হৃদমাঝারে তুমি পর্ব-৪৩+৪৪

0
341

#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_৪৩

হাসপাতালের করিডোরে সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছে । মিহুকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে । সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে । কারো বলার কিছু নেই । মিহু হাটু মুড়ে হাসপাতালের দেওয়াল ঘিরে বসে আছে । ওর কেন যেন নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে । ওর কারণেই তো নীলু ঐ বাসায় থেকে গেল । মিহুর মনে হচ্ছে কোনোভাবে ওর জীবনের বিনিময়ে হলেও নীলুকে বাচতে হবে । আরফান শক্ত হয়ে বসে আছে । কারো কথা বলার কোনো ভাষা নেই ।

মাহিন এতক্ষণ কোথায় যেন ছিল । এলোমেলো পায়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল মিহুর দিকে । ওর চেহারা উস্ক খুস্ক । চোখ দুটো লালা হয়ে গিয়েছে । কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ওর অবস্থা শোচনীয় হয়ে গিয়েছে । কেমন একটা মাতাল মাতাল হয়ে গিয়েছে । ধীর গতিতে মিহুর দিকে গিয়ে ওর পাশে বসে পড়ে । মিহু মাহিনের আগমনে চোখ তুলে তাকায় ।

মাহিন মিহুর হাতটা নিজের কাছে নিয়ে বলতে শুরু করে
– মিহু তুই আমাকে একটা কথা বলেছিলি মনে আছে ?

মাহিনের মুখ থেকে মদের দূর্গন্ধ আসছে । মিহু অবাক হয়ে বলে – মাহিন ভাই তুমি মদ খেয়েছ?

– আরে কোথায় মদ খেলাম ?

– তুমি মদ না খেলে তোমার মুখ থেকে এমন দূর্গন্ধ আসছে কেন ? আর তোমার অবস্থা এরকম মাতাল মাতাল কেন ?

– তুই ওসব কথা রাখ । তুই আগে বল আমাকে একটা ওয়াদা করেছিলি তোর মনে আছে ?

মাহিনের এমন ব্যবহারে সবাই ই অবাক হলো । একটু পরে যা হলো সেটা হাসপাতালের প্রতিটা সদস্যকে অবাক করে দিল । মাহিনের এই ব্যবহারে মিহু যখন দাঁড়িয়ে পড়ল তখন মাহিন হঠাৎ করে মিহুর পা ধরে কেঁদে উঠল । চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল

– তুই একদিন আমাকে বলেছিলি আমি যাকে ভালোবাসি তাকে তুই এনে দিবি । তুই এখন সেই ওয়াদা ভাঙতে পারবি না । আমার নীলুকে আমার কাছে এনে দে । ও এমনিতেই মাথায় তেমন চাপ নিতে পারে না । এত বড় একটা এক্সিডেন্ট কীভাবে সহ্য করবে ? ও তো খুব ছোট একটা মেয়ে । ওকে তুই আমার কাছে এনে দে । ওর রক্তাক্ত শরীর আমি দেখতে পারছি না । ওকে বলে দে আমি কখনো আর বেশী সময় নেব না । সব সময় আমি ভেবে চিন্তে অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেব । ও বলেছিল বেশি সময় নিতে গেলে হারিয়ে যাবে । প্লিজ ওকে আমার কাছে এনে দে । ওকে বল ও যেন হারিয়ে না যায় । আমাকে যা শাস্তি দেবে সেই শাস্তি মাথা পেতে নেব । প্লিজ এনে দে

মাহিনে এমন ব্যবহারে সবাই অবাক হয়ে আছে । মিহু মাহিনের পা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল

– ভাইয়া সব ঠিক হয়ে যাবে । তুমি প্লিজ শান্ত হও । এভাবে মদ খেয়ে মাতাল হলে কি সব ঠিক হবে ? আল্লাহ কে ডাকো । আল্লাহ বান্দার বিপদের সময়ে মুখ ফিরিয়ে নেন না । আল্লাহর কাছে বলো ।

মাহিন মিহুর তেমন কোনো কথাই কানে নিচ্ছে না । নিজের মনে বির বির করে যাচ্ছে । বসা থেকে দাঁড়িয়ে অপারেশন থিয়েটারের দরজা ধরে ধাক্কা দিতে দিতে বলল

– তোমরা এমন কেন । আমার নীলুকে আমার কাছে আসতে দাও । ওকে আমার এখনো অনেক কথা বলার আছে । আমার নীল পরী আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না । ও শুধু আমার ।

কেউ বের হচ্ছে না দেখে আরো জোরে চেচাতে চেচাতে বলতে লাগল – তোমরা খুব খারাপ । তোমাদের আমি অনেক টাকা দেব । সেটা দিয়ে তোমরা অনেক কিছু কিনতে পারবে । তোমরা আমার নীলুকে দিয়ে দাও । আমি কাউকে কিছু বলব না ।

আরফান এগিয়ে গিয়ে মাহিন ধরে এনে বসালো । আরফানকে ছেড়ে ছুড়ে মাহিন উঠে যেতে চাচ্ছে । কিন্তু মাহিনের শরীর দুর্বল হওয়ার কারনে আরফানের কবল থেকে মুক্তি পেল না । তাই উপায় না পেয়ে আরফানের হাতে কামড় দিয়ে দৌড়ে আবার দরজা ধাক্কাতে লাগল । এবার নেহাল সহ আরো অনেকে মাহিনকে ধরল তারপর একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিল । মাহিন ধীরে ধীরে চুপ হয়ে যেতে লাগল । ওকে একটা কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলো ।

——

সময় চলে যাচ্ছে । সকাল থেকে দুপুর হয়ে গিয়েছে কিন্তু কারো কোথাও যাওয়ার বা অন্য কিছুর করার নাম নেই । কেউ কাউকে খাওয়ার কথা বলতে পারছে না । কারণ এখন কারোর ই খাওয়ার ইচ্ছা নেই । একজন ডাক্তার বের হলে আরফান দাঁড়িয়ে যায় ।

– ডক্টর আমার বোন কেমন এখন ?

ডক্টর শুকনো মুখে বলল – এখানে পেশেন্টের লিগ্যাল অভিভাবক কে ?

– আমি । আমাকে বলুন , আমার বোন হয় ।

– আপনাকে একটু আমার সাথে আসতে হবে ।

সবাই আরফানের দিকে তাকিয়ে আছে । আরফান একবার সবার দিকে নজর বুলিয়ে ডক্টরের সাথে চলে গেল ।

——-

-মিস্টার আরফান অপারেশনের সময় আমরা যেটা দেখতে পেলাম আর বুঝলাম পেশেন্ট কে ইচ্ছা করে এমন করা হয়েছে । কারণ একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কার কারণে এরকম হতে পারে না ।

– কিছু কি খারাপ ঘটেছে ডক্টর?

– আপনি আগে নিজেকে শক্ত করুন । আপনি যদি ভেঙে পড়েন তাহলে বাকিদের কি হবে ?

– আমার বোনটা কি বাঁচবে ডক্টর?

– বাঁচার আশা আছে তবে সেটা খুবই ক্ষীণ । পেশেন্টের মাথায় ট্রাকের হেড লাইটের কাচ গভীরভাবে ঢুকে গিয়েছে । এখন আমাদের মাথার একটা অপারেশন দরকার । যদি অপারেশন করি তাহলে বাচার সম্ভবনা 0.005 পারসেন্ট ।

– যদি অপারেশন না করা হয় ?

– অপারেশন না করলে তার বাচার মেয়াদ একসপ্তাহ । কারণ কাঁচের পজিশন ভালো না । এখন আপনাকে অপারেশন করতে হলে বন্ড সই করতে হবে ।

– মানে পেশেন্টের কিছু হলে আপনারা কেউ দায়ী নয় তাইতো ?

– জ্বী । আরেকটা কথা অপারেশন করলে যদি বেচেও যায় তাহলেও তিনি সুস্থ ভাবে থাকবেন না । তিনি কোমায় চলে যাবেন । এমন কি যদি কোমা থেকে ফেরেন যদিও এটা অসম্ভব প্রায় তাহলে মেমরি লস্টের সম্ভাবনা হান্ড্রেড পারসেন্ট । তবে এগুলো যদি বেচে থাকেন সেই ক্ষেত্রে । এখন সব কিছু আপনার হাতে ।

– কোথায় সই করতে হবে ?

————

হাসপাতালের ছাদে আরফান চুপচাপ বসে আছে । আকাশের দিকে তাকিয়ে নীলুর সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো ভাবছে । মিহু আরফানকে ছাদে আসতে দেখে নিজেও ওর পেছনে পেছনে আসল । চুপচাপ আরফানের পেছনে দাড়াল কিন্তু আরফান মিহুর অস্তিত্ব টের পেল ।

– মিহু আমার কাছে এসে বসো ।

মিহু আরফানের কথা মতো ওর কাছে গেল । আরফান হঠাৎ করে মিহুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল

– মিহু আমি নিজের হাতে আমার বোনকে মেরে ফেললাম । আজ যদি সই না করতাম তাহলে ও আরো এক সপ্তাহ বাচতো । আমি কি করে এসব করতে পারলাম ।

– আরফান আপনি এভাবে খারাপ দিকটা ভাবছেন কেন ? নীলুর কিছু হবে না । দেখবেন নীলু আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছে । শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করুন । একমাত্র আল্লাহ ই সকল কিছুর মালিক

– তাই যেন হয় । আমার বোনটা যেন হাসি খুশি থাকে । আল্লাহ যেন আমার বোনকে বাঁচিয়ে রাখে ।

#চলবে

#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_৪৪

নীলুর অপারেশন চলছে । মাহিন এখন একটু সুস্থ আছে তবে ঘুম থেকে ওঠার পরে একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছে । যেহেতু নীলুর বিষয়ে পুলিশে আগেই ইনফর্ম করা হয়েছে তাই তারা ট্রাকটি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছে । কারণ অত সকালে ওরকম কোনো ট্রাক চলাচল করার কথা নয় । আরফানকে পুলিশের সাথে থানায় যেতে হয়েছে । কে এই কাজটা করতে পারে সেই বিষয়ে পুলিশকে ধারণা দেওয়ার জন্য ।

এদিকে পিহু বাসায় চলে যাচ্ছে সবার জন্য খাবারের উদ্দেশ্যে । কারণ যতই হোক সবাইকে তো খেতে হবে । না খেলে তো সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বে । নেহাল পিহুর সাথে মিহু আর রেবেকাকেও পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু রেবেকা যায় নি । কারণ নীলুর খবর না শোনার আগে কোথাও যাবে না সে । যতই নীলু রেবেকার পেটের সন্তান না হোক নীলু তো তার মেয়ে । নীলুকে সে তার নিজের মেয়ের মতই ট্রিট করেছে । আরফান নেহাল বা নীলু কাউকেই ভিন্ন চোখে দেখে নি । সবাইকে এক নজরে দেখেছে । এখানে যদি নীলুর জায়গায় রেবেকার নিজের সন্তান থাকতো তাহলে কি রেবেকা চলে যেতে পারত ?

মিহু আর পিহুকে একা ছাড়বে কীভাবে ? একজন পুরুষ মানুষ না গেলে ওরা যেতে পারবে ? আবার এখানে আরফান ও নেই । নেহাল চলে গেলে এদিকের বিষয়ে দেখে রাখার মতো কোনো মানুষ থাকবে না । কারণ মাহিন কে দেখে রাখার জন্যই আরেকজন লাগবে । নেহালের এতক্ষণ পরে খেয়াল এলো পিয়াস ওদের সাথে নেই । এতো চিন্তার মধ্যে পিয়াসের কথা মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল । পিয়াসের নম্বরে ফোন দিতে গিয়ে দেখে পিয়াস অনেক গুলো মিসড কল দিয়েছিল রাতে । কিন্তু তখন ব্যস্ত থাকায় আর ফোনের দিকে নজর দেয় নি । তবে পিয়াসকে ফোন দিয়ে ওর ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে । অনেক বার ফোন দিয়েও বন্ধই শোনাচ্ছে । বাধ্য হয়ে মিহু পিহুকে একা ছাড়তে হলো । তবে মিহু পিহু কেউ ই এই বিষয়ে আপত্তি করেনি বা তেমন কোনো কথা বলেনি । কারণ যেখানে নীলুর এরকম অবস্থা সেখানে তাদের দুজনকে নিয়ে তো ভয় হওয়ারই কথা ।

——

রান্না ঘরে দুজনে এক সাথে রান্না করছে । পিহু রান্না করছে আর মিহু সব কিছু কেটে দিচ্ছে । অমনোযোগী হয়ে পেয়াজ কাটতে গিয়ে মিহু হাত কেটে ফেলে । মিহুর হঠাৎ কিঞ্জিৎ চিৎকারে পিহু এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরে ।

– মিহু কিভাবে কাটলি হাত ? তোকে আমি রান্না ঘরে আসতে নিষেধ করেছিলাম । তখন শুনিস নি

– ও কিছু না । এটা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে

– এমনিতে ঠিক হবে , না ? আমাকে বোকা পেয়েছিস ? এত খানি হাত কাটল রক্তে ভেসে যাচ্ছে । আর তুই বলছিস কিছুই হবে না ।

মিহু পিহুর থেকে হাত সরিয়ে বলে – আরে আগে এমন ভাবে কত হাত কেটেছি তখন ব্যথা করত । কারণ তখন দেখার কেউ ছিল না আর শান্তনা দেওয়ার মতো ও কেউ ছিল না । আর এখন তো এগুলো সয়ে গিয়েছে

পিহু মিহুর দিকে অপরাধীর মতো তাকিয়ে বলে – আগের কথা নিয়ে খোটা দিচ্ছিস ?

– না না খোটা দিলাম কই । এমনিই বললাম কথার কথা

– তখন তো চাচি যা বলত তাই বিশ্বাস

পিহুকে আর বলতে না দিয়ে মিহু বলল – থাক পুরনো কথা মনে করে লাভ নেই । এখন বর্তমানের কথা নিয়ে থাকি । তুই রান্নার দিকে নজর দে । আমি হাতটা পরিষ্কার করে আসছি ।

রুমে এসে মিহু সারা ঘরে তন্ন তন্ন করে ক্রীম টা খুজছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না । চাকুটা বেশ ধারালো হওয়ার কারণে হাতটা অনেক গভীরেই কেটেছে । ক্রীমটা সময় মতো না লাগানোর ফলে অনেক জ্বালা পোড়া করছে । খুজতে খুজতে হঠাৎ মনে পড়ল নীলুর রুম থেকে জিনিস পত্র আরফানের রুমে আনা হয় নি । তাই ক্রীম টা নীলুর রুমেই থেকে গিয়েছে ।

নীলুর রুমে প্রবেশ করতেই মিহুর মনটা আগের তুলনায় ভার হয়ে গেল । নীলুর অনুপস্থিতি মিহুকে চরমভাবে পোড়াচ্ছে । হাতটা জ্বালা পোড়া করতেই ক্রীমটা খুঁজতে লাগল । সহজেই খুঁজে পেল । ক্রীম লাগানোর পরে মিহু চলে গেল কিন্তু কি মনে করে আবার ফিরে আসল । নীলুর ল্যাপটপ টা খাটে পড়ে আছে । বাড়ি থেকে বের হবার আগে নীলু ল্যাপটপে কিছু করছিল তারপর আর ল্যাপটপ টা জায়গা মতো রাখা হয় নি । ল্যাপটপ টা উঠিয়ে রাখার আগে একবার চেক করলো । তেমন কিছুই পেল না । বের হবার আগে আরেকবার চেক করে একটা ফাইল পেল যেখানে কিছু ডকুমেন্টের মতো ছিল । একটা ওপেন করতেই দেখলো সেখানে কিছু লেখা রয়েছে

‘ আজকে আমি অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি । আরফান ভাইয়া আমাকে মানা করেছে আমি যাতে ভাবির দাদুর রুমে না ঢুকি । মানে যাতে ভাবির মায়ের আসল ডায়েরি টা না খুঁজি কিন্তু আমি ভাইয়ার এই কথাটা মানতে পারব না । কারণ ডায়েরিটা না পেলে আমরা তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাবো না । আর জানতেও পারবো না কেন ভাবির মাকে তার দাদু মেরে ফেলেছে । আমি সবার অজান্তে তার রুমে ঢুকতে যাচ্ছি । সেখানে শুধু একটা হিডেন ক্যামেরা লাগিয়ে আসবো । আমি আসলে কথা গুলো লিখে রাখছি যাতে আমার কিছু হয়ে গেলেও প্রমাণ থেকে যায় । ‘

মিহু কথাগুলো পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেল । মিহুর মা মারা যায় নি ? ওর দাদু তাকে মেরে ফেলেছে? এসব কি ? এগুলো কি সত্যিই? না হলে নীলু নিছের জীবন বাজি রাখবে কেন ? আর আরফান এগুলো জেনেও ওকে বলেনি কিছু । সত্যতা যাচাই করার জন্য নীলুর সব লেখা গুলো পড়ল । তারপর সেখানের তথ্য ব্যবহার করে দেখতে পেল স্ক্রীনে ওর দাদুর রুম দেখাচ্ছে । একদম স্পষ্ট । তবে শুধু ফ্লোর ই দেখা যাচ্ছে । মিহু তখন পিহুকে কিছু না বলেই ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ।

———

থানায় এসে আরফানের তেমন কোনো উপকার হচ্ছে না । আরফান মিহুর দাদুর বিষয় টা তাদের কে বলতে চাচ্ছে না । কারণ ও মুখোমুখি হতে চাচ্ছে মিহুর দাদুর । আর এই জন্য পুলিশেরা আরফানকে সন্দেহ করছে । আরফানের করার কিছু নেই কারন এই পুলিশের কাজই হচ্ছে সন্দহ করা । তাই তাদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই । আরফানকে যেতে বললেও আরফানের ফোনের সাথে তারা কানেক্ট করে রেখেছে । কেউ ফোন দিলেই তাদের কাছেও ফোন চলে আসবে । আরফান তাদের কাজে লাধা দিল না ।

তাদের সামনে বসেই আরফানের ফোনে ফোন এলো । আরফান রিসিভ করে শোনার পরে দ্রুত রওনা দিল । খারাপ চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে । একজন পুলিশ ও আরফানের সাথে গেল ।

আরফান বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয়ে দেখলো রান্না ঘরের অবস্থা বেহাল । সব কিছু এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । আরফানের চাচি পিহুর পাশে বসে আছে । পিহু কান্না চোখে আরফানের দিকে তাকিয়ে বলল

– ভাইয়া মিহুকে কোথাও দেখছি না

আরফান গম্ভীর কন্ঠে বলল – কি হয়েছে প্রথম থেকে খুলে বলো

– আমি আর মিহু রান্না ঘরে ছিলাম তারপর মিহুর বেখেয়ালির কারণে ওর হাত কেটে যায় । অনেক রক্ত পড়ে । ও ওপরে চলে যায় হাত পরিষ্কার করতে । কিন্তু আমি ওর রক্ত দেখে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাই । চুলোর ওপরে রান্না বসানো ছিল তাই আগুণ ছড়িয়ে পড়েছিল কিন্তু তার আগেই অ্যালার্ম বেজে ওঠে আর কাকিমণিরা চলে এসে আগুন নিভিয়ে ফেলে । কিন্তু আমার জ্ঞান ফেরার পরে মিহুকে আর কোথাও দেখতে পাইনি ।

পিহুর কথা অনুযায়ী মিহু ওপরে গিয়েছিল । আরফান ওদের রুমে ঢুকে অনেক কিছু এলোমেলো দেখে তারপর নীলুর রুমে ঢুকে ওর ল্যাপটপ বের করা দেখে চালু করে একটু খোঁজার পরেই বুঝে যায় মিহু কোথায় গিয়েছে আর নীলুর এই অবস্থার জন্য যে মিহুর দাদুআ দায়ী সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে যায় ।

———–

মিহু ওর দাদুর রুমের ভেতরে অবস্থান করছে । এখানে সব কিছু এতো গোছানো কেন ? কিছুটা এলোমেলো থাকার কথা । দুইদিনে কেউ বাসায় নেই তাহলে কিছু হলেও ধুলোবালি জমার কথা কিন্তু এটা একদম পরিষ্কার । মনে হচ্ছে কেউ পরিষ্কার করে গিয়েছে । রাতে যখন এসেছিল তখন এরকম ছিল না । কেউ এসে পরিষ্কার করে গিয়েছে । মিহু হঠাৎ করেই কারো কথার আওয়াজ শুনতে পেল । তাই একটা ভালো জায়গায় লুকিয়ে পড়ল যেখান থেকে কথা ভালোভাবে শোনা যায় ।

– মা দেখেছো রুবেল আঙ্কেল দরজা খুলে রেখে গিয়েছে । এসব দেখলে তো আরো সন্দেহ করবে ।

– রুবেল তো ওরকমই । কিন্তু ওকে আবার আসতে বলেছিলি কেন ?

– আরে নীলুকে যে আটকে রেখেছিলাম সেখানের ওর শাড়ির ছেড়া অংশ ছিল । সেটা আমি এসে আগেই ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলাম । তারপর আঙ্কেলকে এসে নিয়ে যেতে বলেছিলাম কারণ পুলিবের সন্দেহ হলে আবার আসতে পারে ।

– তুই ছিলি কই ?

– দাদুর গোডাউনে

– সে ভালো কথা । তোর দাদু কি গোডাউনেই আছে নাকি অন্য কোথাও ?

– ওখানেই আছে

– কিন্তু নীলু যে ঐ রিস্কি জায়গা থেকে কি করে পালালো বুঝলাম না

– নীলু বহুত ধড়িবাজ মেয়ে । পাসওয়ার্ড জেনে ফেলেছে । তাই সহজেই পালিয়েছে । দেখেছো একদম মিহুর মায়ের মতো অবস্থা হয়েছে । বেশি চালাক করতে গিয়ে মরছে ।

– ওর মা তো আগেই সব জানত শুধু বলেনি । কিন্তু যাই বল না কেন ওরা দুই বোন একটুও ওদের মায়ের মতো হয় নি ।

– ওরা দুবোন কিভাবে ? পিহুকে তো ছোট চাচ্চু পালতে এনেছে । ওরা সত্যিকারে জমজ নাকি ?

– তোর ছোট চাচ্চুও কম চালাক না । তার বাবা যদি জানতো যে পিহু ও তার মেয়ে তাহলে একজনকে মেরে ফেলত । তাই পিহুকে পালক মেয়ে বলেছে ।

– আমি বুঝলাম না বিষয় টা মা । কাহিনী টা বলোতো

– তোর ছোট চাচ্চু মিহু পিহু হওয়ার সময় সব জেনে গিয়েছিল কিন্তু তোর দাদু বলেছে সে যদি চুপ থাকে তাহলে তাকে কিছু বলবে না । তাদের যে জমজ বাচ্চা হবে তার একটি রেখে দিতে হবে অন্য টি হয় বেঁচে দিতে হবে না হয় মেরে ফেলতে হবে । তোর চাচ্চু করেছিল কি পিহুকে আরেক বেডে রেখে হাসপাতাল থেকে একটা মরা ছেলে সন্তান এনে সবাইকে বলেছিল যে তার ছেলে মারা গিয়েছে ।

– পিহুকে নিল কেন ?

– আরে মিহুর চেহারার সাথে প্রিয়ন্তির মিল আছে না ! মিহুকে সরালে তো তোর দাদু বিষয় টা বুঝে যেতো । তাই পিহুকে সরিয়েছে ।

– তাহলে মিহুর সাথে খারাপ ব্যবহার করত কেন ?

– তোর দাদু বলেছে করতে যাতে মিহু তোর দাদুকে বেশি বিশ্বাস করে ।

– মা তুমি এতসব কীভাবে জানলে ? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে যে তুমিও ওর মায়ের খুনে জড়িয়ে ছিলে ?

তুলির মা চোরা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে । পরে তুলির জেদে স্বীকার করে যে ওর কথা ঠিক ।

– আরে আমি মিহুর মায়ের কেবিনে ঢুকে তোর দাদুর দেওয়া ইন্জেকশন টা দিয়ে দেই । ঐটা দিলে নাকি ওর শরীরে ভাইরাস ঢুকে ওকে ধ্বংস করে ফেলবে । কিন্তু বিষয় টা আবার বিদিশার মা দেখে ফেলে কিন্তু সাহস না থাকায় কাউকে বলতে পারেনি

– তুমি যখন জানলে মিহু পিহু দুজনে বোন তখন দাদুকে বললে না কেন ?

– কারণ কবিরও দেখেছিল আমি প্রিয়ন্তিকে ইন্জেকশন দিয়েছি । ও কথা দিয়েছে যদি পিহুর বিষয় টা গোপন রাখি তাহলে ও প্রিয়ন্তির কথা বলবে না ।

তুলি হাতের তালি দিয়ে বলল – জিনিয়াস মা তুমি একটা জিনিয়াস । আচ্ছা তুমি মিহুর মাকে এত ঘৃণা কর কেন ? শুধু তাদের জন্য বাবা মারা গিয়েছে তাই ?

– ও তো তোর বাবাকে ফাসিয়ে দিয়েছে । সে যাই হোক তুই ও কিন্তু কম না ! নীলুকে যেভাবে ওখানে নিয়েছিলি

– কেন তার আগেই তো প্রমিকেও নিয়েছিলাম । ঐ যে একটা মেয়ের কিডনি আগেই ড্যামেজ ছিল সেটার জন্য একটা বাড়তি মেয়ে লাগল না ? তখনই তো প্রমিকে আনলাম

মিহু আর শুনতে পারল না । ছি ছি করতে করতে বের হয়ে আসল । বলল – কি করে পারলে তোমরা এত কিছু করতে ? তোমাদের কি বিবেক আর মন বলতে কিছু নেই ? তোমরা তো পশুর চেয়েও অধম

তুলি আর ওর মা চমকে গেল । মিহু এখানে আসলো খি করে ? তুলি তোতলাতে তোতলাতে বলল – তুই এখানে এসেছিস কি করে ? আর তুই সব শুনে ফেলেছিস ?

– শুধু শুনিই নি রেকর্ড ও করেছি বলে হাতের ফোনটা দেখায় । আর তখনই তুলির মা একটা ফুলদানি উঠিয়ে মিহুর মাথায় জোরে বাড়ি মারে । মিহু সাথে সাথে জায়গায়ই অজ্ঞান হয়ে যায় ।

– মা একে কি করবে ? সব তো জেনে ফেললো ।

– এক কাজ করি চল ওকে মেরে চেহারা থেতলে দেই তারপর মেয়েদের মধ্যে মিলিয়ে দেব যাতে তোর দাদু চিনতে না পারে

– কিন্তু দাদু তো নিষেধ করেছে মিহুর কিছু করতে ।

– তুই তোর দাদুর কথা মানবি ? এখন সুযোগ এসেছে মিহুর ওপর সব প্রতিশোধ নেওয়ার ।

– তুমি ঠিকই বলেছো ।

একটা গরম স্ত্রী মেশিন এনে চালু করল । তারপর মিহুর চেহারার সামনে ধরে বলল – মিহু চির জীবনের মতো গুড বাই । আমার জীবন থেকে সব কিছু কেড়ে নেওয়ার শাস্তি ভোগ করবি একটু পরে ।

#চলবে