#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_১০
#মোহনা_হক
‘রুয়াত নিস্তব্ধ। একটা মানুষ অসুস্থ কিভাবে এসব কথা বলতে পারে ভেবে পায় না সে। আবারও ফেঁসে গেলো নিজের কাজে৷’
-‘মেডিসিন খেয়ে নিবেন রাখছি।’
‘কল কেটে দিলো রুয়াত। ভালোর কথা জিগ্যেস করতে গিয়েছিলো সে লোকটা এভাবে তাকে
লজ্জা দিবে ভাবতে পারেনি। কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো।’
‘আয়াজ আনমনে হাসছে। চোখে ভীষণ ঘুম আর হৃদয়ে প্রেয়সীর ছোটাছুটি। শুধু তাকে পাওয়ার অপেক্ষা। এ অপেক্ষার যেনো শেষ হচ্ছে না। বড্ড বেশিই ভালোবাসে। আয়াজের পাল্লায় পড়ে রুয়াতের মন পরিবর্তন হওয়া শুরু করেছে। প্রতিদিন রাতে রুয়াতের জন্য তার হৃদয় পুড়ে। মেয়েটা কে কেনো এতো ভালোবাসে জানা নেই। এর উত্তর নেই। তার হৃদয়ের আনাচেকানাচে শুধু প্রেয়সীর আভাস।’
‘সকাল আটটায় রুয়াতের ঘুম ভাঙে তাও তার মায়ের ডাকে। চোখ খুলেই তার মাকে প্রথম দেখেছে। মেহরুবা কে দেখে ঘুম থেকে উঠে রুয়াত হেসে দিয়েছে।’
-‘আজ মন কি বেশি ভালো নাকি?’
‘রুয়াত হাসি বন্ধ করে দিলো।’
-‘কয়টা বাজে এখন?’
‘মেহরুবা রুয়াতের কলেজ ড্রেস আলমিরা থেকে বের করতে করতে বললো-‘
-‘আটটা বাজে। কলেজ যাবি না?’
‘রুয়াত মাথা নাড়লো। এখন থেকে কলেজ কন্টিনিউ যেতে হবে। নাহলে পড়া তো মিস করবে সাথে আরও অনেক কিছু বাকি রয়েছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে পড়লো রুয়াত। নাস্তা খেয়েই ছুটেছে কলেজের উদ্দেশ্যে। নিমি বারবার করে বলেছে আজ যাতে তাড়াতাড়ি বের হয় বাসা থেকে। রুয়াত পড়াশোনা নিয়ে আগে থেকেই সিরিয়াস। কিন্তু নিমি দু’দিন হলো সিরিয়াস হয়েছে।’
‘কলেজ এসে মাঠের এক বেঞ্চির উপর বসে আছে রুয়াত। নিমির এখনো আসার খবর নেই। দিন দিন অনেক ধোঁকা দিচ্ছে রুয়াত কে। এভাবে একা একা বসে থাকা যায় নাকি? বিরক্ত লাগছে রুয়াতের। আর কখনো নিমি তাড়াতাড়ি আসার কথা বললে আসবে না। মাথা নিচু করে মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। কলেজের অনেক স্টুডেন্টও এসে পড়েছে শুধু নিমিই উধাও। একা একা বিড়বিড় করছে আর নিমিকে বকছে রুয়াত। প্রায় একঘন্টা পর নিমি আসলো। দৌড়ে যে ক্লাসে ঢুকেছে তা খেয়াল করেছে রুয়াত। এখন ক্লাসে ব্যাগটা রেখেই দৌড় দিবে রুয়াতের কাছে। যে কথা সে কাজ। মেয়েটার অভ্যাস আর চেঞ্জ হলো না। এভাবে মাঠের মধ্যে দৌড়ালে কেমন দেখা যায়। শতবার বলার পর অভ্যাস পাল্টাতে পারলো না।’
-‘দোস্ত কেমন আছিস? আগেই সরি বলছি কারণ তুই রাগ করে বসে আছিস। আরে ভাইয়া আজ বাসা থেকে বের হতে দেয় নাই বলেছে তার সাথে যেনো আমি কলেজ আসি।’
‘রুয়াত মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এমন বহুত অযুহাত দিয়েছে সে। আর বিশ্বাস করবে না।
‘রুয়াতের এহেন কান্ড সহ্য হলো না নিমির। আজ একটাও মিথ্যে বলেনি সে। এটা ঠিক প্রতিবার মিথ্যে বললেও আজ সত্যি কথাটিই বলেছে। এখানে তো সে সম্পুর্ণ নির্দোষ।’
‘নিমি রুয়াতের হাত ধরে তারই সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।’
-‘এবার ক্ষমা করে দে বান্ধুবী। তুই কথা না বললে আমার ভীষণ কষ্ট হবে। এবারের মতো। আর যদি কখনো তোকে অপেক্ষা করাই তাহলে তুই আমার সাথে কথা বলিস না।’
‘রুয়াত নিমির বাহু ধরে উঠিয়ে তার পাশে বসালো। এইতো মেয়েটার এসব কথা শুনলে সে একদম গলে
তরল পদার্থের ন্যায় হয়ে যায়। কারও প্রতি রাগ বেশিক্ষণ পুষে রাখতে পারে না।’
-‘সব সময় এসব বলিস। এটাই কিন্তু লাস্ট। আর এমন সুযোগ দেওয়া হবে না। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নে।’
‘যাক বান্ধুবী কে তো অবশেষে রাজি করাতে পেরেছে তাতেই খুশি। নিমি জানে রুয়াত ঝাপটে ধরা পছন্দ করে না তাও সেভাবেই ধরলো। মেয়েটা রাগ করলে একদম ম’রে’ই যেতো। রুয়াতের কলেজে যেমন কোনো ফ্রেন্ড নেই তেমনই নিমির ও নেই।’
-‘আচ্ছা রুয়াত তোর ওনি কেমন আছে?’
‘ভ্রু কুচকে রুয়াত নিমির দিকে তাকালো। আজকাল নিমি কেনো জানি আয়াজের কথা একটু বেশিই জিগ্যেস করছে। কাল ও করেছিলো।’
‘রুয়াত ছোট্ট করে উত্তর দিলো।’
-‘ভালো।’
‘নিমি মিনমিন করে বললো-
-‘ভাইয়ার সাথে একটু কথা বলিয়ে দিস।’
‘নিমি আস্তে বললেও রুয়াত শুনে ফেলেছে।’
-‘কোনো একদিন।’
‘বেশ খুশি হলো নিমি। ভেবেছে রুয়াত মানা করে দিবে কিন্তু না সে মানা করলো না উল্টো রাজি হয়ে গেলো।
বেল বাজতেই দু’জন ক্লাসে ঢুকলো। আবার টানা কয়েক ঘন্টা বসে বসে ক্লাস করতে হবে।
(*)
-‘স্যার ইকরামুলের কুকীর্তির বিষয়ে আমরা না গেলেই ভালো হবে।’
‘আশরাফের কথায় চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো আয়াজের। এতো ভয় করলে যুদ্ধ জয় করবে কিভাবে?’
-‘এতো ভয় পাচ্ছো কেনো আশরাফ?’
‘আয়াজের কথায় ভয়ে মিইয়ে গেলো আশরাফ। একদিকে ইকরামুলের ভয় আরেকদিকে স্যারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আশরাফ ইকরামুলের থেকে টাকা খেয়েছে, কিন্তু আয়াজ ও তার জন্য কম করেনি। দুঃসময়ে, তার বিপদে সব সময় আয়াজ কে পাশে পেয়েছে। দোটানায় ভুগছে আশরাফ।’
-‘স্যার এখানে আমাদের জীবন নিয়ে টানাটানির ব্যাপার আছে। এসব বাদ দিলে হয়না?’
‘রাগ হচ্ছে আয়াজের। নিজেকে সংযত রেখে বললো-
-‘তুমি থেকো না। ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারো। তোমার মতো এমন লোক রেখে আমার কোনো কাজে আসবে না।’
‘উপস্থিত সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু আশরাফের মাথা উঁচু। কখনো আয়াজের চোখ দিকে
তাকিয়ে কথা বলেনি আশরাফ। আর সেই আজ মুখে মুখে কথা বলছে। অবাক হয়ে শুধু চেয়ে আছে আয়াজ।’
‘আশরাফের বর্তমান কাজ হচ্ছে আয়াজের যাবতীয় গোপন খবর প্রচার করা ইকরামুলের কাছে। চাইলে এখনই বের হয়ে আসতে পারতো কিন্তু একজনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এর জন্য অনেক টাকা পায় দিনকে দিন। যা কখনো শোধ করতে পারবে না। ‘
-‘স্যার আমি আপনার হয়ে কাজ করবো।’
-‘উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলছি আমার দলের হয়ে কাজ করতে পারলে থাকো নাহয় বের হয়ে যাও। আর যদি শুনি আমার দলের কোনো লোক কাজের হেরফের করছে বা ভয়ে কাজ করবে না, আমার গোপন তথ্য অন্য কারো কাছে প্রচার করবে তার পরিমাণ খুব খারাপ হবে। খুব খারাপ।’
‘চিল্লিয়ে উঠলো আয়াজ। সব নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সব সময় স্যারের রাগ দেখা হতো অন্য কারণে। এবার রাগ দেখেছে দলের লোকের জন্য।
‘আশরাফ নত হয়ে আছে। একবার যদি স্যার এসব জেনে যায়, যাই করুক তাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না। লোভের কারণে আজ তার এই পরিনতি। জীবদ্দশায় ভুগছে সে।’
‘বের হয়ে আসে কক্ষ থেকে। নিজের অফিসে এসে মাথা হেলিয়ে দেয় চেয়ারে। সবাই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও সাহেদ চলে আসে আয়াজের পিছন পিছন। তার কাজ হচ্ছে আয়জের সাথে থাকা।
-‘স্যার বের হবেন?’
‘মাথা উঠিয়ে টাইম দেখে। আজ কোঁথাও যাবে না। সন্ধ্যার পর যাওয়ার কথা আছে এক জায়গায়। সেখানই যাবে।’
-‘সন্ধ্যার পর।’
‘সাহেদ বের হয়ে আসলো। সে জানে এখন স্যার একটু রেস্ট করবে তাই থেকে কোনো কাজ নেই।’
(*)
‘দুপুরে ক্লাস শেষ হলো তাদের। কলেজ ছুটি। নিমি আর রুয়াত ঠিক করলো আজ ঝালমুড়ি ফুসকা খাবে। আর কাল আয়াজ বলেনি দেখা করতে আসবে আজ। ঝালমুড়ির দোকানে ঝালমুড়ি ওর্ডার দিলো নিমি।’
-‘আপুরা কেমন আছেন?’
‘রুয়াত পিছন ফিরে চায়। ওইদিনের ছেলেটা আবারও এসেছে আজ। নিমি ছেলেটা কে দেখেই চ’টে যায়।’
-‘আজ আবার এসেছো বিরক্ত করতে? তোমার কি লজ্জা নেই?’
‘রুয়ায় থামালো নিমি কে। মেয়েটা একটু বেশিই করছে। শান্ত কন্ঠে বললো-‘
-‘কি কারণে এসেছো?’
‘ছেলেটা হাসলো। যাক কেউ অন্তত তার কথা শুনতে চেয়েছে।’
-‘আমি আপনাদের বন্ধু হতে চাই আপু।’
‘নিমি যেনো আরও রেগে উঠলো। কিন্তু রুয়াত ভদ্রতা দেখিয়ে বললো-
-‘দেখো তুমি আমাদের ছোট। আমরা এমন কাউকে বন্ধু বানাতে পারবো না। রাগ করো না। দুঃখিত এবার তুমি আসতে পারো।’
‘ছেলেটাও সুন্দর করে চলে গিয়েছে। আর কোনো কথা বলেনি। কিন্তু নিমি শুরু করেছে কেনো বকা দেয়নি ছেলেটা কে। রুয়াত কোনো মতে নিমি কে বুঝিয়েছে। ঝালমুড়ি ফুসকা খাওয়ার পর রুয়াত বাসায় চলে আসে। বাহিরে প্রচন্ড গরম পড়েছে। বেশিক্ষণ বাহিরে থাকা যাবে না।’
‘আজ রুয়াতের ফুপি এসেছে। সাথে তার ছেলে মেয়ে ও এসেছে। বাসায় মেহমান আসলে রুয়াত লুকিয়ে থাকে। আজ বাসায় ঢুকতে না ঢুকতে ফুফাতো ভাই আদিবের সাথে দেখা হয়। মূলত আদিব আর ইনিমার বয়স একই। রুয়াত কে দেখামাত্র আদিব হাসে।’
-‘কেমন আছো রুয়াত?’
‘রুয়াত মাথা নিচু করে বাসার ভিতরে ঢুকে। ছোট্ট করে উত্তর দেয়-
-‘ভালো আছি।’
‘ফুপির সাথে টুকটাক কথা বলে উপরে চলে যায় রুয়াত। অনেক ক্লান্ত সে।’
‘রাত নয়টা। রুয়াত রুমে বসে পড়ছে আর হাঁটছে। অনেক চেষ্টা করার পর ও পড়া মুখস্থ হচ্ছে না। একবার বারান্দায় আসছে আবার রুমে আসছে। বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে ছিলো রুয়াত। হঠাৎ মোবাইলে কল আসাতে রুমে আসে সে। স্ক্রিনে আয়াজের নাম্বার। রুয়াত বুঝতে পারছে না অসময়ে আয়াজের থেকে কল আসার কারণ। একবার রিসিভ করেনি। ভেবেছে আর কল দিবে না কিন্তু আবারও কল আসলো। অনেক কিছু ভাবার পর কল রিসিভ করে।’
‘কল রিসিভ করার সাথে সাথেই এক গম্ভীর পুরুষালী স্বর শোনা যায়।’
-‘আমি তোমার বাসার নিচে। এক্ষুনি দেখা করো।’
‘ব্যাস এটুকু বলে কল কেটে দেয় আয়াজ। রুয়াত বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দেখা করো বললেই কি দেখা করতে হবে নাকি। আর করবেও বা কিভাবে নিচে সবাই বসে কথা বলছে। জায়গা নড়চড় করলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। টুংটুং আওয়াজে দৃষ্টি মোবাইলের দিকে যায়। আয়াজ মেসেজ পাঠিয়েছে নিচে আসার জন্য। কি করবে ভাবতে পারছে না। সবার সামনে থেকে বের হবে কিভাবে? কেউ না কেউ কিছু জিগ্যেস করে ছাড়বে। কিন্তু না যেও তো উপায় নেই। মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা টানলো। হাতের মোবাইল বুকে চেপে নিচে আসলো। বাবা মা ফুপি কেউ নেই। রান্নাঘর থেকে মেহরুবা আর রুয়াতের ফুপির গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। সোফায় আবিদ ভাইয়া বসে আছেন। সে যদি কিছু জিগ্যেস করে তাহলে কি উত্তর দিবে?
‘সাহস করে রুয়াত দরজায় পা রাখে। ওমনি আবিদ বলে উঠলো-
-‘কোঁথায় যাচ্ছো রুয়াত?’
‘দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে রুয়াত। এমন মনে হচ্ছে যেনো কিছু চুরি করেছে আর ধরা খেয়েছে। আমতা আমতা করে বললো-
-‘একটু কাজ আছে বাহিরে যাচ্ছি।’
‘ব্যস্ত হয়ে আবিদ বলে-
-‘আমি আসবো কি?’
-‘না আসার দরকার নেই।’
‘রুয়াত বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। আবিদ শুধু চেয়ে আছে। রুয়াত কখনো মুখ ফুঁটে কথা বলেনি কারও সাথে। যদি তারা নিজ থেকে কেউ বলে তাহলেই মুখে কথা ফুটে নাহলে কারও সাথে কথা বলতে দেখেনি রুয়াত কে। একটু বেশিই চুপচাপ মেয়েটা।’
‘আয়াজ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। রুয়াত আয়াজের সামনে এসে দাঁড়ায়।’
-‘কলেজ গিয়েছিলে আজ?’
‘মাথা নাড়ায় রুয়াত। মুখে কিছু বলেনি।’
-‘মুখে বলো।’
‘কথাটা একটু জোরেই বললো আয়াজ। আজ অনেক রাগ নিয়েই এখানে এসেছে সে। তবে অবুঝ মেয়েটি জানেনা কেনো আয়াজ তার সাথে জোরে কথা বললো।’
-‘জ্বী গিয়েছিলাম।’
‘আয়াজ রুয়াতের হাত ধরে। একহাত পিছন দিক থেকে পেচিয়ে ধরেছে। অতঃপর আবারও বলে-
-‘কিছু প্রশ্ন জিগ্যেস করবো। একদম সোজাসাপ্টা উত্তর দিবে। যদি আমার এক কথা দু’বার বলা লাগে তাহলে দেখবে আসল আয়াজ কেমন। দেরি করে উত্তর দিলে তোমার আর আমার মাঝের দূরত্ব কমবে। মিথ্যে বললে যে হাত পিছনে আছে সে হাতে ব্যাথা পাবে। আর সত্যি কথা বললে হাতে অধর ছুঁয়ে দিবো।’
#চলবে…