হৃদয়দহন পর্ব-০৫

0
60

#হৃদয়দহন (৫)

ভার্সিটির ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছে নীলা আর অয়ন। দুজনের প্রণয়ের বিষয়টা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। ভার্সিটিতে বিষয়টা সবাই জানলেও এলাকায় গুপ্ত রাখা হয়েছে। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে অবশ্য। নীলা’র নীল রঙ পছন্দ। তাই তার বেশির ভাগ জামার রঙ ই নীল। আজ তার পরনে নীল রঙা কামিজ। সাথে সাদা সালোয়ার আর ওড়না। চুল খোলা রাখায় অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে। যেন নীল রঙা অপরাজিতা। অয়ন দু চোখ ভরে দেখছে নিজ প্রেমিকাকে। দুজনের বাড়ি এক পাড়াতে হলেও রোজ দেখা হয়ে ওঠে না। তাই ভার্সিটির ক্লাস ফাঁকি দিতেই হলো। সহসাই নীলা বলল,”চলো না,কোথাও বসি। অনেকটা পথ চলে এসেছি।”

“ঠিক আছে। সামনের ঝিল পাড়ে চলো।”

ওরা কিছুটা এগিয়ে এসে ঝিলপাড়ে বসল। শান বাঁধানো ঝিলের মাঝে অনেক গুলো শাপলা ফুটে আছে। ওসব ই দেখছে নীলা। অয়ন ওর নজর দেখে বলল,”আমি কিন্তু গল্প উপন্যাসের প্রেমিক নই।”

নীল ভ্রু নাচিয়ে বলল,”কেন?”

“যেভাবে শাপলা দেখে চলেছ, আমি বাবা ভিজে এনে দিতে পারব না।”

“ইস, আমি বোধহয় আনতে বলেছি।”

“বলো নি, যদি বলে ফেলো। তাই আগেই জানিয়ে নিলাম।”

নীলা ভেংচি কেটে হাসল। তারপর দুজনের মাঝের দূরত্ব কমিয়ে বাহু টেনে ধরল।

“নীলা।”

“হুম?”

“আমি ফাইনাল দিয়েই জব নিয়ে নিব। যাতে দ্রুত তোমায় ঘরে আনতে পারি।”

“এত তাড়াহুড়ো করছ কেন?”

“যদি তোমার বাসায় ঝামেলা হয়?”

“সে দেখা যাবে। এখনো তো সময় আছে।”

“হুম।”

বলেই একটু থামল অয়ন। তারপর বলল,”শাপলা এনে দেই?”

“এই না। ভিজে যাবে তো।”

“আরে,কিছু হবে না।”

অয়ন সত্যি সত্যি শাপলা আনতে যাচ্ছিল। সে সময়ই কিছু মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল। একটি কণ্ঠ ভীষণ পরিচিত। অয়নের পা থমকে গেল। ও দেখল অপরা আর তার কলেজের বান্ধবী’রা ঘুরতে বেরিয়েছে। পরনে কলেজ ড্রেস। সহসাই দুজনার চোখাচোখি হয়ে গেল। অপরা’রা পা থেমে গিয়েছে। ও শুকনো ঢোক গিলতেই খেয়াল হলো একটু দূরেই নীলাপু বসে আছে। অয়ন ডেকে ওঠল।

“কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘোরা হচ্ছে?”

কথাটা শুনতে পেয়ে পেছন ফিরল নীলা। সে একটু ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অয়ন আর পানিতে নামল না। ওঠে এল। একদম অপরার বরাবর হয়ে বলল,”ক্লাস নেই আজ?”

অপরা চুপ। পাশেই ওর দুজন বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছে। অয়ন কে তারা চিনে। সিনিয়র ভাই হয়। সেই সাথে অপরার কাজিন। ওরা ও অয়নের থমথমে কণ্ঠে ভরকে গিয়েছে। নীলা এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। ইষৎ ভয় কাজ করছে তার। যদি অপরা বিষয় গুলো বলে দেয়। তাহলে তো ঝামেলা হয়ে যাবে। অয়ন বেশ রেগে গেছে। অপরা বরাবরই পড়াশোনায় ফাঁকি দেয়। মেয়েটি’র চুল টেনে ধরল ও।

“কথা বলছিস না কেন?”

“ব্যথা পাই তো। চুল ছাড়েন।”

“ব্যথা তো আরো দেওয়া উচিত। কলেজে না গিয়ে এভাবে ঘুরাঘুরি?”

“আপনিও তো এসেছেন।”

কথাটা চট করেই বলে ফেলল অপরা। অয়ন অবাক হলো না। মাঝে মাঝে মেয়েটি ওকে চমকে দেয়।

“আমি আর তুই এক হলাম?”

“কেন না? আমি করলেই শুধু দোষ।”

“বেশি কথা বলছিস না? একটা কানের নিচে দিব।”

বন্ধুদের সামনে অপমানে লাল হয়ে গেল অপরার মুখশ্রী। অয়ন প্রায় ধমকে মেয়েটিকে বাড়ি পাঠাল। নীলা সে দিকে তাকিয়ে বলল‍,”তুমি নিজেও তো ফাঁকি দিয়ে এসেছ।”

ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল অয়ন। নীলার ঠোঁটে দুষ্টুমি।

“আমি আর ও এক না।”

“হুম জানি। নিজের গা বাঁচানোর ধান্দা।”

ফোঁস করে দম ফেলল অয়ন। অপরাকে নিয়ে সত্যিই জ্বালা হলো। মেয়েটা পড়াশোনায় একটু বেশিই অনীহা প্রকাশ করে।

“অয়ন, অপরা যদি বাসায় বলে দেয়।”

“কী বলবে?”

“তোমার আমার সম্পর্কের বিষয়ে।”

“ও জানে নাকি?”

“দেখে গেল তো।”

“এতে প্রমাণ হয় আমরা সম্পর্কে আছি?”

“তবু। ও যথেষ্ট বড়ো হয়েছে।”

“আরে তুমি বেশি চিন্তা করছ। ও কোথায় বড়ো? এই তো ছোট্ট একটা বাচ্চা।”

নীলার চিন্তা তবু গেল না। শেষমেশ অয়ন ভরসা দিয়ে বলল‍,”বুঝলেও বলবে না। ও অন্য রকম। একটু বোকা, পড়াশোনায় ফাঁকি দিতে পছন্দ করে। তবে কারো ক্ষতি হোক, অথবা বিপদে পড়তে হবে, এমন কিছু কখনোই করে না।”

বেজায় মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরল অপরা। ছোট মা বসার ঘরেই ছিলেন। অপরাকে দেখে বললেন,”অপু, এত আগে বাড়ি আসলি কেন?”

মেয়েটার মিথ্যে বলা ছাড়া উপায় নেই। তবে ভয় অয়ন ভাই এসে যদি বলে দেয় সব। ও মনমড়া করে রইল।

“এই অপু।”

ছোট মা বাহুতে হাত রেখে ডাকলেন। অপরা ফোঁস করে দম ফেলল।

“ভালো লাগছিল না গো। তাই চলে এসেছি।”

“শরীর খারাপ করল নাকি?”

কথাটা বলেই কপালে হাত রাখলেন তিনি। অপরা আরেক দফায় নিশ্বাস ফেলল।
“না। ঠিক আছি। আমি ঘরে যাই।”

অপরা চলে গেল। ষোলো বছর বয়সী হেংলা দেহের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ে। চুল গুলো ভারী সুন্দর। দুই বিনুনি করাতে আরো দারুণ লাগছে। ছোট মা সে দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছু সময়। তারপর নিজের কাজে ব্যস্ত হলেন।

কিয়ান নিজ ঘরেই ছিল। সারাক্ষণ আঁকাআঁকিতে ব্যস্ত। মা এসে বললেন,”তোর কী আর কোনো কাজ নেই কিয়ান?”

“কিছু বলবে মা?”

“বললাম ই তো।”

“সেটা তো শুনেছি। আমি তো কাজ করছি, তাই না?”

“করছিস সেটা ঠিক আছে। তবে এই আঁকাআঁকি থেকে যা রোজগার হয় সেটা দিয়ে তো তোর ই চলে না। বিয়ে করতে হবে না?”

“যখন করব, তখন দেখা যাবে।”

ছেলের কথায় তিনি হতাশ হলেন। এই বাড়ির ছোট গিন্নি সে। তবে সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন আগে ভাগেই। তখন পরিস্থিতি ছিল ভীষণ খারাপ। বাজারে যে মিষ্টির দোকানটা ছিল, সেটায় আগুন লেগে গিয়েছিল। রাতারাতি সব শেষ হয়ে গেল। তারপর কত কষ্টে দিন গেল তাদের। দোতলা এই বাড়িটা ছিল বিধায়, অন্তত মাথা গোজার ঠাই টা হয়েছে। নতুবা যে কি হতো। হয়তো দুধের শিশু নিয়ে রাস্তায় ঘুরতে হতো। তিনি বড়ো একটি নিশ্বাস ফেললেন। তারপর ছেলের মাথায় হাত রাখলেন।

“বাবা, ছাব্বিশ হয়ে গেছে তোর। বিয়ের কথাটা ভেবে হলেও কাজের দিকে মন দিস? আর যাই হোক, অন্তত দোকানে তো বসতে পারিস।”

“এক দোকানে কজন বসব মা? বাবা-চাচ্চু তো বসেই। বড়ো অর্ডার থাকলে, তখন তো আমি যাই।”

তিনি আরেক দফায় হতাশ হলেন। ছেলেকে বোঝাতে পারছেন না, সংসারের খরচ দিন কে দিন বেড়ে যাচ্ছে। সবার হাড়ি এখন এক সাথেই আছে। তবে বাড়িতে নতুন বউ’রা আসলে, তারপর নতুন অতিথি’রা আসলে, তখন তো এক হাড়ি সম্ভব হবে না। তিনি আজকাল এসব নিয়ে বেশ চিন্তা করেন। আর এতেই ভেতরটা কেমন করতে থাকে। কিয়ান মায়ের অবস্থা দেখে বলল,”ঠিক আছে। আমি দেখছি কি করা যায়।”

অপরা চা বানিয়েছে। সে এখন চা বিলি করছে। ঘরে কিয়ান ভাইয়ের সাথে ছোট মা কে পেয়ে যাওয়াতে হাসি ফুটল অধরে।

“আরে বাহ! মা – ছেলের গল্প চলছে?”

ছোট গিন্নি, অধর প্রসারিত করলেন। বললেন,”এই ভরা দুপুরে চা কেন বানিয়েছিস অপু?”

“শুধুই খেতে ইচ্ছে করল। বেশি হলো বিধায় দিতে এলাম।”

কিয়ানের দিকে চা বাড়িয়ে দিল অপরা। তারপর ছোট মা কে বলল,”তুমি নাও।”

“না রে। আমি খাব না।”

“বেশি হয়ে গেল তো।”

“দু কাপ ই খেয়ে নে। আমি যাই। কত কাজ।”

তিনি ওঠে চলে গেলেন। কিয়ানের সমস্ত ঘরে রঙের গন্ধ মিশে আছে। অপরা বুক ভরে ঘ্রাণটা টেনে নিল।

“রঙের ঘ্রাণটা কি যে দারুণ লাগে কিয়ান ভাই। মন চায় এই ঘর ছেড়ে কোথায় না যাই।”

ওর কথায় হাসল কিয়ান। তারপর বলল,”সেটা তো হবে না অপু।”

“কেন, কেন?”

“তুমি তো আমাদের অয়নের বউ।”

এ কথায় ফিক করে হেসে ফেলল অপরা। তারপর বলল,”ওসব বাজে কথা কিয়ান ভাই। আমি কারো বউ টউ নই।”

“কেন? রাগ হয়েছে নাকি?”

“রাগ কেন হবে? আসলে ছোট বেলায় কি এক বোকার মতন বলে ফেলেছিলাম, বিয়ে করব অয়ন ভাই। সেই থেকে সবাই খ্যাপাতে শুরু করল।”

কিয়ান চা কাপে চুমুক বসাল। স্বাদটা খারাপ নয়। তবে আহামরিও নয়। চলে যাওয়ার মতন।

“অয়নের সাথে তোমার বিয়ে হলে তো ভালোই হবে। দাদিজান ভীষণ খুশি হবে।”

“ধুর, কি যে বলেন। অয়ন ভাই আর আমি? আকাশ আর পানি।”

এ কথা বলেই আরেক দফায় হাসতে লাগল অপরা। কিয়ান মাঝ থেকে বলল,”তুমি কিন্তু অজান্তেই একটা জিনিস মিলিয়ে ফেললে।”

“কী?”

“আকাশ আর পানি। মেঘ কিন্তু পানির ই একটা রূপ। সে আকাশেই ঘুরে বেড়ায়।”

অপরা থমথমে মুখশ্রী নিয়ে চেয়ে রইল। কিয়ান চা কাপটা রেখে বলল,”চায়ের জন্য ধন্যবাদ।”

আপরা কিছু বলল না। চা কাপ নেওয়ার সময় সহসাই তার চোখ গেল আড়ালে রাখা ছবিটার দিকে। সেটা লক্ষ্য করে কিয়ান বলল,”অপু, আমি একটু কাজ করব। তুমি এখন যাও।”

অপরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তবে তার চোখটা যেন সরছেই না। পেন্টিংটা দেখার লোভ হচ্ছে। অথচ মুখ ফুটে বলতে পারছে না।

চলবে…
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি