স্বপ্ন জুড়ে তুমি পর্ব-৩০

0
132

#স্বপ্ন_জুড়ে_তুমি
#পর্ব_৩০
#সামসুন_নাহার

“মা আব্বুর কি হয়েছে। তোমরা আব্বুকে হাসপাতালে কেনো নিয়ে আসছো। আমি তো আব্বুকে ভালো দেখে গেছিলাম তাহলে কি হলো আমার আব্বুর।”

উপরক্ত কথাটি বলে প্রিয়শা আবার কান্নায় ভেঙ্গে পরল।মেয়ের এইরকম আর্তনাদ কান্না দেখে আতিফা বেগম নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না।তিনি আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলেন।প্রিয়শা কাঁদতে লাগল লাগাতার।
তাহমিদ প্রিয়শাকে আগলে নিল।প্রিয়শার মাথা নিকের বুকে চেঁপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।ভাবতে লাগল সে আর প্রিয়শা রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন আদিলের কল আসে।আর তারা তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে চলে আসে।আদিলের কল করার পর থেকে প্রিয়শা কান্না করেই যাচ্ছ।এভাবে কান্না করলে তো তার শরীর খারাপ করবে।তাহমিদ প্রিয়শার উদ্দেশ্যে সান্ত্বনামূলক বাণীর সুরে আদুরে কন্ঠে বলল,

“প্রিয় চুপ করো।এভাবে কান্না করলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। তবে তোমাকে শক্ত হতে হবে।তার আব্বু তোমাকে এইভাবে কান্না করতে দেখলে নিশ্চয় বকা দিত।সাথে আমাকেও দিত।বলত,তার মেয়েকে আমি সুখে রাখতে পারিনি।দেখো আদিল ও তোমার মা কিভাবে ভেঙ্গে পরেছে।তাদের শক্তি সাহস তোমাকেই হতে হবে।যদি তুমি এখন তাদের পাশে না দাঁড়াও তাহলে কে দাঁড়াবে।”

প্রিয়শা তাহমিদের কথা শুনে প্রিয়শা তাহমিদকে জড়িয়ে ধরে নৈঃশব্দ্যে কান্না করতে করতে বলল,

“এসবের জন্য আমি দায়ী।আব্বু আমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করবে না।আমি কল করলেও আব্বু রিসিভ করত না।আমার উপরে আব্বু অভিমান করে আছে।”

তাহমিদ প্রিয়শার মাথায় একটা চুমু দিয়ে আদুরে নেশাক্ত কন্ঠে বলল,

“প্রিয় তোমার চোখের পানি আমাকে বড্ড পোড়ায়।তোমার চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারি না।এই নয়নের পানি দেখলে নিজেকে ছন্নছাড়া পাগলের মত লাগে।কেন এসব হয় জানো।কারন আমি আমার এই প্রিয়’কে ভালোবাসি।তার সুখের জন্য আমি সব করতে পারি।তাই তো তার কষ্ট আমার সহ্য হয়না।

তেমনিভাবে তোমার আব্বুও তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তিনি ভেবেছিলেন তুমি আমার সাথে না আরহানের সাথে বেশি সুখে থাকবে।এইজন্য তোমাকে আরহানের সাথে বিয়ে দিয়ে চেয়েছিল।তিনি কিন্তু কঠোর হয়েছেন তোমার সুখের জন্য।তুমি তো এখন সুখে আছো তাহলে উনি কেন তোমাকে ক্ষমা করবেন না।উনি নিশ্চয় তোমাকে ক্ষমা করবেন ”

“সত্যি বলছো তুমি।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

এইটুকু বলেই প্রিয়শা আবার কান্নায় ভেঙ্গে পরল। তাহমিদ আবার বলল,

“আবার কিসের কান্না।দেখো তুমি কান্না করছো আমি তোমার পাশে আছি।কিন্তু তোমার মা আর ভাইকে দেখো। ওদের পাশে কেউ নাই।এখন তোমাকেই ওদের পাশে থাকতে হবে।যাও ওদের কাছেনার চোখে পানি নয়।”

প্রিয়শা তাহমিদের বুক থেকে মাথা তুলে দেখল দূরে আদিল ও তার মা বসে কান্না করছে।তাহমিদ মৃদু হেসে প্রিয়শার কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“আমার প্রিয় এতটা দূর্বল নয়।আমি জানি আমার প্রিয় নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারবে।নিজের পরিবারকে সামলাতে পারবে।”

প্রিয়শা তাহমিদের কথার প্রেক্ষিতে কিছুই বলল না।দূরে অবস্থিত মা ও ভাইয়ের কাছে গেল।তাহমিদ দূর থেকে সবকিছু দেখছে।প্রিয়শা যেতেই আদিল কান্নায় ভেঙ্গে পরল।প্রিয়শা অনেক কিছু বলে আদিলকে চুপ করাল।ঠিক একইভাবে তার মাকেও চুপ করাল।তাহমিদ ওদের কাছে গেল না।দূর থেকেই সবকিছু দেখে গেল।বিপদের সময় সবাই ভেঙ্গে পরলে হয়না।কাউকে না কাউকে শক্ত হাতে সবকিছু ধরতে হয়।এখানে নাহয় প্রিয়শা সবকিছু শক্ত হাতে সামলে নিক।

ডাক্তার আসতেই তাহমিদ ডাক্তারের কাছে গিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল,

“এখন কি অবস্থা রোগীর। কি হয়েছে ওনার।”

ততক্ষণে প্রিয়শারা সবাই তাহমিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।ডাক্তার তাহমিদের উদ্দেশ্যে বললেন,

“অতিরিক্ত চিন্তা,অস্বাস্থ্যকর খাবার আর পরিমিত ঘুম না পারার কারনে একটু অসুস্থ হয়েছে।তবে চিন্তার কোনো বিষয় নেই।তবে ওনাকে যত্নে রাখতে হবে।নাহলে এভাবে চললে উনি কিন্তু পরবর্তীতে আরো অসুস্থ হবেন।”

আতিফা বেগম চোখের পানি মুছে বললেন,

“এখন থেকে আর কোনো অনিয়ম হবে না।আমি ওনাকে সবসময় যত্নে রাখব।আর কক্ষনো আর অযত্নে রাখব না।”

বলে তিনি আবার কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন।স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বোধহয় এইরকম হয়।যেকোনো খারাপ সময়ে পূর্বের রাগ, অভিমান ভুলে পাশে থাকা। আতিফা বেগম তাই করলেন।প্রিয়শা নিজের মা’কে আগলে নিল।তাহমিদ আবার ডাক্তারকে বলল,

“আমরা কি এখন ওনার সাথে কথা বলতে পারি।”

“দেখা করতে পারেন।তবে ওনাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে।তবে রোগীর কেবিনে বেশি গোলমাল কিংবা শব্দ করবেন না।”

“আচ্ছা আমরা বিষয়টি দেখব।”

ডাক্তার চলে গেল।আর সবাই এক এক করে সাইদুর রহমানের কেবিনে ঢুকলেন।তাহমিদ দূরেই দাঁড়িয়ে থাকল।এখন পরিবারের মানুষজনেরা একটু তাদের আবেগঘন সময় কাটাবে সে নাহয় দূর থেকেই উপভোগ করুক।

আতিফা বেগম সাইদূর রহমানের শিয়রের কাছে বসে চাপা কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন।তিনি বিলাপ করে বলতে লাগলেন,

“আমার জন্য সব হয়েছে।আমি যদি তোমাকে রাগ না দেখাতাম তাহলে এসব কিছুই হতো না।ওনার আজ এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী।আমি কেন তোমার যত্ন নিলাম না।”

সাইদুর রহমান যদি স্বজ্ঞানে থাকতেন তাহলে তিনি আতিফা বেগমকে কি বলতেন সেটা উনি ছাড়া কেউ জানে না।আদিল বাবার হাত ধরে বলল,

“আব্বু তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও।তারপর তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব।তোমার কথার অবাধ্য হবো না।আমি এতদিনে, এতক্ষণে বুঝে গেছি আব্বু তুমি ছাড়া আমরা নিঃস্ব।তুমি আমাদের বটগাছের ছায়ার মত।সেই বটগাছ ছাড়া আমরা কেউ বাঁচতে পারব না।তুমি শুধু একবার সুস্থ হয়ে উঠো আমি আর কিছু চাই না।আব্বুউউউ।”

আদিল কান্নায় ভেঙ্গে পরল।কে বলে ছেলেরা কান্না করতে জানে না।যখন প্রিয়জনরা নিজের থেকে দূরে থাকার কিংবা হারিয়ে ফেলার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে তখন নিজ থেকেই চোখের পানি বের হয়।
প্রিয়শা শুধু দেখেই যাচ্ছে। তারও নিরবে চোখের পানি বের হচ্ছে।যখন তখন সেটা শব্দে রূপ নিবে।এসব দেখে তাহমিদ এগিয়ে এসে সবার উদ্দেশ্যে বলল,

“ডাক্তার শব্দ করতে মানা করেছে।কিন্তু তোমরা যা করতেছ সেই হিসেবে তোমাদের এখানে থাকার দরকার নেই।আর এখানে থাকতে চাইলে কান্না করা যাবে না।”

তাহমিদের কথায় সবাই একটু হলেও থামল।তবে পুরোপুরি থামল না।পুরোপুরি কান্না থামানো কি যায় এই কষ্টের সময়ে।

——————-
চারদিকে পাখির কলরব।মুগ্ধ করছে পরিবেশ।সময়টা সকাল।কয়টা বাজে সেটা জানা গেল না।চারিপাশে মানুষ,যানবাহনের আওয়াজ আস্তে আস্তে করে বেড়েই যাচ্ছে।পুরো রুম জুড়ে নিঃশব্দতা বিরাজ করছে।সাইদুর রহমান পিটপিট করে চোখ খুললেন।বোঝার চেষ্টা করলেন কোথায় আছেন।চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন তিনি এখন হাসপাতালে অবস্থান করছেন।তিনি চোখ বন্ধ করলেন।ভাবলেন তাহলে কালকে রাতেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।

সাইদুর রহমান আবার চোখ খুলে দেখল আতিফা ও আদিল চেয়ারের মধ্যে গুটিসুটি মেরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।অপরদিকে তাকিয়ে দেখলেন প্রিয়শা তাহমিদের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।সাইদুর রহমান আবার চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন,

“সবাই তাকে নিয়ে কত চিন্তিত আর তিনি কখনো তাদের বোঝার চেষ্টাই করেননি। যদি তিনি আগেই বোঝার চেষ্টা করতেন তাহলে আজ এই অবস্থা হতো না।ছেলে-মেয়ে পরিবার নিয়ে সুখে থাকতেন।নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করার মত অস্বস্তিকর বিষয় আর দ্বিতীয়টি নেই।”

প্রিয়শা একটু পরপর চোখ খুলে সাইদুর রহমানকে দেখিছিল।স্বভাবতই চোখ খুলে দেখতে পেল তার আব্বু নড়ছে।তার মানে তার আব্বুর ঘুম ভেঙ্গেছে।প্রিয়শা দৌড়ে সাইদুর রহমানের কাছে গিয়ে আদুরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে ডাকল,

“আব্বু।”

প্রিয়শার মুখে আব্বু ডাক শুনে সাইদুর রহমান চোখ খুললেন।মেয়ের মুখে আজ কতদিন পর আব্বু ডাক শুনলেন।এই আব্বু ডাকের মধ্যে যে অনেক শান্তি,ভালোবাসা, আবেগ,অভিমান লুকানো থাকে তিনি বুঝতে পারলেন।
নিজের আব্বুকে চোখ খুলতে দেখে প্রিয়শা আর নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারল না।আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরল।কান্না করতে করতে হেচকি উঠে গেছে।প্রিয়শা আব্বুর চোখে মুখে গালে হাত দিয়ে কান্না করতে করতে বলল,

“আব্বু কেমন আছো এখন।তোমার শরীর খারাপের জন্য আমি দায়ী।আমি তোমার কথা শুনিনি তাই তোমার এই অবস্থা। তুমি একবারও আমাদের কথা ভাবলে না।এভাবে নিজের শরীরের অযত্ন করলে।তুমি জানো না তুমি ছাড়া আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই।তুমি কিভাবে পারলে।আসলে তোমার দোষ না দোষ আমার। আমার মত মেয়ে থাকলে যেকোনো বাবা-মায়ের এইরকম অবস্থা হবে।”

প্রিয়শার মুখে এসব কথা শুনে সাইদুর রহমান আঁতকে উঠলেন।তার মেয়ে নিজেকে কি বলছে।দোষ তো প্রিয়শার না দোষ তো নিজের।এভাবে বলে প্রিয়শা সাইদুর রহমানের অপরাধবোধ বাড়াচ্ছে সেটা কি প্রিয়শা জানে।সাইদুর রহমান প্রিয়শাকে কিছু বলার জন্য মুখে খুলতেই আদিল এসে বলল,

“আব্বু।তুমি ঠিক হয়ে যাও।আমি আর কোনোদিন তোমার অবাধ্য হবো না।তুমি যাই বলবে আমি তাই শুনব। তোমার বাধ্য ছেলে হবো।তোমার ছেলে তোমাকে বাইরে যা দেখায় সেটা আসল না।তোমার ছেলে তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে।তুমি শুধু ঠিক হয়ে যাও আব্বু আমি আর কিছুই চাইবো না।”

সাইদুর রহমানকে চোখ দিয়ে পানি বের হলো।ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসা দেখে তিনি অবাকের সাথে কষ্ট পেলেন।তিনি তো এদের মত করে ভালোইবাসতে পারেননি।কিভাবে তিনি ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকাবেন।তিনি যে আজ খুব অপরাধবোধে ভুগছেন।সাইদুর রহমান দুই ছেলে-মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

“তোমাদের কোনো ভুল নেই সব ভুল আমার।আমি তোমাদের ভালো করে বুঝতে পারিনি।আমিই সবসময় ভেবেছি তোমাদের বেস্ট দিতে।কিন্তু তোমাদের বেস্ট দিতে দিতে আমি তোমাদের ভালো-মন্দের মতামত নিতেই ভুলে গেলাম।তোমাদের ভালোবাসা উপভোগ না করে শুধুই..।”

সাইদুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন,

“আমাকে তোমরা দুইজন ক্ষমা করে দাও।তোমাদের কাছে আমি অপরাধী।জানি এই অপরাধের ক্ষমা হয় না।তবুও আমি ক্ষমা চাচ্ছি।তোমাদের এই ব্যর্থ বাবাকে শেষবারের মত ক্ষমা করে দিয়ে একটা সুযোগ দাও ভালো বাবা হওয়ার। ”

আদিল বলল,

“আব্বু তুমি এসব কি বলছো।তুমি কেনো আমাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাইবে।ক্ষমা তো আমরা চাইবো তোমার কথার অবাধ্য হয়েছি।”

সাইদুর রহমান চোখ দিয়ে আবার চোখের পানি বের হইল।তিনি দুই ছেল-মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

“আমার সোনারা এখন থেকে তোমাদের আব্বু অন্যরকম আব্বু হবে।তোমাদের সব শখ আহ্লাদ পূরণ করবে।তোমাদের আব্বু তোমাদের অনেক ভালোবাসে। তোমাদের আব্বু এতদিন যা করেছে সব তোমাদের ভালোর জন্যই করেছ।তবে সেটা ভুলভাবে করেছে।আজ থেকে সব ভুল ঠিক করার সময় এসেছে।ভালোবাসে তোমাদের আব্বু তার সন্তানদের। ”

প্রিয়শা তার আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আমরাও তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি আব্বু।এই ভালোবাসার পরিমাপ করা যাবে না।তবে মনে রেখ আমরা তোমাকে আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবাসি।”

#চলবে……………………