স্মৃতির শহর পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0
1004

#স্মৃতির শহর
#অন্তিম পর্ব
#তানিশা সুলতানা

তারপরের দিনই আদি রাইকে নিয়ে চলে যায় কক্সবাজার। বিহানকে আর দেখা যায় নি।
অহির জেদের কাছে হার মেনে বাবা মা রাজি হয়ে যায় বিয়েতে। বিহানের মাও রাজি। উনি চাইছেন এই সপ্তাহেই বিয়েটা হয়ে যাক।
আদি আর রাইয়ের সাথে যেতে পারেন না ওদের মা৷ কি করে যাবে মেয়ের বিয়ে রেখে। রাইয়ের খুব ইচ্ছে করছিলো অহিকে সবটা বলতে কিন্তু বলা ওয়ে ওঠে নি। শুধু অহিকে এই এটুকুই বলেছিলো “খুব ভালো থাকবি তোরা”

আজকে রাইয়ের সিজারের ডেট। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে রাই। একটু পরেই অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাওয়া হবে। আদি খুব নার্ভাস হয়ে গেছে। একা একা পুরোটা সামলাতে পারবে না। রাইয়ের রক্ত কম ছিলো কিছু দিন আগে রক্তেও দেওয়া হয়েছে।

আদি রাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

“আপনি আমাকে ছোট থেকেই ভালোবাসেন তাই না?
রাইয়ের প্রশ্নে থমথমে খেয়ে যায় আদি।
” আপনার ডাইরি পরেছি। আগে কেনো বলেন নাই আপনি আগে থেকেই চেনেন আমায়? আর কেনো গেছিলেন বিদেশে? না গেলে এসব কিছু হতোই না।
মুখ ভার করে বলে রাই।
আদি একটু হাসে।
সব কিছুই লেখা ছিলো ডাইরিতে।
“এখনও ভীষন ভালোবাসি।
রাইয়ের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলে আদি।
” আমিও আপনাকে ভালোবাসি।
আদি রাইয়ের কপালে চুমু দেয়।
“একদম ভয় পাবে না কিন্তু। আমি আছি তো।
” আপনি পাশে থাকলে আমি বিশ্বটাও জয় করতে পারবো।
“পাগলী
নার্স এসে তারা দেয়।
আদি ছেড়ে দেয় রাইকে। চোখের ইশারায় ভরসা দেয় আমি আছি। রাই আলতো হাসে।

করিডোরে পায়চারি করছে আদি। ভীষণ টেনশন হচ্ছে। পাশে কেউ থাকলে হয়ত এতোটা নার্ভাস লাগতো না। এমন একটা দিনে আদি একা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আদি।
ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পরে একজন নার্স সাদা তোয়ালে মুরিয়ে একটা বাচ্চা নিয়ে বের হয়। আদির কোলে দেয় বাচ্চাটাকে। আদি বাচ্চাটার কানে র কাছে মুখ নিয়ে সালাম দেয়।
“আমার ওয়াইফ
” সুস্থ আছে। কিছুখন পরে কেবিনে সিফট করা হবে।
আলহামদুলিল্লাহ

সন্ধার দিকে বাবা মা চলে আসে আদির বাচ্চাটাকে দেখতে। রাই তো কোলেই নিতে পারে না বাবুকে। খালি ভয় পায় যদি পরে যায়। একদম পুচকি হয়েছে। আদিই রেখেছে এতখনে। একজন নার্সের সাহায্যে বাচ্চাকে খাইয়েছে।
মা এসেই কোলে করে ঘুরছে।
বাবা খুব করে আদিকে রিকোয়েস্ট করছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আদি যেতে নারাজ।
পরে জানায় বিহান অহিকে নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছে আজকে। আদির খারাপ লাগে। নিজের বোনের সাথেই যোগাযোগ রাখা ছেড়ে দিয়েছে ও। নিজের ওপর খুব রাগ হয়।

তিনদিন পরে রাইকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসা হয়। মেয়েটার মাম রেখেছে আয়াত। নামটা আদি রেখেছে নিজের নামের সাথে মিলিয়ে।
রাইয়ের বাবা এসেও দেখে যায় নাতনির মুখ।

পাঁচ বছর পরে
পাঁচ বছর বাদে আজকে বিহান আর অহি দেশে ফিরছে কাউকে কিছু না জানিয়ে। সারপ্রাইজ দেবে বলে।
অহি বিহানের এখনো কোনো সন্তান হয় নি। বিহান মানতে পারছিলো না অহিকে। বারবার অহিকে রিকোয়েস্ট করেছিলো ওর জীবন থেকে চলে যাওয়ার জন্য। অহিও কম যায় না আঠার মতো লেগে ছিলো। ভালোবাসা আদায় করেই ছেড়েছে বিহানের থেকে। এর জন্য পাঁচটা বছর লেগে গেছে।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই আদি নেমে পড়ে। বাড়িতে না ঢুকেই এদিক বাগানের দিকে যায়। কেনো গেলো নিজেও জানে না।কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে বাগানটাতে একটু হাঁটতে। কতো বছর পরে পা রাখলো স্মৃতির শহরে। কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে। এই বছরে কিছুই ভুলতে পারে নি বিহান।
অহি বিহানকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। যাক না একটু ঘুরে আসুক।
লাগেজের কান ধরে অহি শাশুড়ীকে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।

বাগানের কাছে যেতেই একটা ফুটফুটে মেয়ে এসে বিহানে জড়িয়ে ধরে। হকচকিয়ে যায় বিহান।
নিচের দিকে তাকায়। গোলাপি ফ্রক পড়া পিচ্চি মেয়েটা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
বিহান হাঁটু মুরে বসে। খুব চেনা লাগছে মেয়েটা। কতো মায়াবী মুখটা। নিজের মুখের সাথে বেশ মিল খুঁজে পাচ্ছে বিহান।

বিহান পিচ্চিটার চোখের পানি মুছে দেয়।
“মামনি কি হয়েছে তোমার?
আদুর গলায় বলে আদি।

” মা মেরেছে।
নাক টেনে বলে পিচ্চিটা।
“আমাকে বাবার কাছে দিয়ে আসবে তুমি?
বিহানের হাত ধরে বলে।
বিহান মুচকি হাসে।
” কোথায় থাকে তোমার বাবা?
“এখানেই থাকে। এখন আমার জন্য চকলেট আনতে গেছে।
রাস্তার দিকে ইশারা করে বলে পিচ্চি।
বুকের ভেতর ধক করে ওঠে বিহানের। বুঝে যায় বাচ্চাটার পরিচয়।
জাপ্টে ধরে পিচ্চিটাকে বুকের ভেতর হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
অনেক করে দেখতে চেয়েছিলো বাচ্চাটার ছবি। কেউ দেখায় নি। অনেক রিকোয়েস্ট করেছিলো আদিকে এক নজর দেখার জন্য। দেখায় নি আদি।
আয়াত ভরকে যায়। কখনো কাউকে কাঁদতে দেখে নি ও।
” তুমি কাঁদছে কেনো? আমার বাবার মতো হতে পারো না? আমার বাবাকে আম্মু দাদু এতো বকে তবুও কাঁদে না।
মুখ ভার করে বলে আয়াত।
“তুই বুঝবি না রে।
কাঁদতে কাঁদতে বলে বিহান।
আয়াত রেগে যায়। বিহানের থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়।

” একদম মা বলবে না আমায়। আমাকে শুধু আমার বাবা মা বলবে।
বিহান আলতো হাসে। চোখের পানি মুছে ফেলে। কে বলেছে রক্তের টান থাকে? যে বলেছে সে মিথ্যে বলেছে। রক্তের টান থাকলে অবশ্যই আয়াত বিহানের বুকে ঘাপটি মেরে থাকতো।

“আয়াত আয়াত বাবা এসেছে
রাই মেয়েকে ডাকতে ডাকতে আসছিলো বিহানকে দেখে থমকে যায়। রাইকে দেখে বিহান উঠে দাঁড়ায়। কতোদিন পরে দেখছে।
রাই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তোলে।
” কেমন আছেন ভাইয়া?
বিহান আলতো হাসে। উওর দেয় না।
“ভালোই আছো না?
” শুধু ভালো?
খুব ভালো আছি।
একটু থামে রাই।
“আপনার থেকে ধোকা খাওয়ার পরে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম মরে গেলেই শান্তি পাবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তখন মরে গেলে অনেক কিছু মিস করে যেতাম।আল্লাহ না চাইতেই অনেক দিয়েছে আমায়। তারজন্য সব সময় আলহামদুলিল্লাহ বলি।

আয়াতকে কোলে তুলে নেয় রাই। হাঁটতে থাকে।
বিহান ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
” ছোট্ট একটা ভুল আমাদের জীবনটাকেই পাল্টে দেয়।

ততখনে আদিও চলে এসেছে।আয়াতকে রাই কোলে নিয়েছে বলে চোখ রাঙিয়ে তাকায় রাইয়ের দিকে। রাই জিভ কামড়ে আয়াতকে নামিয়ে দেয়।
“রাই তোমার ছয় মাস চলছে এখন এভাবে কেনো কোলে নাও ওকে?
বিরক্ত হয়ে বলে আদি।
” আর ছোট মা তুমি কেনো মায়ের কোলে ওঠো? ভাইয়া কষ্ট পায় তো।
আয়াত হাত বাড়িয়ে দেয় আদি কোলে তুলে নেয়।
“আর কখনো মায়ের কোলে উঠবো না। মা বকে আমাকে। তুমি যেখানেই যাবে আমাকে নিয়ে যাবে ওকে?
আদি হাসে।
” ওকে সোনা
আয়াতের কপালে চুমু দিয়ে বলে আদি।
“এখন তে আমি পর হয়ে গেছি। কেউ না আমি।
রাই গাল ফুলিয়ে বলে।
আদি রাইয়ের গাল টেনে দিয়ে রাইয়ের কপালে চুমু দেয়। মুচকি হেসে গলা জড়িয়ে ধরে রাই।
আদি আয়াত আর রাইকে চকলেট ভাগ করে দেয়।

ওরা দুজনই চকলেট ছিড়ে আগে আদির মুখে দেয় পরে দুজন খায়।

” আমার ভালেবাসার কুড়োঘর। সারাজীবন এমন থাকবে। কারণ আমি ভালোবেসে আগলে রাখতে জানি। আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি সম্মান করি।

সমাপ্ত