হঠাৎ প্রণয় পর্ব-১৮+১৯

0
315

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টাদশ পর্ব

তেসরা নভেম্বরের সকাল। আজকে আপুর গায়ে হলুদ হবে। তাই ভোর ভোরই বাড়িটা রমরমা সাজে সেজে উঠলো। বাসার গ্যারেজে অনুষ্ঠান হবে। সেদিকে সাজসজ্জার কাজ চলছে।

গতকালকেই সব আত্মীয়স্বজন চলে এসেছে। সারা বাড়ি ভর্তি মানুষজন। বসা, শোয়া সবকিছুতেই সমস্যা হচ্ছিল। সব সমস্যার মাঝেও একটা আনন্দ আছে যে আপুর বিয়ে।

তানিমা আপু ও সব মেয়ে কাজিনরা আমরা একসাথে ঘুমাতে শুয়েছিলাম। সকালে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরেই মেহেদী দিতে বসে গেলাম। আপুর ফ্রেন্ডরাও সকাল সকাল এসে হাজির হয়েছে।

দুহাত ভরে মেহেদী দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। অথৈ আপুর মেহেদী সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে। এভাবেই ক°য়ে°দিদের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি আর অয়ন আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ডাইনিং এ।

হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ বলল,
“কি রে তন্বী, শেষে আমার ভাইকে কাবু করেই নিলি।”

পেছন ফিরে অথৈ আপুকে দেখে একপ্রকার ঝা°পটে ধরতে গেলে আপু আমার হাত ধরে বলল,
“আস্তে, লে°প্টে যাবে।”

আমি হেসে সরে আসলাম।
“কেমন আছো আপু?”
“ভালো আছি। তোর কি খবর?”
“এইতো ভালোই।”

আপু আমার গা ঘে°ষে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া তোকে পছন্দ করে, তন্বু?”
“কে বলেছে?”
“ভাইয়াই বলেছে। জব পেয়েই আমাকে জানিয়ে দিয়েছে।”

আমি লাজুক হাসলাম। অথৈ আপু বলল,
“আমি কিন্তু আসতে চাইনি। শুধুমাত্র আমার এক এবং একমাত্র ভাবিটাকে দেখতে এসেছি।”

আপুর মুখোমুখি রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
“আসতে চাওনি কেন?”
“আমি যে একা নই, তাই আসতে চাইনি।”
“মানাফ ভাইয়াও আসবেন।”
“মানাফ আসতে পারবে না, ওর অফিসে কাজ আছে।”
“ওহ, এজন্যই আসতে চাওনি?”

আপু লাজুক হেসে বলল,
“আরে না, আসলে আমি প্রেগন্যান্ট।”

লাফিয়ে উঠে আপুর গালে একটা চুমো দিয়ে বললাম,
“আমি খালামনি হবো, ইয়ে।”
“উহু, মামী হবেন।”

কথাটা বলে আপু চলে গেল। আমি হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়ালাম। মিসেস আয়মান রহমান হবো আমি, সবাই কি নিশ্চিত? আমি তো বাবাকে নিয়ে ভ°য় পাচ্ছি।

সারাদিন ব্যস্ততায় কাটলো। এর এটা, ওর ওটা, সবটাই দেখছি আমি। বিকালে জাহানারা আন্টি আর আনোয়ার আংকেল এলেন। আম্মু আন্টির সাথে কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু একটু দূরত্ব রেখে। এখন আর নতুন কোনো ঝা°মে°লা না হোক।

সন্ধ্যায় হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়েছি। মানহা সাহায্য করলো শাড়ি পড়তে। তারপর আমি মানহাকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছি।

“তনুমনু, তুই সিংগার ইত্তাজা রহমানকে চিনিস?”
“ইত্তাজা? হ্যাঁ, চিনি তো।”

মানহার শাড়ির কুঁচি ঠিক করছি। মানহা নিচু হয়ে বলল,
“উনার একটা গান আছে না পৃথিবী যাক জেনে আমি পড়েছি প্রেমে?”
“হু।”
“প্রেমে পড়ার পর থেকে ওটাই আমার মনে বাজছে।”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম,
“কিন্তু তুই ঠিক কার গলায় ঝু°লে°ছিস বল তো।”

মানহা মুখের সামনে তু°ড়ি বাজিয়ে বলল,
“সেটা সারপ্রাইজ, সময় মতো পেয়ে যাবি।”

মানহা বেরিয়ে গেল। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,
“সবাই আমাকে সারপ্রাইজই দেয়। এখন নাকি মানহাও দিবে।”

মানহাকে নিয়ে খুব একটা ভাবলাম না। ছোটবেলা থেকেই এর ওর ক্রা°শ খেয়ে বেড়ানোই ওর স্বভাব। বলা যায় ওর প্রধান খাবারই ক্রা°শ।

আপুকে নিয়ে অনুষ্ঠানের স্থানে গেলাম। ঠিক যা যা থাকলে হলুদের অনুষ্ঠান পূর্ণতা পায়, সবটাই আছে। একটা স্টেজে আপুকে বসানো হয়েছে, ঠিক তার উলটো দিকে আরেকটা স্টেজ। ওখানেই হবে নাচ-গান।

সবই পূর্ণ, অপূর্ণতা শুধু আমার বেলায়ই। অয়ন নেই, সে আসবে না। হয়তো এখনো অফিসে। আজ বৃহস্পতিবার, অফিস থাকাটাই স্বাভাবিক।

বাবা সকাল থেকে অনেক কাজ করেছে। এ বয়সে এতো কাজে উনি ক্লান্ত। আমি এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে বাবার হাতে দিয়ে বললাম,
“মামারা আছে, চাচ্চুরা আছে, কেন সারাদিন এতো কাজ করেছেন?”

আমাকে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন,
“যাতে তোমাদের কষ্ট না হয়।”

বাবা চেহারার দিকে তাকালাম। ক্লান্ত শরীরেও হাসছেন। সত্যিই বাবারা মেয়েদের জীবন অনুকূলে আনতে কত ক°ষ্টই না করে, এ ক°ষ্টের পরিমাণ বাবা ছাড়া আর কেউ জানে না আর বাবারা তা জানতেও দেন না।

আপু স্টেজ থেকে হাতের ইশারায় আমাকে ডাকলো। চুপচাপ গিয়ে পাশে বসলাম। আপু সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রেগে আছিস আমার উপর?”
“না। আর কোনো রাগ নেই আমার।”

কাঁদোকাঁদো সুরে আপু বলল,
“তবে হলুদ লাগাবি না আমাকে?”

একটু হলুদ আপুর হাতে লাগিয়ে একটা গোলাপ এনে খোঁপায় পরিয়ে দিয়ে বললাম,
“খোঁপায় থাকুক সতেজ ফুল,
আপুনি থাকুক সুখে।
ফুলপরিরা কাঁদে কেন
আমার বোনের দুখে।
সে যে এখন ফুলের রানী
রাজার মনে গেল,
রাজার তোঁতা রাগ করেছে
রানী কেন এলো।”

আপু হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এতোটাই খুশি যে সে কান্নাই করে দিয়েছে।

আপু ঠিক হয়ে বসে নাক ঝে°ড়ে বলল,
“আরে, অয়ন ভাই যে? কেমন আছেন?”

অয়ন ভাই? পেছনে তাকাতে দেখি সত্যিই অয়ন। সবুজ পাঞ্জাবি আর সাদা জিন্স পড়নে, মুখে অফিস ফেরত ক্লান্তিও আছে, তবুও কি সুন্দর হাসছে।

“তানিমা, কেমন আছিস?”
“ভালো।”

আপুর অন্যপাশে এসে বসে আপুর হাতে হলুদ লাগিয়ে বলল,
“আজ তোকে অসাধারণ লাগছে।”

কথাটা কাকে বলেছে ঠিক বোঝা গেল না। কারণ অয়নের দৃষ্টি আমার দিকে। আপু ঠিকই দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো। হুট করে এমন ঘটনায় লজ্জা পেলাম। স্টেজ থেকে নেমে একটু সরে গেলাম আমি।

মানহা আর আরেক ফ্রেন্ড তাইবাকে নিয়ে উঠে গেলাম বিপরীতে থাকা স্টেজে। মানহা বলল,
“এখনই কি আমাদের নাচ?”
“এখনই হবে, এখন না হলে আর কখনোই হবে না।”

তাইবাকে বললাম,
“গান ছাড়তে বল।”

“নি°শা লাগিলো রে, নি°শা লাগিলো রে
বাঁকা দুই নয়নে নি°শা লাগিলো রে
ও নি°শা লাগিলো রে, নি°শা লাগিলো রে
বাঁকা দুই নয়নে নি°শা লাগিলো রে
হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে ম°জিলো রে
হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে ম°জিলো রে
নি°শা লাগিলো রে, নি°শা লাগিলো রে
বাঁকা দুই নয়নে নি°শা লাগিলো রে।”

গানের তালে তিনজনে নাচ হলো। অয়ন একদম স্টেজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নাচ শেষে ওদের আগেই আমি নেমে গেলাম। সোজা চলে গেলাম স্টেজের পেছনের অংশে।

অয়ন পিছুপিছু আসলো। নাচের কারণে এখনো নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অয়নকে কিছু বলার আগেই কাছে টে°নে নিলো। তার ডানহাতে থাকা হলুদগুলো আমার মুখে-গলায় লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“নে°শা কি শুধু তোর লেগেছে? আমি তো মা°তা°ল হয়ে গেছি।”

অয়নের হাতটা সরিয়ে ওকেও একটু ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে বললাম,
“তবে দূরে থাকো। আর তোমার সাথে এমনিতেও আমি কথা বলবো না।”
“কেন কেন?”
“মিথ্যা বলেছো তাই।”

অয়ন কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“মিথ্যা?”
“হুম, বলেছে একেবারে আমাকে নিতে আসবে। অথচ আপুর বিয়েতে এসে বসে আছো।”

অয়ন শব্দ করে হাসলো। টিস্যু বের করে হলুদ মুছতে আসলে বাধা দিলাম। অয়ন বলল,
“এসেছি বলে খুশি হসনি বুঝি?”
“তোমাকে দেখলেই খুশি থাকি।”

অয়ন আবারো হাসলো।
“আন্টি কল দিয়েছিল। না আসলে তো খারাপ দেখায়, তাই আসা।”
“আমাকে নিয়ে কিছু বলেছে?”
“শিয়ালের কাছে কি মুরগির খোঁজ কেউ দেয়?”

বলেই অয়ন চলে গেল। এটা কেমন কথা বলল সে? বাবা কি তাকে এতো খারাপ ভাবে?

আবারো ফিরে এসে বলল,
“সরি, হলুদ তো তোর পছন্দ না। তবুও লাগিয়ে দিলাম।”

ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
“আজ থেকে পছন্দ, অনেক বেশি পছন্দ। তুমি লাগিয়েছো যে।”

আমার গালটা ওর গালে ঘ°ষে দিয়ে চলে আসলাম। শুধু আমি না, আজ অয়নও লজ্জা পেয়েছে। ওর আলতো হাসি তো সেটাই জানান দিলো।

আপুর পাশে এসে বসে বললাম,
“কেমন লাগলো?”

আপু আমার দিকে তাকিয়ে একটু রাগি সুরেই বলল,
“তোকে তো অসাধারণ লাগছে, সেটা তো অয়ন ভাই বলেই দিলো।”
“আমি সেটা বলিনি। নাচ কেমন লাগলো?”
“ভালো।”

আপু আমার গালে হাত দিয়ে বলল,
“তুই হলুদ লাগিয়েছিস?”
“আ.. ওই অয়ন।”

আমি থেমে গেলেও আপু বিষয়টা বুঝে গেল। একটু গম্ভীর গলায় বলল,
“একটু দূরত্ব রেখে চল।”
আমি কিছুই বললাম না। আপু কেন এমন আচরণ করছে ঠিক বুঝে উঠলাম না।

আপুর এক ফ্রেন্ড, নাবিলা। সে স্টেজে এসে আমাকে ডেকে বলল,
“তন্বী, একটা ছেলে গেইটের বাইরে তোমাকে ডাকছিলো।”

তানিমা আপু বলল,
“অয়ন ভাইকে বলিস বারবার এভাবে ডাকাডাকি না করতে। বাসায় আত্মীয় আছে, এসব খারাপ দেখায়।”
কিছু না বলে উঠে চলে গেলাম।

গেইরের বাইরে এসে কাউকে দেখলাম না। কপাল কুঁচকে গেল, মে°জা°জও খারাপ হয়ে গেছে।

এদিকে পাত্রের বাড়ি থেকে উপহার নিয়ে মেহমানরা চলে এসেছে। বিরক্ত হয়ে ভিতরে যাওয়ার সময় পেছন থেকে কেউ বলল,
“তন্বী, একটু দাঁড়াও।”

ফিরে দেখি ইত্তাজা। ডানহাতে সি°গা°রে°ট ধরে রেখেছে। একটু সরে এসে বললাম,
“আ.. জি, বলুন। আপনি আমাকে ডেকেছেন?”
“হ্যাঁ।”

কয়েকবার সি°গা°রেটের দিকে তাকালে ইত্তাজা সি°গা°রেটটা ফেলে পায়ে পি°ষে ফেললো। বলল,
“সরি।”
“ডেকেছেন কেন?”
“এমনিই, কথা বলার জন্য। কেমন আছো?”
“ভালো।”

ইত্তাজা একটু হেসে বলল,
“তুমি নাকি আজকে পারফর্ম করেছো? লেইট হয়ে গেছে তাই দেখা হলো না।”
“ইয়োর ব্যা°ড লাক।”
“হয়তো।”

এর মধ্যে আয়েশা আপু এসে ধ°মক দিয়ে বলল,
“তনু, তুই এখানে কি করিস? মেহমানরা সব চলে আসছে।”
“আসছি আমি, যাও।”

আয়েশা আপু চলে গেলে আমি ইত্তাজাকে বললাম,
“চলুন, ভিতরে যাই।”
“হুম।”

আমি আগে আগে ভিতরে চলে আসলাম। গেইটের কাছে মানহা দ্রুত এসে বলল,
“আন্টি ডাকছে, দৌড়ে যা।”

আমি দ্রুত ভিতরে চলে আসলাম। রুম্মান ভাইয়ার বাসা থেকে আসা মেহমানদের আমাদের ফ্ল্যাটে বসানো হলো।

ডাইনিং এ এসে শরবত গ্লাসে ঢালছি। আম্মু পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

“অয়নের কাছ থেকে দূরে থেকো। ওকে আসতে বলেছি বলে তুমি আবার ওর সাথে মেলামেশা শুরু করে দিও না।”

আম্মুর কথায় উত্তর দিলাম না। আপন মনে নিজের কাজ করছি। ট্রে-তে গ্লাসগুলো সাজিয়ে নিতেই আম্মু আমার খালাতো বোন ফারিহাকে দিয়ে মেহমানদের রুমে পাঠিয়ে দিলো।

ফারিহা আপু চলে গেলে আম্মু রেগে বলল,
“আমার কথা কি কানে যাচ্ছে না?”
“শুনেছি তো।”
“অয়ন তো স্টেজের সামনেই দাঁড়িয়েছিল।”

একটা নিশ্বাস ছেড়ে নিচুস্বরে বললাম,
“তাকে আসতেই কেন বললে আম্মু? না আসলেই তো হতো।”
“মুখে মুখে তর্ক করো না।”

মাথানিচু করে বললাম,
“সরি, কে কোথায় দাঁড়াবে তা তো আর আমি ঠিক করতে পারবো না।”

বলে সোজা নিচে চলে আসলাম। অথৈ আপু, আয়েশা আপু, তানিমা আপুর সাথে স্টেজে বসে আছে। আপুর ফ্রেন্ডরা সবাই দুষ্টুমিতে মেতেছে। আমি প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে এদিক ওদিক দেখছি। হঠাৎ অয়ন এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।

“কিরে, কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলি?”

মাথা নেড়ে বললাম,
“কোথাও না।”

হঠাৎ করে বলে উঠলাম,
“ইত্তাজা ভাইয়া সি°গা°রেট খায়?”

অয়ন হেসে ইত্তাজার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“অনেক আগে থেকেই উনার এই অভ্যাস আছে।”

অয়নের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“তুমিও খাও?”
“না, আমি ট্রাই করেছিলাম, ঠিক স্যুট করেনি।”
“ট্রাইও করেছিলে?”

অয়ন হাসলো। কিছু বলার আগেই জাহানারা আন্টি এসে হাজির হলো, সাথে অথৈ আপু। আমি মুচকি হেসে বললাম,
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি। কেমন আছেন?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আমি ভালো আছি। তোমার কি খবর?”
“এইতো আন্টি ভালোই।”

আন্টি হাহুতাশ করে বলল,
“আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলেটার সাথে তানিমার বিয়ে দিয়ে মিতুর সাথে সম্পর্কটা আরো গভীর করবো। তার আগেই তানিমার বিয়ের খবর পেলাম। (একটু থেমে) যাক, আল্লাহ যার তাকদিরে যাকে রেখেছে।”

অথৈ আপু অয়নের হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলল,
“আম্মু, আন্টির কিন্তু দুই মেয়ে। ছোট মেয়েও তো কোনোদিকে কম না।”

আমি চমকে তাকালাম আপুর দিকে। আপু হাসছে, অয়নও মুখের সামনে হাত দিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,
“আন্টি, আমি একটু আসছি।”

দ্রুত চলে এলাম। একটা চেয়ার টেনে বসে আবারো সেদিকে তাকিয়ে দেখি আন্টি আরেকজন মহিলার সাথে কথা বলছে আর অয়ন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। লজ্জায় আর ওর দিকে তাকাতে পারলাম না।

মানহা এসে পাশে বসে বলল,
“কিরে, বিয়ে আপুর নাকি তোর আমি তো পুরাই কনফিউজড।”
“কেন?”
“আপু তার ফ্রেন্ডদের সাথে নাচানাচি করছে আর তুই এখানে বসে লজ্জা পাচ্ছিস।”

শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা দিয়ে বললাম,
“আমার বিয়ের দিনটা শুধু আসতে দে, দেখ নাচানাচি কাকে বলে।”

একটু থেমে ইত্তাজার দিকে চোখ পড়তেই মানহাকে বললাম,
“ওই যে সিংগার ইত্তাজা।”

মানহা ওদিকে তাকিয়ে বলল,
“চিনি তো আমি। আর আজকে কথাও হয়েছে।”
“কথা কখন হলো?”
“গেইটের কাছে।”

আমি মানহার কাছে গিয়ে বললাম,
“তার গান যে দিনরাত গাইছিস সে জানে?”
“না।”

এর মধ্যে ইত্তাজার গানের সুর কানে এলো।
“বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হৃদয়
কতটা তোমায় ভালোবাসি।
চলতে গিয়ে মনে হয়
দূরত্ব কিছু নয়
তোমারি কাছেই ফিরে আসি।
তুমি তুমি তুমি শুধু এই মনের
আ°না°চে কা°না°চে,
সত্যি বলনা কেউ কি প্রেম হীনা
কখনো বাঁচে।”

গানের পুরো সময়টাতে ইত্তাজার দৃষ্টি আমাদের দিকে ছিল আর মানহার দৃষ্টি স্টেজের দিকে। মানহাকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি, ওর প্রত্যেকটা চাহনি আমার মুখস্ত। তবে আজকের চাহনিটা অন্যদিনের চেয়ে আলাদা। তবে কি মানহার মনে প্রেমের দোলা সত্যিই লেগেছে?

চলবে……

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ঊনবিংশ পর্ব

চৌঠা নভেম্বর, ২০২২, শুক্রবার। আজকের দিনটা হাইলাইট কেন? আজ আমার আপুর বিয়ে। তানিমা আপু আজ বউ সাজবে। লাল বেনারসি, গহনা, লাল দোপা°ট্টা দিয়ে একদম খাঁটি বাঙালি সাজ।

সকাল বেলায়ই পার্লার থেকে বেশ কয়েকজন আপু আসলো। উনারাই পুরো সাজানোর দায়িত্ব নিয়ে নিলো। আমার আর কোনো কাজই রইলো না।

রেডি হতে মানহাকে নিয়ে আম্মুর বেডরুমে চলে আসলাম। মানহা গোলাপী রঙের গাউন পড়েছে আর আমি পড়েছি লাল লেহেঙ্গা।

মানহা আড়চোখে আমাকে দেখে বলল,
“বিয়ে কি তোর লাগছে?”
“না তো।”
“তাইলে লাল লেহেঙ্গা পড়ছিস কেন?”

আমি মানহার কাছে এসে নিচুস্বরে বললাম,
“অয়নকে পাগল করার জন্য।”

মানহা হুট করে কা°শতে কা°শতে সরে গেল। পরে বিছানায় বসে বলল,
“অয়ন ভাই আজকে হা°র্ট অ্যা°টা°ক করবে, শিউর।”
“ছি, এসব কি বলিস? আমার অয়ন ভালো থাকুক।”

দুজনে সেজেগুজে বাইরে আসলাম। লেহেঙ্গার ওড়না আমিও মাথায় পড়েছি। পাশাপাশি আমাকে আর আপুকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না কে কনে আর কে কনের বোন।

আজকের অনুষ্ঠানটাও বাসার গ্যারেজেই হবে। সাজানো গ্যারেজটাকে দেখে মনেই হচ্ছে না এখানে সারি সারি গাড়ি থাকে।

আপুকে স্টেজে বসিয়ে আমি ছুটে গেলাম অয়নকে খুঁজতে। আপুর ফ্রেন্ডরা আর আমার কাজিনরা এতো সুন্দর করে সেজেছে যে ওদেরকে যে কেউ প্রিন্সেস উপাধি দিয়ে দিবে। একেকজনকে একেকরকম সুন্দর লাগছে।

অয়নকে দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। আমাকে দেখে সে কি হা°র্ট অ্যা°টাক করবে, ওকে দেখে তো আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।

কালো শার্ট আর কালো ফরমাল প্যান্ট পড়েছে সে। চুল গোছানো, দাঁড়িগুলো সুন্দর শেইপে কাটা, চোখে আবার চিকন ফ্রেমের চশমা পড়েছে। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, যেন আমার পুরো পৃথিবী এক জায়গায় এসে থমকে গেছে।

আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে এমন এক হাসি দিলো যে হুট করে দুএকটা হা°র্টবি°ট মিস করেও টের পেলাম না।

“কেমন লাগছে, তনুশ্রী?”

সে সামনে আসতেই একটা মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে এলো। আমি কিছু না বলে চলে গেলাম। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমার নিশ্চিত মৃ°ত্যু।

বাসা থেকে বেরিয়ে একদম মেইন রাস্তার কাছে চলে আসলাম। অয়নও দ্রুত গতিতে আমার কাছে এসে বলল,
“কিরে? মন খারাপ?”

তার দিকে ফিরে চুপচাপ তাকিয়ে আছি। অয়ন আমার দৃষ্টি অনুসরণ করার চেষ্টা করলো।

“অয়ন?”
“হুম।”
হঠাৎ ডাকে চমকে উঠে বলল।

আমি একটু সরে গিয়ে মাথানিচু করে ফেললাম। ওর দিকে তাকালে তাকাতেই ইচ্ছা করছে, না তাকালেও তার চেহারাও চোখে ভাসছে৷ কতটা অস্বস্তিতে আছি আমি কেবল আমিই জানি।

অয়ন হয়তো আমার অস্বস্থিটুকু বুঝেছে। সে বলে বসলো,
“বিয়ে হয় আধঘন্টায়-একঘন্টায় আর অনুষ্ঠান হয় দুই-তিনদিন ধরে।”

আমি হেসে উঠলাম। অয়নের বি°র°ক্তি প্রকাশে বললাম,
“ভালো হয়নি কি? এই যে বিয়েতে এতো সুন্দরী আছে।”
“সো হোয়াট, আমার সুন্দরী তো পুরাই সুন্দরবন হয়ে গেছে।”

চোখ মুখ কুঁচকে বললাম,
“সুন্দরবন হয়ে গেছে মানে কি বোঝাতে চাইলে?”
“মানে যা বুঝিস তাই।”

রাগে গি°রগি°র করে চলে গেলাম আপুর কাছে। আমার রাগি ভাব দেখে আপু বলল,
“কি হয়েছে রে?”
“প্রশংসা করার অনেক ওয়ে আছে, বাট হোয়াট এবাউট সুন্দরবন?”

কপাল কুঁচকে বলল,
“বুঝলাম না।”
“আমাকে সুন্দরবন বলেছে। (একটু থেমে) ওয়েট, এটা কি প্রশংসা আদৌ?”

আপু হেসে দিলো, সাথে থাকা আপুর বান্ধুবীর দল সবগুলো একসাথে হো হো করে উঠলো।

রাগ দেখিয়ে বললাম,
“সব শিয়ালের এক ডাক, হু°ক্কা°হু°য়া।”

ফিরতে নিয়েই মানহার সাথে ধা°ক্কা লাগলো। এতোক্ষণ ও আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো।

মানহা হেসে বলল,
“ওহো, সুন্দরবন।”
“এই আসলো আরেকজন। সারাদিন আমার থেকে দূরে দূরে।”

মানহা চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“কে কার থেকে দূরে থাকে দেখা হইছে আমার। (একটু থেমে) বাই দা ওয়ে, আমাদের পারফরম্যান্স কি অনুষ্ঠানের শেষে হবে?”
“না তো।”

সাউন্ড বক্সের গান থামিয়ে আমাদের নাচের এনাউন্সমেন্ট করা হলো। অয়ন ভিতরে এসে আপুর একপাশে গিয়ে বসলো।

আমি ভাব নিয়ে স্টেজে উঠে গেলাম। আমি আর মানহা দুজনে একসাথে নাচবো। মিউজিক বেজে উঠলো,
“চোখ পরেছে তোমার চোখে
কি আর হবে মুখটা ঢেকে,
হওয়াতে এই মনটা দিলাম ভাসিয়ে
দাও না তুমি আলতো করে একটু ছুঁয়ে
এসোনা প্রেমের পথে যাব হারিয়ে
এসোনা প্রেমের পথে যাব হারিয়ে।”

আমি স্টেজ থেকে নেমে আপুর অন্যপাশে গিয়ে বসলাম। মানহা এসে বলল,
“অয়ন ভাই?”
“কি?”
“আমার এই সুইট, কিউট তনুমনুটাকে নাকি কেউ সুন্দরবন বলেছে। এটা কি ঠিক?”

অয়ন মুখ টিপে হেসে বলল,
“না, একদম ঠিক না। খুব অন্যায়।”
“সেটা তো আমিও বলছি।”

অয়ন আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আংকেলকে বলি একবারে দুইমেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে, খরচও করবে আর কষ্টও কম হবে।”
“হা হা, বলো গিয়ে।”

আপু চোখ রা°ঙিয়ে তাকিয়ে আছে। আপুকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে রাগ দেখিয়ে বললাম,
“আমি ছাদে যাচ্ছি, কেউ গেলে আসতে পারে।”

আমি গিয়ে লিফটে উঠলাম। দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই অয়ন এসে পা দিলো। সে ভিতরে ঢুকতেই আমি সরে দাঁড়ালাম।

“জাস্ট, কবুল বলার দূরত্ব তনুশ্রী।”

চোখমুখ কুঁচকে দাঁত খিঁ°চি°য়ে বললাম,
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তবে কবুল বলো।”

অয়ন আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি ছটফট করছি না, কথাও বলছি না। অনুভূতিশূন্য আমি শুধু চাচ্ছি সময় থেমে যাক। অয়ন এভাবেই আমার কাছাকাছি থাকুক।

টপ ফ্লোরে এসে লিফট খুললো। অয়ন বেরিয়ে গেল। বড়বড় দুইটা নিশ্বাস নিয়ে আমিও বেরিয়ে গেলাম। ছাদে গিয়ে বললাম,
“রাতে কোথায় ছিলে?”
“আমি বাসায় চলে গিয়েছিলাম। আব্বু আর আমি আমার বাসায় ছিলাম।”
“আর আন্টি?”
“এখানেই, কেন তুই টের পাসনি?”
“আসলে ক্লান্ত ছিলাম, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

আমি ছাদের একটা গাছ থেকে একটু একটু করে পাতা ছিঁ°ড়°ছি। অয়ন পেছন থেকে আমার মাথার ওড়নাটা ফেলে দিয়ে বলল,
“পাগল করার অনেক উপায় ছিল, কিন্তু এটাই কেন বেছে নিলি?”

আমি হাসছি। এ হাসি সে দেখবে না। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“চুপ করে থাকলে হবে? বলতে হবে তো কেন আমার দিনটা এলোমেলো করে দিলি?”

ওর দিকে ফিরে বললাম,
“যাতে চলে গেলেও ফিরে আসো, এভাবে পিছুটান থাকে।”

অয়ন হাসলো। ওর শার্টের কলার ধরে কাছে এনে বললাম,
“আই লাভ ইউ টু।”
“শেষে কলার ধরে আই লাভ ইউ?”

ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে বললাম,
“আমি ইউনিক কিছু পছন্দ করি।”

অন্যদিকে চলে গেলাম। পেছন থেকে ডাকলো,
“তনুশ্রী?”

ফিরে দাঁড়িয়ে বললাম,
“কি?”

অয়ন এগিয়ে আসলো। হাটু গেড়ে বসে পকেট থেকে একটা রিং বের করে বলল,
“আমার প্রেমিকা থেকে স্ত্রীতে প্রমোশন নিবে?”

এই ছেলে নি°র্ঘা°ত আমার মন পড়তে পারে৷ ঠিক যা যা আমার স্বপ্ন সব সে বাস্তব করে দিচ্ছে।

মাথা নেড়ে বললাম,
“খুশি খুশি তোমার মিসেস হতে রাজি।”

আংটিটা আমার বামহাতের অনামিকা আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো। উঠে দুইপা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দুহাত মেলে দিয়ে বলল,
“কাম হেয়ার।”

হ্যাঁ, আমার সেই কল্পনা আজ সত্যি হলো। সিনেমাটিক অ্যা°ক°শ°নে আজ অয়ন আমাকে প্রপোজ করেছে।

অয়নকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“মন পড়েছো বুঝি?”
“চুপ থাক তনুশ্রী। কিছু শোনার চেষ্টা কর।”

নিরব হয়ে গেলাম, চোখ বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করছি। এখনো সূর্য মামা মাথার উপর আসেনি। হয়তো সকাল ১১ টা বাজে। এখনই মনে হচ্ছে মধ্যরাত, আমাদের আশেপাশে কেউ নেই। পাখিরা নীড়ে ফিরেছে, ঝিঁঝি পোকা আজ রাগ করেছে, ব্যাঙেরা আজ বৈঠক করছে না। সবাই যেন একেবারে থেমে গেছে।

অথৈ আপুর মেহেন্দী সন্ধ্যা বা কুমিল্লার কাটানো সেই সন্ধ্যার পর আজ আবারো শুনতে পাচ্ছি তার বুকের বামপাশের পাঁজরের ভিতর বাজতে থাকা নিরবচ্ছিন্ন ডি°পডি°প শব্দ। আজ তো আমাকে কোলে নিয়ে সে হাঁটছে না তবে আজ কেন তার হৃদপিণ্ড এতো জোরে কাঁপছে?

এই লাবডাবের সমীকরণ মেলাতে মেলাতে সময় কেটে গেল। আমার ফোন বেজে উঠায় চমকে উঠে দুজনে সরে গেলাম।

মানহা কল করেছে। রিসিভ করলাম,
“তনুমনু, তাড়াতাড়ি আয়। বর চলে আসবে এখনই।”
“আসছি।”

ফোন রেখে আড়চোখে তাকিয়ে অয়নকে বললাম,
“নিচে যাবো।”
“চল।”

অয়ন যেতে পা বাড়ালে বাধা দিয়ে বললাম,
“ওয়েট।”
“কি?”

অয়নের চশমাটা খুলে বললাম,
“এটা কোন ঢ°ঙে পড়ছো?”
“সকাল থেকে মাথাব্য°থা করছে, তাই।”
“তবে পড়ো।”

ওর চুলগুলো এলোমেলো করে, শার্টের উপরের আরো একটা বোতাম খুলে দিয়ে বললাম,
“হাতা ফোল্ড করো।”
“ভালো লাগছে না আমাকে?”
“যা বলছি করো।”

অয়ন হাতা ফোল্ড করলো। আমি যেতে যেতে বলল,
“ভালো লাগছিলো, আমি দেখেছি। ব্যস, আর কাউকে দেখাতে হবে না।”
“জে°লা°স?”

কপাল কুঁচকে তাকাতেই অয়ন বলল,
“ওকে, ওকে।”

আমি নিচে চলে আসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বর আসলো, সকলের সাথে আমিও গেইট আটকে দাঁড়ালাম। রুম্মান ভাইয়াকে আজ কেমন যেন লাগছে, যেন বেচারা ভ°য় পাচ্ছে। সোনালী রঙের শেরওয়ানি পড়েছে, সাজগোজও করেছে বোধহয় কিন্তু তার চেহারা দেখে আমার হাসি পেল।

মেহমানদের মধ্যে ইত্তাজার বাবা মানে অয়নের বড়চাচাকে দেখলাম। যদিও উনাকে আমি আগে দেখিনি তবে ইত্তাজার মা শারমিন আন্টির পাশে আর কোনো পুরুষ হওয়ার কথা না।

উনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করলো।

“আসসালামু আলাইকুম, আংকেল।”

ইত্তাজার বাবা আমাকে ভালো করে দেখে বললেন,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
“আমি তন্বী, তানিমা আপুর ছোট বোন।”
“ওহ তুমি? মাশা-আল্লাহ। বসো এখানে।”

এমনভাবে “তুমি” বলল যেন আমাকে উনি কত চিনেন। বিষয়টাতে মাথা না ঘামিয়ে বললাম,
“না আংকেল থাক। আপনারা শরবত নিয়েছেন?”
“হ্যাঁ, নিয়েছি।”
“আচ্ছা আংকেল, আমি আসছি।”

চলে আসতে নিলে উনি বলল,
“আনোয়ারের ছেলে এখানে কেন এসেছে?”

আমি অয়নের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আনোয়ার আংকেল আর জাহানারা আন্টিও এসেছেন। উনারা আমাদের পূর্ব পরিচিত।”

উনি কিছু না বলে মাথা নাড়লেন। অয়নও উনার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি অয়নের কাছে গিয়ে বললাম,
“তোমার চাচা?”
“হুম, কিভাবে চিনলি?”
“তোমাদের বাসায় আন্টিকে দেখেছিলাম, তাই গেস করলাম আরকি।”

অয়ন কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে চলে গেল।

সময় এগিয়ে গেল। জুমার নামাজের পর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। আড়ম্বর করে বিয়ের পর কনে বিদায়ের সময় টে°র পেলাম এ শুধু আমার আপু যাচ্ছে না, আমার দ্বিতীয় মা চলে যাচ্ছে। আপুর সাথে রাগ করে থাকলেও এখন কষ্টটা বেড়ে গেল।

আপুকে ছাড়া ছোটবেলা থেকে একা কখনো থাকিনি। অভ্যাস নেই বললেই চলে। সেই আপুর চলে যাওয়াটা আনন্দের হবে না এটাই স্বাভাবিক। বাবা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো এখানে থাকলে উনিও কান্না করবেন। আম্মু ঠিক বলেছিল মেয়ের বিয়ে সহজ কথা না।

শেষবারের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কাঁদিস না। আর একটা কথা জেনে রাখ, বাবাকে কখনো কষ্ট দিস না, বোন।”

কিছুই বললাম না। সবসময় আপুকে চলে যেতে বললেও আজ আর বলতে পারলাম না। আজ না বলতেই আপু চলে গেল। কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামিয়ে আমাকে ডাকলো।

আমি দৌড়ে যেতেই আপু বের হয়ে আমার দুগালে দুটো চুমো দিয়ে বলল,
“বড় হয়েছিস, এখন আর আগলে রাখতে পারবো না। নিজের ভালো মন্দ বুঝে কাজ করিস।”
“আপু।”

চোখ মুছে দিয়ে সে গাড়িতে উঠে গেল। রুম্মান ভাইয়া বলল,
“বাই বাই তন্বী, ভালো থেকো।”
“বাই ভাইয়া।”

বাসায় চলে আসলাম। বাবা গেইটের কাছে এসে আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেল।

অয়ন নেই এখানে। সে কি চলে গেছে? আমার সাথে দেখা না করেই চলে গেল সে।

কিছুক্ষণ পর মানহা চলে যাওয়ার সময় আমার কাছে এসে বলল,
“তনুমনু, অয়ন ভাইয়ের পছন্দ কিন্তু ভালো।”
“মানে?”

মানহা মুচকি হেসে হাতের আংটির দিকে ইশারা করে বলল,
“মানিয়েছে ভালো। ভাবছি একটা নতুন সিনেমা বানাবো। (একটু থেমে) আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল তোর ইচ্ছা সম্পর্কে, আমি এটাই বলেছি।”

বুঝলাম এই মেয়েই অয়নকে এসব বুদ্ধি দিয়েছে। না হলে আমার ইচ্ছাগুলো অয়ন কিভাবে জানলো? আমি হাসলাম। আমার মানহু, আমার ইচ্ছাগুলো পূরণ করে দিয়েছে।

মেহমান বিদায়, খাওয়া দাওয়া এসবে আজকের দিনটা কাটলো। রাতটাও খুব একটা ভালো গেল না। আপুকে ছাড়া একা একা লাগছে। হুটহাট ঝ°গ°ড়া আর খুনশুটি আর ফিরে আসবে না।

প্রায় একসপ্তাহ গেল শুধু ঘর গুছিয়ে আগের চেহারায় ফেরাতে। এর মাঝে কলম ধরার সময় পাইনি যে কলেজে যাবো।

অবশেষে আজ কলেজে যাচ্ছি। সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম। খিলগাঁও থেকে কলেজ বাসে করে সোজা চলে আসলাম ইডেন মহিলা কলেজ।

ক্লাস শেষ হলো ১২ টায়। বাইরে এসে ক্যাম্পাসে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি আর এটা ওটার ছবি তুলছি।

এমনসময় অয়ন কল দিলো। রিসিভ করলাম,
“অয়ন?”
“কেমন আছিস?”
“হুম, ঠিক আছি।”

অয়ন একটু সময় নিয়ে বলল,
“আমি আসলে কল দিয়েছিলাম একটা জরুরি কথা বলতে। তোর টাইম হবে?”
“ওমা, এভাবে বলছো কেন? বলো তুমি।”
“আমি তোকে নিয়ে গাজীপুর যেতে চাচ্ছি। যেতে পারবি?”

খাঁচায় ব°ন্ধী পাখিটা ডানা ঝাপটাতে শুরু করলো। মুখ ব°ন্ধ হয়ে গেল বুঝি, কোনো কথাই আসছে না।

“আম্মুর সাথে কথা বলবো বিয়ের ব্যাপারে। তুইও উপস্থিত থাকবি।”

আমার নিরবতায় সে চিন্তিত হলো,
“তনুশ্রী, তুই যেতে পারবি?”
“বাসায় কি বলবো?”

অয়ন একটু ভেবে বলল,
“কিছু একটা বলে দিস।”
“হুম।”

ভেবেচিন্তে বাসায় এসে জানালাম আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে শুক্রবার সকালে ঢাকার বাইরে ট্যুরে যাবো। আম্মু একটু নারাজ থাকলেও বাবা ঠিকই রাজি হলো।

আগামী শুক্রবার সকালে গাজীপুর যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হলো। অপেক্ষায় অপেক্ষায় দিন কাটছে।

বৃহস্পতিবার খুব ভোরে অয়নের কল পেলাম। ফোনের রিং শুনে ঘুম থেক উঠে দেখি ভোর সাড়ে ৪ টা। তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করতেই অয়ন নি°স্প্রা°ণ কন্ঠে বলল,
“তনুশ্রী, আব্বু অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি, স্ট্রো°ক করেছেন।”

লাফিয়ে উঠে বললাম,
“অয়ন, কি বলছো তুমি? কোথায় তুমি?”
“হাসপাতালে যাচ্ছি। দোয়া করিস।”

কলটা কে°টে গেল। তার বাবা অসুস্থ, কথা বলার অবস্থায় সে নেই। আম্মুকে জানাবো নাকি জানাবো না? জানালে বলবে কোথা থেকে জেনেছো। কি করবো আমি?

আমি যাবো কিনা ভাবছি। গেলে যদি আবারো বাবা কোনো ঝা°মে°লা করে, এখনের ঝা°মে°লা অয়ন কিভাবে সামাল দিবে? অনুভূতিশূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে একটাই দোয়া করছি আংকেল যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন।

চলবে……..