হয়তো তোমারই জন্য পর্ব-১২

0
3

#হয়তো_তোমারই_জন্য
পর্বসংখ্যা.১২
~প্রথমাংশ
লেখনীতে:সাদিয়া তাসনিম

(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, চাইলে শেয়ার দিয়ে পাশে থাকতে পারেন)

তালুকদার বাড়িতে বিকেলের পরিবেশটা সবসময়ই একটু অন্যরকম হয় । বাড়ির প্রতিটা কোণ যেন নিজস্ব এক রকম গল্প বলে সকলের কাছে। ড্রয়িং রুমের কোথাও পুরনো কাঠের আসবাবের গন্ধ, কোথাও রোদ মেখে থাকা জানালার পর্দা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ এই সময়ে ড্রয়িংরুমের ঠিক কোণটা জানালার পর্দার ফাঁক থেকে সূর্যের আলো বেরিয়ে এসে তা মেখে একদম সোনালি হয়ে থাকে রুমের একঅংশ। বিকেলে চা-নাস্তার আয়োজনটা এই বাড়িতে প্রায় নিয়মিত। বড় ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে ড্রয়িংরুমের সোফা, ঘরের মানুষগুলো বিকেলের চা-বিস্কুটের আড্ডায় মেতে থাকে। আজও ঠিক এমনই এক বিকেল। বাড়ির ড্রয়িংরুমে লোকে লোকারণ্য। সুবহা, তাসনিয়া, ঈশিতা, সাঁঝ, সৌহার্দ্য, লুবনা এমনকি সাঈদও এখানে উপস্থিত। সুবহা সোফায় বসে বসে টিভির রিমোট নিয়ে চ্যানেল বদল করছে। ঈশিতা নতুন একটা সিরিজ দেখতে চাচ্ছে , কিন্তু তাসনিয়া ঠিক তার উল্টো ও অন্য কিছু দেখবে। আর সাঁঝ? সে তো এক কোণায় বসে নিজের চিন্তায় তলিয়ে আছে আর ভাত খাচ্ছে। সুবহারা আজ তাকে টিভির রিমোট দেয়নি, তাই সে ভদ্র মেয়ের মতো নিজের খাবার খাচ্ছে আর টিভির দিকে তাকিয়ে রয়েছে । সৌহার্দ্য ঠিক তার সামনাসামনি একটা সোফায় আরাম করে বসে আছে। সৌহার্দ্যের মুখে সেই চিরচেনা ফিচেল হাসি। সাঁঝ আজ দুপুরে খেতে নিচে আসেনি। সুবহা সাঁঝের রুমে গিয়ে দেখে মেয়ে গোসল করে নিজের বিড়ালটাকে নিজে বিছানায় গুটি মেরে শুয়ে আছে তাই সে আর সাঁঝে খাবার খাওয়ার জন্য ডাকেনি। সাঁঝ অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়িতে টইটই করছিলো কিন্তু এখনই সকলের মাঝে খাবার নিয়ে বসেছে। সাঁঝ নিজের মনে খাবার খেতে খেতে সৌহার্দ্য দিকে তাকাতেই দেখে সৌহার্দ্য আগে থেকে তার গিয়ে তাকিয়ে আছে যা দেখে সাঁঝ নিজের মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
ড্রয়িংরুমের সাজসজ্জাটা বেশ পরিপাটি। একদিকে শো-পিসের আলমারি, অন্যদিকে দেয়ালে বাঁধানো পুরনো পারিবারিক ছবি। এক কোণে রাখা বড় একটা ফার্নের গাছ, সাথে একজোড়া সুন্দর গোলাপি পর্দা। টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিতে তাজা রজনীগন্ধার গন্ধ পুরো ঘরে ছড়িয়ে আছে। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে বড় একটা সেন্টার টেবিল, যার ওপর রাখা চায়ের ট্রে। সবাই যার যার মগ হাতে নিয়ে চা-তে চুমুক দিচ্ছে।

সাঁঝ এখন একটু চুপচাপ। সৌহার্দ্য অবশ্য একবারও তাকে বিরক্ত করেনি। সাঁঝ চুপচাপ বসে বসে ভাত খাচ্ছিলো ঠিক তখনই টিভির পর্দায় একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে সেখানে নায়ককে জোর করে তার পরিবার বিয়ে দিতে নিয়ে যায় কিন্তু নায়ক কোনো ভাবেই বিয়ে করবে না তাই নানা উপায়ে পরিবারের হাত থেকে বাঁচার কৌশল বের করতে থাকে।
এই ফানি সুবহা আর তাসনিয়া একসাথে হেসে উঠল। ঈশিতাও হাসল, তবে একটু কম। সৌহার্দ্য চায়ের মগ হাতে নিয়েই সাঁঝের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। সাঁঝ সেটা লক্ষ করল, কিন্তু পাত্তা না দেওয়ার ভান করল। সাঈদ দৃশ্যটা দেখে নিজের মুখ কুঁচকে নিলো।সে হঠাৎ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠল,

‘ এই সিরিজের নায়কটা এতো বোকা কেন বলতো আমাকে? পরিবার বিয়েটা দিতে চাইছে সে বিয়ে না করে বারবার পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাকে বললে তো আমি এক পায়ে দাঁড়িয়ে রাজি হয়ে যেতাম। জানিস তোরা আমার কী মনে হয়?’

সকলের দৃষ্টি টিভির দিকে থাকলেও সকলে সাঈদের এমন কথাটা শুনে নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে তা নিক্ষেপ করলো সাঈদের দিকে। সৌহার্দ্য সাঈদের দিকে নিজের ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আসলে সকলে বোঝবার চেষ্টা করছে সাঈদ এখন কী বলবে তা। সাঈদ সকলে দিকে একবার তাকিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো। সকলকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার কেমন যেনও ভালোই লাগতে লাগলো। সে একটু ঢং করে বলে উঠলো,

‘ আমার মনে হয় কী আমার বিয়েটা আর হবে না রে। বাড়ির লোকজনের কী সেই খেয়াল আছে? আমি যে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি সেটা ওদের চোখেই পড়ছে না।’

সাঈদের কথাটা শুনে ঘরটা মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেল। সবাই একসাথে তাকিয়ে রয়লো সাঈদের দিকে। সাঁঝ তখন ভাত খাচ্ছিল। সাঁঝ সবাইকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে, চুপচাপ বসে থাকা সাঁঝ এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ভাত মুখে নিয়েই তা চিবতে চিবতে বলে উঠল,

‘চিন্তা করিস না ভাইয়া। বাড়ির লোকজন যখন তোর মুসলমানিটা দিয়েছে, তখন বিয়েটাও দিয়ে দেবে কারণ দুইটাই ফরজ কাজ।’

সাঁঝের কথাটা শেষ হতে না হতেই ঘরের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। সুবহা তো চায়ের মগ হাত থেকে ফেলে দিতে দিতে সামলাল। তাসনিয়া আর ঈশিতা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। সাঈদ সাঁঝের কথাটা শুনে নিজের চোখ ছোট ছোট করে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য সাঁঝের কথাটা শুনে মৃদু হেসে তার দিকে তাকাল তবে সাঁঝ তা দেখে ফেলার আগে নিজের মুখটা গম্ভীর করে সৌহার্দ্য সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

‘ তুই কী ভদ্র হবি না? ‘

সাঁঝ এবার আড়চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘ আসলে ভাইয়া আমি ভদ্রই শুধু নির্দিষ্ট সাক্ষীর অভাবে তা আপনাকে প্রমাণ দিতে পারছি না। সাক্ষাৎ প্রমাণ হলে আমিও দেখিয়ে দিতাম আমি কেমন ভদ্র। আপনার মতো লাফাঙ্গা নাকি? ‘

সুবহা সাঁঝের কথাটা শেষ হতে না হতেই বলে উঠলো,

‘ সাঁঝ, তুই যা শুরু করেছিস! একদিন দেখিস এরজন্য ভাইয়া তোকে ঠিক ভালো করে ঝাড়বে। ‘

সাঁঝ সুবহার কথাটা শুনে সৌহার্দ্যের দিকে আড়চোখে তাকালো । সৌহার্দ্যকে মৃদু হেসে নিজের দিকে তাকাতে দেখে সাঁঝ নিজেই একটু অস্বস্তি বোধ করল। সে চুপ করে আবারও নিজের খাওয়াতে মনোযোগ দিলো।
ড্রয়িংরুমে হাসির রেশ এখনো কাটেনি। সেখানকার বাতাসে রজনীগন্ধার মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে এরই মধ্যে তাসনিয়া এবার সাঈদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

‘ আচ্ছা, ভাইয়া তোর গফের কী হলো?’

সাঈদের দিকে আবারও সকলে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তখন সাঈদ চুপ করে বসে আছে। তাই পাশ থেকে সাঁঝ তখন ঠাট্টার সুরে বলে উঠলো,

‘ সাঈদ ভাইয়ের গফ হওয়া আর সাপের পাঁচ পা দেখা একই বিষয় আপু। সৌহার্দ্য ভাই আর সাঈদ ভাই এক না, আলাদা।’

সাঁঝের কথাটা শুনে সকলে নড়েচড়ে বসলো। সকলে কৌতূহলী দৃষ্টিতে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে আছে এমনকি সৌহার্দ্যও সাঁঝের নিকে নিজের চোখ জোড়া নিবন্ধ করে বোঝাবার চেষ্টা করছে মেয়েটা আসলে কী বলতে চাচ্ছে। তাসনিয়া সাঁঝকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ সৌহার্দ্য ভাইয়ের ব্যপারে কিছু জানিস নাকি?’

তাসনিয়া কথাটা শুনে সৌহার্দ্য নিজেই সটানভাবে বসে নিজের চোখগুলো ছোট ছোট করে তার আশেপাশে বসে থাকা বদমাশগুলোকে একবার দেখে নিয়ে এক ভ্রুঁ কুঁচকে বলে উঠলো,

‘ আমার ব্যপারে আমি নিজেই জানি না ও কেমনে জানবে?’

সাঁঝ সৌহার্দ্যের কথায় চমকে উঠলো। সে সৌহার্দ্যের কথার বিপরীতে তীব্র প্রতিবাদ করে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ আমি একবার আপনাকে দেখেছিলাম ফোনে কাউকে ভালোবাসি বলেছেন। ‘

সৌহার্দ্য সাঁঝের কথাটা শুনে যেনও ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বলে উঠলো,

‘ আমি? পাগল হলি তুই? এসব ভালোবাসা-টালোবাসা আমার মুখ দিয়ে বের হয় না বুঝেছি? না বুঝলেও সমস্যা নেই তুই এমনিতেই দুই লাইন বেশি বুঝিস।’

সাঁঝ সৌহার্দ্যের কথার বিপরীতে বলে উঠলো,

‘ আমি বেশি বুঝি? হ্যাঁ? আমি? আপনি বলেন নি?আপনি যে ফোনে প্রেম করেন তা কী আমরা বুঝি না?’

সৌহার্দ্য সাঁঝের কথাটা শুনে সাঁঝের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে সুবহাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

‘ সুবহা একে বোঝা, বয়সে তোদের থেকে বড় আমি। তোমাদের সাথে সহজে মিশে যায় বলে এমন কথা ও যেনও আর না বলে। ‘

সৌহার্দ্য কথাগুলো শেষ চুপ করে বসে রয়লো। সাঁঝ হতভম্ব হয়ে গেলো সে তো সেদিন নিজের কানে শুনে ছিলো কিন্তু মিথ্যা কথা কেমন বলছে সৌহার্দ্য সাঁঝ সেটা বুঝতে পারলো না।শীতল এক বিকাল। টেবিলের উপরে রাখা গরম চা আর কিছু স্ন্যাকস, একদিকে আলো-আঁধারিতে মিটমিট করছে শো-পিসের আলোগুলো। ড্রয়িং রুমে সকলে মিলে গল্পে মগ্ন। টিভিটাও চলছে পাশেই, তবে কারো মনোযোগ সেখানে নেই। সকলে সাঁঝ আর সৌহার্দ্যের কথা শুনতে ব্যস্থ।হঠাৎ করেই টেলিভিশনের পর্দায় একটি খবর প্রচারিত হতে শুরু করলো, যা মুহূর্তের মধ্যে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। খবরটি ছিল ভয়ংকর সাথে হৃদয়বিদারক।

আবারও হঠাৎ করে এক তীক্ষ্ণ ধ্বনি হয়ে “ব্রেকিং নিউজ!” টিভির স্ক্রিনে ঝলসে ওঠলো। সংবাদপাঠক তার কণ্ঠে উদ্বেগ এবং শোকের ছাপ স্পষ্ট করে তুলে বলে উঠলো,

” বনানীতে আঠারো বছর বয়সী এক ছেলে তার নিজের বাবা-মাকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। এই ঘটনায় পুরো বাংলাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবরটি ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে। ”

এই কথা শুনে সকলের উপর যেন বজ্রপাত হলো। সাঁঝ বিস্ময়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো ,

‘ কি বলছে? নিজের বাবা-মাকে খুন করেছে?’

সাঁঝ বিরবির করে বললো সৌহার্দ্য সাঁঝের কথা শুনতে পেলো। টিভিতে এখন হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ আসছে। ছেলেটির নাম, তার শিক্ষাগত পরিচয়, এবং ঘটনার পেছনের প্রেক্ষাপট। সংবাদে উঠে আসে, পারিবারিক কলহ থেকেই নাকি এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে। ছেলেটি তার বাবার ব্যবসায় জড়ানো চাপ নিয়ে বিরক্ত ছিল এবং কিছুদিন ধরে হতাশাগ্রস্ত ছিল। পুলিশ ইতিমধ্যেই তাকে আটক করেছে। এ ঘটনার আরও ভয়াবহ দিক হচ্ছে, এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। লোকজন এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউব সব প্ল্যাটফর্মেই এই ঘটনা ট্রেন্ডিং। কিছু মানুষ ছেলেটিকে শাস্তি দাবি করছে, আবার কেউ কেউ তার মানসিক অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে দুঃখপ্রকাশ করছে….। আর কিছু বলতে যাবে তার বাড়ির কারেন্টটা চলে গেলো। খবরটা শুনে ড্রয়িং রুমে এখন সকলের মাঝে যেন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। সবাই নিজের চিন্তায় মগ্ন, এর মধ্যে হঠাৎ সাঁঝ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

‘ এটা কেমন সমাজ হয়ে যাচ্ছে, যেখানে একজন ছেলে এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে? আমাদের কি ভালোবাসা, সহমর্মিতা সবই ফুরিয়ে যাচ্ছে সাঈদ ভাইয়া?’

সকলে সাঁঝের কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিলো না। সকলে চুপ, নিরব।

চলবে…