#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-১০
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
খোদেজা রান্নাঘরে বসে বটি দিয়ে তরকারি কুটছে। তার সামনেই জ্বলন্ত মাটির চুলা। সেখানে পাতিলে করে কাঁচা কলা সিদ্ধ হচ্ছে। তা দিয়েই আজকে দুপুরে খাবার জন্য ভর্তা করা হবে। ধারা আর শুদ্ধ’র আজকে দাওয়াত আছে, ধারার বাপের বাড়ি। ধারার ছোট চাচা বিয়েতে ছিলেন না। শুদ্ধকে দেখেননি। তিনি তার ভাতিজির জামাইকে দেখতে চান। সেই সুবাদেই আজ দাওয়াত দেওয়া হয়েছে তাদের। এই ফাঁকে পরিচয়ও হবে। এজন্যই আজ দুপুরে খাবারে ভারী আয়োজন রাখেননি খোদেজা। ছেলে, বৌ দুজনই চলে যাবেন। খাবে তো শুধু চুমকি আর সে। তাই ভাত, ভর্তা, বেগুন ভাজা আর একটু ডাল দিয়েই রান্নার পাটটা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলার নিয়ত তার। কিন্তু তা হবে বলে মনে হচ্ছে না। পাশের বাড়ির মকবুল আর তার বৌ এসেছে খোদেজার কাছে। আজ সকালেই ছোটভাই আবুলের সাথে তার লেগেছে তুমুল ঝগড়া। সেই ঝগড়ার পুরো বর্ণনা আর এর পেছনে মূল দায়ী যে আবুলই তাই সাজিয়ে গুছিয়ে তারা শুনিয়ে যাচ্ছে খোদেজাকে। খোদেজা মনোযোগ দিয়েই ওদের দুজনের কথা শুনছে আর কাজ করছে। ধারা গেছে গোসলে। তাই শুদ্ধও গোসলখানার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের দাওয়াতের জন্যই আজ সকাল সকাল গোসল করা ধারার। ধারা গোসলে ঢুকেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। শুদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠে বলল,
‘ধারা, আর কতক্ষণ? তাড়াতাড়ি করুন। আমাদের আপনাদের বাড়িতেও তো যেতে হবে।’
ভেতর থেকে ধারা চেঁচিয়ে বলল,
‘এই তো হয়ে গেছে। আর একটু….!’
কিছুক্ষণ পর ধারা ব্লাউজ পেটিকোটের উপর একটা হলুদ শাড়ি কোনরকমে পেঁচিয়ে বের হয়ে এলো। ভেজা জামা কাপড়ের বালতি হাতে নিয়েই বললো, ‘হয়ে গেছে, চলুন।’
যাবার জন্য এক পা বাড়িয়েও দিল ধারা। কিছুক্ষণ ধারার দিকে তাকিয়ে থেকে শুদ্ধ দ্রুত বলে উঠলো, ‘এক মিনিট! দাঁড়ান।’
ধারা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কি হলো?’
‘আপনার এই অবস্থা কেন? শাড়ি শুধু পেঁচিয়েই রেখেছেন, পড়েননি কেন? আপনি শাড়ি পরতে পারেন না?’
‘পারি তো। কিন্তু শাড়িটা দেখছেন না! একদম নতুন শাড়ি, এখনও ভাঁজও ভাঙা হয়নি। পরতে গেলে ফুলে থাকবে। কল পাড় একদম ভিজে আছে। এখানে কিভাবে পরবো? তাই এখন কোনমতে প্যাচ দিয়ে রেখেছি। রুমের ভেতর গিয়ে পরবো। চলুন।’
আবারও ধারাকে থামিয়ে শুদ্ধ বলল,
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। যাবেন না। রান্নাঘরের সামনে মকবুল ভাই আর তার বৌ দাঁড়িয়ে আছে।’
ধারা থেমে গিয়ে কিছুটা ভেবে বলল,
‘ও! কিন্তু এখন আর কি করবো? কলপাড়ও তো একদম ভেজা। কুচি ঠিক করে পরতে গেলেই শাড়ি পুরো ভিজে যাবে।’
‘আপনি এখানেই শাড়ি নিয়ে এসেছেন কেন? এখন গোসল করে একটা থ্রি পিছ পরতেন তারপর না হয় ভেতরে গিয়ে শাড়ি পরতেন।’
‘ঠিকই। কিন্তু তখন তো আর এতকিছু ভাবিনি। আর আমি কি জানতাম এখানে কোন লোক এসে পরবে। এখন কি করবো? আচ্ছা দাঁড়ান।’
এই বলে ধারা ভেতরে গিয়ে মাথা টাথা ঢেকে আরো ভালো মতো শাড়ি পেঁচিয়ে বের হয়ে বলল,
‘এইবার হয়েছে? এখন চলুন।’
‘কোথায় হয়েছে? আপনার সাইডে কোমড় বের হয়ে আছে?’
ধারা লজ্জা পেয়ে চমকে উঠে তাড়াতাড়ি সেখানে তাকিয়ে শাড়ি টেনে ঢেকে নিল। শুদ্ধ বলল,
‘আপনি একটা কাজ করুন। গোসলখানার ভেতরে যান। শাড়ি পরে তারপর বাইরে আসুন। দেরি হলে হোক।’
‘আপনাকে তো বললামই, কলপাড় পুরো ভেজা। আমি একা একা এখানে কিভাবে শাড়ি পরবো? এভাবেই চলুন। এখন তো ভালোমতো ঠিক করেছিই। তারা তো রান্নাঘরে দাঁড়ানো। আমি তাড়াতাড়ি ওটার সামনে দিয়ে চলে যাবো। সমস্যা নেই।’
শুদ্ধ বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বলল,
‘আপনার সমস্যা না থাকলেও আমার সমস্যা আছে। আমি কাউকে এভাবে আমার বৌকে দেখতে দেবো না।’
এই বলে শুদ্ধ ধারার হাত টেনে গোসলখানার ভেতরে নিয়ে এলো। ধারা হতবাক। এতক্ষণ ভেবেছিল শুদ্ধ হয়তো ধারা অন্যদের সামনে লজ্জা পাবে ভেবে বলছে। আর এখন এটা কি শুনলো! আর কিভাবেই না দ্বিধাহীন লোকটা লজ্জাশুন্য কণ্ঠে কতই না অনায়াসে আমার বৌ বলে দিলো। মুহুর্ত গড়াতেই একদম লজ্জাবতী গাছটির ন্যায়ই গুটিয়ে গেলো ধারা। বুকের মধ্যকার অপ্রতিরোধ্য ধুকপুক ধ্বনি বৃদ্ধি পেলো কয়েকগুণ। শুদ্ধ বলল,
‘দেখুন, হিরোদের মতো আমি শাড়ি পরাতে পারি না। কোনদিন দেখিওনি কিভাবে পরে। আমি শাড়িটা ধরে রাখছি। আপনি আপনার মতো পরুন। কোন হেল্প লাগলে আমি চেষ্টা করবো।’
ধারা ধীরে ধীরে শাড়ি পরতে লাগলো। শুদ্ধ শাড়ি পানি থেকে ভেজানো থেকে বাঁচিয়ে রেখে যতটুকু সম্ভব ধরে রাখলো। বিপত্তিটা বাঁধলো কুচি ঠিক করতে গিয়ে। কুচি ঠিক করতে গিয়ে শুদ্ধ ঠিক করার থেকে বেশি আরো গুলিয়ে ফেললো। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অতিষ্ট হয়ে উঠলো ধারা। শুদ্ধকে যতোই বলল ‘আপনি ছেড়ে দিন, হবে না। আমিই দেখছি।’ শুদ্ধ ততই নাছোড়বান্দা। এর শেষ সে দেখেই ছাড়বে। এতো এতো কঠিন কাজ সে করেছে। শাড়ি পরানো এমন কি জিনিস যে সে পারবে না! আজকে শাড়ি পরানো সে শিখেই ছাড়বে। ধারার মনে হলো, আজকে বোধহয় ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পরবে। শুদ্ধ তখন একদম সিরিয়াস মুডে। তার সমস্ত ধ্যান শাড়ির কুচির দিকে। মনে হচ্ছে কোন জটিল যুদ্ধ পরিচালনার কাজে আছে সে। শাড়ির একপ্রান্ত শুদ্ধ’র হাত ফসকে ভেজা জায়গায় পরতে নিলে ধারা অনুযোগের স্বরে বলে উঠলো,
‘কি করছেন কি? এভাবে কেউ শাড়ি ধরে! এজন্যই বলছিলাম, আগে ভেতরে গিয়ে নেই।’
তখন বাইরে দিয়ে পাশের বাড়ির নাজমা কলপাড়ে আসছিল। ভেতর থেকে হঠাৎ এই কথাটা তার কানে আসলো। এই কথার মানে নাজমা কি বুঝলো কে জানে! মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হঠাৎ জোরে জোরে হেসে উঠলো সে। শুদ্ধ ধারা দুজনেই চমকে উঠলো। নাজমা বলতে লাগলো, ‘এইবার বুঝলাম মাহতাব ভাই। ভেতরে ভেতরে তাইলে এই চলে! এই কারণেই আমাদের কাউরে ভেতরে ঢুকতে দেন না।’
ধারার গাল লজ্জায় লালবর্ণ ধারণ করলো। শুদ্ধ কি করবে না করবে বুঝতে না পেরে মাথা চুলকে একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বলল, ‘ভাবী, আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন কিছু না।’
নাজমা দুষ্টমির ন্যায় বলে উঠলো, ‘আমি আবার কখন বললাম আমি কিছু ভাবতাছি? চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।’
নাজমা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। শুদ্ধ ধারা বিব্রত হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। নাজমা বলল,
‘চালায় যান দেবরজি, চালায় যান। আমরা ভাবী মানুষ কি আর দেবরের সোহাগের সময় বাধা হইতে পারি! আমি চললুম।’
নাজমা চলে গেলে শুদ্ধ, ধারা দুইজনই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বাকিটুকু ঝটপট করে ফেলে অবশেষে শাড়ি পরা সম্পন্ন হলো ধারার। সব শেষ হতেই ধারা বলল,
‘এইবার হয়েছে? এখন যাবো?’
শুদ্ধ হুম বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে বলল, ‘এক সেকেন্ড!’ তারপর ধারার আঁচলটা টেনে দু হাত দিয়ে মাথায় একটা ঘোমটা পরিয়ে হেসে বলল, ‘এইবার একদম পার্ফেক্ট!’
শুদ্ধ মুখের হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ধারার দিকে। ধারা তখন একটা হলুদ পরী। কাঁচা হলুদ আবরণে মুড়িয়ে থেকে, প্রভাত স্নানের স্নিগ্ধ সুভাস মুখরিত মুখমন্ডলে সকালের সোনালী রোদের লুটোপুটি খেলা তার ফর্সা মসৃণ ত্বকটিকে হলুদাভ করে তুলেছে। এই অনিন্দ্য হলুদ সুন্দরীটি তখন নিজ জ্ঞাত শুন্য। সামনের পুরুষটির গালের টোল পরা হাসিই যে তার ধ্যান কেড়ে রেখেছে।
__________________________________________
শুদ্ধ ধারার মধুপুর গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর বারোটা বেজে গেলো। জামাই মেয়েকে একসাথে দেখে প্রসন্ন মুখে এগিয়ে গেলো আসমা। একে একে সবাইকে ডেকে নিয়ে আসলো সেখানে। শুদ্ধ শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে সালাম করার পর পরিচিত হলো শাহেদের সাথে। আসমা ওদের দুজনকে ভেতরে বসিয়ে চলে গেলেন খাবারের আয়োজনে। শাহেদ গভীর মনোযোগের সাথে তার সামনে বসা ছাব্বিশ কি সাতাশ বছরের যুবকটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। না! জামাই হিসেবে দেখতে শুনতে খারাপ না। এখন মেয়ে যেহেতু দিয়েই ফেলেছে তাই আর কি করার! ধারা বলল,
‘ছোট চাচা, কাকী আর তামিম ভালো আছে? তাদেরকেও নিয়ে আসলেন না কেন?’
‘আরে ধারা, আমি কি আর বেশি দিনের ছুটি এনেছি। তামিম কত ছোট না! আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে কি আর এতো জার্নি করা যায়! আবার যখন বেশি দিনের ছুটিতে আসবো তখন নিয়ে আসবো। একসময় যাস আমাদের ওখানে বেড়াতে। তুই আর শু…শু কি যেন নাম!’
শুদ্ধ স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘শুদ্ধ।’
‘কি?’
শুদ্ধ আবারও বলল, ‘শুদ্ধ।’
‘ঐ…যাস শুদ্ধকে নিয়ে বেড়াতে চট্টগ্রামে।’
ধারা মাথা দুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা।’
শাহেদ বলল, ‘আমি শুদ্ধকে নিয়ে একটু হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। তুই থাক এখানে। আর শোন, ফ্যান বন্ধ করে দে। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। তোরও ঠান্ডা লাগবে।’
শাহেদের কথা অনুযায়ী ধারা উঠে ফ্যান বন্ধ করে দিলো। অথচ ধারার নাক মুখে ঘাম জমে আছে। তারা এই মাত্রই বাইরে থেকে এসেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার গরম লাগছে। তবুও ধারা কিছু বলল না। শুদ্ধ খানিক অবাক হলো।
শাহেদ শুদ্ধকে নিয়ে বসার ঘরে সোফায় গিয়ে বসল। এবার শুদ্ধকে সরাসরি বলল, ‘আচ্ছা শুদ্ধ, তুমি কি কাজ করো? বাড়ির কেউ তো দেখলাম তোমার কাজের ব্যাপারে ঠিকমতো গুছিয়ে বলতেই পারছে না।’
শুদ্ধ ও’র সমস্ত কাজের ধরণটা, কি করতে চায় সবটা শাহেদকে বুঝিয়ে বলতে লাগলো। কিন্তু সবটা একদম মাথার উপর দিয়ে গেলো শাহেদের। এতে করে লাভটা কি সে বুঝতে পারলো না। শুদ্ধ তবুও ধৈর্য্যের সাথে শাহেদকে বোঝাতে লাগলো। শাহেদ বারবারই বারবারই শুদ্ধকে কথার মাঝে থামিয়ে বলতে লাগলো, ‘এসব বাদ দাও। তুমি নাকি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলে! রেজাল্ট অনেক ভালো! একটা কাজ করো বিসিএসে ট্রাই করো। একটা ভালো সরকারি চাকরি একবার পেয়ে গেলে তোমার আর ধারার দুজনেরই লাইফ সেট হয়ে যাবে। বিসিএসের জন্যই প্রিপারেশন নাও।’
শাহেদের সাথে শুদ্ধ একমত হলো না। সুস্পষ্ট এবং তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সাথে সে নিজের অভিমতটাই প্রকাশ করতে লাগলো। প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করলো শাহেদ। শুদ্ধ’র কোন কথাই না বুঝে শেষমেশ একটা কথাই তার বোধগম্য হলো, ছেলে তো দেখি বেয়াদব! বড়দের পরামর্শ শোনে না।
শাহেদ আর শুদ্ধ’র কথার আসর ভাঙলো আসমার ডাকে। টেবিলে খাবার সাজানো হয়েছে। ছেলেদের আগে খেতে দেওয়া হয়েছে। রাতুল গিয়ে বসলো ঠিক শুদ্ধ’র পাশে। এই অল্পদিনের আলাপেই দুলাভাইকে ভারী পছন্দ হয়েছে তার। প্রথম দিনেই তো কি সুন্দর রাতুল আর তার এক ক্লাসমেটের নিত্যদিনের ঝগড়ার কি সুন্দর সমাধান বলে দিয়েছেন তার দুলাভাই। সমাধানটা খুব সুন্দর কাজেও লেগেছে। সেদিন থেকেই শুদ্ধ তার পছন্দের। শুদ্ধ’র বলা সব কথাই রাতুলের কাছে কোন বিজ্ঞানীর থেকে কম লাগে না। আসমা ধারাকেও বলল তাদের সাথেই খেতে বসে যেতে। ধারা গড়িমসি করছিল। বলল পরেই খাবে। আজিজ সাহেব এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। আস্তে করে তিনি পাশ থেকে বললেন,
‘বসতে বলছে যখন বসো।’
ধারা ঝট করে বাবার দিকে তাকালো। তার বাবা আজ কতদিন পর তার সাথে কথা বলল। মনটাই ভালো হয়ে গেলো ধারার। সে তাড়াতাড়ি শুদ্ধ’র পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। খাবার দাবারের একটা হুলস্থূল কান্ড ঘটিয়ে রেখেছে আসমা। কি নেই টেবিলে! বেগুন ভাজা থেকে শুরু করে চিংরি মাছ ভুনা, ইলিশ মাছ ভাজা, রুই মাছের কালিয়া, মুরগির রোস্ট, গরুর ঝাল মাংস, পায়েস, পোলাও আরো কত কি! আসমা ব্যস্ত হয়ে পড়ল শুদ্ধকে আপ্যায়নে। শ্বাশুড়ির মন রক্ষার্থে শুদ্ধও খুব বেশি আপত্তি করলো না। ধারার চিংড়ি মাছ পছন্দ। প্রথমেই সে হাত বাড়ালো চিংড়ির বাটির দিকে। ধারার বাবা বলল, ‘এটা ঝাল বেশি হয়েছে। খেয়ো না। ইলিশ মাছ নাও।’
ধারা আর নিলো না। ইলিশ মাছ ভাজাই নিলো। শুদ্ধ খেয়াল করলো ঝাল অতো বেশিও না যে খাওয়া যায় না। আর তাছাড়া সবাই তো খাচ্ছে। আরো কয়েকবার ধারার কিছু বিষয় শুদ্ধকে অবাক করলো। দেখতে দেখতে একে একে সবার খাওয়াই শেষ হয়ে এলো। এখন শুধু টেবিলে আছে ধারা, শুদ্ধ আর শাহেদ। শুদ্ধ’র প্লেটে আসমা খাবারের পাহাড় বানিয়ে তুলেছিল বলেই শুদ্ধ পিছিয়ে গেছে। শাহেদ পায়েস খাচ্ছে। ধারার খাওয়াও মোটামুটি শেষ। খাওয়া শেষে ধারা যখন পায়েস নেওয়ার জন্য চামচ দিয়ে নিজের প্লেটের দিকে অগ্রসর হলো তখনই শাহেদ বলল, ‘ধারা, নিস না পায়েস। মিষ্টি বেশি হয়ে গেছে। তোর টেস্ট নষ্ট হয়ে যেতে পারে। একটা কাজ কর হাত ধুয়ে আয়। তারপর দই খা।’
শুদ্ধ একবার ধারাকে কথায় কথায় বলতে শুনেছিল মিষ্টি জাতীয় খাবার তার বেশি পছন্দ। শাহেদ বলায় নিজের প্লেটের দিকে বাড়িয়ে নেয়া পায়েসের চামচও ধারা রেখে দিল। সে একবার নিজের থেকে টেস্ট করেও তো দেখতে পারতো এতটুকু মিষ্টি সে খেতে পারে কিনা! শুদ্ধ হতবাক হয়ে রইলো। শাহেদ চলে যাওয়ার পরই শুদ্ধ ডাকলো, ‘ধারা!’
ধারা পাশ ফিরে বলল, ‘হুম?’
‘আপনি কোথায়?’
শুদ্ধ’র হঠাৎ এমন প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে ধারা বিভ্রান্ত স্বরে বলল, ‘এই যে।’
শুদ্ধ আফসোসের সহিত বলল, ‘আপনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না।’
চলবে,
#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-১১
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
রাত গভীর। আশেপাশে সবকয়টা বাড়ির বাতি নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। বাইরের ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ধারার ভীষণ অস্থির বোধ হচ্ছে। বিকেলে সেই যে শুদ্ধ ধারাকে এই বাড়িতে ফিরিয়ে এনে রেখে গেছে আর তার কোন পাত্তা নেই। এমনকি ফেরার সময় পুরো রাস্তায় ধারার সাথে কোন ধরণের কোন কথাও বলেনি সে। সারাটা পথ গম্ভীর হয়েই থেকেছে। এত রাত হয়ে গেল, মানুষটা এখনো বাড়ি ফিরে এলো না যে! খোদেজা আর চুমকিও রুমের বাতি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। ধারা একবার ভাবলো শ্বাশুড়িকে ডেকে তুলেই না হয় বলা যাক কথাটা। ভাবা মতো কাজ করবার জন্য অগ্রসর হতেই ধারা কাঠের সিঁড়িতে ঠকঠক পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। দ্রুত গতিতে রুমে প্রবেশ করেই শুদ্ধ ধারার কাছে এসে কোন ভালো মন্দ না বলেই সরাসরি বলে উঠলো, ‘ধারা, আপনি কোথায় ভর্তি হবেন না হবেন কিছু ঠিক করেছেন?’
ধারা সংকুচিত হয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘বাবা তো কিছু বলেনি আমি আর পড়বো কিনা?’
‘এখানে আপনার বাবার বলার কি আছে? আপনি পড়তে চান কি চান না সেটা বলুন।’
ধারা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। শুদ্ধ আশাহত হয়ে বিরক্তি মাখা গলায় বলল,
‘ধারা, এইসব কি আমাকে একটু বোঝাতে পারেন। আপনার কোন ধারণা আছে আপনি নিজের সাথে কি করছেন! আপনার কান্ডকারখানা দেখে আমি জাস্ট শকড হয়ে থাকি। আপনাকে যে যা বলে আপনি তাই করেন। আপনার নিজের কোন আলাদা চিন্তা ভাবনা নেই, নিজের কোন ইচ্ছা নেই, নিজের কোন সিদ্ধান্তও নেই। সামনের জন উঠতে বললে উঠেন আর বসতে বললে বসেন। আপনি একটা পসেসড বডির মতো হয়ে আছেন। শরীরটা তো আপনারই। কিন্তু এর ভেতরকার ইচ্ছা, ভাবনা, চালনাশক্তি সব অন্যদের হাতে। আপনি সবাইকে এতো কেন ভয় পান ধারা? তারা তো আপনার আপনজনই। কোন ভুল হলে হয়তো আপনার উপর রাগ করবে, বকা দিবে। মেরে তো আর ফেলবে না! আপনি কেন এতো আতংকিত হয়ে নিজের সবকিছু অন্যদের উপর ছেড়ে দেন!’
ধারা একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে শুদ্ধ’র এই প্রশ্নবিদ্ধ নজর থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে। যেই প্রশ্নের আদৌও কোন সুস্পষ্ট উত্তর ধারার কাছে নেই। নিজের নজরকে লুকাতেই আশেপাশে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ধারা বারবার ডান হাত দিয়ে কপালের কার্ণিশটা ঘষতে লাগলো। শুদ্ধ এই ব্যাপারটা আগেও অনেকবার লক্ষ করেছে। ধারা যখনই অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে যায় সে তার হাত দিয়ে কপালের কার্ণিশ ঘষতে থাকে। শুদ্ধ সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম স্বরে বলল,
‘ধারা, এভাবে নিচে তাকিয়ে থাকবেন না। তাকান আমার দিকে। তাকান বলছি!’
ধারা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে তাকালো শুদ্ধ’র দিকে। শুদ্ধ দু হাত দিয়ে ধারার বাহু ধরে বলতে লাগলো, ‘আপনার কোন ধারণাও নেই ধারা, আপনি নিজেই নিজের সাথে কত বড় অন্যায় করছেন! এভাবে শুধু সবার কথা মেনে চললে আপনার নিজের বলে কোন ব্যক্তিত্ব থাকবে না। আপনি জানেন, আপনার যে নিজের বলে কোন সত্তা নেই! কোন অস্তিত্ব নেই! আপনার দিকে তাকালে শুধু অনেকগুলো মানুষের ছায়া দেখতে পাই। পাই না শুধু একটা ‘আমি’কে দেখতে, একটা ধারাকে দেখতে। আপনি কোথায় ধারা? কোথায় আপনি? আমি আপনাকে দেখতে চাই। একটা ধারাকে দেখতে চাই।’
ধারার চোখ থেকে টপ করে একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো। শুদ্ধ সেই জল হাত দিয়ে মুছে দিয়ে বলল, ‘কাঁদবেন না ধারা। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি পাশ করুন বা ফেল করুন, ভালো করুন, খারাপ করুন আমি সবসময় আপনার সাথে আছি। সবসময়!’
ধারা কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন ভাবে কখনো তো কেউ বলেনি তাকে! সবাই শুধু তার থেকে তার সেরাটাই চেয়েছে। এর থেকে কম সব অগ্রহণযোগ্য।
কিছুক্ষণ পর ধারা একটু স্বাভাবিক হলে শুদ্ধ বলল,
‘আচ্ছা ধারা, আপনার রেজাল্ট তো মোটামুটি ভালোই ছিল। একটুর জন্যই এ প্লাস মিস হয়েছে। সাইন্সের সাবজেক্টগুলোতেই কম মার্ক পেয়েছেন আপনি। আপনি বেশি ভালো পারেন কোন সাবজেক্টগুলো?’
‘আমি বেশি ভালো পারি বাংলা। বাংলার গল্প, কবিতাগুলো আমার খুব ভালো লাগে। ইংরেজিও ভালো পারি। সাইন্সের সাবজেক্টগুলোও মোটামুটি পারি কিন্তু ওগুলো আমার পড়তে ভালো লাগে না।’
‘হুম বুঝেছি। ধারা, আমার কথাটা এবার মনোযোগ দিয়ে শুনুন, আমি এতক্ষণ আপনাকে নিয়েই ভেবেছি। সব খোঁজ খবর নিয়েছি। আপনি একটা কাজ কেন করেন না! আপনি এডমিশন টেস্ট দিন।’
ধারা ঝট করে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এডমিশন টেস্ট মানে? ইউনিভার্সিটিতে?’
‘হুম।’
ধারার কথাটা হজম হলো না। ধারা গ্রামের মেয়ে। ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞানও নেই তার। শুধু জানে এটা খুব একটা বড় কিছু। অনেক যোগ্যতার প্রয়োজন সেখানে পড়তে হলে। দেশের সেরাদের সাথে লড়াই করতে হয়। ধারা সাধারণ মেয়ে হয়ে এতো কিভাবে পারবে? সম্ভবই না!
ধারা ভড়কে যাওয়া গলায় বলল,
‘কি বলেন! আমি কি পারবো নাকি!’
‘অসম্ভবের মতো তো কিছু বলিনি। আর আমি তো বলছি না আপনি দিলেই পারবেন। কিন্তু একটা চেষ্টা তো করা যেতে পারে। আমি এ নিয়ে অনেক খোঁজ খবর নিয়েছি। এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্কুলার বের হয়ে ফরম ফিল আপও হয়ে গেছে। শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এটারও এতো দিনে হয়ে যাবার কথাই ছিল কিন্তু এই বছর এমন রাজনৈতিক গোলযোগের জন্য ঢাকায় ঝামেলা হওয়ায় এটার ফরম ফিল আপ স্থগিত করে রাখা হয়েছিল। আর মাত্র কয়দিনই এখন বাকি আছে এটার লাস্ট ডেটের। আপনি এখানেই দিবেন। এখানে অনেকগুলো ইউনিট। পরবর্তীতে যেন বাংলা সাবজেক্টটা পাওয়া যায় এরকম একটা ইউনিটে দিবেন।’
‘বাংলা সাবজেক্ট! সাইন্সের কোন সাবজেক্ট নেই?’
‘আছে। কিন্তু আপনিই তো বললেন আপনার সাইন্সের সাবজেক্ট ভালো লাগে না। আর যেটা ভালো লাগে না সেটা পড়ে কখনোই ভালো কিছু করতে পারবেন না। বাংলা আপনার ভালো লাগে যেহেতু বাংলা নিয়ে পড়বেন, ভালো রেজাল্টও করতে পারবেন।’
‘বাবা আর কাকা কখনোই রাজী হবে না। তারা তো সাইন্স ছাড়া অন্য কিছু শুনতেই পারে না। আর্টসের কিছু শুনলেই নাক সিটকায়।’
‘ধারা, সাইন্স, কমার্স, আর্টস কোনটাই কোন থেকে ফেলনা কিছু না। কিছু মানুষ জাস্ট এগুলোর মধ্যে একটা সস্তা, দামীর মাত্রা টেনে রেখেছে। পৃথিবীর সবাইকেই তো আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না। সবকিছুরই প্রয়োজন সমাজের আছে। পৃথিবীর অন্য দেশ গুলোতে গিয়ে দেখুন সাবজেক্ট নিয়ে ওখানে এমন বদ্ধ ধারণা নেই। বাড়াবাড়িও নেই। যার যেটায় ইন্টারেস্ট, পছন্দ, সে সেটা নিচ্ছে। আমাদের দেশেই শুধু কিছু মূর্খ জাতির দল এইভাবে কমার্স, আর্টসকে তাদের চিন্তা দিয়ে নগন্য বানিয়ে রেখেছে। আপনি বাংলা অথবা যদি মানবিক বিভাগের অন্য কোন সাবজেক্ট পান সেটা পড়েও ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারবেন। শুধু সেটাই করুন যেটা আপনার ভালো লাগে।’
ধারা কিছুই বললো না। বিভ্রান্ত বোধ করতে লাগলো। ধারাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুদ্ধ ধারার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘ধারা, এতো ভয় পাবেন না। আপনার বাবা আর কাকা নাকি আপনার এ প্লাসই নিশ্চিত করবার জন্য এক বছর গ্যাপ দিয়ে আপনাকে ফার্সট ইয়ারেরই দুই বছর রেখেছিল? একটা স্টুডেন্ট হিসেবেও কি আপনি বুঝেননি এক একটা বছরের কতটা গুরুত্ব! তখনও কি আপনার কিছু বেঠিক মনে হয়নি ধারা।
একবার তো একটু নিজের মনের মতো করে দেখুন, সব ভালোই হবে। নিজেকে এতো ছোট মনে করবেন না ধারা। চেষ্টা করতে তো কোন অসুবিধা নেই। হয়তো আপনিও পারবেন। এতো বড় ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারবেন। তখন দেখবেন আপনার বাবাও আপনার উপর প্রাউড ফিল করবে। আমার একটা বন্ধু আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইউনিভার্সিটিতে থার্ড, ফোর্থ ইয়ারে থাকাকালীন ও এডমিশন কোচিংয়ের কিছু ক্লাস করাতো। এখন অবশ্য একটা অনলাইন বিজনেসের পাশাপাশি একটা জবের প্রিপারেশন নিচ্ছে। এখন আমাদের শহরেরই আছে। ওকে আমি বলবো আপনাকে পড়াতে। আর তাছাড়া আমি তো আছিই। আপনার যা সাহায্য লাগে আমি করবো। আমি পাশে আছি। শুধু নিজের উপর আপনি একটু বিশ্বাস রাখুন ধারা।’
ধারার কাঁধে হাত রেখে শুদ্ধ পরম ভরসা মাখা গলায় বলল, ‘আমরা একটা চেষ্টা করি ধারা? বলুন ধারা, করবেন তো!’
ধারা দ্বিধান্বিত চোখে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো।
__________________________________________
ভোর হতে না হতেই শুদ্ধ ধারাকে ডেকে তুললো। বাইরে তখনও অন্ধকার। ভোরের আলোও ঠিকমতো ফুটেনি। ধারাকে বেশ কয়েকবার ডাকতে হলো শুদ্ধকে। পিটপিট করে হালকা চোখের পাপড়ি খুলতেই ধারা দেখলো শুদ্ধ তাকে ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। ধারাকে চোখ মেলতে দেখেই শুদ্ধ প্রসন্ন মুখে বলে উঠলো,
‘ধারা উঠুন, পড়তে বসবেন না?’
ধারা চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে বলল,
‘এতো সকালে! এখনও তো দেখি সকালও হয়নি ঠিক মতো।’
‘আমাদের হাতে তো খুব বেশি সময় নেই। মাত্র দুই মাসের মতন আছে। আমরা এমনিতেও পিছিয়ে আছি।’
শুদ্ধ এমন ভাবে ‘আমরা’ ‘আমরা’ বলতে লাগলো যেন শুধু ধারা না ধারার সাথে সেও পরীক্ষা দেবে। তারই প্রস্তুতি শুরু করবে এখন দুজন। ধারা নিচে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসলো। তার ঘুম এখনও কাটেনি। বারবার হাই তুলে তারই জানান দিচ্ছে সে। ধারা ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলল,
‘আজকে না হয় থাক! গতকালই তো মাত্র ঠিক করলাম এডমিশন দেবো। কালকে থেকে একদম ধুমছে পড়বো। আজকে এখন একটু ঘুমিয়ে থাকি।’
‘জ্বি না। আজকে থেকেই আমরা পড়া শুরু করবো। এখন থেকেই করবো। এভাবে কালকে কালকে করতে থাকলে সেই ‘কাল’ আর কোনদিনও আসবে না।’
‘আমি পড়বো যে, কি দেখে পড়বো? বই কি এখনও কেনা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ হয়েছে।’
‘আপনি বই কিনলেন কখন? এতো সকালেই দোকান খুলে ফেলেছিল?’
‘আমি কালকে রাতেই বই কিনে এনেছিলাম। তারপরই আপনার সাথে কথা বলেছি।’
‘তার মানে আপনি আগে থেকেই বুঝেছিলেন আমি রাজী হয়ে যাবো।’
ঠোঁট চেঁপে হেসে শুদ্ধ ধারার গাল টেনে বলল,
‘হ্যাঁ, বুঝেছিলাম। কারণ আপনি যে আমার লক্ষ্মী বউ।’
এভাবে বাচ্চাদের মতো গাল টেনে দেওয়ায় ধারা হতবাক হয়ে গেলো। শুদ্ধ তাড়া দিয়ে বলল,
‘নিন, পড়া শুরু করুন। আমি আমার বন্ধুর থেকে কিছু ইম্পর্টেন্ট টপিক দাগিয়ে এনেছি। সেখান থেকেই শুরু করুন।’
ধারা সাধারণ জ্ঞানের একটা বই নিয়ে পড়া শুরু করলো। আর শুদ্ধ আরেকটা বই নিয়ে পড়া কম করার জন্য শুধু ইম্পর্টেন্টগুলো দাগিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর কিছু একটা ধারাকে বোঝানোর জন্য সামনে তাকাতেই দেখে ধারা বালিশের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমে বেহুঁশ। আবারও তাকে ডেকে তুলে পড়তে বসালো শুদ্ধ। কিছুক্ষণ পড়ার পর আবারও একটু পরপরই ঘুমে ঝিমাতে লাগলো ধারা। আর তাকে ডেকে তুলতে তুলতে ক্লান্ত হলো শুদ্ধ। তবুও সেই একই অবস্থা। পরীক্ষার পর রেজাল্ট অব্দি দীর্ঘসময় আর কিছু পড়া হয়নি বলে সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস এমনিতেই পেয়ে বসেছে ধারাকে। তার উপর তার যেই গাঢ় ঘুম! রাতে একবার ঘুমালে কোলে করে তুলে নিয়ে গেলেও বোধহয় টের পাবে না। এই মেয়েকে কিভাবে শুদ্ধ সকালে উঠিয়ে পড়াবে তা ভেবেই মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো শুদ্ধ। ধারা তখন আবারও মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। কিছুসময় এভাবেই পার হবার পর হঠাৎ শুদ্ধ চেঁচিয়ে উঠলো,
‘ধারা, আপনার বাবা এসেছে।’
ধড়ফড় করে উঠে বসে পড়লো ধারা। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে যখন বুঝলো এটা শুদ্ধ’র মজা ছাড়া আর কিছু না তখন সরু চোখে তাকালো শুদ্ধ’র দিকে। শুদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আমার শ্বশুর মশাইটাকে আমি এই মুহুর্তে অনেক মিস করছি। এই মুহুর্তে একমাত্র তিনি থাকলেই হয়তো আপনার ঘুম তাড়াতে পারতো।’
ধারা সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে হাই তুলতে লাগলো। শুদ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর সদ্য কল থেকে আনা এক জগ ঠান্ডা পানি নিয়ে ফিরে এলো সে। বিছানার পাশে টেবিলে রেখে আবারও ধারার একটা বই নিয়ে বসলো। জগের দিকে তাকিয়ে ধারা বলল,
‘শুধু শুধু এক জগ পানি আনতে গেলেন কেন? এতো সকাল সকাল কি আর এতো পানির পিপাসা পাবে!’
শুদ্ধ বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘পানি খাবার জন্য আনিনি?’
‘তাহলে?’
‘এরপর থেকে আপনি যতবার ঝিমাবেন ততবার আপনার মাথায় পানি ঢালা হবে, সেই জন্য এনেছি।’
শুদ্ধ’র কথা শুনে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো ধারার। কি বলে লোকটা!
চলবে,