হৃদয়স্পর্শী মায়াবিনী পর্ব-০২

0
145

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ২

কাক ভেজা হয়ে বাসার ফিরলো ফারিসতা। বাসার সামনে এসে রিক্সাওয়ালার ভাড়া মেটাতে গেলে রিক্সাওয়ালা ভাড়া লাগবে না বলে ফারিসতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো।

ফারিসতা সেদিকে কিছুক্ষণ হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলা উঠলো। লিফট কেনো যেনো বন্ধ যার জন্য সিঁড়ি বেয়েই উপরে উঠতে হলো। শরীরটা টেনে টুনে কোনো রকম দোতলায় উঠলো। এইটুকু উঠতে একদম হাপিয়ে গেলো যেনো। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি যেনো ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। বৃষ্টিতে কাক ভেজার জন্য হঠাৎ করে শরীর ঝাকিয়ে শীতে কেঁপে উঠল সেই সাথে মাথায় তীব্র যন্ত্রণা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। কপালের পাশটায় ব্যথায় টনটন করছে। ফারিসতা চোখ মুখ কুঁচকে ক্লান্ত হাতে কলিংবেল চাপ দিলো।

কলিংবেল চাপার সাথে সাথে ফারজানা বেগম দরজা খুলে ফারিসতাকে দেখে বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। বাহিরে বৃষ্টি নামার পর থেকে তিনি সব কাজ ফেলে রেখে চিন্তিত হয়ে ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন মেয়ের আসার অপেক্ষায়। তার চিন্তা বেড়ে কয়েকগুন হয়ে গেলো ফারিসতাকে দেখে। কপালের এক পাশে লাল হয়ে আছে, বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে আছে যেনো চোখ খোলা দায় হয়ে পড়েছে মেয়েটার। ফারজানা বেগম বিচলিত হয়ে ফারিসতার কাছে যেয়ে অস্থির হয়ে বলে উঠলো,

ফারু এই অবস্থা কেনো তোর? কপালে কি হয়েছে? কিভাবে আঘাত পেয়েছিস? আমার এই ভুল হয়েছে তোকে একা রেখে আসা। কিভাবে এমন হলো দেখি এ বলে হাত দিয়ে কাঁপালের পাশটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে তার চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো। তার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল কলিজার টুকরো মেয়েটাকে একটা পিঁপড়া কামড় দিলে তার বুক কেঁপে ওঠে সেখানে মেয়ে এত বড় আঘাত পেয়েছে ভাবতে তার চোখে পানি চলে আসলো।

ফারিসতা এত যন্ত্রণার মাঝেও স্লান হাসলো মায়ের বিচলিত ভাব দেখে। ও জানে ও একটু আঘাত পেলে সেই আঘাত ওর গায়ে না যেনো ওর জন্মদাত্রী এই মায়ের গায়ে লাগে৷ ফারিসতা দূর্বল কণ্ঠে শুধালো,

আম্মু পরে কান্নাকাটি করো এখন আগে ভিতরে যেতে দাও আমার প্রচুর শীত লাগছে।

ফারজানা বেগম আর কোনো প্রশ্ন না করে দ্রুত মেয়েকে নিয়ে ভিতরে গেলেন৷ বুকের ভিতর চিনচিন করে ব্যথা করছে মেয়ের এই অবস্থা দেখে। বার বার নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো কেনো তিনি মেয়েকে একা রেখে আসলো।

ফারিসতা কোনো রকম জামাকাপড় চেঞ্জ করে আসতে চোখমুখ ঘোলা হয়ে আসলো। শীতে শরীর থরথর করে কাপছে সাথে তীব্র মাথা যন্ত্রণায় মাথা ফেটে পড়ছে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সামনে ফারজানা বেগমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারিসতা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলো নিজের যন্ত্রণাগুলো লুকাতে। কারণ ও জানে ওর এই কষ্ট দেখলে ওর চেয়েও ওর মা বেশি কষ্ট পাবে। কিন্তু মায়েদের থেকে কি আদো কিছু লুকানো যায়? মায়েরা নাকি সন্তানের কণ্ঠে শুনলেই বুঝে যায় সন্তানের কিছু একটা হয়েছে সেখানে ওতো শয়ং জন্মদাত্রী মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে।

ফারজানা বেগম ফারিসতাকে ধরে বেডে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে কপালের পাশে আলতো করে হাত রেখে কাতর স্বরে বলল,

বেশি ব্যথা করছে?

মায়ের কাতর স্বর শুনে ফারিসতার চোখে পানি চলে আসলো। এই দুনিয়াতে ওর মা ছাড়া আপন বলতে আর কেউ নেই। এই মা সবসময় বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। ছোট বেলা খেলতে গেলে পড়ে ব্যথা পেলে ওর আগে যেনো ওর মায়ের কান্না চলে আসতো। ও এক চিমটি ব্যথা পেলে যেনো সেই ব্যথা তার বুকে যেয়ে লাগে। সেখানে আজ এত বড় আঘাত পেয়েছে। ফারিসতার নিজেরও নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কখনো এতো জোরে আঘাত পায়নি সব সময় ফারজানা বেগম আগলে রেখেছে বুকের মাঝে। আজ যেনো ব্যথাটা শরীরে কুলাচ্ছে না।

বাহিরে প্রবল বেগে এখনো বৃষ্টি নামছে। এদিকে সন্ধ্যা ও ঘনিয়ে এসেছে। এই অবস্থায় ফারজানা বেগম মেয়েকে নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। নতুন এই এলাকায় এসেছে তাই ভালো করে চেনেও না সব কিছু। তবুও তিনি বসে না থেকে ফারিসতাকে নিয়ে হসপিটালে যেতে চাইলে ফারিসতা ঘোর আপত্তি জানালো এই বৃষ্টির ভিতর এখন কোথাও যাবে না। ব্যথার ঔষধ খেলেই সেরে যাবে।

ফারজানা বেগম অনেক চেষ্টা করেও পারলো না ফারিসতাকে হসপিটালের নিয়ে যেতে রাজি করাতে। ফারিসতাকে রাজি করাতে না পেরে তিনি হতাশ শ্বাস ফেলল। এই মেয়ে ছোট থেকে জেদি আর একরোখা স্বভাবের। যেটা একবার বলবে সেটা করেই ছাড়বে। এই যে এখন হসপিটালে যাবে না বলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ছে। এখন হাজার ডেকেও এই মেয়েকে ওঠানো যাবে না জানে তাই তিনি হতাশ হয়ে ব্যথার ঔষধ জোর করে খাইয়ে দিলো।

***
চৌধুরী নীড়ে খাবার টেবিলে চলছে পিনপতন নীরবতা কারো মুখে কোনো কথা নেই। এই পিনপতন নীরবতার মাঝে কিছুক্ষণ পর পর ভেসে আসছে প্লেটের সাথে চামচের সঙ্ঘর্ষণের টুংটাং আওয়াজ।

খাবার টেবিলের এই নীরবতা যেনো ঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ তা ঢের বুঝতে পারছেন তাহমিনা বেগম। কিছুক্ষণের মাঝেই যে ঝড় উঠে যাবে ভাবতে তিনি ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলো তাজরিয়ানের দিকে। ছেলের চিন্তায় চোখমুখ শুকিয়ে যাচ্ছে তার।

তাহমিনা বেগমের ভাবনার মাঝে নীরবতা ভেঙে শক্ত গম্ভীর কণ্ঠে তিফাজ চৌধুরী তাজের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো আজো মা/রা/মা/রি করেছো?

তাজ চামচ দিয়ে খাবার মুখে নিতে নিতে নির্বিকার ভাবে জবাব দিলো জানোই তো তাহলে আবার প্রশ্ন করছো কেনো?

এমনিতে তিফাজ চৌধুরীর মেজাট চটে ছিলো এবার তাজরিয়ানের এমন ত্যাড়া কথায় তার মেজাজ এবার তুঙ্গে উঠে গেলো। তবুও তিনি নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে বলে উঠলো কেনো করেছো মা/রা/মা/রি?

কোনো কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই মা/রি/নি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল তাজরিয়ান৷

তিফাজ চৌধুরীর এবার চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। চোয়াল শক্ত করে রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠলো সেই কারণ টাই জানতে চাচ্ছি।

মা/রা/মা/রি করেছি সেটা যেহেতু নিজ দায়িত্বে জানতে পেরেছো তাহলে কেনো মে/রে/ছি সেটাও নিজ দায়িত্বে জেনে নিলে খুশি হবো।

তিফাজ চৌধুরী এবার নিজের রাগ আর ধরে রাখতে না পেরে হাতে থাকা চামচটা শব্দ করে প্লেটে রেখে চোখমুখ শক্ত করে বলে উঠলো তোমার এই উগ্র স্বভাব তুৃমি ছাড়বে না? কি ভাবো নিজেকে? নিজের পেশাকে এক পাশে ফেলে রেখে প্রতিনিয়ত এমন উগ্র আচরণ করে যাবে সেটা চুপচাপ মেনে নিবো?

আই ডোন্ট থিঙ্ক এটা উগ্র আচরণ না কজ এটাও আমার পেশা।

বখাটেপানা তোমার পেশা? আর কত ছোট করবে মানুষের কাছে আমায়? তোমার উগ্র আচরণের জন্য শহরের মানুষ সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকে কখন না কার উপরে হামলে পড়ো। ছোট বেলা থেকে যে শিক্ষায় বড় করেছি সেই শিক্ষা না নিয়ে চাচার শিক্ষা ধরে রেখেছো যার জন্য আজ এতো অধপনত।

তাজরিয়ান এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এবার আর নিজেকে শান্ত রাখতে না পেরে চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

সব কিছুর মধ্যে চাচ্চুকে টানবে না বাবা। আমি কারো শিক্ষায় বড় হয়নি আমি আমার শিক্ষায় বড় হয়েছি।

হ্যা নিজের শিক্ষায় কত বড় হয়েছো তাতো দেখতেই পারছি। তোমার এই উগ্র আচরণ আমি মোটেও টলারেট করবো না। এখনো সময় আছে চাচার শিক্ষা রেখে নিজের পেশায় মন দেও।

বলেছিনা সব কিছু মাঝে চাচ্চুকে টানবে না বলে তাজরিয়ান শব্দ করে খাবারের প্লেটটা দূরে সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত কটমট করে ফের বলল,

নেক্সট টাইম আমার ব্যাপারে চাচ্চুকে টানলে ভুলে যাবো আমার আরেক পেশাকে এ বলে হনহনিয়ে খাবার ফেলে উপরে চলে গেলো।

তাজরিয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তিফাজ চৌধুরী চেচিয়ে বলে উঠলো তোমার ওই নামের পেশায় এখন কিছুই যায় আসে না। নিজের নামের সাথে তো পার্মানেন্ট পেশা যোগ করে নিয়েছো বখাটে পেশা এখন আর ওই পেশা তোমার কিসের দরকার? একজন বখাটে আর যাই হোক অমন সম্মানীয় পেশার যোগ্য না।

তিফাজ চৌধুরীর কথা তাজরিয়ান শুনলো কিন্ত কোনো জবাব না দিয়ে সোজা রুমে যেয়ে বিকট শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো যেই শব্দে কেঁপে উঠলো ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত থাকা কিছু মানুষ।

তাজরিয়ানের কাজে তিফাজ চৌধুরী রাগে হিসহিসিয়ে তাহমিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো দেখেছো দিন দিন কেমন বেয়াদব হচ্ছে তোমার ছেলে?

তিফাজ চৌধুরীর কথায় তাহমিনা বেগম মাথা নিচু করে ফেলল। মাথা নিচু করা ছাড়া আর কি এই বা করার আছে? ছেলেকে শত বুঝিয়েও পারলো না এই উগ্র আচরণ থেকে দূরে সরিয়ে আনতে।

তিফাজ চৌধুরী এবার তার অপজিট পাশে বসা তার ভাই সৌরভ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

এবার দেখলেতো তোমার শিক্ষার ফল এ বলে তিনিও খাবার ছেড়ে হনহনিয়ে চলে গেলো।

এদিকে তিফাজ চৌধুরীর কথায় সৌরভ চৌধুরী মাথা নিচু করে ফেলল। তিফাজ, রিফাজ আর সৌরভ চৌধুরী হলো চৌধুরী বাড়ির ছেলে। তিন ভাইয়ের ভিতরে ছোট হলো সৌরভ চৌধুরী। তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তাদের মায়ের মৃত্যু হয় সেই থেকে বড় দুই ভাই আর বাবা হাতে বড় হয় সৌরভ চৌধুরী। সবার ছোট হওয়ায় সবার খুব আদরের ছিলো সৌরভ চৌধুরী। সৌরভ চৌধুরী একটু বড় হতে তাদের বাবা ও তাদের একা করে পরপারে চলে গেলো। তখন থেকে বড় ভাই তিফাজ আর মেজো ভাই রিফাজ চৌধুরীর ছায়াতলে থেকে বড় হয় সৌরভ চৌধুরী। তিফাজ চৌধুরী পশায় ডক্টর তাই তিনি চাইতেন তার ছোট ভাই ও তার মতো ডক্টর হোক কিন্তু সৌরভ চৌধুরী ছিলো কিছুটা উগ্র সভাবের। সবার আদরের ছায়াতলে থেকে কিছুটা বেঁকে গিয়েছিলো যার জন্য তিফাজ চৌধুরী শত চেষ্টা করেও পড়ালেখার দিকে তার কন্সেন্ট্রেশন আনতে পরেনি। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মেজো ভাই রিফাজের সাথে বিজনেসে জয়েন হতে বললেন এখানেও সৌরভ চৌধুরী বেঁকে বসলেন কারণ তার ঝোক ছিলো রাজনীতির প্রতি। এই রাজনীতি থেকে তাকে সরানোর জন্য কম চেষ্টা করেনি তিফাজ চৌধুরী কিন্তু কোনো কিছুতে কাজ হলো না। সেই থেকে ছোট ভাইয়ের প্রতি তার রাগ রয়ে গিয়েছে। সেই রাগ আরো দ্বিগুণ হয়েছে যখন দেখলেন তার একমাত্র ছেলে তাজরিয়ানকেও সৌরভ চৌধুরী রাজনীতির দিকে ঝোঁক আনাতে। সেই থেকে করা শাসনে ছেলেকে বড় করতে লাগলো কিন্তু সেই শেষে এসে চাচার স্বভাব এই ছেলে আয়ত্ত করেছে সেই থেকে ছোট ভাইয়ের প্রতি তার রাগ আর ক্ষোবের কোনো অংশ কমতি নেই।

এদিকে সৌরভ চৌধুরী মাথা নিচু করে বসে আছে অপরাধবোধে। ছোট বেলা থেকে সবার বিরুদ্ধে যেয়ে রাজনীতিতে জড়ালো। আস্তে ধীরে এমপির পদ ও হাসিল করে নিয়েছে তিনি। রাজনীতির পিছে ছুটতে ছুটতে তিনি নিজের দিকে তাকাতেই ভুলে গিয়েছিলো প্রায় যার জন্য বিয়ে পর্যন্ত করেনি। একটা সময় ভেবে নিলো সে বিয়ে করবে না এই রাজনীতি নিয়েই সারাজীবন পার করবে। তার লাইফে দুটি জিনিস ছিলো সবচেয়ে আপন। প্রথমত হলো রাজনীতি আর দ্বিতীয় হলো তাজ। তাজ জন্মের পর প্রথম বার চাচা হওয়ার অনুভূতিতে যেনো বাবা হওয়ার স্বাদ পেয়েছে। আর তাজ ও ছোট চাচ্চু বলতে পাগল প্রায় ছিলো। সব সময় সৌরভ চৌধুরীর সাথে থাকতো সেই থেকে আস্তে ধীরে সৌরভ চৌধুরীর সাথে তাজেরও রাজনীতির প্রতি ঝোঁক বাড়তে লাগলো। সৌরভ চৌধুরী জানতো তার বড় ভাই রাজনীতি পছন্দ করে না তাই তিনি চাইতেন তাজকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে কিন্তু তাজ ঠিক তার মতোই একরোখা আর জেদি স্বভাবের হয়েছে যার জন্য চাইলেও রাজনীতি থেকে তাজকে দূরে রাখতে পারেনি। সেই তাজ বড় হয়ে যে এতটা উগ্র হবে সেটা কখনো কল্পনাও করে পরেনি। বাবার চাপে রাজনীতিতে জড়াতে না পারলেও রাজনীতি বাপ হয়ে উঠেছে যেনো তাজ এখন। সৌরভ চৌধুরী এমপি হলেও লোকে তাকে যতটা না ভয় পায় তা চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভয় পায় তাজকে। তিনি কখনো চায়নি তাজ তার মতো উগ্র স্বভাবের হোক কিন্তু তাজ তাকেও ছাড়িয়ে কয়ক ধাপ এগিয়ে আছে ভাবতে সৌরভ চৌধুরীর মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে। অপরাধবোধ হয় তার জন্য তার ভাতিজা এতটা উগ্র স্বভাবের হয়েছে।

রিফাজ চৌধুরী সৌরভ চৌধুরীর নিচু মাথার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বলল,

ভাইয়ের কথায় কষ্ট পাস না ছোট। ভাইয়ের মাথা ঠিক নেই এখন তাজের উগ্র আচরণ দেখে তাই রাগের মাথায় ওগুলো বলে ফেলেছে।

রিফাজ চৌধুরীর দিকে সৌরভ ছলছল চোখে তাকিয়ে স্লান হেঁসে বলল,

বড় ভাই ভুল কিছু বলেনি কথাটা বলে সৌরভ চৌধুরী চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে তাহমিনা বেগম উদ্দেশ্যে বলল,

ভাবি তাজের খাবারটা আমার রুমে পাঠিয়ে দিয়ো আমি দেখছি ওকে এ বলে উপরে উঠে গেলো।

সৌরভ চৌধুরীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রিফাজ চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনিও খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলো। এখন গলা দিয়ে খাবার নামবে না তাই তিনি উঠে রেহেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলল এক কাপ চা করে পাঠিয়ো মাথা ধরেছে।

রিফাজ চৌধুরী যেতে রেহেনা বেগম তাহমিনা বেগমের কাছে গেলো যে চুপচাপ টেবিলের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। রেহেনা বেগমের তার কাছে যেয়ে কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলল,

ভাবি এতো টেনশন করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে আল্লাহ ভরসা। আপনি বসুন খেয়ে নিবেন দিন দিন না খেয়ে নিজের কি হাল করেছেন একবার দেখেছেন?

তাহমিনা বেগম কাতর স্বরে বলল, রেহেনা তুমি খেয়ে নেও আমি পরে খেয়ে নিবো। আমি তাজের খাবারটা সৌরভের কাছে দিয়ে আসি এ খাবার বারতে নিবে তখন রেহেনা বেগম তাকে খাবার বারতে না দিয়ে জোর করে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিয়ে খাবার বেরে দিলো তাকে খাওয়ার জন্য। তাহমিনা বেগম সম্পর্কে রেহেনা বেগমের বড় জা হলেও এদের মাঝে সম্পর্কটা ঠিক আপন বোনের মতো।

একে একে সবাই খাবার ছেড়ে যাওয়ার পর এখন খাবার টেবিলে উপস্থিত রয়েছে শুধু তাহমিনা আর রেহেনা বেগম। তাদের অপজিট পাশে রেহেনা বেগমের দুই জমজ সন্তান সাফওয়ান আর রুশা চুপচাপ বসে আছে। সাফওয়ান আর রুশা তাজের চেয়ে বছর খানেকের ছোট। এতক্ষণ যেই তান্ডব বয়ে গিয়েছে তাতে টু টা শব্দ না করলেও এবার বড় চাচির দিকে তাকিয়ে খুব খারাপ লাগলো সাফওয়ানের তাই গলা ঝেড়ে তাহমিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,

বড় মা আগে নিজের দিকে দিকে খেয়াল দেও কি অবস্থা করেছো নিজের? তাজ ভাইয়ের চিন্তা এক পাশে ফেলে দেও। ও দিন দিন যেই উগ্র হয়ে উঠছে তোমার দিকে আছে ওর কোনো খেয়াল?

রুশা খাবার মুখে দিতে দিতে বলল, বড় মা তাজ ভাইয়াকে বিয়ে করিয়ে দেও। দেখবে বউ পেলে শুধরে যাবে তখন তোমার মাথা থেকেও চিন্তা নেমে যাবে।

তাহমিনা বেগম হতাশ স্বাস ফেলে বলল, ছেলে কোনো কথা শুনলেতো বিয়ে দিবো।

রুশা ফের বলল, বড় ভাইয়া খুবি অদ্ভুত এক সাথে দুটো পেশা হ্যান্ডেল করছে দেখছো। একটা সবচেয়ে সম্মানীও আবার আরেকটা সব চেয়ে অসম্মানীও। ছোট চাচ্চু আর বড় চাচ্চু দুজনের দেওয়া দুই রকম শিক্ষা এক সাথে ধরে রেখেছে আমার তো বিষয়টা দারুণ লাগে বলে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।

সাফওয়ান রুশার মাথায় গাট্টা মেরে বলল এত পকপক না করে চুপ খা। তুই যেমন মাথা ভাঙ্গা তোর পছন্দ ও তেমন মাথা ভাঙ্গা।

রুশা দাঁত কটমট করে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে ঝগড়া বাজাতে যাবে তার আগে রেহেনা বেগম ধমকে উঠে বলল, এখন যদি দুইটায় আবার ঝগড়া লাগাস তাহলে মার একটাও নিচে পড়বে না।

রেহেনা বেগমের ধমকে রুশা ঠোঁট উল্টে তাহমিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, বড় আম্মু দেখেছো আগে কে বাজিয়েছে? আমি কিছু বলতে গেলেই আম্মু এমন করে।

রুশার কথায় তাহমিনা বেগম স্মিত হেঁসে বলল, হ্যারে মেজো আমার মেয়েটার সাথে এরকম করিস কেনো?

হয়েছে মেয়ের সাফাই গাওয়া লাগবে না এবার খাওয়া শুরু করো।

সাফওয়ান আর রুশার খুনসুটিতে সবার মন কিছুটা হালকা হলো। সবার খাওয়া হলে তাহমিনা বেগম দুইটা প্লেটে খাবার নিয়ে সৌরভ চৌধুরীর রুমে দিয়ে আসলো।

সৌরভ চৌধুরী খাবার নিয়ে তাজের রুমের কাছে যেয়ে দরজায় নক করলো। তাজ দরজা না খুলে সৌরভ চৌধুরীকে বলল আমাকে একা থাকতে দেও চাচ্চু।

আমি যদি তোর শুধু চাচ্চু হতাম তাহলে একা ছেড়ে দিতাম। আমি তোর চাচ্চুর আগে বেস্ট ফ্রেন্ড তাই একা ছাড়ছি না জলদি দরজা খোল। তোর জন্য আমিও না খেয়ে চলে এসেছি তাড়াতাড়ি দরজা খোল খুদায় আমার পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে।

তাজরিয়ান এবার দরজা খুলে দাঁত কটমট করে বলল কি সমস্যা?

তোকে বলতে হবে নাকি কি সমস্যা? সর সামনে থেকে এ বলে সৌরভ চৌধুরী তাজের পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে খাবার টেবিলের উপরে রেখে তাজরিয়ানের পাশে এসে দাঁড়ালো। এদের দুজনের সম্পর্ক চাচা ভাতিজার হলেও আসল সম্পর্ক যেনো বেস্ট ফ্রেন্ডের। এই বাসার ভিতরে একমাত্র সৌরভ চৌধুরীর কথা তাজরিয়ান যতটুকু মানে এ ছাড়া কারো কথার ধার ধরে না। তাইতো তিফাজ চৌধুরীর অভিযোগ সৌরভ চৌধুরীর শিক্ষা পেয়ে তাজ বেঁকে গিয়েছে কথাগুলো ভেবে সৌরভ চৌধুরী তাজের পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বলল এখনো রাগ কমেনি?

তাজরিয়ান কিছুক্ষণ সৌরভ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে থেকে চোখমুখ শক্ত করে বলল,

চাচ্চু তোমার মনে হয় না বাবা একটু বেশি করে?

সৌরভ চৌধুরী স্লান হেঁসে বলল, বড় ভাই তোর ভালো চায় তাই ওরকম করে ওগুলো বাদ দে চল খেয়ে নিবি।

আমার ভালো আমি দেখে নিতে জানি। আমার ভালো কাউকে দেখতে হবে না।

আচ্ছা বাপ বাদ দে এখন খেয়ে নিবি কালতো ডিউটি আছে তাই মাথা ঠান্ডা কর।

তাজ চোখমুখে বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে উঠলো বোরিং ডিউটি।

তাজের চোখমুখের এক্সপ্রেশন দেখে সৌরভ চৌধুরী হো হো করে হেঁসে উঠলো তা দেখে তাজ চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠলো আমার অসহায়ত্ব দেখে মজা নিচ্ছো? দাঁড়াও আজ এই তোমার রাজনীতির বারোটা বাজাবো আমি।

তাজের কথায় সৌরভ চৌধুরী হাসি থামিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছিস? দাঁড়া বড় ভাইকে বলে তোর ডিউটি আরো বাড়ানোর ব্যবস্থা করছি আমি।

ডিউটি বাড়ানোর কথা শুনে তাজরিয়া চোখমুখ খিঁচে বলে উঠলো চাচ্চু…

বলো ভাতিজা হেঁসে বলল সৌরভ চৌধুরী।

তুমি কিন্তু বেশি করছো এবার…

তুমিও বেশি করছো ভাতিজা…

তাজ চোখমুখ কুঁচকে সৌরভ চৌধুরীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাঁকা হেসে বলল, দাঁড়াও তুমি পাশের বাসার রহিমা আন্টিকে ছোট মা করার ব্যবস্থা করছি আমি।

আমার পিছে লেগে লাভ নেই ভাতিজা আগে নিজেকে বাঁচাও। দাঁড়া তোকে একটা সিক্রেট খবর দেই বড় ভাই তোর জন্য মেয়ে দেখছে। এবার মনে হয়ে বিয়ের তকমা লাগলো বলে তোমার কপালে ভাতিজা এ বলে সৌরভ চৌধুরী কিছুটা শব্দ করে হেঁসে উঠলো।

তাজরিয়ান সে দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চোখমুখ কুঁচকে থেকে বলল চাচ্চু চলো একটা কাজ করি।

সৌরভ চৌধুরী হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো কি কাজ?

চলো বাবাকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দেই।

তাজরিয়ানের কথায় সৌরভ চৌধুরীর বিষম খেয়ে চোখ কপালে উঠে গেলো যেনো। গোল গোল চোখে তাজের দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বলে উঠলো কি…?

শোনো আমার কথা, বাবা যেভাবে সারাদিন আমাদের পিছে বিচ্ছুর মতো লেগে থাকে শুনেছি নতুন বউ পেলে পুরুষ মানুষ নাকি দিন দুনিয়া ভুলে যায় এখন যদি নতুন বউ পেয়ে বাবা দিন দুনিয়া ভুলে একটু পিছু ছাড়ে তাহলেতো আমাদের রাস্তা ক্লিয়ার বুঝলে। বুদ্ধিটা দারুণ না বলো?

তাজের এহেন কথা শুনে সৌরভ চৌধুরী হাঁসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারলো না। পিছু ছাড়ানোর জন্য নিজের বাবাকে আরেকটা বিয়ে দিবে ভাবা যায়?

এদিকে তিফাজ চৌধুরী হসপিটালে যাচ্ছিলো ইমার্জেন্সি রোগী এসেছে। তার বাসা যেহেতু সবচেয়ে কাছে তাই তাকেই ডেকে নেওয়া হলো। তিনি রেডি হয়ে হসপিটালে যাওয়ার জন্য বের হয়ে তাজের রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুই চাচা ভাতিজার কথপোকথন শুনে কাশি উঠে গেলো।

হঠাৎ রুমের বাহিরে কাশির শব্দে তাজ আর সৌরভ চৌধুরী এক সাথে রুম থেকে বেরিয়ে রুমের বাহিরে তিফাজ চৌধুরীকে দেখে দু’জনের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। এই মুহূর্তে মোটেও তিফাজ চৌধুরীকে কেউ আশা করেনি।

তাজ আর সৌরভ চৌধুরীকে রুম থেকে বের হতে তিফাজ চৌধুরী দাঁত কটমট করে দুজনের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। হাতে টাইম নেই ইমার্জেন্সি হসপিটালে পৌঁছাতে হবে তাই কিছু না বলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচে চলে গেলো।

তিফাজ চৌধুরী যেতে সৌরভ চৌধুরী তাজের কাধ এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে অসহায় ফেস করে বলল,

ভাতিজা সমস্যা সমাধান করার বদলে উল্টো কেস খেয়ে গেলাম এবার কি হবে?

#চলবে?