হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-০৬

0
15

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ৬

ইতোমধ্যে সূর্য তার কিরণ ছড়িয়ে দিয়েছে ধরনীর বুকে। বাতাসের প্রকোপে বালিকণা গুলো উড়ছে অবিরত। হাওয়ার তালে ইভার উন্মুক্ত চুল গুলো দুলছে। হলুদ রঙের ওড়নাটাও ঢেউ’য়ের সাথে তাল মিলিয়ে একেঁবেকে উড়ছে। এক ধ্যাঁনে মাহিমের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মাহিম অসহায় চোখে উত্তরের আসায় ইভার দিকে চেয়ে। কি বলবে? কি বলা উচিত? কিছুই বুঝতে পারছেনা ইভা। মাহিম অধৈর্য সহিত বলে উঠলো,

” প্লিজ চুপ করে থেকোনা ইভা। কিছুতো বলো। ”

হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করে ইভা বলল,

” আপনি যে আমাকে পছন্দ করেন সেটা আমি প্রথম দিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনার কথা শুনেই বুঝে গিয়েছিলাম। ”

ওর কথা কেঁড়ে নিয়ে মাহিম বলল,

” বুজেও এত নিরব কেন? কেন এত যন্ত্রনা দিচ্ছ?”

” আমার কথাটা শেষ করতে দিন। ”

” বলো। ”

ইভা হালকা হেসে বলে,

” যেকোন ছেলের চোখের দিকে তাকিয়েই একটা মেয়ে বলে দিতে পারবে, যে ছেলেটা সেই মেয়েকে কেমন নজরে দেখে। প্রথম যখন আমাদের দেখা হয়েছিল। আপনার চোখে আমার জন্য একরাশ মুগ্ধতা দেখেছি আমি। বারান্দায় দাড়িয়ে আমার চোখ, ঠোঁট নিয়ে যেই মন্তব্য গুলো করেছিলেন সেগুলো মন থেকে বলেননি। আমাকে ক্ষপানোর জন্য বলেছিলেন। বিচে থাকা কালিন যখন ওই বাজে ছেলে গুলো আমার ওড়না নিয়ে টানাটানি করছিল। অসভ্যতামি করেছিল। তখন আমার জন্য আপনার চোখে রক্ষাকারি হিসেবে এক নতুন মানবকে দেখেছিলাম। যেমন আমাদের আপন কাছের কাওকে কিছু বললে তার হয়ে শত্রুদের সাথে মোকাবেলা করে তেমন। মাতাল ছেলেদের জন্য রাগ, ক্ষোব দেখেছিলাম আপনার চোখে। ব্রেকফাস্টের সময় আপনি মাঝ বয়সি সেই মহিলাকে নয়! আমার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে ছিলেন। আজকে যখন আমার চলে যাওয়ার খবর পেলেন। ছুটে আসলেন কিছু বলার জন্য। তখনি আপনার চোখ দেখে বুঝে গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে ভালোবাসেন। ভালোবাসি বলার জন্যই এসেছেন। ”

” বুঝেই যখন গিয়েছ। তাহলে তোমাকে আমায় ভালোবাসতেই হবে। ”

” থ্রেট করছেন? ভালো না বাসলে ফোর্স করবেন? ”

” না থ্রেট করছি। আর না ফোর্স করবো। তবে পাগলামি নিশ্চই করবো। ”

মাহিমের কথায় শব্দ করে হেসে উঠে ইভা।

” আমি আপনাকে চাইলেও ভালোবাসতে পারবো না মিস্টার মাহিম। আমরা কোনদিনি এক হতে পারবো না। ”

” কেন? কেন পারবো না? তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো? ”

” আমার জীবনে কখনো সত্যি কারের ভালোবাসা আসেনি। কোনো ছেলের সাথেও রিলেশন করিনি। ”

” তাহলে সমস্যা কি? আমি কি দেখতে খারাপ নাকি? নাকি আমার মধ্যে কোনো কিছুর কমতি আছে? নাকি ভাবছো আমি ঠিক ভাবে তোমার খেয়াল রাখতে পারবো না। আমাদের কিন্তু যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে। ”

ইভা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

” টাকাই কি জীবনের সব সুখ দিতে পারে? আমার বাবা টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে মেয়েকে সময় দিতে পারেনি। মাস শেষে হোস্টেলে মোটা অঙকের টাকা পাঠাতো। দিন শেষে না পেতাম বাবার ভালোবাসা। আর মাকে তো চোখের দেখাও দেখিনি। ”

ইভার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে। যেকোনো সময় নোনা জল গড়িয়ে পড়বে।

” তোমার মা কি মারা গিয়েছেন? ”

” হ্যাঁ। ছোট থাকতেই মা মারা গিয়েছেন। আমাকে দেখার জন্য সার্ভেন্ট রেখে দিয়ে ছিলেন বাবা। বড় হওয়ার পর হোস্টেলে থেকেই পড়াশুনা করেছি। ছুটি পেলেও বাড়িতে তেমন যাইনা। এভাবেই বিভিন্ন জায়গায় ঘোড়াঘুড়ি করি। ফ্রেন্সদের সাথে ওদের বাড়িতে যাই। ”

” আমি তোমাকে আমার সবটা দিয়ে আগলে রাখবো ইভা। কখনো কষ্ট পেতে দিবো না। আমি কেমন টাইপের ছেলে জানতে চাইলে আলভী, সাকিবদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারো। আমার হৃদয়ের রাণী করে রাখবো তোমায়। কথা দিলাম।”

” কারো কাছে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন নেই। এই কদিনেই আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কেমন। ”

” তাহলে আমাকে ফিরিয়ে দিও না লাল পরী। তোমার থেকে দূরে চলে আসবো। তোমাকে আর দেখতে পারবো না ভাবতেও আমার দম বন্ধ লাগে। ”

” আপনি বুঝতে পারছেননা মাহিম। আমার বাবা কখনো মানবে না। ”

” তোমার বাবাকে আমি মানাবো। কথা বলবো তার সাথে। তুমি আমাকে ভালোবাসো নাকি আগে সেটা বলো? ”

” ভালোবাসা কি মামা বাড়ি আবদার নাকি, যে চাইলেই পাওয়া যাবে? ”

” মামা বাড়ি আবদার নাকি জানিনা। তবে মাহিমের আবদার। যেটা তার লাল পরী পূরণ করবে। ”

মাহিমের কথায় ফিক করে হেসে ওঠে ইভা। একটু এগিয়ে লতার মতো চিকন, রোদে হালকা শুকিয়ে গিয়েছে কিছু একটা নিয়ে আসে। সেটা মাহিমের হাতে দিয়ে বলে, গোল করে আংটির মতো বানিয়ে ওর হাতের আঙুলে পড়িয়ে দিতে। মাহিম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ওর মনোভাব বুঝতে পেরে বাঁকা হেসে ইভা বলল,

” কি মিস্টার বুঝতে পারেননি? সাথে অবাকও হয়েছেন তাইতো? অবাক হওয়ার কিছু নেই। মিথ্যে বলবোনা। আপনাকে আমিও ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছি। হয়তো ভালোওবাসি। ”

” এত ঝঁটকা কেন দিচ্ছ? পড়ে সামলাতে পারবে তো? ”

” আপনার কথা ছাড়ুন। আমাকে হ্যান্ডেল করতে আপনার জীবন তেঁজ পাতা হয়ে যাবে। ”

” ও কামন লাল পরী। এইবার তো তুমি করে বলো। প্লিজ। আপনি ডাকটা তোমার মুখে মানায় না। ”

ইভা স্মিথ হেসে বলল,

” দাঁড়িয়েই থাকবে নাকি যেটা বললাম সেই কাজটা করবে? ”

সহসা জীভ কা”টল মাহিম। লতাটা দিয়ে প্যাঁচিয়ে গোল করে আংটির মতো করে বানিয়ে ইভার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ইভা লজ্জা মিশ্রীত হাসি দিয়ে বাম হাতটা এগিয়ে দেয়। উত্তেজনায় ইভার শরীর কাঁপছে। মাহিম বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা শক্ত করে মুঠে পুরে নেয়। ইভার দিকে একবার তাকিয়ে ওর হাতের অনামিকা আঙুলে লতা দিয়ে বানানো আংটিটা যত্ন করে পড়িয়ে দেয়। ইভার চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। ধরে রাখা হাতে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে দেয় মাহিম। ঈষৎ কেঁপে উঠে সে। হাত বাড়িয়ে অশ্রু কণা মুছে দেয় অতি যত্নে। অতি আবেগে ফুঁপিয়ে উঠে ইভা। দিক বেদিক ভুলে সহসা জড়িয়ে ধরে প্রথম ভালোবাসার বীজ বোনা মানুষটিকে। মাহিমও তৃপ্তিময় হেসে আলতো করে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। ঠিক তখনি হাত তালির আওয়াজ ভেসে আসে কানে। তড়িৎ বেগে দুজন ছিটকে যায় একে অপরের থেকে। তাকিয়ে দেখে মাহিম, ইভা ওদের দুজনেরি ফ্রেন্ডসরা সবাই এক সাথে। সোমা তো সেই খুশি। তার দুঃখি বন্ধুটার জীবনে কোনো সত্যি কারের ভালোবাসার মানুষ এসেছে। আলভী কাছে এসে বলল,

” কিরে শা”লা! তলে তলে টেম্পু চালাস। আর আমরা বললেই হরতাল। ”

মাহিম ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,

” তোরা সবাই এখানে কেন? ”

সাকিব খোঁচা দিয়ে বলে,

” জায়গাটাকি তোর একার, যে অন্য কেউ আসতে পারবেনা। তুই ধরা খেয়েগিয়েছিস মামা। খুব তো বলেছিলি মেয়ে মানুষে নাকি তোর এ্যালার্জি। এখন তবে এসব কি? পল্টি”বাজ কোথাকার। কত দিন ধরে চলছে এসব? হুমম। ”

মাহিম বিরক্ত হয়। বলে,

” তোর এই সব ল্যাইম মার্কা কথা অফ কর। কাকে কখন কিভাবে ভালো লাগবে সেটা কি আগে থেকে বুঝা যায় নাকি! ”

” আমাদের আর বোকা বানানোর চেষ্টা করিস না। আমরা যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। যাইহোক ভাবি কিন্তু মাশা আল্লাহ্। ”

ইভা লাজুক হাসে। আলভী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

” বলছিলাম কি আমার জন্যেও একটা খুঁজে দে দোস্ত। জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত সিঙ্গেল আছি। সমাজে মুখ দেখানো বড় কষ্ট দায়ক হয়ে উঠেছে। সারা জীবন কি আইবুড়ো হয়েই থেকে যাবো নাকি? আমার মতো নিশ্বপাপ ভোলা ভালা বাচ্চাকে রেখে একাই গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছিস। তোর মন এত পাষাণ কেন। ”

মিম হাসতে হাসতে বলল,

” কেন প্রিন্সিপাল স্যারের মেয়ে আছে না। সে নাকি তোর জন্য দিওয়ানা। তাকেই বিয়ে করে ফেল। ”

” হোপপ! টাকলা প্রিন্সিপাল রাজি হবেনা। যেদিন তার টাকলা ভরাট হয়ে যাবে সেদিন মেবি রাজি হবে। তার আগে নয়। আর তার মেয়েতো মাইরি পাত্তাই দেয়না। জীবন’টাই বেকার। ”

পাশ থেকে সাকিব বলে,

” বুঝলি আলভী। এমন মেয়ে খুঁজতে হবে যেন বাতাসে তাদের ওড়না উড়ে। আর সেই ওড়না আমাদের মুখের উপর এসে পরে। চোখ বুঝে সেটার সুভাস নিলে মনের ভেতর সামথিং সামথিং ফিল হবে। দেখিসনি পাগলু টু মুভিতে, কোয়েল মল্লিকের ওড়না উড়ে এসে কিভাবে দেবের মুখের উপর পড়েছিল। সেই থেকেই ব্যাটা ভোলা ভালা মেয়েটার পিছে পড়েছিল। অবশেষে সে সাকসেছ। আবার ঘাস কূটা, লতা পাতা যা পাবি তা দিয়ে আংটি বানিয়ে মেয়েদের প্রপোজ করলেই ক্যাঁল্লাফতে। ”

আলভী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

” ঠিক বলেছিস। মাহিমকে দেখ। সারা জীবন ক্রিকেট না খেলা মাম্মিকি ব্যাটা, এক বলেই ছক্কা! আমরা যে এত এত মেয়েদের পটানোর চেষ্টা করলাম। একটাও বিয়ে পর্যন্ত যেতে চায় না। সবাই টাইম পাস করতে চায়। লাস্ট যেটা ছিল সে তো আমাকে পার্কে ওয়েট করতে বলে, নিউ বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেই পার্কেই ফুসকা খাচ্ছিল। বেঁচে থেকে কি লাভ? ভাই জীবনে কি করলাম। কেউ করলা দে খাইয়া সুই*সা*ইড করি। ”

মাহিম দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” এত ড্রামা কিভাবে করিস ? এই জন্যেই কোনো মেয়ে তোদের পাত্তা দেয় না। এবার অন্তত ভালো হয়ে যা। ”

মাথার চুল গুলোকে হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে, বেশ ভাব নিয়ে আলভী বলল,

” মাঝে মাঝেই ভাবি যে ভালো হয়ে যাবো ।তারপরেই মনে হয় আমি খারাপ ছিলাম কবে? ”

চলবে,,,,