হৃদমাঝারে তুমি পর্ব-২৯+৩০

0
327

#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_২৯

মাহিন বাইকে বসে চাবি ঘুরাবে এমন সময় কোথা থেকে নীলু মাহিন ভাইয়া মাহিন ভাইয়া করতে করতে এলো । মাহিন অবাক দৃষ্টিতে নীলুর দিকে তাকিয়ে আছে । এই এলাকার মধ্যে নীলু আসবে কোথা থেকে । এটা ওর অফিসের এলাকা , এখানে আশেপাশে কোনো থাকার জায়গা ও নেই যে অন্য কারো বাসায় আসবে । নীলু দৌড়াতে দৌড়াতে ওর কাছে এসে থামলো । হাঁপাতে হাঁপাতে বলল

– আপনাকে সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি আপনি শোনার নাম ই নিলেন না

– তুমি এখানে কি করছো ?

– বলছি বলছি , আপনার কাছে পানি আছে ?
– আছে
– তাহলে দিন ।

মাহিন তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিল । নীলু তা মুহূর্তেই ছিনিয়ে নিয়ে তার তৃষ্ণা মেটালো । তারপর বোতল টি দিতে দিতে বলল

– এটা কিন্তু ঠিক না ভাইয়া, রোজা রমজানের দিনে পানির বোতল নিয়ে ঘুরেন ।

মাহিন তাজ্জব হয়ে কতক্ষণ নীলুর দিকে তাকালো । নিজে রোজা না রেখে সবার সামনে বসে পানি খেয়ে অন্যকে সেই পানি বহন করার জন্য খোঁচা দিচ্ছে । তবুও মাহিন এ সম্পর্কে সেরকম কিছুই বলল না । তবে আগের প্রশ্ন ই পুনরায় জিজ্ঞেস করল

– এখন বলো তো তুমি এখানে কি করছো ?

– বলব বলব , তার আগে একটা নিরিবিলি পরিবেশে চলুন তো । বলেই মাহিনের বাইকের পেছনে উঠে মাহিনকে ধরে বসল । মাহিন নীলুর হাত ছাড়িয়ে বলল

– আমাকে না ধরে বাইক ধরলে খুশি হবো

– আজব তো আপনার খুশির জন্য কাজ করছে কে ? আমি তো নিজের বেনিফিট দেখছি

– তারপরও আমি কখনো কোনো মেয়েকে বাইকে নেই নি তাই আমাকে ধরতে নিষেধ করছি আর সাবধানতার জন্য বাইক ধরতে বলছি

– বেশ আপনাকে ধরলাম না তবে । বাইক ই ধরলাম

মাহিন বাইক চালাতে শুরু করলে কিছুক্ষণ যেতেই নীলু মাহিনকে জড়িয়ে ধরে । এইবার ও মজা করে ধরেনি । আসলেই ওর ভয় লাগছে । ওর অসুস্থতার জন্য আরফান ওকে বেশি বাইকে চড়তে দেয়নি সব সময়ই গাড়ি তে চড়েছে । তাই ভয়ে এখন মুখ খানা একটু হয়ে গিয়েছে । মাহিন বাইকের আয়নায় ওর এমন ভয় পাওয়া দেখে আর চলন্ত অবস্থা দেখে তেমন কিছুই বলে নি। বাইক এসে থামলো পার্কের সামনে । এখন দুপুরের একটু পর অর্থাৎ বিকেলের কাছাকাছি টাইম তাই পার্কে তেমন মানুষ নেই । ওখানের সামনা সামনি রাখা দুইটি বেঞ্চে দুইজনে বিপরীত ভাবে অবস্থান করলো । মাহিন নীলুর দিকে তাকিয়ে আছে । নীলু নিজেই বলতে শুরু করল

– দেখুন আমি যা বলার খোলাখুলিই বলতে চাই । আর আপনার কাছ থেকেও সরাসরি ই উত্তর চাইছি । আশা করি আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না ।

মাহিন কিছু বলল না । তবে নিরবতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে নীলু বলতে শুরু করল

– আপনি মিহু ভাবিকে ভালোবাসেন একথাটা কি সঠিক?

মাহিন একটা ধাক্কার মতো খেলো । ও যে মিহুকে ভালোবাসে সে কথা তো কেবল বিদিশা জানে তাহলে কি বিদিশা নীলুকে কথাটি বলে দিয়েছে । মাহিন শিওর হওয়ার জন্য বলল

– একথা বলার কারণ জানতে পারি?

– আগে আমি হ্যাঁ বা না উত্তর চাই

– দেখো নীলু তোমাকে আমি এসব কথা বলতে বাধ্য নই । আমি কাকে ভালোবাসি বা না বাসি সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার । এসব কথা তো আমি অন্য কে বলতে যাবো না

– ফার্স্ট অফ অল আপনার কথায় এটা বোঝা যাচ্ছে যে আমার কথা সঠিক । আর দ্বিতীয়ত এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার না । আপনি যাকে ভালোবাসেন সে আমার ভাইয়ের স্ত্রী । আর আপনি তাদের জীবনে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারবেন না

– নীলু আমি বুঝতে পারছি না তুমি কিসের ভিত্তিতে এসব কথা বলছো । তোমার কি সত্যিই মনে হয় আমি মিহুকে ভালোবাসি ?

– তাহলে কি আপনি আমাকে ভালোবাসেন ?

নীলুর কথায় মাহিন একটু থেমে হেসে দিল ।বলল- ভালো মজা করতে পারো তুমি । আচ্ছা তুমি কি এবার বলবে যে তুমি এসব কেনো বলছো

নীলুর কথাটা মাহিনের কাছে মজা হলেও নীলু কথাটি মজা করে বলে নি । ও কথাটি মন থেকেই বলেছিল। মাহিন যেহেতু কথাটি মজা বলে উড়িয়ে দিল তাই নীলুও কথাটি মজা করে উড়িয়ে দিল । তারপর নিজের ফোন বের করে তুলি যে ভিডিও টা দেখিয়ে ছিল সেই দেখালো । মাহিন দেখার পরে বলল

– নীলু দেখো মিহুকে খারাপ ভেবো না । আসলে এখানে যেমন টা দেখাচ্ছে বিষয় টা তেমন না হ্যাঁ আমি এটা অস্বীকার করতে পারব না যে আমি মিহুকে ভালোবাসি না । কথা সত্য যে আমি মিহুকে ভালোবাসি কিন্তু মিহু আমাকে ভাইয়ের নজরে দেখেছে সব সময় । আর মিহু তো প্রায় ই মন খারাপ থাকলে ছাদে যেতো ঐদিন ও যাওয়ার পরে আমি লুকিয়ে গিয়েছিলাম । আসলে মিহু অনেক ভালো একটা মেয়ে । ওকে ভুল বুঝো না

– আচ্ছা ভাইয়া আপনি যেখানে ভাবিকে এতো ভালোবাসেন সেখানে কি আপনার উচিত হবে তার ভালো থাকাটা কেড়ে নেওয়া ? সে যদি আপনাকে ভালোবাসতো তাহলে হতো । কিন্তু এক পাক্ষিক ভালোবাসা কি ভালো থাকে যদি অন্য জনে অন্য কাউকে ভালোবাসে ?

– তুমি চিন্তা করো না । আমি মিহুর চোখে আরফানের জন্য ভালোবাসা দেখেছি । আর আমি কখনোই ওদের জীবনে বাঁধা হয়ে দাড়াতাম না । কারণ যাকে ভালোবাসি তাকে কি করে খারাপ থাকতে দেখি ?

আচ্ছা তাহলে এখন বাসায় যাওয়া যাক । অন্য কেউ দেখলে বিষয় টি খারাপ ভাবতে পারে । বলে মাহিন উঠে দাঁড়াতেই নীলু বলে উঠলো

– ভাইয়া সব কিছু ভুলে আপনি আবার শুরু করতে পারেন না ? যে আপনাকে চাইবে তাকে নিয়ে?

মাহিন মুচকি হেসে বলল – প্রথম ভালোবাসা কি ভোলা যায়? তবে আমি চেষ্টা করে দেখবো তাতে আমার টাইম লাগবে

– টাইম নিতে গিয়ে আবার তাকেও হারিয়ে ফেলেন না যে আপনাকে চাইতো । পরে একটা সময় এটা ভেবে আফসোস করতে না হয় যে ঐ সময় বিষয় টা কেনো ভেবে দেখলাম না ।

—————————-

রেবেকার শরীর টা খারাপ লাগছে তাই আজকে ইফতারির আয়োজন টা করতে পারেনি । তাই আজকে মিহু ইফতারি তৈরি করছে । প্রায় জিনিস তৈরি করাই শেষ । এখন ভাজা পোড়া গুলো বাকি । চুলায় ভরা তেলের মাঝে পিয়াজু গুলো ভেজে নিল আর বেগুনের টুকরো গুলো বেসনের মধ্যে ভিজিয়ে সেটা ছেড়ে দিল । এমন সময় মিহুর কপালের সামনে চুলগুলো এসে গেল । ও কোনোভাবে হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে বেসন কপালে মেখে ফেলল । তারপর কিছুক্ষণ চেষ্টা করতেই চুলের কাটা পড়ে গিয়ে সব চুল গুলো খুলে গেল । মিহু অসহায় হয়ে বসে আছে । কিন্তু দূর থেকে এসব অবলোকন করছিল আরফান । সে রান্নাঘরে এসেই মেঝে থেকে চুলের কাটা টি উঠিয়ে মিহুর চুলগুলো খোপা করার চেষ্টা করল । হঠাৎ করে আরফানের আগমনে মিহু একটু ঘাবড়ে গেল । তাই আরফান বলল

– আরে ভয় পেয়ো না , আমি আরফান

– কিন্তু আপনি আমার চুলগুলো নিয়ে কি করছেন ?

– দেখছি এর কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা । আচ্ছা চুলের খোপা করে কীভাবে? আমি কখনো কাউকে খোপা করে দেই নি । তবে বেণী করেছি , তাহলে বেণী করে দেই

আরফান অনেক আগ্রহের সাথে কথাগুলো বললেও মিহু কেমন যেন আড়চোখে তাকিয়ে আছে আরফানের দিকে । মিহুকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরফান ঠোটের কোণে হাসি এনে বলল

– জেলাস ? হ্যাঁ? আরে এভাবে জেলাসের কি আছে ? শুধু তো চুল নিয়ে বেণীই করেছিলাম বেশি কিছু না আর

আরফানকে আরকিছু বলতে না দিয়ে মিহু হাত ধুয়ে ফেলে । মুখ গোমরা করে বেগুণি গুলো নিয়ে চলে যায় । আরফান পেছনে পেছনে যায় তবে মিহুকে ওর বলা কথাগুলো শুনাতে পারে না । পিহু বাকি সব ইফতারির আয়োজন করছিল । মিহু ওকে বাকি সব বুঝিয়ে দিয়ে বলল

– পিহু আমি ওপরে যাচ্ছি , বাকি গুলো তুই সাজিয়ে রাখ । আমার মাথা টা ধরেছে

বলে মিহু ওপরে চলে গেল । আরফান ও মিহুর পেছনে পেছনে চলে গেল । মিহু মন খারাপ করে বাগানের দোলনায় বসে আছে আরফান ওদিকে যেতে নিলেই ফারিশের ফোন আসায় অন্য দিকে চলে যায়

ইফতারির সময়ে মিহু তেমন কোনো কথাই বললো না । রেবেকা জিজ্ঞেস করেছিল ঐদিন তোমাদের বাসার রান্না গুলো কি তুমিই করেছিলে? মিহুর আগেই নীলু উত্তরটা বলে দেয় । তারপর শুধু টেবিলে চামচ নাড়ানির শব্দ ই পাওয়া গেছে । সবার আগেই মিহু উঠে চলে গেল । আরফান সবার সাথে ইফতারি করে ঘরে গেল । গিয়ে দেখল ঘর সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা । আরফান গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দেখলো মিহু শুয়ে আছে বিপরীত দিকে ফিরে । আরফান মিহুর কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বলতে লাগল

– মিহু এই মিহু এদিকে তাকাও

বলে মিহুকে ঘুরাতে চেয়েও পারেনি । মিহু জোর করে বসে আছে । আরফান এবার অনেক কষ্ট করে মিহুকে ফিরিয়ে দেখল পুরো চোখ মুখ লাল করে আছে । কান্না করার ফলে চোখ মুখ ফুলে গেছে । আরফানের খুব কষ্ট হলো মিহুর এমন অবস্থা দেখে ।

– মিহু এ কি অবস্থা করেছো ?

(নিরুত্তর)

– আমি কি কোনো ভুল করেছি ?

(নিরুত্তর)

– মিহু তুমি কি এখনো ঐ কথায় রাগ হয়ে আছো । দেখো প্লিজ রাগ করো না । আমার কথাটা পুরো শুনতে তারপর যা করার করতে

– না আমার শোনা লাগবে না , আপনি চলে যান সেই মেয়ের কাছে যার বেণী করেছিলেন

– তুমি যদি কথাটা না শোনো তাহলে কিন্তু আমি সেই মেয়ের কাছে চলে যাবো

মিহু কান্না রেখে আরফানের দিকে তাকিয়ে আবার কান্না করে দিল । আরফান অস্থির হয়ে বলতে লাগল

– এই মিহু তুমি কান্না করো কেন ? আগে নামটা তো শোনো । আমি নীলুর চুল বেঁধে দিয়েছিলাম আর কোনো মেয়ে নয়।

– সত্যি তো

নীলুর চোখ চকচক করছে । আরফান এবার মিহুর কানে কানে বলল – আচ্ছা জেলাস ফিল করে তো সে যে ভালোবাসে । তাহলে আমি কি ভেবে নেবো আমার বেলী ফুল আমাকে ভালোবাসে ?

মিহু লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে উঠে ছাদে চলে গেল । আরফানের হৃদয়ে এখন বসন্তের ফুল ফুটেছে । আরফানের মনে একটা প্রশান্তির হাওয়া বইছে ।

#চলবে

#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_৩০

– শোনো আরফান আমি তোমাকে এ সম্পর্কে তেমন কিছুই বলতে চাইনি । কারণ আমি চাইনি আমার নাতনী কষ্ট পাক । তবে তুমি যেহেতু এ সম্পর্কে কিছু হলেও জেনেছো তাই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি । তবে আমাকে তোমার কথা দিতে হবে যে তুমি মিহুকে অবহেলা করতে পারবে না ।

আরফান কিছু না বলে মিহুর দাদুর দিকে তাকিয়ে থাকলো । তিনি বলতে শুরু করলেন

– প্রিয়ন্তি ছিল আমার বন্ধু সরোয়ারের ভাইয়ের মেয়ে । সরোয়ারের সাথে পরিচয় টা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় এ বসে । ও ছিল রসায়ন বিষয়ের আর আমি ছিলাম জুওলজির ছাত্র । সে যাই হোক ওদের গ্রাম বা পরিবার সম্পর্কে আমি সেরকম কাছুই জানতাম না । শুনেছিলাম সরোয়ারের নাকি একটা বোন ছিল একদম হুবহু প্রিয়ন্তির মতো দেখতে । তবে তার নাকি মৃত্যু হয়েছিল রহস্য জনক ভাবে । এমন ভাবে সে মারা গিয়েছিল যে তাকে কেউ শনাক্ত করতে পারেনি । তার চেহারা একদম থেতলে গিয়েছিল । ঐ ঘটনার পরে নাকি তাদের গ্রামে অশান্তি শুরু হয় । একের পর এক মেয়ে এইভাবে মৃত্যু বরণ করে । তখন পুলিশ গিয়েও নাকি ঘটনার উদ্ধার করতে পারেনি । প্রিয়ন্তিকে সরোয়ার তখন এখানে নিয়ে আসে । এরপর ওদের গ্রাম সম্পর্কে আমি আর অতটা জানতে পারিনি । সরোয়ার অনেক ভালো স্টুডেন্ট ছিল তাই সে একটা ভালো জায়গায় চাকরি পায় । ও বিয়ে করেনি কিন্তু আমি ততদিনে তিন বাচ্চার বাপ আর আমার বড় ছেলেও বিয়ে করেছে । আমার বড় ছেলে করিম আর ছোট ছেলে কবির । প্রিয়ন্তি ওর ফুফুর মৃত্যুতে একদম ভেঙে পড়েছিল । সারাদিন বিমর্ষ হয়ে থাকত । আমার ছোট ছেলে কবির ছিল প্রায় প্রিয়ন্তির সমবয়সী । একটু ছোট বড় হবে । তবে প্রিয়ন্তির সাথে ভাবটা ছিল করিমের বেশি । এমন কি করিম তাকে এই ট্রমা থেকে বের করে আনে । প্রিয়ন্তিও তার চাচার মতোই একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী ছিল । আর ও ওর চাচাকে দেখে তার মতো একজন হতে চাইতো । তাই সেও রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিল । আর সে ঠিকই সেটা করেছিল । দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল তবে আমার ছোট ছেলে সম্ভবত প্রিয়ন্তিকে পছন্দ করতো । বড় ছেলের সাথে প্রিয়ন্তির এতো সখ্যতা সে ভালো চোখে দেখতে পারত না । তাই একদিন,,,,,,,(একটু থামলেন) বলাটা ঠিক হবে কিনা জানি না । যতই হোক আমার নিজের ছেলে তবে তার দোষ তো অস্বীকার করা যাবে না । একদিন সরোয়ার প্রিয়ন্তিকে আমাদের বাসায় দিয়ে গিয়েছে তখন প্রিয়ন্তির ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা চলে । প্রিয়ন্তির বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাই সরোয়ার প্রিয়ন্তিকে না জানিয়ে ওদের গ্রামে চলে যায় । ঐদিন রাতে প্রিয়ন্তি বেশ রাত করেই পড়ছিল , আমরা ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম । হঠাৎ প্রিয়ন্তির চিৎকারে আমরা ওর ঘরে চলে যাই দেখতে পাই কবির ওর ঘরে ঢুকে একটা খারাপ কিছু করতে চেয়েছিল । আমি তখন বাকরুদ্ধ হয়ে যাই । আমার ছোট ছেলে যে এত খারাপ হতে পারে তা আমি ভাবতেও পারিনি । যদিও আল্লাহ্ বাঁচিয়েছিল সেদিন কিন্তু পরের দিন থেকে আশেপাশের সবাই খারাপ কথা বলতে শুরু করে । এতে পিউ আবার আগের মতো হয়ে পড়ে । এদিকে সরোয়ারের ও কোনো খবর নেই । তার গ্রামের ঠিকানাও জানি না । আমি দিগ্বিদিক হয়ে প্রিয়ন্তি আর কবিরের বিয়ে দিয়ে দেই ।

– কিন্তু দাদু এর সঙ্গে মিহুকে অপছন্দ করার বা ঘৃণা করার সম্পর্ক কী ?

– বলছি শোনো । ওদের বিয়ের পরে কবির অনেকটাই ভালো হয়ে গিয়েছিল । এমনকি প্রিয়ন্তিকে ছাড়া তেমন কিছুই বুঝতো না । এদিকে আমার বড় ছেলের ঘরে মাহিন আর তুলি হয় । সব মিলিয়ে সুখেই যাচ্ছিল কিন্তু আমি যখন অনেক খোঁজ খবর নিয়ে সরোয়ারের গ্রামে যাই তখন সেখানে গিয়ে জানতে পারি ওদের ঘরে নাকি আগুন লেগেছিল । কেউ নাকি বেঁচে নেই । আমি প্রিয়ন্তিকে খবরটা দেই নি কারণ জীবনে দুই দুইবার আঘাত পেয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে । ওকে আগেই বলেছিলাম যে তোমার গ্রামের সবাই ভালো আছে । তোমার ছোট চাচাও গ্রামে গিয়ে ব্যবসা করবেন । প্রিয়ন্তি এই কথা বিশ্বাস করেনি তাই বাধ্য হয়ে আমি একটি মিথ্যা চিঠি লিখেছি সরোয়ারের হয়ে । সেই চিঠিটা কি তুমি পড়তে চাও আরফান ? আমার কাছে এখনো এই চিঠিটা আছে । বলে তিনি তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা খামে ভরা চিঠি বের করে আরফানকে দিলেন । বললেন পরে পড়ো।

আরফান চিঠিটা হাতে নিল । তারপর মিহুর দাদুর কথায় মনোযোগ দিল ।

-প্রিয়ন্তির কাছে কথাগুলো আমাকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল । কিন্তু আমি প্রিয়ন্তিকে বাঁচাতে চেয়েও বাঁচাতে পারিনি । আমি জানি না প্রিয়ন্তির সাথে শেষে কি হয়েছিল আমি তখন একটা কাজে অন্য গ্রামে গিয়েছিলাম । এসে শুনি প্রিয়ন্তিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে । আমি যখন হাসপাতালে যাই তখন জানতে পারি প্রিয়ন্তি আর এই পৃথিবীতে নেই এমন কি ওর জমজ বাচ্চার একটি বাচ্চা মারা গিয়েছে । তখন হাসপাতালে ছিলাম আমি আর কবির । আমি যখন হাসপাতালের বাইরে একা বিমর্ষ অবস্থায় হাটছিলাম তখন আমি একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পাই । আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি কয়েকটা কুকুর মিলে সদ্য জন্ম নেওয়া একটি বাচ্চাকে কামড়াচ্ছে । আমার মনে তখন নাতনী হারাবার শোক । তাই আমি বাচ্চা টিকে কুকুর গুলোর হাত থেকে বাঁচিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাই । পরে দেখতে পাই মেয়েটির পেটে একদম হুবহু প্রিয়ন্তির গলায় একটা দাগ রয়েছে সেরকম । আমি তখন বুঝতে পারলাম এটা আমার নাতনী । কিন্তু কবিরের কাছ থেকে জানতে পারি প্রিয়ন্তির নাকি এক ছেলে আর এক মেয়ে হয়েছিল যার মধ্যে ছেলেটি মারা যায় । আমি কবিরকে এটা বোঝাই যে হয়ত কোনো ভূল হয়েছে কিন্তু কবির এটা বিশ্বাস করে না । তবে আমি এটা জানতে পারলাম না আসলেই মিহু কবিরের সন্তান কিনা ? মিহু প্রিয়ন্তির সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী কিন্তু কীভাবে আমি কি মিলাবো বুঝতে পারছি না । আমি এটাও বুঝতে পারছিনা যে কবিরের কি অন্য কোনো রিলেশন ছিল কিনা ? কিন্তু তাহলে মিহু প্রিয়ন্তির মতো হবে কি করে । এটাও হতে পারে মিহু কবিরের অবৈধ সন্তান । আমি এটা সম্পর্কে এখনো খোজ খবর করছি । আর আমি চাই তুমিও মিহুর আসল পরিচয় উদ্ধারে সাহায্য করো ।

– দাদু মিহু যদি কারো অবৈধ সন্তান হয়েও থাকে তাহলেও মিহু আমার আর না হলেও মিহু আমার । মিহুকে আমি মন থেকে ভালোবাসি । আর এখানে ওর কোনো দোষ আমি দেখছি না । তাই মিহুকে খারাপ ভাবার কোনো প্রশ্নই আসে না ।

তখনই একজন লোক এসে মিহুর দাদুর হাতে একটা চিঠি দিল । আর বলল – মিস্টার এসকে রহমান আপনার অ্যাপ্লিকেশন সাকসেসফুল হয়েছে । আপনাকে চিঠিতে সব জানিয়ে দেওয়া হয়েছে । আপনি আজকের মধ্যেই পুনরায় জবাব দিবেন

– ঠিক আছে

লোকটি চলে যাওয়ার পরে আরফান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে মিহুর দাদু বলে – আমি একজন গোয়েন্দা অফিসারের কাছে অ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম মিহুর রহস্য সন্ধানে যাতে সাহায্য করে । তিনি বিষয় টিতে সম্মতি জানিয়েছেন । আর গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য হাতে হাতে চিঠির মাধ্যমে কথা বার্তা চলছে ।

আরফান মিহুর দাদুর কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো । মিহুর দাদুর ছোট খাটো একটা আতরের ব্যবসা আছে । ছোট ছোট শিশিতে ভরা আতর থেকে খুব সুন্দর ঘ্রাণ আসে । তিনি পড়াশোনা শেষ করার পরে কৌতুহল বশত ব্যবসা করলেন এটা আরফানের মানতে কষ্ট হচ্ছে ।তারপরও আরফান চলতে শুরু করল নিজের গন্তব্যে । আচ্ছা মিহুর জন্ম নিয়ে যে সত্যিই বের হোক না কেন আরফান কি এরকম থাকবে ?

——————-

– মাহিন ভাইয়া দাঁড়ান

মাহিন আজকেও অবাক হয়ে আছে । নীলু আজকেও ওর পেছনে পেছনে এসেছে । ও একটা মিটিং এর জন্য এখানে এসেছিল । যখনই বের হতে যাবে তখন কোথা থেকে নীলু দৌড়ে আসল

– তুমি এখানে কি করছ ?

– কেন এজায়গা টা কি আপনার কেনা সম্পত্তি

– আমি সেটা বললাম কখন ?

– তাহলে অবাক হলেন কেন আমাকে দেখে

– না এমনিই । আচ্ছা তুমি তাহলে তোমার কাজ করো আমি যাচ্ছি বলে চলে যেতেই নীলু মাহিনের হাত টেনে ধরল ।

– আরে আরে আপনি কোথায় যাচ্ছেন ? আমি কি আপনাকে এমনি এমনি ডেকেছি নাকি ? আমার সাথে চলুন ।

– কোথায় যাবো আমি ?

নীলু মাহিনের কথার উত্তর না দিয়ে ওকে টানতে টানতে নিয়ে চলে যায় শপিং মলের মধ্যে । সেখানে গিয়ে কয়েকটা পাঞ্জাবি বের করা ছিল সেগুলো ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল

– এগুলো পড়ে আসুন তো ।
– কিন্তু কেন?
– ভাইদের জন্য শপিং করছি কিন্তু কোনটা ভালো মানাবে বুঝতে পারছি না । আর আপনি যেহেতু ভাইদের বয়সী তাই আপনাকে দেখলে একটা ধারণা পাবো।

অগ্যতা মাহিনকে এতগুলো পাঞ্জাবি একের পর এক পড়ে আসতে হলো । নীলুর কোনোটাই পছন্দ হচ্ছে না । শেষ মেষ একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি তে নীলুর চোখ আটকে গেল । নীলু ঐ পাঞ্জাবি টা একটা আলাদা প্যাকেট করালো । আর অন্য সবার জন্য কিছু কিছু কিনলো ।

বের হয়ে যখন যাবে তখন নীলু বলল – ভাইয়া আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসবেন ? মানে বাসা পর্যন্ত যাওয়া লাগবে না । আপনি তার আগে নামিয়ে দিলেই হবে ।

নীলু যেহেতু নিজে বলেছে তাই মাহিন না করল না । তবে নীলুকে সাবধান করে বলে দিল – আজকে সাবধানে বসবে ? আর বাইক ধরে বসবে । যদি বেশি ভয় লাগে তাহলে শুধু কাঁধে হাত রাখবে । জড়িয়ে ধরবে না

নীলু শুধু মাথাই নাড়ালো । বাইক চলার সাথে সাথে আবার আগের অবস্থা । মাহিনকে জড়িয়ে ধরল নীলু । মাহিন হঠাৎ করেই ব্রেক কসলো । নীলু আজকে ইচ্ছা করে জড়িয়ে ধরেছিল কিন্তু হঠাৎ ব্রেক কষায় মাহিনের হেলমেটে ঠাস করে বাড়ি খেলো।মাহিন বাইক থেকে নেমে বলল

– তোমাকে নিষেধ করলাম না আমাকে জড়িয়ে ধরতে ?

নীলু দেখলো মাহিন রেগে যাচ্ছে তাই ও নিজের মাথা ধরে অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করলো । মাহিন যেহেতু জানে নীলুর কথা তাই ও ব্যপারটা সিরিয়াস ভাবে নিয়ে ওকে ধরল ।

– নীলু এই নীলু , অজ্ঞান হয়ে গিয়েছো নাকি?

নীলুর মনে হলো ও চেচিয়ে বলুক যে – না ভাই আমি ঘুমাইতাছি । অভিনয় আর যেভাবেই হোক দেখছে যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে এখন অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তি কেই জিজ্ঞেস করছে অজ্ঞান হইছে কিনা ? মানে বিষয় টা এই রকম যে মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে এটা বলবে যে আমি মরে গেছি তারপর আবার মরে যাবে ।

মাহিনের কাছে পানির বোতল থাকায় ও সেটা নীলুর মুখে ছিটিয়ে দিল । তারপর নীলু চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে বলল

– আমার কি হয়েছিল ?
– তুমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে
– ওহ । আমি কোথায়?
– তুমি এখন রাস্তায়, বাসায় যাচ্ছো।

মাহিন বাইকে উঠে এবার নিজেই নীলুকে জড়িয়ে ধরতে বলল। নীলু নিজেকে অসুস্থ হওয়ার ভান করে হাতের বাধন আলগা করে দেয় আর মাথা মাহিনের পিঠে এলিয়ে দেয় । মাহিন তখন একহাত দিয়ে বাধন শক্ত করে দেয় তারপর বাইক চালাতে শুরু করে

নীলু বাকা হেসে মনে মনে বলল- সেই তো ধরতে দিলেন শুধু আমাকে কষ্ট করিয়ে । আগে ধরতে দিলে কি হতো ? শুধু শুধু আমার কষ্ট করা লাগছে

বসার একটু আগে বাইক আসতেই নীলু জোড়ে বলে উঠে – থামান !

নীলুর হঠাৎ চিৎকারে মাহিন হতভম্ব হয়ে যায় । একটু আগেই না নীলু দুর্বল ছিল হঠাৎ এতো শক্তি পেলো কোথায়? নীলু বাই থেকে নেমে একটা শপিং মাহিনের হাতে দিয়ে বলল – এটা আমার পক্ষ থেকে । আমার জন্য এতো কষ্ট করলেন তার জন্য ধন্যবাদ ।

– কিন্তু

– ভাইয়া প্লিজ না করবেন না

নীলুর করুন মুখ দেখে আর ফিরিয়ে দিল না । ও বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল । নীলু এবার বাসার দিকে রওনা দিল আর বলতে লাগল

– উফ যাক এত সাধনার পরে প্লান সাকসেসফুল । আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল তাকে পাঞ্জাবি গিফ্ট করা সেটা হয়ে গিয়েছে ।

মাহিন বাইকটা রেখে স্তব্ধ হয়ে আছে । নীলু শুধুমাত্র ওকে পাঞ্জাবি গিফ্ট করতে চেয়েছিল ? কিন্তু কেন ?
নীলুর একটা চুলের ক্লিপ মাহিনে কাছে থেকে গিয়েছিল সেটা ফেরত দিতে এসেই নীলুর কথা গুলো শুনলো । তারপর মাহিন ক্লিপটা না দিয়েই চলতে শুরু করল

#চলবে