁ খাঁ করে। সহ্য করে নিলো বুকে চাপা বিষাক্ত খনিটাকে! ছেলেকে বুঝানোর সময় হলো না, দাদার সাথে আজমাইন দেখাও করলো না। বাকিসব তো দূরেই থাকুক! একদম রাগে দাউদাউ করে কাটিয়ে গেলো একটা দিন।
মাহতাব যাওয়ার পরদিনই চিঠি এলো রোজার কাছে। মাহতাবের চিঠি তো এতো তাড়াতাড়ি আসার কথা না। অন্তত দুইটা দিন পেরিয়ে চিঠি হাতে আসে। তাই আজ আলোকেই চিঠি প্রেরক হিসেবে ধরে নিতে পেরেছে রোজা। সে জানে, এই দুজনের কাছ থেকেই তার জন্য চিঠি আসে। আজ যেন একটু উত্তেজনা নিয়েই চিঠিটা খুললো। এই চিঠির মাধ্যমেই ওই আলো ধীরে ধীরে নিজের পরিচয় জানাবে বলে আশাবাদী। গত পরশুর রাতে যখন আজমাইন এসেছিলো, রাতের খাবার খায়িয়ে বিদায়ের সময় ঘরের বাইরে একা একটু কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো। চুপিচুপি জিজ্ঞেস করেছিলো, তারা যেখানে থাকে সেখানে কোনো মেয়ে আছে কি না। কিংবা আশেপাশেই ‘আলো’ নামে কেউ আছে কি না। আজমাইন তেমন কারো সন্ধান দিতে পারলো না। সময় অল্প থাকায় ঠিকানাটা দেখিয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্য বলতে পারেনি। মাহতাব জানতে পারলে ব্যাপারটা অন্যরকম হবে। তাকে আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে, সে যা ভাবছে তা-ই কি না। মাহতাবের সাথে এই আলো পরিচিত কি না, যা রোজা জানে না! আর তাই আজ চিঠি পেয়ে নতুন কোনো ইস্যু পাওয়ার প্রত্যাশায় উত্তেজনা নিয়ে একা ঘরে চিঠি খুললো। সেই আলোর চিঠি।
“কেমন আছো তুমি? তোমার দাদাজান ভালো আছেন? অনেকদিন হলো দেখি না উনাকে। বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বোধহয়। তাই না? উনাকে আমার সালাম জানিয়ো।”
রোজা বিস্ময় চোখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চিঠির দিকে। দাদাজান! দাদাজানকে চেনেন তিনি! দাদাজানের সাথে দেখা হয়? হয় তো। এইযে, দাদাজান অসুস্থ তা-ও জানেন। তবে কে তিনি? তিনি কি দাদাজানের সাথেই সম্পর্কিত? দাদাজান জানেন তো আলোকে? পাওয়া যাবে দাদাজানের কাছে আলোর পরিচয়? রোজা ভারি চিন্তিত হয়ে বসে রইলো। কে এই অপরিচিত ব্যাক্তি, যে কি না রোজার কাছেই তার পরিচয় তুলে ধরার সূত্রে একাধারে তার নামে চিঠি পাঠিয়ে যাচ্ছে? সে তো নিশ্চয়ই তার পরিবারের সব খবরাখবর রাখে। একদম বিয়ে, সংসার থেকে শুরু করে দাদাজানের অসুস্থতা পর্যন্ত সব খবর আছে তার কাছে। অথচ ঠিকানা শহরের! দাদাজানের সাথেও বোধহয় খুব দেখা হতো একসময়, যা এখন হচ্ছে না। পরিচয় তথ্য নিয়ে দাদাজানের কাছেই যেতে হবে তাকে। জানতে হবে, আলো কে? কেন পাঠায় চিঠি শুধুমাত্র রোজার কাছেই?
চলবে।