হৃদয়দহন পর্ব-১৮

0
54

#হৃদয়দহন (১৮)

দুদিন বাদে অপরা’র মন মেজাজ পুরো শান্ত হয়ে গেল। যে দ্বিধাটা ছিল, সেটা কেটে গিয়েছে। ও ঠিক করেছে, বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। আর সেটা শুনে কথা হেসে মেঝেতে বসে পড়েছে। এখনো হেসে চলেছে দুষ্টু কিশোরী। হাত খানা পেট চেপে রেখেছে। যেন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার মতন অবস্থা। সবটা ঠোঁট উল্টিয়ে দেখল অপরা। তারপর বলল,”তুই আমার সাথে মজা নিচ্ছিস?”

“উফ, আরেকটু হাসতে দাও। অপুবু, তুমি আর পড়াশোনা? আমি ভাবছি চাঁদ আজ কোন দিকে ওঠবে। পূর্ব নাকি পশ্চিম।”

অপরা ঠোঁট উল্টিয়েই চেয়ে থাকে। কিয়ৎকাল যাওয়ার পর দম ফেলে। কথা’র পাশে বসে বলে,”সত্যিই আমি এবার পড়াশোনা করব।”

মন খারাপের সুর। কথা সরল চোখে চায়। কয়েক পলক দেখে নিয়ে অপরার কপালে হাত ঠেকায়।

“তোমার কি শরীর খারাপ?”

“আবার মজা নিচ্ছিস?”

“না। মজা নিচ্ছি না। তুমি হুট করে পড়াশোনা কেন করতে চাও?”

এই বিষয়ে থেমে যায় অপরা। সত্যিই তো, হুট করে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে চাচ্ছে কেন? অপরা জবাব না দিয়ে ভাবে। ভাবতে থাকে কয়েক দিনের ঘটনা। রুবিনাবু, নীলাপু, কিংবা অয়ন ভাই, কিয়ান ভাই। সব মিলিয়ে আরো একবার জটিলতা তৈরি হয়। অপরা ফোঁস করে দম ফেলে। বসা থেকে ওঠে গিয়ে বলে,”পড়াশোনা করতে মন চাচ্ছে। এর জন্য কোনো কারণ থাকে কী?”

“হুম, সেটাও ঠিক। যাক ভালোই হলো। এখন থেকে অপুবু, আর ফেইল করবে না।”

শেষ কথায় বেকুব বনে যায় অপরা। হিস হিস করে বলে,”কী বললি তুই? আমি ফেল করেছি আগে?”

কথা বুঝে পরিস্থিতি খারাপ। অপুবু’র খুব লেগেছে। তবে ও মজা নিতে ফের বলে,”বাহ রে, করেছই তো। লাস্ট বার বাংলায় পেলে ৩৯। এটাকে পাস করা বলে? বাংলায় কেউ ৩৯ পায়?”

আরেক দফায় রাগিয়ে দেয় কথা। অপরা এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”দাঁড়া বেয়াদব। দেখাচ্ছি মজা।”

অপরা যেই না ধরতে যায়, ওমনি ছুট লাগায় কথা। চিল্লাতে থাকে ‘ও মা’ বলে। ছুটতে ছুটতে অপরাও বলে,”এখন পালাচ্ছিস কেন? দাঁড়া বলছ‍ি। বেয়াদব হয়ে গেছিস। দাঁড়া বলছি।”

বলতে বলতে করিডোর দিয়ে ছুটতে থাকে অপরা আর কথা। কথা ছুটতে ছুটতে ছাদে চলে যায়। পেছন পেছন যেতে নেয় অপরাও। তবে হুট করেই একটা কণ্ঠ ডেকে ওঠে,”অপরা, এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন?”

অয়ন ভাইয়ের গলা। মানুষটা সব জায়গায় বাঁধা দেয়। অয়নের কণ্ঠে পা থেমে যায় মেয়েটির। ও থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। অয়ন বেরিয়ে আসে। সে মাত্র ঘুম থেকে ওঠেছে। মেজাজ সামান্য উষ্ণ। চুল গুলো অগোছালো। সেটা হাতের সাহায্যে নাড়াচাড়া করে বলে,”পাগল ধরতে এসেছে? নাকি পেছনে কু’ত্তা লেগেছে?”

ক্ষণে ক্ষণে মেয়েটি’র মুখ ভারী হয়। যেন আসমানের মেঘ জমেছে ঐ মুখে। অয়ন জবাবের আশা করেনি। ও হাই তুলতে তুলতে বলে,”দ্রুত চা নিয়ে আয়। শরীর মেজমেজ করছে।”

এবার অপরা বলে ওঠে,”আমি কেন চা আনব?”

কথাটা ঠিকঠাক শুনেনি অয়ন। তাই একটু সময় নেয়। তারপর ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধায়,”কী বললি?”

“কিছু না।”

“যা,কুইক চা নিয়ে আয়।”

মেজাজের পিণ্ডি চটকিয়ে অপরা হনহনিয়ে চা আনতে যায়। মাঝে কিয়ানের ঘর খানা চোখে পড়ে। দরজা খোলাই আছে। কিয়ান ভাই রং তুলি নিয়ে বসেছেন। অপরা দরজায় ঠকঠক করে। কিয়ান না তাকিয়েই বলে,”কে?”

“আমি, চা খাবেন?”

“চা, বাজে তো এগারোটা।”

“নবাবপুত্র মাত্র ঘুম থেকে ওঠেছেন। চা আনার আদেশ করেছেন। আপনার জন্য আনব?”

“ও,হো, তাহলে নিয়ে এসো। চিনি কম দিও।”

“হুম।”

অপরা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চলতে থাকে। ধীর পায়ে যেতে যেতে খেয়াল করে তার পাশে কথা এসে দাঁড়িয়েছে। দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

“যা, মাফ করে দিলাম।”

“আমি তো মাফ চাই নি।”

“চাইতি তো।”

“মোটেও না।”

“তাহলে? পিঠে দুটো বসাব?”

“এই না, আমার অপুবু তো খুব মিষ্টি।”

বলেই অপরার বাহু খানা ধরে নেয় কথা। অপরাও হেসে ফেলে। এই বাড়িতে অপরার সবথেকে ভালো সঙ্গী কথা। যাকে ছাড়া ওর এক মুহূর্ত ও চলে না।

বেশ সেজেগুজে বের হচ্ছে অয়ন। আজকাল তার স্মার্টনেস আরো বেড়ে গেছে। অবশ্য বাড়বে নাই বা কেন? পাড়ার সবথেকে সুন্দরী মেয়ের সাথে যার প্রণয় রয়েছে। তাই নিজেকে সর্বোচ্চ পরিপাটি দেখানো, অনেকটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বড়ো গিন্নি ছেলের মতিগতি বুঝতে পারছেন না। তিনি সহসাই বলে ওঠেন,”ছেলেটা আমার বেশ বদ‍লে গেছে। গোছালো হয়েছে অনেক।”

জবাবে হেসে ফেলেন ছোট গিন্নি। তারপর বলেন,”সেটার পেছনে তো কারণ আছে। তোমার ছেলে তো প্রেমে মজেছে।”

এই সময়ে একটু ধাক্কা লাগে বড়ো গিন্নির। তিনি বেশ অনেকটাই চমকে ওঠেছেন। ভ্রু কুঁচকে শুধায়,”কি যা তো কথা। অয়ন আবার কার প্রেমে মজলো?”

“ওমা, জানো না তুমি? ছেলের একটু খেয়াল রাখবে না আপা?”

এই সময়ে বড়ো গিন্নি সত্যিই চিন্তিত বোধ করলেন। ছোট গিন্নি আরেক দফা হেসে তরকারিতে লবন দিলেন।

“শোনো, আমাদের অয়ন অনেক দিন ধরেই নীলার সাথে প্রেম করছে। তুমি খেয়াল করো নি সেদিন?”

“নীলা? ডাক্তারের মেয়ে?”

“হুম।”

চমকের ওপর চমকে পেলেন বড়ো গিন্নি। তিনি সত্যিই বিষয়টা ধরতে পারেন নি। ছোট গিন্নি বললেন,”ছেলেটার পছন্দ আছে বলতে হয়। কাজের কাজ করেছে। পাড়ার সব থেকে সুন্দরী মেয়ে।”

বড়ো গিন্নি চুপ করে থাকেন। জবাব দিতে পারেন না। ছেলে’র এহেন গতিবিধি তিনি মোটেও লক্ষ্য করেননি। অথচ বিষয়টা যে অনেকেই জানেন, তা ছোট গিন্নির কথাতেই বোঝা যায়। তবে কি তিনি মা হিসেবে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন?

অপু খাবার খেয়ে সবে ওঠেছে। ওমনি শুনল নুহাশ পড়াতে আসবে। মেজাজটা গরম হলো ওর। দুপুরের এই সময়টা ঘুরে বেড়ানোর কথা ছিল। অথচ লোকটা কী না পড়াতে আসবে! বেচারি’র কান্না পাচ্ছে। সেই জন্যই মুখটা ওমন করে আছে। সেটা বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে ফেলল কথা। বই পত্র নামিয়ে নিতে নিতে বলল,”অপুবু, আমি বলেছিলাম তুমি পারবে না।”

কথার কথা শুনে, ভরকাল মেয়েটি। সেই সাথে স্মরণ হলে সকালেই বলেছিল পড়াশোনায় মনোযোগী হবে। অথচ এই দুপুরের শেষ বেলাতেই মন যে বেইমানি করবে, সেটা কী জানত সে? জানত তা। আর তাই তো বেশ জোর দিয়ে বলেছিল কথা গুলো। এখন আর কিছু করার নেই। অপু লুকিয়ে শ্বাস ফেলে। বই গুলো হাতে তুলে বলে,”তুই বেশি বুঝিস। আমি তো পড়তেই চাচ্ছি।”

কথা জানে, অপুবু চাপের মুখে সত্য গোপন করে চলেছে। এখন ঘাটাতে গেলে, ঝামেলা আরো বাড়বে। ও বরং নিজের বই গুলো নিয়ে পড়ানোর রুমে গিয়ে বসল। অপু উদাস ভরা নয়নে জানালা দিয়ে চেয়ে আছে। এখান থেকে জারুল গাছটা দেখা যায়। সেই গাছে একটা পাখির বাসা আছে। সেখানে সুন্দর একটা সংসার ওদের। পাখির সংসার। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে দেখতে অপরা কেমন ঘোরে ডুবে গেল। এদিকে নুহাশ এসে পড়েছে। কথা সুন্দর মতন সালাম দিয়েছে। নুহাশ উত্তর দিয়েছে। তবে, অপরা। তার কী কোনো ধ্যান আছে? নেই। সে তো ঘোরে বুদ হয়ে আছে। নুহাশ কিছু সময় অপরাকে দেখল। মেয়েটার চোখের দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকাল। বুঝল পাখির বাসার দিকে চেয়ে আছে।

“কথা, এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো তো। ঠাণ্ডা পানি।”

কথা মুহূর্তেই ওঠে চলে গেল। এবার নুহাশ নিজের অবস্থান থেকেই অপুকে উদ্দেশ্য করে বলল,”পাখির বাসা দেখছ যে, পাখি হতে মন চায়?”

প্রথম দফায় অপরা বুঝে ওঠে নি। তবে কিয়ৎকাল যেতেই কথাটা বুঝতে পারে। সেই সাথে কিছুটা চমকে তাকায়। দুজনের চোখাচোখি ঘটে। নুহাশ দৃষ্টি সরিয়ে বলে,”তুমি খুব উদাসীন থাকো। এভাবে পড়াশোনা হবে কী?”

অপু জবাব দিতে পারে না। তার পূর্বেই পানির গ্লাস হাতে নিয়ে কথা বলে,”অপুবু তো শপথ করেছে।”

নুহাশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পানির গ্লাস হাতে তুলে দিয়ে কথা ফের বলে,”অপুবু বলেছে এখন থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে।”

“তাই নাকি?”

এবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নুহাশ। এদিকে অপরা কটমট করে চায় কথার দিকে। কিছু বলতে পারে না। নুহাশ পানি পান করে বলে,”যাই হোক, পড়াশোনা ঠিক মতন করতে হবে। জীবনে পড়াশোনার দরকার আছে। দেখো, নিজের পায়ে আমরা অনেক আগেই দাঁড়িয়ে গিয়েছি। তবে, সামাজিক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো বলতে ভালো একটা জবকে বোঝায়। রোজগার করাকে বোঝায়। সেটা পাওয়ার জন্য পড়াশোনা মাস্ট। বিকল্প আছে, তবে বিকল্প পথ অনেক কঠিন। সবাই কিন্তু বিকল্প পথে সফল হয় না। তবে পড়াশোনা করলে, সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।”

এত গুলো কথার মানে কথা কি বুঝল কে জানে, সে খুব করে মাথা দোলাল। যেন সবটা বুঝেছে। এদিকে অপরা, তার মোটা মাথায়, কোনো কথাই প্রবেশ করতে পারে নি। ওর মন আজ সত্যিই উদাস হয়ে আছে। সময়ে অসময়ে মুডের পরিবর্তন ঘটে।

নীলা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। অয়ন এসেই ওর গা ঘেঁষে বসল। মেয়েটির হাত খানা হাতে তুলে নিয়ে বলল,”দ্রুত, একটা ব্যবস্থা করব ভেবেছি। তার আগে কিয়ান ভাইয়ের বিয়েটা হওয়া দরকার।”

“তাড়াহুড়ো’র কী আছে? আমার তো অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।”

“আমার ভয় হয়।”

“একটু বেশিই ভয় পাও তুমি।”

নিজের হাত খানা অয়নের গালে ছোঁয়াল নীলা। মৃদু হাসি এল দুজনের অধরেই।

“ক্লিনসেভ করা হয় নি। করে নিব।”

“উহু, এভাবেই তো ভালো লাগে। অল্প অল্প খোঁচা দাড়িতে তোমায় বড়ো বড়ো লাগে।”

“তোমার বুঝি বড়ো ছেলে পছন্দ?”

“উহু, আমার শুধু তোমাকে পছন্দ।”

“তুমি এভাবেই আমাকে অধৈর্য করে দিচ্ছ নীলা। এই ভালোবাসাটা হারাতে চাই না।”

অয়নের কণ্ঠের খাদ নেমে এসেছে। ভয় ঠেকে কণ্ঠতে। ওকে ভরসা দিয়ে নীলা বলে,”হারাবে না। আমরা হারাতে দিব না। ঠিক আছে?”

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি