হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-০২

0
1542

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-২
বিয়ে নিয়ে ঝিলিকের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। গায়ে হলুদে শ তিনেক ছবি তুলল। এতো উচ্ছ্বাস, আনন্দ নাতাশা খুব কম মানুষেরই দেখেছে। অবশ্য ঝিলিকের ব্যাপার টা আলাদা। এক বাড়ি পরে শ্বশুর বাড়ি। মন খারাপ এর কোনো কারণ নেই, বাবা মায়ের জন্য মন কেমন করা ব্যাপার টাও নেই। এরচেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! কিন্তু নাতাশার মনে হচ্ছে সবকিছু এতো সহজ হবে না। ঝিলিক ও’কে কতো পছন্দ করে, তবুও নাতাশার ঝিলিকের জন্য এমন ভাবনা কেন মাথায় এলো! ফাহাদের প্রতি আক্ষেপ থেকে বোধহয়!

ফাহাদের সাথে সম্পর্ক না থাকলে সম্পর্কগুলো বোধহয় বদলে যাবে। ঝিলিক কে তখন আর আপন মনে হবে না। দূরের কেউ ভেবে ওর কষ্টে আনন্দ পাবে!

বিয়ে বাড়ির ঝলমলে আলো, এতো আয়োজন সবকিছু ম্লান লাগছে নাতাশার। ইশরাকের মুখটা থমথমে। নিশ্চয়ই কল্পনায় অন্যকেউ এসেছে। যাকে ও খুব চেয়েছিল। নাতাশা বোধহয় ভাবনায় একটু ভুল করে ফেলল। মন থেকে একাগ্রভাবে চাইলে আজ ঝিলিকের জায়গায় তার থাকার কথা! নাতাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যা হয় ভালোর জন্য হয় কথাটা ভাবতে গিয়েও হাসি আসে। ওর জীবনে কী ভালো হয়েছে!

নাতাশা মানুষ হয়েছে মামার বাড়ি। সেখানে খুব যে কষ্টে ছিলো ব্যাপার টা তেমন নয়। তবুও একটা পর পর ভাব ছিলো। পড়াশোনায় ভালো ছিলো, ইউনিভার্সিটিতে পড়া অবস্থায় ই বিয়ে হয়ে গেল। পাত্র পছন্দ করলেন ছোট খালা। ফাহাদ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ঢুকেছে তখন। শ্বশুরের ব্যাংকের চাকরি ছিলো। স্বচ্ছল পরিবার। দুই ননদ আর একজন দেবর। খুশির তখন বিয়ে হয়েছে কেবল। মাসের অর্ধেক সময় বাপের বাড়ি, অর্ধেক সময় শ্বশুর বাড়ি থাকে। ঝিলিক, রিয়াদ দুজনেই ছোট। শাশুড়ীকে প্রথমে নরম স্বভাবের মনে হলেও পরে বুঝলো নরমের মধ্যে গরম। তবে নাতাশার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি টাইপ আচরণ কখনো করেন নি। ভুল কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখান বটে তবে ভালো কিছু করলে প্রশংসা করতে ভীষণ কার্পণ্য করেন। শ্বশুরের অবশ্য সংসারে তেমন কর্তৃত্ব নেই। তিনি সবার সঙ্গেই সমান। ভালো, মিষ্টভাষী।

খুশি এসে নাতাশাকে ডাকলো। বলল,

“ভাবী এখানে বসে আছ কেন? ইশরাক ডাকলো তোমাকে! ”

“বসে থাকলে আমাকে সবার চোখে পড়বে খুশি। এজন্য বসে আছি। ”

খুশি থতমত খেয়ে বলল,

“এভাবে কেন বলছ! এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। ”

নাতাশা উঠে যেতে গেলে খুশি আবারও প্রশ্ন করলো,

“ইশরাক তোমাকে কেন এতো খুঁজছে। কল করছে আবার এখানে এসেও বলছে তোমার সঙ্গে কথা বলবে।”

নাতাশা এবারের জবাব টাও দিলো কঠিন করে। বলল,

“সেটা ঝিলিক জানে। তুমি বরং ওর থেকে শুনে নিও। আমি বললে একটা কেমন ঝগড়ার মতো হবে। ”

খুশি হতভম্ব হয়ে গেল। নাতাশা নরম স্বভাবের হাসি, খুশি মেয়ে। মুখের উপর কাউকে কিছু বলে না। অথচ এখন কী হলো! দুটো কথা বলল দুটোই ঠাস ঠাস চড়ের মতো আওয়াজ করে!

****
“তোমাদের বাড়ি থেকে কেউ আসে নি কেন ভাবী?”

“তুমি জানো না? ”

“ভাবী এসব কেন হচ্ছে? ”

“ইশরাক, এই যে নাটক করার চেষ্টা তুমি এখন করছ সেটা একটু ঝিলিকের সঙ্গে কোরো প্লিজ। মেয়েটা অনেক স্বপ্ন, আশা নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু। ”

ইশরাক অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার জীবন তো খোলা বইয়ের মতো ভাবী। কোনো কিছু কারোর অজানা নেই। ঝিলিক কেন আমার থেকে এতকিছু এক্সপেক্ট করছে? ও’কে কী আমি কখনো ওই নজরে দেখেছি!”

“ও দেখেছে। আর তুমি কখনো ওর ভ্রম ভাঙো নি। ”

“ভাবী একটা কথা রাখবে? ”

“না ইশরাক, আজকের পর এই টপিকে আমরা আর কথা বলব না। জোর করে হলেও তোমার মনের মধ্যে ঝিলিক কে গেথে নাও। যার কথা ভাবছ তাকে নিজের দোষে হারিয়েছ। ”

ইশরাক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি তো সেটাই জানতে চাই। আমার আসলে দোষ টা কোথায়!

ঝিলিকের মন টা খারাপ হয়ে গেল বিয়ের পর পর ই। নাতাশাকে ডেকে বলল,

“ও তোমাকে কী বলল ভাবী?”

নাতাশা এই সময়েও হেসে ফেলল। ঝিলিক ইশরাক কে ভাইয়া বলে ডাকতো। এখন ‘ও’ সম্বোধন শুরু করেছে। নাতাশা স্পষ্ট গলায় বলল,

“ঝিলিক তুমি যা ভাবছ ঠিক তাই। ”

ঝিলিকের ম্লান হয়ে যাওয়া মুখ টা দেখে নাতাশার একটু খারাপ লাগছে। একটা কিছু বলে দিলেই পারতো! এতোটা স্পষ্টভাষী ও কবেই বা ছিলো! সবকিছু হারিয়ে যাবে বলেই কী এমন বিদ্রোহ চলে এসেছে। কারোর ভালো লাগা, খারাপ লাগা নিয়ে এখন আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না।

ফাহাদ কে দেখা গেল। মেরুন রঙের পাঞ্জাবী পরেছে। খানিকটা বিরক্তও মনে হচ্ছে। দায়িত্ব, কর্তব্য খুব ভয় পায়। অথচ ওর বউ এই দায়িত্ব কর্তব্যের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। ফাহাদ নাতাশাকে দেখে এগিয়ে এলো।

“তোমার শরীর খারাপ নাকি? কেমন যেন লাগছে। ”

“সস্তা মুখে দামী মেকাপ মনে হয় মানায় নি। ”

ফাহাদ বিরক্ত হলো না, নাতাশা চেয়েছিল একটু বিরক্ত করতে। ফাহাদ বলল,

“শোনো একটা বক্সে একটু খাবার ভরে দিও তো। অফিসের হেমায়েত ভাই কে পাঠাব। বেচারা অসুস্থ বলে ভাবীও আসতে পারলো না। পোলাও, রোস্ট যা যা আছে সব দিও।”

“বক্স দুটো হবে না? আরেকটা ইকরার ওখানে যাবে না!”

ফাহাদ শীতল চোখে তাকালো। নাতাশা ভয় পেল না একটুও। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। জয়ের হাসি।

****
“আমি যে তোমাকে নিয়ে কী ভয়ে ছিলাম। তুমি তো কিছু জানালেও না। এদিকে মায়ের টেনশন! ”

সুপ্রীতি কফিতে চিনি মেশাচ্ছে। প্রকৃতি আবার কফিতে বেশী চিনি খায়। কফির মগ টা নিতে নিতে প্রকৃতি বলল,

“এবার বলো তো আপু ঘটনা কী?”

“সিরিয়াস কিছু না। ”

প্রকৃতি বিশ্বাস করলো না। সুপ্রীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো। শুনে প্রকৃতি বলল,

“ভাইয়ার রাগ দেখে কী তুমি ভয় পেয়েছ?”

“প্রথমে পেয়েছি! এতো অস্বাভাবিক রাগ আমি কারোর দেখিনি।”

“এখন সব ঠিকঠাক? ”

“হু। মা’কে কিছু বলিস না। কিছুই না। ”

“আচ্ছা। ”

“তুই কিন্তু দুপুরে খেয়ে যাবি। অর্ণব জানালো আজ দুপুরে খেতে আসবে। ”

প্রকৃতি সুপ্রীতিকে দেখলো। সবকিছু গুছিয়ে রান্নার আয়োজন করছে। এই ফ্ল্যাটে ওরা দুজন থাকে। দোতলায় ওর বড় ভাসুর থাকে। নীচতলায় থাকেন শাশুড়ী। সবাই যার যার মতো আলাদা থাকে। এতে সম্পর্ক ভালো থাকে। সুপ্রীতির শাশুড়ী একাই থাকেন। গ্রামের দু:সম্পর্কের এক আত্মীয় আছে মলিনা তাকে নিয়ে। নিজেই রান্না করেন। শরীর ঠিক থাকলে ছেলেদের বাসায় আসেন বিকেলের দিকে একবার।

অর্ণব দুপুর বেলা এসে প্রকৃতিকে দেখে বলল,

“আরে তুমি যে! কখন এলে?”

“এই তো সকালে। আপু ওইদিন গেল না, ভাবলাম দেখা করে আসি। মা জানে না অবশ্য। ”

অর্ণব হেসে ফেলল। বলল,

“বুঝিনা তোমরা মা’কে কেন এতো ভয় পাও? সুপ্রীতির কাছে এলেও মা’কে জানিয়ে আসতে হবে কেন?”

“মা একটু আমাদের বেশী শাসন করেছেন তো এজন্য। ”

“এটা ভাই ভারী অন্যায়। এভাবে চলতে থাকলে তোমাদের প্রেম টেম তো হবে না। ”

অর্ণব কথাটা বলে শব্দ করে হাসলো। প্রকৃতি কথাটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও আড়চোখে সুপ্রীতিকে একবার দেখলো। ও জানে না যে আপু তার জীবনের কতটুকু সত্যি বলেছে ভাইয়া কে।

সুপ্রীতি কিভাবে কিভাবে যেন ভালো রাঁধতে শিখে গেল। মা ওদের রান্নাঘরে যেত দেন না। ওসব বিয়ের পর শিখলে হবে সবসময় তেমন বলতেন। তার মধ্যেও সুপ্রীতি দারুণ সব রান্না শিখে গেল। অল্প সময়ে বেশ আয়োজন করেছে সুপ্রীতি। ছোট বাটিতে করে শাশুড়ীকেও খাবার পাঠিয়েছে। উনি না খেলেও এই আন্তরিকতা পছন্দ করেন।

চিংড়ি দিয়ে কচুর লতির তরকারি টা মুখে দিয়ে প্রকৃতি বলল,

“লবণ মনে হয় একটু বেশী দিয়েছ আপু। ”

সুপ্রীতি একটু ভেবে বলল, হতে পারে। খেয়াল করা উচিত ছিলো।

অর্ণব চুপচাপ খাচ্ছিলো। কচুর লতির বাটিটা নিয়ে প্লেটে খানিকটা তুলে নিয়ে খেল। প্রকৃতি দেখছে আড়চোখে। অর্ণব হেসে বলল,

“তুমি রাঁধতে পারো প্রকৃতি? ”

“নুডলস, চা, পাস্তা এগুলো পারি। ”

“উঁহু। একদিন তুমি আমাকে কচুর লতির এই তরকারি টা করে খাওয়াবে। ”

প্রকৃতি হেসে বলল, আচ্ছা।

অর্ণব সুপ্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল,

“রান্না মজা হয়েছে। এতোটাও লবণ হয় নি। এই আইটেম টা আমিই খাব। ”

প্রকৃতি মাথানিচু করে হাসলো। কচুর লতিতে দ্বিতীয়বার লবণ দেয়ার অকাজ টা ও করেছে। ওর যা দেখার ছিলো সেটা দেখা হয়ে গেছে।

একবার তাকায় বোনের দিকে। মনে পড়ে যায় একদিনের কথা। সুপ্রীতি উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকে প্রকৃতিকে ডাকে।

“কৃতি, কৃতি কোথায় তুই! আমাকে এসে একটু জড়িয়ে ধর। কষ্টে আমি মরে যাচ্ছি!”

****
ইশরাক ঘরে ঢুকেই ঝিলিকের উদ্দেশ্যে বলল,

“তুই কী ওয়াশরুমে চেঞ্জ করবি নাকি ঘরে? ”

“কেন?”

“প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করিস কেন? সারারাত এভাবে বসে থাকবি? ঘুমাবি না। ফুলটুল সরিয়ে বেড টাকে ঠিক করতে পারতি। ”

ঝিলিক হেসে বলল,

“আজকে এতো মেজাজ দেখাচ্ছো কেন? বাসর রাত স্মরণীয় করে রাখবে?”

ঝিলিক টা সবসময় ই ফাজিল। ছোটবেলায় একবার সব আত্মীয়দের সামনে বলেছিল, আমি বড় হয়ে ইশরাক ভাইয়াকে বিয়ে করব। এই যে পেয়ারা গাছ ছুঁয়ে বলছি আমি ইশরাক ভাইয়াকেই বিয়ে করব।

কতোশত স্মৃতি সব ভুলে গেল অথচ এই ব্যাপার টা মনে আছে। ইশরাক নিজেই বিছানা ঠিক করলো। ফুলগুলো অবহেলায় মাটিতে পড়ে আছে অসহায়ের মতো। ঝিলিক বসে আছে রকিং চেয়ারে। ইশরাক সব ঠিকঠাক করে বলল,

“বাতি নিভিয়ে দে। ”

“আমাকে একটু দেখলে না?”

ইশরাক ঝিলিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোকে নতুন করে দেখার কী আছে? ছোট থেকে দেখছি। ভ্যা ভ্যা করতি সারাদিন। চূড়ান্ত ফাজিল, বেয়াদব ছিলি, এখনো আছিস। ”

“আহ! বউ সেজেছি তো। সেটা দেখার কথা বলছি। ”

ইশরাক পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। বলল,

“বউ সাজে সবাইকেই ভালো লাগে। অগা মগা সবাইকেই। কিন্তু তোকে লাগছে না। তোকে লাগছে বিষের মতো। ”

“তাহলে খেয়ে মরে যাও প্লিজ। প্লিজ প্লিজ প্লিজ! ”

ঝিলিক শব্দ করে হাসলো।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা