#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪০)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৯৯)
বেশ লম্বা সময় ধরে জার্নি করার পর তাহির চৌধুরী মেনশনের মূল গেইটের পাশে এসে গাড়ি দাড় করিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে হুমায়রা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে গিয়েছে। অতঃপর তাহির আর হুমায়রাকে জাগানোর চেষ্টা না করে গাড়ি থেকে নেমে চৌধুরী মেনশনের মূল গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই নিজের চারপাশের পরিবেশটা রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারে আজ কোনো কারণে চৌধুরী মেনশনে আনন্দের মেলা জমেছে।
তাহির তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ধীরপায়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। একদিকে ভালোবাসার মানুষটিকে হারানোর বেদনায় এক প্রেমিক পুরুষের কলিজা পু*ড়ে ছা*ড়*খা*ড় হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে সেই মানুষটি বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা ছাড়াই শত শত মানুষের মাঝে আনন্দ মেলায় মেতে আছে। আহা প্রকৃতি কতোই না নিপুনতার সাথে নিজ কাজ সম্পন্ন করে যাচ্ছে। লোকজনের টুকটাক আওয়াজ কানে পড়তেই তাহির সেদিকে যেতে শুরু করে। পরক্ষণেই চৌধুরী মেনশনের পিছন সাইডে এসে দাঁড়াতেই শতশত মানুষের উপস্থিতিতে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ দেখতে পায় সে।
এই শতশত মানুষের ভিড়ে তাহিরের দু’চোখ শুধু একজনের মায়া মাখানো মুখশ্রী দেখার জন্য ছটফট করছে। তাহির যেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তার পাশেই ছোট্ট একটা স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র রাখা আছে। সেই স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে একজন মধ্যবয়সের পুরুষ লোক কারোর সাথে কলে কথা বলছে…..
—“আপনি এসব কি বলছেন মি.সায়মন হাসান! এই শেষ মুহূর্তে এসে আমি আরেকজন গায়কের ব্যবস্থা করবো কি করে? চৌধুরীদের থেকে ইতিমধ্যে আমি অর্ধেকের বেশি টাকা নিয়ে নিয়েছি। এখন এই অনুষ্ঠান পর্বে আপনার অনুপস্থিতির জন্য পুরো এরেঞ্জমেন্টই ন*ষ্ট হয়ে যাবে এটা আপনি বুঝতে পারছেন না কেনো?”
ফোনের ওপাশ থেকে সায়মন হাসান বললেন….
—“আই এম সরি মি.ইকবাল আকন্দ। পারসোনাল কিছু সমস্যার কারণে আমাকে শেষ মূহুর্তে এসে এই প্রোগ্রামটা কে*ন্সে*ল করতে হলো। আপনি যেকোনো ভাবে অন্য আরেকজন গায়কের ব্যবস্থা করে নিন। আমি এখন রাখছি।”
এই বলে সায়মন হাসান কল রেখে দেন। ইকবাল আকন্দের কপালে চিন্তার ভাঁ*জ স্পষ্ট হয়। কি করবে ভেবে না পেয়ে স্টেজের পাশে তাহিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে ইকবালের। ইকবাল মনে মনে ভাবলেন…..
—“এই ছেলেটাকে কোথায় যেনো দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছে আমার। কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে না কেনো?”
পরক্ষণেই ইকবাল ওর ফোনটা দিয়ে লুকিয়ে তাহিরের একটা ছবি তুলে গুগোলে প্রবেশ করে সার্চ অপশনে ছবিটি আপলোড করতেই কয়েক সেকেন্ডের ভিতর তাহিরের শত শত ছবি বেড়িয়ে আসে। তাহিরের ছবিগুলো দেখামাত্র ইকবাল চোখ বড়বড় করে তাহিরের দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললেন…..
—“২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরষ্কার লাভকৃত তওকির তালুকদার তাহির স্বয়ং চৌধুরী পরিবারের অনুষ্ঠান পর্বে উপস্থিত হয়েছেন! এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি লাভ হওয়ার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। এখন যেভাবেই হোক উনাকে আজকের অনুষ্ঠান পর্বে গান গাওয়ার জন্য রাজি করাতেই হবে আমায়। নয়তো চৌধুরীদের হাত থেকে নিজের প্রাণ বাঁচানোর আর কোনো রাস্তা আমার জন্য খোলা থাকবে না।”
এই বলে ইকবাল আকন্দ তাহিরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“এক্সকিউজ মি স্যার!”
তাহির ইকবালের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললো…
—“জ্বি..আমাকে বলছেন?”
—“জ্বি স্যার।”
—“হুম…বলুন!”
—“আমি আপনার গানের অনেক বড় ভক্ত স্যার। আগে আপনার গান অনেকবার শুনেছি আমি। কিন্তু গত ৫ বছর যাবৎ কোনো অনুষ্ঠান পর্বে আপনাকে গান গাইতে দেখি নি। এমনকি আপনার প্রোফেশনাল গানের পেইজেও কোনো নতুন গান রিলিজ হয় নি। তার কারণ আমি জানতে চাইছি না। কিন্তু আমি এই মুহূর্তে খুব বড় একটা সমস্যার মধ্যে ফেঁ*সে গিয়েছি স্যার। এই সমস্যা থেকে আমাকে একমাত্র আপনিই উদ্ধার করতে পারবেন স্যার।”
ইকবালের এরূপ কথা শুনে তাহির কিছুটা অবাক হয়ে বললো….
—“আমি কিভাবে আপনাকে সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে পারবো?”
—“আমি বড় বড় গায়কদের তাদের বাজেট অনুযায়ী টাকা দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ভাড়া করে নিয়ে আসি। সেখান থেকে যে স্বল্প পরিমাণ আয় হয় তা দিয়েই আমার সংসারের খরচ চালাতে হয়। আজ চৌধুরী পরিবারের বড় ছেলের স্ত্রী প্রেগন্যান্ট হওয়ায় এই আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন চৌধুরীরা। তাই সকালে আমাকে কল করে একজন ভালো গায়ককে আজকের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ইনভাইট করে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। আমি তাদের কথানুযায়ী বিশিষ্ট গায়ক মি. সায়মন হাসানকে ইনভাইট করেছিলাম। কিছুসময় পূর্বে সায়মন হাসান আমাকে কল করে বললেন উনি আজকের এই প্রোগ্রামে গান গাইতে আসতে পারবেন না। এদিকে আমি চৌধুরীদের থেকে অর্ধেকের বেশি টাকা নিয়ে আমার মেয়ের বিয়ের গহনা বানাতে স্বর্ণকারের কাছে জমা করে এসেছি। তাই এই শেষ মূহূর্তে এসে দাঁড়িয়ে এতোগুলো টাকা চৌধুরীদের ফিরিয়ে দিয়ে প্রোগ্রাম কেন্সেল করার কথা বলার সাহস ও আমি করে উঠতে পারছি না। তাই আপনি যদি দয়াকরে আজকের এই অনুষ্ঠান পর্বে মাত্র একটা গান গেয়ে দিতেন তাহলে চৌধুরীদের সামনে আমার সম্মানটা রক্ষা হতো স্যার। সারাজীবন আপনার এই ঋণ আমি মনে রাখতাম।”
দীর্ঘ ৫বছর পর আবারও কারোর আকুল কন্ঠে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে শুনে তাহির কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়। একদিকে তাহিরের মন-মানসিকতার অবস্থা ভালো না অন্যদিকে এতো বছর ধরে গান না গাওয়ায় ওর গানের কন্ঠ, সুর ও তাল ধরার ক্ষমতা যে ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে গিয়েছে এমনটাই তাহির ধারণা করতে পারছে। বেশ কিছুসময় পেরিয়ে গেলেও তাহিরের কোনোরূপ রেসপন্স না পেয়ে ইকবাল আবারও বললেন…..
—“স্যার….আপনি তো হ্যা বা না কিছুই বলছেন না। তাহলে আমি আপনার নিরাবতাকেই সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নিলাম!”
এই বলে ইকবাল তাহিরকে আর কোনোরূপ কথা বলার সুযোগ না দিয়েই স্টেইজ পাশে থাকা ছোট টেবিলের উপর থেকে মাউথ স্পিকারটা হাতে নিয়ে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন……
—“হ্যালো….হ্যালো….হ্যালো….লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যানস! চৌধুরী পরিবারে নতুন সদস্য আসার খুশিতে আজকের আয়োজিত এই পার্টিতে আপনাদের সকলের উপস্থিতি খুশির মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। তাই এই আনন্দময় পরিবেশের মাঝে খুশির মাত্রা আরো বাড়িয়ে তুলতে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী মি. তওকির তালুকদার তাহির। ওনার সুমধুর কন্ঠে একটি সুন্দর গান শোনার জন্য আপনারা প্রস্তুত তো!”
ইকবালের বলা কথা শুনে উপস্থিত সকলের মাঝে তাহিরের কন্ঠে গান শোনার জন্য উৎফুল্লতার মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এই পরিস্থিতি থেকে গান না গেয়ে বের হয়ে আসা তাহিরের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অগত্যা আর কোনো উপায় না পেয়ে তাহির একপ্রকার বাধ্য হয়েই স্টেজে উঠে মাইকের সামনে বসে পাশে থাকা স্ট্যন্ডের উপর থেকে গিটারটা হাতে তুলে নিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে গিটারের দিকে তাকিয়ে রয় কিছুসময়। অতঃপর তাহির গিটারে সুর তুলে গাইতে শুরু করে……..
❝বড় ইচ্ছে করছে ডাকতে ,
তার গন্ধে মেখে থাকতে ,
কেনো সন্ধ্যে সন্ধ্যে নামলে সে পালায়?
তাকে আটকে রাখার চেষ্টা ,
আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তেষ্টা ,
আমি দাঁড়িয়ে দেখছি শেষটা জানলায়।
বোঝেনা সে বোঝেনা (৪বার)
বোঝেনা (৬বার)❞
(১০০)
গানের স্টেইজ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকজন কম বয়সী মেয়ের সাথে গল্প করছিলো তরুনিমা। সেইসময় বেশ পুরোনো পরিচিত কারোর কন্ঠে গাওয়া গানের আওয়াজ ভেসে আসায় তরু গানের স্টেইজের দিকে তাকায়। স্টেইজের সামনে অনেক মানুষের ভীর হওয়ায় তরু তাহিরের চেহারা দেখতে পারছে না। ভীর ঠেলে ধীরপায়ে একটু একটু করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তরুনিমা। তরুর হৃৎস্পন্দনের গতি অজানা কারণে স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বেড়ে গিয়েছে, যার কারণ এই মুহূর্তে জানা নেই তরুর।
❝পায়ে স্বপ্ন স্বপ্ন লগ্নে ,
তার অন্য অন্য ডাকনাম ,
তাকে নিত্য নতুন যত্নে কে সাজায়?
সব স্বপ্ন সত্যি হয় কার!
তবু দেখতে দেখতে কাটছি ,
আর হাঁটছি যেদিক আমার দু’চোখ যায়।
বোঝেনা সে বোঝেনা (৪বার)
বোঝেনা (৬বার)❞
(১০১)
হুমায়রার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে চোখ মেলে সামনে তাকাতেই দেখে ওদের গাড়িটা কোথাও থামানো অবস্থায় আছে। গাড়ির ভিতরে তাহির নেই। হুমায়রা আন্দাজ করে তাহির হয়তো তরুনিমার সাথে দেখা করার জন্য চৌধুরী মেনশনে এসেছে। হুমায়রা তড়িৎগতিতে গাড়ি থেকে নেমে সামনে লক্ষ্য করতেই মূল গেইটের পাশে বড় বড় অক্ষরে ‘চৌধুরী মেনশন’ লেখা দেখতে পায়। ওর আন্দাজই সঠিক হয়। হুমায়রা নিজের মধ্যে কাজ করা সব সংকোচ বোধকে দূরে সরিয়ে চৌধুরী মেনশনের মূল গেইট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সেইসময় চৌধুরী মেনশনের পিছন সাইড থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসে। তাহিরের কন্ঠ চিনতে হুমায়রার ভুল হয় না। হুমায়রা একমুহূর্তের জন্য না দাঁড়িয়ে ছুট লাগায় সেদিকে।
.
.
.
তরুনিমা একেবারে স্টেইজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাহিরের দিকে তাকিয়ে পুরোপুরি ভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়। এতোবছর পর নিজের শ্বশুড় বাড়িতে তাহিরের উপস্থিতি দেখে তরুনিমা অবাক না হয়ে পারে না। তরুনিমার থেকে কয়েকহাত দূরে হুমায়রাও অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহির ওর দু’চোখ বন্ধ রেখে গান করছে…..
❝এটা গল্প হলেও পারতো ,
পাতা একটা-আধটা পড়তাম ,
খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখতাম তাকে।
জানি আবার আসবে কালকে!
নিয়ে পালকি পালকি ভাবনা ,
ফের চলে যাবে করে একলা আমা…….!❞
.
.
.
তাহিরের গান গাওয়া শেষ হওয়ার পূর্বেই তরুনিমা উচ্চস্বরে বলে উঠলো….
—“বন্ধ করুন এই গান গাওয়া।”
উপস্থিত সকলেই তরুর দিকে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাহির চোখ মেলে তাকাতেই নিজের সামনে বহুবছর পর নিজের না হওয়া প্রিয় মানুষটিকে রুক্ষমূর্তি রূপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় না। তরুনিমা তো এখনও আসল সত্যটা জানে না যে তাহির ওর বড় বোন অরুনিমাকে খু*ন করে নি। তাই এখন তাহিরকে নিজের চোখের সামনে দেখে তরুনিমার রেগে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ……….
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪১)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১০২)
তরুনিমা অত্যন্ত রাগ নিয়ে উচ্চস্বরে তাহিরকে উদ্দেশ্য করে বললো……
—“আপনার সাহস হলো কি করে আমার শ্বশুড় বাড়িতে এসে গান গাওয়ার?”
তরুনিমাকে এভাবে রিয়েক্ট করতে দেখে উপস্থিত সকলেই যেনো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। সকলের মাঝে কানাঘুঁষা শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কুশল কারোর সাথে ফোনে কথা বলছিলো। সেইসময় সকলের হালকা শোরগোলের আওয়াজ কুশলের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছালে সে কল কেটে দিয়ে ঐদিকে পা বাড়ায়। হুমায়রা তরুর দিকে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। তাহির গিটারটা স্ট্যন্ডের উপর রেখে বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতেই তরুনিমা দ্রুত পায়ে স্টেইজের উপরে উঠে তাহিরের শার্টের কলার্ট চেপে ধরে ওকে টানতে টানতে স্টেইজ থেকে নিচে নামিয়ে আনে। তাহির তরুনিমার এমন কাজে কোনোরূপ রিয়েক্ট না করে তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে মাত্র। দীর্ঘ সময় পর তরুনিমাকে দেখার সুযোগ পেয়ে তাহিরের তৃষ্ণার্ত দু’চোখে ও মনে যেনো স্বস্তি কাজ করছে। তরুনিমা রাগী স্বরে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো…..
—“আপনাদের সকলের প্রিয় বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী মি.তওকির তালুকদার তাহিরের যে আরো একটা বিশেষ পরিচয় আছে সে সম্পর্কে হয়তো আপনারা কেওই অবগত নন। সেই পরিচয় সম্পর্কে আপনারা অবগত হলে ওনার গাওয়া গান গুলোকে এবং ওনাকে সবাই ঘৃ*ণার চোখে দেখবেন তাই আপনাদের থেকে সম্পূর্ণ সত্যটাকে লুকিয়ে নিজের ফেম ধরে রেখেছেন উনি। কিন্তু এতোবড় একটা সত্যকে লুকিয়ে রেখে ওনাকে সকলের সামনে সম্মানের সহিত হাসি-খুশি ভাবে চলাফেরা করতে দিতে তো আমি পারবো না। আজ সকলের সামনে ওনার মু*খো*শ আমি খুলেই ছাড়বো।”
কুশল ভির এড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। তরু আবারও বললো…..
—“এই জ*ঘ*ন্য লোকটার লুকানো পরিচয়টা হলো উনি একজন খু*নি। আমার বড় বোন অরুনিমা সিকদারকে ৫বছর আগে খুবই ক*রু*ণ ভাবে খু*ন করার অ*প*রা*ধে উনাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু আফসোসের কারণ এটা দাড়িয়েছে যে উনার মতো নি*কৃ*ষ্ট মানসিকতার একজন খু*নি*কে আইন ফাঁ*সি*র শাস্তি না দিয়ে মাত্র ৫বছরের জন্য জে*ল বন্দী করেছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়া মাত্রই এই জ*ঘ*ন্য ব্যক্তিটি আবারও আমার চারপাশে ঘুরঘুর করতে শুরু করেছে। হয়তো আবারও আমার থেকে কোনো খুব প্রিয় মানুষকে মে*রে ফেলে আমাকে য*ন্ত্র*ণা দিতে চাইছে।”
তরুনিমা এমন কথায় উপস্থিত সকল অতিথিরা ও চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা যেনো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন। সেইসময় কুশল তরুর সামনে দাড়িয়ে ওর দু’কাধে দুই হাত রেখে শান্ত স্বরে তরুকে উদ্দেশ্য করে বললো…
—“তরুনিমা….নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করো।”
—“আপনি সরুন আমার সামনে থেকে। এই লোকের উপর আমার চরম রাগ ও ঘৃ*ণা জমে রয়েছে। এনাকে চোখের সামনে জিবীত অবস্থায় দেখে আমার সর্বশরীর ঘৃ*ণা*য় রি রি করে উঠছে। ইচ্ছে তো করছে এই মুহূর্তে এই নি*কৃ*ষ্ট লোকটাকে নিজের হাতে খু*ন করি।”
এই বলে তরুনিমা কুশলের বুকে হালকা ধা*ক্কা প্রয়োগ করে ওকে নিজের সামনে থেকে সরাতে নিলে কুশল সকলের সামনেই তরুনিমা নিজের বুকের সাথে খুব শক্ত বাঁধনে আবব্ধ করে ফেলে। তরুনিমা তবুও ছোটার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। নিজের প্রিয় মানুষটিকে অন্য পুরুষের বুকে আবব্ধ হয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হতে দেখে তাহিরের বুকের ভিতরটা মো*চ*র দিয়ে উঠে। তবুও নিজেকে সামলে নিতে তাহির ওর ঠোঁটে এক চিলতে মি*থ্যে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে নিঃশব্দে স্থান ত্যগ করতে মূল গেইটের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তাহিরকে চলে যেতে দেখে হুমায়রাও তাহিরের পিছন পিছন যেতে শুরু করে। কিছুটা পথ অগ্রসর হতেই হঠাৎ ঝোঁপের আড়াল থেকে দু’জন অগ্যাত ব্যক্তির মাঝে কুশলকে নিয়ে কথপোকথন শুনতে পেয়ে তাহির সেখানেই থেমে যায়। ভ্রু কুঁচকে ঝোপের পাশে থাকা বট গাছটির আড়ালে লুকিয়ে অগ্যাত লোক দু’টির কথোপকথনগুলো স্পষ্ট ভাবে শোনার চেষ্টা করে তাহির।
সেইসময় হুমায়রা সেখানে এসে দাঁড়াতেই নিজের আশেপাশে তাহিরকে দেখতে না পেয়ে অবাক স্বরে বললো…
—“আশ্চর্য তো….মুহূর্তের মধ্যেই কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো! নিজের প্রেমিকাকে অন্য পুরুষের সংস্পর্শে দেখে কঠিন ভাবে শো*কা*হত হয়ে গিয়ে কোথাও আমাকে এখানে ফেলে রেখেই চলে গেলো না তো তাহির! গাড়িতে গিয়ে দেখি আগে।”
এই বলে হুমায়রা চৌধুরী মেনশনের মূল গেইটের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ঝোপের আড়ালে থাকা অগ্যাত দু’জন ব্যক্তির মাঝে একজন বলে উঠলো….
—“অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব প্রায় শেষ। একটুপর সকল অতিথিরা চলে গেলে চৌধুরী পরিবারের সকলে যখন খাবার খেতে বসবে তখন আমি সুযোগ বুঝে কুশল চৌধুরীর খাবারের ভিতর এই বি*ষা*ক্ত ঔষধীটি মিশিয়ে দিবো। এই ঔষধীটি এতোটাই বি*ষা*ক্ত যে একবার কুশল চৌধুরী শরীরের চলে গেলে ১ঘন্টার মধ্যে ওর সর্বশরীর বি*ষে গাড় নীল হয়ে যাবে। আর তখন কুশল চৌধুরীকে বাঁচানো কোনো ডাক্তারের দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠবে না। তুমি ততোক্ষণে পার্কিং সাইডে থাকা সবকয়টা গাড়ির দুইটা করে টায়ার পাংচার করে দেওয়ার কাজটা সম্পন্ন করো। যেনো কুশল চৌধুরীর অবস্থা সমীচীন হতে দেখে কেও ই তাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যেতে না পারে।”
এই কথা বলে লোক দু’জন ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে যায়। তাহির আপনমনে বিড়বিড়িয়ে বললো….
—“তরুনিমার স্বামীর নাম তো কুশল চৌধুরী। এই দু’জন ওনাকে মা*রা*র এতো বড় পরিকল্পনা করেছে। আমাকে এই মুহূর্তে গিয়ে ওদের সকলকে সাবধান করে দিতে হবে নয়তো অনেক বড় ক্ষ*তি হবে যাবে। তরুনিমার নতুন জীবন এতো সহজে শে*ষ হয়ে যেতে দিতে পারি না আমি।”
এই বলে তাহির আবারও বাগানের পিছন সাইডের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। পকেট থেকে মাস্ক আর সানগ্লাসটা বের করে পড়ে নেয় যেনো হু*ট করে তরুনিমার চোখে পড়ে গেলে আবারও কোনো সিনক্রিয়েট না হয়। কিছুসময়ের মধ্যে সকল অতিথিরা খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। ওয়েটারের পোশাক পরিহিত একজন ব্যক্তি খাবার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক একপলক তাকিয়ে পকেট থেকে সেই বি*ষা*ক্ত ঔষধীর বোতলটা বের করে একটা খাবারের প্লেটে ঢেলে দেয়। দূর থেকে তাহির তা লক্ষ্য করে। সেইসময় চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্যরা খাবার টেবিলের কাছে এসে বসে পরে। বি*ষা*ক্ত ঔষধী দেওয়া খাবারের প্লেটটি যেই চেয়ারে সামনে রাখা ছিলো সেই চেয়ারে তরুনিমাকে বসতে দেখে তাহির আর নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দ্রুত কদমে খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে তরুনিমার প্লেটটি ছু*ড়ে নিচে ফেলে দিয়ে বললো….
—“এই খাবারের ভিতর বি*ষা*ক্ত ঔষধী মেশানো আছে।”
আকস্মিক তাহিরের এমন কাজে উপস্থিত সকলে অত্যন্ত অবাক হয়ে বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তরুনিমার পাশের চেয়ারেই কুশল বসে ছিলো। কুশল বললো….
—“বি*ষা*ক্ত ঔষধী? কি বলছেন কি আপনি?”
তাহির বললো….
—“আমি এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় বাগানের সামনের দিকে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দু’জন ব্যক্তিকে কুশল চৌধুরীর খাবারে বি*ষা*ক্ত ঔষধী মিশিয়ে তাকে মে*রে ফেলার পরিকল্পনা করতে শুনেছিলাম। পরক্ষণেই সব অতিথিরা চলে যেতেই একজন ওয়েটার এসে ঐ খাবারের প্লেটে বি*ষা*ক্ত ঔষধী মিশিয়ে দিয়েছিলো। আমি ওয়েটারটিকে ধরার পূর্বেই আপনারা এখানে চলে আসায় সে চোখের আড়া…..!”
তাহির পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই তরুনিমা স্বজোরে তাহিরের গালে একটা থা*প্প*ড় দেয়। আকস্মিক তরুনিমার এমন কাজে তাহির তাল সামলাতে না পেরে ওদের থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে গালে একহাত রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়। তরুনিমা রাগ নিয়ে উচ্চস্বরে বললো….
—“আমার স্বামীর খাবারে বি*ষা*ক্ত ঔষধী মিশিয়ে তাকে মে*রে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলেন তাই তো যখনি দেখলেন বি*ষা*ক্ত ঔষধী মেশানো খাবারটি আমার স্বামী খেতে না নিয়ে আমি নিয়েছি তখনি ছুটে এসে খাবারের প্লেটটি ছুঁ*ড়ে ফেলে দিলেন। আপনার পরিকল্পনা ব্য*র্থ হওয়ায় নিজেকে নিষ্পাপ প্রমাণ করতে নতুন করে এই নাটকটি সাজিয়েছেন তাই তো! আর কতো নিচে নামবেন আপনি! আপনার উপর থু*তু ফেলতেও ঘৃ*ণা বোধ হচ্ছে আমার।”
আবারও ভু*ল বুঝাবুঝির যাঁতাকলে ফেঁ*সে গিয়ে সকলের সামনে দো*ষী হয়ে দাঁড়াতে হলো তাহিরকে। লজ্জায়, অপমানে তাহিরের চোখ দুটো লাল হয়ে গিয়েছে। যেনো দু’চোখ ফেঁ*টে নোনাজলের পরিবর্তে র*ক্ত বেড়িয়ে আসতে চাইছে।
.
.
.
হুমায়রা গাড়ির কাছে গিয়ে তাহিরকে না পেয়ে আবারও চৌধুরী মেনশনের ভিতরে প্রবেশ করে বাগান বাড়ির পিছন সাইডে খাবারের ব্যবস্থা করা সেই জায়গায় এসে দাঁড়াতেই তাহিরকে গালে হাত রেখে মাথা নিচু অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এখানে উপস্থিত হওয়ায় কি থেকে কি হয়েছে তা বুঝে উঠতে পারছে না হুমায়রা। তাহির কোনোভাবে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে কুশলের পাশে তরুনিমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“আমাকে ভু*ল বুঝতে বুঝতেই জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিলে। আগেও যেমন বুঝেছো এখনও আমার সম্পর্কে তোমার তেমনই ধারণা। তোমার চোখে আমার জন্য এতোটা ঘৃ*ণা আর মুখ দিয়ে ছো*ড়া প্রতিটি বি*ষা*ক্ত বুলি আমার ভিতরটা একটু একটু করে শে*ষ করে দিচ্ছে। তোমার কাছে নিজেকে নির্দোষ কিংবা নিষ্পাপ প্রমাণ করার সাধ্য কখনও আমার হয়ে উঠবে কিনা জানি না। এখানে আসার পিছনে আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো না। ভেবেছিলাম দূর থেকে তোমার খুশিটা শেষ বারের মতো একপলক দেখে নিয়ে আমি নিঃশব্দে এখান থেকে চলে যাবো। কিন্তু আমার ভাগ্য আমার প্রতি এতোটা সহায় হলো না। তাই শেষ দেখার মুহূর্তটুকুতেও তোমার ঘৃ*ণা দেখেই আমাকে স্থান ত্যগ করতে হচ্ছে। সবশেষে এতোটুকুই বলবো, ভালো থেকো নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে। কখনও তাকে ভু*ল বুঝে অবিশ্বাস করো না। কারণ প্রিয় মানুষটি যখন ভু*ল বুঝে অবিশ্বাস করে তখন নিজেকে ভিষণ দূর্বল বলে মনে হয়। তার সামনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার মতো শক্তি ও বুদ্ধিও মাথায় কাজ করে না।”
এই বলে তাহির পিছন ঘুরে কুশলের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই ওদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে সেই ওয়েটারটিকে কুশলের দিকে বন্দুক তাঁক করে রাখতে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ধা*ক্কা দিকে কুশলকে সরিয়ে দিতেই গু*লি*টি এসে তাহিরের বুকে বিঁ*ধে যায়। চোখের পলকে কি থেকে কি হয়ে গেলো তা বুঝে উঠতেও সকলের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। হুমায়রা ‘তাহিরররর’ বলে চিৎকার করে উঠে ওর দিকে ছুটে যায়। কুশল পিছন ঘুরতেই তাহির কুশলের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে। কুশল উচ্চস্বরে বললো…..
—“গার্ডস ধ*রো ওকে, পালাতে যেনো না পারে।”
তরুনিমা স্তব্ধ মুখশ্রী নিয়ে তাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ……..
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪২)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১০৩)
কুশলের পায়ের উপর তাহির লুটিয়ে পড়ে আছে। তাহিরের বুকের বাম পার্শের গু*লি লাগা স্থানটি থেকে অনরগল র*ক্ত পড়তে দেখে কুশলের চোখের সামনে সাদিককে ছু*রি বিদ্ধ হয়ে য*ন্ত্র*ণায় ছ*ট-ফ*ট করার মুহূর্তটি ভেসে উঠে। সাদিকও কুশলকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন ত্য*গ করেছে আর আজ তাহিরেরও যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে কুশল নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। অজানা কারণে কুশলের দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কুশল একবার চোখ বন্ধ করে পরপরই চোখ মেলে তাকিয়ে একজন গার্ডকে উদ্দেশ্য করে চিল্লিয়ে বললো…..
—“দ্রুত গাড়ি বের করো।”
গার্ডটি কুশলের কথানুযায়ী গাড়ি বের করতে চলে যায়। হুমায়রা কাঁদতে কাঁদতে বললো…..
—“তোমার কিছু হবে না তাহির। তুমি শুধু সজ্ঞানে থাকার চেষ্টা করো, চোখ বন্ধ করো না। তাহির…আমার কথা শুনতে পারছো তুমি!”
এই বলে হুমায়রা তাহিরের গালে হালকা ভাবে চা*প*ড় দিতে শুরু করে। পরক্ষণেই গার্ডটি কুশলের কাছে এসে বললো….
—“স্যার পার্কিং সাইডে রাখা আপনাদের সব গাড়ির ২টা করে চাকা কে যেনো পাংচার করে দিয়েছে। আমি দুইজন গার্ডকে নতুন চাকা লাগানোর কাজে নিয়োজিত করে এসেছি। একটু সময় লাগবে কাজটি সম্পন্ন করতে।”
কুশল বুঝতে পারে এটা ওর শ*ত্রু*পক্ষের পূর্ব থেকেই সাজানো কূ*ট*নৈ*তি*ক পরিকল্পনার একেকটি ধাপ মাত্র। হুমায়রা বললো….
—“আপনাদের বাড়ির বাহিরে আমাদের গাড়ি রাখা আছে। আমাদের গাড়িতে করেই তাহিরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন প্লিজ৷”
হুমায়রার এহেনু কথা শুনে কুশল আর একমুহূর্তের জন্য দেড়ি না করে ২জন গার্ডের সহোযোগিতায় তাহিরকে নিয়ে চৌধুরী মেনশনের মূল গেইটের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। হুমায়রাও ওদের সাথে সাথে যায়। এতোসময় ধরে তরুনিমা স্ত*ব্ধ হয়ে একস্থানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কি বলবে, কি করবে কিছুই যেনো সে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তাহিরকে নিয়ে যেতে দেখে তরুনিমাও আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সেও ওদের পিছন পিছন যেতে শুরু করে।
কামিনী নিজের বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে রিজভীকে ফিসফিসিয়ে বললো….
—“বাহিরের কোনো শ*ত্রু*র পক্ষে বাড়ির ভিতর ঢুকে কুশলকে পর পর ২ভাবে মা*রা*র চেষ্টা করা কি আদেও সম্ভব!”
রিজভী স্বাভাবিক মুখশ্রী নিয়েই বললো….
—“সম্ভব জন্যই তো আ*ক্র*ম*ণটি করতে পারলো।”
—“আমার তো মনে হচ্ছে ঘর শ*ত্রু*ই আজ বি*ভী*ষ*ণের রূপ ধারণ করেছে। আর কুশলের আসল শ*ত্রু তো ওর….!”
কামিনী পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই রিজভী কামিনীর দিকে চোখ পা*কি*য়ে তাকায়। যার ফলে কামিনী সেখানে থেমে যায়। পরক্ষণেই সাগরিকা চৌধুরী পরিবারের বাকি সদস্যদের উদ্দেশ্যে বললো….
—“যা হওয়ার ছিলো তা তো হলোই, আল্লাহ তায়লা আমার কুশল দাদুভাইকে সবসময় সবরকম বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করুক। যার জন্য আজ আমার দাদুভাইয়ের প্রাণ রক্ষা পেলো আল্লাহ তায়ালা তাকেও পুরোপুরি ভাবে সুস্থ করে তুলুক এই কামনাই করছি। এখন তোমরা সবাই সবার নিজ নিজ কক্ষে গিয়ে বিশ্রাম করো।”
সাগরিকা চৌধুরীর কথানুযায়ী সকলেই ধীরে ধীরে চৌধুরী মেনশনের ভিতরে চলে যায়।
(১০৪)
অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে পায়চারী করছে কুশল। অ.টি এর দরজার সামনে রাখা চেয়ার গুলোতে বসে নিরব ভাবে দু’চোখ দিয়ে অশ্রুপাত করছে হুমায়রা। ওদের থেকে কিছুটা দূরে দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে মেঝের উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে তরুনিমা। সেইসময় তরুনিমার মা তমালিকা সিকদার ও তরুনিমার বাবা তারেক সিকদার সেখানে এসে উপস্থিত হন। তারেক সিকদার কুশলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো….
—“তাহিরের এখন কি অবস্থা বাবা!”
—“এখনও কিছু জানতে পারি নি। বেশ কিছু সময় হলো ওকে নিয়ে অ.টিতে প্রবেশ করেছেন ডাক্তাররা।”
—“অফিস থেকে আসার পর পরই শরীর কিছুটা খারাপ লাগায় তোমাদের বাসার অনুষ্ঠান পর্ব আজ যেতে পারি নি। তরুর মায়ের থেকে তাহিরের বলা সব কথা জানতে পারার পরপরই বড়মা ফোন করে এই দূ*র্ঘ*ট*নার কথা জানালেন আমায়। অজানা কারণে বাসায় আর স্থির হয়ে থাকতে পারছিলাম না জন্যই এখানে চলে আসলাম আমরা।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো….
—“আমি জানি না ৫বছর আগে তাহিরের সাথে আপনাদের কি সম্পর্ক ছিলো। আর সেই সম্পর্কের গভীরতাই বা কতোটুকু ছিলো। কিন্তু অরুনিমার মৃ*ত্যু*র পিছনে আদোতেও তাহিরের কোনো হাত ছিলো কিনা এই বিষয় নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ আমি মনে করি ‘অন্যের জীবন বাঁচানোর জন্য যে নিজের জীবনের পরোয়া করে না সে কখনও কাওকে খু*ন করতে পারে না’।”
এই বলে কুশল স্থান ত্যগ করে। তারেক সিকদার শান্ত দৃষ্টি নিয়ে কুশলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়।
তরুনিমা ওভাবেই এক ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তমালিকাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“মা..আমি আজ সকলের সামনে তাহিরকে অনেক ছোট-বড় কথা শুনিয়ে অ*প*মা*নিত করেছিলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়ে কুশলকে বাঁচাতে গিয়ে উনি নিজের জীবনের কোনো পরোয়া করলেন এতোটাও নিখুঁত ভাবে কি কেও নাটক করতে পারে! আমরা কি ওনাকে কোনোভাবে ভু*ল বুঝছি মা! আমার মাঝে এতোটা দোটানা কাজ করছে কেনো বলতে পারো!”
তরুনিমার মুখে এরূপ কথা শুনে তমালিকা শান্ত স্বরে বললেন….
—“তুই যেই দোটানার মাঝে আটকে আছিস আমিও সেই দোটানার মাঝেই আটকে আছি রে তরু। আজ বিকেলবেলা তাহির যখন আমাদের বাড়িতে এসে দাঁড়িয়েছিলো! ওকে দেখামাত্রই রাগে-ঘৃ*ণা*য় আমার সর্বশরীর রি রি করছিলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওর বলা কথাগুলো শুনে আমার মন ও মস্তিষ্ক আমাকে ৫ বছর আগের সেই দূ*র্বি*ষ*হ রাতের সময়টিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলো।”
—“কি বলেছিলো তাহির তোমায়!”
অতঃপর তমালিকা সব কথা খুলে বলে তরুনিমাকে।
(১০৫)
কুশলের গোপন আস্তানার একটি বিশালাকার রুমের ভিতর চেয়ারের সাথে হাত-পা-মুখ বাঁ*ধা অবস্থায় বসিয়ে রাখা হয়েছে তাহিরকে গু*লি বি*দ্ধ করা সেই ওয়েটারটিকে। বেশ লম্বা সময় ধরে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করায় এখন ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে সে। রুমটির চারপাশে ব*ন্দু*ক হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন কালো পোশাকধারী গার্ডসরা। এছাড়াও আস্তানাটির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আরো অনেক গার্ডসরা। সেইসময় কুশল ওর আস্তানায় এসে সেই বিশালাকার রুমটির মূল দরজা ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করে লোকটির সামনে এসে দাঁড়াতেই একজন গার্ড একটি চেয়ার এনে দেয়। কুশল চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে। লোকটি ভীত দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকজন গার্ড লোকটির কাছে এসে ওর মুখের বাঁ*ধ*ন খুলে দেয়। কুশল ওর কপালের ডানপার্শে শাহাদত আঙুল দিয়ে ঘষা দিতে দিতে প্রশ্ন করলো……
—“আমাকে মা*রা*র জন্য কে পাঠিয়েছিলো তোকে?”
লোকটি নিজের ভ*য়*কে নিজের মাঝেই দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে উচ্চস্বরে বললো…..
—“আপনার জায়গায় যাকে গু*লি বি*দ্ধ করেছি সেই মোটা টাকা দিয়ে ঠিক করেছিলো আমায়। আপনাকে বা আপনার পরিবারের কোনো সদস্যকেই সে মে*রে ফেলতো না। আপনাদের উপর অ্যা*টা*ক হবে আর আপনাদের কোনোরূপ ক্ষ*য়-ক্ষ*তি হওয়ার পূর্বেই তিনি আপনাদের চোখে নিজেকে নিষ্পাপ ও ভালো মানুষ প্রমাণ করতে নিজের প্রাণের ঝুঁ*কি নিয়ে আপনাদের যে কাওকে বাঁচিয়ে নিবে এটাই ছিলো তার আসল উদ্দেশ্য। আপনার জায়গায় নিজে গু*লি বি*দ্ধ হয়ে ওনার উদ্দেশ্যে সফল ও হলেন। মাঝখান থেকে আমি ধরা পড়লাম। আমি অনেক গরীব খুব সাধারণ একজন মানুষ। দিন আনি দিন খাই৷ তাই এতোগুলো টাকা একসাথে পাওয়ার লো*ভ আমাকে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলো। যার দরুণ আমি এই কাজটি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমাকে আপনি ছেড়ে দিন। আমি আর কখনও এমন খারাপ কাজে জড়ানোর কথা চিন্তাও করবো না।”
কুশল বাঁকা হেসে একজন গার্ডকে ইশারা করলো। গার্ডটি কুশলের ইশারা বুঝতে পেরে আরো ২জন গার্ডস এর সহযোগিতায় চেয়ারের হাতল থেকে লোকটির হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে ওর হাতজোড়া কমোরের পিছনে নিয়ে আবারও বেঁধে দেয়। লোকটি নিজেকে ছাড়াতে ছটফট করতে নিলে লোকটির মুখের উপর ক্লোরোফম ছিটিয়ে দিয়ে তাকে অ*জ্ঞান করে দেয়।
বেশ কিছুসময় পর অতিরিক্ত গরম বোধ করে লোকটি চোখ মেলে তাকাতেই দেখে সে উল্টো অবস্থায় ঝু*লে আছে। আর ওর মাথার ২হাত নিচে একটা বিশালাকার কড়াইয়ে ফুটন্ত তেল রাখা আছে। নিজেকে এমন ক*রু*ণ অবস্থায় ফেঁ*সে থাকতে দেখে লোকটি বুঝতে পারে কুশল ওর বলা মি*থ্যে কথাগুলো বিশ্বাস করে নি। লোকটি এবার আর নিজের ভ*য়*কে নিজের মাঝে দমিয়ে রাখতে পারে না। অনুনয়ের স্বরে কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললো…..
—“স্যার……স্যার…..দয়াকরে আমায় আমার প্রাণ ভি*ক্ষা দিন। আমি আপনাকে সব সত্যকথা বলছি। তবুও আমাকে আপনি মা*রি*য়েন না। আমার বাড়িতে আমার স্ত্রী ও ছোট ছোট ২টা দুধের শিশু বাচ্চা আছে। ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে আমার বাড়িতে ফিরতে হবে স্যার।”
কুশল লোকটির দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে বললো…..
—“মি*থ্যে জিনিসটা আমার বরাবরই ভিষণ অপছন্দ। তাই এবার সত্য ব্যতিত মুখ থেকে একটাও মি*থ্যে শব্দ বের করিস না। নয়তো এই গরম ফুটন্ত তেলের ভিতর তোকে খুব ভালো ভাবে ভাজার পর জজ্ঞলের শে*য়া*ল-কু*কু*রের খাবার হিসেবে ছেড়ে আসা হবে।”
লোকটি নিজের প্রাণ রক্ষার খাতিরে ভী*ত স্বরে বললো….
—“স্যার…আমি ওনার নাম জানি না আর না আমি ওনাকে দেখেছি। আমি এবং আমার একজন সঙ্গী শুধু ওনার ছায়াটাই দেখতে পেয়েছিলাম আর ওনার কন্ঠস্বর শুনতে পেরেছিলাম। আজ সন্ধ্যার সময় তিনি আমাদের মোটা টাকা দেওয়ার লো*ভ দেখিয়ে আপনাকে মে*রে ফেলতে বলেছিলেন। আর এটাও বলেছিলেন যদি আমরা ধ*রা পরে যাই তাহলে নিজের মতো করে একটা মি*থ্যে কাহিনী যেনো বানিয়ে বলে দেই কিন্তু ওনার কথা যেনো কোনো ভাবেই আপনাকে না বলি। উনি একজন পুরুষ ব্যক্তি ছিলেন। কন্ঠ শুনে আর ছায়া দেখে যতোটুকু বুঝতে পেরেছিলাম তাতে মনে হয়েছে উনার বয়স ৫০ এর উর্ধেই হবে। এর বেশি আমি কিছু জানি না স্যার। আমি আমার বউ আর বাচ্চাদের কসম কেটে বলছি আমি সম্পূর্ণ সত্য কথাই বলেছি আপনাকে।”
সেইসময় কুশলের ফোন বেজে উঠে। কুশল ফোনস্ক্রিণের দিকে তাকাতেই দেখলো ডাক্তার আকরাম সাহেব কল করেছেন। কুশল কলটি রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে আকরাম সাহেবের কথাগুলো শোনামাত্র কুশলের চেহারায় স্বস্তির ছাপ ফুটে উঠে। পরমুহূর্তে কুশল কল কেটে দিয়ে বসাবস্থা থেকে উঠে বললো….
—“ওকে ওখান থেকে নামিয়ে আগের ন্যয় বেঁ*ধে রাখো।”
এই বলে কুশল ওর আস্তানা থেকে বেড়িয়ে যায়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…..