#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৩৩
সকাল সকাল একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে ফারিসতা রেডি হচ্ছে। এখন মায়ের কাছে যাবে ভাবতেই মেয়েটার খুশি যেনো উপচে পড়ছে। মাত্র একটা দিন মাকে ছাড়া থেকেছে কিন্তু ওর কাছে এই একটা দিন যেনো একটা বছরের সমান লেগেছে। মাকে ছাড়া কখনো এক রাতের জন্য মেয়েটা কোথাও থাকেনি সেখানে একটা দিন যে মাকে ছাড়া থাকতে পেরেছে এই অনেক।
বুকে হাত বেঁধে দরজার সাথে হেলান দিয়ে ফারিসতাকে পর্যবেক্ষণ করছে তাজ। উচ্ছসিত মেয়েটার নাকে জ্বলজ্বল করছে ছোট্ট নাকফুলটা। গলায় চেইন, কানে ছোট ছোট দুল এক কথায় সব মিলিয়ে শাড়ি পড়া শুভ্র পরীকে সত্যি বউ বউ মনে হচ্ছে তাজের কাছে। শাড়ির মাঝেই যেনো লুকিয়ে থাকে মেয়েদের অর্ধেক সৌন্দর্য। এই জন্যই বোধহয় বলা হয় শাড়িতেই নারী। মায়ের কাছে যাওয়া নিয়ে মেয়েটা এত উৎসুক হয়ে আছে যে কখন থেকে ও এখানে দাঁড়িয়ে ওকে পর্যবেক্ষণ করছে সেটা খেয়াল এই করেনি। তাজ যখন ফারিসতাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত তখন হুট করে তাজের চোখ যেয়ে ঠেকলো ফারিসতার কোমরে। চুল আচরানোর জন্য ফারিসতা হাত উঁচু করতে কেমর থেকে শাড়ি সরে গিয়ে ফর্সা কোমর সহ পেটের এক অংশ বেরিয়ে আসতে ধক করে উঠলো তাজের বুকের ভিতর। থমকে গেলো দৃষ্টি মেদহীন ফর্সা পেটে। শুকিয়ে আসলো গলা। তাজ ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে গিয়েও সরাতে পারলো না। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো একি ভাবে।
ফারিসতা একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে চুল আচরানো শেষ করে চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে পাশে তাকাতে ধড়াস করে উঠলো বক্ষ। ফারিসতা তাজের ঘোলাটে দৃষ্টি অনুস্মরণ করে নিজের দিকে তাকাতে এক ঝটকা খেলো। ফারিসতা চোখ গোল গোল করে একবার নিজের দিকে আরেকবার তাজের দিকে তাকিয়ে চট করে চুল ছেড়ে দিয়ে দ্রুত হাত নামিয়ে বেরিয়ে থাকা কোমর ঢেকে দিয়ে দাঁত কটমট করে উঠলো অসভ্য।
ফারিসতার অসভ্য বলায় তাজের ঘোর কাটততে চোখ ছোট ছোট করে ফারিসতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, কে অসভ্য?
এখানে আপনি ছাড়া আর কাউকে তো দেখতে পারছি না। ওভাবে তাকিয়ে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলেন কেনো?
আমি চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলাম? ফারিসতার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলো তাজ৷
তাজকে এগোতে দেকে ফারিসতা ধড়ফড়িয়ে উঠে পিছাতে পিছাতে বলল, একদম সামনে এগোবেন না।
কি করবে এগোলে?
ফারিসতা পিছাতে পিছাতে কিছু বলতে যাবে তার আগে কাভার্ডের সাথে যেয়ে পিঠ ঠেকতে চমকে উঠলো ফারিসতা। আর পিছে যাওয়ার জায়গা নেই কিন্তু তাজ একদম ওর কাছে চলে এসেছে দেখতে বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম শব্দ তুলে হার্টবিট লাফানো শুরু করে দিলো। এমতাবস্থায় ফারিসতা কি করবে খুঁজে না পেয়ে পাশ দিয়ে যেই দৌড় দিয়ে পালাতে নিবে তার আগে তাজ ফারিসতার দুই পশে কাবার্ডের সাথে হাত ঠেকিয়ে দুই বাহুর মাঝে আঁটকে নিলো ফারিসতারকে।
তাজ এভাবে বাহুডোরের মাঝে আঁটকে নিতে হার্টবিট এত দ্রুত লাফাতে লাগলো যেনো আরেকটু হলে বুক চিড়ে হার্ট বেড়িয়ে আসবে।
আমি অসভ্য? কথাটা বলে ফারিসতাকে কোনো কিছুর বলার সুযোগ না দিয়ে তাজ ফারিসতার আরো নিকটে চলে গিয়ে ঝুঁকে ফারসিতার ঘাড়ের কাছে মুখ নিতে তাজের গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ের উপর পড়তে নিঃশ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম হলো ফারিসতার। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে তাজের বুকের কাছের শার্ট খামছে ধরে চোখমুখ খিছে বন্ধ করে নিলো ফারিসতা তখন অনুভব করলো পুরুষালি ওষ্ঠের কোমল ছোয়া কানের লতিতে পড়তে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। দাঁড়িয়ে গেলো শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। বুকের কাছে খামছে ধরে রাখা শার্ট আরো জোরে খামছি ধরতে নখগুলো যেয়ে বিধলো তাজের বুকে। তাজ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ফারিসতার কানের লতিতে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে ঘাড় সোজা করে তাকালো ফারিসতা খিঁচে রাখা কম্পিত মুখশ্রীর দিকে। তাজ ফারিসতার কম্পিত মুখশ্রী অবলোকন করে ফারিসতার মুখের উপরে ফু দিয়ে শুধালো, একে বলে অসভ্যতামি এ বলে ফারিসতাকে বাহুডোর থেকে মুক্ত করে দিতে ফারিসতা দিক বেদিক ভুলে এক দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। তাজ কি করছে ভাবতে ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠল পুরো শরীর। লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো গাল। ফারিসতা কাঁপা কাঁপা হাতে হাত তুলে কানের লতিতে রাখতে ফের কেঁপে উঠলো। এভাবে কত সময় ওয়াশরুমে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো ফারিসতার জানা নেই। হুশ আসলো রুম থেকে তাজের হাক ছেড়ে বলা কথা কানে যেতে।
সারাদিন ওয়াশরুমে থাকার ইচ্ছে থাকলে থাকতে পারো আমি কিন্তু চলে গেলাম। পড়ে মায়ের কাছে যাবো বলে কান্না করে সব ভাসিয়ে দিলেও নিয়ে যাবো না।
তাজের কথা কানে যেতে ফারিসতা বিড়বিড় করে বলল, নির্লজ্জ গুন্ডা একটা। এর গুন্ডামো স্বভাব জীবনেও যাবে না এ বলে ফারিসতা নিজেকে স্বাভাবিক করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তাজের দিকে একবারো না তাকিয়ে একপ্রকার ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
ফারিসতার কাজে কিছুটা শব্দ করে হেঁসে ফেললো তাজ। সেই শব্দ ফারসিতার কানেও পৌচ্ছাতে ফারিসতা বিড়বিড় করে তাজের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে নিচে যেতে উদ্যত হতেও কিছু একটা মনে করে তিফাজ চৌধুরীর রুমের সামনে গিয়ে নক করলো, আঙ্কেল আসবো?
ভিতর থেকে তিফাজ চৌধুরী বলল, বাবার রুমে আসতে অনুমতি লাগে নাকি বোকা মেয়ে? আসো।
ফারিসতা স্মিত হেঁসে রুমে প্রবেশ করে তিফাজ চৌধুরী সামনে যেয়ে বলল, আঙ্কেল আমাদের বাসায় যাচ্ছি তাই ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই৷
তিফাজ চৌধুরী হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসে বলল, আঙ্কেল কে হ্যা? বাবা ডাকবি আমায় বুঝেছিস?
তিফাজ চৌধুরীর এমন কথায় ফারিসতার চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো। এই বাসার প্রতিটা লোক ওঁকে এতটা আপন করে নিয়েছে যে মনে হয়না তারা কিছুদিন আগেও সবাই ওর অপরিচিত ছিলো। হুট করে মনের ভিতর এক ভালো-লাগায় ছেয়ে গেলো। সারা জীবন বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়া মেয়েটা বাবা রূপে তিফাজ চৌধুরীকে পেয়ে আবেগে আপ্লূত হয়ে গেলো। ফারিসতা জ্বলজ্বল চোখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে উপর নিচ মাথা ঝাকালো তা দেখে তিফাজ চৌধুরী বলল,
উহুম শুধু মাথা ঝাকালে হবে না বাবাও ডাকতে হবে। বাবা ডাকো…
ফারিসতা এবার কাঁপা কাঁপা স্বরে ডেকে উঠলো ব..বাবা। কণ্ঠ কাঁপার সাথে কেঁপে উঠলো ফারিসতার পুরো শরীর। জীবনে সেই সাত বছর বয়সে বাবা নামে পাষাণ লোকটার থেকে দূরে যাওয়ার পর আজ প্রথম কাউকে বাবা রূপে পেয়ে তাকে বাবা ডাকতে কণ্ঠনালি কেঁপে উঠলো ফারিসতার। চোখের কোটরে জমা হলো বিন্দু বিন্দু অশ্রু।
তিফাজ চৌধুরী ফারিসতাকে অবলোক করে ইশারায় কাছে ডাকতে ফারিসতা গুটিগুটি পায়ে তার পাশে বসতে তিফাজ চৌধুরী স্নেহের হাত ফারিসতার মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, কান্না না হাসি মুখে বিদায় নেও মামনী। সাবধানে যেও আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে কিন্তু বাবা ওয়েট করবো।
ফারিসতা অশ্রুসিক্ত নয়নেও স্মিত হেঁসে আসি বাবা বলে তার থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে তাজের সাথে বেরিয়ে গেলো। তাজ প্রথমে হসপিটালে যেয়ে ফারিসতার কিছু চেক-আপ করিয়ে ফারিসতাকে নিয়ে একটা শাড়ির শপিং মলে আসলো। শাড়ির শপে আসায় ফারিসতা চোখ গোল গোল করে বলে উঠলো এখানে কেনো এসেছি?
শাড়ি কিনতে।
কার জন্য?
তোমার জন্য।
তাজের এবারের কথায় ফারিসতার চোখ কপালে উঠে গেলো। ফারিসতা চোখ কপালে উঠিয়ে মৃদু চেচিয়ে বলে উঠলো কি….?
ফারিসতার এমন চেঁচানোতে তাক চোখ চোখমুখ কুঁচকে বলল, শান্তশিষ্ট ভাবে কথা বলা যায় না? সব সময় ষাঁড়ের মতো চেচাও কেনো?
কি বললেন আমি ষাঁড়? দাঁত কটমট করে বলে উঠলো ফারিসতা।
ঝগড়া করার সময় এখন না বাসায় বসে রিলাক্সে ঝগড়া করো এখন যেটা যেটা পছন্দ কুয়িকলি নিয়ে নেও।
মাথা ঠিক আছে আপনার? শাড়ি নিয়ে আমি কি করবো?
এই মেয়ে এত পক পক না করে নিতে বলেছি চুপচাপ নিবে। শাড়ি মানুষ কেনো নেও?
আমি শাড়ি পড়বো না অসম্ভব আপনার দরকার হলে আপনি নিন আমার দরকার নেই এ বলে ফারিসতা ধুক করে কর্ণারের একটা চেয়ারে যেয়ে বসে পড়লো।
তাজ চোখমুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ ফারিসতার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ত্যাড়া মেয়ের ত্যাড়ামি কাজে রাগ লাগলেও সেটা প্রকাশ না করে নিজেই কতগুলো শাড়ি নিয়ে নিলে সেদিকে ফিরেও তাকালো না ফারিসতা। ফারিসতার এমন ত্যাড়ামি দেখে তাজ ও শাড়ি ছাড়া আর কিছু কিনলো না। ভেবেছিলো শাড়ির পাশে অন্য ড্রেস ও নিয়ে দিবে কিন্তু এর ত্যাড়া রগ সোজা করার জন্য একে শাড়ি পড়িয়েই রাখতে হবে ভেবে তাজ বাঁকা হেঁসে ফারিসতাকে নিয়ে ফের গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি তালুকদার বাড়ির সামনে আসতেই ফারিতা যেই ছুটে গাড়ি থেকে বের হতে যাবে তখন দেখলো গাড়ির ডোর খুলছে না। ফারিসতা কিছুক্ষণ ধাক্কা ধাক্কি করে বুঝলো যে তাজ ডোর লক করে দিয়েছে তা দেখে ফারিসতা চট করে তাজের দিকে ফিরে বলে উঠলো, কি সমস্যা ডোর লক করে রেখেন কেনো?
তোমার ত্যাড়া রগ সোজা করার জন্য গবেট একটা। আজ প্রথম শশুর বাড়ি এসেছি আর তুমি আমাকে রেখে নাচতে নাচতে এক ছুটে চলে যাবে আর আমি একা একা উপরে যাবো?
তো আপনাকে কি এখন কোলে করে নিতে হবে? আপনার মতো দানবকে কোলে নিলে আমি চ্যাপ্টা হয়ে হয়ে যাবো।
ফারিসতার এমন ননস্টপ বকবকানিতে তাজ চোখমুখ কুঁচকে ইস্টুপিট বলে দরজার লক খুলে গাড়ি থেকে নামতে ফারসিতাও নেমে দাঁড়ালো। যদিও প্রথমে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে তাজের কথা ভুলেই বসেছিলো যে তাজ ওঁদের বাসায় প্রথম যাচ্ছে তাই তো তাজকে ভুলে এক ছুটে বাসায় চলে যাওয়ার জন্য গাড়ি থেকে নামতে চেয়েছিলো। যদিও এখনো পারে তাজকে ফেলে রেখে আগে চলে যেতে কিন্তু সেটা না করে ফারিসতা গাড়ি থেকে নেমে কোমরে হাত দিয়ে তাজের উদ্দেশ্যে বলল, আসুন নতুন জামাই আপনার জন্য আপনার নতুন বউ দাঁড়িয়ে আছে।
চোখ পাকিয়ে তাকালো তাজ ফারিসতার দিকে। এই মেয়ে আচ্ছা ছুচকাদুন। একে পরে দেখে নিবে ভেবে তাজ ফারিসতার হাতে শপিং ব্যাগ সমূহ ধরিয়ে দিয়ে নিজে ফলমূল, মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে লিফটে উঠে গেলো। তাজের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে ফারিসতা ঠোঁট টিপে হেঁসে তাজের পিছু পিছু যেয়ে লিফটে উঠলো। তাজকে জ্বালাতন করতে পেরে মনটা খুশি খুশি হয়ে গেলো।
#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন
#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৩৪
কাজের ফাকে ফাকে ফারজানা বেগম বার বার চাতক পাখির মতো দরজার দিকে তাকাচ্ছে কখন কলিংবেল বাজবে সেই আকাঙ্খায়। মেয়ের জান্য তার মনটা যে ছটফট করছে। সারাজীবন বুকের মাঝে আগলে রাখা মেয়েটাকে নতুম ঠিকানার রেখে এসে ছটফট করে কেটেছে পুরে একটা দিন। যেই মেয়েটাকে ছাড়া কখনো একটা রাত ঘুমায়নি সেই মেয়েকে ছাড়া কিভাবে ঘুমায়? দুটো রাত ছটফট করে কেটেছে তার।
ফারজানা বেগমকে হাতে হাতে কাজে সাহায্য করছে আর আরে চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে রাশফিয়া। মায়ের মনের ব্যাকুলতা দেখে নীরবে স্মিত রাশফিয়া। এই মা মেয়ে যেনো একে অপরের প্রাণ। মা মেয়ের এমন মধুর বন্ডিংটা দেখে বরাবর এই রাশফিয়া খুব মুগ্ধ হয়। ফারজানা বেগম উপর থেকে যতটা নিজেকে শক্ত দেখাক ভিতরটা শিমুল তুলোর চেয়েও নরম। মেয়েকে ছাড়া সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক দেখালেও যে ভিতরে ভিতরে উনি যে ভেঙে পড়বে রাশফিয়া খুব ভালো করেই জানে। তাইতো হোস্টেল থেকে চলে এসেছে তার কাছে। ও যেই কয়টা দিন আছে এই কয়টা দিন তাকে সঙ্গ দিলে ভিতরে ভিতরে এতটা ভেঙে পড়বে না। এতে তার ও ভালো লাগবে আর ও ও পাবে একজন মায়ের ভালোবাসা যেটা ও নিজের মায়ের থেকেও পায়নি। একটা মানুষের যত কিছুই থাকুক না কেনো কখনো সে পরিপূর্ণ হতে পারে না। কোনো না কোনো দিক দিয়ে সে অপূর্ণ থেকে থাকেই। বলা বাহুল্য ফারজানা বেগমের থেকে যতটুকু মমতাময়ী স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছে সেটা ও নিজের মায়ের থাকতেও পায়নি। তাইতো বুকের ভিতর পাহাড় সমান অভিমান, কষ্ট নিয়ে পড়ালেখার অজুহাত দিয়ে পরিবার ছেড়ে পারি জমালো ডাবিতে।
রাশফিয়ার ভাবনার মাঝে কলিংবেল বেজে উঠতে ফারজানা বেগম এক প্রকার ছুটে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। রাশফিয়া ফারজানা বেগমের কাজে ফের স্মিত হেঁসে ও ও তার পিছু পিছু গেলো।
কলিংবেল চাপার সাথে সাথে ফারজানা বেগম দরজা খুলে দিতে ফারিসতা এক লাফে মায়ের কাছে যেয়ে তাকে ঝাপটে ধরলো। একটা দিন পর মাকে কাছে পেয়ে ফারিসতা যেনো প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে পারলো। ফারিসতা ফারজানা বেগমকে আরো শক্ত করে ঝাপটে ধরে ভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো, আই মিস ইউ আম্মু।
ফারজানা বেগম ফারসিতাকে নিজ থেকে ছাড়িয়ে মেয়ের সারা মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে গালে হাত রেখে বলল, মিস ইউ টু সোনা। কেমন আছো তুমি? ওই বাসার সবার সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছো?
ফারিসতা মায়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, সবার মাঝে তোমাকে খুব মিস করি আম্মু। একদিনে চোখমুখের কি অবস্থা করেছো? সারারাত ঘুমাওনি না?
ভাইয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেনো ভিতরে আসুন।
রাশফিয়ার কথায় ধ্যান ভাঙলো তাজের। মা মেয়ের এই মধুময় সম্পর্ক দেখে কখন ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছে নিজেও জানেনা। এদিকে ফারজানা বেগমের এতক্ষণ তাজের কথা খেয়াল হতে থতমত খেয়ে গেলেন। মেয়েকে পেয়ে দিনদুনিয়ার সব কিছু ভুলে বসেছে ভাবতে তিনি লজ্জায় পড়ে গেলো নতুন জামাইকে আপ্যায়ান না করে এভাবে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আবেগি হয়ে হয়ে পরে এমন ভুল করে ফেলেছে ভাবতে ফারজানা বেগম তড়িঘড়ি করে ফারিসতাকে ছেড়ে তাজের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, তাজ বাবা কেমন আছো? বাহিরে দাঁড়িয়ে কেনো ভিতরে আসো।
ফারজানা বেগমকে এমন বিচলিত হতে দেখে তাজ ফারজানা বেগমকে সালাম দিয়ে তার সাথে কুশল বিনিময় করলো। ফারজানা বেগম তাজকে নিয়ে বাসায় ঢুকতে ফারিসতা গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। রাশফিয়া ফারিসতার মাথায় চাপড় মেরে বলল, তোর এইতো জামাই এতো হিংসা করার কি হলো?
জামাই মাই ফুট গুন্ডা একটা।
হ্যা এই জন্যই তো এই গুন্ডাকে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করেছিস। আর আমাদের সামনে ভাব নিতি এই গুন্ডাকে দুই চোখেও দেখতে পারিস না৷
রাশুর বাচ্চা সব জেনেও আমাকে খোঁচা মেরে কথা বলছিস দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি মজা এ বলে রাশফিয়াকে ধরতে নিবে তা দেখে রাশফিয়া ছাঁদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পালানোর জন্য যেই দৌড়ে বাসা থেকে বের হতে যাবে ঠিক তখন কেউ বাসায় প্রবেশ করতে তার সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে তাকে সহ ধপাস করে নিচে পড়ে গেলো।
আকস্মিক ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেলো আরফি। তাজের ফোন পেয়ে ফারিসতাদের বাসায় প্রবেশ করতে না করতে আকস্মিক আক্রমণে নিজের ব্যালেন্স ধরে রাখতে না পেরে ধাক্কা দেওয়া ব্যক্তির সাথে নিজেও পড়ে গেলো। কে এমন ধাক্কা দিয়েছে দেখার জন্য আরফি চোখ তুলে তাকাতে রাশফিয়ার ভয়ার্ত মুখশ্রী চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কি ছিলো ওই ভয়ার্ত মুখশ্রীতে আরফি জানেনা কিন্তু ওই মুখশ্রী চোখের সামনে ভেসে উঠতে হুট করে থমকে গেলো আরফির হার্টবিট।
হঠাৎ ফারিসতার উচ্চশব্দের হাসি কানে যেতে রাশফিয়া পিটপিট করে চোখ খুলতে চোখের সামনে আরফিকে দেখে ছলাৎ করে উঠলো বুক পাঁজরে। রাশফিয়া তড়িঘড়ি করে আরফির উপর থেকে সরতে সরতে বলে উঠলো সরি সরি সরি আমি খ….
পথিমধ্যে রাশফিয়াকে থামিয়ে দিয়ে আরফি উঠে বসতে বসতে বলে উঠলো, একি এক্সকিউজ শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে অন্য এক্সকিউজ দেও। আজকেও আরেকবার প্রুভ করে দিয়েছো যে তুমি চোখ কপালে না হাঁটুতে রেখে চলাচল করো।
আরে ভাইয়া ভুল বলেছেন ওর তো চোখ এই নাই। চোখ থাকলে কি যেখানে সেখানে এমন ধাপুসধুপুস করে পড়ে?
রাশফিয়া দাঁত কটমট করে ফারিসতার দিকে তাকালো যেনো চিবিয়ে খেয়ে ফেলে এই মুহূর্তে ফারিসতাকে।
এদিকে তাজকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে ফারজানা বেগম চা নাস্তা আনার জন্য কিচেনে চলে যেতে হঠাৎ দরজার সামনে কিছু পড়ার শব্দ শুনে তাজ ভ্রু কুঁচকে বসা থেকে উঠে সেদিকে পা বাড়ালো। দরজার কাছে এসে রাশফিয়া আর আরফিকে ফ্লোরে বসে থাকতে দেখে তাজ ভ্রু আরো কুঁচকে বলে উঠলো, কি হয়েছে?
আগে উঠা শা*লা তারপর প্রশ্ন করিস এ বলে আরফি হাত বাড়িয়ে দিলো।
তাজ এক হাত দিয়ে আরফিকে টান দিয়ে উঠিয়ে রাশফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকেও হেল্প করা লাগবে?
তাজের প্রশ্নে রাশফিয়া হকচকিয়ে দ্রুত উঠে বসে তড়িঘড়ি করে বলল, ন..না ভাইয়া লাগবে না।
গুড.. ভিতরে আসো এ বলে আরফিকে নিয়ে চলে যেতে রাশফিয়া দাঁত কটমট করে তাকালো ফারিসতার দিকে যে এখনো ঠোঁট টিপে হাসছে তা দেখে রাশফিয়া তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে ফারিসতাকে ধাওয়াও করে বলতে লাগলো ফারুর বাচ্চা সব তোর জন্য হয়েছে এ বলে ফারিসতার পিছে ছোটা শুরু করতে ফারিসতা ও ছুটে নিজের রুমে যেতে নিবে তার আগে ফারজানা বেগম ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলে উঠলো, শুরু হয়ে গিয়েছে দু’জনের বাঁদরামি? মার দিবো একটা ধরে। তাজকে নিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো আমি নাস্তা দিচ্ছি।
মায়ের কথায় ফারিসতার চোখমুখ কুঁচকে গেলেও কিছু না বলে তাজকে রুমে নিয়ে ও এসে পড়তে নিবে তার আগে তাজ হাত ধরে ফেলে বলল, কোথায় যাচ্ছো?
ফারিসতা এবার চোখমুখ কুঁচকে বলল, নতুন জামাই আমাকে ছাড়া বাসায় আসতে পারবেন না এখন কি আমাকে ছাড়া ফ্রেশ ও হতে পারবেন না? এখন কি ফ্রেশ করিয়েও দিতে হবে?
তুমি চাইলে করিয়ে দিতে পারবো আমি মাইন্ড করবো না।
তাজের এহেন জবাবে ফারসিতা অসভ্য বলতে গিয়েও অ… তে আঁটকে গেলো সকালের কথা মনে পড়তে। তাই অসম্পূর্ণ কথাটা গিলে নিয়ে বলে উঠলো, ফ্রেশ হয়ে আসুন যাচ্ছি না আমি এখানেই আছি।
আগে তুমি যাও।
আমি সব সময় তরতাজা থাকি তাই আমার সেকেন্ডের মাথায় ফ্রেশ হওয়া লাগে না।
ফারিসতার কথায় তাজ ভ্রু গুটিয়ে বলল, তাই না? তা এত জার্নির পর ও সব সময় কিভাবে তরতাজা থাকো শুনি একটু?
বলা যাবে না সিক্রেট এটা। আপনি যাবেন ফ্রেশ হতে নাকি আমি চলে যাবো?
যাও….
আজব হাত না ছাড়লে যাবো কিভাবে?
হাত ছাড়া যাবে না এভাবে যেতে পারলে যাও….
ফারিসতা এবার এক হাত কোমরে দিয়ে নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল, মজা করছেন আমার সাথে?
তাজ ফারিসতা নাক টেনে দিয়ে বলল, রাগলো তোমায় একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগে আর বাচ্চাদের নাক টেনে দেওয়ার জন্য আমার হাত নিশপিশ নিশপিশ করে এতে আমার কিন্তু দোষ নেই এ বলে তাজ ফারিসতার ক্ষেপে যাওয়ার আগে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
তাজের এমন কাজে রাগ লাগার বদলে ফিক করে হেঁসে ফেললো ফারিসতা। দিনদিন লোকটার পাগলামোর সাথে সাথে মুখে কথার খৈ ও ফুটেছে। সব সময় গুনে গুনে কথা বলা মানুষটা এখন ওর মতো ননস্টপ বকবকানি করে ওকে সারাক্ষণ বিরক্ত করে। কথাগুলো ভাবতে ফারিসতা ব্যাগ থেকে তাজের তোয়ালে বের করে বেডের উপরে রেখে ও চলে গেলো ওর শখের বেলকনিতে। যেখানে ফুটে আছে বাহারি রকমের ফুল। প্রতিটা ফুলগাছ খুব যত্ন করে ওর লাগানো। ফারিসতা আলতো করে ওর প্রিয় ফুল গুলো ছুঁয়ে দিতে লাগলো তখন হঠাৎ পিছ থেকে শাড়ির আঁচলে টান পড়তে ফারিসতা চমকে পিছু ঘুতরে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তাজের কাজে। তাজকে ওর ভেজা হাত আর মুখ ফারিসতার আঁচল দিয়ে মুছতে দেখে ফারিসতা আঁচল ছুটানোর জন্য টান দিয়ে চোখ গোল গোল করে বলে উঠলো কি করছেন কি? তোয়ালে বেডের উপরে রেখে এসেছি চোখে দেখেননি।
তাজ মুখ মুছে আচল ছেড়ে দিয়ে বলল, বউয়ের আঁচল থাকলে তোয়ালের প্রয়োজন হয়না। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। জার্নি করে এসেছো হাত পায়ে জীবানু আছে।
এত স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি তাহলে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছলেন কেনো?
এতো বুঝতে হবে না তোমায়। তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করো।
জানে এর সাথে তর্ক করে লাভ নেই তাই ফারিসতা চোখ পাকিয়ে তাজের দিকে তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
****
তপ্ত দুপুরে সবাই নিজেদের খুদা নিবারন করার জন্য দুপুরের খাবার খাওয়ায় ব্যস্ত। কর্মরত সকল পুলিশ অফিসাররা এক সাথে লান্স শেষ করতে ঘুমে সবার চোখ লেগে আসলো। দুপুরে এই একটাই সমস্যা খাওয়ার পর দুই চোখে ঘুম ঢোলে পড়ে কিন্তু ডিউটির চাপে দুপুরের ঘুমটা যেনো সবার হারাম হয়ে গিয়েছে কিন্তু আজ যেনো একটু বেশি এই ঘুম পাচ্ছে সবার। যতই ঘুম পাক ঘুমানো চলবে না তাই সবাই সবার ডিউটিতে লেগে পড়লো। অফিসার নাজিম যার আন্ডারে আপাতত নাহির খান আছে। অন্য সব ক্রিমিনালদের এক সাথে রাখলেও নাহির খানকে আলাদা রাখা হয়েছে স্পেশাল ভাবে আদর যত্ন করার জন্য। এই স্পেশাল আদর যত্নে নাহির খানের অবস্থা অলরেডি নিঃশ্বাস টেনে উঠানো ও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। নাহির খানকে বন্দী করে রাখা জেলের সামনে ধুপ করে চেয়ারের উপরে বসে পড়লো অফিসার নাজিম। এতো ঘুম পাচ্ছে যে চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে পড়েছে। তিনি চোখ আর খুলে রাখতে না পেরে টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমে ঢোলে পড়লো।
#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং…🥰