#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৪
অর্ণবের সঙ্গে সুপ্রীতির বিয়েটা পারিবারিক ভাবে ঠিক করা। অর্ণব অসংখ্য মেয়ের মধ্যে থেকে সুপ্রীতিকে পছন্দ করেছে। অর্ণবের ছোট মামীর সঙ্গে সুপ্রীতির মায়ের সদ্ভাব আছে। একটা অনলাইন গ্রুপ থেকে পরিচয়। এদিকে অর্ণবের জন্যও পাত্রী দেখা হচ্ছিলো। তখন সুপ্রীতির ছবিটা দেখায়। অর্ণব প্রথমে হ্যাঁ বললেও সুপ্রীতির কাছ থেকে নেতিবাচক রিয়েকশন আসে। বলা হয়েছিল সুপ্রীতি বিয়েতে এখন আগ্রহী নয়, ক্যারিয়ারে ফোকাস করার ইচ্ছে। গ্রাজুয়েশন শেষ করে এমবিএ পড়ার প্ল্যান। এরপর চাকরি, তারপর বিয়ে। মোটামুটি লম্বা একটা সময়। অর্ণবের অবশ্য বিয়ের তাড়া নেই। তবুও বলে নি যে সুপ্রীতির জন্য অপেক্ষা করবে। অন্য পাত্রী দেখা হচ্ছিলো। মেডিকেলে পড়ুয়া, আইন বিষয় নিয়ে পড়া পাত্রীকেও অর্ণব না করে দিয়েছে। স্পেসিফিক কোনো ব্যাপার নেই, ছবি ও প্রোফাইল দেখে ওর মনে হতো ওদের ভাইব ম্যাচ হবে না।
অর্ণব মায়ের আদুরে ছেলে। ছোট থেকেই একটা ভয়ংকর সমস্যা হলো রেগে গেলে মাথার ঠিক থাকে না। বড়দের যুক্তিমতে অর্ণবের জন্য শান্ত, নরম, ভদ্র ধরনের ঘরোয়া মেয়ে প্রয়োজন। অর্ণব এই যুক্তিতে বিশ্বাসী নয়। পার্টনার কে অবশ্যই স্মার্ট হতে হবে। যেকোনো বিষয়ে কথা বলার সময় শ্রোতা হিসেবেও দারুন সাপোর্টিভ হতে হবে। লুকস ব্যাপার টা অতো ম্যাটার করে না। আজকাল টাকা থাকলে চেহারা ঠিক করে নেয়া কোনো ব্যাপার ই না। শুধু মগজ টা উন্নত আর এক্টিভ থাকলেই হবে।
সুপ্রীতিকে এক দেখায় ভালো লেগে যায়। অর্ণবের এরকম খুব কম ই হয়েছে। প্রথম দেখায় কাউকে ভালো লাগে নি। অনেক বার সম্পর্ক তৈরী হতে গিয়েও হয় নি। দেখা হয়েছিল সুপ্রীতিদের বাসায়। সবাই মিলে আয়োজন করে গেছে পাত্রী দেখতে। অর্ণব ঘরে ঢুকেই সুপ্রীতির বাবাকে বলল,
“আঙ্কেল আমি আগে সুপ্রীতির সঙ্গে দেখা করতে চাই। ”
বাসাভর্তি লোকজন সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। মেয়ে দেখতে এসেছে। মেয়ে সেজেগুজে আসবে তারপর না দেখা হবে। স্বপ্না হেসে বললেন,
“বসো বাবা, সুপ্রীতি আসছে এক্ষুনি। ”
অর্ণব স্মিত হেসে বলল,
“সুপ্রীতিকে সবার সামনে গরুর মতো প্রদর্শন করতে হবে না আন্টি। আমি এসেছি, আমিই দেখা করে কথা বলব। ”
গোটা ঘর একই সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল যেন। সবাই চুপচাপ। সুপ্রীতির বাবা বললেন,
“তুমি এসো আমার সঙ্গে। ”
যেখানে স্বপ্নার কথা ছাড়া কিছুই হয় না সেখানে সুপ্রীতির বাবা সিদ্ধান্ত নিতে একবারও সময় নিলেন না।
অর্ণব কে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে বাবা ডাকলেন।
“প্রীতি, মা আছিস। ”
সুপ্রীতি দাঁড়ালো। শাড়িটা তখনও খাটের উপর রাখা। স্পেশাল জামদানী কালেকশন থেকে বেছে নেয়া হয়েছিল। সুপ্রীতি পার্লারে সাজতে যাবে না। অনিয়মিত ঘুম, টেনশন, অশান্তির কারণে মুখে অসংখ্য ব্রন আছে। জেদী মেয়ে মেকাপের আবরনে ঢেকে কাউকে ইমপ্রেস করতে একটুও আগ্রহী নয়।
বাবা সুপ্রীতির সঙ্গে কথা বলে অর্ণব কে যেতে বলল। অর্ণব ঘরে ঢুকেই সালাম দিলো। জিজ্ঞেস করলো,
“বারান্দায় এতো সবজি গাছ কেন? ফুল ভালো লাগে না? শুধু খেতেই ভালো লাগে? ”
সুপ্রীতি ওই নার্ভাস মুহুর্তেও হেসে ফেলল। মুখে বলল, না যে এই বাসায় কর্ত্রী যা চান তাই ই হয়। অন্যের ভালোলাগায় তার বিশেষ কিছু আসে যায় না।
সুপ্রীতির পরনে তখন কলাপাতা রঙের সুতি জামা। চুলে শ্যাম্পু করা, পিঠময় ছড়ানো। ঠোঁট পর্যন্ত শুকনো। একটুও অস্বস্তি নেই ওর তাতে। অর্ণব সরাসরি ওর দিকে তাকালো না। বলল,
“তোমার ফিউচার প্ল্যান হঠাৎ পাল্টে গেল কেন? জাস্ট কিউরিওসিটি থেকে জানার ইচ্ছা। আমি আসলে জানতে চাচ্ছি যে বাই এনি চান্স তোমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়েতে বাধ্য করা হচ্ছে না তো!”
সুপ্রীতি মাথা নেড়ে না বলল। একটু সময় নিয়ে বলল,
“আমি বিয়েতে এখন রাজী। ”
“শিওর?”
“হ্যাঁ। ”
“এতো তাড়াতাড়ি কোনো ডিসিশনে পৌছানো ঠিক না। তুমি সময় নাও। ”
সুপ্রীতি কোনো জবাব দিলো না। ওর মাথায় তখনও হাজারো অভিযোগ, অনুযোগ, প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অবচেতন মন বলছে ইশরাকের জীবনে তোমাকে প্রয়োজন নেই সুপ্রীতি। তুমি বোকা মেয়ে, ইশরাক তোমাকে ছাড়া ভালো থাকবে। ওর জীবনে কিচ্ছু আটকে থাকবে না, ওর অনেকে আছে। অনেক মানুষ, অনেক কারণ। যেসব কারণে ও ভালো থাকবে! তোমার কে আছে বলোতো! কেউ নেই কেউ নেই।
সুপ্রীতি হঠাৎ বলল,
“আপনাকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই। ”
অর্ণব ওর দিকে তাকালো। ও কিছুই বলে নি, অথচ সুপ্রীতির কথাটা জবাবের মতো শোনালো। অর্ণব বলল,
“তুমি আরও সময় নাও। আমার তাড়া নেই। আমি একবার ই বিয়ে করব। ভালো না লাগলে বউ ছেড়ে দেব এমন ছেলে আমি নই। ”
সুপ্রীতি চোখ তুলে তাকালো। অর্ণব দ্বিতীয়বার মুগ্ধ চোখে দেখলো। এই মেয়েটা বেশী সুন্দর ওই দুটো চোখের জন্য। গভীর সুন্দর চোখ।
***
সুপ্রীতি শাড়ি পরে সুন্দর সেজেগুজে গেল। ভারী মেকাপ নয়, যতটুকুতে প্রেজেন্টেবল লাগে ততটুকুই করেছে। ঠোঁটে লিপস্টিকও পরেছে মানানসই। স্বপ্না নিজেই মেয়েকে দেখে চমকে গেলেন। সুপ্রীতির গায়ের রঙ প্রকৃতির মতো ফর্সা নয়। শ্যামলার চেয়ে একটু উজ্জ্বল গড়নের। তবুও সবাই সুপ্রীতিকে বেশী সুন্দর বলে। অর্ণব দের বাড়ি থেকে আনা ডায়মন্ডের আংটি টা সুপ্রীতি স্বেচ্ছায় হাত বাড়িয়ে পড়লো। কোনো বাড়তি ভান, কিংবা নাটকীয় ঘটনার ধার ধারলো না।
সুপ্রীতির বাবা সেদিন সুপ্রীতির সঙ্গে কথা বলতে এলেন। সুপ্রীতি জবাবে ক্লান্ত গলায় বলল,
“যা চেয়েছি মন থেকেই চেয়েছি বাবা। আমারও একটু নি:শ্বাস নেয়ার প্রয়োজন বাবা। ”
***
বিয়ে হলো ধুমধাম আয়োজনে। গা ভর্তি কতরকমের গয়না পেল সুপ্রীতি। অর্ণবের খালা, ফুপু, মামা সবাই দু’হাত ভরে দিলেন। আনন্দে স্বপ্না ঝলমল করছে। প্রকৃতি আর বাবার অন্য চিন্তা। তাদের চিন্তাধারা সুপ্রীতির ভালো থাকা, মানসিক শান্তিতে থাকা। সুপ্রীতির ভাই সাদাত কেবল ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলো। দুনিয়ার এতো প্যাচগোছ বোঝে না। বড় আপুর বিয়েতে বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আনন্দ করলো।
সুপ্রীতি শ্বশুর বাড়ি যখন যাবে তখন স্বপ্না খুব কাঁদলেন। সুপ্রীতি কাঁদলো তবে সেটা প্রকৃতিকে জড়িয়ে ধরে। বাবার সামনেও হাসিমুখে বলল, আসি বাবা। তোমার দোয়া ও প্রার্থনায় আমাকে একটু অন্যদের থেকে বেশী রেখো।
গাড়িতে যাবার সময় অর্ণব টিস্যু নিয়ে সুপ্রীতির চোখ টা যত্ন করে মুছিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বলল,
“প্রকৃতিকে তুমি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসো না?”
সুপ্রীতি অবাক চোখে অর্ণব কে দেখলো। ও তো কখনো ভাবে নি কাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। মায়ের অতিরিক্ত শাসন সবসময়ের। বাবা সেই শাসন রুখতে পারতেন না বলে একটু বাড়তি আদর করতেন। তবে কখনো মায়ের উপর কথা বলতেন না। তাই বাড়তি আদরটুকু হেরে যেত অনুযোগের কাছে। সাদাত বাচ্চা ছেলে, বড় বোন হিসেবে যতটুকু আদর ওর পাওনা সেটুকু সুপ্রীতি কখনো প্রকাশ করতে পারে নি ওর অন্ত:র্মুখী স্বভাবের কারণে। বাকী রইলো প্রকৃতি, যার সঙ্গে সব শেয়ার করা যায়! বিছানা থেকে শুরু করে দু:খ, সুখ সবকিছু। একবার ওর ইউনিভার্সিটি ট্যুরে যাবার টাকা শর্ট পড়লো। মা টাকা দিবেন না, প্রকৃতি কোত্থেকে যেন ম্যানেজ করলো। বেশী না, সাড়ে তিন হাজার টাকা। ওর ঈদের জামাটা রিসাইকল গ্রুপে বিক্রি করে দিয়েছিল খুব ই কম দামে।
হ্যাঁ, সুপ্রীতি ওই বাড়িতে বোধহয় প্রকৃতিকেই ভালোবাসে। যে সত্যিই ও’কে একটু বুঝতে পারে।
অর্ণব ওর মেজাজ হালকা করতে বলল,
“তোমার মা যেভাবে কাঁদছিল তাতে মনে হচ্ছে কোনো ডাকাতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তোমার। কেন আমাকে কী হ্যান্ডসাম লাগছে না?”
সুপ্রীতি মৃদু হাসলো।
***
ঝিলিকের জ্বরে অচেতন ছিলো দুদিন। কিছু খেতেও পারছিল না। যা কিছু খাওয়ানো হয় সব বমি করে ফেলে। ইশরাক নিজ হাতেই সেগুলো পরিষ্কার করলো। খালা এসে দুদিনের রান্না করে দিয়ে গেছেন। সেগুলো বক্স ভরে ফ্রিজেই রাখা হয়েছে। ইশরাক নিজেও তেমন কিছু খেতে পারে নি। ভাতের সঙ্গে ডিমভাজি করে খেয়ে নিয়েছে। ঝিলিক কে রেখে খেতে বিবেকে বাঁধলো।
একটু সুস্থ দেখে ইশরাক আজ অফিসে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। ঝিলিক কে বলল,
“আমি না আসা পর্যন্ত খালা থাকবেন। তবুও কিছু দরকার হলে একটা কল করিস। ”
“দরকার হবে না। ”
“ঠাস ঠাস জবাব দেয়া বন্ধ কর। জ্বর বাঁধিয়ে বাঁকা হয়ে পড়েছিলি। তখন তো তেজ দেখাতে পারলি না। ”
“আমি কী তোমাকে বলেছিলাম নার্সগিরি করতে!”
“কথাবার্তা ভীষণ খারাপ তোর। ওষুধ গুলো খেয়ে উদ্ধার করিস। ”
ইশরাক যেতে গিয়েও ফিরে এসে বলল,
“কাবার্ড খালি আছে। জিনিসপত্র রাখিস। ”
ঝিলিক কিছু বলল না। ইশরাক যাবার পর রান্নাঘরে ঢুকে ভাত রাঁধলো। লাল করে মরিচের ভর্তা করে ভাত খেল। তার ভারী জিনিসপত্র দিয়ে আস্তে আস্তে সময় নিয়ে কাবার্ড ভাঙলো। খালা এই অবস্থা দেখে ইশরাক কে ফোন করে বলল। ও কিছু বলল না, মনে মনে প্রার্থনা করলো যেন আল্লাহ ওর সহ্যশক্তি বাড়িয়ে দেয়।
ইশরাক সন্ধ্যেবেলা ফিরে শুনলো ঝিলিক নিজে রান্না করে খেয়েছে। খালার দেয়া চা টুকুও খায় নি। ঘরে ফিরে কাবার্ডের ওই অবস্থা দেখে রাগার বদলে হেসে ফেলল।
যেটুকু রাগ অবশিষ্ট ছিলো সেটুকুও গলে বরফ হলো ঝিলিক কে দেখে। গোসল করে লাল রঙের শাড়ি পরেছে। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ছাটা, সেগুলো ছেড়ে রেখেছে। ঠোঁটে লিপস্টিকও লাগিয়েছে। ইশরাক না চাইতেও মুগ্ধ চোখে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
“কোথাও যাচ্ছিস নাকি?”
ঝিলিক নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলো,
“হ্যাঁ। ঘুমাতে।”
চলবে….