#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ১৩ ( অন্তিম পর্ব )
রুমের মধ্যে পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। মাহিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে শান্ত কন্ঠে বলল,
” জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করলাম। মনে হয়েছিল মাথার যন্ত্রণায় মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো তখন আমার শুধু ইভাকে খুঁজছিল। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি মা আমার একটা হাত ধরে বসে আছেন। সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছেন। রুমে আর কেউ ছিল না। আমি নড়াচড়া করতেই মায়ের ঘুম ছুটে যায়। বাইরে গিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনেন। আমার জ্ঞান ফিরেছে শুনে বাবা আলভী, সাকিব, মিম’রা আমার সাথে দেখা করতে হাসপাতালে আসে। মা কাঁদছেন। উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করেন আমি ঠিক আছি কিনা। এখন আমার কেমন লাগছে। আমি এসবের উত্তর না দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলেছিলাম ইভা কোথায়? তারা কেউ কিছু বলেনি। আমি ইভার কাছে যাব। ইভাকে এনে দাও বলে চিৎকার করছিলা। হাতের ক্যানেল খুলে ফেলেছিলাম। র*ক্ত উঠে এসেছিল তাতে। বেড থেকে নামার চেষ্টা করছিলাম। আমার পাগলামো দেখে শেষে আলভী বলতে বাধ্য হয়েছিল। সে বলল, আমি নাকি তিন দিন ধরে সেনসলিস হয়ে হাসপাতালে ছিলাম। আজকেই আমার জ্ঞান ফিরেছে। আর ইভার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমি হসপিটালে থাকা কালিন বাবা, বন্ধুরা সবাই মিলে ইভাকে খুঁজে আমার কাছে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দিন শেষে সবাই হতাশ হয়েছিল। কেওই জানতে পারেনি ইভা এখন কোথায় আছে। ”
এইটুকু বলে অধরার দিকে তাকিয়ে পানি দিতে বলল। গলাটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। অধরা চটজলদি পানি এনে দিতেই মাহিম এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিল। গ্লাসটা সাইডে রেখে পুনরায় বলতে শুরু করলো,
” ইভাকে হারিয়ে শারীরিক ভাবে সুস্থতো হয়েছি। কিন্তু দিনের পর দিন আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। না ঠিক মতো খাবার খেতাম, না কারো সাথে ঠিক করে কথা বলতাম, কেউ কাছে আসলে ঘরের ভেতর ভাঙচুর শুরু করে দিতাম। ইভার সাথে কাটানো কিছু মুহূর্তে ছবি ছিল আমার ফোনে। সারাদিন সেই ছবি গুলোই দেখে কাটিয়ে দিতাম। এক প্রকার ঘরবন্ধী করে রেখেছিলাম নিজেকে। দেখতে দেখতে প্রায় তিন-চার বছর পেরিয়ে গিয়েছিল। তবে আমার মানসিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। উল্টো খারাপ হতে শুরু করেছিল। আমার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে বাবা আমার ফোন থেকে ইভার সব ছবি ডিলিট করে দিয়েছিলেন। তার জন্য নিজেকে নিজেই আ*ঘাত করার চেষ্টা কছিলাম। বাবা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসি? সেজন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন। আমি তাদের এক মাত্র সন্তান। আমার এসব পাগলামো, অসুস্থতায় বাবা-মাও চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তুমি তো জানো মায়ের প্রেশারে সমস্যা আছে। একদিন মায়ের প্রেশার বেড়ে গিয়ে এতটা পরিমাণে অসুস্থ হয়েছিলেন যে তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। সেদিন আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছিলেন মাকে কোনো টেনশন দেওয়া যাবে না। আমার কিছুই ভালো লাগছিলো না। মনের ভেতর শান্তি না থাকলে কোনো কিছুই ভালো লাগে না। আলভী, সাকিব এসে আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। আমি যদি ভালো থাকি, আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাই। হাসি খুশি থাকি তাহলে মা দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন। তারমধ্যে বাবা এসে আমাকে বিয়ে করার কথা বলেন। রাজি ছিলাম না। মায়ের কথা চিন্তা করে রাজি হতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভাবলাম অন্তত মায়ের জন্য হলেও নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। সেদিন মায়ের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখেছিলাম। শুধু একটা বিষয় নিয়ে টেনশন হচ্ছিল আমার। যাকে বিয়ে করবো তাকে নিয়ে আজও সংসার করতে পারবো কি না। মনে জায়গা দিতে পারবো কি না। কারন যে আসবে আমার বউ হয়ে সেই মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই। তাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো অধিকার আমার নেই। যদি সেটা করি তাহলে তাকে বিয়ে করে তার জীবন নষ্ট করার কোনো অধিকারও আমার নেই। ”
” আমাকে কি তোমার মায়ের পছন্দেই বিয়ে করেছিলে? ”
মাহিম মুচকি হেসে বউয়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। চমকায় সে। পরপর হাতটা মাহিমের মাথার চুলের ভাঁজে গুজে দেয়। আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে মাহিম বলল,
” যদিও তোমাকে সবার আগে মা-বাবাই পছন্দ করেছিলেন। তবে যেদিন তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম তুমি যখন সবাইকে শরবত দিচ্ছিলে, আমার দিকে পেছন ফিরে ছিলে। তোমাকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল তুমি ইভা। পেছন থেকে দেখে আমার সেটাই মনে হয়েছিল। খুশি হয়েছিলাম। যখনি আমার দিকে ফিরে আমাকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিলে তখন তোমার মুখ পুরোপুরি ভাবে দেখতে পেয়েছিলাম। নাহ! এতো লাল পরী নয়! তবে তোমার চোখ দুটো একদম ইভার মতো দেখতে। তোমার মুচকি হাসিটাও। তক্ষুনি মনস্থির করে ছিলাম বিয়ে করলে তোমাকেই করবো। এমনিতেও বাবা-মার জন্য বিয়ে তো আমাকে করতেই হতো। আর সেই মেয়েটা তুমি হলে ক্ষতি কি? তাইতো কিছুদিনের মধ্যেই তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিলাম। তোমার মধ্যে নিজেকে নতুন ভাবে গড়ার পথ খুঁজতে চেয়েছিলাম। একসময় তোমার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি। দ্বিতীয় বারের মতো তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ইভার কথা শুরুতেই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম মা বলতে নিষেধ করেছিলেন। তবুও আমি চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে সবটা বলার। কিন্তু পারিনি। সময়ও সঙ্গ দেয়নি। কালকে ইভার সাথে হঠাৎ দেখা না হলে হয়তো কোন দিনই জানতে পারতে না। ভালোবাসা কোনো পাপ নয় অধরা। আচ্ছা, আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই নতুন কাউকে পেয়ে তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে? তোমার মনে কি আর আমাকে রাখবে না? চিরজীবনের জন্য ভুলে যেতে পারবে?”
মাহিমের কথায় অধরার বুক কেঁপে উঠে। সহসা মাহিমের ঠোঁটে হাত রেখে ইশারায় মাথা নাড়িয়ে এমন কথা বলতে নিষেধ করে। অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে বলল,
” কক্ষনো না। তোমাকে ভুলে যাব এটা তুমি ভাবলে কি করে? আর আমি চাইও না তুমি ইভাকে ভুলে যাও। যদি সেই ভালোবাসার মানুষটিকে ভুলে যাও তারমানে তো তোমার জীবনে নতুন কেউ আসলে তাকে পেয়ে আমাকে ভুলে যাবে। ইভাকে সহ্য করে নিয়েছি আমি। তবে এরপর অন্য কাউকে সহ্য করতে পারবো না। আমার পর তোমার জীবনে অন্য নারী যেন না আসে। আমি তোমার প্রথম ভালোবাসা হতে পারিনি তো কি হয়েছে? আমি তোমার শেষ ভালোবাসা হয়ে তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই। ”
মাহিম ওঠে বসে। তৃপ্তিময় হেসে অধরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” ইভাকে হয়তো আমি ভুলতে পারিনি। মনের এক কোনে যত্নে রয়েছে সে। তবে সময়ের সাথে তার কথা মনের এক কোণায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। তোমার সীমাহীন ভালোবাসা ইভার কথা আমাকে মনে করতে দিত না। ”
**********
ব্রেকফাস্ট করে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে মাহিম। অধরা ঘরের টুকিটাকি কাজ করছে। এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। পরপর তিনবার বেল বাজলো। অধরা যেতে নিলেই মাহিম ইশারায় বুঝালো সে দেখছে। অধরা মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিল। দরজা খুলে সামনে তাকাতেই চমকে গেল। ইভা দাঁড়িয়ে আছে। মাহিমের শরীর মৃদু কেঁপে উঠল। কথা বলার ক্ষেই হারিয়ে ফেলেছে। এই মুহূর্তে এখানে ইভাকে সে আশা করেনি। আবার কোন নতুন ঝড় আসতে চলেছে তার জীবনে? অধরা দেখলে তাকে ভুল বুঝবে না তো? সে তো ইভাকে আসতে বলেনি। অধরা কি বিশ্বাস করবে? ওর ভাবনার মাঝেই ইভা ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছো মাহিম? ভুলে গিয়েছ নাকি আমাকে? নাকি চিন্তেই পারছো না?
মাহিমের শরীরের ঘাম ছুটে গিয়েছে। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। কি বলবে? কি উত্তর দিবে? ইভা পুনরায় শুধালো,
” কথা বলবে না আমার সাথে? ”
মাহিম নিজেকে সামলে শান্ত কন্ঠে বলল,
” এইত ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো? ”
” এতদিন ভালো ছিলাম না। তবে চেষ্টা করবো এখন থেকে ভালো থাকার। ”
” ভালো ছিলে না মানে? তোমার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তোমার বাবার পছন্দের ছেলের সাথে তাই না? তোমার স্বামী কোথায়? ”
ইভার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। দ্রুত ওড়না দ্বারা তা মুছেও নিল। তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
” বিয়ে! আমার তো কোনো বিয়ে হয়নি। ”
মাহিম অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। উৎকন্ঠা সহিত জিজ্ঞেস করে,
” কি বলছো এসব? বিয়ে হয়নি মানে কি? বিয়ে না হলে এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? ”
” আমেরিকায় ছিলাম। সেদিন তোমার থেকে দূরে চলে আসার পর বিয়ে না দিয়েই বাবা আমাকে রতনের সাথে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন। যেতে না চাইলে রতন আমার গায়ে হাত তোলে। জোড় করে নিয়ে যায় তার সাথে। সেখানে নিয়ে সে আমাকে বিয়ে করেনি। প্রতি রাতে সে আমাকে নিজের বেড পার্টনার বানাতো। যদি বিয়ে করে কিছু করতো তবুও ভাগ্য বলে মেনে নিতাম। জা*নো*য়া*রের মতো আমার দেহে আ’ক্র’মন করতো। শারীরিক ভাবে নি’র্যা’তন করার পাশাপাশি মানসিক ভাবেও অ’ত্যা’চার করতো সে। টানা এক মাস আমাকে ভোগ করার পর নিষিদ্ধ পল্লিতে রেখে আসে। আমার সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কতশত লোক আসতো। চওড়া দামে বিক্রি হতাম আমি একেক জনের কাছে। মাঝেমাঝে রতনও এসে নিজের খায়েশ মিটিয়ে যেত আমার মাধ্যমে। এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলাম না। দুইবার সু*ই*সা*ইড করতে চেয়েছিলাম, পারিনি। রতনের লোকেরা সর্বক্ষণ আমার উপর নজর রাখত। পালানোর সকল রাস্তাই বন্ধ ছিল আমার জন্য। বাবাকেও তার প্রাপ্য জিনিস দেয়নি। ঠকিয়েছে তাকে। না বাড়ি আর না গাড়ি। উল্টো তাকে অনেক ট’র্চার করেছিল। এখন বাবা কোথায় আছে আমি জানি না। জানতেও চাই না। আমার জীবন ধ্বংশ হওয়ার একমাত্র কারন তিনি। তাকে আমার বাবা বলতেও লজ্জা লাগছে। মেয়ের থেকেও তার কাছে টাকা, ক্ষমতা পাওয়ার লোভ বেশি ছিল। ঘৃণা করি তাকে আমি। ”
সবকিছু শুনে মাহিম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে তার। ওর লাল পরী এতটা কষ্টে ছিল? এতটা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল তাকে? মাহিমের চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। ওর ইচ্ছা করছে লাল পরীকে ঝাঁপটে বুকের ভেতর আগলে নিতে। কিন্তু পারছে না। পা দুটো কাঁপছে। ক্ষীণ স্বরে বলল,
” আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে কিভাবে আসলে? ওরা কি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিল? ”
মাহিমের কথায় ইভা শব্দ করে হেসে উঠে। মাহিম বুঝতে পারছে এই হাসির পেছনে কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে।
” তারা ছেড়ে দিবে আমাকে? সোনার ডিম দেওয়া হাস’কে কেউ ছেড়ে দেয়? আমাকে দিয়ে তাদের ব্যবসার যতটা লাভ হয়েছে, ছেড়ে দিয়ে ব্যবসার লস করার মতো এতটা দয়াশীল মানুষ রতন নয়।আজকে আমি’সহ বেশ কয়েকদন মেয়েকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে খোদ্দের জন্য। সুযোগ বুঝে রতনের লোকদের দৃষ্টি এড়িয়ে এয়ারপোর্ট থেকে পালিয়ে এসেছি। ম’রে যাবো তবুও ওই নরকে আর ফিরে যেতে চাই না। সেখান থেকে পালিয়ে ভেবেছিলাম আ’ত্য’হ’ত্যা করবো। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তোমার সাথে পার্কে দেখা হয়ে গিয়েছিল বলে নিজেকে আর আটকাতে পারিনি। পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলাম তোমার কাছে। আমি জানতাম না তুমি বিবাহিত। জানলে কক্ষনো তোমার স্ত্রীর সামনে তোমাকে ওই ভাবে জড়িয়ে ধরতাম না। ”
ফুঁপানোর আওয়াজ শুনতেই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাল ইভা। ড্রয়িং রুমের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে অধরা। মাহিমও তাকাল। এতক্ষণ ইভার বলা সব কথাই শুনেছে সে। ইভা এগিয়ে যায় তার নিকট। মাহিম বাঁধা দিতে গিয়েও দিল না। অধরার থুতনিতে হাত দিয়ে মাহিমের দিকে চেয়ে ম্লান হেসে ইভা বলল,
” তোমার বউ তো বেশ সুন্দরি। পছন্দ আছে। ”
নজর ফিরিয়ে মুচকি হেসে অধরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” তুমি মাহিম’কে ভুল বোঝোনা। আমি তোমার থেকে তোমার স্বামী’কে কেড়ে নিতে আসিনি বোন। আমাদের এক সাথে দেখে রাগ করে যখন চলে এসেছিলে? মাহিমও ছুটে ছিল তোমার পিছু। তখনি বুঝে গিয়েছিলাম তুমি হয়তো ওর বউ। তোমাদের মধ্যে আমার জন্য যেন ভুল বোঝা-বুঝি সৃষ্টি না হয়, সেজন্য এসেছি। আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি যদি এখন মাহিমের জীবনে ফিরে আসতে চাই মাহিম আমাকে মেনে নিবে না। কেন জানো? কারন ওর জীবনের সাথে তুমি জড়িয়ে আছো। আমাকে ফিরিয়ে দিলেও সারাজীবন কষ্টের আগুন ওর বুকের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলবে। না পারবে আমার কথা ফেলতে। না পারবে তোমাকে নিয়ে সুখে সংসার করতে। আমি মাহিমকে ভালোবাসি। একটু বেশিই ভালোবাসি। যাকে ভালোবাসি তাকে কষ্ট পেতে কিভাবে দেই বলো? তাছাড়া আমার সব থেকে মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে ফেলেছি। এই অপবিত্র আমিটাকে কিভাবে দিব আমার ভালোবাসার পবিত্র মানুষটাকে? আমরা শুধু ভালোবেসেছি। কোনো অন্যায় করিনি। ভালোবাসা একটি পবিত্র শব্দ। এই পবিত্র শব্দটাকে ব্যবহার করে যারা ভালোবাসার নামে নোংরামো করে বেড়ায় দোষ তাদের। ভালোবাসার নয়। সেদিন সবকিছু ঠিক থাকলে মাহিমের জীবনে আমি থাকতাম। তুমি না। ভাগ্যের কাছে হেরে গিয়েছি আমরা। আমার জন্য মাহিমকে কষ্ট দিওনা প্লিজ। ও খুব ভালো ছেলে।
অধরা মাথা নিচু করে নিল। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে অনুতপ্ত। সত্যিই তো! ইভা থাকলে মাহিমকে সে পেত না। না জেনে না বুঝে কাউকে নিয়ে বাজে কথা বলা ঠিক না। রেগে ইভাকে নিয়ে কতকিছু বলে ফেলেছিল। যেখানে মেয়েটার কোনো দোষ নেই। উল্টো মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছে এতদিন। মাথা উঠিয়ে সে বলল,
” তুমি কেন ক্ষমা চাইছো আপু। অাই এম সরি। আমি না জেনে তোমাদের ভুল বুঝেছিলাম ”
অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ইভা। মাহিমের কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর চোখ জোড়া লাল হয়ে উঠেছে। মাহিম কিছু বলছে না। চুপ করে এক দৃষ্টিতে ইভার দিকে চেয়ে আছে। মুচকি হেসে ইভা বলল,
” ভালো থেকো তোমরা। আমার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। উমম হু! ভেবো না নিজের কোনো ক্ষতি করবো। লন্ডনে আমার এক খালামনি আছে। তার সাথে কথা হয়েছে। তার কাছে চলে যাবো। বাকিটা জীবন তোমার স্মৃতি বুকে নিয়ে আরামছে কা’টিয়ে দিতে পারবো। তোমার থেকে যতটুকু ভালোবাসা পেয়েছি। একজীবনে বেঁচে থাকার জন্য আমার এতটুকুই যথেষ্ট। আর কিছু চাওয়া বা পাওয়ার নেই। ”
বলতে বলতে পা দিয়ে ধীর কদমে পেছনের দিকে পেছাতে পেছাতে, অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষ বারের মতো দেখছে তার অতি যত্নে করে গড়ে তোলা ভালোবাসার মানুষটিকে। যেতে যেতে পুনরায় আওড়ালো,
❝ চিন্তা নেই প্রিয়
আর ফিরবো না
তোমার এই শহরে। ❞
আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না ইভা। পেছন ঘুড়ে হাঁটা ধরলো নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একটি বারো আর ফিরে তাকালো না। মাহিমের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শরীর ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়েছে। ঘন ঘন শ্বাস টানছে। তার লাল পরী চলে গিয়েছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে। অধরা তড়িৎ বেগে কাছে এসে মাহিমকে বুকের ভেতর ঝাঁপটে ধরে। মাহিমের শরীর কাঁপছে। চোখের জলে অধরার গলদেশ ভিজে গিয়েছে। অধরা নিজেও স্বামীর কষ্টে হাউমাউ করে কাঁদছে। নিয়তি এত নিষ্ঠুর কেন? মাহিমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাদের মতো কান্না করছে অধরা। মাহিম তাকায় স্ত্রীর অশ্রু ভেজা মুখের দিকে। মেয়েটা অনেক নরম মনের। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারে না। অল্পতেই ইমোশনাল হয়ে যায়। নিজের কান্না ভুলে বউকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কপালে বার কয়েক চুমু খেয়ে, বুকের সাথে ভালো ভাবে মিশিয়ে মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে ক্রন্দনরত গলায় বলল,
” আমাকে শক্ত করে তোমার সাথে জড়িয়ে রাখো অধরা। আমি আর পেছন ফিরে তাকাতে চাই না। বাকিটা জীবন তোমার বুকে মাথা রেখে শান্তিতে কাটিয়ে দিতে চাই। তোমার সাথে সুখের সংসার করতে চাই বউ। ভালো থাকতে চাই আমি। ”
সত্যি ভালোবাসা খুব কষ্টের। কাউকে দেয় সীমাহীন সুখ দিয়ে পূর্ণতা। কাউকে আবার দেয় বিষাদময় যন্ত্রণা দিয়ে অপূর্ণতা। তবুও মানুষ ভালোবেসে যায়। ভালোবাসলে তাকে পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দূর থেকেও ভালোবাসার মানুষ’টিকে ভালোবাসা যায়।
সমাপ্ত।