#হয়তো_তোমারই_জন্য
#পর্বসংখ্যা_৭
#সাদিয়া_তাসনিম
সাঁঝ দ্রুত পায়ে নিচে থেকে উপরে যেতে লাগল। তার মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। সৌহার্দ্য ভাই কি সত্যিই চলে যাবে? সে কি তাকে থামাতে পারবে? সৌহার্দ্য ভাই কী তার উপর রাগ করে চলে যাচ্ছে? এখন যদি সে সৌহার্দ্যের সামনে যায় তখন কী সৌহার্দ্য সাঁঝের কানের নিচে একটা বসিয়ে দিবে তার এমন সব খারাপ কথা বলার জন্য? সাঁঝের মাথার মধ্যে এইসব হাজারও প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। এখন যে বুঝতে পারছে তখন কাজটা করা মোটেও ভালো হয়নি যদিও সে তখন নিজের মুখে নিজের দোষ গুলো স্বীকার করেনি, কিন্তু এখন তার মনের গভীরে একটা অনুশোচনা কাজ করে।
সাঁঝ সৌহার্দ্যের রুমের সামনে এসে দেখল সৌহার্দ্য হাতে ব্যাগ নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটা থমথমে। একবার তার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে তো আবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। সাঁঝ কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। সাঁঝ সৌহার্দ্যের সাথে কীভাবে বলবে তা বুঝি উঠতে পারছে না। সে কিছুক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে রইল। সাঁঝ কী বলবে, তা ভেবে পাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল সৌহার্দ্যকে এমনভাবে চলে যেতে দিলে সে হয়তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। সাঁঝ যখন দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো তখন সৌহার্দ্য সাঁঝকে দেখতে পেল। সে একবার সাঁঝের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। তার দৃষ্টিতে গভীর ক্লান্তি আর কিছুটা অভিমান মিশে ছিল। সৌহার্দ্যের এমন দৃষ্টি দেখে সাঁঝের বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। সাঁঝ এতোক্ষণ ধরে নিজের রাগ আর অভিমান নিয়ে থাকলেও এখন তার মনে হলো সে সত্যিই ভুল করেছে।
সাঁঝ সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা ঢোক গিললো। তারপর সাঁঝ ধীর পায়ে সৌহার্দ্যের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।সৌহার্দ্যকে নিজের দিকে তাকাতে না দেখে সে কিছু সময় ওভাবে দাঁড়িয়ে রয়ল। সৌহার্দ্য সাঁঝকে নিজের কাছে আসতে দেখে কিছু বলল না এমনকি সাঁঝের দিকে তাকালও না। সাঁঝের কাছে মনে হলো সৌহার্দ্য যেন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে নিয়েছে। সাঁঝ দেখলো সৌহার্দ্য নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে তাতে কীসব করছে। সাঁঝ সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। সে মৃদু কন্ঠে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে শুধালো,
‘ ভাইয়া আপনি কী সত্যি চলে যাচ্ছেন?’
সৌহার্দ্য নিজের ফোনের দিকে চোখ রেখেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ো।সে এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো। প্রথম কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেলো। সৌহার্দ্য একবার সাঁঝের দিকে তাকালো। সাঁঝ নিজের চোখে আকাশচুম্বী কৌতুহল নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য সাঁঝের দিক থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আবারও নিজের ফোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ হুম।’
সৌহার্দ্য নিজের কথাটা শেষ করতে না করতেই সাঁঝ নিজের হাতের তালু ঘোষতে ঘোষতে নিজের গলায় এক ধরনের অস্থিরতা নিয়ে এসে অধিকারী কন্ঠে সৌহার্দ্যের মুখের দিকে চেয়ে আমতা-আমতা জিজ্ঞাসা করে উঠলো,
‘ কিন্তু এত রাতে? আপনি তো… না মানে.. এমন কখনো করেন না তাই..।’
সৌহার্দ্য সাঁঝের এমন আমতা-আমতা করা দেখে এতোক্ষণ পরে সে সরাসরি সাঁঝের দিকে তাকাল। তারপর গভীর দৃষ্টিতে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে উঠলো,
‘ আমতা-আমতা কেন করছিস? কী করি না?’
‘ এভাবে এতো রাতে যান না ঢাকায়।’
সাঁঝের কথাটা শুনে সৌহার্দ্য নিজের এক ভ্রুঁ উঁচু করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘ তুই নিজেই তো বললি আমাকে আর এখানে আসতে না আসতে। আমার আসা নাকি সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তারপর কী যেনও? আমি নাকি সকলের মধ্যে ঝগড়া, ঝামেলা তৈরি করি। তাহলে আমি থেকে গেলে তোর সহ্য হবে? ‘
সৌহার্দ্যের কথাগুলো শুনে সাঁঝ কোনো উত্তর দিতে পারল না। সৌহার্দ্য যা বলেছে তা তো মিথ্যে নয়, সে নিজেই তো কথাগুলো বলেছিল তাকে। সাঁঝ যখন কথাগুলো সৌহার্দ্য বলেছিলো তখন তার মনে হয়নি কথাগুলো এতটা গভীরভাবে আঘাত করবে। সাঁঝ সৌহার্দ্যের কথাগুলো শুনে নিজের মাথা নিচু করে নিলো। সাঁঝ মাথা নিচু করেই ধীরে ধীরে বলে উঠলো,
‘ আসলে আমি সেভাবে বলতে চাইনি। ‘
সাঁঝের কথাটা শুনে সৌহার্দ্য সাঁঝের দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিল। সে সাঁঝের দিকে নিজের দৃষ্টি ঝুঁকি মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ তুই যা বলতে চেয়েছিলি তা আমি ভালো করেই বুঝেছি সাঁঝ।দেখ তোর দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। আমার সামনে তুই এমন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবি না। ভালো লাগে না।’
সাঁঝ সৌহার্দ্যের কথাগুলো শুনে এবার সত্যিই ভেঙে পড়ল। তার চোখে পানি চলে এলো। সে মাথা উঁচু করে নিজের চোখের পানি মুছতে মুছতে দ্রুত মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ আপনি চলে গেলে দাদুভাই কীভাবে থাকবে? আপনি জানেনই তো সে আপনাকে কতটা ভালোবাসে তাছাড়া আর আমরা সবাই? বাকিরা বিষয়টা জানতে পারলে… ‘
সাঁঝ নিজের কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই কান্নার ফলে তার কন্ঠটা বন্ধ হয়ে আসলো। সৌহার্দ্য সাঁঝের এমন অবস্থা দেখে এবার একটু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘ তাহলে সবাই ভালো থাকিস। আমি যায় বরং । ‘
সাঁঝ এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে মৃদু কন্ঠে বলে উঠল,
‘ভাইয়া আপনি এমন কেন করছেন? আমি ক্ষমা চাচ্ছি যা করেছি তার জন্য। আমি জানি আমি ভুল করেছি। কথাগুলো সব আমি রাগের মাথায় বলেছি। আপনি তো আামকে বুঝতে পারেন। তখন আমার দাদুভাইয়ের জন্য খারাপ লেগেছিল বলে….’
সৌহার্দ্য সাঁঝের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ দেখ সাঁঝ, আমি এখানে আসি কারণ এই বাড়িটা আমার জন্য সেকেন্ড হোম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমার এখানে আসাটা তোর জন্য ঝামেলা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমি চাই না আমার কারণে কেউ কষ্ট পাক।যাতে কেউ কষ্ট না পায় তার থেকে আমার চলে যাওয়াই ভালো না?’
সাঁঝ এবার আর কথা বলতে পারলো না। তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগল।তবুও সে কোনোভাবে মৃদু কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আপনি যদি আজ চলে যান তাহলে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।’
সাঁঝের কথাগুলো শুনে সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সাঁঝের কান্না তার হৃদয়কে নরম করে তুললো,কিন্তু সে নিজের অভিমান ছাড়তে পারছিল না। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে সুবহা এসে উপস্থিত হলো।সে একবার সাঁঝের দিকে তাকালো তারপর সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ ভাইয়া, প্লিজ তুমি থেকে যাও। সাঁঝ যা বলেছে, সেটা রাগের মাথায় বলেছে। তুমি তো জানোই ও কেমন। ও তো আসলে মন থেকে এমন কিছু বলতে চায়নি।’
সৌহার্দ্য সুবহার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে একবার সাঁঝের দিকে তাকালো তারপর মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ তোরা যা-ই বলিস না কেন আমাকে এখন যেতে হবে।’
সুবহা এবার হতাশ হয়ে পড়ল। সে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ ভাইয়াকে নিয়ে নিচে আয় আম্মু খাবার বাড়ছে।’
সুবহা সেখানে আর দাঁড়ালো না সে একবার সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে সেখান থেকে চলে গেলো।
সাঁঝ এবার কী ভাবে সৌহার্দ্যকে আটকাবে সেটা ভাবতে লাগলো। সাঁজ এবার সাহস করে সৌহার্দ্যের হাত ধরে ফেলল। সাঁঝ সৌহার্দ্যের হাত ধরার সাথে সাথে সৌহার্দ্য সাঁঝের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। সে বোঝার চেষ্টা করলো সাঁঝ কী করতে চায়ছে। এদিকে সাঁঝ নিজের কণ্ঠকে শক্ত করে সৌহার্দ্যের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
‘ ভাই প্লিজ যেয়েন না। আপনি থেকে যান। আমি সত্যিই এমন ভুল আর জীবনেও করবো না। আমি ভুল করেছি যার জন্য প্লিজ ক্ষমা করে দিন।’
সৌহার্দ্য এবার নরম হয়ে গেল। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সাঁঝের দিকে তাকালো। তারপর সে সাঁঝের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে নিজের এক ভ্রুঁ উঁচু করে কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে উঠলো,
‘ তুই কি সত্যিই চাস আমি থেকে যায়?’
সাঁঝ মুখে কিছু বললো না শুধু মাথা নাড়ল। তার চোখে তখনও পানি। সে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ হ্যাঁ।’
সৌহার্দ্য এবার সাঁঝের কথা শুনে মৃদু হাসলো। তারপর সাঁঝের মাথায় হাত রেখে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ ঠিক আছে, আমি থাকবো। তবে আজ না সাঁঝ। ‘
‘ কেনও? ক্ষমা করেন নি আমাকে?’
সাঁঝ শুকনো ঢোক গিললো কথাটা বললো। তার চোখে তখনও কান্নার ছাপ স্পষ্ট । সৌহার্দ্য সাঁঝের কথা শুনে নিজের দুপাশে মাথা নাড়ালো তারপর মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ পাগল তোর উপর আমি রাগ করিনি ঢাকাতেই সত্যিই আমার কাজ আছে। আমার বন্ধুর আম্মু অসুস্থ। তার মা বাদে কেউ নেই জানিস ও ভয়ঙ্কর ভাবে ভেঙ্গে পরেছে আমি না গেলে ও নিজেকে সামলাতে পারবে নারে সাঁঝ।’
‘ তার মানে আপনি আমার কথায় রাগ করে যাচ্ছেন না আপনার বন্ধুর জন্য যাচ্ছেন।’
‘ হ্যাঁ।’
‘ তাহলে একটু আগে যে বললেন আপনি আমার জন্য চলে যাচ্ছেন?’
সাঁঝ কথা শুনে সৌহার্দ্য হাসলো। সে সাঁঝের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
‘ তোর কথায় হালকা রাগ হলে এই রাগ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মতো না সাঁঝ। আর একটু বেশি রাগ হলেও সেই রাগ তোদেরকে, তোকে ছেড়ে যাওয়ার মতো না কখনো। ‘
সাঁঝ সৌহার্দ্যের কথাটা শুনে মনে মনে সৌহার্দ্যের উপর রাগতে লাগলো। লোকটা এতোক্ষণ বিনা কারণে তাকে কাঁদিয়েছে? একে তো..? সাঁঝ আর কিছু ভাবতে তার আগেই সৌহার্দ্য তার মুখের সামনে তুড়ি মেরে বলে উঠলো,
‘ নিচে চল চাচিমণি ডাকছেন তো।কোথায় হারিয়ে গেলি?’
চলবে…..