হয়তো তোমারি জন্য পর্ব-০৬

0
89

#হয়তো_তোমারি_জন্য ( ষষ্ঠ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র

কথাটা বলে শারদীয়া খেয়াল করলো উজান থমকে গেল হঠাৎ! খাওয়াটা থামিয়ে দিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপর একটু অন্ধকার মুখেই বললো,
——-” তুমি চলে যাবে তার মানে! ”
কথাটা বলেই কয়েক মুহূর্তে নিজেকে ঠিক করে কিছুটা জোর করে হেসেই যেন বললো,
——-” ঠিকই তো। খুবই ভালো চাকরি। স্কুল টিচার! আর এরপর কেনই বা তুমি রান্নার কাজ করবে এখানে! ঠিকই তো। কংগ্র্যাচুলেশন..”
কথাগুলো বলে ও আবার একটু থমথমে মুখেই খেতে শুরু করলো। তবে শারদীয়া উজানের মুখটা দেখেই বুঝেছিল ওর খারাপ লাগছে! তার মানে ওর ধারণা ভুল। উজান ওকে চ্যারিটি কেস হিসেবে দেখে না। দেখলে ওর এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা শুনে এইভাবে রিয়্যাক্ট করতো না! আর উজানের সত্যি মনে হয় ওর হাতের রান্না খাওয়ার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন হঠাৎ এইভাবে চলে গেলে ছেলেটার খুব অসুবিধা হবে নিশ্চয়ই। আর সত্যিই তো, বিপদের দিনে যখন এই শহরে একটা লোককেও চিনতো না, তখন তো উজানই ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কাজ দিয়েছিল, থাকার জায়গা দিয়েছিল। আর আজ সেই লোকটার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে ভাববে না শারদীয়া! কথাটা ভেবেই ও একটু ভেবে বলেছিল,
——-” না স্যার। আমি আসলে ভাবছিলাম আমি যদি সকালে রান্না করে দিয়ে তারপর স্কুলে যাই এখান থেকে, তাহলে আপনার কোন প্রব্লেম নেই তো? ”
কথাটা শুনে এক গালি হাসি হঠাৎ উজানের মুখে। ছেলেটা হঠাৎ বাচ্চাদের মতন আনন্দ করে বলে উঠলো,
——-” তার মানে তুমি যাবে না? এখানেই থাকবে! ”
এই কথায় শারদীয়া কিছু না বলে অল্প হেসে ঘাড় দোলালো। আসলে এই এত বড় বিজনেসম্যানের এই সামান্য কারণে আনন্দ হতে পারে; এটা ভেবেই খুব অবাক লাগছিল! তবে এরপরই উজান অন্য একটা কথা বলে উঠলো। ও বেশ ইতঃস্তত হয়েই বললো,
——” কিন্তু একজন স্কুল টিচার কথায় কথায় আমাকে স্যার বলে ডাকবে, এটা আমি ঠিক মানতে পারছি না। আমার সিরিয়াসলি খুব অস্বস্তি হবে। সো প্লিজ, কল মি উজান.. ”
কথাটায় শারদীয়া যেন একটু ঘাবড়ে গিয়েই বললো,
——-” না না স্যার,! সেটা কি করে হয়! আর আমি তো প্রথম থেকেই! ”
না, শারদীয়ার কথাটাকে আর শেষ হতে না দিয়ে উজান বললো,
——-” প্রথম থেকে যা বলতে বলতে! কিন্তু আজ থেকে উজানই বলবে। এটা একটা রিকুয়েস্টই বলতে পারো। ”
কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে বললো উজান। তবে শারদীয়া এর ঠিক কোন উত্তর খুঁজে পেল না যেন! সেই জন্য হ্যাঁ না, কিছু না বলেই অল্প ঘাড় দোলালো শুধু।

যাইহোক, এরপর থেকে শারদীয়া উজানের বাড়িতে থেকেই স্কুলের চাকরিটা করতে শুরু করলো। তবে প্রত্যেকদিন উজানের জন্য রান্না করে তবেই বেরতো। কিন্তু এই বাড়িটা ধীরে ধীরে ওর কাছে খুব নিজের হতে শুরু করেছিল যেন। ছুটির দিনে এই বাড়ির বাগানের গাছগুলো পরিচর্যা করা, ছাদে গিয়ে খোলা আকাশ দেখা, মাঝে মাঝে উজানের অগোছালো ঘরটাকে বিশু কাকার সাথে গিয়ে পরিষ্কার করে দেয়া, এইসবের মধ্যে দিয়ে দিনগুলো এগিয়ে যাচ্ছিল নিজের তালে, নিজের ছন্দে। তবে এই দিনগুলোয় কিছু টুকরো মুহূর্ত এসে জমা হয়েছিল জীবনে। যেমন সেদিন উজানের জন্মদিনের কথা বিশু কাকার মুখে শুনেছিল শারদীয়া। তাই একটু সকাল সকাল উঠে পায়েস বানিয়েছিল। তারপর ব্রেকফাস্ট টেবিলে উজান আসতেই পায়েসটা সাজিয়ে দিয়ে বিশু কাকার সাথে মিলে উজানকে উইশ করেছিল জন্মদিনে একটা হাসি মুখে। সেদিন সত্যি উজান অবাক হয়ে গেছিল! আসলে এত বছর এই দিনটার কথা ও নিজেও মনে রাখতো না বিশেষ। বিশু কাকা তবে এই দিনটায় আশীর্বাদ করতো মাথায় হাত দিয়ে, কিন্তু তার বেশি কিছুই হতো না। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম আজকের দিনে কেউ পায়েস রান্না করে দিয়েছে ওকে! কথাটা ভেবেই শারদীয়াকে খুব নিজের লাগলো যেন। তাই কয়েক মুহূর্ত ভীষণ নিস্পলকভাবে তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর আস্তে গলায় বলেছিল,
——-” থ্যাঙ্ক ইউ.. থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ.. খুব মন থেকে বললাম। ”
কথাটা শুনে শারদীয়ার ঠোঁটেও হাসি ছিল। আসলে ও বোঝে নিজের মা বাবা না থাকার কষ্টটা। উজান যে মনে মনে কতটা একা, কতটা নিঃসঙ্গ সেটা ওর থমকে থাকা দুটো চোখ দেখলেই বোঝা যায়। তবে এই বোঝাটা শারদীয়া আরো বেশি করে ফিল করেছিল উজানের বাবার মৃত্যুদিনে। সেদিন ও স্কুল থেকে ফেরার পর বিশু কাকা ভীষণ হন্ত দন্ত হয়ে এসেছিল ওর ঘরে। তারপর একটু উত্তেজিত হয়েই বলেছিল,
——–” তুমি একটু যাবে আমার সাথে উজানের ঘরে? ছেলেটা সকাল থেকে একবারের জন্যও ঘর থেকে বেরোয়নি। দরজা আটকে আছে। কিছু খায়নি। আমি দুপুরবেলাও কতবার ডাকলাম। কোন সাড়া দিল না! ”
কথাগুলো খুব অসহায়ভাবে বললো বিশু কাকা। তবে শারদীয়া এটা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েই বললো,
——–” মানে? এরকম কেন করছে হঠাৎ! কি হয়েছে?”
কথাটা বলতেই বিশু কাকা খুব ক্লান্ত গলায় বললো,
——–” আসলে আজকের দিনটাই এত বাজে! অনেক বছর আগে আজকের দিনেই স্যার, মানে উজানের বাবা মারা গেছিল। সেই দিনটা মনে হয় ছেলেটা আজ অব্দি ভুলতে পারে না! আসলে আমি তো দেখেছি উজান ওর বাবাকে কতটা ভালোবাসতো! স্যারও ছিল ছেলে অন্ত প্রাণ। দুজনে একেবারে বন্ধুর মতন ছিল জানো। ম্যাম যদিও উজানকে কখনোই বিশেষ সময় দিত না! কিন্তু স্যার সব সময় ছেলের জন্য ভাবতো। অফিস থেকে ফিরেই ছেলের ঘরে চলে যেত! তারপর কত গল্প, কত আড্ডা, মজা দুজনের! আজ যদি স্যার বেঁচে থাকতেন তাহলে ছেলেটা এরকম একলা একটা জীবন কাটাতো না! উজান ওর বাবার মৃত্যুটাকে আসলে মানতে পারেনি আজও। তাই এই দিনটা এলেই নিজেকে ঘর বন্দি করে নেয়! সারাদিন শুধু ড্রিঙ্ক করে। এক এক বছর তো খুব অসুস্থও হয়ে যায় ছেলেটা। মনে আছে, দু বছর আগে তো দরজা ভাঙতে হয়েছিল শেষে মাঝ রাতে। কি জ্বর চলে এসেছিল সেইবার ছেলেটার! ”
কথাগুলো বেশ ভয় নিয়েই বলেছিল বিশু কাকা। তবে এইসব শুনে শারদীয়া আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি যেন! ও প্রায় দৌড়ে গেছিল বিশু কাকার সাথে উজানের ঘরের সামনে। তারপর নিজেই দরজায় ধাক্কা মেরেছিল। কিন্তু বেশ অনেকক্ষণ ধরে ডেকে, দরজায় ধাক্কা মেরেও যখন কোন সাড়া শব্দ পায়নি উজানের, তখন আর শারদীয়া নিজের ধৈর্য্য বজায় রাখতে পারেনি। বিশু কাকাকে বেশ ভয়ের সাথেই বলেছিল,
——-” আমার মনে হয় দরজা ভাঙতে হবে। এইভাবে চুপ করে বসে তো থাকা যায় না! তুমি বরং নিচে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডকে ডাকো। ও ই কিছু একটা করবে। ”
কথাগুলো শুনে বিশু কাকাও আর অপেক্ষা করেনি। তাড়াতাড়ি এই সিকিউরিটি গার্ড অমিতকে গেট থেকে ডেকে এনেছিল। তবে অমিত সেদিন এসে একটা অন্য কথা বলেছিল। ও বেশ ব্যাস্ত হয়েই বলেছিল,
——–” আমি বরং পাইপ দিয়ে ওপরে উঠে স্যারের রুমের ব্যালকনিতে যাচ্ছি। ব্যালকনির দরজাটা খোলা দেখলাম। ওখান থেকে সহজেই ঘরে ঢোকা যাবে। ”
কথাগুলো শুনে শারদীয়া সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল,
——–” হ্যাঁ। এটা ভালো আইডিয়া। তুমি তাহলে তাই করো। ”
কথাটা ওর শেষ হওয়ার পরই অমিত আর দাঁড়ায়নি। ও তাড়াতাড়ি গিয়ে পাইপ বেয়ে উজানের ঘরে উঠেছিল। তবে সেই মুহূর্তে ঘরের ভিতরের দৃশ্যটা দেখে ও কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছিল যেন! তারপর আর দেরি না করে শারদীয়াদের দিকের দরজাটা খুলেছিল ভিতর থেকে। কিন্তু এরপর শারদীয়া আর বিশু কাকা উজানের ঘরে ঢুকে স্থির হয়ে গেছিল কেমন! আসলে ওদের এতক্ষণের ভয়টা শেষে সত্যি হয়ে গেল যেন।
এলোমেলো ছন্নছাড়া একটা ঘরে উজান পড়েছিল পুরোপুরি সেন্সলেস হয়ে। হাতটা কেটে রক্ত পড়ছিল ছেলেটার। পাশের ভাঙা রক্ত লাগা মদের বোতলটা বুঝিয়ে দিয়েছিল ওই ভাঙা কাঁচেই ইচ্ছে করে হাত কেটেছে উজান। ঘরের একটা জিনিসও এই মুহূর্তে নিজের জায়গায় নেই। ড্রেসিং টেবিলের কাঁচটা পর্যন্ত ভাঙা! এই দৃশ্যটা দেখে শারদীয়া থমকে গেছিল নিজে। এইভাবে উজানকে ও কোনদিন দেখবে ভাবেনি! তারপর বিশু কাকার সাথে শারদীয়াও প্রায় দৌড়ে গেছিল উজানের কাছে। এরপর কোনভাবে ওকে ধরে সবাই খাটে শুইয়েছিল। উজান তখন মদের নেশায় পুরোপুরি সেন্সলেস। তার মধ্যেই শারদীয়া ফার্স্ট এড বক্সটা নিয়ে এসে ওর হাতের কাটা জায়গা থেকে কাঁচের টুকরো গুলো ধীরে ধীরে বার করেছিল। এরপর খুব যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল হাতে। তবে সেই মুহূর্তে শারদীয়া বুঝেছিল ক্ষতটা আসলে মনের। যেখানটা এখনো রক্তাক্ত! আর সেই ক্ষতটা না সারলে উজান বার বার নিজেকে এইভাবেই কষ্ট দেবে। এইভাবেই শেষ করবে, একটু একটু করে।

সেদিন এরপর শারদীয়া উজানের এলোমেলো ঘরটা গুছিয়ে রেখেছিল নতুন করে। আর মনে মনে অপেক্ষা করছিল, এই রাতটা কাটিয়ে সকাল হওয়ার!
তবে পরেরদিন উজানের যখন ঘুম ভেঙেছিল তখন ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁয়েছে। উজান সেই মুহূর্তে কোনভাবে বিছানা ছেড়ে উঠে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। আসলে মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে ওর। আর আবছা আবছা মনে পড়ছে কালকের দিনটা। ও ওই বাবার মৃত্যুদিনে কিছুতেই যেন ঠিক রাখতে পারে না নিজেকে। কালও সারাক্ষণ বাবার মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল যেন। তারপর বাবার সেই শেষ দিন, মায়ের ওই লোকটাকে বাড়িতে নিয়ে আসা, বাবা মারা যাওয়ার পর ওদের রোজের আনন্দ, উচ্ছাস, পার্টি; আর তারপর সেই এক্সিডেন্ট, মায়ের রক্তাক্ত শরীর ওই লোকটার সাথে, আর নানা রকম লোকের নানা রকম কথা, সব কিছু যেন একসাথে দেখতে পাচ্ছিল উজান খোলা চোখে। তাই তো মদের নেশায় ডুবিয়ে দিয়েছিল পুরোপুরি নিজেকে। ওই নেশাটাই তো ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবনে তো আর কোন ডিলিট বটন নেই। তাই এই নেশাটাকে আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ ভুলে থাকা যায় মাত্র। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলো নিজের হাতের ব্যান্ডেজটা। এটা কোথা থেকে এলো! তারপর হঠাৎ নিজের ঘরের দিকেও খেয়াল হয়ে যেন খুব অবাক হয়ে গেল উজান! ওর আবছা আবছা মনে আছে কালকের কথা। কাল সমস্ত পুরনো কথা মনে করে ভীষণ রাগ হচ্ছিল আসলে; তাই ঘরের সমস্ত জিনিসপত্রের ওপরই রাগটা বার করেছিল পাগলের মতন। আসলে এক এক সময় নিজের ওপর কন্ট্রোল থাকে না কোন। তখন মনে হয় ওর ভাঙাচোরা জীবনের মতন সব কিছু ভেঙে শেষ করে দিতে। কিন্তু এই ঘরটাকে আবার এইভাবে গুছিয়ে রাখলো কে! বিশু কাকা! প্রশ্নটা মনে আসতেই সেদিন শারদীয়া এসেছিল ওর ঘরে। তবে শারদীয়াকে দেখে উজানের কেমন লজ্জা লেগেছিল সেই সময়। আসলে কাল শারদীয়া নিশ্চয়ই ওকে খুব খারাপ অবস্থায় দেখেছে! ভেবেই কেমন ইতঃস্তত লাগছিল যেন। তবে শারদীয়া এই ভাবনার ভিড়েই উজানের কাছে এসে এক গ্লাস লেবুর জল এগিয়ে দিয়ে বললো,
——-” এটা খেয়ে নিন। বেটার লাগবে। ”
এই কথায় উজান চোখটা নামিয়েই লেবুর জলটা নিল। তারপর আস্তে গলায় একটু এলোমেলো হয়ে বলে উঠলো,
——–” কাল মনে হয় সবাইকে আমার জন্য খুব ঝামেলায় পড়তে হয়েছে! এম সরি ফর অল দিজ..”
কথাটায় শারদীয়া কিছুটা সহজভাবে বললো,
——–” এতটা ফরম্যালিটি না করলেও চলবে। আমি জানি কালকের দিনটার ব্যাপারে! বিশু কাকার মুখে শুনেছিলাম। আর আমি এটাও জানি মা বাবা চলে গেলে ঠিক কতটা কষ্ট হয়! ”

চলবে।