হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-১৮+১৯

0
444

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-১৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

সেদিনের মতো আজ ভরা পূর্ণিমা না হলেও আকাশে মেঘের লুকোচুরির আড়ালে থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে অর্ধচন্দ্রটি। পুকুরের ওপাশে একরাশ অন্ধকার। ঝোপের মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে একঝাঁক জোনাকির দল। তাদের মৃদুমন্দ আলোতে সৃষ্টি করেছে নজরকাড়া পরিবেশ। শুদ্ধ বসে আছে পুকুরপাড়ে বানানো বাঁশের মাচায়। পাশে ধারাও। ঘরের মধ্যে বিদ্যুৎ আছে। তবুও ইচ্ছে করেই ধারাকে নিয়ে বাইরে এসেছে শুদ্ধ। ধারা আজ দুপুরে খাবার পর থেকে একটানা পড়েছে। পরীক্ষা নিকটে। বলাবাহুল্য পড়ার চাপ একটু বেশিই। তাই পড়তে পড়তে ধারার একঘেয়েমি দূর করতেই তাকে নিয়ে বাইরে আসা। অল্প সময়ের হাওয়া বদল মনের ক্লান্তি দূর করতে পারে। বসে থাকতে থাকতে শুদ্ধ ধারাকে বলল,
‘ধারা, আমি এখন ফোন দেখে দেখে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো। এগুলো পূর্ব বছরের প্রশ্নব্যাংক। দেখি আপনি কতগুলো পারেন। এটাই প্রমাণ করবে আপনার প্রিপারেশন কেমন?’

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলো ধারা। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ফোন ঘেঁটে সাধারণ জ্ঞানের অংশ থেকে প্রথম প্রশ্নটি করলো। ধারা সঠিক উত্তরটাই দিলো। এরপর আরো কিছু প্রশ্ন করলেও ধারা বলতে পারলো। মাঝের একটা আইকিউ থেকে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। আরেকটা ভুল বলল। এরপর আরেকটা প্রশ্ন করলে ধারা কিছু বলছে না দেখে শুদ্ধ অপশন চারটি বলল। ধারা একটা উত্তর বলে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে শুদ্ধর প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ মাথা নেড়ে ইতিবাচক ইশারা দিয়ে মুচকি করে হাসলো। ধারা আনন্দিত হয়ে উঠলো। তার থেকেও বেশি খুশি হলো শুদ্ধ। পনেরো টা প্রশ্নের মধ্যে বারোটারই সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে ধারা। যেখানে বেছে বেছে শুদ্ধ কঠিন প্রশ্নগুলোই করেছিল। খুশির জোরে হঠাৎ করে ওরা দুজন একটা হাই ফাইভও করে ফেললো। শুদ্ধ উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘ধারা, আপনি খুব ভালো করছেন। আমার মনে হয় আপনি পারবেন।’

ধারা মৃদু হেসে মাথা নিচু করলো। শুদ্ধ বলল,
‘আপনার পরীক্ষার সময় তো আপনাকে নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে৷ তারপর দুইদিন থেকে আবার ফেরত চলে আসবো। এর জন্য আমার কাজগুলো আগে থেকেই গুছিয়ে রাখতে হবে। একবার চান্স পেয়ে গেলে তো আবারো যেতে হবে তারপর তো একেবারে ভর্তি করে আপনাকে হলে রাখার ব্যবস্থা করেই আসতে হবে।’

কথাটা বলতে বলতেই শুদ্ধ’র গলার আওয়াজ হঠাৎ কমে এলো। ধারা উদ্গ্রীব হয়ে বলল,
‘রেখে আসতে হবে মানে?’
শুদ্ধ জোর করে একটু হেসে বলল, ‘ঢাকায় থেকেই তো আপনাকে পড়তে হবে। রোজ রোজ তো আর আপনি গ্রাম থেকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারবেন না। ইউনিভার্সিটির কাছেই হলে থাকবেন। মন দিয়ে পড়ালেখা করবেন।’

ধারার কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেলো। কি বলবে না বলবে সে ভেবে না পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘আচ্ছা, আপনিও তো দূরে থেকে পড়ালেখা করেছেন। এভাবে দূরে থাকতে আপনার খারাপ লাগেনি?’

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে শুদ্ধ মুখে হাসি টেনে সামনে দৃষ্টি নিয়ে বলল, ‘কখনো কখনো বড় কিছু অর্জনের জন্য ছোট ছোট এই অনুভূতিগুলোকে আড়াল করতে হয় ধারা। আপনি সেখানে গিয়ে পড়বেন, খুব বড় হয়ে একদিন ফিরে আসবেন। ফিরে তো আসবেনই। এই যে আমিও তো এসেছি। সেই দিন পর্যন্ত থেকে যায় শুধু আপনজনদের নিরন্তর অপেক্ষা।’

এরপর ধারার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে শুদ্ধ বলল, ‘এখন কোন ধরণের দূর্বল অনুভূতিকে মনে জায়গা দিবেন না। আপনার সামনে এখন সফলতার দরজা খোলা। কঠিন হলেও আপনাকে সেই পথে যেতে হবে৷ আপনাকে আমি একজন সফল মানুস হিসেবে দেখতে চাই ধারা। তার জন্য যা করা দরকার আমি করবো৷ আপনি শুধু মনে সাহস রাখবেন। ভেঙে না পড়ে নিজের উপর বিশ্বাস রাখবেন। নিজের জন্য, আমার জন্য এই চেষ্টাটা আপনি করবেন তো ধারা?’

আনত দৃষ্টি তুলে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো ধারা। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে আশ্বাসের সাথে চোখের পলক ফেলে সে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। শুদ্ধও খুশি হলো। ধারা বলল,
‘আমার রেস্ট নেওয়া হয়ে গেছে। চলুন ভেতরে গিয়ে পড়তে বসি। আপনিই তো বলেছেন, পরীক্ষা এসে পড়েছে, সময় নষ্ট করা এখন একদমই উচিত হবে না।’

ধারার আগ্রহ দেখে শুদ্ধ’র ভালো লাগলো। হেসে বলল, ‘চলুন।’

ধারা মাচা থেকে নেমে আগে আগেই যেতে যেতে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি যদি পারি আপনি আমাকে কি দিবেন?’

শুদ্ধ মাচার ওপরে আরও আয়েশ করে বসে আড়চোখে চেয়ে বলল,

‘আন্ধার রাইতে আইসো কন্যা একলা দীঘির পাড়,
তোমায় আমি দিমু একখান নীল জ্যোৎস্নার হার।’

ধারা নিজের লজ্জা আড়াল করে পেছনে ফিরে মৃদু হেসে বলল, ‘বাহ! আপনি তো ভালোই ছন্দ বানাতে পারেন।’
শুদ্ধও ঠোঁট চেঁপে খানিক হাসলো। তারপর মাচা থেকে নেমে ধারার পাশে এসে কথা কাটিয়ে ব্যগ্র দিয়ে বলল,
‘চলুন, চলুন, পড়তে বসবেন না! চলুন।’
ঠোঁট ফুলিয়ে ধারা শুদ্ধ’র সাথে সাথে গেলো। রুমে গিয়ে বিছানায় বই নিয়ে বসলো ধারা। রাত গভীর হতে লাগলো। ধারা মনোযোগী হয়ে পড়লো বইয়ে। পড়তে পড়তে একসময় বই থেকে মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো শুদ্ধ ধারার একটা বই কোলে নিয়ে হাতে কলম ধরেই বালিশের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীরে একটা ক্লান্তির ছাপ। ধারার ভীষণ মায়া লাগলো। ধারার এই এডমিশনের চক্করে শুদ্ধ এতোটাই খাটছে যে ধারার মাঝে মাঝে মনে হয় পরীক্ষাটা তার না, আসলে শুদ্ধ’র। প্রতিদিন সাথে করে ধারাকে শহরে নিয়ে যাওয়া, যতক্ষণ ধারা পড়বে ততক্ষণ ধারার সাথে বসে থাকা, এমনকি ধারা ঘুমিয়ে গেলেও গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ধারার জন্য মনে রাখায় সহজ করে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরমালা তৈরি করা, রাত বিরাতে ধারার জন্য ঘন ঘন নিচ থেকে চা বানিয়ে নিয়ে আসা সবই তো লোকটা বিনা ক্লান্তিতে, বিনা বিরক্তিতে করে আসছে। এর সাথে তার নিজের কাজ তো আছেই। সব অর্থেই ধারার চেয়ে যেন দ্বিগুণ খাটছে শুদ্ধ। ধারার এক মামাতো বোনের বিয়ের পর ধারা দেখেছিল কিভাবে এতো ভালো ছাত্রী হওয়ার পরও তার স্বামী তাকে পড়তে দেয়নি। বাড়ির বউয়ের বাইরে গিয়ে পড়ালেখা তারা পছন্দ করে না বলে। তারপর পাশের বাসার রেশমি আপুর সময়ও তো দেখলো, তার স্বামী অবশ্য নিষেধাজ্ঞা করেনি তবে পড়ালেখার জন্য সময় ব্যয় করায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতোটাই খিটখিট করতো যে শেষমেশ আপুটা সংসারের শান্তির জন্য নিজের পড়ালেখা ছেড়ে দিল। তার স্বামীও তখন ছিল নিশ্চুপ। আর এতো এতো উদাহরণের মধ্যে শুদ্ধ যা করছে তা সত্যিই ধারণার অতীত।

ধারা বই রেখে উঠে দাঁড়ালো। শুদ্ধ’র কাছে গিয়ে তার কোল থেকে বই সরিয়ে, হাত থেকে কলম ছাড়িয়ে ঠিক করে রাখলো। তারপর গায়ে একটা কাঁথা দিয়ে ঢেকে শুদ্ধ’র ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধার সাথে মৃদু হাসলো।
__________________________________________

ধারার পরীক্ষার মাত্র দুইদিন আগে ফাহিম অসময়ে শুদ্ধকে আর্জেন্ট ডেকে পাঠালে শুদ্ধ ভাবলো হয়তো ধারার পরীক্ষা বিষয়ক কোন আলাপ করতেই ডেকেছে। কিন্তু গিয়ে দেখলো ব্যাপারটা ভিন্ন। ফাহিম খুবই উশখুশ করে কথাটা বলল, ‘দোস্ত, কথাটা কিভাবে বলবো আমি বুঝতে পারছি না।’
শুদ্ধ বলল, ‘তুই এতো ভাবছিস কেন? কি বলবি বল!’
ফাহিম গড়িমসি করে বলল,
‘খুব প্রয়োজন না হলে তোকে বলতাম না রে। আমার খুব আর্জেন্ট এখন টাকার প্রয়োজন। তুই যদি তোর টাকাটা আমাকে এখন দিতে পারতি তাহলে খুব ভালো হতো।’
টাকার কথা শুনে শুদ্ধ’র মুখ শুকিয়ে গেলো। ফাহিম বলতে লাগলো, ‘তোর সাথে তো আমার আট হাজার টাকার ডিল হয়েছিল ধারার পড়া নিয়ে। তুই না হয় সাত হাজারই দিস৷ কিন্তু টাকাটা আমার এখনই প্রয়োজন রে শুদ্ধ। বিশ্বাস কর, দরকার বলেই এভাবে চাইছি। নয়তো এমন হঠাৎ তোকে তাড়া দিতাম না।’
শুদ্ধ একটা হাসি টেনে বলল, ‘আরে দূর! তুই এতো সংকোচ করছিস কেন? আমরা আমরাই তো। তোকে আমি তোর ফুল টাকাটাই দিবো। কম কেন দিবো? তুইও তো ধারার পেছনে কম কষ্ট করোস নাই। এতো ব্যস্ত থাকার পরেও সময় বের করেছিস। আমি তোকে দিয়ে দেবো। টেনশন নিস না।’

শুদ্ধ’র থেকে আশ্বাস পেয়ে ফাহিম স্বস্তির হাসি দিয়ে চলে গেলো। ফাহিম যেতেই চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেলো শুদ্ধ’র কপালে। ফাহিমকে শুদ্ধ কিছু মাস পর সমস্ত টাকা দিবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু টাকাটা তো ফাহিমের এখনই প্রয়োজন। হঠাৎ করে এতোগুলো টাকার ব্যবস্থা শুদ্ধ কিভাবে করবে বুঝতে পারলো না। ইতিমধ্যেই সব টাকা সে তার প্রজেক্টে লাগিয়ে দিয়েছে। তার উপর বিয়েতেও কম টাকা খরচ হয়নি। মাসের মধ্যবর্তী সময় চলছে। হাতে এখন একপ্রকার টাকা নেই বললেই চলে। ধারাকে নিয়ে ঢাকায় আসা যাওয়া করতেও তো কতো টাকা লাগবে! শুদ্ধ কি করবে কিছু খুঁজে পেলো না। এতোগুলো টাকার ব্যবস্থা হঠাৎ কোথা থেকে করবে? হঠাৎ ই তার নজর পড়ে হাতের ফোনটির দিকে। এই আড়াই মাস আগেই টাকা জমিয়ে পনেরো হাজার টাকা দিয়ে শখ করে ফোনটা কিনেছিল৷ ফোনটার স্ক্রিনে একবার মায়ার সাথে হাত বুলালো শুদ্ধ। পরক্ষনেই তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ধারাকে তার এখন সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পেছনে ফিরে তাকাবার এতো সময় কই! ফোন তো এর কাছে অতি সামান্যই।

চলবে,

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-১৯
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

বাড়ি ফিরে যেতেই শুদ্ধ শুনতে পেলো ধারার দাদী অসুস্থ। ধারার বাবা খোদেজাকে ফোন করে দাদীকে দেখতে আসার জন্য ধারাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। শুদ্ধ’র কপালে খানিক চিন্তার ভাঁজ পরলো। আগামীকাল পরীক্ষা। আর আজকেই যদি ধারাকে মধুপুর গ্রামে যেতে হয় তাহলে কিভাবে কি করবে? অপরদিকে দাদী অসুস্থ। না গিয়েও তো পারা যাবে না। যেখানে ধারার বাবা নিজ থেকে খোদেজাকে ফোন করে বলেছে৷ রুমে গিয়ে দেখলো ধারা শুদ্ধ’র আসার অপেক্ষায় বসে আছে৷ এখনও ব্যাগ গোছানো শুরু করেনি। শুদ্ধ বলল,
‘ধারা, যাওয়াটা তো প্রয়োজনই। একটা কাজ করেন, সব একসাথেই গুছিয়ে ফেলেন। পরীক্ষা তো আগামীকাল বিকাল সাড়ে তিনটায়। আমরা সকাল সকালই ঢাকার জন্য রওয়ানা হয়ে যাবো৷ আপনি ওখান থেকেই সকালে বাস স্ট্যান্ডে চলে আসবেন। আমি আগে থেকেই সেখানে থাকবো৷ আমিও আপনার সাথে যেতে পারতাম কিন্তু আমার এদিকে আরও কিছু কাজ আছে। ঢাকায় যাওয়ার আগে সেগুলোও মিটাতে হবে। আপনি সময়মতো এসে পড়বেন, ঠিকাছে?’

শুদ্ধ’র কথায় সায় দিয়ে ধারা মাথা দুলালো। শুদ্ধ বলল,
‘আর শুনুন, আপনার বাবাকে বলা নিয়ে বেশি ভাববেন না। যেহেতু সেখানে যাচ্ছেন জানাতে তো তাকে হবেই। আপনার বাবা যদি একটু রাগও করে বেশি মন খারাপ করবেন না। একটু ইগনোর করার চেষ্টা করবেন। যদিও আমার মনে হয় না, সম্পূর্ণ পরীক্ষার প্রিপারেশন নিয়ে ফেলেছেন জানতে পারলে আপনার বাবা বেশি কিছু বলবে। ঠিক মতো যাবেন ধারা। আমি আমাদের পরিচিত এক অটোচালককে ঠিক করে রেখেছি। সে সোজা আপনাকে আপনাদের বাড়িতে দিয়ে আসবে।’

ধারা ব্যাগ গুছানো শুরু করলে শুদ্ধ আবারো পাশ থেকে বলল,
‘আপনার পড়া তো সব কমপ্লিট করাই, তবুও আমি যেই ইম্পর্টেন্ট নোটগুলো বানিয়ে দিয়েছিলাম সেগুলো নিয়ে যান। বারবার শুধু সেগুলোতে হালকার উপর একটু চোখ বুলাবেন। এখন বেশি চাপ নিতে হবে না। নতুন কিছুও আর পড়তে হবে না। যা পড়েছেন এখন তাই যথেষ্ঠ।’

ধারা আবারো মাথা নাড়ালো। ব্যাগ গুছানো হয়ে গেলে শুদ্ধ আবারো বলতে শুরু করলো,
‘আজকে আর বেশি রাত পর্যন্ত জাগবেন না ধারা। তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়বেন। আর নিজের খেয়াল রাখবেন। ঠিকমতো খাবার খাবেন। একটু পর পর পানি খাবেন। বুঝেছেন?’

হাতের কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলো ধারা। মানুষটা আজকে এতো বকবক করছে! ধারা বলল, ‘বুঝেছি। খুব ভালো মতোই বুঝেছি। আপনি এতো ভাববেন না। আমি নিজের খেয়াল রাখবো।’

শুদ্ধ স্মিত হাসলো। একটুপর অটো চলে এলে ধারা চলে গেলো। শুদ্ধ’র খানিক খারাপ লাগলো বটে তবে সে ব্যাকুল হয়ে কালকের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ভালো মতো কালকে ধারার পরীক্ষাটা দেওয়া হয়ে গেলেই শুদ্ধ’র স্বস্তি।
__________________________________________

বাড়ি ফিরে নিজের বাবার শক্ত গম্ভীর মুখটা দেখতেই ধারার মুখের ভাব পাল্টে গেলো। কোনমতে বাবার সামনে থেকে চলে এসে নিজের রুমটায় ঢুকে পড়লো সে। এতদিন বাদে ধারা এই বাড়িতে থাকতে এসেছে বলে ভীষণ খুশি হলো আসমা। রাতুলও বড় বোনের আসায় আনন্দিত হলো। ধারা ও’র ব্যাগ থেকে রাতুলের জন্য একটা ঘড়ি বের করে বলল তার দুলাভাই দিয়েছে। গতমাসেই রাতুলের জন্য পছন্দ হওয়ায় কিনে রেখেছিল শুদ্ধ। পড়ার চাপে নিজের বাপের বাড়ি এতদিন না আসায় ধারা দিতে পারেনি। এরপর দাদীর কাছে গিয়ে বসতেই জমিরন বিবি অসুস্থ গলায় বিরক্তি ভাব নিয়ে বললেন,
‘প্রত্তম আইসাই নিজের রুমটার মইধ্যে ঢুকলি! কই দাদীরে দেখতে আইবো তা না! তুই জীবনেও কিছু শিখতে পারলি নারে ধারা। এমন যদি শ্বশুরবাড়িত করোস, পরের বাড়ির ভাত দুইদিনও খাইতে পারবি না।’

ধারা চুপ করে রইলো৷ মাথা নিচু করে বসে রইলো দাদীর পাশে। তখন আজিজ সাহেব এসে দাঁড়ালেন সেই রুমে। জমিরন বিবি হঠাৎ খুকখুক করে কাশতে লাগলো। আজিজ সাহেব তার স্বভাবগত গম্ভির স্বরে দ্রুত বললেন,
‘ধারা, তোমার দাদীকে ফ্লাক্স থেকে গরম পানি ঢেলে খাইয়ে দাও।’

আজিজ সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই ধারা যত দ্রুত সম্ভব উঠে দাঁড়ালো। তার বাবা কোন কিছুতেই বিলম্ব একদমই পছন্দ করেন না। আর এই তাড়াহুড়োর চক্করে ধারা সবসময়ই একটা না একটা গড়মিল করে ফেলে। বিশেষ করে তার বাবা যখন সামনে থাকে। যেমনটা এই মুহুর্তে করলো। আজিজ সাহেবের সামনে কোন কাজ করতে গেলে সেটাতে যাতে কোন ভুল না হয় এই প্রয়াসে ধারা এতোটাই নার্ভাস হয়ে পড়ে যে সেই মুহুর্তে তার মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। দাদীর জন্য ফ্লাক্স থেকে পানি ঢালতে গিয়ে সে কাঁপা হাতে কিছুটা গরম পানি জমিরন বিবির হাতে ফেলে দেয়। ধারা ঘাবড়ে যায়। যদিও ছিটকে আসা পানির পরিমাণ ছিল খুব অল্পই এবং পানি খুব বেশি গরম ছিল না যার দরুন জমিরন বিবির হাত খুব বেশি জ্বলে না। তবুও সেই হালকা জ্বালাতেই জমিরন বিবি কঁকিয়ে উঠে বলেন, ‘আজিজ রে তোর মাইয়ারে কি আনছোস আমারে মারতে! কি করলো!’

আজিজ সাহেব বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি কি কোন কাজই ঠিকমতো করতে পারো না ধারা!’

এই বলে আজিজ সাহেব চলে যান। ধারাও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ সে মুহুর্তে তার আর বলা হয়ে ওঠে না আগামীকাল পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা। সে ভেবে নেয় রাতে বলবে। কিন্তু সেই রাতে আর আজিজ সাহেবের দেখা পাওয়া যায় না। গ্রামের এক ঝগড়া সুলভের মাতব্বরীতে যেতে হয় তাকে। ধারা অপেক্ষা করতে থাকে। গভীর রাত হয়ে গেলে অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়েও যায়। ঘুম ভেঙে সকালের আলো দেখতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। খুব বেশি বেলা হয়নি। তার বাস সকাল নয়টার। এর আগে যে করেই হোক ধারাকে সবটা বলতে হবে তার বাবাকে।

শুদ্ধ সকাল সাতটা নাগাদই চলে আসে বাস স্ট্যান্ডে। তার আশেপাশের একটা হোটেল থেকেই সকালের নাস্তা করে নেয়। উত্তেজনায় খুব একটা খেতেও পারে না শুদ্ধ। আধপেটেই পুনরায় চলে আসে বাস স্ট্যান্ডে। বাস আসতে এখনও অনেক দেরী। বাস সমিতির কি একটা ঝামেলার কারণে একদম সকালের বাস বন্ধ থাকায় শুদ্ধকে নয়টার বাসেরই টিকিট কাটতে হয়। এতেই পরীক্ষা শুরুর আগে অনয়াসেই পৌঁছানো যাবে। শুদ্ধ একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে। তবুও স্থির হতে পারে না। একটু পরপরই ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় যেন কাটছেই না। কখন আসার সময় হবে ধারার?

ধারার বাবা সকালে হাটতে বেড়িয়ে এখনো ফিরে আসেনি। ধারা আছে শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। আবহাওয়া খুব বেশি গরম না হওয়ার ফলেও খুব করে ঘামছে সে। গলা বারবার শুকিয়ে আসছে৷ কিভাবে যে কথাটা বাবার কাছে শুরু করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না ধারা। তবুও বলতে তো তাকে হবেই। বাইরে দৃষ্টি রেখে সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার পায়চারি করতে থাকে। জমিরন বিবি এখন বেশ খানিকটা সুস্থ। ঠান্ডা, জ্বর রাতের মধ্যেই কমে গেছে। রোদের মধ্যে মোড়া পেতে এখন বসে আছে সে। একসময় আজিজ সাহেব গম্ভীর মুখে বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। ধারা নিজেকে একটু ধাতস্থ করে যেই না কিছু বলতে যাবে তার আগেই আজিজ সাহেব রাতুল বলে ডেকে একটা হুংকার ছাড়েন। আজিজ সাহেবের রাগের সাথে সেই বাড়ির সকলেই পরিচিত। সকাল সকাল এমন হুংকার শুনে রান্নাঘর থেকে আসমা, জমিরন বিবি দুজনেই ছুটে আসেন। ধারা হঠাৎ বুঝতে পারে না কি হয়েছে? রাতুল শঙ্কিত হয়ে দ্রুত বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়। আজিজ সাহেব মেঘের গর্জনের চাইতেও গম্ভীর মুখে বলেন,
‘তুমি আগামীকাল স্কুল থেকে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলে?’
রাতুল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। আজিজ সাহেব প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে রাতুল আস্তে আস্তে মাথা নাড়ায়। আজিজ সাহেব বরফের মতো শীতল কণ্ঠে বলেন,
‘কেন?’
রাতুল নিশ্চুপ হয়ে থাকে। কোন উত্তর না পেয়ে আজিজ সাহেব গর্জন করে বলেন, ‘বলো কেন?’
রাতুল ভয়ে কেঁদে ফেলে। আজিজ সাহেব বলতে থাকেন, ‘তোমার স্যারের সাথে আজকে সকালে আমার দেখা হয়েছিল। তুমি স্কুলের ক্রিকেট বোর্ডে নাম লিখিয়েছো। সেখান থেকে আবার ক্লাস বাদ দিয়ে আরেক স্কুলে খেলতেও গেছো। তোমাকে কি স্কুলে পাঠাই ক্লাস করতে নাকি ক্রিকেট খেলতে? ক্রিকেট খেলে তোমার কি লাভটা হবে শুনি? যে ক্লাসের থেকে তোমার ক্রিকেট বড় হয়ে গেলো?’

রাতুল কাঁদতেই থাকে। আজিজ সাহেবের চিৎকার সেখানে উপস্থিত সকলের রক্ত ঠান্ডা করে দেয়। জমিরন বিবি নাতির পক্ষে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আজিজ সাহেব থামিয়ে বলেন,
‘আম্মা, আপনি আজকে কিছু বলবেন না। এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমি কিছুই জানতে পারলাম না। অনেক বড় হয়ে গেছো? আমাকে জানানোর দরকার মনে হলো না! এতো সাহস এর হলো কিভাবে? আমার কাছে না জিজ্ঞেস করে কাজ করে! এতো বাড় বেড়ে গেছে! এতো বড় আস্পর্ধা?’

এই বলে অগ্নিশর্মা আজিজ সাহেব টেবিল থেকে স্টিলের জগ হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। বিকট আওয়াজ তুলে পানি সহ জগটা ঝনঝন করতে করতে ধারার পায়ের কাছে এসে পড়ে। বাবাকে জমের মতো ভয় পাওয়া ধারা এমন রূপ দেখে মুখের সমস্ত শব্দ হারিয়ে ফেলে। হাতের ফোনটা বারবার ভ্রাইবেট হতে থাকে আর ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ভয়ে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে ধারা।

সময় গড়াতে থাকে। এদিকে ধারা এখনও আসছে না দেখে শুদ্ধ উদ্গ্রীব হয়ে উঠে। স্মার্ট ফোনটা বিক্রি করে সদ্য কেনা সস্তা বাটন ফোনটা দিয়ে ধারার ফোনে ননস্টপ কল করে যায় শুদ্ধ। ধারা ফোন তুলছে না দেখে আরও বিচলিত হয়ে উঠে। বাস ছাড়ার সময় হয়ে যায়। শুদ্ধ অনেক বলে কয়ে বাসকে পাঁচ মিনিটের জন্য আটকে রাখে। তারপর আবারও বলে বলে দুই মিনিট। মূলত ছেলেটার এতো ব্যাকুলতা দেখেই বাস চালক দশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করে। তারপর আর সম্ভব না বলে আফসোস করে চলে যায়। সময় নষ্ট না করে শুদ্ধ আবারও সেকেন্ড বাসের টিকিট কেটে রাখে৷ আর ধারাকে লাগাতার ফোন করতে থাকে। এতক্ষণ ফোন রিং হলেও এখন ওপাশ থেকে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। মুখের রং পাল্টে যায় শুদ্ধ’র। সে আরও দু তিনবার ফোন করে। সেই একই কথা শোনা যায়। দেখতে দেখতে দ্বিতীয়, তৃতীয় বাসটাও চলে যায়। এখন আর ঢাকার বাসে উঠলেও পরীক্ষার আগে যাওয়া কোন পক্ষেই সম্ভব হবে না। শুদ্ধ ধপ করে বসে পড়ে বেঞ্চে। একসময় ঘড়ির কাটায় বেজে উঠে তিনটা ত্রিশ। শুদ্ধ তখনও পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসেই থাকে সেই কাঠের বেঞ্চে।

চলবে,