হিমাদ্রিণী পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0
2

#হিমাদ্রিণী – ২৩ (শেষ পর্ব)
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা

স্নিগ্ধ সকালের আলো বাতাবরণে শোভা পাচ্ছে।আর পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে প্রকৃতি জেগে উঠেছে। আজ ভোরেই মাশুক কাউকে কিছু না জানিয়ে কয়েকজন লোক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। হেমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ইচ্ছা একটাই,এই বাড়িটিকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনা। ঠিক যেমনটা হেমা বলেছিল।যেমন কেটেছে তার অতীত এখানে। দুঃখের নয় সুখের স্মৃতিগুলো পুনরুদ্ধার করতে এসেছে। হেমার দেওয়া প্রতিটি ছোটখাটো বিবরণ মাশুকের মনে গাঁথা। হেমা বাড়ির চাবি এনে দিয়েছিলো।তাই বাইরের দরজা খুলতে খুব একটা কষ্ট হয়নি।

তার পূর্বেই নারী কণ্ঠে জোরালো ডাক পড়লো। সকলেই ঘুরে তাকায়। এক বৃদ্ধা লাঠি নিয়ে দৌঁড়ে আসছেন। ক্ষ্যাপাটে মুখ তার। তেড়ে এলেন মাশুকের দিকেই। লাঠি দেখিয়ে বললেন,

-“এই ব্যাটা! এই বাড়ির ধারে আইছোস কেন?”

মাশুক চমকিত ভঙ্গিতে তাকালো। জবাবে কিছু বলার পূর্বেই সে আরো এগিয়ে আসেন। মাশুককে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেপে বললেন,

-“ভালো ঘরের পোলা মনে হইতাছে। টাকা পয়সাও আছে মনে হয়। আবার আমার ভাইগ্নার বাড়ি দখল করবার আইছোস!”

মাশুক দ্রুত গতিতে না বোধক মাথা দোলায়। বলে,

-“এমন কিছুই না… আমি”

লাঠির আঘাত করবেন বলে। ভীষণ রাগান্বিত সে। মাশুক ভাবলো হয়তো ইনিই সেই যে হেমাকে সেদিন তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তেজি সুরে বললেন,

-“দিমু নাকি লাঠির বারি?কি ভাবছোস, আমার ভাইগ্না নাই দেইখ্যা বাড়ি দখল করবি? এক্কেরে দিমু না। বুড়ি হইছি শরীরে এহনও অনেক শক্তি। বাইর হো! বাইর হো কইতাছি।”

মাশুক অনিচ্ছায় হেসে ফেললো। বৃদ্ধার মুখের আশ্চর্যের ছাপ।বললেন,

-“এই ব্যাটা হাসোস কেন?”

মাশুক হাসি থামায়।বলে উঠে,

-“হাসছি নিজের কপালের উপরে…”

-“আইচ্ছা ঐটা পরে হাসিস… ঐযে সামনে দেখতাছোস? ঐটা আমার বাড়ি। আমি কিন্তু কোনো ফকিরনি না। আস্তা একটা বাড়ি আমার আছে। এই লেবাসে দেইখা আমার ভিখারী ভাববি না। এক্কেরে থানায় নিমু। বাইর হ আমার খায়রুলের বাড়ি থেকে।”

মাশুক চাইলো হাতের লাঠিটা নিজের হাতে নিতে। কিন্তু পেলো না। তেতে উঠলেন বৃদ্ধা। মাশুক বুঝলো যেহেতু ভাগ্নে বলছে সেহেতু সে খায়রুল সাহেব এবং খতিব সাহেবের খালা হবেন। সম্পর্কে তার দাদি শ্বাশুড়ি। মাশুক আর জোর করলো না। বললো,

-“হাসির কারণ জানতে চাইবেন না দাদি?”

-“আবার দাদি কয়?… তয় তোর হাসির কারণ ক দিহি?”

-“নিজের কপালের উপর হাসছিলাম। প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি এসে লাঠির বারি খেতে হবে বলে। দিন, দুটো বারি কপালেই দিন।”

মাসুমা বেগম লাঠি নামালেন তৎক্ষণাৎ। পূর্বের চেয়ে আরো বেশি কপাল কুঁচকে তাকালেন। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে তার। বললেন,

-“এডা তোমার শ্বশুরবাড়ি?”

-“হ্যাঁ”

-“তুমি কিডা?”

-“আপনার হেমার একমাত্র বর”

মাসুমা বেগমের চক্ষু জ্বলজ্বল করে উঠলো। কুচকানো চামড়ার মুখে এক আদুরে হাসি ফুটে। কি অমায়িক লাগে তাদের হাসতে দেখলে! প্রাণ জুড়ায় এই বয়সের মানুষের বাচ্চামো,হাসি। মাসুমা বেগম এগিয়ে এলেন। মাশুকের বাহুতে হাত বুলিয়ে বলেন,

-“তুমি আমার নাতজামাই?আমার হেমারে বিয়া করছো?”

মাশুক মাসুমা বেগমের দুহাত আগলে বললো,

-“হুম”

-“হায় হায়! তোমারে মারতে আইছি আমি? ছিঃ ছিঃ! বুড়ি হইছি মাথা কাম করে না বুঝলা। আহো আমার ঘরে আহো।”

মাশুক মাথা নাড়ে। বলে, – “আসবো কিন্তু এখন না দাদি। আপনার হেমার বাড়িকে আবার আগের মত সাজাতে এসেছি। ঠিক যেমনটা দশ বছর আগে ছিল।”

হুট করেই মাসুমা বেগমের চোখে পানি ছলছল করলো। বললো,

-“আমার পোলারা! আমার দুইটা কলিজা , গেলো গা ছাইড়া। আমার হেমার অবস্থা জানতাম নারে নাতজামাই। খুঁজছি অনেক, ওইদিন পাইছি রাস্তায়।আমার পরান জুড়ায় গেছে। তুমি বলে ডাক্তার? তোমার কথা কইছে হেমা। ওরে ভালো রাইখো।”

-“ ওকে ভালো রাখবো, তবে আপনি বলুন? আপনি কি একা থাকেন?”

-“না না! একলা থাকুম কেন? আমার তিন মাইয়া বিয়া দিছি। ওরা আমার বাড়িত থাকে। আমার ভরা সংসার। খতিব মরণের আগে আমারে এই বাড়ির চাবি দিয়া গেছিলো। আর হেমার নামে এই বাড়ি দিয়া গেছিলো। ওর বউ পোলার কাছ থিকা আড়াল কইরা।”

মাশুক হেসে বললো, – “আপনার সংসারে আরো একজন যোগ হলো তাহলে।”

-“কেডা?”

-“আমি…”

-“হ আমার চান্দের টুকরা নাতজামাই! আহো আইজ আমার বাড়িত দুইটা ভাত খাইবা।”

-“উহু দাদি! আপনার নাতনির বিয়ে। আপনি তৈরি হন। এবাড়ি থেকে বিদায় দিবেন নাতনিকে।”

______

হেমা বাড়ির প্রতিটি কোণ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মাশুকের কোনো সন্ধান পেল না। বারবার শান্তা বেগম আর জহির সাহেবের কাছে জানতে চাইলে তারা সাফ জানান এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। হেমার বুকের ভেতর শঙ্কা তৈরি হলো। মাশুক কি তাকে শাস্তি দিচ্ছে?হেমা তো সেদিন তাকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলো, সেই অভিমানে কি মাশুকও তাকে ছেড়ে চলে গেছে? হেমার হৃদয়ে গভীর উদ্বেগে কম্পন শুরু হলো। ঠিক তখনই কলিং বেল বাজে। শান্তা বেগম উঠে যাওয়ার পূর্বেই হেমা দৌঁড় লাগায়। দরজা খুলে দ্রুত। স্বস্তি পেলো, মাশুক দাঁড়িয়ে। হেমা বললো,

-“ভেবেছিলাম তুমিও চলে গেছো”

হেমা এমন আবেগঘন কথার গুরুত্ব পেলো না। মাশুক তাকে এড়িয়ে ঘরের দিকে চলে গেলো। আড়ালে মুচকি হাসলো। পেছনে হেমা চুপচাপ স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে।

ঘরে গেলো না আর। অপেক্ষা করলো শান্তা বেগম আর জহির সাহেবের সাথে বসে।পনেরো মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এলো হাতে লাগেজ নিয়ে। হেমার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে বললো,

-“চলো”

হেমা অবাক সুরে প্রশ্ন করে, -“কোথায়?”

-“তোমাকে তোমার বাড়িতে দিয়ে আসবো।”

হেমা একলাফে উঠে দাঁড়ালো।বললো,

-“কেনো? বাড়িতে কেনো? এটাই আমার বাড়ি।”

-“বেশি কথা বলবে না। চলো”

হেমা বাধ্য হয়েই ঘরের সাধারণ কাপড়ে বেরিয়ে এলো। একবার সাহস করে বলতে চেয়েছিলো, যেতে চায় না, কিন্তু মাশুকের চোখের কঠিন দৃষ্টি দেখে আর সাহস হলো না। আগে কখনো এমন ভয় অনুভব করেনি হেমা। নিঃশব্দে চোখের জল চেপে ধরে বসে রইলো। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই মরিচা বাতির আলোয় তার চোখের জল চিকচিক করে উঠলো। মাশুক কোনো কথা না বলে লাগেজ হাতে নিয়ে হেমার কাঁপা হাত ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।

বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই যেনো ঝটকা খায়। সেদিনকার পুরোনো ময়লায় আচ্ছাদিত ঘর পরিষ্কার। সবকিছু চেনা চেনা লাগছে। ঠিক এই রকমই ছিলো তাদের বাড়ি। সাথে রয়েছে মাসুমা বেগম, তার তিন মেয়ে এবং তাদের পরিবার। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। বুক কাঁপছে। ভেসে উঠছে সবকিছু যেনো। সামনে দাঁড়ানো সকলের মুখেই হাসি। হেমা তাদের চেনে আবার চেনে না। হেমা ঘুরে মাশুকের দিকে তাকালো। সবার সামনেই হুট করে জড়িয়ে ধরলো মাশুককে। মাশুক আড়ালে হেমার কোমর জড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,

-“সবাই দেখছে কিন্তু…”

-“দেখুক! আমি আমার বরকে জড়িয়ে ধরেছি, সবাই দেখুক। হিংসে করুক।”

-“ এখন ছেড়ে দাও।তৈরি হও আমার বউরূপে।নিতে আসবো। আর হ্যাঁ…রাতে যত ইচ্ছে জড়িয়ে ধরো, না করবো না।”

হেমা ছেড়ে দিলো। আজ কেনো যেনো এই বাড়িতে এসে কান্না পাচ্ছেনা। পাশে এবং সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো তার পরিচিত। ভীষণ আপন। এক তিক্ত অতীত পেরিয়ে নতুনের স্বাদ গ্রহণ করলো। মাশুক কানের কাছে এসে বললো,

-“আসছি..”

___

আয়োজন খুব বড় কিছু নয়। হেমার বউ সাজার ইচ্ছাপূরণ, খানাপিনা আর পরিবারের সাথে কিছুটা আনন্দঘন সময় কাটানো এই তো। মাশুকের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা আসবে, আর থাকবে শান্তনু। দাদি, ফুপু আর ফুপাতো ভাইবোনদের হাসি-ঠাট্টার মাঝে হেমা নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। দুজন ফুপাতো বোন তাকে সাজানোর কাজে ব্যস্ত। তবু কেন যেনো তার মনে হচ্ছে শ্বাস আটকে আসছে। স্বস্তি আর শান্তির অনুভব যেন একমাত্র একজনের মধ্যেই। তার কাছেই নিজেকে উজাড় করা যায়। মনে পড়ছে প্রতিটি মুহূর্তেই। এমন সময় মাসুমা বেগম এসে উপস্থিত হলেন। হেমার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বললেন,

-“খাইয়া ল, পোলা বাড়ির মানুষ আইলে খাইতে পারবি না।”

হেমা হাসলো। খেয়ে নিলো যত্নে মুখে তুলে দেওয়া খারাপ নীরবে। সাথে মাসুমা বেগম একটি ফাইল হেমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-“এই ধর তোর হক! এটায় এই বাড়ির দলিল আছে। অনেক বছর সামলায় রাখছি তোর আমানত।”

হেমা বললো, – “দাদি… আমি এসব বুঝি না তুমি মাশুককে দিও। আমি হারিয়ে ফেলবো।”

গতকাল ফোন এনে দিয়েছিল মাশুক। রাতভর শিখিয়েছে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়ে। হেমা ফোন তুললো। টুকটুক করে মেসেজ লিখলো বেশ সময় নিয়ে,

-“ কখন আসবে?”

জবাব এলো, “কেনো ভালো লাগছে না সেখানে?”

-“আমি তোমাকে মিস করছি…”

মাশুক বিছানায় আরাম করে শুয়ে হাসলো। আর কোনো জবাব দিলো না। একটু নাহয় অপেক্ষা করুক। অধিরতা বাড়ুক তার জন্য। ঠিক তখনই শান্তনু তার স্ত্রী আর মাকে নিয়ে হাজির। তাগাদা দেওয়া শুরু করলো মাশুককে। তৈরি হতে। বললো,

-“তোর শ্বশুরের সাদা পাঞ্জাবি একদম তোর মাপমত ফিটিং করিয়ে এনেছি। দেখ ঠিকঠাক হয় নাকি।”

মাশুক পাঞ্জাবি হাতে নিলো,- “পুলিশ থেকে দর্জির কাজ শিখলি কবে?”

-“আমাদের সব পারতে হয়”

ততক্ষণে মাশুক পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো নিজেকে। ঠিকঠাক হয়েছে একদম শুধু একটুখানি লম্বা। হয়তো তিনি তার সময় অনেক লম্বা ছিলেন। শান্তনু বললো,

-“তোর শ্বশুরের চয়েস বলতেই হয়, মনেই হচ্ছেনা আগের পাঞ্জাবি। একদম লেটেস্ট”

অনবরত হেমা মেসেজ করে যাচ্ছে। মাশুক কোনো জবাব দিলো না। বাকিদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।সাথে আসেনি শুধু মৃদুল এবং রিমা। অল্প কয়েকজন মানুষের সাথে ছোটখাটো বরযাত্রী হেমার বাড়িতে এসে পৌঁছায়। বউ লাজুক হতে হয়, অথচ গাড়ির শব্দ পেয়ে হেমা লাফিয়ে বেরিয়ে এলো। মাশুকের নজর গেলো হেমার দিকে। হুট করেই কদম জোড়া থামলো যেনো একগুচ্ছ গোলাপ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।সুন্দর, মোহনীয়।

আনমনে বললো,- “কিভাবে বিশ্লেষণ করবো নতুন তোমাকে?”

বলেও থেমে যায়। চোখ নামিয়ে নেয়। আশপাশে মুরব্বী মানুষজন। নির্লজ্জের মত চেয়ে থাকা উচিত নয়। হেমা সবার কাছে এসে বললো,

-“এত দেরি করলে কেনো?”

মাশুক চোখ তুললো না। শান্তা বেগম হেমাকে নিয়ে গেলো। সোফায় বসিয়ে দেওয়া হলো দুজনকেই একত্রে। ছেলের লজ্জা ভাবটা খুব ভালো করেই বুঝছেন। সকলের আলোচনার মাঝে মাশুক ধীর কণ্ঠে ছটফট করতে থাকা হেমাকে বললো,

-“বউকে শান্ত থাকতে হয়, লজ্জা পেতে হয় আর তুমি বসে বসে ছটফট করছো।”

হেমা মুখ ঘুরিয়ে বলে, – “আমারতো লজ্জা লাগছে না।”

মাশুক এবারের মত থেমে গেলো। কপালে হাত রেখে মুখে তালা দিলো। মেয়ের কণ্ঠের জোর যেনো বেড়ে গেছে। মান সম্মান বাঁচাতে চুপ থাকাই শ্রেয়। কাজী সাহেবকে ডাকা হয়েছে এখানে। কারণ কেউই জানে না। বিয়ে তো আগেই হয়েছে তাহলে তার কাজ কি? মাশুক এবং শান্তনু তার সাথে আলাদাভাবে কথা বললো। তাকে আপ্যায়ন করে বিদায় দিয়ে দিলো।

রাতের নীরবতা ভেদ করে বিদায়ের ক্ষণ এসে উপস্থিত। সন্ধ্যার মিষ্টি স্মৃতি সবার হৃদয়ে ছাপ ফেলেছে। হেমাকে বিদায় জানাতে গিয়ে মাসুমা বেগমের চোখে জল চিকচিক করে উঠলো, যেন তার ছোট্ট মেয়েটিকে প্রথমবারের মতো তুলে দিচ্ছেন তার জীবনের সবচেয়ে আপনজনের হাতে। মাশুকের দিকে বাড়ির দলিল বাড়িয়ে দিতে চাইলে, মাশুক শান্ত কণ্ঠে তা ফিরিয়ে দিলো। বলল,

-“হেমার অধিকার হেমারই। সে চাইলে নিজেই নেবে। আমি তার প্রাপ্য নিজের হাতে তুলে ঋণী হতে পারি না। বরং আপনি নিজের কাছেই যত্নে রাখুন। হেমার যখন এসব দলিল বুঝবার বোধ হবে তাকে দিয়েন।”

মাশুকের ঘরের নকশা কখন বদলেছে, হেমা জানে না। নিশ্চয়ই এটি শান্তনুর কাজ। তাই তো বিদায়ের সময় তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। পুরো ঘরজুড়ে ফুলের মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে আছে, এক স্নিগ্ধ অনুভূতি। মালা বলেছিল, যেন এখানেই বসে অপেক্ষা করে মাশুকের জন্য। কিন্তু হেমা স্থির থাকতে পারলো না। এতক্ষণ বসে থাকা কি সম্ভব? মাশুক এসে যদি তাকে এভাবে দেখে? হঠাৎ করেই হেমা বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো।পেট গুলিয়ে এলো তার। বুকের ভেতর অস্বস্তি জমাট বাঁধছে,অস্থির লাগছে কেমন যেনো। মনে হলো, বারান্দায় দাঁড়ালে হয়তো শান্তি পাবে।

আচমকা শীতল স্রোত বয়ে গেলো সর্বাঙ্গ জুড়ে।মাশুকের থুতনি এসে ঠেকেছে হেমার কাঁধে। হাতজোড়া সম্পূর্ণ পেঁচিয়ে আছে তাকে। উষ্ণ নিঃশ্বাসের সহিত গভীর গলায় প্রশ্ন এলো,

-“এখানে কেনো?”

হেমার নিঃশ্বাস আটকে ছিলো। মিয়ে কণ্ঠে জবাব দিলো,

-“অস্থির লাগছিলো।”

মাশুক চুলে মুখ গুঁজে দিয়ে বললো,

-“এখন?”

-“আরো অস্থির লাগছে…”

-“তোমারতো বউ সাজবার শখ ছিল। এখন তাহলে এই অস্থিরতা কেনো? আগেও বহুবার তোমায় জড়িয়ে ধরেছি, কই তখনতো এমন কিছুই হয়নি?”

মাশুক হেমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে চুমু খায়।পরপর হাতের পিঠে।লম্বাটে নিঃশ্বাস ফেলে চোখে চোখ রেখে বললো,

-“আমাদের বিয়ের দিন শর্ত লিখেছিলাম। তুমি যদি কখনও আমাকে ছেড়ে যেতে চাও তাহলে তুমি সেই স্বাধীনতা পাবে। আমি সেই শর্ত শর্ত তুলে নিচ্ছি, নিয়েছি। তোমার স্বাধীনতা হরণ করছি। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলেও পারবে না, বন্দিনী করা হলো তোমাকে।”

-“এটা কি ঠিক হলো?” হেমা মৃদু হেসে প্রশ্ন ছুঁড়ে।

-“তাহলে শোধ দাও। আমি এখন স্বার্থবাদীর মত শোধ চাইবো যদি আমার কারাগার থেকে মুক্তি চাও তাহলে তোমার পেছনে দেওয়া সব সময় আমি ফেরত চাই, আমার ধৈর্যের মূল্য চাই, তোমার প্রেমের রোগে ভুগতে থাকা হৃদয়ের পূর্ণ নিরাময় চাই। দিতে পারলে চলে যেও।”

হেমা জবাবে বলে উঠে,- “যাবো না, বন্দিনী হয়েই থাকবো।”

মাশুক হেমার গ্রিবাদেশে মুখ গুজে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,- “তোমার রূপকে আমি সংজ্ঞায়িত করতে পারছি না।মস্তিষ্ক শূন্য,আর মুখ শব্দহীন। ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে তোমায়। ধৈর্য চূর্ণবিচূর্ণ হতে চাইছে। স্বস্তি দাও আমায়।”

দীর্ঘ খরার পরে হৃদয়ের জমিনে অবশেষে নামল শান্তির বৃষ্টি। মাশুক সযত্নে আবদ্ধ করেছে হেমাকে।ভালোবেসে লুকিয়ে ফেলেছে বাহু তলে। তার চোখের কোণে লুকানো অশ্রুবিন্দু এক বিনম্র স্পর্শে শুষে নিল। নতুন আশার আলোয় ঝলমল করে উঠলো তাদের জগৎ । তাদের গল্প হবে নতুন, উদ্ভাসিত এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। হিমালয়ের বরফ শীতল হিমাদ্রিণীতে বুদ হয়ে থাকা মাশুকের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো,

-“জীবনের শেষ অবধি তোমার সঙ্গ চাই। তুমি পূর্ণ অথবা অপূর্ণ হও না কেনো। তোমার ভাগের দুঃখ আমার হোক। তুমি শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শীতল শৃঙ্গের ন্যায় হও।”

______

মৃদুলের ঘর আজ খুশির আলোয় ঝলমল করছে; তাদের কোল জুড়ে এসেছে এক কন্যা সন্তান। মৃদুলের বাবা-মায়ের চেয়েও বেশি যেনো হেমার আনন্দ। ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নেবার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছে সে। কিন্তু মৃদুল শিশুটিকে হেমার কোলে না দিয়ে মাশুকের দিকে এগিয়ে দেয়।মাশুকের হাত হঠাৎ কেঁপে ওঠে, তার চোখজোড়া অদ্ভুতভাবে নিষ্পলক। মৃদুল তখন মায়ের দিকে চেয়ে নিচু কণ্ঠে বলে ওঠে,

-“মা, তুমি ওকে নাও, আমি একটু পরে আসছি।”

মৃদুল বললো,- “ওর বউকে দেইনি বলে আমার মেয়েটাকে ছুঁয়েও দেখলো না”

মাশুক শীতল দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকায়, -“ভাইয়া আমার এই ছোট্ট প্রাণের প্রতি কোনো রাগ নেই। আমি কিছু সময় একা থাকতে চাচ্ছি, তাই আরকি….”

মাশুক নিঃশব্দে করিডোরের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালো। চোখে ভাসছে হেমার মন খারাপ করা মুখটা। হৃদয়ে কেউ যেনো ছুরি চালালো।দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এবং ট্রমা সরাসরি হেমার হাইপোথ্যালামাসের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেছে। হাইপোথ্যালামাস মস্তিষ্কের একটি অংশ যা প্রজনন হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে। মানসিক চাপের কারণে হাইপোথ্যালামাসের কার্যক্রম ব্যাহত।পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে যথাযথ হরমোন নিঃসরণ ও ছয় বছর যাবত পিরিয়ড সম্পূর্ণ বন্ধ। আকাশের দিকে চেয়ে মন বললো,

-“আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে? জীবন কেনো সম্পূর্ণ সমস্যাবিহীন হয়না?”

মৃদুলের মেয়ের মুখটা কল্পনা করছে বারবার। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। হাতে টান পড়ে। হেমা এসেছে।মাশুকের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মাথা রাখলো তার বলিষ্ঠ বাহুতে। নাক টেনে বললো,

-“আমি কি বাবুকে ব্যথা দিতাম বলো? আমার কোলে কেনো দিলো না? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি কি এত খারাপ? বিশ্বাস করো আমি ওকে ব্যথা দিতাম না।”

জবাব এলো না মাশুকের তরফ থেকে। হেমার নীরব আর্তনাদ হৃদপিণ্ডে এসে বিধছে। এরপর কি কথা আসতে পারে সেটাও মাশুক জানে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে চেনে হেমাকে। হেমা বললো,

-“আমরাও একটা বাবু নিয়ে আসি, ওকে কোলে নিবো।”

মাশুকের চোখ ভেঙে পড়ে অশ্রু জল। চোখের পাপড়ি ভিজিয়ে দিলো। হেমা মগ্ন আকাশের দিকে। অন্যহাতে চশমা খুলে চোখ মুছে নেয়। হেমাকে জানতে দেওয়া যাবেনা কিছুতেই। একাই বহন করতে হবে সবকিছু। আবার কোনো ট্রমাতে ফেলতে চায় না হেমাকে।

হেমা আবার বললো, -“বলো না,আমরা আনবো একটা বাবু?”

কিছু পেয়েছে আবার অনেককিছুই হারিয়েছে। সব দুঃখ কাটিয়ে সুখের মুখ দেখার সাথেসাথে নতুন কোনো দুঃখ না এলেই পারতো। বুকের চাপা ব্যথা পাশে রেখে মাশুক হেমার দিকে চেয়ে বললো,

“আমাদের মাঝে তৃতীয় কেউ আসবে না। আমাদের ভালোবাসার পরিধি হবে অবিভাজ্য। আমরা একসঙ্গে বৃদ্ধ হবো, জীবনের প্রতিটি অধ্যায় পার করবো হাতে হাত রেখে। এ হৃদয়ের অধ্যায়ে শুধু আমরা দুজনেই রয়ে যাবো।অনন্তকাল, চিরকাল।”

সমাপ্ত~