হৃদয়দহন পর্ব-২৪

0
64

#হৃদয়দহন (২৪)

চুপিসারে কিয়ানের ঘরে উপস্থিত হলো কথা। ভাইয়ের সাথে অনেকদিন হয় কথা হয় না। বড়ো ভাই হওয়াতে,একটা দূরত্ব রয়েছে। কথা ছোট ছোট পদক্ষেপে ভাইয়ের কাছে এসে দাঁড়াল। কিয়ান মন দিয়ে ছবি আঁকছিল। একটা শান্ত নদী। তার পাশে কাঁশফুল দেখা যাচ্ছে। নদীর জলে ছোট্ট একটা নৌকা। সেই নৌকায় সুন্দর একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা’র মন খারাপ। নিঁখুত তার কাজ। কথা অস্পষ্ট ভাবে বলল,”কী সুন্দর।”

এবার কিয়ানের কানে কণ্ঠটি পৌঁছাল। ও পেছন ঘুরে বলল,”কখন এসেছিস?”

“এই তো এখনই।”

“ছবিটা ভালো হয়েছে?”

“অনেক বেশি সুন্দর।”

“আরো কিছু ছবি করা হয়েছে। ঐ যে ওখানে।”

কথা এগিয়ে গিয়ে ছবি গুলো তুলে নিল। একটা একটা করে দেখতে লাগল।

“দিন কে দিন তোমার হাতের কাজ আরো ভালো হচ্ছে।”

“আমার ও তাই মনে হয়। এই ছবি গুলো অর্ডারের। শহরে যাবে। নতুন বাঙালি রেস্তেরাঁ খোলা হচ্ছে। ডেকোরেশনের কাজে এগুলো ব্যবহার হবে।”

কিয়ান বলে গেলেও কথা সেসবে ধ্যান দিল না। সব গুলো ছবি দেখে নিয়ে পুনরায় ভাইয়ের কাছে এসে দাঁড়াল। ছেলেটা ক্যানভাসের ওপর রং তুলির সাহায্যে সুন্দর সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে। দেখলেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

একটা মন খারাপ নিয়ে ফিরল কথা। সে কিছু বলতে পারে নি। বলতে পারে নি রুবিনাবুর কথা। দুঃখ, হতাশা নিয়ে অপু’বুর কক্ষে এসে দেখতে পেল মেয়েটা ঘুমিয়ে রয়েছে। ঘড়ির কাটা একটায় ঠেকেছে। অথচ এই মেয়ের ঘুম ছোটে না।

“অপু’বু।”

বাহুতে স্পর্শ করে ডাকল কথা। অপু’র সাড়া নেই। কয়েকবার ডাকল কথা। ধীরে, ধীরে চোখ মেলল মেয়েটা। তবে বেশি সময় চেয়ে থাকতে পারল না।

“কথা?”

“হ্যাঁ। আর কত ঘুমাবে?”

“একটু ঘুমাই রে। চোখ জ্বালা করছে। রাতে ঔষধ খেয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ঘুম না হলে মা রা যাবো।”

“উফ। ওঠো না।”

“পরে ওঠি।”

“না। এখনই ওঠো।”

হাজার চেষ্টা করেও কথা লাভ করতে পারল না। অপরা ঘুম থেকে ওঠল না। তাই মন খারাপ নিয়েই ফিরল সে।

সকাল থেকেই রুবিনার হাতে পায়ে শরীরে কি সব মাখানো হচ্ছে। পাড়ার মেয়েদের ডেকে এসব মাখানোর কাজ দিয়েছেন রুবিনার মা। তিনি এখনো আতঙ্কে আছেন। মেয়েটার একটা গতি হয়েছে। এই গতি যদি কালো রংয়ের জন্য পণ্ড হয়, তবে বড়ো লজ্জায় পড়তে হবে। সব মিলিয়ে আকাশ সম বোঝা তার ঘাড়ে। শান্তি নেই অন্তরে। ঘরে অসুস্থ স্বামী। যার সবটাই তাকে সামাল দিতে হয়। এদিকে মেয়েটার বিয়ে। তিনি এমন ব্যস্ত, দেখে মনে হচ্ছে যখন তখন মাথা ঘুরিয়ে পড়বেন। এই অবস্থা দেখে অয়নের মা ছুটে এলেন।

“এভাবে তো তুমি একটা অঘটন ঘটাবে।”

“মাথায় আর খেলছে না আপা। কি করব। এত কাজ।”

“একটু জিরিয়ে নাও। আমি দেখছি এদিকটায়।”

এ কথায় একটু ফুসরত পেলেন তিনি। কাজ থেকে মুক্তি মিললেও তিনি গেলেন মেয়ের কাছে। মেয়ে থম ধরে আছে। চারপাশে ঘুরঘুর করছে পাড়ার বাকি সব মেয়েরা।

“মুখটা ওমন করে আছিস কেন? এভাবে দেলে তো তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ক্ষেপে যাবে।”

রুবিনা ছোট করে নিশ্বাস ফেলে। বলে,”হলুদের অনুষ্ঠান তো আজ নয় মা।”

“আজ নয় তো কি হয়েছে। এখন যদি এমন মুখ করে রাখিস। পাড়ার সবাই কি ভাববে?”

এ কথা বলে মেয়ের আরেকটু নিকটে গেলেন তিনি। ফিসফিস করে বললেন,”কে কখন বিয়ে ভাঙার ব্যবস্থা করবে, আমরা বলতে পারি? সাবধানে থাকতে হবে। মুখটা ওমন করে রাখিস না। আমি তোর বাবা’র খাবারটা দিয়ে আসি। কে জানে লোকটার কি অবস্থা। এত চাপ আর ভালো লাগে না।”

মা,বাবা’র কক্ষের দিকে এগোলেন। রুবি এক পলক চেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ওর চোখ দুটোয় জল নেই। অথচ, অথচ বুকের ভেতর অশ্রু’র বন্যা চলছে।

বিকেলের মিষ্টি রোদে, ছাদে এসে চুল শুকাচ্ছে অপরা। শ্যাম্পু করেছে বিধায় চুল থেকে দারুণ এক ঘ্রাণ আসছে। সেই সাথে চলছে আমের আচার খাওয়া। এক পিস খেয়ে আরেক পিস মুখে দিতেই পেছন থেকে অয়নের কণ্ঠটা শোনা গেল।
“এখানে বসে আছিস কেন? নুহাশ তো পড়াতে এসেছে।”

না ঘুরেই অপরা বলল,”জানি।”

“তাহলে?”

“পড়ব না।”

“কেন?”

“এমনি।”

অপরা কথা না বাড়িয়ে আরেক টুকরো আচার মুখে দিল। এবার অয়নের ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল।

“বিয়ে তো এখনো হয় নি, এখন থেকেই পড়াশোনা বাদ। ভালোই তো। এখন আবার চুল খুলে নায়িকা সেজে বসে থাকা হচ্ছে।”

অপরা একটা কথাও বলল না। ও নিজের মতন আচার খেতে ব্যস্ত। মেয়েটির এমন আচরণ দেখে অয়ন আহত হলো। অপরা কি তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে? কিন্তু কেন? এদিকে অপরা ভাবছে। ভাবছে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিয়ান ভাই’কে নিয়ে। সত্যিই কি তাদের বিয়েটা হয়ে যাবে? কেমন হবে সেই সংসার? সুখে ভরা, নাকি দুঃখে ভরা? এসব ভেবে ভেবে অপরা হতাশ হলো। কিয়ান ভাইকে বুঝতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে। মানুষটা সত্যিই তাকে বিয়ে করবে?

ছাত্রী আর শিক্ষক, কারোই মনোযোগ নেই। যে যার মতন বসে আছে। কথা পেন্সিল কামড়াচ্ছে। আর নুহাশ ভাবছে অপরা’র কথা। প্রথম দিন মেয়েটিকে দেখার পর, নুহাশের ভেতরটা কেমন করে ওঠেছিল। সুন্দর দুটো চোখ। বাচ্চা বাচ্চা চেহারা। কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। অথচ, গল্পটা এক পাক্ষিক। অপরা কি কখনো ভেবেছে নুহাশের কথা? ভাবার কথা কি? না তো। মেয়েটা কখনো তাকে লক্ষ্য ও করেনি। নুহাশ দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ফেলল। তারপর ওঠে দাঁড়াল। কথা তখনো অন্যমনস্ক।

“আমি আজ যাই।”

বাক্যটি শুনে ঘুরে তাকাল কথা। দাঁড়িয়ে পড়ল বসা থেকে।

“আজ আর পড়া হবে না। আরেকদিন বেশি পড়িয়ে দিব। হোম ওয়ার্ক গুলো মন দিয়ে কোরো।”

কথা শুধু মাথা ঝাঁকাল। তারপর একটা নীরবতা ডিঙিয়ে এগোতে লাগল নুহাশ। হুট করেই বলল,”অপু কি আর পড়াশোনা করবে না?”

কণ্ঠটায় কেমন একটা সংশয়। মেয়েটা না পড়লে তো চোখের দেখাও মিলবে না। কথা মিনমিনে সুরে বলল,”পড়বে তো।”

“ও, আমি ভাবলাম বিয়ে হয়ে যাচ্ছে দেখে হয়তো আর পড়বে না।”

“তেমন কিছুই না। আজ ঘুমিয়েছে খুব। একটু আগে ওঠেছে। তাই আসে নি।”

“ঠিক আছে। আমি আজ যাই। মন দিয়ে কাজ গুলো কোরো।”

নুহাশ অলস ভঙ্গিতে চলে আসে। বাড়ি থেকে বের হয়ে একবার ছাদের দিকে তাকায়। যেখানটায় অপরা বসে আছে। তার খোলা চুল গুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে।

অনেক গুলো অর্ডার ছিল। সব গুলো শেষ করে দম ফেলল কিয়ান। প্রথমবারের মতন এত গুলো কাজ পেয়েছে সে। বেশ টাকা পয়সা হবে। কিয়ানের ভালো লাগছে। ও একটু হেসে সব গুলো কাজ দেখছিল। ওমন সময় মা এসে দাঁড়ালেন।

“কিয়ান। খাওয়া দাওয়া করতে হবে না? কদিন ধরে এত কাজ কেন করছো?”

“অর্ডার ছিল মা।”

“এত?”

“হ্যাঁ।”

“নিচে আসো। খাবার খাবে।”

“আসছি।”

কিয়ান দ্রুত ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এল। এসে দেখল অপরা আগে থেকেই বসে আছে। ছোট গিন্নি খাবার বেড়ে দিয়ে বললেন,”যে যার মতন নিয়ে নিও তো। আমি যাই। বিয়ের কেনাকাটা করতে হবে। লিস্ট করছি।”

ছোট গিন্নি চলে গেলেন। টেবিলে এখন অপরা আর কিয়ান। দুজনই খাচ্ছে। অপরা একটু একটু করে মানুষটাকে দেখে যাচ্ছে। ভালো লাগার মতন ই মানুষটা। অথচ অপরা অনুভূতি পাচ্ছে না। পাবে কেমন করে। এই মানুষটার মনে তো আরেকজন। এভাবে কি ওদের সংসারটা হবে? হবে না তো। এদিকে অয়ন, নিজের কক্ষ থেকে বের হয়েছে। নীলা আসবে রুবিনাদের বাসায়। মাঝে দেখতে পেল কিয়ান আর অপরা’কে। দুজনের চাওয়ার মাঝে প্রণয়ের হাওয়া। যেন কতকাল ধরে একে অপর’কে চেয়ে এসেছে। অথচ অয়ন, কখনোই সেটা বুঝতে পারে নি।

চলবে…
কলমে~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি