হৃদয়স্পর্শী মায়াবিনী পর্ব-০৩

0
154

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৩

নিস্তব্ধ নিরিবিলি মধ্য রাতে চিন্তিত হয়ে মেয়ের শিউরে বসে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে ফারজানা বেগম। রাত বাড়ার সাথে সাথে ফারিসতার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর উঠেছে। রাত বাজে প্রায় তিনটা কিন্তু কিছুতে শরীর থেকে জ্বর কমছে না উল্টো সময়ের সাথে সাথে জ্বর বেড়ে চলেছে। মেয়ের অবস্থা দেখে ফারজানা বেগম কোনো দিক দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। এতো রাতে কোনো হসপিটাল ও খোলা নেই যে হসপিটালে নিয়ে যাবে কিন্তু মেয়ের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে এই অবস্থায় মেয়েকে নিয়ে ঘরে বসেও থাকতে পারছে না। ফারজানা বেগম অস্থির হয়ে মেয়ের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে আর প্রহর গুনছে কখন ভোর হবে।
ফারজানা বেগম বার বার চাতক পাখির মতো জানালা ভেদ করে বাহিরে তাকাচ্ছে ভোরের আলো ফোটার আকাঙ্খা নিয়ে কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম আজ তাকে যেনো হতাশ করছে। যতবার জানালা ভেদ করে বাহিরে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে ততবার প্রকৃতি তাকে দেখিয়ে দিচ্ছে বাহিরে নিকশ কালো অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। যেনো প্রকৃতি চিৎকার করে তাকে বলছে ভোর হতে এখনো অনেক সময় বাকি আমরা আমাদের প্রকৃতির নিয়ম ছেদ করে তোমার জন্য আলো ফোটাতে পারবো না।
প্রকৃতি যদি জানতো সন্তান অসুস্থ হওয়ার পর মায়ের মনের ব্যাকুলতা তাহলে হয়তো প্রকৃতি তার প্রাকৃতিক নিয়মের বাহিরে আলো ফোটাতে পারবোনা না বলে প্রকৃতি তার সব নিয়ম ভেঙে আলো ফুটিয়ে দিয়ে বলতো তোমার ব্যাকুল হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাও তোমার সন্তানকে সুস্থ করে।

আম্মু সবাই এতো স্বার্থপর কেনো? সবাই তোমাকে আমাকে একা করে দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়েছে। কেনো আম্মু আমাদের ছোট একটা সংসার হলো না? কেনো বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলো? সবাই কেনো এতো স্বার্থপর আম্মু? কেনো আমাদের দু’জনকে সবাই একা করে দিলো জ্বরের ঘোরে কথাগুলো বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো ফারিসতা।

জ্বরের ঘোরে মেয়ে এমন আর্তনাদ শুনে ফারজানা বেগমের কলিজাটা যেনো ছিড়ে যাচ্ছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো তীব্র যন্ত্রণায় বুক চিরে বেড়িয়ে আসা অশ্রু। তিনি মেয়েকে ঝাপ্টে ধরে সারা মুখে চুমু দিয়ে বলল,

আম্মু আছি না পাশে মা? আর কউকে লাগবে না আমাদের পাশে। আমরা দুজন দুজনের পৃথিবীর আমাদের আর কউকে লাগবে না আম্মু। এই স্বার্থপর পৃথিবীরতে আমরা মা মেয়ে আমাদের পরিপূরক আর কাউকে লাগবে না আমাদের বলে তিনিও ডুকরে কান্না করে উঠলো।
মনে পরে গেলো সেই কালো অতীতের কথা যে অতিতটা ছিলো কতটা নির্মম স্বার্থপর। ফারিসতার যখন সাত বছর বয়স তখন ওর বাবা আফজাল আকন্দ আরেকটা বিয়ে করে বাসায় আসে নববধূকে নিয়ে। নিজের স্বামীর আরেক বিয়ে করা দেখে ফারজানা বেগমের পুরো দুনিয়াটা ওলটপালট হয়ে গেলো। সেই দিনের ঘটনা কতটাই না যন্ত্রণাদায়ক ছিলো। তবুও ফারজানা বেগম সব যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে তবুও চেয়েছিলো সতীনের সাথে সংসার করতে। কিন্তু এই চাওয়াটাও রাখলো না আফজাল আকন্দ আর তার নববধূ। সেই দিনেই আফজাল আকন্দ তাকে ডিভোর্স দিয়ে বের করে দেয় বাসা থেকে সেদিন ফারজানা বেগমের আর তার ছোট নিষ্পাপ মেয়েটার পাশে ছিলো না কেউ। ফারজানা বেগমকে বাসা থেকে বের করার আগে শুধু অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে ছিলো শ্বাশুড়ির পানে যাকে নিজের ময়ের মতো ভালোবেসে আগলে রেখেছিলো। সংসারের পুরো ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছিলো। নিজের জব, ছোট মেয়ে তারপর এতবড় সংসার সব কিছু এক হাতে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যেতো তবুও হাসি মুখে সব সামলে নিতো। এতো কিছুর পর ও কারো মন জয় করতে পারেনি তিনি। শেষে কেউ ছিলো না ফারজানা বেগমের পাশে।

বুকের ভিতর তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে মেয়েকে নিয়ে সবার থেকে দূরে চলেগেলো। ঢাকা শহরে ছেড়ে পারি জমালো সিলেট। সেখানেই কাটিয়ে দিলো ১১ বছর। ফারিসতা বড় হলো এইচএসসি পাশ করার পর ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেলো। যার জন্য সিলেট থেকে ফেট পারি জমাতে হলো ঢাকা। ফারজানা বেগম ব্যাংকে জব করেন যার জন্য তিনিও ট্রান্সফার হয়ে ঢাকা আসলো। সিলেট থেকে প্রথমে এসে বাবার বাড়ি উঠলো কিছুদিনের জন্য তারপর সেখান থেকে বাসা ঠিক করে মেয়েকে নিয়ে পারি জমালো এই নতুন জায়গায়।

আজানের সুমধুর ধ্বনিতে ভাবনা ছেদ ঘটলো ফারজানা বেগমের। তিনি মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকালো মেয়ের দিকে। সারারাত জ্বরে ছটফট করেছে এখন শরীর থেকে একটু জ্বর ছেড়েছে যার জন্য ঘুম পড়েছে। ফারজানা বেগম মেয়ের কপালে গভীর ভাবে চুমু খেলেন। কিছুক্ষণ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে নামাজ আদায় করে নাস্তা বানাতে কিচেনে গেলেন। যাতে মেয়ের ঘুম ভাঙতে কিছু খাইয়ে সকাল সাকল হসপিটালে নিয়ে যেতে পারেন।

তীব্র রোদের ঝলকানিতে পিটপিট করে চোখ খুললো ফারিসতা। চোখ খুলতে আস্তে ধীরে মনে পড়তে লাগলো কাল রাতের কথা। জ্বরের ঘোরে কি কি করেছে আবছা আবছা মনে আসতে রুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে ফারজানা বেগমকে খুজতে লাগলো।

তখন রুমে প্রবেশ করতে করতে ফারজানা বেগম বলে উঠলো,

উঠে পড়েছো? এখন শরীর কেমন লাগছে? দেখি এ বলে ফারিসতার পাশে বসে কপালে গলায় হাত দিয়ে জ্বর চেক করতে লাগলো। রাতের মতো অতো বেশি জ্বর এখন না থাকলেও মোটামুটি ভালোই জ্বর আছে এখনো শরীরে।

ফাজানা বেগমকে কাছে পেয়ে ফারসি তার কোলে মাথা দিয়ে দুই হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে শুলো। কেনো যেনো মায়ের এই কোলে অন্যরকম এক উম থাকে। যেখানে মাথা রাখলে সব খারাপ লাগা মুহূর্তের মাঝে ভ্যানিস হয়ে যায়।

ফারজানা বেগম ফারিসতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

এখন উঠতে হবে আম্মা। কিছু খেয়ে ডক্টরের কাছে যেতে হবে। কাল আমার কথা শুনলে সারারাত এতো কষ্ট পাওয়া লাগতো? এখন কথা না শুনে সারারাত কে কষ্ট পেলো শুনি? দেখেছো এবার মায়ের কথা না শোনার ফল।

ফারজানা বেগমের কথায় ফারিসতা ঠোঁট উল্টে ফারজানা বেগম দিকে তাকিয়ে বলল, আম্মু এখনো বকা দেওয়া লাগবে তোমার?

মেয়ের এমন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ওল্টাতে দেখে ফারজানা বেগম হেঁসে ফেললেন। তিনি হেঁসে ফারিসতার গাল টেনে দিয়ে বলল, বকা দিলাম কোথায়? বকা খাওয়া এখনো অনেক বাকি আগে সুস্থ হও তারপর দেখবে বকা কাকে বলে। এখন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ওঠেন আম্মাজান হসপিটালে যেতে লেট হয়ে যাচ্ছে।

ফারিসতা ফারজানা বেগমকে আরো গভীর ভাবে ঝাপটে ধরে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, উঠতে ইচ্ছে করছে না। থাকি না আরেকটু তোমার কোলে। জানো আম্মু আমার মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ তোমার এই কোলের মাঝে লুকিয়ে আছে। এতো ভালো কেনো লাগে এখানে থাকতে?

মেয়ের কথায় ফারজানা বেগম মুচকি হাসলেন। তারপর নুয়ে মেয়ের মাথায় চুমু দিয়ে বলল যখন তুমি মা হবে তখন বুঝবে মায়ের কোলে এতো সুখ কেনো থাকে। এবার জলদি ওঠো ফ্রেশ হয়ে কিছু খেতে হবে।

ফারজানা বেগমের কথায় ফারিস ফারজানা বেগমের কোমর ছেড়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো ফেইস করে ঠোঁট উল্টে তাকালো ফারজানা বেগমের দিকে তা দেখে ফারজানা বেগম বলে উঠলো, কি হয়েছে?

ফারিসতা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল আমি বিয়ে করবো না।

ফারিসতার কথায় ফারজানা বেগম ফের হেঁসে ফারিসতার নাক টেনে দিয়ে বলল, ওলে আমাল বাচ্চা মেয়েটা। আচ্ছা বিয়ে করতে হবে না এবার তাড়াতাড়ি ওঠেন আম্মাজান লেট হয়ে যাচ্ছে এ বলে ফারিসতাকে আস্তে ধীরে উঠে বসালো। উঠে বসতে মাথায় যন্ত্রণায় চোখমুখ খিচে বন্ধ করে ফেলল ফারিসতা। কপালের কাছটা ব্যথায় টনটন করছে। কিছুটা সময় নিয়ে ফারিসতা নিজেকে স্বাভাবিক করে মনে মনে একশটা গালি দিলো সেই তাজ নামের দানবীয় শক্তির অধিকারী দানবটাকে যে ওকে এতো বড় আঘাত দিলো। এতো জোরে কেউ মারে? শালা জীবনেও বউ পাবি না তুই। আমার কাছে যদি কখনো দানবীয় শক্তি আসে তাহলে সবার আগে তোর মাথা ফাটাবো দেখে নিস কথাগুলো মনে মনে ভেবে ফারজানা বেগমের সাহায্যে ফ্রেশ হয়ে আসলো ফারিসতা।

ফ্রেশ হতে ফারজানা বেগম জোর করে ফারিসতাকে একটু খাইয়ে দিয়ে রেডি হয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। বাসার কাছেই এক হসপিটালে আসলো। হসপিটালে এসে সিরিয়াল কেটে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে লাগলো সিরিয়ালের। অপেক্ষা করতে করতে ২০ মিনিট পেরিয়ে গেলো কিন্তু এখনো সিরিয়াল আসছে না দেখে ফারিসতার চোখমুখ বিতৃষ্ণায় ভোরে গেলো। শরীর ভালো না থাকলে শোয়া থেকেউ উঠতে ইচ্ছে করে না সেখানে ২০ মিনিট যাবত বসে আছে এর চেয়ে খারাপ লাগার আর কি হতে পারে? অসুস্থ শরীর নিয়ে হসপিটালে এমন বসে থাকতে হয় এই জন্য ফারিসতার সব চেয়ে অপছন্দ হলো হসপিটালে আসা। মায়ের জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে হসপিটালে আসা আর নাহলে এই বোরিং প্লেসে ভুলেও আসতো না ফারিসতা। এদিকে ক্রমশ মাথা ব্যথা যন্ত্রণা বাড়ার সাথে জ্বর ও বড়ছে। ফারিসতা ঠোঁট উল্টে বার বার ফারজানা বেগমকে বলতে লাগলো বাসায় চলে যাবে আর ফারজানা বেগম সান্ত্বনা দিতে লাগলো আরেকটু সময়।

অবশেষে সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আরো দশ মিনিট পরে নার্স ডেকে উঠলো আশফিয়া জাহান ফারিসতা। ফারিসতা মাথা যন্ত্রণায় চোখ বুঁজে ফারজানা বেগমের কাঁধে মাথা রেখে বসে ছিলো তখন হঠাৎ নিজের নাম শোনায় চমকে চোখ তুলে তাকালো। কেনো ওকে ডাকা হচ্ছে বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো। ফারজানা বেগম ফারিসতাকে উঠিয়ে সামনের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। সামনের কাচের দরজা ভেদ করে এক পা রাখতে চোখ তুলে সামনে তাকাতে এক ঝটকা খেলো ফারিসতা। হসপিটালে এসে এমন ঝটকা খাবে কল্পনা ও করেনি। এ কিভাবে সম্ভব? পরক্ষণে চোখে ভুল দেখছে ভেবে ফারিসতা দু হাত দিয়ে চোখ কচলে আবার সামনে তাকালো। না এবারও একি দেখছে।

হঠাৎ হাতে টান পড়তে ফারিসতা সম্বিত ফিরে ফেলো। হাতের দিকে তাকাতে দেখতে পেলো ফারজানা বেগম ওর হাত ধরে সামনের দিকে পা বাড়াচ্ছে। ফারিসতা হাতের থেকে চোখ সরিয়ে আবারও সামনে তাকালো সাথে সাথে পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। সামনে এগোতে থাকা প্রতিটি একদমে বুকের ভিতর ধক ধক করে উঠছে।

ডক্টরের চেয়ারে বসা কালো শার্টের উপরে সাদা এপ্রন পড়া দানবীয় মানুষটাকে চিনতে সময় লাগলো না ফারিসতার। এই সেই দানবীয় মানব যার হাতে বারি খেয়ে আজ ওর এই অবস্থা। কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব? সেই ছেলেতো গুন্ডা মাস্তান যাকে সবাই ভয় পায়। ফারিসতা নিজের চোখে দেখেছে কাল বেধড়ে ছেলেগুলোকে পেটাতে। যার শরীরে দানবের মতো শক্তি আর সেই দানব এই ওকে আঘাত করেছে তাহলে সেই দানব ডক্টর এর জয়গায় কি করে আসলো ফারিসতার মাথায় আসছে না। ফারিসতার বার বার মনে হচ্ছে ও চোখে ভুল দেখছে। ফারিসতা এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো চেয়ারে বসা ডক্টরের দিকে। সামনে থাকা ডক্টর কিছু একটা লিখছে যার দৃষ্টি টেবিলের উপর সীমাবদ্ধ। মুখে খোঁচা খোঁচা কালো দাঁড়ি, চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। চুল গুলো যত্ন করে উল্টে পিছু করে রাখা। গলায় ঝুলছে স্টেথোস্কোপ। সব কিছু খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখে ফারিসতার এবার মনে হলে ও আসলেই চোখে ভুল দেখছে কারণ কালকের দেখা সেই হিংস্র মানবের সাথে ফেইসের মিল থাকলেও অন্য সব কিছু আলাদা। কালকের দেখা তাজ নামের হিংস্র মানবের চোখ ছিলো পিশাচের মতো লাল, উস্ক খুস্ক চুল, চোখে ছিলো না কেনো চশমা। তাছাড়া একটা গুন্ডা মাস্তান ডক্টর হবেই বা কিভাবে কথাটা ভাবতে ফারিসতা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিন্তু তবুও মনের এক কোনে একটা কিন্তু রয়েই গিয়েছে দুটো আলাদা মানুষের ফেইস এতো মিল হয় কিভাবে কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ডক্টরের পাশে রোগী দেখার চেয়ারে যেয়ে বসলো ফারিসতা। চেয়ারে বসে ফের তাকালো ডক্টরের দিকে তখন চোখের সামনে ভেসে উঠলো এপ্রনের উপরে লেখা ডাঃ তাজরিয়ান চৌধুরী তাজ লেখার উপরে। নামটা চোখে পড়তে ফারিসতার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে মুখ থেকে অস্ফট স্বরে বেরিয়ে আসলো এ কিভাবে সম্ভব?

এদিকে তাজ কিছু একটা লিখছিলো মন দিয়ে যার জন্য পাশে কেউ বসাতে সেটা টের পেলেও চোখ তুলে তাকালো না। তখন কারো অস্ফুট স্বরে বলা কথাটা কানে আসতে চমকালো তাজ। এই কণ্ঠের অধিকারী ব্যক্তিকে দেখার জন্য তাজ চট করে চোখ তুলে পাশে তাকাতে স্তব্ধ হয়ে গেলো। পরক্ষণে তাজ দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পাশে বসে একরাশ বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। কালকের দেখা সেই শুভ্র পরীর মুখে আজ ফ্যাকশে একটা ভাব। চোখমুখ বেদনার ছাপ স্পষ্ট। তখন তাজের চোখে পড়লো কপালের বা পাশটা যেখানে নীল আভা ধারণ করে আছে। সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে সময় লাগলো না ঠিক কি কারণে এখানে আসা। তাজ চৌধুরীর হাতে মার খাবে আর সে হসপিটালে আসবে না সেটা কি আদো সম্ভব?

কথা গুলো ভেবে তাজ দ্রুত নিজেকে সামনে গলা খাকানি দিয়ে বলল, সমস্যার কারণ খুলে বলুন।

তাজের কণ্ঠ কালকের মতো আজ রাশভারী ছিলো না। আজকের কণ্ঠস্বর ছিলো নরম তবুও ফারিসতা ওই কণ্ঠস্বর শুনে কেঁপে উঠলো। সমস্যার কারণ কি খুলে বলবে ওর গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না যেনো। সকাল সকাল এমন ঝটকা খেয়ে জমে বরফ হয়ে গেলো মেয়েটা।

এদিকে ফারিসতাকে কোনো কথা বলতে না দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তাজ তা খেয়াল করে ফারজানা বেগম হাসার চেষ্টা করে বলল কিছু মনে করবেন না ও অল্পতে নার্ভাস হয়ে পড়ে তাই এমন করছে এ বলে তিনি সব কিছু বলল। সব শুনে তাজ জ্বর চেক করার জন্য এক হাত বাড়িয়ে ফারিসতার কপাল রাখলো সাথে সাথে তাজের পাথর হৃদয়ের ভিতর ধক করে উঠলো। সেই সাথে অনুভব করলো ওর হাতের স্পর্শে পাশে থাকা শুভ্র পরীর শরীরের কম্পন। তাজ এলোমেলো ভাবে দ্রুত কপাল থেকে হাত সরিয়ে আনলো।

এদিকে তাজের শক্ত হাতের স্পর্শ ফারিসতার কপাল ছুঁতেই ফারিসতার নিঃশ্বাস আঁটকে আসলো সেই সাথে কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। তাজ কপাল থেকে হাত সরাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ফারিসতা। এতক্ষণ অস্বস্তিতে গাট হয়ে শক্ত হয়ে বসে ছিলো। ফারিসতা অসহায় কণ্ঠে মনে মনে শুধালো যার হাতের মার খেয়ে আজ নিজের এই হাল আর সেই কিনা তার কাছেই এসেছি অসুখ নিরাময় করতে। একটা মানুষের এতো নিখুঁত ভাবে দুইটা রূপ কিভাবে হতে পারে? কাল শান্ত গলায় কি হুমকি এই না দিলো আর আজ কি নম্র ব্যবহার।

নাম কি…?

হঠাৎ তাজের গম্ভীর কণ্ঠ কানে যেতে ফারিসতার ভাবনার ছেদ ঘটলো। ফারিসতা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,,,, ফ..ফারিসতা।

বয়স কত..?

এবারের প্রশ্নে চট করে চোখ তুলে ফারিসতা পাশে তাকাতে দেখতে পেলো তাজের দৃষ্টি টেবিলের উপর খাতার দিকে সীমাবদ্ধ যে প্রেশক্রিপশন লিখছে। এদিকে তাজ প্রশ্ন করে কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্ত নিয়ে চোখ তুলে তাকাতে ফারিসতা কাঁপা কণ্ঠে বলল উনিশ।

তাজ কয়েক পলক ফারিসতার বিব্রতকর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে প্রেসক্রিপশন লেখায় মন দিলো। মুখের উপরে বিরক্তভরা ছাপ ফুটিয়ে তুললেও মনে মনে তাজের খুব করে হাসি পাচ্ছে ফারিসতার বিব্রতকর মুখশ্রীর দেখে। ফারিসতাকে আরেকটু বিব্রত করার জন্য তাজ প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলল,

মাথায় আঘাত পেলেন কিভাবে?

তাজের এহেন প্রশ্ন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো ফারিসতা। এই প্রশ্নের পরিপেক্ষিতে কি উত্তর দিবে তাতক্ষণিক খুঁজে পেলো না। কিছুটা সময় নিয়ে ফারিসতা আমতা আমতা করে বলল ওই পড়ে গিয়েছিলাম কথাটা বলে ফারিসতা মনে মনে বলে উঠলো শা*লা দু মুখো সাপ নিজে দানবের মতো শক্তি দিয়ে আঘাত করে এখন প্রশ্ন করা হচ্ছে আঘাত পেলেন কি করে।

ফারিসতার মিথ্যে যুক্তি শুনে তাজ কিছুটা অবাক হলো কিন্তু আর কোনো প্রশ্ন না করে প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ করে সেটা ফারিসতা দিকে বাড়িয়ে বলল, কপালে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নিবেন এতে দ্রুত ব্যথা সেরে যাবে আর এই মেডিসিন নিলে জ্বর ব্যথা সেরে যাবে।

তাজের কথায় ফারিসতা হাসার চেষ্টা করে প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে ফারজানা বেগমের সাথে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।

ফারিসতাদের যাওয়ার পানে চোখ তুলে তাকিয়ে তাজ চেয়ারের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, কিছু একটা আছে ওই চোখে।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰