সোনালী আলোর ঘ্রাণ পর্ব-৩২+৩৩

0
384

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩২
(নূর নাফিসা)
.
.
শনিবার আজমাইন গেছে, রবিবার আলোর চিঠি এসেছে রোজার কাছে। আর এই রবিবার সন্ধ্যাতেই বাগডাশ এসে ঝাপাঝাপি করেছে আজমাইনদের চালে, কবুতরের টংয়ে! কবুতর সব উড়াউড়ি করে পালিয়েছে এদিক সেদিক। হালিমা খাতুন, মৌসুমী, সেলিনা বেগমসহ বাচ্চারা হুড়হুড় করে বেরিয়ে এসেছে উঠুনে। মুখে শব্দ করছে বাগডাশ তাড়ানোর। সিয়াম ওপাশে গাছের ধারে যেতেই কবুতর মুখে বাগডাশকে লাফিয়ে পালাতে দেখলো। তারপর তড়িঘড়ি করে গাছ বেয়ে উঠে গেলো চালে। হালিমা খাতুন টর্চ এনে দিলেন সিয়ামের হাতে। আঘাতপ্রাপ্ত একটা মৃত কবুতর পাওয়া গেছে চালে। ভয়ার্ত কবুতরেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে দাদাজানের চালের দিকে, সিয়ামদের চালের দিকে। মৃত কবুতরটা ফেলতে দেখে বড্ড মায়া হলো মৌসুমীর। কত যত্ন করতো আজমাইন তাদের। এখন দূরে আছে বলেই কি যত্নের কমতি পড়লো? মৌসুমীও তো সকাল বিকাল তাদের আহার করাতো। মালিকও বাড়ি নেই, মালিকের সম্পত্তিও নিধনের দিকে! বাকিদের মুখেও আফসোসের সুর! কয়টা জানি শেষ করেছে! একটা যে মুখে পুরে নিয়ে গেছে, সেটা তো দেখেছেই সিয়াম। আরও খেয়ে গেছে নাকি, কে জানে! অনেকক্ষণ যাবত ডেকে ডেকে কবুতরগুলোকে টংয়ে রাখলো সিয়াম। অল্পস্বল্পই অবস্থান করেছে টংয়ে। কিছু গাছের দিকেও উড়ে গেছে। কতগুলো নষ্ট হয়েছে, সকালে বুঝা যাবে হয়তো। আর তাই সকালে ঘুম থেকে উঠেই মৌসুমী উঠুনে গম ছিটিয়ে কবুতরের সংখ্যা দেখে নিলো। দুইটাই কম পড়েছে। বাকিসব সুস্থ স্বাভাবিক আছে। কিছুক্ষণ পর পাশের বাড়ি থেকে কেঁদে এলো মমো। পাশের বাড়ির তার চেয়ে বছর দুই বড় মেয়েটা তাকে খামচি মেরে দিয়েছে। মায়ের কাছে এসে বিচার দিতেই সেলিনা বেগম মেয়েকে সাথে নিয়ে গেলেন বিচার দিতে। বিচার দেওয়া সত্ত্বেও নিজের মেয়েকে শাসন না করায় সেলিনা বেগম ক্ষেপে প্রতিবাদ করলেন। এক কথা, দুই কথা থেকে তর্কাতর্কি হয়ে গেলো। এরইমধ্যে মহিলা তাদের বাড়ির ছেলেমেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা তুললো। বিশেষ করে রোজার ব্যাপারটা উল্লেখ করলেন। মাহতাবের সাথে ইটিশপিটিশ সম্পর্কে মেয়ে পাঠিয়েছে ফুপুর বাড়ি। সেলিনা বেগমও ছেড়ে দেওয়ার লোক না। ইচ্ছেমতো বকে ঝেড়ে দিয়ে এলেন। হালিমা খাতুন গলা শুনতে পেয়ে দৌড়ে গেলেন তাকে টেনে নিয়ে আসার জন্য। বরাবরই তিনি ঝগড়া এড়িয়ে চলেন। এসব ঝগড়াঝাটি তার পছন্দ নয়। কিন্তু যে-ই টানে, সেলিনা বেগম আবার এগিয়ে গিয়ে গলা বাড়িয়ে বকে দিয়ে আসে। মৌসুমী মায়ের ঝগড়া দেখে হেসে কুটিকুটি। বহুদিন পর একটা ধামাকা ঝগড়া হলো। প্রতিযোগিতা হলে তার মা-ই এই ঝগড়ায় জিতে পুরস্কার অর্জন করতো। বাড়ি এসেও হালিমা খাতুনের কাছে নালিশ করা শুরু করেছে,
“বেডি কত্তবড় খারাপ! আমাগো বাড়ির পোলামাইয়া নিয়া কথা কইতো! বেডির চরিত্র ঠিক আছে?”
হালিমা খাতুন তাকে থামাতে বললেন,
“আরে, হইছে তো। হইছে। চুপ থাক এইবার। বেডি কইছে, বেডির মুখে রইছে কথা। কেউ কইলেই পোলাপান খারাপ হইয়া গেছে?”
“কইবোই ক্যা? জিভ টাইনা ছিঁড়া ফালামু! কোনো কিছুর দরকার হইলে দেখি দৌড় দিয়া গলায় পড়ে। আবার এই বাড়ির পোলাপানরে খারাপ কইতো!”
“হইছে, যা। যা। আব্বা শুনলে রাগ হইবো। ঝগড়াঝাটি ভালা না।”
ফুসতে ফুসতে ঘরে চলে গেলেন সেলিনা বেগম। দাদাজানের ঘরে গিয়ে ঝগড়ার ইতিহাস শুনিয়ে এলো মৌসুমী। শুক্রবার সকালে নাস্তার পরপর রোজা এলো বাবার বাড়ি। মা, চাচীর সাথে দেখা করলো। মেয়েকে দেখে হাসিখুশি মনোভাব পোষণ করলেও পরক্ষণে গল্পেস্বল্পে আজমাইনের কথা বলে মনের দুঃখটা প্রকাশ করলো দুঃখী এই মা। রোজা তাকে সান্ত্বনা প্রদান করলো। ঠিক হয়ে যাবে সব। অযথা মন খারাপ আর চিন্তার কারণ নেই। তার জেদ আর দুষ্টুমি তো সেই ছোট থেকেই বেশি। বিশ-একুশ বছরেও তার পরিবর্তন হয়নি। বুঝার বয়স হয়নি। যেদিন বুঝবে, সেদিনে মাকে আর কাঁদতে দিবে না। নিজ থেকেই মায়ের খোঁজখবর নিবে। কাজের ফাঁকে পরিবারকে স্মরণ করবে। যোগাযোগের চেষ্টা করে ভারাক্রান্ত মনটাকে হালকা করবে। যেমনটা এখন মাহতাব করে যাচ্ছে। এই সময় হয়তো তারও আসবে।
দুপুরের খাবারটা রোজাই নিয়ে গেলো দাদাজানের ঘরে। সাথে সহযোগিতা করছিলো মৌসুমী। রোজা বসে বসে দাদাজানকে খায়িয়ে দিলো। মৌসুমী চেয়ারে বসে বসে বকবক করে গেলো। কত কথা জমে যায় তার এক সপ্তাহেই। সবটা প্রকাশ করে রোজা এলে। গল্প যেন পিছুই ছাড়ে না। দাদাজানের খাওয়া শেষ হলে থালাবাটি মৌসুমীই নিয়ে গেলো ধুয়ে রাখতে। দাদাজানের ওষুধ দিলো রোজা। একা পেয়ে তার প্রশ্নটুকুও তুলে ধরতে সমর্থ হলো অপরিচিত আলোকে নিয়ে।
“দাদাজান, একটা কথা বলবো?”
“কি দাদাভাই?”
“আলো নামে কাউকে তুমি চেনো?”
আহমদ আলী যেন কিঞ্চিৎ বিস্ময় জাগিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রোজার দিকে। রোজা দাদাজানের স্থির তাকিয়ে থাকা দেখে বললো,
“না, মানে একজন চিঠিতে আমার খোঁজখবর নেয় প্রায়ই। নাম আলো। তোমার শারীরিক অবস্থার কথাও জিজ্ঞেস করলো। তোমাকে সালামও জানাতে বললো। তাই ভাবলাম চেনো তুমি।”
আহমদ আলী চিন্তিত দৃষ্টি নিচে নামিয়ে নিলো। পরক্ষণে বালিশ ঠিক করতে করতে বললো,
“না, আমি কাউকে চিনি না।”
“মনে করে দেখো না, কেউ আছে কি না এই নামে।”
“না, নেই।”
“কিন্তু আমি তো জানলাম, তোমার সাথে আগে দেখা হতো। এখন দেখা হয় না, তাই জিজ্ঞেস করেছিলো তুমি খুব অসুস্থ কি না। তুমি কি সত্যিই চেনো না?”
“আলো আবার কে? চিনি না আমি। দরজাটা চাপায় দিস। একটু ঘুমাই।”
“দাদাজান…”
হতাশা নিয়ে নিজেই থেমে গেলো রোজা। বিরক্ত হয়ে না উঠে বারবার জিজ্ঞাসায়! দাদাজানের ওই চোখই তো বলে দিচ্ছিলো ‘আলো’ নামটা উনার পরিচিত। কিন্তু প্রকাশ করতে ভারি অনিচ্ছুক যে তিনি! কেমন এড়িয়ে গেলেন ব্যাপারটা! এমনটা কেন করলেন? হতাশা নিয়ে বেরিয়ে এলো রোজা। দরজাটা চাপিয়ে দিলো দাদাজানের ঘরের। অতি ধীর গতিতে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলো, মাকে একবার জিজ্ঞেস করবে কি না? কিন্তু মা তো না-ও জানতে পারে। আর দাদাজানের ব্যাপারটা দাদাজান যখন একদমই জানাতে ইচ্ছুক হলো না, এটা নিয়ে বাড়িতে বাড়াবাড়ি সৃষ্টি করাটা নিশ্চয়ই বেয়াদবি হবে। কিন্তু আলোর পরিচয় না জানা পর্যন্ত যে শান্তি হচ্ছে না তার। গোপনে গোপনেই তথ্যটা খুঁজে বের করা দরকার। কেন মনে হচ্ছে মাহতাবের সাথেই জড়িত? যা দাদাজানও জানেন। নয়তো এবাড়ির কারো জানা থাকলে তারও তো জানার কথা। সে যা ভাবছে, তা-ই কি? কোনোভাবে ধোকার সম্মুখীন হলো না তো মাহতাবের কাছে? নয়তো বিয়ের অভিনন্দন জানাতেই কেন আলোর উন্মোচন? এর আগে তো কোনো বার্তা আসেনি তার জন্য। এর আগে তো আলো স্মরণ করেনি তাকে! বড্ড দুশ্চিন্তাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটি। আজকাল পড়ায়ও মনযোগ বসে না আলোর জন্য!
মৌসুমী থালাবাটি ধুয়ে নিয়ে গেলো রান্নাঘরে। হালিমা খাতুনও নামাজ পড়ে বেরিয়ে এসেছেন। তারা শ্বাশুড়ি বউ দুপুরে খাওয়ার জন্য ভাত বেড়ে যাচ্ছেন। রোজা ভাবতে ভাবতে বারান্দাতেই পায়চারি করতে লাগলো। মৌসুমী রান্নাঘরের সামনে থেকে ডাকলো তাকে,
“আপু, ভাত খাইতে আসো।”
রোজা ভাবনা থামিয়ে এগিয়ে গেলো। ফুপুর বাড়ি নিত্যদিনের সময় কাটার টুকটাক গল্প করতে করতেই তারা একত্রে খাওয়া শেষ করলো। খাওয়ার পরপরই মৌসুমী তাকে টেনে নিয়ে গেলো একটু ফসলের মাঠ ঘুরে আসার জন্য। কতদিন হয় রোজার সাথে ঘুরতে বের হয় না। রোজা যেতে চাইছিলো না, তবুও সে টেনে নিয়ে গেলো। মন রক্ষা করতে গেলো রোজা। এই রোদের মধ্যেই একটু ঘুরাফেরা করে চলে এলো। তাকে বাড়ি ফিরতে হবে আবার। সেখান থেকে এসেই বোরকা পরে তৈরি হয়ে গেলো। মৌসুমীকে সাধলো সাথে যাওয়ার জন্য। মৌসুমী মিষ্টি হেসে বললো, “ইশ!”
“ইশ কি আবার? চল যাই।”
পরক্ষণে মাকে বললো,
“মা, মৌসুমীর তো পরীক্ষা শেষই হলো। হাতে কিছু সময় আছে। নিয়ে যাই আমার সাথে। থেকে আসুক কয়েকদিন।”
“যাইবো বুঝি?”
“তার তো মতিগতির ঠিক নেই। নিয়ে যাই টেনেই।”
“নাহ, টেনে নেওয়ার দরকার নাই। সবাই তোরা চলে যাবি। একা ঘরে আমার দিনও কাটে না, রাতও কাটে না। তুইই পরীক্ষাটা শেষ হইলে আসিস। কয়টা দিন থেকে যাইস। ভাল্লাগবো।”
“হ্যাঁ, পরীক্ষা শেষে আমি আসবো। আচ্ছা, থাক। একা আছো, যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনিতে যেয়ো চাচীমাকে সাথে নিয়ে। সকালে গেলে সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে চলে এলেও পারো। একদমই যেতে চাও না কেউ। খুব দূরে কি আর?”
“আচ্ছা, যামু নে। তোর দাদাজানেরও তো খেয়াল রাখা লাগে, বুঝোস না? আচ্ছা, সাবধানে যা।”
“হুম, আসি।”
রোজা চলে যেতেই মৌসুমী বড় মা’র কাছে ফিসফিস করলো,
“বড় মা, পাঁচটা টাকা দিবা? বাদাম খাইতাম।”
“দিমু নে।”
“এখনই দাও। দোকান খোলা আছে।”
“মাত্র না ভাতগুলা খাইলি? একটু পরে খা।”
“না, আমার ক্ষুধা লেগে গেছে আরও আগেই।”
হালিমা খাতুন আঁচলের কোণে বাঁধা টাকা নিতে নিতে বললেন,
“বাদাম খাওয়ার ক্ষুধা লাগছে, না? রোজা না মিষ্টি আর মোয়া নিয়া আইলো। ওইটাও তো খাইতে পারোস। তোর ফুপু বানাইছে বোধহয় মোয়া।”
“খামু নে। দাও।”
পাঁচ টাকা নিয়ে দোকান থেকে বাদাম আনতে চলে গেলো মৌসুমী। দোকানে লোকজন থাকায় মূল রাস্তায় উঠলো না। আরও আগে থেকেই যায় না, আজমাইনের দৌড়ানোর ফলে। এখানে দাঁড়িয়েই এক প্রতিবেশী চাচাতো ভাইকে দিয়ে পাঁচ টাকার বাদাম আনিয়ে নিলো। খেতে খেতেই বাড়ি ফিরতে লাগলো। মনে পড়তে লাগলো আজমাইনের কাছে যখন তখন বাদাম চাওয়ার ঘটনাগুলোও। তাকে মনে করে হাসতে ভীষণ ভালো লাগে। আবারও মন চায় ঝগড়া করতে। তখন মনে মনেই ঝগড়া করে।

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩৩
(নূর নাফিসা)
.
.
মিষ্টির প্যাকেট কোলে নিয়ে এক বসাতেই ছয়টা মিষ্টি খেলো মৌসুমী। ভালোই লাগছিলো খাটে বসে পা ঝুলিয়ে মিষ্টি খেতে। খেতে খেতে যেন হুশটাও হারিয়ে বসেছিলো। ছয়টা খাওয়ার পর প্যাকেটে তাকিয়ে দেখলো প্রায় অর্ধেক খালি। একত্রে এতোগুলো মিষ্টি গেলা আদৌও তার পক্ষে সম্ভব নাকি, ভাবতে লাগলো। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, ছয়টা মিষ্টি সে-ই খেলো! কিছুক্ষণ মাত্র হলো, পেট ভরে ভাত খেলো। তার পরপরই আবার বাদাম খেলো। তারপর দুইটা মোয়া খেয়ে এখন মিষ্টি খেতে বসলো। কিন্তু পেট যেন ভরছে না। ব্যাপারটা কি? পেটের এতো খাবার গেলো কোথায়? পেট ফুটো হয়ে যায়নি তো কোনোদিকে? মিষ্টির প্যাকেট নামিয়ে রেখে ঠিকই নিজের পেটে পিঠে হাত বুলিয়ে দেখলো কোনোদিকে ফুটো হয়ে গেলো কি না! না, তেমন কিছুই পাওয়া গেলো না। তবে গলদকৃত খাবারগুলো যাচ্ছে কোথায়? পেট ভরে না কেন? আরও খেতে পারবে মনে হচ্ছে। কিন্তু সে-ই যদি সব খেয়ে যায়, বাকিরা খাবে কি? সর্বনাশ! আর একটাও দেওয়া যাবে না মুখে। দ্রুত প্যাকেটের মুখ বন্ধ করে দিলো। বাইরে গিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে বড়মার কাছ ঘেঁষে বসলো। হালিমা খাতুন উঠুনের কোণে বসে মুলা কাটছেন। ক্ষেত থেকে তুলে আনা সাদা মুলা। মৌসুমী কাটা মুলা থেকে এক পিস মুলা তুলে চিবাতে লাগলো। মিষ্টি সাদের রসালো মুলা ভালোই লাগছে চিবাতে। সেটা খাওয়ার পর আরেক পিস তুলে নিলো। হালিমা খাতুন বললেন,
“কাপড়চোপড় গুলা আগেই ঘরে নিয়া যা। ঠান্ডা হইয়া যাইবো।”
“নিচ্ছি।”
হাতের পিসটা শেষ করে তৃতীয়বারের মতো আরও একটা পিস তুলে নিলো। সেটায় কামড় বসিয়ে মিনমিনে গলায় বললো,
“বড় মা।”
“হু?”
“একটা কথা বললে রাগ করবা?”
“কি কথা?”
“করবা কি না কও।”
“না শুনলে ক্যামনে কই?”
“রোজা আপু মিষ্টি আনছে না?”
“হুম।”
“আমি না একসাথেই ছয়টা মিষ্টি খেয়ে ফেলছি।”
হালিমা খাতুন কাজ চালিয়ে যেতে যেতেই হাসলেন।
“খাইছোস তো কি হইছে?”
“না, মানে আমি তো এতো মিষ্টি একসাথে খাই না। তবুও ক্যামনে জানি আজ খুব ভালো লাগছিলো। খাইতে খাইতে এতোগুলোই খেয়ে ফেলছি।”
“ভালা করছোস। ভালো যখন লাগছে, আরও খা গিয়া। কে খাইবো নয়তো এইগুলা? তোগো ঘরে কয়টা দিমু, তোর দাদাজান খাইলে দুয়েকটা খাইবো। আমি একটা খাইলে খামু, নইলে নাই। খাওয়ার মানুষ কি আর আমার ঘরে কেউ আছে?”
“তুমি রাগ হও নাই তো?”
“পাগল নাকি মাইয়া!”
বড় মা রাগ হয়নি, তাই খুশি হয়ে গেলো মৌসুমী। খুশিতে একটা মোটাসোটা আস্ত মুলাই হাতে তুলে নিয়ে গেলো চিবিয়ে খাওয়ার জন্য। কল চেপে মুলা ধুয়ে দাঁতের আড়িতে খোসা ছাড়িয়ে খেতে খেতে এক হাতে রশি থেকে কাপড়চোপড় টানতে লাগলো। কাটাকুটি শেষে হালিমা খাতুন তার হাতেই ওইঘরে মিষ্টি পাঠালেন। তারপর রান্না বসাতে গেলেন। মাগরিবের আজান পড়লে মৌসুমী আগে নামাজ পড়ে এলে তাকে চুলার পাশে বসিয়ে হালিমা খাতুন নামাজ পড়তে গেলেন। নামাজ শেষে ফিরতেই মৌসুমী বললো,
“বড় মা, ক্ষুধা লাগছে। কি খাই?”
“মিষ্টি খা গিয়া?”
“আর কত খাইতাম?”
“কি খাবি তবে? মুড়ি খাবি? একটু ঝোল তরকারি আছে।”
“দাও, খাই।”
তরকারি মেখে এক বাটি মুড়ি খেয়ে নিলো মৌসুমী। ভাইবোনদের পড়াশোনার ব্যাপারে একটু আলগা শাসন করতে তাদের ঘরে গিয়ে দেখলো মা চিতুই পিঠার আয়োজন করছে। মৌসুমীকে দেখেই সেলিনা বেগম বললেন,
“প্রথমবার শীত আইলো, মেয়ের জামাইরে পিঠা বানাইয়া খাওয়াইতে পারলাম না। ওইদিন আইতে দেইখা ভাবছিলাম পিঠা করমু, চাল ভানার আগেই জামাই উধাও! এইটা কিছু হইলো? এমন করলে ক্যামনে চলে? বেডা মাইনষের রাগ এতোদিন থাকলে চলে?”
মৌসুমী জবাব দিলো,
“তবে বেডি মাইনষের রাগ বহুদিন থাকে, মা?”
“কারো রাগই বহুদিন থাকার দরকার নাই। রাগ কইরা থাকলে ঠক।”
“মাইয়ার জামাইর খাওয়া লাগবো না। মাইয়ারেই খাওয়াও।”
“মাইয়ারে তো যখনতখনই খাওয়ানো যায়। পোলাডার বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হইলো না।”
“না হোক। কি পিঠা বানাইবা?”
“দুধ চিতই।”
“আমার তো শুটকির ভর্তা দিয়াই বেশি ভাল্লাগে।”
“বানামু নে ভর্তা। খাইছ। রাতে দুধে ডুবায় রাখলে কাল সকালে ওইটাও খাইতে পারবি।”
“ফুপুর বাড়ি কিন্তু পাঠাইয়ো।”
“হো, সকালেই পাঠায় দিমু সিয়ামের হাতে।”
মায়ের সাথে গল্প করতে করতে চুলার পাশে বসে গরম গরম পিঠা উপভোগ করলো মৌসুমী। রান্না শেষে হালিমা খাতুনও এখানে এসে বসেছিলেন। দুধ নারকেলের ক্ষীরাটা তিনিই করে দিলেন। মৌসুমীর মন ভরলেও যেন পেট ভরলো না পিঠা দিয়ে। ওই ঘরে এসে আবার ভাত খেলো। দাদাজানের ওষুধপত্র দিয়ে এসে বড়মার সাথে যখন ঘুমাতে এলো, আবারও মনে হলো ক্ষুধা পেলো। সে কি রাক্ষস হয়ে গেছে? তাকে কি ভুতে পেয়েছে? যেন ভেবেই পাচ্ছে না। ভয়ের উপর ভয় জন্মে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
“বড় মা। আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”
হালিমা খাতুন যেন কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়েই তাকিয়ে রইলেন। সন্ধ্যা থেকে এ পর্যন্ত খাওয়ার উপরেই আছে। ভাত যে খেয়েছে, বেশিক্ষণ হয়নি। এখনই আবার ক্ষুধা! তার বিস্ময় চোখ দেখে মৌসুমী একই ভঙ্গিতে বললো,
“আমার উপর মনে হয় রাক্ষস ভর করছে, বড় মা। সারাদিনই খাইতাছি আর ক্ষুধা লাগতাছে। খাই আর ক্ষুধা পায়, খাই আর ক্ষুধা পায়। এট্টু দোয়া পইড়া ফুঁ দাও না।”
“যাহ, মাইয়া! কি বলে এইগুলা!”
“হো, সত্যি কথা।”
“মোয়া খাইয়া পানি খা। ক্ষুধা মিটে যাইবো।”
মৌসুমী তা-ই করলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বমি! কাল সারাদিনের থলি যেন এবার খালি হতে চেয়েছে। কিন্তু পেটের খাবার আগেই হজম হয়ে গেছে। খালি পেটে বমি হচ্ছে! হালিমা খাতুন ভারি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার পেটের গড়নও অন্যরকম দেখায়! ক’দিন যাবত খাওয়াদাওয়ারও ঠিক নেই। কখনো খাওয়ার উপর খেয়েই যাচ্ছে৷ কখনোবা একদমই খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করছে না। সেদিনও অহেতুক বমি করলো। গতকাল এতো খেয়েও বমির পর এখন আর কিছুই মুখে তুলছে না। কিছু জিজ্ঞেস করলেও লজ্জায় বলছে না মৌসুমী। সকালে নাস্তার পরপরই পাড়ার স্বাস্থ্যকর্মী মহিলার কাছে নিয়ে গেলো। দূরসম্পর্কের খালাতো বোন হয় হালিমা খাতুনের। তাকে দেখিয়ে নিশ্চিত হয়ে এলেন পেটের পীড়ার ব্যাপারে। তিনি যা সন্দেহ করছিলেন, তা-ই। খুশিও হয়েছেন বটে। সেলিনা বেগম শুনে তো মহা খুশি! এদিকে মৌসুমীর অবস্থা লজ্জায় মরি মরি! স্বাস্থ্যকর্মী খালা কি শুনালো এগুলো? সে তো আরও কবিরাজ ধরার ভয় করছিলো তার উপর থেকে রাক্ষস তাড়ানোর। গতকালের এতো খাবার তবে বাবু খেয়ে নিলো সব? তাইতো মন বলছিলো, এতো খাবার সে খায় কিভাবে? এই বাবুই সব খেয়ে গেছে। এইটুকু বাবু এত্তো খেতে চায় কিভাবে! সারাদিন শুধু কেটে গেলো তার এই মরিমরি লজ্জায়, আর লজ্জারুণ চিন্তার তাড়নায়। বাবুকে নিয়ে কি উদ্ভট উদ্ভট চিন্তার সূত্রপাত ঘটছিলো মাথার ভিতর! তার বাবু মিষ্টি খেতে পছন্দ করে, তাই এতো মিষ্টি খেয়ে ফেলেছিলো! বাবু পিঠা খেতে পছন্দ করে, তাই এতো পিঠা খেয়ে নিচ্ছিলো! বাবু ভাত খেতেও ভীষণ পছন্দ করে, তাই কাল ভাতও বেশি বেশি খেয়েছিলো। কিন্তু বাবুর আজ কি হলো? আজ যে কোনো খাবারই খেতে পারছে না! খাবারের ঘ্রাণ নাকে এলেই কেন পেটে ঝড় উঠছে? আজ বাবু খাচ্ছে না কেন? কেন রাগ করলো?

চলবে।