#হিমাদ্রিণী – ১১
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা
অবশেষে এক ঘণ্টার দীর্ঘ বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেল মাশুক। হেমার মায়া হলো যেনো। বাথরুমের দরজা খুলে হেমা দুষ্টু হাসিতে মাতোয়ারা।আর মাশুকের মুখে ফুটে উঠেছে অস্বস্তির রেখা। এত সময় বন্দী থেকে মনের কোণে জমেছে অসন্তোষ। মাশুকের মনে হলো, হেমার যেমন নিজের রাগ সামলানোর ক্ষমতা অর্জিত হওয়ার পাশাপাশি অন্যের অনুভূতির প্রতি স্পর্শকাতরতা থাকা উচিত। সেও আজ রাগ দেখাবে।কি প্রতিক্রিয়া দেয় হেমা তা দেখতে চায়।কাঁধে তাওয়াল নিয়ে গুমরো মুখে সরে যায়।ধীর পায়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়।
হেমা বোকা হয়ে দাঁড়ালো।মাশুক তার সাথে কথা বললো না কেনো?মাশুকের সাথে তাল মিলিয়ে তার টিশার্ট টেনে ধরে।বলে,
-“কোথায় যাচ্ছো?”
মাশুক জবাব দিলো না।টিশার্ট ছাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে হাজির হয়।ভেজা তাওয়াল দড়িতে ঝুলিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ায়। হেমাও পিছু পিছু এলো।মুখ উঁচু করে চেয়ে বললো,
-“কথা বলো আমার সাথে”
মাশুকের নীরবতা হেমার মনে উদ্বেগ ছড়ায়। কপালে ভাঁজ ফেলে সে চিন্তায় ডুবে গেলো সে। মাশুক আড়চোখে একবার হেমার মুখ দেখে নিলো।সঙ্গে নিজের ভঙ্গিমা অটুট রাখে। হেমা অনুভব করছে।ভালো লাগছে না মাশুকের নীরবতা।তার চেনা মাশুককে অন্য রকম লাগছে।অস্থিরতা প্রকাশ করলো হামলা করে।টিশার্ট টেনে ধরে বলে,
-“এই মাশরুম কথা বলছো না কেনো?তুমি কি শুনতে পাও না।”
ধারালো নখের আঁচড় পড়েছে গলায়।মাশুক যন্ত্রণা অনুভব করলো।কিন্তু শক্ত রইলো।হেমার দিকে না চেয়ে বললো,
-“আমি রাগ করেছি এটা কি বুঝতে পারছো তুমি?”
-“রাগ করেছো?”
-“হুম”
-“তোমাকে বাথরুমে আটকে রেখেছি বলে?”
মাশুক নীরবে স্বস্তি পেলো।যাক! অন্তত রাগের কারণ ধরতে পেরেছে চট জলদি।মাশুক জবাব দিলো,
-“হুম”
হেমা ড্যাবড্যাব করে মাশুকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।যেনো তার প্রতিটি ভাব প্রকাশ বোঝার চেষ্টা করছে। একসময় তার দৃষ্টি আটকে গেলো মাশুকের গাঢ় বাদামী দাড়ির দিকে।যা তার কাছে হঠাৎ বেশ আকর্ষণীয় মনে হলো। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
-“তুমিও কি আমাকে রাগ করে আটকে রাখবে?”
হুট করে হেমার নরম হাতের স্পর্শে নড়েচড়ে উঠলো মাশুক।কিন্তু আটকে গেলো তার কথায়।মাশুক ঘুরে তাকায়।প্রশ্ন করে,
-“না আটকে রাখবো না।তোমাকে কি কেউ কখনো আটকে রেখেছিলো?”
হেমা ভাবনার সমুদ্রে ডুব দেয়।হাত সরিয়ে নিতে চাইলে মাশুক সেটি হতে দিলো না।নিজ হাতে হেমার হাত আগলে রাখলো রুক্ষ গালে।ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করে,
-“কেউ আটকে রেখেছিলো কখনো?”
-“মনে নেই। উফ! হাত ছাড়ো আমার।তোমার গালে এত চুল কেনো?হাত চুলকাচ্ছে আমার।”
হেমা তড়িৎ গতিতে হাত সরিয়ে অন্যহাতে ঘষতে শুরু করে। দাড়ির রুক্ষতায় অস্বস্তি অনুভব করছে হেমা।অন্যদিকে উপভোগ করছিলো মাশুক।সেটাও বেশিক্ষণ টিকলো না।তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“দুপুরে কি খেয়েছো?”
-“নতুন মা আমাকে মাছ বেছে খাইয়েছে।”
মাশুক হাসলো।বললো, “নতুন মা নয়,শুধু মা।”
হেমা কথার বিপরীতে প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করে, -“এই তোমার রাগ কমে গেছে?”
মাশুক মিছেমিছি বলে উঠে, – “না।তুমি আমাকে সরি বলো নি।কাউকে এভাবে আটকে রাখা ঠিক না হেমা।”
হেমা বেশি সময় নিলো না।দ্রুত বলে উঠলো, – “সরি”
-“আর এমন করবে?”
-“না না একদম না।আমি কি কানে ধরবো?”
হেমাকে বাহুতে পেঁচিয়ে ধরে বললো, -“না কানে ধরার প্রয়োজন নেই।এখন আমরা খাবার ঘরে যাবো।সবাই মিলে নাস্তা করবো।তুমি সবার সাথে কথা বলবে।রাগ করতে পারবে না।”
-“আমি ওই অসভ্য পঁচা মেয়ের কাছে যাবো না”
-“ওর দিকে তাকাবে না।এসো”
সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই আবার একসাথে চায়ের আড্ডায় বসেছে। হেমার কারণে এতদিন এই আড্ডায় কিছুটা বিরতি আসলেও আজ আবার সেই আগের দিনের মতো সবাই মিলে একসাথে বসেছে। মৃদুলও ঠিক আজানের আগে বাড়িতে ফিরে আসে। টিভিতে খবর চলছে, আর সবাই যার যার মতো সোফায় বসে। যেনো পুরনো স্বাভাবিকতাটা আবার ফিরে এলো যেনো।তাছাড়াও পরিবারের সদস্য বৃদ্ধি।মাশুক হেমাকে চা কিছুটা ঠান্ডা করে এগিয়ে দিলো।অন্যদিকে রাইমা সুযোগ বুঝে মাশুককে বললো,
-“আমাকে চায়ের কাপটা পাস করবেন প্লীজ?”
মাশুক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার পূর্বেই হেমা মুখ ভেংচি কাটে। শান্তা বেগম আলগোছে হাসলেন।মাশুক আলতো হাতে রাইমার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে হেমার দিকে তাকায়। হেমাকে ক্ষিপ্ত দেখালো।মাশুকের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।হয়তো তার বিষয়টি পছন্দ হয়নি।টিভির আওয়াজের অগচরে প্রশ্ন করলো,
-“আমি চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়েছি বলে রাগ করেছো?”
হেমা কুটকুট করে ড্রায় কেক চিবুচ্ছে। প্রচন্ড অভিমানে জবাবটুকু দিলো না।মাশুকের মাথায় আরো এক নতুন বুদ্ধি খেলে।মান,অভিমান,রাগ এসব সূক্ষ্ম অনুভূতি।যা হেমার মধ্যে আর জাগ্রত করা উচিত।মাশুক হেমাকে দেখিয়ে রাইমার দিকে কেক এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“শুধু চা খাচ্ছেন যে? নিন হালকা নাস্তা করুন।”
রাইমা এবং রিমা অবাক হলো মাশুকের আন্তরিকতায়।আগেও এসেছে সে এখানে।মুখ ফুটে একটা কথাও বলেনি মাশুক।রিমা অনেক চেষ্টার পরও বলেনি। হেমা ফিরে চাইলো মাশুকের দিকে।অথচ মাশুকের তার দিকে কোনো খেয়াল নেই। রেগে হাতে থাকা চায়ের কাপ এবং ড্রায় কেক টেবিলে শব্দ করে রাখে।দুহাত গুটিয়ে টিভির দিকে চেয়ে বসে রইলো।মাশুকের ঠোঁটে আসন্ন হাসিটা সে বহু কষ্টে দমিয়ে নেয়।বলে,
-“তুমি খাচ্ছো না কেনো?”
হেমা দ্রুত জবাব দেয়, – “খাবো না।”
হেমার আচরণে হঠাৎ অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেলো। মাশুককে একদম এড়িয়ে চলছে। খাবারের টেবিলে নীরব পরিবেশ। একবারও মাশুকের দিকে তাকালো না।মাশুক নিজ হাতে খাবার খাওয়াতে চাইলো, তখন তার হাত সরিয়ে দিলো। এত অভিমান? এত দ্রুত? হেমার এই পরিবর্তন সবাই লক্ষ্য করছে। পরিবেশটা থমথমে হয়ে আছে। জহির সাহেব খানিকটা বিস্মিত হয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কেউ বকেছে তোমায়, হেমা?”
হেমা তবু নির্বাক, যেন তার মনের ভেতর জমে থাকা এক পাহাড় অভিমান শব্দহীনভাব।শুধু মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দেয়।মাশুক আলগোছে হাসে।কিছু না বলেই চুপচাপ খেয়ে হেমার দিকে তার ঔষধ এগিয়ে দেয়। মাশুককে চমকে নিজ থেকেই ঔষধ নিয়ে পানি দিয়ে খেয়ে উঠে তরতর করে ঘরে চলে যায়। এ যেনো আরো অবাক করা দৃশ্য। মাশুকের ঘরেই পা বাড়িয়েছে। রিমা এই দৃশ্যে বিরক্ত।বিড়বিড় করে,
-“যত্তসব ঢং” বলে চলে গেলো।
মাশুকও কম যায় না।হাত ধুয়ে সেও বিড়বিড় করে,
– “অবুঝ মানুষ ঢং করলে ভালোই লাগে। বুঝদারদের সেটা মানায় না।”
বলেই আড়মোড়া দিতে দিতে ঘরে চলে যায়।
ঘরে ঢুকেই মাশুকের চোখে পড়লো এক ভিন্ন দৃশ্য। হেমা কাঁথা গায়ে মুড়িয়ে,হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। যেনো অভিমানের মূর্তি হয়ে গেছে। মাশুক ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে হেমার পেছনে গিয়ে বসলো। তার এই শিশুসুলভ অভিমানে মাশুকের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠে। এই মুহূর্তের শান্ত অথচ রাগ-ভরা নীরবতা দেখে হাতে ভর করে হালকা ঝুঁকে প্রশ্ন করে,
-“অভিমান কি নারীদের জাতিগত স্বভাব?”
মাশুক জানে তার এই প্রশ্ন অনর্থক। হেমা কিছুই বুঝবে না।উল্টো প্রতিক্রিয়া দিলো হেমা।নড়েচড়ে রাগ জাহির করলো।মাশুক আবার বলে উঠে,
-“তুমি কেনো রাগ করেছো?আমি ওই মেয়েটার সাথে কথা বলেছি বলে?”
হেমা কাঁথা নিয়ে মুখ ঢেকে রাখা অবস্থায় মাথা উপর নিচ দোলায়।মাশুক আরেকদফা হেসে ফেলে।মাশুক হাত বাড়িয়ে লাইট নিভিয়ে দিলো।হেমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে প্রশ্ন করলো,
-“আমি কি তোমার পাশে ঘুমোতে পারি?”
হেমা তার হাত ঘুরিয়ে ধাক্কা দেয় মাশুককে। তেজস্মি সুরে বলে,
-“না একদম না। যাও এখান থেকে।তুমি ওই মেয়েকে বিস্কুট এগিয়ে দিয়েছো।ওর সাথে কথা বলেছো।তোমাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না।”
-“তুমি হিংসা করছো হেমা?”
-“আমার সাথে কথা বলবে না।একদম বলবে না।”
হিংসায় জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে হেমা।মাশুক ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে তার এরূপ আচরণে।ভয়ে ভয়ে তার পাশে শুয়ে পড়লো।আলতো হাত বাড়িয়ে কাঁথা টেনে নেয় নিজের গায়ে।লক্ষ্য করছে হেমার অবস্থা।এই বুঝি হুটহাট আক্রমণ করে বসলো।কিন্তু না! এমন কিছুই করেনি।উল্টো ফুসছে নীরবে।
একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হয়ে ভয় পাচ্ছে।এরচেয়ে লজ্জাজনক কিছুই হতে পারেনা।মাশুকের সাহস বাড়লো।হেমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। হেমা মুহূর্তেই শক্ত কাঠের ন্যায় হয়ে পড়ে। সংকুচিত হয়ে গেলো।মাশুক অনুভব করে তাকে আর বলে,
-“আমাদের ব্যাপারটা আলাদা হেমা।পৃথিবীর সবাই একে অপরকে সজ্ঞানে প্রিয় স্থান দেয়।কিন্তু তোমার সকল অপূর্ণতা ধীরে ধীরে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠছে।”
______
সিনিয়র ডক্টরদের সাথে মিটিংয়ে হেমার বিষয় নিয়ে আলোচনার মধ্যে মাশুক জানালো, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ও আচরণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো পরিবর্তন,বাস্তবসম্মত চিন্তা শেখানোর মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানোর ক্ষেত্রে কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি ভালো কাজে দিচ্ছে এই কেসে। ইমোশনাল রেগুলেশন বিষয়টা হেমা পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারছে না।কিন্তু তাকে বোঝালে সে বুঝে। ডক্টর নিজাম বলে উঠলেন,
-“গ্রেট জব মাশুক। হেমা নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করা শিখে গেলে এক্সপোজার থেরাপির দিকে আগাও।”
মাশুক জবাব দিলো, – “স্যার ও এখনই এক্সপোজার থেরাপি নিতে পারবে না। ও ওর বাবা মায়ের সাথে ভীষণ এ্যাটাচড।”
ডক্টর নিজাম বললেন, – “আমি জানি মাশুক।কিন্তু ইউ হেভ টু ডু দিস। হেমা যত দ্রুত তার অতীত ট্রমার সাথে ডিল করতে শুরু করবে তত ভালো। তাছাড়াও হেমার মেন্টাল কন্ডিশন এর পাশাপাশি এখানে আইনি জটিলতা আছে।হেমাকে মনে করাতে হবে ওর মা বাবা মা রা যাওয়ার পর ওর সাথে কি হয়েছে।TF-CBT এবং EMDR শুরু করো।কিন্তু হ্যাঁ সেটাও খুব ধৈর্যের সাথে।সে তোমাকে ভরসা করে,তোমাকে পছন্দ করে।গেম খেলার কথা বলে তুমি শুরু করতে পারো।”
মাশুক শান্তনুর দিকে তাকালো।সেও এই মিটিংয়ে আছে।এখানে আইনের কঠোরতা আর মনোবিজ্ঞানের সূক্ষ্মতার সমন্বয় দরকার। হেমার বাবা-মায়ের কেসটি ক্রমশ জটিলতর হচ্ছে।মানসিক অত্যাচারের প্রমাণে কেস রিওপেন হলেও, আসামির পরিবার এখনও ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করছে না।
-“হেমার বাবা মায়ের হত্যার সিসিটিভি ফুটেজ কিভাবে পেলো তারা?” মাশুক জানতে চাইলো শান্তনুর কাছে।
শান্তনু জবাব দেয়,- “জব্বার সাহেব একজন নিকৃষ্ট লোক।বোন জামাই মারা যাওয়ার অল্পদিনেই সব সম্পর্ক ভুলে তাকে দোষারোপ করছে।বলছে যখন হেমার বাবা মায়ের কেসের এই ফুটেজের ভিত্তিতেই নাকি রায় এসেছে।শুধু খতিব সাহেবের কাছেই নাকি ছিলো এই ফুটেজ।”
মাশুক আকস্মিক বলে উঠে, – “মিথ্যে! সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা।আমি যখন খতিব সাহেবের কাছ থেকে হেমার ঘরের সিসিটিভি একসেস নিতে চাই উনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না কিভাবে কি করবেন? উল্টো ওনার ছেলের মাধ্যমে আমাকে ক্যামেরার নিয়ন্ত্রন দিয়েছেন।”
শান্তনু ভাবুক ভঙ্গিতে মাথা দোলায়।তার কাছে কেসটা পানির মত স্বচ্ছ।কিন্তু এসবের পেছনের কারণ না জানা অব্দি কোনকিছুই এগোবে না।যদি আসামীপক্ষের কাছ থেকে কোনো জবানবন্দি আসতো তাহলে কিছু একটা করা যেতো সেটিও সম্ভব নয়।শান্তনু বললো,
-“খতিব সাহেবের কাছে এই ফুটেজ থাকা মানে ফরিদা বেগমের কাছে থাকা।”
মাশুক একই সুরে বলে উঠে, -“ফরিদা বেগমের কাছে থাকা মানে জব্বার সাহেব আর তার ছেলে ফাহিমের কাছে থাকা।”
-“রাইট!”
শান্তনু আবার বললো, – “ইজি একটা কেস।ফরিদা বেগম এবং জব্বার সাহেব এসবে জড়িত শুধু প্রমাণ করার পালা।হেমার উপর মানসিক নির্যাতনে আমরা রিমান্ডে নিতে পারতাম সন্দেহের ভিত্তিতে কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না যতক্ষণ না পর্যন্ত একতরফা যারা আসামী হয়েছে তাদের থেকে ক্লিয়ার স্টেটমেন্ট আসতো।”
ডক্টর নিজাম বলে উঠেন, -“ওরা অযথা কেনো কাউকে মারবে? ওরা হচ্ছে অন্যের হাতের পুতুল।এটা আমাদের প্রশাসন বুঝে না?”
শান্তনু বললো, -“সবই বুঝে স্যার।কিন্তু বলে না?আইন অন্ধ।চোখে জ্যোতি ফিরবে না ততক্ষণ,যতক্ষণ না পাকাপোক্ত প্রমাণ সামনে রাখা হচ্ছে।”
মাশুক শুধায়, -“উপায় কি?”
-“উপায়? আমার এক গুপ্তচর জানিয়েছে জব্বার সাহেবের নাকি ব্যবসা আছে রূপগঞ্জে।সেখানে যাবো আমি আগামীকাল ছদ্মবেশে।আর খতিব সাহেবের ছেলের হিস্ট্রি বের করলাম।নাথিং সাসপেশিয়াস।আমি একটা প্ল্যান করেছি জানিস?”
মাশুক জানতে চাইলো, -“কি প্ল্যান?”
-“আমি আসামীদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে চাই।এই লোভে যদি মুখ খুলে।”
-“এতোদিন করিস নি কেনো তাহলে?”
শান্তনু হুট করেই ঠাট্টা শুরু করলো।তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, -“ভালোই অধৈর্য হয়েছিস বিয়ে করে। আইন কি তোর শ্বশুর বাড়ির আবদার?বললাম আর সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের ছেড়ে দিলো?”
মাশুক কাটকাট গলায় বললো, – “ছেড়ে দিতে কে বলেছে?মিথ্যে আশ্বাস দিতে বলছি।”
-“এখন সবকিছু গরম গরম।হাত দিলেই ফোস্কা পড়বে।একটু ঠাণ্ডা হোক ডক্টর মাশুক মৃধা?আপনি আপাতত সংসারে মনোযোগী হন।আসলাম আমি”
মাশুক ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে তাকালো। শান্তনুর যাওয়ার পানে চেয়ে বললো,
-“দ্রুত কেস সলভ কর।”
______
-“হেমা আমি ভীষণ নীরব রগচটা মানুষ ছোটবেলা থেকেই।আমার সাথে এক লাইনের বেশি কেউ কথা বললে আমার তাকে সহ্য হয়না।আমি চুপ থাকতে পছন্দ করি,একা থাকতে পছন্দ করি।কিন্তু আমার কাজ আমাকে ধৈর্য ধরতে বাধ্য করেছে কিন্তু তুমি আমাকে ধৈর্য শেখাচ্ছো।বাধ্য করা এবং শেখানো দুটোয় বিরাট তফাৎ।আমার রাগ হয়,অসহ্য লাগে।সবটাই ভিতরে পুষে রাখি,নয়তো হাওয়ায় ভাসিয়ে দেই।নয়তো বেঁচে থাকা সম্ভব না। আমার এই কথাগুলো বুঝবার শক্তি কবে জন্মাবে তোমার মাঝে?”
মাশুক বসে আছে।আর হেমা তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বসে।গতকালকের রাগ উধাও।আজ জেদ জায়গা করেছে সেখানে।মাশুকের গলা পেঁচিয়ে কোলে চড়ে বসে সে,কিছুতেই ওই অসভ্য মেয়ের নাগাল পেতে দিবে না।তার কাছ থেকে বাঁচাতেই এই অভিনব কৌশল।
কথার গভীরতা বুঝলো না হেমা।কিন্তু মস্তিষ্কে সেগুলো বারবার বাজছে। হেমা সবশেষে অনুধাবন করতে পারলো মাশুকের কষ্ট হচ্ছে।গলা পেঁচিয়ে রেখেই মুখ তুলে চায়।বলে,
-“তুমি কষ্ট পাচ্ছো?”
মাশুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, -“হ্যাঁ”
-“কোথায়? বলো? আমি আদর দিয়ে দেই?আমার মা আমাকে আদর দিলে আমার কষ্ট চলে যেতো।”
মাশুক হাসলো।বুকের বাম দিকে ইঙ্গিত করে বললো,
-“এখানে”
নির্বোধ এর মত মাশুকের বুকে হাত বুলায় হেমা।বলে,
-“এখনও কষ্ট হচ্ছে?”
এক গভীর সাগরের ন্যায় অতল তার নেত্র,বরফ ঢাকা শৃঙ্খের ন্যায় শীতল কায়া।তার মাঝে ডুবতে কোনো কারণের প্রয়োজন হয়নি।শুধু চেয়ে থেকেই এক প্রেমবাগ থেকে ঘুরে আসা যায়।তার অবুঝপনা মাশুককে তার দিকেই আকর্ষণ করে।
মাশুক হেমার দিকে একাগ্র দৃষ্টি রেখে বললো,
-“সব জবাব জমা রাখছি,দিবো যেদিন সত্যিই আমার চিত্তের ব্যথা দূর করতে পারবে।এখন থাকুক তোমার অবুঝ কথা,আমিও মেনে নেই।”
হেমার কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়লো। জানা কথা,তার মগজে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।মাশুক লম্বাটে নিঃশ্বাস ফেলে ভ্রুদ্বয় নাচিয়ে বললো,
-“এভাবে আর কতক্ষণ?”
হেমা ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে, – “কিভাবে?”
-“এইযে আমার কোলে চড়ে আছো? বন্দী করে রেখেছো?ছাড়া পাবো কি?”
-“না না! তুমি খুব খারাপ।আমি ছেড়ে দিলে তুমি ওই অসভ্য মেয়ের কাছে চলে যাবে বন্ধুত্ব করতে।”
মাশুক জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়।দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বললো,
-“তুমি আমার ভাগ দিতে চাও না?”
-“উহু একদম না।”
-“তোমাকে তাহলে একটা প্রশ্ন করবো।তোমার প্রমিস করতে হবে তুমি কান্না করবে না,ভয় পাবেনা।তুমি স্ট্রং মেয়ে তাই না?”
মাশুক ট্রমা-ফোকাসড কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (TF-CBT) শুরু করতে চাইছে। হেমা যেনো প্যানিক না করে তাই প্রথমেই তাকে আশ্বস্ত করে নিতে চাইলো মাশুক। হেমা বললো,
-“হুহ! বাবা বলেছে আমি সাহসী মেয়ে।আমি ভয় পাইনা।”
-“হ্যাঁ হেমা সাহসী মেয়ে।আমি তোমার সাথে গেম খেলবো।সেখানে আমি প্রশ্ন করবো তুমি উত্তর দিবে কেমন?ভয় পাবেনা তো?”
-“উহু পাবো না।”
মাশুক ধীর কণ্ঠে বলে উঠে,- “তোমাকে রাতের বেলা কেউ ঘুম থেকে ডেকে তোলে?”
হেমার মুখখানা দেখে বোঝা গেলো সে ভাবছে।মনে করতে চাইছে চোখ পিটপিট করে।মাশুক আবার বললো,
-“একজন শাড়ি পড়া মহিলা আসে তোমার কাছে?তোমার চাচীর মত?তোমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে?”
মাশুককে অবাক করে হেমা চট করে হেসে বললো, – “আরেহ ঐটা চাচী নাতো!মা আসে।আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়।আমরা ছাদে যাই বুঝেছো।আমার মা অনেক ভালো মাশরুম।তোমার চেয়েও ভালো।কিন্তু কিছুদিন যাবত আসছে না।আমি অনেক রাগ!”
চলবে….