হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-০৫

0
98

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ৫

বাইরে শনশন করে বাতাস বইছে। হাওয়ার প্রোকপে জানালার পর্দা গুলো উড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের বাতাস রুমের ভেতর ঢুকছে। ঠান্ডা হাওয়া নিমেষেই মন প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে। আরাম পেয়ে গাঁয়ের কম্বল’টাকে আরেকটু ভালো ভাবে জড়িয়ে নেয় ইভা। বাতাসের তান্ডবে খোলা চুল গুলো উড়ে এসে চোখ, মুখে এসে পড়ছে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে ওঠে বসল সে। জানালার পর্দা গুলো ভালো ভাবে সরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেথায়। হাওয়ার তালে ওর চুল গুলোও দুলছে। একটা ক্লিপ নিয়ে উঁচু করে বেঁধে নিল। গ্রিলে হাত রেখে দূর আকাশে দৃষ্টি মেলাল। চোখ দুটো বুজে এলো সহসা। অমনি বাম গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করে রেডি হয়ে বন্ধুদের ডাকতে গেল। তারা সকলেই ওঠে পড়েছে। সোমা এসে বলল,

” আর কত ঘুমাবি! এখন ওঠার সময় হলো তোর? আমরা ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছি। তুইও করেনে। ”

ইভা তাচ্ছিল্য হাসে। সবসময় তো ওকে একাই থাকতে হয়। একাই খেতে হয়। এ আর নতুন কি। ওর জন্য অপেক্ষা করার মতো কোনো দিন না কেও ছিল! না কেও আছে। বলল,

” আচ্ছা তোরা যা। আমি খেয়ে আসছি। ”

” তাড়াতাড়ি আসিস। আমরা বিচের দিকে যাচ্ছি।”

” ওকে। সেখানেই ওয়েট কর গিয়ে। ”

বন্ধুরা চলে যায়। গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে নিচে নেমে আসে। ইভা গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। ওয়েটারকে ডেকে মেনু কার্ড দেখিয়ে খাবার অর্ডার করে দেয়। মাহিম এসে ইভা যেই টেবিলে বসেছে, সেই টেবিলের একটা চেয়ারে বসে পড়ে। ও অন্য টেবিলে বসে কফি খাচ্ছিল। ইভাকে দেখে এখানে চলে এসেছে। ইভার দিকে তাকিয়ে স্মিথ হেসে বলল,

” গুড মর্নিং লাল পরী। ”

হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইভা ভ্রু কুঁচকে বলল,

” সকাল প্রায় এগারোটা বেজেছে। আপনার জন্য এখনো গুড মর্নিং? ”

” ওই একটা হলেই হলো। আর তোমাকে কাল কি বলেছি? ”

” কি বলেছিলেন? ”

” বলেছিলাম আমাকে তুমি করে বলবে। ”

” ওহ্। মনে থাকেনা। তো আমার যেটা ইচ্ছে সেটাই বলবো। ”

ওদের কথার মধ্যেই ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে যায়। পিঁজ্জা অর্ডার করেছে ও। মাহিম কে খেতে বললে না করে দেয়। ইভা খাচ্ছে আর মাহিম এক দৃষ্টি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ইভা খাবারে মনযোগ দিয়েই বলল,

” এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকলে পেট খারাপ হবে। অন্য দিকে তাকান। ”

” আমি মোটেই তোমাকে দেখছিনা। আমি তো তোমার পিছনের মেয়েটাকে দেখছিল। আহা! কি সুন্দর করে খাচ্ছে। কি কিউট না মেয়েটা? ”

মাহিমের কথায় পেছনে তাকিয়ে দেখে মাঝ বয়সি এক মহিলা ওদের পেছনের টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে। মহিলাটির ওজন কম হলেও আশির উপরে তো হবেই। ইভা ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,

” হ্যাঁ। অনেক কিউট। যান গিয়ে দেখুন পটাতে পারেন কিনা। ”

মাহিম সেই হাসির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,

” যাকে পটাতে চাই সে তো পাত্তা দেয় না। অন্য দিকে নজর দিয়ে কি লাভ? ”

ওদের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ কথা চললো। খাবার খেয়ে বিচের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিল ওরা। কথা বলতে বলতে ওদের বাকি বন্ধুদের নিকট পোঁছে গেল। গিয়ে দেখে সেখানে আড্ডা বেশ ভালো জমেছে। মাহিম বলল,

” কিরে তোরা কি নিয়ে এত হাসা হাসি করছিস। ”

আলভী দমফাঁটা হাসি দিয়ে বলে,

” দোস্ত আর বলিস না। আজকে সাকিব কি করেছে জানিস! ”

মাহিম তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

” না বললে জানবো কি করে? ”

” বলছি। বলছি। আজ সকালে সাকিব ঘুম থেকে ওঠে যখন নিচে নামলো। তখন ওর লুঙ্গি……”

বাকিটা বলার আগেই সাকিব এসে ওর মুখ চেপে ধরলো। মাহিম যা বোঝার বুঝে গিয়েছে। ইভা ঠোঁট টিপে হাসছে। আলভী উমমম উমমম করছে। সাকিব ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে কটমট করে বলল,

” শা*লা মেয়েদের সামনে আমার রেপুটেশন খারাপ করতে চাচ্ছিস ? তোর মুখ আমি ভেঙে দিব। ”

আলভী জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে বলে,

” ব্যাটা ডা*কাত। আর একটু হলে দম আটকে মা’রা যেতাম। ”

মাহিম, আলভীকে ধমকে বলল,

” কি শুরু করেছিস তোরা। বেচারা এমনিতেই গরিব। তাই হয়তো ভেতরে পড়ার মতো কিছু ছিল না। এজন্য ওকে নিয়ে ট্রল করবি। দিস ইজ নট ফ্যার ওকে। ”

বলেই হাসতে থাকে। বাকিরাও হাসছে। সাকিব রাগে ফুঁসছে। মাহিম, আলভীর উদ্দেশ্যে বলল,

” আচ্ছা ফুল প্যান্ট বানাতে কত মজুরি লাগতে পারে? তোর বাবাতো ট্যাইলার। তুই নিশ্চই জানবি? ”

আলভী মাথা নেড়ে বলল,

” এই ধর ছয়শত টাকা। ”

” হ্যাফ প্যান্ট বানাতে কত পরবে? ”

” তিনশত টাকা। ”

” আর জাঙ্গি”য়া? ”

” একশত পঞ্চাশ টাকার মতো। ”

” ঠিক আছে। ”

” কিন্তু এটা যেনে তোর কি কাজ? ”

মাহিম ঠাট্টার হাসি হেসে বলল,

” আমার না। তোর কাজ। তুই তাহলে সাকিবকে একটা জাঙ্গি*য়া কিনে দিস। শুধু জাঙ্গি*য়ার ঝুলটা বাড়িয়ে পায়ের টাকনু পর্যন্ত করে দিস। তাহলেই আর কোনো প্রবলেম হবে না। কি বলিস? ”

মাহিমের কথায় সবাই পুনরায় হো হো করে হেসে উঠল। সাকিব ক্রো’ধ নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। ইভা বলল,

” আপনি তো ভারি অসভ্য। এভাবে ওনাকে ক্ষেপানোর কি খুব দরকার ছিল? হয়তো ওনার খারাপ লেগেছে। ”

” এইযে মানবতার ফেরিওয়ালা। তা আপনার ফেরি ঠিক আছে নাকি ভেঙে গিয়েছে? ”

বুঝতে না পেরে ইভা ভ্রু কুঁচকালো,

” মানে? ”

মাহিম দুষ্টু হেসে বলল,

” এতই যদি তোমার মধ্যে অন্যের জন্য দরদ থাকে। তাহলে আমার প্রতি একটু দরদ দেখালেও তো পারো। ”

ইভা মুখ বাঁকিয়ে বলে,

” আমি আবার যাকে তাকে দরদ দেখাই না। আর আপনাকে তো নয়ই। ”

” আচ্ছা দরদ দেখাতে হবেনা। শুধু সঙ্গ দিলেই হবে। ”

” বুঝতে পারিনি। ক্লিয়ার্লি বলুন। ”

” সময় হলেই বুঝতে পারবে। আপাতত এই টপিক বাদ দাও। চলো পানি পা ভেজাই। ”

**********
সময় তার নিজস্ব গতিতে বহমান। দেখতে দেখতে ওদের সবার যাওয়ার সময় ফুড়িয়ে এসেছে। সকলে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। আজকেই বাড়ি ফিড়ে যাবে সবাই। এদিকে মাহিমের ভীষন অস্থির অস্থির লাগছে। আজকের পর লাল পরীকে আর দেখতে পারবেনা। অজানা এক শুক্ষ্ণ ব্যথা দানা বেঁধেছে বুকের বাম পাশটায়। যেটা কাওকে দেখানো যায় না। অনুভবেই তা প্রকাশ পায়। কত শত চিন্তা করে স্থির করল ইভার সাথে সরাসরি কথা বলবে। এক মুহূর্ত দেড়ি করলো না। ইভার রুমের দিকে পা বাড়াল। ইভা যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। দরজায় নক পড়তেই খুলে দেখে মাহিম দাঁড়িয়ে আছে। চোখ, মুখে বিষণ্ণতার ছাঁপ স্পস্ট। ইভা দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। মাহিম ভেতরে প্রবেশ করে। ইভা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আপাদমস্তক পরখ করছে মাহিমের। মাহিম আমতা আমতা করে বলল,

” তোমাকে আমার কিছু বলার আছে। আই মিন বলতে চাই। ”

” জ্বি। বলুন। ”

” এখানে না রিসোর্টের বাইরে চলো। ”

” কেন ? এখানে বললে কি প্রবলেম ? ”

” ইভা প্লিজ। বোঝার চেষ্টা কর। বিচের দিকে যাই। অথবা কালকে যেখানে বসে অনেকে ট্রুথ ডেয়ার খেলেছে সেখানে চলো। ”

” আমার লেট হয়ে যাবে মস্টার মাহিম। ফ্রেন্ডরা সবাই রেডি। শুধু আমি বাদে। যা বলার এখানেই বলুন। ”

” কোনো লেট হবেনা। ঢাকায় যাবেতো তোমরা রাইট? আমরাও তো ঢাকায় ফিরবো। সবাাই এক সাথেই যেতে পারবো। প্লিজ আমার কথাটা একটু শোনো। ”

মাহিমের কন্ঠে কাতরতা। ইভা আর কিছু বললো না। মাহিমের পিছু পিছু চলল। মাহিম ইভাকে সেদিকটায় নিয়ে আসলো। যেখানে ও ইভাকে প্রথম দেখেছিল। বিচের পশ্চিম দিকটায়। এখানেই তো বালুর মধ্যে হেঁটে চলা, মুক্তর মতো দন্ত পাটি বের করে খিল খিল করে হেসে উঠেছিল ওর লাল পরী। প্রথম দেখাতেই যার বক্ষস্থলে অদ্ভুত শিহরণ জেগে ছিল। সেই মুখের মায়ায় আটকে ছিল। নিরবতা ভেঙে ইভা বলল,

” এবার বলুন। কি বলতে চান। ”

মাহিম জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। বার কয়েক ঢোক গিলে ইভার চোখের দিকে তাকায়। ইভাও ওর দিকে উৎসক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহিম ওর চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

” আমি তোমাকে ভালোবাসি ইভা। বিশ্বাস করো। প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি। কিভাবে হয়েছে আমি জানি না। কিছুই বোধগম্য হয়নি। শুধু জানি তোমাকে আমার লাগবে। সারাজীবন আমার সাথি হয়ে পাশে থাকবে। লাইফে অনেক মেয়ে আমাকে প্রপোজ করেছে। কারো দিকে ফিরেও তাকাইনি। কিন্তু তোমাকে প্রথম দেখায় আমার বুকে কিছু একটা হয়েছিল। অজানা ভালো লাগায় মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। চোখ বুঝলেই তোমার মুখশ্রী ভেসে উঠে। আই রিয়েলি লাভ ইউ। ”

চলবে,,,,,