হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-০৮

0
1215

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৮
নাতাশা হতভম্ব হয়ে গেল। পায়ের তলার মেঝেটুকু বোধহয় ফাঁকা হয়ে গেছে এমন অনুভূতি হলো। ইকরার সাথে কতটা সম্পর্ক এগিয়েছে ফাহাদের তা ও জানে না। নিশ্চয়ই অতোটাও বাড়াবাড়ি কিছু হয় নি যেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। ফাহাদ কী ভাবছে, ওর ভাবনায় নাতাশা নাহয় পুরোপুরি ভিলেন। কিন্তু পালক! ছোট্ট মেয়েটার কথা ভাববে না।

ফাহাদের বাবা নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারলেন না। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন,

“কী বললে তুমি?”

ফাহাদ নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“বাবা পরের বারও আমি একই কথা বলব। আমি জানি তোমরা মানবে না। তোমাদের বংশে আজ অবধি কারোর সংসার ভাঙে নি। তাই শুরু টা আমিই করলাম। ”

ফাহাদের মা আর্তচিৎকার করে উঠলেন।

“এতো বড় স্পর্ধা! বাপের মুখের উপর এই কথাগুলো বলছিস!”

ফাহাদ উঠে দাঁড়ালো। বলল,

“যতদিন পর্যন্ত ঝামেলা চুকে না যাবে ততদিন পর্যন্ত আমি এই বাড়ি ফিরব না। ”

ফাহাদের কর্মকান্ডে সবাই এতো বিস্মিত যে গুছিয়ে কিছু বলতেও পারছে না। খুশি এসে নাতাশার হাত ধরলো। নিচু গলায় বলল,

“রেগে গেছে তো এজন্য যা খুশি বলছে। তুমি মাথা ঠান্ডা রাখো। আমরা আছি তো। ”

নাতাশা খুশির কথা যেন শুনতেই পেল না। ওর মাথার মধ্যে ঘুরেফিরে ওই একটা শব্দই বাজছে বারবার। এতো সহজে সম্পর্ক ভাঙা যায়! সত্যিই এতো সহজ সবকিছু!

ফাহাদ সত্যিই ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে গেল। বাবা, মা এসে নাতাশাকে বোঝালেন। চিন্তার কিছু নেই। এখন মাথা গরম তাই এরকম করছে। রাগ কমলে ফিরে আসবে আবারও।

***
বাড়ির এতসব জটিলতা ঝিলিক জানে না। ও আছে নিজের মতো। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে সেজেগুজে চা বানিয়ে ইশরাকের জন্য অপেক্ষা করে। চোখের পলকে একটা মাস চলেও গেল। অথচ ওদের সম্পর্ক আগের মতোই। নাতাশা বলেছে সময় লাগবে, ঝিলিক অধৈর্য্য হয়ে যায়! আর কত সময় লাগবে! ঝিলিক প্রতিদিন শাড়ি পরে। ইশরাক কখনো বলে না সুন্দর লাগছে। প্রথম দিকে চোখে মুগ্ধতা স্পষ্ট বিরাজমান ছিলো, এখন সেটাও কেটে গেছে। তবু ঝিলিক হাল ছাড়ে না। ও চায় অন্যান্য বর দের মতো ইশরাকও ও’কে নিয়ে একটু আহ্লাদ করুক। প্রতিদিন কপালে টিপ টা বেঠিক জায়গায় লাগায়, একদিনও ইশরাক এসে ঠিক করে দেয় না। কিছু বলেও না। ঝিলিকের এতো খারাপ লাগে! ভেঙেচুরে কান্না আসে ভীষণ! কিন্তু কাঁদলে বা কী! ইশরাকের তো কিছুই যায় আসে না তাতে।

ইশরাক আজ ফিরলো তাড়াতাড়ি। প্রায় ঘন্টাখানেক আগে। ঝিলিক তখন শাড়িটা মাত্র কোমড়ে গুজেছে। ইশরাক বেডরুমের দরজা খুলতেই ঝিলিক চমকে উঠলো। ইশরাক মুখ দিয়ে বিরক্তির শব্দ করে বলল,

“বেকুব যেন কোথাকার! দরজা লাগিয়ে নিবি না?”

ঝিলিক নিজেকে সামলে নিয়ে হাসলো। ইশরাক বেরিয়ে যায়। শাড়ি পরা শেষ হতেই ঝিলিক বেরিয়ে এসে বলে,

“ছি:! তোমার তো দেখি মেয়েদের মতো লজ্জা। আরে আমি তো তোমার ই বউ।”

ইশরাক চোখে চোখ রেখে রাগী গলায় বলে,

“এটাকে লজ্জা বলে না। গুড ম্যানার বলে। তোর যেটার অভাব।”

“প্লিজ প্লিজ আমার ম্যুড খারাপ কোরো না। আমাকে আজ কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাও। ”

“টাকা দিচ্ছি একা ঘুরে আয়। সারাদিন খেটে আমার এনার্জি নেই। ”

ঝিলিক চোখ সরু করে বলল,

“তাই? তোমার এনার্জি এতো কম?”

ইশরাক কঠিন চোখে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে হঠাৎই নরম গলায় বলল,

“চল আজ তোকে আমার পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাব।”

ঝিলিক বিশ্বজয়ের হাসিটা দিলো।

****
তিনশ ফিটের দিকে গেল ইশরাক ঝিলিক কে নিয়ে। ঝিলিকের নামের মতোই আনন্দের ঝিলিক লেগে আছে ওর চোখে, মুখে। ইশরাক গাড়ি থেকে নেমে ঝিলিকের হাত ধরলো। ঝিলিক হিল সামলাতে পারে তবুও বাড়তি সচেতন হবার জন্য ধরেছে। ঝিলিক তো আজ মহাখুশি। আনন্দে রাস্তাঘাটেই নেচে ফেলে নাকি!

ফুচকা পয়েন্টে এসে ইশরাক ফুচকার অর্ডার করলো। সন্ধ্যে হতে শুরু করেছে আর ভীড়ও বাড়ছে। ঝিলিক চাপা গলায় বলল,

“থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি তোমাকে একটা কিস করে ভাইরাল হয়ে যেতে। ”

ইশরাক ওর কথার কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ফুচকা নিয়ে এলো মাঝবয়েসী একটা ছেলে ইশরাকের সঙ্গে হেসে কথা বলল। ইশরাকও খোঁজ খবর নিলো ছেলেটার। ছেলেটা আড়চোখে দুই তিন বার ঝিলিক কে দেখলো। ঝিলিক ব্যস্ত গপাগপ ফুচকা খেতে। নয়টা ফুচকার তিনটা ইতিমধ্যেই পেটে চলে গেছে। এতো অল্প ফুচকায় ওর হয় না। আরও দুই প্লেট অর্ডার করলো।

দ্বিতীয় বার ফুচকা দিতে আসার সময় ছেলেটা ইশরাক কে জিজ্ঞেস করলো,

“মামা মামীরে নিয়ে অনেক দিন আসেন না যে! মামী ভালো আছে? ”

ঝিলিকের সমস্ত আনন্দের ঝিলিক মুহুর্তেই বিষাদে পরিনত হলো। একটু আগে ভালোলাগা ফুচকাটা এখন বিস্বাদ লাগছে। তাকিয়ে আছে ইশরাকের দিকে। ইশরাকের চোখ নির্লিপ্ত। একটা ফুচকা মুখে দিলো। ঝিলিক তখনও তাকিয়ে আছে। চোখে একটাই প্রশ্ন! কেন এই অপমান! কেন! কেন!

***
অফিস ছুটির পর ফাহাদ ক্যাফেতে বসেছে। ও এখন আছে ওর স্কুলবন্ধু মিরাজের বাসায়। মিরাজের বউ এক্সপেক্ট করছে। টাফ টাইম চলছে তাই বাবা, মায়ের কাছে গেছে। প্রথমবার নিজেদের অসচেতনতার কারণে মিসক্যারেজ হয়েছিল তাই এবার রিস্ক নেয় নি।

ফাহাদের অসুবিধা হচ্ছে না। খাওয়া দাওয়া বাইরে সেড়ে নেয়। কিন্তু মিরাজ বড্ড জ্ঞান দিচ্ছে। ঠিক, ভুলের হিসাব নিয়ে বসে রোজ রাতে। এই পেইন অসহ্য লাগছে ওর। ইকরার সঙ্গে আজ কথা বলতে হবে।

ইকরা এসেছে। সারাদিনের ধকলে একটুও ক্লান্ত লাগছে না। অথচ মেয়েটা ল্যাপটপে একের পর এক জটিল কাজ করে। ক্লায়েন্ট মিটিং, ক্লায়েন্টের ফিডব্যাক, ডেটা ট্রান্সফার সবকিছু সামলায়। লিপস্টিক টা সেই আগের মতোই, সকালে যেমন ছিলো। অফিস থেকে বের হবার সময় আবার লাগিয়ে নিয়েছে।

ইকরা এসে বলল,

“এখানে কফি ছাড়া আর কিছু নেই তো। স্পেশাল চকলেট কফি অর্ডার করলাম।”

“করো তোমার যা ইচ্ছা।”

ফাহাদের গলার স্বর শুনে ইকরা আড়চোখে একবার তাকিয়ে বলল,

“ব্যাপার কী? তোমাকে এতো হোপলেস কেন দেখাচ্ছে?”

“আমার খারাপ সময় চলছে ইকরা। ”

ইকরা নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন করলো,

“একটু খারাপ নাকি বেশী? ”

“নাতাশাকে আমি ডিভোর্স দেব।”

ইকরা চমকে উঠলো।

“সিরিয়াসলি?”

“হ্যাঁ। ও নিজেকে খুব স্মার্ট ভাবে। ফালতু একটা মেয়ে শুধু শুধু সবার সামনে আমাকে খারাপ বানিয়েছে। ও’কে জনমের শিক্ষা দেব। ”

“ওয়েট ওয়েট! তোমাদের না একটা বেবী আছে? ”

“আই ডোন্ট কেয়ার।”

ফাহাদকে এতো টা আপসেট হতে ইকরা দেখে নি। ওর পারসোনাল লাইফ, নাতাশাকে নিয়ে ইকরার আগ্রহও নেই। ওয়াইফ যখন হাজবেন্ড কে ইমপ্রেস করতে অক্ষম হয় তখনই সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটে। ইকরা ফাহাদের হাতের উপর হাত রাখলো। ফাহাদ গভীর গলায় বলল,

“উইল ইউ ম্যারি মি ইকরা?”

ইকরা বিস্মিত হলো। রুবাবের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না অনেক দিন যাবত। তাই বলে ডিভোর্স এর কথা তো ভাবে নি।

চলবে….