#স্বপ্ন_জুড়ে_তুমি
#পর্ব_১০
#সামসুন_নাহার
“এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে।”
গম্ভীরমুখে কন্ঠে কঠোরতা বজায় রেখে বললেন সাইদুর রহমান। বাসায় ফিরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুইবার কলিং বেল বাজালেও দরজা না খুললে তৃতীয়বারে দরজা খুললে তিনি এই কথাটি বললেন।
আতিফা বেগম স্বামীর উপর কোনো কথা বললেন না।এমনিতেই কাজ থেকে আসছেন। কাজের ঝামেলা হয়তো বেশি তাই রাগ দেখিয়েছেন দেখে আতিফা বেগম আর কোনো কথা বললেন না।আতিফা বেগম বললেন,
“শরবত করে নিয়ে আসব তোমার জন্য। গরমে আসলে।”
সাইদুর রহমান কন্ঠে কঠোরতা বজায় রেখে বললেন,
“তোমাকে কি আলাদাভাবে বলতে হবে। তারপর আনবে।”
আতিফা বেগম স্বামীর কথা শুনে মন খারাপ করলেন।মাথা নিচু করে রান্নাঘরে যেতে ধরতেই সাইদুর রহমান বললেন,
“প্রিয়শা আর আদিলকে আমার এউমে পাঠিয়ে দাও।”
বলেই তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন।পিছনে রেখে গেলেন স্ত্রী নামক মহিলাকে। যাকে একবারের জন্য বলা হলো না কেমন আছো।অথচ এই মহিলাটি এই সংসারের প্রাণ।যাকে ছাড়া এই সংসার অন্ধকার। আতিফা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে গেলেন।
……………………….
আদিল ও প্রিয়শা দুইজন দুইজনকে সাহস জুগিয়ে সাইদুর রাহমানের সামনে গেল।দুইজনেই চুপ করে আছে।সাইদুর রহমান নিজের ছেলে-মেয়েদের দেখে বললেন,
“কেমন আছো তোমরা দুইজন।দিনকাল কেমন যাচ্ছে তোমাদের।”
আদিল বলল,
“ভালো।”
“ভালো তো যাবেই।আমি বাসায় ছিলাম না ফাঁকিবাজি করার সুযোগ পেয়েছো।”
আদিল আর কোনো কথা বলল না।মাথা নিচু করে থাকল।সাইদুর রহমান গম্ভীরমুখে বললেন,
“মাঝখানে একদিন স্কুল যাওনি কেন।”
আদিল চকিত দৃষ্টিতে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে আবার প্রিয়শার দিকে তাকালো। ভয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“আআসলে আব্বু…”
আদিলের কথার মাঝখানে প্রিয়শা বলল,
“আব্বু আমি ওকে যেতে মানা করেছিলাম।”
সাইদুর রহমান মেয়ের দিকে প্রশ্নাত্তক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“কেন,মানা করেছিলে।”
“আব্বু আসলে ওর খুব পেট ব্যাথা করছিল।তাই আমি মানা করেছিলাম।”
“কেনো তুমি কি ডাক্তার যে তুমি মানা করলে।আর স্কুলে না গেলে পেট ব্যাথা কমে যাবে।”
প্রিয়শা মাথা নিচু করে বলল,
“আব্বু আদিলের কোনো দোষ নেই।আমিই আদিলকে জোর করেছিলাম।বকার হলে আমাকে বকো।”
“খুব তো ভাইয়ের পক্ষ নেওয়া শিখে গেছ।নিজে বেশি বড় হয়ে গেছ।মনে রাখবে আমার সিদ্ধান্তে শেষ সিদ্ধান্ত। এরপর কোনো কাজ করার আগে মনে রাখবে। যাও এখন।”
প্রিয়শা ও আদিল মাথানিচু করে চলে গেল।আদিক চুপিসারে প্রিয়শাকে বলল,
“দেখছ বুবু আব্বু কোনোদিনও বদলাবে না।অন্যদের আব্বু কোথাও থেকে আসলে নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে হাসিখুশিতে কথা বলে।কিন্তু আমাদের আব্বু শুধু বকেই।”
প্রিয়শা কোনো কথা না বলে ভাইয়ের মুখে দেখল কেবল।তার বলার মত কোনো ভাষা নেই।আদিল তো মিথ্যে কিছু বলেনি।
……………………………………
আমরা সামাজিক জীব।আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক পথ অবলম্বন করতে হয়।তেমনিভাবে আমাদের কাজ করতে হয়।কাজের বিভিন্ন ধরনের সাথে আমরা নিজেদের মানিয়ে নেই।
ফাইয়াজ বাসায় ল্যাপটপে কাজ করছে।কাজ করতে করতে তার কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে।অভ্যাসগতভাবে ফাইয়াজ নিজের মায়ের উদ্দেশ্যে নিজের রুম থেকে চেচিয়ে বলল,
“আম্মু আমার কফি পাঠিয়ে দাও।”
অপাশ থেকে কোনো উত্তর আসল না।তবে ফাইয়াজ জানে তার মা কিছুক্ষণ পর কফি করে নিয়ে আসবে।ফাইয়াজের কাজের মাঝখানে কেউ সামনে কফির মগ ধরল। ফাইয়াজ না তাকিয়েই কফির মগ নিয়ে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ আম্মু।”
বলেই ফাইয়াজ সামনে দেখতেই দেখল আরশিকে।আরশিকে দেখে ফাইয়াজ নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল,
“আরশি তুই আম্মু কই।”
আরশি বিছানায় বসে বলল,
“মামি ঘুমাচ্ছে। তাই আমি কফি নিয়ে আসলাম।”
“কফি আনার জন্য ধন্যবাদ। ”
ফাইয়াজ আর কোনো কথা না বলে নিজের কাজ করতে লাগল।কিন্তু ফাইয়াজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে আরশি তার দিকে তাকিয়ে আছে।ফাইয়াজ নিজের মুখ তুলে দেখল তার ধারণাই ঠিক।ফাইয়াজ তাকাতেই আরশি চোখ নামিয়ে নিল।ফাইয়াজ বলল,
“কিছু বলবি আরশি।এইরকম করে মুখ দেখতেছিস কেন।”
ফাইয়াজ এইরকম মুখের উপর বলায় আরশি কিছুটা লজ্জা পেল।মাথা নিচু রেখে কোমল স্বরে বলল,
“আমি কি দেখতে খুব খারাপ ফাইয়াজ ভাইয়া।”
ফাইয়াজ কাজ করতে করতে বলল,
“না তুই দেখতে অনেক সুন্দর। যে বলে তুই সুন্দর না তার চোখ নষ্ট।”
ফাইয়াজের কথা শুনে আরশি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।বুকের মধ্যে কষ্টগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।যদি সে সুন্দর হয় তাহলে বিয়ে করতে রাজি হলো না কেন।নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করল।আরশি নিজেকে সামলিয়ে আবার বলল,
“আমার দিকে তাকিয়ে বলো।”
ফাইয়াজ আরশির দিকে তাকালো। দেখল মেয়েটা অনেকটা শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি জমা হয়েছে।ফাইয়াজ আরশির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই অনেক সুন্দর।”
“তবে আমাকে বউ হিসেবে কেন গ্রহণ করছো না।”
ফাইয়াজ আরশির মুখের দিকে তাকালো।আরশির আখিদ্বয়ে অশ্রু টলমল করছে।যখন তখন বর্ষণ হতে পারে।ফাইয়াজ আরশির দিকে না তাকিয়ে বলল,
“আমি তোকে ছোট থেকে ফিজার মত দেখে আসছি।ফিজা যেমন আমার বোন তুইও আমার বোন।ফিজার কষ্ট যেমন আমি সহ্য করতে পারি না।তেমন তোর কষ্ট আমার সহ্য হয় না।”
ফাইয়াজের কথা শুনে আরশি কেঁদে দিল।কাঁদতে কাঁদতে হেচকি তুলে ফেলল।হেচকি তুলে আরশি বলল,
“কককিনন্তু আআমি ততোমাকে…”
আরশিকে থামিয়ে ফাইয়াজ আরশিকে পানি খেতে দিল।আরশি পানি খেয়ে বলল,
“আমি তো তোমাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি।আমি যে সহ্য করতে পারছি না।আমার যে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে।”
ফাইয়াজ আরশির কথা শুনে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করল।ফাইয়াজ জানে এক পাক্ষিক ভালোবাসা কতটা পীড়াদায়ক। ফাইয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি কি কখনো তোকে ভালোবাসি বলেছি।কিংবা তোকে কথা দিয়েছে।বলিনি তাহলে কেন তুই একপাক্ষিক হয়ে ভালোবাসতে গেলি।একাই ভালোবাসলি আর একাই কষ্ট পাচ্ছিস।দেখবি আমার চেয়ে অনেক ভালো ছেলে পাবি তুই।”
আরশি করুনভাবে বলল
“আমার তো অন্য কাউকে চাই না।আমার যে তোমাকেই লাগবে।”
“আমাকে পাবার আশা ছেড়ে দে।আমি কোনোদিন তোর হবো না।”
“তুমি কি কাউকে ভালোবাসো।”
“হুম।”
আরশি নিজের চোখের পানি মুছে শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমার ভালোবাসা দেখে তোমার সহানুভূতি বের হচ্ছে। তাই না।আমি যেই কষ্ট পাচ্ছি।তুমিও সেই কষ্ট পাবে। তোমার ভালোবাসা কোনোদিন পূর্ণতা পাবে না।তুমিও ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট বুঝবে।”
বলেই আরশি দৌড়ে ফাইয়াজের রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।ফাইয়াজ শুধু চেয়ে দেখল আরশির যাওয়ার পথে।আরশি বেরিয়ে যেতেই সেখানে প্রবেশ করলেন ফিরোজ ইসলাম প্রবেশ করে গম্ভীরমুখে বললেন,
“আমাকে এভাবে তোমার ফুপির কাছে ছোট করে খুব ভালো লাগছে নিশ্চয় তোমার।”
ফাইয়াজ তার আব্বুকে দেখে বলল,
“আব্বু তোমার উচিত ছিল আমাকে জানিয়ে কথা দেওয়া। তুমি না জানিয়ে কথা দিলে তো এমন হবে।আমি কি একবারের জন্যও বলেছিলাম আমি আরশিকে বিয়ে করব।”
“তা করবে কেন।আমার তো আর ইচ্ছে নেই।বড়টা নিজের ইচ্ছেই বিয়ে করেছে তুমিও করবে আর কি।জেদ দেখাচ্ছ।”
ফিরোজ ইসলামের কথা শুনে ফাইয়াজ খানিকটা লুকিয়ে হাসল।তার আব্বুর সাথে এ বাড়ির সবাই খুব ফ্রেন্ডলি। তবে আরশিকে বিয়ে না করতে চাওয়াই তিনি কিছুটা রাগ করেছেন।তাই তাদের মধ্যে মাস যাবত ধরে ভালো করে কথা হচ্ছে না।ফাইয়াজ তার আব্বু কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার ছেলে আব্বু আমরা।তোমার দেখানো পথেই যাচ্ছি।”
“মানে। কি বলতে চাচ্ছো তুমি। ”
“তুমি দাদুর অমতে আম্মুকে যেভাবে বিয়ে করেছিলে। আমরাও সেভাবে করছি।বংশের প্রথা তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে তো কি বলো।”
ফাইয়াজের মুখে এমন কথা শুনে ফিরোজ ইসলাম খানিকটা ভরকালেন।এইজন্য ছেলে-মেয়েদের সবকিছু বলা যায় না।স্ত্রীর কথা শুনে যদি তিনি তাদের বিয়ের কথা না বলতেন তাহলে আজ এসব শুনতে হত না।তিনি কঠোরভাবে বললেন,
“মুখে মুখে কথা বলা শিখে গেছ দেখছি।আমিও দেখব তোমার পছন্দ কেমন।”
বলেই ফিরোজ ইসলাম চলে গেলেন।ফিরোজ ইসলাম চলে যেতেই ফাইয়াজ উচ্চস্বরে হাসল।কিন্তু ফাইয়াজের মন খজখজ করছে।আরশির শেষ কথা বলা।আরশির ভাষ্যমতে যদি ফাইয়াজের ভালোবাসা যদি পূর্ণতা না পায়।এমনিতেই ফাইয়াজের মনে এসব চলছেই।আবার আরশির কথা শুনে ফাইয়াজের বুক কেঁপে উঠল।
ফাইয়াজ তৎক্ষনাৎ প্রিয়শাকে কল লাগাল।একবার, দুইবার, তিনবার রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।আর এইদিকে ফাইয়াজের চিন্তা বাড়ছেই খুব দ্রুত গতিতে। চতুর্থবারে কল রিসিভ হলো।ফাইয়াজ উদ্ধিগ্ন গলায় বলল,
“এতক্ষণ সময় লাগে কল ধরতে।কই ছিলে এতক্ষণ। ”
“আব্বুর রুমে ছিলাম।কিন্তু হয়েছে কি।”
ফাইয়াজ লম্বা একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত হয়ে বলল,
“কিছুনা।কল ধরছিলে না চিন্তা হয়েছিল।”
ফাইয়াজের কথা শুনে প্রিয়শা হাসল।হেসে বলল,
“তাই বুঝি। তা এত কি জরুরী কথা বলার জন্য ফোন দেওয়া।”
ফাইয়াজ অন্য কোনো কথা না বলে বলল,
“ভালোবাসি।”
“আমিও তোমামে ভালোবাসি।কিন্তু কেন ফোন করেছিলে।”
ফাইয়াজ ভীতু হয়ে উদ্ধিগ্ন গলায় বলল,
“আমার খুব ভয় করছে প্রিয়।”
“কিসের ভয়।”
“আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে তো।নাকি আমাদের ভালোবাসা অপূর্ণ থেকে যাবে।আমার ভীষণ ভয় করছে।”
“যেখানে আমরা দুইজন দুইজনকে ভালোবাসি সেখানে আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবেই। তুমি দেখে নিও।এখন চিন্তা করিও না।আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব।”
প্রিয়শার কথা শুনে ফাইয়াজ খানিকটা হাসল।তবে মনে কিছুটা ভয় থেকে গেল।কি হবে তাদের ভবিষ্যৎ।
#চলবে………………
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ)