হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-৫+৬

0
1203

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৫
ঝিলিক অন্যঘরে ঘুমাতে গেল। ইশরাক কিছু বলল না। যেভাবে শান্তি পায় সেভাবে থাকুক। এতে অবশ্য ওরও শান্তি। ঝিলিকের বকবক থেকে একটু তো নিস্তার পাওয়া যাবে। রাতে খাওয়ার সময় ঝিলিক কে ডাকলো। ও সাড়া দিলো না। ইশরাক খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে নিজে খেয়ে নিলো। একটু মন টা খচখচ করছিল অবশ্য। এতো জ্বর গেল, রাতে খাবার পর ওষুধও ছিলো। বাড়ি থেকে বাবা, মা কল করেছিল। ঝিলিকের খেয়াল রাখতে বলেছিল। নাতাশাও কল করে ইশরাক কে কিছু কঠিন কথাবার্তা শুনিয়েছে। সুপ্রীতির জিনিসপত্র এখনো ওর কাবার্ডে কেন! ঝিলিকের সঙ্গে কেন সুপ্রীতির তুলনা করছে! পরিস্থিতি এতো জটিল হবে তাহলে বিয়েই বা কেন করেছে!

ইশরাক চুপ করে শুনেছে। এখন যে যা বলে ও চুপচাপ শুনে নেয়। শুধু ঝিলিক কিছু বললে উত্তর তৈরী থাকে। ইশরাক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সুপ্রীতির জিনিসপত্র বলতে শুধু ও’কে বিভিন্ন সময় দেয়া কিছু গিফট। এছাড়া আর কিছু না। সুপ্রীতি সেগুলো ফেরত পাঠিয়েছে, সেই সঙ্গে নিয়ে গেছে ও’কে দেয়া জিনিসগুলোও। প্রকৃতি এসেছিল জিনিসগুলো নিতে। নির্লিপ্ত গলায় বলেছে,

“আপুর বিয়ে হয়ে গেছে ইশরাক ভাইয়া। তোমার সঙ্গে সবকিছু যেহেতু ক্লোজ হয়ে গেছে এগুলো আকড়ে ধরে রাখার কোনো লজিক নেই। ”

প্রকৃতি ছোট একটা মেয়ে। ইউনিভার্সিটি তে এবার থার্ড ইয়ারে পড়ছে। অথচ এমন কঠিন কঠিন কথা বলে গেল ইশরাক কে। ইশরাক প্রশ্ন করেছিল,

“আমার অপরাধ টা কী জানিয়ে যাও প্রকৃতি। সুপ্রীতি নিশ্চয়ই তোমাকে জানিয়েছে।”

“তোমার অপরাধ কিংবা দোষ তোমার থেকে ভালো কেউই জানে না। ”

ইশরাক সেদিন পাল্টা জবাব দিয়েছিল,

“ভালো মানুষ হওয়া দোষ নাকি পরোপকারী মানুষ হওয়া দোষ? ”

“কথায় কথা বাড়বে ইশরাক ভাইয়া। এক পর্যায়ে সেটা ঝগড়ায় রুপ নিবে। তোমার সঙ্গে ঝগড়া হোক চাই না, নাতাশা আপু আমাদের বোন। তার শ্বশুরবাড়ির মানুষজন কে ডিজরিসপেক্ট করতে আমার ভালো লাগবে না।”

“তাহলে এই জ্ঞান তোমার মায়ের মধ্যে কেন নেই। সে তো বিভিন্ন সময়ে অনেক কথা শুনিয়েছে আমার আপুকে, মা’কে। ”

প্রকৃতি এই জায়গায় এসে থেমে যায়। শব্দভান্ডারও ফুরিয়ে যায়। যাবার আগে বলে যায়,

“আপু তোমার জন্য সব ছাড়তে প্রস্তুত ছিলো। সব ছেড়েও ছিলো কিন্তু… তুমি তখন তাকে কোনো সম্মান দেখাও নি। ”

ইশরাক কিছু বলে না। প্রথম যখন সুপ্রীতির বিয়ের খবর ও শুনেছিল তখন কথাটা বিশ্বাস করে নি। ভেবেছিল এভাবে কিভাবে আরেকজন কে বিয়ে করে নিতে পারে! সুপ্রীতির পক্ষে তো এটা সম্ভব ই না। সুপ্রীতি কতটা সেনসিটিভ সেটা তো ও জানে। পরে যখন শুনলো ওর মায়ের পছন্দের পাত্র তখন ধরে নিলো বিয়েতে সুপ্রীতির মত ছিলো না একফোঁটাও। জোর করে দেয়া হয়েছে। ঝিলিকের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা হবার পরও ইশরাক চেয়েছে সুপ্রীতির সঙ্গে একবার কথা বলতে। একবার যদি সুপ্রীতি ওকে বলতো ওর কাছে ফিরতে চায় তবে ফিরিয়ে আনতো কোনো প্রশ্ন ছাড়াই। পুরো দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই করার সাহস ওর তখন ছিলো। সুপ্রীতি কোনো যোগাযোগ করার সুযোগ রাখে নি। ওদের যত কমন ফ্রেন্ড ছিলো তারাও ইশরাক কে সুপ্রীতির কোনো খোঁজ দেয় নি। উল্টো ইশরাকের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করলো।

বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ইশরাকের একটু চিন্তা হলো। ঝিলিক কে ডাকবে একবার! যা সব বাজে চিন্তা ওর মাথায় ঘোরে, কী না কী বলে বসবে মুখ ফসকে!

ঝিলিক এলো ঘন্টাখানেক এর মধ্যেই। আদো আলোতে ইশরাক ঝিলিক কে দেখে হেসে ফেলল। কাজল, লিপস্টিক সব ঘেটে গেছে। অদ্ভুত রকমের লাগছে। ঝিলিক বালিশ টা ইশরাকের পাশে রেখে বলল,

“ভুত আছে মনে হয় এই বাসায়। দু’বার কার যেন ছায়া দেখলাম। ”

ইশরাক মৃদু হেসে বলল,

“আগে ছিলো না। ঘাড়ে করে নিয়ে এলাম যে বাড়ি থেকে। ”

“আমাকে ভুত বলতেও মানুষের কলিজা থাকা লাগে। কত ছেলে এখনো আমার জন্য পাগল জানো?”

“জানিনা। প্লিজ একটু জানা তো। সবাইকে আমি কল করব। হেমায়েতপুরে তাদের সমস্যা হচ্ছে কী না জিজ্ঞেস করব!”

“আমার সঙ্গে রসিকতা কোরো না তো। ভালো লাগছে না। ”

ইশরাক পাশ ফিরে কপালে হাত দিয়ে বলল, দেখি জ্বর আছে কীনা!

ঝিলিকের কপাল টা গরম। ইশরাক বলল,

“জ্বর আছে। এতো অনিয়ম করিস! চল ওষুধ খেতে হবে। ”

“উঁহু, জীবনেও খাব না।”

ইশরাক গলার স্বর কঠিন করে বলল,

“ওঠ ঝিলিক!”

ঝিলিক উঠলো। ইশরাক খাবার গরম করলো। ভাত, ডাল, মুরগীর মাংস। ”

ঝিলিক এক লোকমা মুখে দিয়ে বলল,

“খালার রান্না খুব ই জঘন্য। ”

“একটুও না। জ্বর মুখে খাচ্ছিস তাই লাগছে। ”

“জ্বর মুখে মরিচ ভর্তা তো খুব ভালো লাগলো। ”

“তুই না ঝাল খেতে পারিস না?”

ঝিলিক মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে ইশরাকের দিকে তাকালো। খাবারটুকু গিলে বলল,

“তুমি সেটাও খেয়াল করেছ তাহলে? শুধু ভাব নাও যে আমাকে পছন্দ করো না। ”

ইশরাক তাকালো। ফ্যামিলি গেট টুগেদারে মাংসে ঝাল হয়েছে বলে ঝিলিক খায় নি। খুব সামান্য ব্যাপার। অন্য কাজিন দেরও এরকম দুই একটা অভ্যাস হয়তো চোখে পড়েছে। অথচ ঝিলিক সেটাকে কী না কী ভাবছে।

ঝিলিক ভালোই খেল। খিদেও পেয়েছিল বোধহয়। ওষুধ খেয়ে ইশরাকের গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। ইশরাক একটু সরতেই আবার সেই জায়গাটা দখল করে নিলো। ঝিলিকের গরম নি:শ্বাস পড়ছে ওর ঘাড়ে। এভাবে চলতে থাকলে একটা কিছু ভুল খুব শিগগিরই হবে। ইশরাক মৃদু গলায় বলল,

“একটু পাশে সর ঝিলিক। আমার এভাবে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। ”

ঝিলিক বলল,

“তার মানে তোমার চরিত্র ঠিক আছে। ”

“চরিত্র ঠিক আছে মানে কী?”

“সুপ্রীতির সঙ্গে ভয়ংকর কিছু নিশ্চিত ঘটে নি!”

ইশরাক ভীষণ বিরক্ত হলো। উঠে চলে যেতে গেলে ঝিলিক বলল,

“আচ্ছা সরি। সুপ্রীতির নাম নেয়া উচিত হয় নি। রাতে এরপর আর সুপ্রীতির নাম নেব না। মাথায় রাখব যে তুমি উত্তেজিত হয়ে যাও। ”

ইশরাক পাশ ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে ঝিলিক আবারও ওর গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো।

***
“এটাকে আবার হানিমুন টাইপ ভেবো না। কোম্পানি থেকে স্পন্সর করলো ভাবলাম ঘুরে যাই। ”

সুপ্রীতি হেসে বলল,

“আচ্ছা। রিসোর্ট টা সুন্দর অনেক। ”

“অতো বেশী না। তুমি যে কয়টা দেখেছ তার মধ্যে বোধহয় এটা সুন্দর। ”

সুপ্রীতি মাথা নাড়লো। অর্ণব সুপ্রীতির মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো। এক্ষুনি ও একটা কঠিন কথা সুপ্রীতিকে বলেছে, সেটার প্রতিক্রিয়া কেমন আসে সেটা দেখার অপেক্ষা করছে।

সুপ্রীতি খুব ই স্বাভাবিক। হাত, মুখ ধুয়ে ময়েশ্চারাইজার মাখলো স্বাভাবিকভাবে। মুখাবয়বও স্বাভাবিক। অর্ণব নিশ্চিন্ত হলো। বেশ কিছুদিন ধরে ওদের মধ্যে একটা রাগারাগি ভাব চলছিল। সেদিন পার্টির ঘটনাটা নিয়ে অর্ণব আপসেটও ছিলো খুব। যতটা রাগ ওই রাস্কেল টার প্রতি ছিলো তারচেয়ে বেশী রাগ ছিলো সুপ্রীতির উপর। ও আশা করেছিল ওই কমেন্ট শুনে সুপ্রীতি নিজেই প্রতিবাদ করবে।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ভীষণ। এই সময়ে কতটুকু ঘুরে দেখা যাবে কে জানে! তবে রিসোর্টে থাকতেও সুপ্রীতির খারাপ লাগছে না। অর্ণব এসেই লম্বা ঘুম দিয়েছে। সুপ্রীতি একাই বসে বসে বৃষ্টি দেখছিল। ইচ্ছে করছিলো কফি খেতে। কফির সব সরঞ্জাম দেয়া আছে। পানি গরমের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু সুপ্রীতি খায় নি। অর্ণব কে ছাড়া খেতে ইচ্ছে করে নি ব্যাপার টা তেমন না, তবে ও খেয়াল করেছে যে অর্ণব ওর এই অপেক্ষা করা ব্যাপার টা ভীষণ উপভোগ করে। রাতে যেদিন সুপ্রীতি না খেয়ে বসে থাকে সেদিন অর্ণব বলে যে অপেক্ষা না করলেই পারতে, খেয়ে নিতে। তবুও ওর উজ্জ্বল মুখ টা দেখে বোঝা যেত যে ব্যাপার টা উপভোগ করছে।

সুপ্রীতি সম্পূর্ণ অচেনা একজন কে বিয়ে করেছে। আগে থেকে পছন্দ, অপছন্দ জানার সুযোগ পেয়েছে কম। এখন জানার চেষ্টা করছে। একই চেষ্টা অর্ণবও করছে, একদিন বলল, তোমার প্রোফাইল ঘুরে বুঝলাম ঘুরতে ভালোবাসো। আমার অবশ্য তেমন ভালো লাগে না। একটা ছুটির দিন এসিরুমে ঘুমিয়ে কাটাতে বেশী স্বচ্ছন্দবোধ করি। কিন্তু তোমার সব পছন্দের জায়গা গুলোতে তোমার সঙ্গে যাব। তুমি একটা উইশলিস্ট বানিয়ে ফেলো তো।

সুপ্রীতি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুব দ্রুত। এতো দ্রুত যে বিয়ের সিদ্ধান্ত হতে পারে না সেটা অনেকে বলেছে। ওর বন্ধু অহনা কল করে বুঝিয়েছে যে এভাবে হুটহাট বিয়ে হলে ও’কে কতটা সাফার করতে হবে। এখনো সময় আছে সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসার। বিয়ে ঠিক হয়ে পিছু হটা এমন কোনো বদনাম না। দুই, চার মাস পর সব ঠিক হয়ে যাবে। সুপ্রীতির সেসব জ্ঞান ভালো লাগে নি। বিয়ের তারিখ ঠিক হবার পর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো, সামনে ওর ভালো দিন আসছে। এটা ভেবেই মন টা ফুরফুরে লাগলো। ল্যাপটপ খুলে ব্যক্তিগত নোটে লিখলো,

The Next Chapter of my life is called Happy and Happy. That’s the vibe from this day forward.

***
রাতে খাওয়া শেষে সুপ্রীতি বলল,

“একটু বারান্দায় বসি। কফি খেতে সমস্যা নেই তো?”

অর্ণব তাকালো। সাধারণ বাক্যটা কেমন যেন অসাধারণ হয়ে গেল। আবহাওয়ায় একটা রোমান্টিক আমেজ ছিলো বলেই বোধহয় বাক্যটা প্রেমের ভাষা হয়ে গেল।

বারান্দায় পাশাপাশি দুজন বসা। অর্ণব সুপ্রীতির জন্য কিছু নাইটি কিনেছে। আসার সময় সেগুলো ব্যাগে রেখেছিল, কিছু বলে নি। তারমধ্যে থেকে একটা পরেছে। এই রংটাকে অর্ণব গোলাপি রং বলে জানতো। অনলাইনে কেনার সময় জানতে পারলো এটা নাকি হট পিংক।

কফির সঙ্গে বৃষ্টিমুখর রাত অর্ণবের খারাপ লাগছে না। সুপ্রীতিকে হাত ধরে কাছে টানলো। সুপ্রীতি একটু চমকে গেলেও ঘনিষ্ঠ ব্যাপার টুকু এড়িয়ে গেল না। অর্ণব চুল সরিয়ে ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলল,

“তুমি চাইলে তোমার সমস্যা আমাকে বলতে পারো। ”

সুপ্রীতি স্মিত গলায় বলল,

“কোন সমস্যা? ”

“একটা কিছু সমস্যা আছে আমি টের পাই। তোমার মায়ের ডমিনেটিং আচরণ এর কারণে কী তুমি কম হাসো নাকি জীবনে অন্য কোনো ব্যাপার ছিলো! ”

সুপ্রীতি জবাব দিতে পারে না। ইশরাকের ব্যাপারটা ও অর্ণবের কাছ থেকে পুরোপুরি লুকিয়ে না গেলেও কিছু তো লুকিয়েছে ঠিকই। অর্ণব কে বলেছিল একটা সম্পর্কে ছিলো তবে সেরকম ঘনিষ্ঠতা আসার আগেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছিল পরিবারের চাপে। অবশ্য সেটা বলেছিল অর্ণবের কারণেই। সুপ্রীতি কিছু ভাবতে চায় না। শারিরীক ভাবে ইশরাকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাটুকু হয় নি দুজনের মধ্যেই নৈতিকতা ও সংস্কার ছিলো বলে। রিকশার হুড তুলে একজন আরেকজন কে চুমু খাওয়ার ব্যাপারটাও তো মানসিক ঘনিষ্ঠতা থেকে এসেছে। তখন একবারও কারোর মধ্যে নীতিবোধ ব্যাপার টা আসে নি। দুই পক্ষের ই মনে হয়েছিল বিয়ের আগে এটুকু আদর একজন আরেকজন ডিজার্ভ করে।

অর্ণব সুপ্রীতির ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল সুপ্রীতি। চলচ্চিত্রের মতো ভেসে উঠলো ইশরাকের সঙ্গে প্রথম চুমু খাওয়ার স্মৃতি টা। সেদিন সুপ্রীতি কাঁপছিল ভীষণ, খামচে ধরেছিল ইশরাকের হাত। নখের দাগ ছিলো অনেকদিন। এই ব্যাপার টা অর্ণবের ক্ষেত্রে ঘটেনি। কোনো আনাড়িপনা ছিলো না, কাঁপুনি ছিলো ঠিকই কিন্তু অনুভূতি তো আলাদা ছিলো। সুপ্রীতির হঠাৎ খুব রাগ হলো, প্রথম চুমুর অনুভূতি টা অর্ণবের প্রাপ্য ছিলো!

হঠাৎ সুপ্রীতির সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ যেন অর্ণবকে বহন করতে হলো।

সাবিকুন নাহার নিপা

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৬
ঝিলিক ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করলো। নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে তাই একটু চাপ কম আছে। রান্নাবান্না, ঘরের কোনো কাজ ই ও’কে দেখতে হয় না। খালা এসে সব কাজ করে। ওর তেমন কোনো ঝামেলা নেই। আগের মতোই ঘুরে ফিরে বাসায় এসে শান্তিমতো খায় দায়। কিন্তু এতো শান্তি আবার ওর সহ্য হয় না। ওর ইশরাকের এটেনশন দরকার। অন্যান্য হাজবেন্ড রা বিয়ের পর বউকে যেমন এটেনশন দেয় তেমন এটেনশন ওরও পেতে ইচ্ছে করে। এই কথা নাতাশা কে ছাড়া আর কাউকে বলতে পারে না। নাতাশাকে বলেছে,

“ভাবী এক বিছানায় শুয়েও আমাদের মধ্যে এখনো কিছু হয় নি জানো। ”

নাতাশা চুপ করে থেকে বলল,

“সময় লাগবে ঝিলিক। ধৈর্য্য ধরো। ইশরাকের ক্ষত টা এখনো তাজা। ”

ঝিলিক অবাধ্য মেয়ের মতো বলে,

“কেন ভাবী কেন? সত্যি করে বলো, আমি কী সুপ্রীতির চেয়ে সুন্দর না? নিজের বোন বলে ওর টান একদম টানবে না।”

নাতাশা হেসে ফেলে। সুপ্রীতি যতটা সুন্দর রুপের জন্য ছিলো তারচেয়ে বেশী সুন্দর ওর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের জন্য। এটা ঝিলিক বুঝবে না, বোঝার বয়স হলেও ও বুঝবে না।

ঝিলিক তবুও ইশরাক কে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত। রোজ শাড়ি পরে সেজেগুজে থাকে। প্রথম দিন শাড়িতে দেখে ইশরাকের চোখে এক ছটাক মুগ্ধতা ওর চোখ এড়ায় নি। ইশরাক অবশ্য স্বাভাবিক। ঝিলিক কে শাড়িতে দেখে প্রশ্ন করে,

“ঘুমাতে যাচ্ছিস নাকি গোসল করতে।”

ঝিলিক কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

“আরেহ আমি তোমার জন্য শাড়ি পরেছি। ”

“আমি তো তোকে এই ষ্টুপিড কাজ করতে বলিনি। ”

“শাড়ি পরা ষ্টুপিড কাজ?”

“উঁহু তোর কথাবার্তা।”

এরপর ইশরাক চা বানাতে চলে যায়। এখানেও ঝিলিকের আক্ষেপ। বলে,

“চা টা আমিও তো বানিয়ে দিতে পারতাম। ”

“আগে আমি নিজেই বানিয়ে খেতাম। ”

“আগের হিসাব আর এখনের হিসাব কী এক? এখন তোমার বউ আছে।”

“ঠিক আছে তাহলে তোর জন্যও বানাচ্ছি এক কাপ। ”

ঝিলিক হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইশরাক একটু চাপা ধরনের হলেও পরিবার অন্ত প্রাণ। ইশরাকের পছন্দ অপছন্দ ঝিলিক সব জেনে নিয়েছে। শাশুড়ীর থেকে ওর পছন্দের খাবার বানানোও শিখেছে কিছু কিছু। সেগুলো বানিয়ে ইশরাকের সামনে দিলেও ও খুশি হবে না। সেদিন ওর পছন্দের ক্ষীর বানিয়েছিলো। ইশরাক এক চামচ খেয়ে আর খেল না। ঝিলিক দেখলো মিষ্টি টা একটু বেশী। বলল,

“ক্ষীর একটু মিষ্টি বেশীই হয়। তোমার মন টা ঝালে ভরপুর তো এজন্য এই মিষ্টি ঠিকঠাক। ”

“আমি কী কিছু বলেছি তোকে? এতো জ্ঞান কেন ঝাড়ছিস।”

পরদিন ইশরাক ক্ষীর বানিয়ে ঝিলিক কে খেতে দিলো। ঝিলিক এক চামচ খেয়েই বলল,

“ইয়ামি!”

ইশরাক নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“আমার সব পছন্দের খাবার আমি বানাতে পারি। তুই সেগুলো বানিয়ে আমার পছন্দের লিস্ট টা অপছন্দের করে দিস না। এমনিই অনেক পছন্দের জিনিস জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এগুলোকে একটু রেহাই দিস।

****
বেশ কিছুদিন ধরে নাতাশা ফাহাদের সঙ্গে কথা বলছে না। ফাহাদ এলে আগে এগিয়ে এসে কী কী লাগবে সেগুলো দেখতো। কয়েকদিন ধরে সেগুলো করছে না। পালক কে নিয়ে ওই সময় টা ব্যস্ত থাকে। ফাহাদের অবশ্য সমস্যা হবার কথা না, ও এসেই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। এরপর দুনিয়ার সব পরিচিত মানুষ দের সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় পাড় করে। রাতে খেতে বসে বাবা, মায়ের সঙ্গে। নাতাশা তখন পালক কে ঘুম পাড়ায়। এরপর যখন ফাহাদ আসে তখন ও খেতে যায়। প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে টিভি দেখতে দেখতে খায়। ব্যপার টা যে ভালো লাগা থেকে করে তা না। ও ফাহাদ কে এড়িয়ে চলতে চায়।

আজ খেতে বসার দশ বারো মিনিটের মধ্যেই ফাহাদ এসে বলল,

“তোমার খেতে কতক্ষণ সময় লাগবে? ”

নাতাশা নির্লিপ্ত গলায় বলে,

“অনেকক্ষন। ”

“কতক্ষণ? ”

“কেন বলো তো?”

“কথা আছে তোমার সঙ্গে। ”

“কাল বোলো। আমি ভীষণ টায়ার্ড, ঘুমাব।”

“কয়টা রাজ্য উদ্ধার করে এসেছ যে আমার কথা শোনার মতো এনার্জি তোমার এখন নেই। ”

নাতাশা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খাবার টা খাচ্ছে। ইলিশ মাছ দিয়ে বেগুন আলুর তরকারি করেছিল আর পুইশাক দিয়ে ডালের একটা আইটেম। অথচ খাচ্ছে শুধু পুইশাকের তরকারি টা দিয়ে। ফাহাদ এই ব্যাপার টা খেয়াল করতে পারতো। এতো বড় একটা ইলিশ রান্না হলো, অথচ ওর পাতে এক টুকরাও কেন নেই। নাতাশা ইচ্ছে করেই খায় নি। আজকাল এই বাড়ির ভালো খাবারেও যেন ওর অরুচি ধরে গেছে।

ফাহাদ অপেক্ষা করলো নাতাশার খাওয়া পর্যন্ত। নাতাশা খাওয়া শেষে প্লেট, বাটিগুলো ধুয়ে রাখলো। সকালে রুটির সঙ্গে খাওয়ার জন্য আলু কেটে রাখলো। আরও কিছু কাজ গুছিয়ে যখন ঘরে গেল তখন ফাহাদের ঘুমিয়ে যাবার কথা। কিন্তু ও’কে চমকে দিয়ে ফাহাদ বসে ছিলো। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল,

“আরও কিছু বাকী আছে করার?”

নাতাশা চুল টা খুলে ফেলল। কঠিন গলায় বলল,

“একটা কথাও এখন শুনতে চাই না ফাহাদ। আমি ঘুমাব। তোমার রাজ্য সামলাতে সামলাতে আমি সত্যিই ক্লান্ত। ”

ফাহাদ আচমকা ওর হাত ধরে টানলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না নাতাশা। অনেক সহ্য করেছি। ”

নাতাশা এবার ঠান্ডা গলায় বলল,

“ধৈর্যের পরীক্ষা তো আমি দিচ্ছি। সহ্যও তো আমি করছি। কারণ আমার যাবার কোনো জায়গা নেই। ”

ফাহাদ একরকম চিৎকার করে বলল,

“এক্সাক্টলি। এটা যখন বোঝো তাহলে শুধু শুধু নাটক করো কেন?”

নাতাশা জবাব না দিয়ে পালকের কাছে গেল। পালক এবার তিনে পড়লো। মেয়েটা হয়েছে শান্ত, ভদ্র। এই বয়সী বাচ্চা যতটুকু বিরক্ত করে ও সেই তুলনায় বিরক্ত করেই না। খুশির ছেলেমেয়েদের কাছে মার খেলেও কখনো পাল্টা মার দিতে যায় না। নাতাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মেয়েটা কী ওর মতো হচ্ছে তবে! না ওর মতে হতে দেয়া যাবে না! মেয়েকে ও শক্ত বানাবে।

ফাহাদ এতক্ষণ রাগে ফুসছিলো। হঠাৎ তেড়ে এসে নাতাশার হাত ধরে টান দিলো। এতো জোরে যে নাতাশা মাগো বলে আর্তনাদ করে উঠলো। পালকের ঘুম ভেঙে গেল। কান্নার শব্দে পাশের ঘর থেকে নাতাশার শ্বশুর শাশুড়ী দুজন ই এলেন। ফাহাদ হতভম্ব হয়ে গেল। দরজা খুলে আমতা আমতা করতে লাগলো। শাশুড়ী বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“পালক কাঁদতেছে কেন নাতাশা? একটা বাচ্চা সামলাতে পারো না?”

নাতাশা হাত চেপে বসে রইলো। ফাহাদের বাবা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

“তোমার হাতে কী হয়েছে নাতাশা?”

নাতাশা হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফাহাদ কে আরও এক দফা হতভম্ব করে বলল,

“মেয়েটার নাম ইকরা বাবা। ওর অফিস কলিগ। ”

চলবে….