হৃদয়ে লাগিল দোলা পর্ব-০৪

0
178

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৪ [চড়ুইভাতি স্পেশাল(১)🕊️]
#বোনাস_পর্ব

ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পড়া নিজের প্রতিবিম্বের পানে বারবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছি। ঠোঁটে হালকা করে মেহরুন কালারের লিপস্টিক দিয়ে আরও একবার পরোখ করে নিলাম নিজেকে। না ঠিক আছে, খারাপ লাগছেনা। আমার পড়নে রয়েছে কালো রঙের সুঁতির থ্রিপিস। আর মুখে হালকা সাঁজ। আমি খুব বেশি একটা সাজতে পছন্দ করিনা। সাজগোছ নিয়ে আমি বড়ই উদাসীন। তবুও রিশতার জোরাজুরিতে কোনোরকমে একটু সেজেছি।

রিশতা আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল

-‘ আরে বেইব, তোকে তো হেব্বি সুন্দর লাগছে রে। দেখবি আদ্রিশ ভাইয়া কিছুতেই তোর দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারবেনা।

আমি চোখ গরম করে তাকাতেই রিশতা মিইয়ে যায়। ওকে তাড়া দিয়ে গটগট পায়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। সবাই-ই যে যার মতো তৈরি হয়ে নিয়েছে। সবাই তো রেডি তবে আদ্রিশ ভাইয়া কই?

আজ উইকেন্ড ডে তাই বাসায় বাবা এবং চাচ্চু উভয়েই আছেন। আলোচনা সাপেক্ষে তারা হুট করে সিদ্ধান্ত নিলেন অবসর কাটানোর জন্য আজ কোথাও ঘুরতে বের হবেন। ‘চড়ুইভাতি’ যাকে বলে আরকি। আমিও মনে মনে একটু খুশি হলাম। আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তো আর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। এখন এই সুযোগে যা হোক একটু ঘুরাঘুরি যদি হয়, তাহলে তো মন্দ হয়না।

আমি এসব ভাবতে ভাবতে সামনে তাকাতেই আমার নজর আটকে যায়। আদ্রিশ ভাইয়া হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। পড়নে তার কালো রঙের পাঞ্জাবি, সাদা সালোয়ার এবং দামী ব্রান্ডের একটা হাতঘড়ি। ব্যাস এটুকুই। আচ্ছা আদ্রিশ ভাইয়া কি মেকআপ টেকআপ করেছে নাকি? তাকে আজ অন্যদিনের তুলনায় যেন একটু বেশিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এমনিতেই তো সে দেখতে মাশাআল্লাহ! কিন্তু আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। রিশতার ভাষ্যমতে, আদ্রিশ ভাইয়া নাকি আমায় দেখলে চোখ ফেরাতে পারবেন না, কিন্তু আমি-ই তো তাকে দেখে চোখ ফেরাতে পারছিনা। যেন পলক ফেলতেই ভুলে গিয়েছি আমি।

হঠাৎ অরনীর কনুইয়ের ধাক্কায় আমার ভাবনার সুঁতোয় টান পড়ে। আমি দ্রুত নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম আদ্রিশ ভাইয়া হতে। অরনী আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল

-‘ ছেলেটাকে আর চোখ দিয়ে গিলে খাসনা বইন। ভুলে যাসনা ওটা তোর চাচাতো ভাই লাগে। তোর নজরে হয়তো বেচারা নির্ঘাত অসুস্থ হয়ে পড়বে।

আমি লজ্জা পেলেও আমার রাগ হলো ভীষণ। কিছুটা রাগ নিয়ে দুম করে অরনীর পিঠে কিল বসিয়ে দিলাম। অরনী ‘আহ্’ করে মৃদু চিৎকার করে উঠল। মা আমাদের এমন কর্মকান্ডে এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন

-‘ বেড়াতে যাওয়ার আগেও মারামারি না করলে হয়না? তোরে নিয়ে আর সত্যিই পারিনা বাপু। বিয়ের পর যে তোর কি হবে আল্লাহই ভালো জানে? এমন বাঁদরামি করলে তো শাশুড়ির হাতে কান মোলা খাবি। তোকে নিয়ে আমার চিন্তার কোনো শেষ নেই।

মায়ের কথা শুনে আমি থেমে গেলাম। সাথে কিছুটা মন খারাপও হলো। মা এখনই আমার বিয়ের কথা চিন্তা করছেন। আমিও এককথার মেয়ে আমার বাসা ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা। দরকার পড়লে এখানেই স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করব।

মামনি মাকে শান্তনা দিয়ে বললেন

-‘ আমাদের মেয়ে আমাদের কাছেই থাকবে। তোমায় ওতো চিন্তা করতে হবেনা। ঘুরতে যাওয়ার আগে মেয়েটাকে আর বকাবকি করো না তো। আয় তো মেহু, আমার কাছে আয়। মায়েরা একটু ওমন-ই হয়, মায়ের কথায় একদম কষ্ট পাবিনা কেমন?

মামনির কাছে গিয়ে মামনিকে জড়িয়ে ধরে আদুরে কন্ঠে বললাম

-‘ এই তো আমার সোনা মামনি। তুমি ছাড়া আমায় আর এত্তো ভালোবাসে কে?

মামনি পরম যত্নে আমায় আগলে নিলেন।

আদ্রিশ দাঁড়িয়ে থেকে তার মা এবং মেহরুনকে একবার পরোখ করে নিলো। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে তার মুখে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি।

সব গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বাবার গাড়িতে ড্রাইভার আঙ্কেল, বাবা, মা, চাচ্চু এবং মামনি উঠেছেন। আর চাচ্চুর গাড়িতে আমরা কাজিনরা উঠেছি। আমাদের কোনো ড্রাইভারের প্রয়োজন নেই কারণ আমাদের আদ্রিশ ভাইয়া একাই একশো! আদ্রিশ ভাইয়ার পাশের সিটে আমার ভাই আলভি ভাইয়া বসেছে। আর বেক সিটে আমি, রিশতা আর অরনী বসেছে। আমি বসেছি গাড়ির উইন্ডো কর্ণারটাতে। জানালার কাচ নামানোই ছিল। পথিমধ্যে বয়ে চলেছে মৃদু মন্দ হাওয়া! এমন একটা ফুরফুরে আমেজে গান হলে মন্দ হতো না! তবে আদ্রিশ ভাইয়া কিভাবে যেন আমার মনে কথাটা বুঝে ফেললেন। তিনি মিডিয়াম ভলিউমে একটা সং প্লে করলেন।

“|বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হৃদয়
কতটা তোমায় ভালোবাসি
চলতে গিয়ে মনে হয়
দূরত্ব কিছু নয়
তোমারি কাছেই ফিরে আসি
তুমি তুমি তুমি শুধু এই মনের
আনাচে কানাচে
সত্যি বলনা কেউ কি প্রেম হীনা
কখনো বাঁচে
মেঘের খামে আজ তোমার নামে
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম
পড়ে নিও তুমি মিলিয়ে নিও
খুব যতনে তা লিখেছিলাম
ও চায় পেতে আরো মন
পেয়েও এত কাছে
বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হৃদয়
কতটা তোমায় ভালোবাসি|”

গানটা শেষ হতেই রিশতা বলে উঠল

-‘ ভাইয়া এটা কি আপনার পছন্দের গান নাকি?

আদ্রিশ ভাইয়া সুক্ষ্ম হেসে মাথা নাড়ায়। তা দেখে রিশতা বাঁকা হাসে। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে সে বলল

-‘ দেখলি তো আদ্রিশ ভাইয়া আর তোর কত্তো মিল। তোরা দু’জনই আজ ম্যাচিং ম্যাচিং পড়লি প্লাস তোদের পছন্দ অপছন্দেরও মিল রয়েছে। বাহ্ ওয়াট অ্যা সুইটি কিউটি জুটি!

আমি আলতো হেসে ফিসফিসিয়ে বললাম

-‘ ভাইবোন না এজন্যই তো এতো মিল আমাদের।

আমার এহেন কথায় রিশতা চোখমুখ কুচকে ফেলে বলল

-‘ তুই আর আদ্রিশ ভাইয়া দুইটাই একরকম। দুইটাই নিরামিষ করোলার জুস।

রিশতার কথায় আমি আর না হেসে পারলাম না। খিলখিলিয়ে হেসেই ফেললাম। আমার হাসি শুনে আদ্রিশ ভাইয়া করুণ কন্ঠে বলে উঠল

-‘ মেহু, প্লিজ তোর এমন পেত্নিমার্কা হাসি থামা। আরেকটু হলেই আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত। ইশ তোর সাথে যার বিয়ে তার যে কি হাল হবে, সেটা ভেবেই আমার বুকটা প্যাটপ্যাট ঢ্যাপঢ্যাপ ট্যাপট্যাপ করছে।

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় উপস্থিত সবাই ফিক করে হেসে ফেলে। আর এদিকে আমার মুখটা ভার হয়ে যায়। আমার হাসি মোটেও খারাপ নয়। যারা আমায় প্রেমপত্র দিতো তারা সবাই আমার হাসিরই প্রশংসা করত। যদিও আমি সবকটাকে রিজেক্ট করেছিলাম কারণ আমি তো একজন পুরুষের মোহে আটকে গিয়েছিলাম ততদিনে। তাকে ছাড়া দুনিয়ার সবকিছুই কেমন পানসে পানসে লাগে আমার কাছে। আর ঐদিকে ব্যাটা খচ্চর একনাগারে হেসেই চলেছে। আমি তার হাসির পানে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলাম। এই হাসিতেই তো হয়েছিল আমার সর্বনাশ!

গাড়ির হঠাৎ ব্রেক পড়ায় আমার ভাবনার ছেদ ঘটলো। নেমে পড়লাম। আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি। সামনে একটা বিলাসবহুল রিসোর্ট দেখা যাচ্ছে। তার পাশেই খুব সুন্দর একটা লেক। লেকের পানি স্বচ্ছ। আশেপাশের ভিউটা বেশ মনোরম! আজকের ওয়েদারটাও বেশ ভালো! কেমন স্বচ্ছ নীল আকাশ! এখানে ছবিও ভালো আসবে। তবে বুঝলাম না হুট মুহুর্তের সিদ্ধান্তে এতো কিছু কিভাবে সম্ভব? নাকি আগে থেকেই প্ল্যান ছিল, শুধু আমি-ই জানতাম না?

পরবর্তীতে অবশ্য জানা গেল, এসবই আদ্রিশ ভাইয়ার কারসাজি। আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কিছু জানানো হয়নি। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ ভালো লাগল। আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল কিছুটা অন্যরকম। তার ছোট ছোট বিষয়ে টেক কেয়ার, সারাক্ষণ আমার খেয়াল রাখা, খেতে না চাইলে খাইয়ে দেওয়া, এমনকি কোলে নিয়ে পুরো বাড়িতে ঘুরে বেড়ানো। এসবই আমার ভীষণ ভালো লাগত। তবে এ নিয়ে আমার তখনকার শিশুমনে কোনো অনুভূতি জাগেনি। কাজিনদের মধ্যে আমি-ই একমাত্র তাকে ‘তুমি’ বলে সম্মোধন করি আর বাকিরা ‘আপনি’ বলে। তার কারণ আমাদের মাঝে খুব ভালো একটা বন্ডিং ছিল। বয়সের যথেষ্ট ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও আমরা মিশতাম বন্ধুর মতোন। তাই তো সবাই আমাদেরকে ‘মানিকজোড়’ বলে ডাকত। কিন্তু সেসবই এখন স্মৃতি! হয়তো ধুলো জমা মোটা আস্তরনে পড়ে রবে চিরকাল! আমার সে-ই ছোটবেলার আদ্রিশ ভাইয়াকে হারিয়ে ফেলেছি বহুকাল আগেই। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে যথেষ্ট বদলে গেলো। আগের মতো কথা বলেনা, বললেও কেমন রাগী রাগী ভাব। আমি তো এমনটা চাইনি তবে…। আমি তো বদলাইনি তবে সে কেন হুট করে এভাবে বদলে গেলো জানা নেই আমার। যখন থেকে আমার কিশোরী মনে তাকে ঘিরে নানান অনুভূতিরা ডানা মেলে উড়তে শুরু করল, ঠিক তখনই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো মানুষটা। আচ্ছা আমি কি এতোটাই কুৎসিত যে তার পাশে আমায় মানাবেনা! সবার ভাষ্যমতে, আমি যথেষ্ট সুন্দরী, তবে..।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে লেকের পাড়ে চলে এসেছিলাম খেয়াল নেই, এমন সময় একজোড়া বলিষ্ঠ হাত এসে আকড়ে ধরে আমায়। আঁতকে উঠলাম আমি। সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম আমি। কাঁপা কন্ঠে বললাম

-‘ আমায় ছেড়ে দাও না, আদ্রিশ ভাইয়া।

উনি গম্ভীর কণ্ঠে বলল

-‘ পেছন ফিরে একবার দেখ, পানি থৈথৈ করছে। আমি ছেড়ে দিলেই কিন্তু…।

অর্ধেক কথা বলেই নিজের হাতের বাঁধন আলগা করেন তিনি। আমি তার কথামতো পেছন ফিরতেই চমকালাম। একদম লেকের কিনারায় আমি। আর কিঞ্চিৎ পরিমাণ অতিক্রম করলে পানিতে পড়ে যাব। তা দেখে আমি আদ্রিশ ভাইয়ার পাঞ্জাবির হাতা খামচে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম

-‘ এই আমায় একদম ছাড়বেনা কিন্তু ভাইয়া।

আদ্রিশ ভাইয়া একটানে আমাকে কিনারা থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো। আমার থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে, তিনি অন্যপাশ ফিরে লম্বা কয়েকটা শ্বাস টেনে নেন। এরপর আমার দিকে ফিরে রাগী কন্ঠে বলল

-‘ তোর কি কাণ্ডজ্ঞান আর কখনোই হবেনা, মেহু? কি এতো ভাবতে ভাবতে এখানে এসেছিস তুই? এই পানিতে পড়ে গেলে, তুই তো সাঁতারও জানিস না যে সাঁতড়ে উঠতে পারবি। যদি আমি এখানে না আসতাম তখন কি হতো?

এতোটুকু বলে থামল সে। বোঝাই যাচ্ছে লোকটা ভীষন চটে আছে। ওনাকে এখন বেশি একটা ঘাটানো ঠিক হবেনা মনে হয়। উনি রাগ করলেও আমার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছে আদ্রিশ ভাইয়া আগের মতোই আছে তবে বাইরের খোলসটা শুধু পাল্টে ফেলেছে।

#চলবে ~