হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব-১+২

0
1046

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#সূচনা_পর্ব

পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে আরাবী।পাত্রপক্ষ বললে অবশ্য ভুল হবে কারন পাত্রই তো আসেনি এসেছে পাত্রপক্ষের পরিবার।তাও আবার তারই বাবার অফিসের বস।আরাবী’র বাবা জিহাদ সাহেবের অফিসের বস নিহান সাহেব স্বপরিবারে তার ছেলের জন্যে আরাবী’কে দেখতে এসেছেন। তার একমাত্র ছেলে জায়ান সাখাওয়াতের জন্যে আরাবীর হাত চাইতে এসেছেন তিনি।জিহাদ সাহেব প্রথমে বেশ ভড়কে গেলেও পরক্ষনে তার অফিসের বস মানে নিহান সাহেবের অমায়িক ব্যবহারে তার ভ’য়টুকু গায়েব হয়ে গিয়েছে।এদিকে শাড়ি পরে তাদের সামনে পুতুলের মতো বসে আছে আরাবী।কি থেকে কি হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।হাত-পা কেমন যেন কাঁ’পছে বাজেভাবে।ভীষন নার্ভাস লাগছে আরাবীর।বাবার দিকে একবার তাকালো আরাবীর।জিহাদ সাহেবের হাস্যজ্বল চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার এই সম্বন্ধে পুরোপুরি মত আছে।
**
-‘ জিহাদ সাহেব তো ধরে নিবো সম্পর্ক’টা পাকাপোক্ত? ‘

জিহাদ সাহেব নিহান সাহেবের প্রশ্নে অপ্রস্তুত হলেন।তিনি অবশ্য রাজি এই সম্বন্ধে। জায়ানকেও তার ভালোলাগে।ছেলেটা ভালো।তবে কথাবার্তা একটু কম বলে এই আরকি।কিন্তু যতোই হোক।তাদের কথায় তো আর কিছু হবে নাহ? ছেলে মেয়ের নিজেরও একটা পছন্দ আছে।তাদের যদি একে-অপরকে পছন্দ হয় তবেই না আহাবে সম্পর্কটা। জিহাদ সাহেব আগেই তো সম্মত্তি দিতে পারেন না। জিহাদ সাহেব আমতা আমতা করতে দেখে নিহান সাহেব হালকা হেসে বলেন,
-‘ কোন সমস্যা থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন জিহাদ সাহেব।কোন সমস্যা নেই।’

জিহাদ সাহেব যেন কিছুটা সাহস পেলেন এই কথায়।তাই কোন ভণিতা না করেই বললেন,
-‘ ভাবছিলাম যে স্যার আমাদের কথায় তো আর কিছু হবে নাহ।জায়ান বাবা আর আমার আরাবী তো একে-অপরকে দেখলো না।তাদের যদি দুজন দুজনকে পছন্দ হয় তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।কিন্তু তাদের মতামত ছাড়া তো আর আগানো যাবে না স্যার।’

নিহান সাহেব হেঁসে উঠলেন।বললেন,
-‘ এই সমস্যা? তাহলে আমি এক্ষুণি আমার ছেলেকে ফোন করে আসতে বলছি।আসলে ওকেও নিয়ে আসতাম কিন্তু ও আবার মিটিংয়ের জন্যে একটু ধানমন্ডির দিকে গিয়েছে।’

-‘ স্যার জরুরি মিটিং তো থাক পরে নাহয় দুজন একসাথে দেখা করে নেবে।’

নিহান সাহেব হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলেন।তারপর বলেন,
-‘ মিটিং বোধহয় ১৫ মিনিট পরেই শেষ হয়ে যাবে। কোন সমস্যা হবে নাহ।’

নিহান সাহেব ফোন করে তার ছেলেকে জানিয়ে দিলেন এখানে আসার কথা।তারপর ফোন রেখে বললেন,
-‘ তা আপনার শরীরের অবস্থা কেমন জিহাদ সাহেব?’

-‘ এইতো আলহামদুলিল্লাহ। আর গোটা পাঁচেক পরেই অফিস জয়েন করবো।’

-‘ প্রেসার নিতে হবে নাহ।মাত্রই আপনার এপেন্ডিসাইটিস এর অপা’রেশন হলো ঠিকঠাক বিশ্রাম নিন।শরীর পুরো সুস্থ্য হলে তবেই অফিসে আসবেন।’

জিহাদ সাহেব হেঁসে মাথা দুলালেন। দুজন আরো খোশগল্প করতে লাগলেন।তাদের দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না যে তাদের সম্পর্কটা অফিসের বস আর এমপ্লয়িয়ের।আরাবী টুকুরটুকুর চোখে এতোক্ষন সবটাই দেখছিলো।কিন্তু যখন নিহান সাহেব জায়ানকে ফোন করে এখানের আসার কথা বললেন তা শুনেই আরাবীর ভ’য়ের মাত্রা যেন আরো বেড়ে গেলো।গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গিয়েছে একেবারে। আরাবী কোনরকম ইনিয়েবিনিয়ে সেখান থেকে কেটে পরলো।সোজা নিজের রুমে প্রবেশ করলো আরাবী।চুপচাপ বিছানায় বসে রইলো। আরাবী বিরবির করে বলে উঠলো,
-‘ আব্বু মনে হয় এইবার আমার বিয়েটা পাকাপোক্ত করেই ফেলবেন যে অবস্থা দেখছি।’

নানান রকম চিন্তাভাবনা চলছে আরাবীর মাথার ভীতরে। বিছানায় সুয়ে চোখ বুজে নিলো আরাবী।ঠিক তখনই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো।আরাবীর মা লিপি বেগম ডাকছেন আরাবীকে।আরাবী লাফ দিয়ে উঠে বসলো।তারপর জলদি গিয়ে দরজা খুলে দিলো।আরাবী দরজা খুলতেই লিপি বেগম বেশ রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠেন,
-‘ কি সমস্যা তোর?বাড়িতে মেহমান ভরা আর তুই দরজা আটকে আছিস কেন? বড়লোক বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছে এইজন্যে কি ভাব বেরে গিয়েছে?’

আরাবী মায়ের কথাগুলো শুনে মন খারাপ করে মাথা নিচু করে নিলো।হালকা আওয়াজে বলে,
-‘ না আম্মু।এমন কিছু না।’

-‘ তাহলে কেমন কিছু? এখনই এই অবস্থা বিয়ে হলে তো তোর ভাবের চো’টে মনে হয় মাটিতে পা পরবে নাহ।’

আরাবী চোখ ভরে উঠলো। মায়ের কথাগুলো তীরের মতো এসে বিধছে বুকে।আরাবী আর কোন কথা বললো না।চুপচাপ রইলো।লিপি বেগম আরাবীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলেন,
-‘ এইভাবে সং সেজে না দাঁড়িয়ে থেকে যা ভালোভাবে হাত মুখ ধুয়ে আয়।তোকে ছেলের পছন্দ হলেইবিয়েটা পাকাপোক্ত হবে।হালকা সাজগোছ করে নিস। ভালোই ভালোই বিয়েটা হলেই হলো। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে এই বাড়ি থেকে বিদায় হো তুই।তাহলেই আমি বাঁচি।’

কথাগুলো বলেই লিপি বেগম চলে গেলেন।আরাবী অ’শ্রু চোখে মায়ের যাওয়ার পথে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।টলমলে নয়নজোড়া আলতো হাতে মুছে নিলো আরাবী।ভাবলো ওর মা ওর ভাই আর বোনকে অনেক ভালোবাসে।তাহলে ওর সাথেই কেন এমন করে? কেন ওর ভাই আর ছোট্টো বোনের মতো ওকেও ভালোবাসে না আদর করে নাহ।কেন সবসময় এইভাবে রু’ক্ষ ব্যবহার করে ওর সাথে। কি এমন করেছে আরাবী যে মা ওকে একটুও দেখতে পারে নাহ।আরাবী তো মায়ের একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে ছটফট করে সারাটাক্ষন।মা যা পছন্দ করেননা এমন কোন কাজ করে নাহ আরাবী।মায়ের সাথে সাথে সকল কাজে সাহায্য করে ও।বাড়িতে থাকলে সুয়ে বসে সময় কাটায় না ওর ছোট বোনের মতো।সেদিন একা হাতে সব করে আরাবী।তবুও মা কোন দিন ওর প্রসংশা করেনি আজ পর্যন্ত। বুঝার বয়স হতেই সবসময় মা’কে তার সাথে এইরকম রু’ক্ষ ব্যবহার করে আসতেই দেখছে আরাবী।হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়লো আরাবী।তারপর চলে গেলো ওয়াশরুমে। হাতমুখ ধুয়ে এসে নিজেকে পরিপাটি করে নিলো আরাবী।বাহির থেকে বেশ শোরগোলের আওয়াজ আসছে। তাহলে কি কাঙ্খিত ব্যাক্তিটি এসে পরেছে। অজানা ভ’য়ে উত্তেজনায় হিম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আরাবী। বুকটা ধ্বুকপুক করছে ভীষনভাবে।দরজার বাহিরে লিপি বেগমের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে কেঁপে উঠলো আরাবী।তিনি আরাবীকে বাহিরে আসতে বলছেন।

-‘ আরাবী?হলো তোর? জলদি বাহিরে আয়।ছেলে এসে পরেছে।’

আরাবী মায়ের কথায় দুরুদুরু বুক নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো।লিপি বেগম চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই আরাবী মাথা নিচু করে নিলো।লিপি বেগম বলেন,
-‘ জলদি আয়!’

আরাবীকে নিয়ে লিপি বেগম বসার ঘরে আসলেন।আরাবী মাথা নিচু করেই ধীর স্বরে সালাম জানালো।ঠিক তখনই ওর কানে তীব্রভাবে গম্ভীর গলার একটা পুরুষালি কন্ঠ এসে বারি খেলো। ওর সালামের জবাব দিয়েছে মূলত।আরাবীকে নিয়ে নিহান সাহেবের স্ত্রী সাথি বেগমের পাশে বসালেন। সাথি বেগম আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
-‘ মেয়ে আমার তোর বাবা তোর চাচ্চু আর ছোটমায়ের খুব পছন্দ হয়েছে।এখন তুই কি বলিস?তুই যা বলবি তাই হবে।’

আরাবী কান পেতে। লোকটা কি বলে শোনার জন্যে।কিন্তু কোন রকম উত্তর এলো না অপরপাশ হতে।আরাবী ঠোঁট চেপে বসে রইলো।ভাবছে লোকটা বোবা না-কি? নিহান সাহেব ছেলের দিকে একবার তাকালেন।ছেলে যে তার ঘার’ত্যারা সেটা তিনি ভালোভাবেই জানেন।এখানে আসতে চাইছিলো না।কোনরকম বুঝিয়ে শুনিয়ে এনেছে।ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানে আনার কারনে ঠ্যা*টামি ধরে বসে রয়েছে।নিহান সাহেব বলে উঠলেন,
-‘ জিহাদ সাহেব।বলছিলাম কি আমার ছেলে আর আরাবী মা’কে একটু আলাদা কথা বলতে দেওয়া উচিত কি বলেন?’

জিহাদ সাহেব নিহান সাহেবের কথায় হেসে বলেন,
-‘ অবশ্যই তা কেন নয়।আরাবী মা?’

আরাবী’র জবাব,
-‘ জি আব্বু।’

-‘ যাও জায়ান বাবাকে নিয়ে ছাদে যাও।’

আরাবী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলালো।কিন্তু ওর মনের ভীতরে তৈরি হওয়া উথা*লপাথা*ল ঝড়টা কেউ বুঝতে পারছে না।দমটা কেমন যেন আটকে আসছে আরাবী’র।পাজোড়া যেন সামনের দিকে অগ্রসর হতেই চাচ্ছে না।কি একটা অবস্থা।আরাবী হেটে দু-একপা সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।লিপি বেগম আরাবীর কানে ফিসফিসিয়ে বেশ কিছু কথা বলে দিলেন তারপর সরে গেলেন।
এদিকে জায়ানকে কোনরকম নড়চড় করতে না দেখে নিহান সাহেব জায়ানের গা ঘেসে ফিসফিস করে বলেন,
-‘ কি হচ্ছে জায়ান?উঠছো না কেন? চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো আরাবী মায়ের সাথে যাও।কোন রকম অভ’দ্রতা করে আমায় লজ্জা দিও নাহ।’

জায়ান বাবার কথায় শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বাবার দিকে।অতঃপর শক্ত গলায় নিচুস্বরে বললো,
-‘ যা করছো ভালো করছো নাহ।’

কথাটা বলেই জায়ান হনহনিয়ে চলে গেলো।নিহান সাহেব ছেলের দিকে হতা*শ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন।যাই হয়ে যাক আরাবীকেই তিনি পুত্রবধু রূপে ঘরে তুলবেন ব্যস।

#চলবে___________

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০২
স্নিগ্ধ প্রকৃতি,হিমেল হাওয়া বইছে।আকাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা।সূর্য প্রায় হেলে পরছে পশ্চিমে।লাল আভা ছড়িয়েছে চারদিকে। ছাদের আনাচে কানাচে গাছ-গাছালিতে ভরপুর।এমন একটা মনোরম পরিবেশেও মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আরাবী।আর কিইবা করবে ও? এমনিতেই কাঁপা-কাঁপি করতে করতে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর একটু পর বোধহয় শ্বাস আটকে মা’রা যাবে ও এমনটাই মনে হবে ওকে দেখলে।প্রায় আধাঘন্টা যাবত এমনভাবে দাঁড়িয়ে আরাবী।ভ*য়ের পাশাপাশি বিরক্তও হচ্ছে।ছাদে এসেছে পর থেকে জায়ান নামক ব্যাক্তিটি একটা কথাও বলেনি ওর সাথে না নিজ জায়গা হতে একটু নড়চড় করেছে।সেইযে এসে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে ফোনে কি যেন দেখছে তো দেখছেই।এদিকে যে তার সামনে একটা মানুষের ভ’য়ের চোটে দম ব*ন্ধ মা*রা যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।আরাবী যে একপলক তাকিয়ে লোকটাকে দেখবে সেই সাহসও হচ্ছে না ওর।কি একটা অবস্থা।গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে বা*জেভাবে।লোকটা কি তাকে পছন্দ করে নি?তাই তো কিছুই বলছে না।না করারই কথা।ওর গায়ের রঙটা তো শ্যামলা বর্ণের।আর মানুষ হলো সুন্দরের পূজারি।আর এতো বড়লোক বাড়ির ছেলে কি ওর মতো শ্যামলা গায়ের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হবে নাকি?যাই হোক বিয়েটা না হলেই ভালো।আরাবী এখনই বিয়ে করতে চায়না।সবে মাত্র অনার্স কমপ্লিট করেছে ও।মাস্টার্সের ভর্তি হয়েছে এইতো কিছুদিন পর থেকেই ক্লাস শুরু হবে ওর।ও মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা চাকরি করতে চায়।তারপরেই বিয়েটা করার ইচ্ছা আরাবী।মনেপ্রানে চায় ওর সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি যেন বিয়েতে না করে দেয়। তাহলেই হলো।কিন্তু এই বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে যে ওর মা ওকে কি করবে আরাবী জানে না।এই শ্যামবর্ণের জন্যে ওর দু-তিনিটা সম্বন্ধ ফিরত চলে গিয়েছে।এই জন্যে কম কথা শুনায়নি ওকে লিপি বেগম।তবে আরাবী এটুকু ভেবে পায় না।ওর ভাই আর ওর ছোট বোনের গায়ের রঙ ফর্সা,ওর আব্বু আম্মুও ফর্সা।তাহলে ও এমন শ্যামলা গায়ের রঙ পেলো কিভাবে? এই প্রশ্নটা প্রায় জাগে ওর মনে।কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করে না।এমন বাচ্চামো প্রশ্ন করা নেহাতই বোকামি বলে গন্য করবে সবাই।আরাবী চাপা শ্বাস ফেললো।ঠিক তখনই ছাদে এসে উপস্থিত হয় ইফতি।ইফতি সাখাওয়াত পুরো নাম। নিহান সাখাওয়াতের ভাই মিহান সাখাওয়াতের ছেলে ইশতিয়াক ইফতি সাখাওয়াত।ইফতি ছাদে এসেই চাপা স্বরে জায়ানকে ডেকে উঠলো,
-‘ ভাই,তোকে ডাকছে নিচে।’

কথাটা বলেই ইফতি দ্রুত পায়ে নিচে চলে গেলো।জায়ান ফোনটা পকেটে রেখে ছাদ থেকে নামার জন্যে অগ্রসর হলো।আরাবী ইফতির ঝড়ের মতো আসা যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলো।পরক্ষনে জায়ানকে ভালো মন্দ কিছু না বলে চলে যেতে দেখে আরাবী নিজেও নিচে যাওয়ার জন্যে অগ্রসর হলো।কিন্তু কাঁপাকাঁপির কারনে ঠিকঠাকভাবে হাটতেও পারছে না মেয়েটা।তার উপর এই শাড়িটাও তার সাথে যেন শ’ত্রুতামি শুরু করেছে। শাড়ির কুচিগুলো ঢিলে হয়ে বার বার নিচের দিক চলে যাচ্ছে। ফলে আরাবীর হাটতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। হাটার মাঝে একসময় শাড়ির কুচিতে পা পেঁচিয়ে পরে যেতে নেয় আরাবী।ভ’য়ে মৃদ্যু চিৎকার করে উঠে।নিজেকে রক্ষার জন্যে যা পায় তাই স্বজোড়ে আঁকড়ে ধরে মেয়েটা।ভ’য়ে প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার উপক্রম ওর।আজ যেন সব ওর সাথে উল্টাপাল্টা হচ্ছে।সাথে সাথে কোমড়ে কারো শীতল হাতের স্পর্শে সর্বাঙ্গ মৃদু ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠে।হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো হু হু করে।ব্যাপারটা ও যা ভাবছে তা যদি হয়ে থাকে।তাহলে আরাবী এখনই এই মুহুর্তে লজ্জায় কেঁদে দিবে।অলরেডি ওর চোখজোড়া ভিজে উঠেছে।ভেজা ভেজা চোখজোড়া নিয়েই আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো আরাবী।আর ওর আন্দাজ করা ব্যাপারটাই সত্যি।একমুহূর্তে ও জায়ানের বাহুডোড়েই বন্দি।সাথে নিজেও খামছে ধরে আছে জায়ানের গায়ে পরিহিত কোট’টা। লোকটার দিকে তাকালো আরাবী ভয়ে ভয়ে।সাথে সাথে যেন হৃদয়ের মাঝে কেমন করে উঠলো আরাবীর।নিজেও বুঝতে পারলো না কিছু।এমন সুদর্শন ছেলে না-কি ওকে বিয়ে করবে? গ্রে কালার সুট কোট পরিহিত,ফর্সা গায়ের ছেলেটা অধিক সুদর্শন। সূর্যের লাল আভায় অন্যরকম লাগছে, গালে চাপদাড়ি,পুরু ভ্রুজোড়ায় ওই চোখদুটোর সৌন্দর্য যেন দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।চোখের দিকে তাকাতেই আরাবীর যেন অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।দিন দুনিয়া ভুলে বেহায়ার মতো ওই চোখের দিকেই তাকিয়ে রইলো।চোখের পলক ফেলাও যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে ওর।হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠের চাপা ধমকে হুশ ফিরে আসে আরাবীর,
-‘ ডা’ফার একটা।শাড়ি পরে হাটতে না পারলে পরো কেন? এখন নিজেও পরতে সাথে আমাকেও ফেলতে,ইডি’য়ট একটা।’

আরাবী এমন ধমকে ভ’য়ে কেঁপে উঠলো।ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই হাশফা’শ করতে লাগলো আরাবী।জায়ানও আরাবীকে ছেড়ে দিলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরাবীকে একপলক দেখে তারপর হনহনিয়ে চলে গেলো নিচে।এদিকে আরাবী ক্যাব’লাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে। ভাবছে লোকটা একমুহূর্তে ওর সাথে কথা বললো।তাও কিভাবে?প্রথম কথাতেই ধম’কে ধাম’কে একাকার করে দিলো। আর ওইবা কি? মানছে লোকটা সুন্দর তাই বলে এইভাবে হা*বলার মতো তাকিয়ে থাকার কোন মানে হলো? কিভাবে তাকিয়েছিলো ও? লোকটা কি ভাববে এখন আরাবীকে?নিশ্চয়ই ভাববে আরাবী ছ্যা*ছড়া মেয়ে।নিজের মনে আরো শত রকম উল্টাপাল্টা ভাবনা চিন্তা করতে করতে নিচে নেমে আসলো আরাবীও।সাথি বেগম এগিয়ে এসে আরাবীকে টেনে নিয়ে আবারও নিজের পাশে বসালেন। নিহান সাহেব জায়ানের পক্ষ থেকে জানালেন তার ছেলের এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই। এখন আরাবী মতামত দিলেই হলো।জিহাদ সাহেব মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-‘ আরাবী,আম্মু তোমার কোন আপত্তি আছে এই বিয়েতে?’

আরাবী কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।কিইবা বলবে ও?ছেলে মেয়েদের আলাদা কথা বলতে পাঠালো তারা।অথচ আধাঘন্টা খামোখা সং সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজন।কেউ কোন কথা বলে নি।লাস্টে আসার সময় জায়ানই আগে কথা বললো কিন্তু ওটাকে কথা বলে না ওটাকে ধম’কাধম*কি বলে।এখন আরাবী তাদের এসব কথা কিভাবে বলবে?জিহাদ সাহেব আবারও একই প্রশ্ন করতে আরাবী নড়েচড়ে বসলো অপরপাশে সোফায় বসা লিপি বেগমের দিকে আঁড়চোখে তাকাতেই তিনি চোখ রা’ঙ্গিয়ে আরাবীকে ইশারা করলো হ্যা বলার জন্যে।আরাবী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আলতো করে মাথা দুলালো।সাথে সাথে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললো।দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাবী।নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েও বাবা মায়ের খুশির জন্যে হ্যা বলে দিলো আরাবী।ভবিষ্যতে যা হবে দেখা যাবে।আরাবী জানে ওর বাবা কখনো ওর খারা’প চাইবে না।বাবার উপর সেই ভরসা আছে ওর।তাই আর দ্বিমত করলো না।।এদিকে সাথি বেগম হাসি মুখে বলে উঠেন,
-‘ ভাই সাহেব ছেলেমেয়েদের যেহেতু কোন আপত্তি নেই।আমরা চাইছিলাম বিয়েটা যেন খুব দ্রুতই হয়ে যাক।আপনার কোন আপত্তি আছে?’

জিহাদ সাহেব বলেন,
-‘ নাহ নাহ আমার কোন আপত্তি নেই, আলহামদুলিল্লাহ! ‘

নিহাদ সাহেব বলেন,
-‘ তাহলে এই মাসের তো আর পনেরোদিন আছে।তাহলে জিহাদ সাহেব সামনের মাসের ১ তারিখেই ওদের বিয়ের ফাইনাল ডেট। কি বলেন?’

-‘ জি আচ্ছা,আপনারা যা ভালো মনে করেন।’

সবার মতামতে আগামী মাসের ১ তারিখই বিয়ের দিন নির্ধারন করা হলো। জায়ানের পরিবার আরাবীকে আংটি পরিয়ে দিলেন আর পাঁচ হাজার টাকা সালামিও দিলেন।তারপর তারা সন্ধ্যার হালকা নাস্তা করে চলে গেলেন।রাতের ভোজনের জন্যে অনেক সাধলেন জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগম কিন্তু তারা কেউ রাজি হলো না তাতে।জায়ান’রা চলে যেতেই জিহাদ সাহেব হেসে বলেন,
-‘ শুনলে লিপি আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমার আরাবী আম্মুর এতো ভালো ঘরে বিয়ে হবে।অবশ্য হবে নাই বা কেন?আমার আম্মুর মতো মেয়ে লাখে একটা হয়।আমার আম্মাটা আমার কাছে সেরা।’

জিহাদ সাহেব মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন।আরাবী চোখ বন্ধ করে বাবার বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো।তার বাবা এই বিয়েতে অনেক খুশি।আর বাবার খুশি জন্যে আরাবী সব করতে রাজি।কারন এই মানুষটাকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি ভালোবাসে ও।

#চলবে___________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।