#হলুদ_শহরের_প্রেম – [১০]
লাবিবা ওয়াহিদ
চারতলায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। যার কারণে সকাল থেকেই সিঁড়িঘরে জিনিসপত্র টানা-হেঁচড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাবিনা অবসর পেলেই দরজা আলতো খুলে উঁকি দিয়ে পরখ করছেন। কিন্তু নতুন মুখের কাউকে নজরে পড়ছে না। মিনহাজ সাহেব বললেন এক অল্প বয়সী মেয়ে আর ছোটো ভাই-ই মিলেই নাকি পরিবার। এ কথা শুনে সাবিনার মন যেমন কৌতুহলী, তেমনই চিন্তিত। একা মেয়ে, পরিবার ছাড়া ভাড়া দেওয়াটা কী উচিত হয়েছে? আবার মেয়েটাকে একপলক দেখার জন্য ভীষণ কৌতুহলও অনুভব করছেন তিনি। দুই মিলিয়ে মনে হলো কৌতুহলকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন ভদ্রমহিলা।
সুপ্ত কাজের সুবাদে সকাল সকালই বেরিয়ে গিয়েছে। মিনহাজ সাহেবও নেই। গিয়েছেন হয়তো কোনো কাজে। বাসায় থেকে গেছেন সাবিনা এবং কাজের মেয়ে মাসুদা। তাও সহজে আসেনি। প্রতিদিন ওকে কল করে করে দ্রুত আনতে হয়। সে ফাঁকিবাজির সমস্ত ঘাট পার করে ফেলেছে যেন। সাবিনা মহা বিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও মুখে কিছু বলতে পারেন না। আজকালের এই যুগে কাজের লোক পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। আর সেটারই ফায়দা লুটে মাসুদার মতো মেয়েগুলা। নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায় যেন একদম।
সাবিনা যখন উঁকি দিচ্ছিল তখন মাসুদা চেঁচিয়ে বলল,
–“ও খালাম্মা, বারবার দরজা ফাঁক করে কী দ্যাহেন?”
সাবিনা দরজা লাগিয়ে মাসুদাকে বলল, “চারতলায় নতুন ভাড়াটিয়া আসছে মাসুদা। একটা মেয়ে আর তার ভাই।”
মাসুদা কী ভেবে বলল, “ওই টিভির মাইয়াটা?”
সাবিনা ভ্রু কুচকে বলল, “টিভির মেয়ে মানে?”
–“আরে হ, হ। কিসব ল্যাখে টিভির লেইগা, আমি তো আর এত কিছু বুঝি না। আপনের বাড়িত আওয়ার সময় নিচে দেখলাম মাইয়াডারে। আগে ওই পুরান বাড়িত থাকত।”
মেয়েটা টিভিতে কী করে সেটা মাসুদার কথায় এখনো বুঝে উঠতে পারেননি সাবিনা। মাথার ওপর দিয়েই গেছে মূলত। আকাশ-পাতাল ভাবতে গিয়ে মাসুদা তার কথা দ্বারা বাঁধ সাধলো।
থেমে বলল,
–“মাইয়াটা দেকতে ম্যালা সুন্দর কিন্তু খালাম্মা।”
সাবিনার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। ধমকিয়ে মাসুদাকে কাজে পাঠিয়ে দেয়। টিভিতে কী করে সেটা নাহয় মিনহাজ সাহেবের থেকেই শুনে নিবে।
জিনিসপত্র কম থাকার কারণে নিপুণের নব্বই শতাংশ গোছগাছ দুপুর তিনটার মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। নিশাতকে কোনো কাজে হাত লাগাতে দেয়নি। আগামীকালই নিশাতের পরীক্ষা, এজন্য নিশাতকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে সে। বাসাটা মোটামুটি বেশ বড়ো। নিশাত যেহেতু নেই, নিপুণ রিয়াকে ডেকে এনেছে সাহায্যের জন্য। রিয়া মেয়েটা খুব ভালো। অত্যন্ত সাহায্য করেছে তাকে। দুজন ক্লান্ত হয়ে বসতেই খুদায় পেট মোচড় দিয়ে ওঠলো যেন। নিপুণ আলতো হেসে বলল,
–“খাবার বাইরে থেকে অর্ডার করছি। এখন তো রান্না সম্ভব না।”
রিয়া সম্মতি দিলো। এমন সময়ই সদর দরজায় কড়াঘাত পড়ল। নিপুণ রিয়াকে বসতে বলে গিয়ে দরজা খুললো। খুলে দেখলো অদ্ভুত কিসিমের একটা মেয়ে হাতে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার মুখে টানা হাসি। নিপুণ তাকে চিনতে পারলো না।
মেয়েটা নিজ থেকেই বলল, “আপনের জন্যে খালাম্মা এই খাবার পাঠাইছে।”
নিপুণের ভ্রু কুচকে গেলো। খাবার? কে খালাম্মা?
নিপুণ প্রশ্ন মনে চেপে না রেখে সহসা প্রকাশ করল,
–“কে পাঠিয়েছে?”
–“আপনেগো বাড়িওয়ালী। আপনেরা মাত্র আইছেন, নিশ্চয়ই খান টান নাই কিছু। এর লাই আমারে দিয়া পাঠাইল। আমি বাড়িওয়ালার বাসায় কাম করি। নাম আমার মাসুদা।”
চট করে নিপুণের মাথায় খেলে গেলো একটি বাক্য, “মাসুদ তুমি কী কখনো ভালো হবা না?”
আর এই মেয়েটার নাম তো মাসুদা। সেরকম ধাচের মেয়েও তো লাগছে না। তবে বাড়িওয়ালীর প্রতি মন থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেল তার। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, মানুষটা বেশ ভালো মনের। নিপুণ সন্তুষ্ট মুখে সেই ট্রেটা নিয়ে ধন্যবাদ জানালো, এবং বলল,
–“আন্টিকে আমার সালাম জানাবেন।”
নিপুণের শান্ত, নরম ব্যবহার মাসুদাকে বোধ হয় বেশ ইম্প্রেস করলো। মুগ্ধতার রেশ নিয়ে মাসুদা দাঁত কেলিয়ে বলল, “কোনো দরকার হইলে আমারে ডাইকেন। আপনের জন্যে মাসুদা সবসময় ফিরি।”
নিপুণ হাসলো। মাসুদা চলে গেলো। নিপুণ দরজা আটকে আসতেই রিয়া প্রশ্ন করল,
–“কে এসেছিল?”
–“বাড়িওয়ালীদের কাজের মেয়ে। বাড়িওয়ালী খাবার পাঠিয়েছে।”
রিয়া বেশ অবাক হয়ে বলল,
–“আজকালকার যুগে এরকম কেউ করে ভাড়াটিয়াদের জন্য? ভদ্রমহিলা তো মনে হয় বেশ ভালো মানুষ।”
নিপুণ হেসে বলে,
–“বাড়িওয়ালা ভালো মানুষ হলে তার স্ত্রী ভালো হবে না কেন? মানুষটা আমার কত উপকার করেছে। গতকাল আমি বিপদে পড়ে এডভান্স দিয়ে আজ উঠতে চাইলাম, উনি রাজি হয়ে গেলো। মাসের মাঝামাঝি হওয়া সত্ত্বেও।”
রিয়া নিজেও সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো।
—————-
রাতে রিপোর্ট মেইল করে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ে হঠাৎ ফোনের মেসেজ টোন বেজে ওঠে নিপুণের। নিপুণ শুয়ে মোবাইল চেক করলো। সুপ্তের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। নিপুণ মেসেজে ক্লিক করতেই সুপ্তের মেসেজটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। মেসেজে লিখা,
“প্রাণ,
তোমার সকল দুঃখ পোশাকের ময়লার মতো ঝেড়ে ফেলো। চিন্তা করো না, খুব দ্রুত আমার নামে তোমায় করে নিব। এরপর দেখব কার সাধ্যি তোমায় কষ্ট দেওয়ার।”
শেষ বাক্যটি দেখতেই নিপুণের ভেতরটা অজানা কারণে ধ্ক করে ওঠে। কীসব বলছে এই লোক? মাথা কী ঠিক আছে?
নিপুণ মেসেজের কঠিন উত্তর দিলো,
–“দুঃস্বপ্নতেও আমি আপনার নামে নিজেকে রাঙাব না। তাই এসব আবেগ, কাব্যিক কথা ছাড়ুন এবং বাস্তবতা দেখুন। আমি মোটেও ফিকশনে লাল হওয়া মেয়ে নই।”
পরপর সুপ্তের মেসেজ,
–“ফিকশনে লাল হতে এমনিতেও হবে না। বাস্তবে, আমার সামনে লাল হবা। আমার বউরূপে। আই চ্যালেঞ্জ ইয়্যু নিপুণ, শুধু দেখে যাও।”
নিপুণ মুখ বাঁকালো। বিরক্ত হয়ে ফোনটা বালিশের কাছে রেখে শুয়ে পড়ল। আবোলতাবোল বকা কিংবা শোনার সময় তার নেই।
সকালে দ্রুত উঠতে হলো নিপুণকে। পড়ার জন্য ফজরের সময়ই নিশাতকে উঠতে হয়। তাই নিশাতকে উঠাতে হলো না। নিপুণ ফ্রেশ হয়ে দ্রুত হাতে নাস্তা বানালো। নতুন বাসাতে এই প্রথম নাস্তা বানাচ্ছে সে। নতুন ফ্ল্যাট, চারিপাশের পরিবেশ সব মিলিয়ে বেশ শান্তিপূর্ণ। নিপুণ চা করে বারান্দায় গিয়ে বসলো। বারান্দাটা আয়তকার মাঝারি আকারের। বারান্দার গ্রিল হাঁটুর কিছুটা নিচ থেকে শুরু হয়ে উপরের দেয়াল মিশেছে। বলা যায়, মোটামুটি ভালোই জায়গা আছে বারান্দাতে। দুজন পাশাপাশি বসতে পারবে চেয়ারে করে।
নিপুণ সুখ চুমুকের সাথে বারান্দা দিয়ে চারপাশে নজর বুলালো। এখানে বেশ কয়েকটা বাড়িঘর সহ থোকা থোকা গাছপালা দেখা যাচ্ছে। তার চাইতেও বড়ো ব্যাপার অদূরে একটা খেলার মাঠ আছে। ওখানে এলাকার কিশোর ছেলেরা বিকাল কিংবা শীতের রাতে, প্রায় সবসময়ই খেলার আসর জমায়।
পরীক্ষার সেন্টারে নিপুণই নিশাতকে দিয়ে আসে। নিশাতের পরীক্ষার সেন্টারটা বেশ দূরেই পড়েছে। ভেঙে ভেঙে যেতে বেশ সময় লাগে। নিশাত আগেই নেমে গেছে। আর নিপুণ সব চেক করে তালা লাগিয়ে কিছুটা সময় পর সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। তিন তলায় আসতেই দেখলো বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। মিনহাজ আঙ্কেল বলেছিল তাদের সাথে তাদের ছেলে থাকে। খুব সম্ভবত ইনিই সেই ছেলে। ছেলেটি পিছ ফিরে তাকাতেই নিপুণ নজর নামিয়ে চলে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সুপ্ত দরজা খুললো। সুপ্ত ঘুমে ঢুলুঢুলু। ছোটো ছোটো চোখে একপলক তাকিয়ে দেখতেই ঘুমের ঘোরে বলল,
–“আই হোপ, ঘুমের কারণে আমি ভুল দেখছি না।”
মাহমুদ হাসলো। সুপ্তের কাঁধ চাপড়ে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,
–“আফসোস তুই ভুল দেখছিস না। আমিই এসেছি। এখনো ঘুমোচ্ছিলি?”
সুপ্ত দরজা আটকে চোখ কচকালো। হাই তুলে বলল,
–“ঘুমাতে দেরী হয়েছিল, এছাড়া অনেকদিন পর আজ কোনো কাজ নেই। তাই, ঘুমানোই যায়।”
মাহমুদ আশপাশ তাকিয়ে বলল,
–“মা কোথায়?”
–“কেন? কল করে আসোনি?”
–“না, ভাবলাম সারপ্রাইজ দেই।”
সুপ্ত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“গিয়ে বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
মাহমুদ সোফায় গিয়ে বসলো। সুপ্ত ফ্রেশ হতে সময় নিলো না। সুপ্ত এসে সোফায় বসলো সেভেন আপের বোতল নিয়ে। সেটা মাহমুদের দিকে ছুঁড়ে মেরে সোফায় বসলো।
–“ফ্রিজে এটাই ছিল। খা, আমি নাস্তার অর্ডার দিয়েছি।”
মাহমুদ তৃষ্ণার্ত হয়ে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ হতেই মাহমুদ মুচকি হেসে বলল,
–“মা নাকি তোকে বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে? কবে বিয়ে করছিস?”
বিরক্তির ভাঁজ পড়ল সুপ্তের কপালে। ছোটো চোখে মাহমুদের দিকে চেয়ে বলল,
–“ভাই প্লিজ, তুমি আবার শুরু কোরো না।”
–“কেন? তোর সমস্যা কোথায়? তুই নাকি কাকে পছন্দ করিস বলেছিলি? সে কোথায়?”
–“আমার নীড়েই আছে ভাই। তবে তাকে রাজি করানো কষ্টসাধ্য।”
অবাক হলো মাহমুদ। অবাক সুরে বলল,
–“রাজি হচ্ছে না মানে? আমার ভাই কোন দিক থেকে কম? আমার ভাইয়ের জন্য সব মেয়েরা পাগল আর ও কেন নয়? রাজি না হয়ে যাবে কোথায়?”
সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আপনমনে বলল,
–“অন্য মেয়েদের মতো নয় বলেই তো ওকে আমি ভালোবাসি ভাইয়া। নিপুণ আমার জন্যই গড়া, সে আমারই হবে। যত দাগই থাকুক না কেন তার মধ্যে, আমি সেসব দাগকে ভালোবেসে ফুল বানিয়ে নিব।”
চলবে—