হৃদয়স্পর্শী মায়াবিনী পর্ব-৪১+৪২

0
219

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৪১

লেক পার্কের সিঁড়ির উপরে পাশাপাশি বসে আছে আরফি আর রাশফিয়া। এটা সেই লেক পার্ক যেখানে প্রথমবার দুজন দু’জনের সাথে দেখা হয়েছিলো। সেদিন ফারিসতার সাথে এখানেই বসা ছিলো রাশফিয়া। এরপর কারো চিৎকারের শব্দে উপরে উঠতে তাজের সেই কি ধমক খেলো। সেদিন তাজের ধমকে দুজন যখন কাঁপছিলো তখন তাজের হাত থেকে আরফি ওঁদের বাঁচিয়ে এখান থেকে বেরোনোর সুযোগ করে দিয়েছিলো। সেটাই ছিলো আরফির সাথে রাশফিয়ার প্রথম সাক্ষাৎ। তাইতো ওদের প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে এই লেকপার্কটা হলো অন্যতন। দু’জনের মন যখন খুব ভালো থাকে তখন এই জায়গায় আসে আবার যখন মন খারাপ থাকে তখন ও এই জায়গায় আসলে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু আজ যেনো কারো মন এই ভালো হওয়ার না। দু’জনের মুখেই লেগে আছে নিকোশ কালো অন্ধকার। আরফি মুখ অন্ধকার করে কাতর স্বরে বলল,

যেতেই হবে?

রাশফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বাবা বিদেশ থেকে এসেছে আমাকে দেখতে চাচ্ছে মাও অসুস্থ আমাকে দেখতে চাচ্ছে। আগে যাই করুক তাঁরাই তো আমার মা-বাবা। তাদের একপাল দেখার আকাঙ্খা আমার বুকেও আছে। শুধু তিনটা দিন এইতো। তিনদিন পর আবার চলে আসবো প্রমিজ। আরফির হাতের ভাজে হাত রেখে শেষের কথাটা বলল৷

রাশফিয়ার কথায় আরফি প্রত্যুত্তর না করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল, চলো……

রাশফিয়াও উঠে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নিলে আরফি হাত ধরে আঁটকে দিলো।

হাতে টান পড়তে রাশফিয়া পিছু ঘুরে ছোট করে বলল কি?

একবার জড়িয়ে ধরতে দিবে?

আরফির এই কাতর স্বরে আবদারে রাশফিয়ার চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো। রাশফিয়া নিজেকে সামলে স্নান হেসে নিজ থেকেই আরফির কাছে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আরফির বুকে মাথা রাখলো। বুকের ভিতর এক অজানা অস্থিরতায় চোখের কোটরে জমা হলো অশ্রু। সেটা আরফিকে বুঝতে না দিয়ে রাশফিয়া নিজেকে সামলে ছোট করে বলল হয়েছে?

আরফি রাশফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ছাড়তে মন চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একবার ছাড়লে তুমি দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে।

রাশফিয়া আরফির বুক থেকে মাথা তুলে আরফির দিকে তাকিয়ে বলল, ধুর বোকা মাত্র তিনদিন এর এইতো ব্যাপার। এই প্রথম দূরে যাচ্ছি তাজ জন্য এমন লাগছে। চলো এবার লেট হয়ে যাচ্ছে।

আরফি আর কথা না বলে নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রাশফিয়ার ফ্যাকাশে মুখপানে। কেনো বুকের ভিতর এত অস্থির লাগছে আরফি জানেনা শুধু মনে হচ্ছে দূরে গেলেই ওর রাশফিয়া হারিয়ে যাবে। বিদায়ের বেলা মেয়েটাকে এভাবে বিদায় দিলে মন খারাপ করে থাকবে তাই আরফি নিজের অস্থিরতা চেপে রাশফিয়ার কপালে ছোট করে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে চলো বলে রাশফিয়ার হাত নিজেট হাতের মুঠোয় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। স্টেশনে পৌঁছে ভারাক্রান্ত মনে রাশফিয়াকে বিদায় দিয়ে তাকিয়ে রইলো ট্রেনের দিকে যতক্ষণ না ট্রেনটা চোখের আড়াল হয়।

***
ফারিসতা গাল ফুলিয়ে বসে আছে বেলকনিতে। আজ বিকেলে তাজের কাথা ছিলো ওকে নিয়ে ওর মায়ের বাসায় যাবে কিন্তু বিকেল পেরিয়ে রাত ৮ টা বেজে গেলো কিন্তু তাজের আসার নাম গন্ধ নেই এমনকি ফোন ও তুলছে না। ফারিসতা রাগে দুঃখে শাড়ি খুলে থ্রিপিস পড়ে গাল ফুলিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসে রইলো। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কত আশা উত্তেজনা নিয়ে বিকেলে তাজের পছন্দের ব্লু কালার শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে অপেক্ষা করেছিলো কিন্তু তাজ অপেক্ষার প্রহর বাড়িয়ে দিয়ে আসলোই না। এতবার ফোন করেছে ফোনটা পর্যন্ত রিসিভ করেনি ভাবতে ফারিসতার গাল আরো ফুলে গেলো অভিমানে।

হসপিটাল থেকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ফিরে তাজ রুমের ভেরানো দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা শাড়ি দেখে ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, বাঘিনী ক্ষেপেছে এ বলে হাতের ভাজে থাকা এপ্রনটা বেডের উপরে রেখে বেলকনির দিকে পা বাড়ালো। বেলকনিতে এসে দেখলো বাঘিনী দোলনায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ওর উপস্থিতি বেলকনিতে টের পেয়েও এক বারের জন্য ও ফিরে তাকালো না তা দেখে তাজ স্মিত হেঁসে ফারিসতার সামনে যেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ফারিসতার দিকে একটা গোলাম বাড়িয়ে দিয়ে আরেক হাত কানে দিয়ে বলল, সরি জান….

ফারিসতা এবারো তাকালো না তাজের দিকে। মুখ ঘুরিয়ে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে।

তাজ এবার উঠে ফারিসতার পাশে বসে ফারিসতাকে এক হাত দিয়ে বুকর মাঝে আলিঙ্গন করে নিয়ে বলল, ইমার্জেন্সি পেসেন্ট ছিলো তাই তাড়াতাড়ি ফিরতে পারিনি। ইমার্জেন্সি পেসেন্ট রেখে আসাটাকি ঠিক হতো? জানো সেই পেসেন্টগুলোর ভিতরে আজ একজন পেসেন্টের তোমার পছন্দের টুইন বেবি হয়েছে।

ফারিসতা এবার চোখ তুলে তাজের দিকে তাকাতে তাজের ক্লান্তিমাখা মুখটা দেখে সব রাগ অভিমান হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। লোকটা এত ক্লান্তি নিয়ে এসে একটু রিল্যাক্স করবে তা না করে ওর রাগ ভাঙাচ্ছে ভাবতে ফারিসতার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। ফারিসতা সব ভুলে ওড়নার এক মাথা হাতের মুঠোয় নিয়ে তাজের কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল, রুমে চলুন এখানে গরম আমি ঠান্ডা শরবত করে দিচ্ছি।

ফারিসতা…

হুম…

আমিও টুইন বেবি চাই।

ফারিসতা টিপটিপ বুকে তাজকে তাড়া দিয়ে বলল, আল্লাহ দিলে ইন শা আল্লাহ আসবে এবার উঠুন।

তাজ উঠে ফারিসতাকে আচমকা কোলে তুলে নিতে ফারিসতা ভয় পেয়ে তাজের শার্টের কলার টেনে ধরে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো ক..কি করছেন? নামান আমায়…

তাজ নামালো না একবারে রুমে নিয়ে যেয়ে নামিয়ে দিয়ে বলল, কিছু করতে হবে না শাড়িটা আবার পড়ে নেও আমি পাঁচ মিনিটের ভিতরে ফ্রেশ হয়ে আসছি

আপনি এখন ক্লান্ত আমরা কাল যাই সমস্যা ন…..

তাজ ফারিসতার ঠোঁটে উপরে আঙ্গুল দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে এক পলক দেখার মাঝে আমার সকল ক্লান্তি ভ্যানিশ হয়ে যায়। চুপচাপ রেডি হও আর নাহলে কিন্তু আমি রেডি করিয়ে দিবো।

ফারিসতা ছিটকে তাজের থেকে দূরে সরে বলল, আমি হচ্ছি রেডি আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।

তাজ ফারিসতার গাল টেনে দিয়ে বলল, গুড। ওয়েট করো আমি পাঁচ মিনিটের ভিতরে আসছি এ বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

তাজের যাওয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো ফারিসতা। এই গাল টানার জন্য তাজের সাথে এতো বাজে তারপর ও ওকে রাগানোর জন্য গাল টানবেই ভবাতে রাগের মাঝেও ফারিসতা হেঁসে ফেললো তাজের পাগলামিগুলো দেখে।

****
ফজরের আজানের ধ্বনি কানে যেতে নড়েচড়ে উঠলো আরফি। সারারাত নিদ্রাহীন ছটফটিয়ে কাটিয়েছে কখন ভোর হবে সেই আকাঙ্ক্ষায়। আজ পাঁচদিন হলো রাশফিয়ার সাথে কোনো ভাবে কন্টাক্ট করতে পারছে না। রাশফিয়া বলেছিলো তিনদিন পর চলে আসবে কিন্তু সেখানে পাঁচদিন হতে চলেছে কিন্তু রাশফিয়ার সাথে কোনো ভাবে যোগাযোগ করতে পারছে না। এই পাঁচটাদিন কোনো করম ছটফট করে কাটালেও কাল রাত বারোটার পর রাশফিয়ার ফোন থেকে আসা ছোট একটা এসএমএসে আরফির পুরো দুনিয়াটা ওলটপালট হয়ে গেলো। আরফি এখনো ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে রাশফিয়ার একটা ফোনের আসায়। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছো ছোট একটা এসএমএস আমায় ক্ষমা করো। এসএমএসটা দেখার পর থেকে আরফির মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। সারারাত হাজারের উপরে ফোন,এসএমএস করেই চলেছে কিন্তু ওপার থেকে কোনো রেসপন্স আসছে না। আরফি শেষ বারের মতো আরেকবার কল করলো কিন্তু এবারো সারারাতের মতো বলল, ওপারের ফোন সুইচড অফ। আরফি আর সময় ব্যয় না করে প্রথমে ফজরের নামাজ আদায় করে হাতের কাছে যা পেলো তা ব্যাগে ভিতর ঢুকিয়ে কোনো রকম আমেনা বেগমকে বলে গেলো সিলেট যাচ্ছে রাশফিয়াকে আনতে। রাশফিয়ার কথা অনেক আগেই আমেনা বেগমের কাছে আরফি বলেছে। এইকয়দিন ছেলের শুকনো মুখ দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ছেলের কিছু একটা হয়েছে তাই তিনি জানতে চাইলে আরফি কোনো বিলম্ব না করে সব জানায়। যেহেতু সব আগে থেকেই জানা তাই আরফিকে আর বাঁধা দিলো না শুধু বলল সাবধানে যাস। কোনো সমস্যা হলে তোর বাবাকে জানাস।

আরফি সম্মতি দিয়ে সোজা সেকেন্ড ফ্লোরে এসে কলিংবেল চাপতে ফারজানা বেগম এসে দরজা খুলে দিয়ে এতো সকাল সকাল আরফিকে দেখে অবাক হয়ে বলল, ভিতরে আসো বাবা। এতো সকাল সকাল কিছু কি হয়েছে?

আরফি অস্থির শুরে বলল, বলছি আন্টি। তাজরা উঠেছে ঘুম থেকে?

না ওঠেনিতো৷ ডেকে দিবো?

আপনার কষ্ট করতে হবে না আন্টি আমি ডেকে নিচ্ছি এ বলে আরফি তড়িঘড়ি করে ফারিসতার রুমের দরকার নক করতে কিছুক্ষণ পর তাজ চোখ ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে আরফিকে অবলোকন করে বলে উঠলো, কিছু হয়েছে? এমন লাগছে কেনো তোকে?

তাজের কথা যেনো কানেই গেলো না আরফির। আরফি অস্থির কণ্ঠেই বলল, ফারিসতা কোথায়?

আরফির প্রশ্নে তাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, ঘুমাচ্ছে কেনো?

একটু ওঁকে জাগিয়ে দিবি?

তাজ আরফির অস্থির চিত্ত মুখশ্রী দেখে বুঝে নিলো সিরিয়াস কিছু হয়েছে তাই আর প্রশ্ন না করে বলল, তুই বোস আমি ডেকে নিয়ে আসছি এ বলে রুমে যেয়ে ফারিসতাকে ডেকে তুলে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতে ফারিসতা আরফিকে অবলোকন করে বলল, কোনো সমস্যা ভাইয়া?

আরফি সব খুলে বলে রাশফিয়ার বাসার ঠিকানা চাইতে ফারিসতাও চিন্তিত হয়ে বলল, আমিও যেতে চাই এ বলে তাজের দিকে তাকাতে তাজ আরফির দিকে তাকালো। ছেলেটাকে একদমি ঠিক লাগছে না এই অবস্থায় একা ছাড়া ঠিক হবে না তাই তাজও যাওয়ার জন্য রাজি হতে ফারিসতা ঝটপট রেডি হয়ে ফারজানা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে তিনজন বেরিয়ে পড়লো সিলেটের উদ্দেশ্যে।

#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৪২

তিনজন সিলেট পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেলো। সিলেট পৌঁছে আরো আধাঘন্টা পর রাশফিয়াদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামতে রাশফিয়াদের বাসা সাজানো দেখে কামড় মেরে উঠলো আরফির বুক। হাত-পা ক্রমশ অবশ হয়ে আসছিলো তখন তাজের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে আস্তে ধীরে গাড়ি থেকে তিনজন নামলো।

বাসা এমন সাজানো দেখে ফারিসতার চিন্তাও ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। ফারিসতা আশপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলো এখানে কি হচ্ছে জানার জন্য। ফারিসতার খোঁজার মাঝে পিছ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,

আরে ফারিসতা না? কেমন আছো?

কারো কণ্ঠস্বর শুনে ফারিসতা পিছে তাকাতে প্রতিবেশী পরিচিত এক আন্টিকে দেখে ঠোঁটের কোনে টেনে হিঁচড়ে হাসি টেনে বলল, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন আন্টি?

আলহামদুলিল্লাহ। তা তোমার সাথে এরা কারা? বাঁকা চোখে তাজ আর আরফির দিকে তাকিয়ে বলল।

ফারিসতা কোনো বিলম্ব না করে তাজ আর আরফিকে দেখিয়ে বলল, আমার হাসবেন্ড আর ভাই।

ভদ্রমহিলা চোখ বড় বড় করে বলল, ঢাকা যেয়ে বিয়েসাদী ও করে নিলে একটু জানালে ওতো না।

ভদ্রমহিলার এমন আজাইরা কথায় তাজ বিরক্ত হলো কিন্তু কিছু বলল না। ফারিসতা তাজের বিরক্তমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
আসলে আন্টি হুট করে বিয়েটা হয়ে গিয়েছে তাই কাউকে জানানো হয়নি।

হ্যা বুঝি বুঝি দাওয়াত দেওয়ার ভয়ে জানাওনি। তা রাশফিয়ার এতো ভালো বন্ধু তুমি তাহলে বান্ধবীর বিয়ের এক সপ্তাহ আগে না এসে বিয়ের দিন আসলে যে?

ভদ্রমহিলার কথা কানে যেতে বিনা মেঘে বজ্রপাত হতে লাগলো সবার মাথার উপরে। আরিফ কোনো রকম নিজেকে সামলে অস্থির হয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, বিয়েটা কি হয়ে গিয়েছে?

ভদ্রমহিলা সন্দিহান চোখে আরফির দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়ে খেতে এসেছো আর জানোই না এখনো বিয়ে হয়েছে কিনা?

মহিলার কথায় ঘাবড়ে যেয়ে ফারিসতা তড়িঘড়ি করে বলল, আসলে হয়েছে কি আন্টি রাশফিয়া আমাদের আরো তিনদিন আগে আসতে বলেছে কিন্তু কিছু কাজ থাকায় আসতে পারিনি এই জন্য ও রাগ করে আমাদের কারো সাথে কথা বলে না তাই ওকে কিছু না জানিয়ে আজ ওকে সারপ্রাইজ দিতে চলে এসেছি তাই সেভাবে কিছু জানিনা আমরা।

ফারিসতার কথা ভদ্রমহিলার বিশ্বাস হলো কিনা জানা গেলো না। তিনি বাঁকা চোখে তাজ আর আরফিকে পর্যবেক্ষণ করে বলল, এখনো বিয়ে হয়নি রাতে হবে।

এতক্ষণে সবাই যেনো প্রাণ ফিরে পেলো। তাহলে ওরা সঠিক টাইমে এসেছে ভাবতে সবাই বড় করে নিঃশ্বাস নিলো।

ভদ্রমহিলা যখন বাঁকা চোখে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছিলো তখন তার ডাক পড়ায় সেখায় থেকে যেতে যেতে বলল, আচ্ছা তাহলে পরে কথা হবে তোমরা যেয়ে রাশফিয়ার সাথে দেখা করো।

মহিলা যেতে ফারিসতা সামনে দিকে যেতে উদ্যত হতে হতে বলল, চলুন আমার সা..

পথিমধ্যে ফারিসতারকে থামিয়ে দিয়ে তাজ ফারিসতার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে আরফিকেও ইশারা করলো গাড়িতে উঠতে। তাজ এভাবে গাড়িতে আনায় ফারিসতা অবাক হয়ে বলল, আবার গাড়িতে এলাম কেনো আমরা?

তোমার মতো গাঁধির বুদ্ধিতে চললে বিয়ে আটকানো লাগবে না। রাশফিয়া আর কাউকে না বলুক অন্তত তোমাকে যেহেতু কিছু বলেনি তাহলে এখানে নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। তোমার থেকেইতো শুনেছি ওর ফ্যামিলির সাথে ওর সম্পর্কটা তেমন ভালো না। হতেও পারে ওর ফ্যামিলি ওকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে যার জন্য তোমার সাথে বা কারো সাথে যোগাযোগ করতে দেয়নি। এখন তুমি যদি এভাবে ভিতরে যাও তাহলে সবাই সন্দেহ করবে এতে বিষয়টা আরো জটিল হবে। আমাদের হাতে এখনো অনেকটা সময় বাকি আছে তাই তাড়াহুড়ো করা যাবে না।

তাজের লজিক শুনে ফারিসতা বুঝলো যে আসলেই ভুল করছিলো। ফারিসতা তাজের দিকে তাকিয়ে বলল, তা এখন কি করবো?

এখন এখান থেকে চলে যাবো, যা করার রাতে করবো।

আরফি ভীতুশ্রী কণ্ঠে শুধালো, ততক্ষণে যদি বিয়ে হয়ে যায়?

তাজ ভ্রু কুঁচকে পিছু ঘুরে আরফির দিকে তাকিয়ে বলল, ভরসা করিস আমাকে?

নিজের চেয়েও বেশি।

তাজ গাড়ির হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, তাহলে চুপ থাক আর দেখ কি করি এ বলে সেখান থেকে চলে গেলো কাছের হোটেলে এরপর কাউকে ফোন করে কিছু বলতে লাগলো। সব ব্যবস্থা করতে করতে সন্ধ্যা নেমে যেতে তাজ আরফি আর ফারিসতাকে নিয়ে ফের আসলো রাশফিয়াদের বাসার গেটের সামনে। তাজ কি করতে চাচ্ছে কিছুই ফারিসতা আর আরফির মাথায় আসছে না। যদিও তাজের উপরে আরফির সম্পূর্ণ ভরসা আছে তবুও প্রতিটি সেকেন্ডের সাথে সাথে যেনো আরফির হাত-পা ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে।

তাজ সিটের সাথে হেলান দিয়ে সিরিয়া মুড নিয়ে ফারিসতার উদ্দেশ্যে বলল, আমার কথা মন দিয়ে শোনো। তুমি আর আরফি এখন রাশফিয়ার কাছে যাবে। তোমরা গেটের বাহিরে পা দেওয়ার সাথে সাথে পুরো বাসার ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাবে সেই সুযোগে তোমরা রাশফিয়ার কাছে যাবে। যেহেতু ব্যাপারটা বিয়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছে সেহেতু রাশফিয়াকে কোনো না কোনো ভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে তাই তোমাদের সাথে ও আসতে চাইবে না তাই এই স্প্রে দিয়ে ওঁকে সেন্সলেস করে বাসার পিছের সাইড দিয়ে বের হবে। ওই সাইডে কেউ থাকবে না আমার লোকেরা ওই সাইডে পাহারা দিচ্ছে। ওখানে কেউ দেখলেও সমস্যা হবে না ওরা হ্যান্ডেল করে নিবে তাকে তাই নিশ্চিন্তে ওকে নিয়ে বাসার পিছের সাইডে চলে যাবে আমি ওখানে গাড়ি নিয়ে থাকবো৷ এখন বলতে পারো আমরা চাইলে সবার সামনে যেয়ে রাশফিয়াকে তুলে আনতে পাড়ি তাহলে এত ঝামেলা কেনো করছি। শোনো রাশফিয়াকে সবার সামনে তুলে আনা আমার বা হাতের কাজ। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো রাশফিয়া কোনো কারণে তাদের কাছে বাঁধা পড়ে গিয়েছে তাই আমরা ওকে সরাসরি আনতে গেলে ও আসতো না তখন ব্যাপারটা অন্য দিকে চলে যেতো। সময় কম এখন তোমরা ভিতরে যাও। যা করার দ্রুত করতে হবে কিছুক্ষণের ভিতরেই বরপক্ষ চলে আসবে।

তাজের তাৎক্ষণিক এমন বুদ্ধিমত্তা দেখে মুগ্ধ হলো ফারিসতা৷ আজ যদি ওদের সাথে তাজ না থাকতো তাহলে এতক্ষণে কোনো না কোনো সমস্যা বাঁধিয়েই ফেলতো ভাবতে ভাবতে ফারিসতা আস্তে ধীরে গাড়ি থেকে নামে আরফিকে নিয়ে গেট পেরোতেই পুরো বাসা অন্ধকার হয়ে গেলো সেই সুযোগে ফারিসতা আরফিকে নিয়ে সোজা চলে গেলো রাশফিয়ার রুমে। এভাবে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়ায় কি হয়েছে দেখার জন্য সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে যার জন্য রুম পুরো ফাকা। ফারিসতার সেই সুযোগ পেয়ে জলদি রুমে এসে দরজা লাগিয়ে ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালাতে ভেসে উঠলো লাল টুকটুকে বউ সাজে বেডের এক কোনে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা রাশফিয়ার দিকে যেনো আত্নাবিহীন এক শরীর বসে আছে।
হুট করে রাশফিয়ার দিকে আলো পড়তে ছ্যাত করে উঠলো আরফির বুক। সামনে আর এককদম এগোনোর সাহস হলো না। আরফি দরজা ঘেঁসে ঠায় দাঁড়িয়ে একি ভাবে চেয়ে রইলো রাশফিয়ার সজ্জিত মুখশ্রীর দিকে।

এদিকে ফারিসতা ফোনের ফ্লাশলাইট অন করতেও রাশফিয়ার ভিতরে কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলো না এমনকি একটা বারের জন্য ফিরেও তাকালো না কে লাইট মারলো দেখার জন্য তা দেখে ফারিসতা রাশফিয়ার কাছে যেয়ে কাঁধে হাত রাখতে রাশফিয়া ঢুলুমুলু চোখে চোখ তুলে সামনে দিকে তাকাতে বুকের ভিতর মোচড় মেরে উঠলো। ফারিসতা যেহেতু এসেছে তাহলে আরফিও এসেছে ভাবতে রাশফিয়া চাতক পাখির মতো ফারিসতাকে পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে তাকাতে আবছা আলোয় কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে চোখের সামনে ধীরে ধীরে সব অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। রাশফিয়া এত করে চেষ্টা করলো চোখ জোড়া একটু খুলে রেখে প্রিয় মানুষটার মুখটা একটাবার দর্শন করতে কিন্তু নিষ্ঠুর ভাগ্যের পরিহাস সেটা হতে দিলো না। ধীরে ধীরে শরীরের সমস্ত শক্তি ছেড়ে দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেলো।

রাশফিয়াকে হঠাৎ পড়ে যেতে দেখে ফারিসতা দ্রুত রাশফিয়াকে ধরে নিতে পিছ থেকে আরফি ছুটে এসে অস্থির হয়ে বলে উঠলো কি হয়েছে?

বুঝতে পারছি না ভাইয়া। আমরা কিছু করার আগেই ও সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। সময় বেশি নেই ভাইয়া ওকে নিয়ে চলুন গাড়িতে বসে জ্ঞান ফিরাবো।

আরফি সম্মতি দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রাশফিয়ার নিস্তেজ শরীরটা কোলে তুলে নিয়ে সাবধানে বাসার পিছের সাইড দিয়ে তাজের গড়িতে উঠে বসতে তাজ গাড়ি স্টার্ট করে হাওয়ার বেগে গাড়ি নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

গাড়ি কিছুদূর যেতে আরফি হঠাৎ চ্যাচিয়ে বলে উঠলো, তাজ গাড়ি থামা।

আরফির চ্যাচানোতে তাজ গাড়ি থামিয়ে পিছু ঘুরতে আরফি অস্থির হয়ে বলে উঠলো, ওর মুখ দিয়ে ফ্যানা জাতীয় কিছু বের হচ্ছে, শরীর নীল হয়ে আসছে এমন হচ্ছে কেনো?

আরফির কথা শুনে তাজ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পিছে যেয়ে রাশফিয়াকে চেক করে বলল, ওহ্ সীট পয়জন পান করেছে এখনো পুরো শরীরে বিষ ছড়াতে পারেনি ইমেডিয়েটলি হসপিটালে নিতে হবে এ বলে ফের ড্রাইভিং সিটে বসে ফারিসতাকে তাগাদা দিয়ে বলল, কুয়িক গাড়িতে ওঠো।

রাশফিয়ার অবস্থা দেখে ফারিসতা এবার কান্না করে দিলো। তাজের কথা কানে যেতে আর সামনে না যেয়ে পিছে বসেই রাশফিয়াকে লাগাতরে ডাকতে লাগলো। রাশফিয়ার কোনো প্রকার সাড়াশব্দ না পেয়ে ফারিসতার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো। ফারিসতার এমন কান্নায় তাজ ড্রাইভ করতে করতে ফারিসতাকে ধমকে উঠতে ফারিসতার কান্নার বেগ কমলেও কষ্টের পরিমাণ বাড়তেই লাগলো। সবচেয়ে কাছের প্রিয় বোনকে হারানোর শঙ্কায় ফারিসতার পুরো দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো।

কাছের একটা ছোটখাটো হসপিটালে পৌঁছে রাশফিয়াকে নিয়ে সবাই হসপিটালে প্রবেশ করতে জানতে পারলো এতো রাতে কোনো ডক্টর হসপিটালে নেই। ইমার্জেন্সি ডক্টর কিছু প্রয়োজন বাসায় গিয়েছে এখনি এসে পড়বে। এখনি আসতে আসতে কয় ঘন্টা লেগে যাবে ততক্ষণে পুরো শরীরে বিষ ছড়িয়ে যাবে ভাবতে তাজ নিজের পরিচয় দিয়ে নার্সদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কুয়িকলি আনতে বলে রাশফিয়াকে কেবিনে নিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে আরফিকে একবার অবলোকন করে ফারিসতার উদ্দেশ্যে বলে গেলো কান্না না করে ওঁকে একটু সাহস দেও আরফিকে ঠিক লাগছে না এ বলে কেবিনে চলে গেলো।

#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন

হ্যাপি রিডিং…🥰