হৃদয়ে লাগিল দোলা পর্ব-১০+১১

0
168

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১০

-‘ আদ্রিশ ভাইয়া, তুমি না আমায় বোনের নজরে দেখো তাহলে এসব কি করছো?

চোখ বুঁজে কাঁপা কন্ঠে এতোটুকু বলে থামলাম। আদ্রিশ ভাইয়া হতে কোনো জবাব না পেয়ে এবার পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম। সে তার পূর্বের অবস্থানেই রয়েছে এখনো। কিন্তু অধরের কোণে ঝুলে আছে তার বাঁকা হাসির রেখা। এই প্রথম আদ্রিশ ভাইয়াকে আমার এতোটা কাছাকাছি দেখে, ভড়কে গেলেও বুঝতে দিলাম না বিষয়টা।

সে আমার মুখের কাছে মুখ এনে হাসির রেখা প্রশস্ত করে শীতল কন্ঠে বলল

-‘ কি ভড়কে গেলি মেহু?

আমি নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে, শক্ত কন্ঠে বললাম

-‘ ভড়কে আমি যাইনি, তবে তোমার অসভ্যতামি দেখছি। ভদ্র মানুষের আড়ালে একটা মানুষ কতোটা চরম লেভেলের অসভ্য হতে পারে, সেটাই আমাকে ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে।

আমার এমন কথায় আদ্রিশ ভাইয়া অবাক হওয়ার ভান ধরল তবে নিজের অবস্থান থেকে এক ছটাকও সরলো না। হাসির রেখা আরও খানিকটা প্রশস্ত করে সে বলল

-‘ বাহ্ এক ধমকানিতেই আমাদের মেহুপাখি বড় হয়ে গিয়েছে দেখছি? বাচ্চামো স্বভাব ছেড়ে সে এখন বড় বড় কথাও বলে! বাহ্, চমৎকার, নাইস, গ্রেট, ওয়ান্ডারফুল!

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমার রাগ হলো ভীষণ। কন্ঠে তাই কিছুটা কাঠিন্য ভাব বজায় রেখে আমি বললাম

-‘ আদ্রিশ ভাইয়া এবার একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? তুমি তো এমন ছিলেনা, আমায় নাকি তুমি বোনের নজরে দেখো তাহলে এখন এসব কেন? আবার নাকি তুমি আমায় অনেক বেশি সম্মান করো, আমার সম্মানে আঘাত লাগুক তা তুমি চাও না, তাহলে এসব কি? আমার পথ ছাড়ো নয়তো আমি মামনিকে ডাকতে বাধ্য হবো।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার কথা শুনে আচমকা হো হো করে হেসে ফেলল। আদ্রিশ ভাইয়া এবার বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠল

-‘ ওয়েট অসভ্যতামির কিন্তু এখনো কিছুই করিনি আমি। শুধু শুধু আমার মতো একটা ইনোসেন্ট চাইল্ডকে এসব অপবাদ দিচ্ছিস তুই। তবে যাই বলিস না কেন তুই কিন্তু বড্ড বেশি পাকনা হয়ে যাচ্ছিস মেহু।

এই ব্যাটা বলে কি? ডাক্তারি পাশ করা আধবুড়ো ছেলেটা নাকি ইনোসেন্ট চাইল্ড তাহলে আমি কি সদ্য জন্মানো নবজাতক! আমি এবার মৃদু চিৎকার করে বললাম

-‘ অসভ্যতামি করোনি মানে? এটা কি খুব সভ্য মানুষের কাজ? তুমি আমার এতো কাছাকাছি কেন, দূরে সরো বলছি।

আদ্রিশ ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল

-‘ কেন ভয় পাচ্ছিস আমায়?

-‘ তোমার মতো ধলা বিলাইকে কেন ভয় পেতে যাব আমি? আমি শুধু সরতে বলেছি তোমায়। আমায় নাকি বোনের নজরে দেখো তাহলে বোনের সাথে এসব ফাজলামি কেমন বেমানান না?

আদ্রিশ ভাইয়া এবার বেশ সিরিয়াসভাবে বলল

-‘ মানে সিরিয়াসলি মেহু, তুই নিজেকে কি ভাবিস বল তো? মানে তোর সাথে আমি… কিভাবে সম্ভব? হাসালি আমায়। ওয়াট অ্যা গ্রেট ফুলিশ পারসন ইউ আর!

আমার কপালে যৎ কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল। এ ব্যাটা বলে কি? সকাল সকাল কি মাথায় ব্যামো বাঁধিয়ে বসল লোকটা? নিজে নিজেই তো সব বলে। একেক সময় একেক কথা। এমন চলতে থাকলে তো রোগীরা এমনিতেও হার্ট অ্যাটাক করবে!

আদ্রিশ ভাইয়া এবার রসিকতা ছেড়ে চোখমুখ শক্ত করে বলল

-‘ একেই তো বিনা অনুমতিতে আমার ঘরে এসেছিস? তার উপর আবার আমার মুখে মুখে তর্ক করছিস। তুই যতোই নিজেকে চেঞ্জ করিসনা কেন, তোর এই কৌতুহলপ্রবণ মনোভাবটা আর বোধ হয় যাবেনা। মানে মানুষ কতোটা বোকা হলে, সামান্য একটা ডায়েরিও লুকাতে পারেনা!

আদ্রিশ ভাইয়ার মুখে ডায়েরির কথাটা শুনতেই চমকে উঠলাম। আদ্রিশ ভাইয়া টের পেয়ে গেল কিভাবে? হাত দুটো পেছনে রেখে লুকিয়ে রেখেছিলাম ডায়েরিটা, যাতে আদ্রিশ ভাইয়ার নজরে না পড়ে। আমায় এবার আরও অবাক করে দিয়ে আদ্রিশ ভাইয়া একদম কাছাকাছি চলে আসে আমার। আমি চোখমুখ কুচকে ফেললাম। শাস্তিস্বরূপ না জানি আবার কি করতে কি করে বসে লোকটা। বিশ্বাস নেই এই পল্টিবাজটাকে। পল্টি খাওয়া যার নিত্য স্বভাব সে যা তা করেও ফেলতে পারে! ফট করে আমার হাত থেকে ডায়রিটা কেড়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায় সে। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, এতোক্ষণ যেন আমার দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। সে এখন আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আমি এবার পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম। এই রে এভাবে যে ধরা পড়ে যাবো তা কখনো ভাবিনি আমি। ব্যাটায় বুঝল কেমন করে? চোখ তো না যেন বাজপাখির ধারালো দৃষ্টি!

ডায়রিটা হাতে নিয়ে সে এপিট ওপিট ওল্টায়। আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠল

-‘ তোর সাহস হলো কিভাবে আমার অনুমতি ব্যতিত আমারই পার্সোনাল ডায়রিতে হাত দেওয়ার? নেক্সট টাইম তোকে যেন ভুল ক্রমেও আমার ডায়রির আশেপাশেও না দেখি। তাহলে কিন্তু আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না। আজ তো এক ঝলক দেখেছিস, এরপর কিন্তু শাস্তিস্বরূপ কপালে শনি আছে তোর!

বুঝলাম না সামান্য একটা ডায়রি ধরায় তার আচমকা এমন রেগে যাওয়ার কি কারণ? আদ্রিশ ভাইয়া গম্ভীর কণ্ঠে কথা বললেও আমার সাথে কখনোই উচ্চ স্বরে কথা বলেনি সে। তাহলে আজ হঠাৎ এমন কেন করল? সামান্য একটা ডায়রির জন্যে তার এমন নিখুঁত অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়! তবে আমি তো সত্যিই ভড়কে গিয়েছিলাম তার এহেন কর্মকান্ডে! পরে বুঝলাম তিনি আমায় কথার জালে পেঁচিয়ে ডায়রির অবস্থানটা দেখে নিয়েছিলেন। আর আমার চাইতে লম্বা হওয়ার সুবাদে এটা তার কাছে কোনো ব্যাপারই ছিলনা। তবে ডাক্তার না হয়ে অভিনেতা হলে তার বেশ নামডাক হতো বটে। কিন্তু মাথামোটাটার মাথায় হয়তো এ বুদ্ধি খেলেনি! আমি ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ফেললাম, কিন্তু কোনো জবাব দিলাম না। আপাতত এই ঢেড়ষের সাথে কোনো কথায় জড়ানোর মুড নেই আমার।

আদ্রিশ ভাইয়া ডায়রিটা বুক সেলফে রেখে দিলো, আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টি এড়ায়না তা। কাবার্ড থেকে ট্রাউজারটা বের করে নেয় সে। কোমড়ে জড়ানো টাওয়াল খুলতে গিয়ে থমকে যায় সে। আমার দিক ফিরে ভ্রু কুটি করে থমথমে গলায় বলল

-‘ তুই এখনো আমার রুম থেকে গেলি না? আমার চেঞ্জ করা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছিস বুঝি?

আমি ছিলাম আমার ভাবনার জগতে আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমার ভাবনার সুঁতোয় টান পড়ে। আমি তার দিকে ফিরতেই সে এবার ভ্রু নাচিয়ে দুষ্ট হেসে বলল

-‘ আমার এমন রূপ দেখে তোর হয়তো যেতেই মন চাইছে না। তুই চাইলে এখানেই থাকতে পারিস। তোর সামনে চেঞ্জ করতে কিন্তু আমার কোনো প্রবলেম নেই। তুই চাইলে দেখেও নিতে পারিস কেমন করে আসলে চেঞ্জ করতে হয়।

আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম তার পানে। একটু আগে ঝাড়ি দিয়ে এখন আবার এসব ছি মার্কা কথাবার্তা বলতেও দ্বিধা বোধ করছে না এই অসভ্য মানুষটা! একই অঙ্গে আর কতখানি রূপ দেখিতে হইবে তাহার? আমি প্রথমে হতভম্ব বনে গেলেও পরে বোধগম্য হতেই একরাশ লজ্জায় নুইয়ে পড়লাম আমি। দরজা খোলাই ছিল তাই দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। ইশ লোকটা এমন নির্লজ্জ ঠোঁটকাটা স্বভাবের কেন! মুখে কি একটুও কিছু আটকায় না তার! আজ সকাল থেকেই সে যে ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করছে তা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয়না আমার।

আমার ঘরে এসে পাইচারি করছি আর ভাবছি কিভাবে আদ্রিশ ভাইয়ার ডায়রিটা বাগে আনা যায়। আমার মনে হচ্ছে ওটা পড়লেই আমি আমার সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব কারণ আমি দেখেছি ওখানে মনের মাধুরী মিশিয়ে ভালোভাবেই তার মনের কোণে জমে থাকা সুপ্ত কথাগুলি সাজিয়ে গুছিয়ে ব্যক্ত করে রেখেছে মহাশয়! আমার পড়ার ইচ্ছে না থাকলেও আদ্রিশ ভাইয়ার ওমন ডায়রিটাকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা দেখে আমার পড়ার আগ্রহ আরও শতগুণে যেন বেড়ে গেল। আমার কৌতুহলপ্রবণ মনটা বারবার চাইছে ডায়রিটা এক্ষুনি পড়ার জন্য। তবে তা আর হলো কই? কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া থাকতে পড়া হবেনা আর। ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম বিকেলের দিকে আদ্রিশ ভাইয়া আর আলভি ভাইয়া বাইরে বের হবে। এটাই মক্ষোম সুযোগ! তখন ঘর ফাঁকা পড়ে থাকবে আর আমি টুপ ঢুকে টুকুশ করে পড়ে বেরিয়ে আসবো। ব্যাস্ কেল্লা ফতে! এইতো এই না হলে আমার বুদ্ধি! সত্যিই আমার বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়!

শিস বাজাতে বাজাতে ডাইনিং রুমে চলে এলাম আমি। নাস্তা পানি সেরে যোগ দিলাম অরনী আর রিশতার সাথে গল্পের আসরে। বিকেলের দিকে ওরা ওদের দাদু বাড়ি বেড়াতে চলে যায়। বাড়িতে শুধু মা, মামনি আর আমি রয়েছে। আমি আর কাল বিলম্ব না করে সোজা আদ্রিশ ভাইয়ার রুমে চলে এলাম। এদিক ওদিক দেখে বুক সেলফটার দিকে এগিয়ে গেলাম ডায়রি নিতে। যাক পেয়েও গেলাম। ইশ আদ্রিশ ভাইয়া এতোটা বোকা তা তো জানতাম না, ডায়রিটা না লুকিয়ে এখানেই রেখে চলে গেছে। আসলে আমার বুদ্ধির সাথে কি পারা যায়! সেও যেমন ‘খান’ বংশের ছেলে আর আমিও তেমনি ‘খান’ বংশের মেয়ে! সবসময় শেয়ানে শেয়ানে টক্কর হয়। আমি আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে ডায়রিটা নিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে এলাম।

বিছানায় ডায়রিটা ফেলে উবু হয়ে শুয়ে পড়লাম ডায়রি পড়ার জন্যে। ও মা এ কি ডায়রির পাতা সাদা পড়ে আছে কেন!

পেছন থেকে হঠাৎ ভেসে এলো কোনো এক পুরুষের ঘর কাঁপানো হাসির ঝংকার! আমি ঘাড়বে গেলাম। এই রে বেশি চালাকি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম যে। ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ এটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি এখন। কেন মরতে বাঘের লেজে পারা দিতে গেলাম! এখন তবে কি হবে আমার? আমায় তো আস্তো রাখবে বলে মনে হয়না।

#চলবে ~

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১১

পেছন ফিরে আলভি ভাইয়াকে দেখতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। যাক বাবা এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম তবে! আমি আগেই বুঝেছিলাম এমন ঘর কাঁপানো হাসি আমার ভাই ছাড়া কেউ দিতেই পারেনা। আর ঐ গোমড়ামুখো কুমড়ো পটাসটার পক্ষে তো মোটেও সম্ভব নয়।

আলভি ভাইয়া হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে আমার পাশে বসল। অধরের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল

-‘ সারাবছর তো বইয়ের ধারে কাছেও নেওয়া যায়না তোকে। আর এখন তো পড়াশোনার ঝামেলা নেই তো কি এতো মনোযোগ দিয়ে পড়ছিস এখন?

আমি ডায়রিটা বন্ধ করে, আলভি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। সত্য গোপনে রেখে তাই মিথ্যে বানিয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম

-‘ একটা নতুন ডায়রি কিনেছিলাম, সেটাই উল্টে পাল্টে দেখছি আরকি।

আলভি ভাইয়া এবার কিছুটা ঠাট্টার ছলে বলল

-‘ ওহ তাই তো বলি, যে মানুষ সারাবছর পড়ার ধারে কাছেও যায়না। সে কিনা এই অবসরে পড়বে, এটা তো একটা ভৌতিক ব্যাপার!

আলভি ভাইয়ার কথায় আমি চটে গেলাম। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম

-‘ কি বললি ভাইয়া?

-‘ ক্ষেপিস না বইন। মজা করছিলাম। একটু আধটু কি মশকরাও করতে পারব না তোর সাথে?

আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম

-‘ তাই বলে তুই আমাকে এভাবে অপমান্স করবি ভাইয়া? দিস ইজ নট ফেয়ার কিন্তু!

আলভি ভাইয়া আলতো হেসে বলল

-‘ তুই আমার বোন তুই আমার মতোই হবি। তোর অত বেশি পড়াশোনার কোনো দরকার নেই, বুঝলি। যারা বেশি বেশি পড়ে তারা হয় বেশিদিন বাঁচেনা নয়তো পাগল টাগল হয়ে পাগলাগারদে আশ্রয় নিতে হয়। যেমন আমাদের সবার প্রিয় আদ্রিশ ব্রো।

শেষোক্ত কথাটা বলে আলভি ভাইয়া হো হো করে হেসে ওঠে। আমিও তাল মিলিয়ে হেসে ফেললাম। একমাত্র আমার ভাই-ই পারে আদ্রিশ ভাইয়াকে সেই লেভেলের রোস্ট করতে তবে সামনাসামনি এমন ভন ধরবে যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা! আলভির ভাইয়ার হাসির তোড় এতোটাই তীব্র ছিল যে মনে হলো আমাদের বাড়ি সুদ্ধ কেমন কেঁপে উঠল যেন।
আমি হাত দিয়ে কান চেপে তাই বললাম

-‘ ভাইয়া আস্তে হাস, হয়তো এই বাড়ি ভেঙে পড়বে নয়তো আমি চির বধির হয়ে যাব।

আলভি ভাইয়া হাসি থামিয়ে সরু চোখে তাকায়। থমথমে গলায় বলল

-‘ সবাই আমার হাসির প্রশংসা করে আর তুই আমার বোন হয়েও এমনভাবে বলতে পারলি?

আমি সূক্ষ্ম হেসে বললাম

-‘ মশকরা করছিলাম ভাইয়া। কি যেন বলছিলি?

আলভি ভাইয়া এবার হতাশ কন্ঠে বলল

-‘ জানিশ মেহু, আদ্রিশ ভাই যে কি পাগলের মতো করে পড়ত। বাপ রে বাপ! মানুষ ওতো পড়ে কেমনে? আমাদের বংশে ঐ এক পিসই একটা চিজ!

আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম

-‘ উনি তো একটা বদ্ধ উন্মাদ! কখন কি বলে আর কখন কি করে তা বোঝা ভার! কে বলবে উনি আমার শান্তশিষ্ট ভালো মামনিটার একমাত্র বেয়াড়া কুমড়ো পটাসমার্কা স্পেশাল চাইল্ড!

আলভি ভাইয়া আমার কথা শুনে আবারও হো হো করে হেসে ওঠে। আমি বুঝিনা এই বান্দা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, এতে এতো হে হে করার মতো কি আছে আশ্চর্য! আমার সাথে তাল মিলিয়ে বিদ্রুপ করে সে বলল

-‘ বেচারাকে শেষমেশ স্পেশাল চাইল্ড বানায় দিলি। ভাগ্য ভালো যে আমরা কেউ-ই ভাইয়ের মতো ওমন পাগল হইনি রে। এখন তো তোকে নিয়ে ভয় হচ্ছে, তুইও না আবার আদ্রিশ ভাইয়ের মতো পাগল টাগল হয়ে যাস।

আমি ভ্রু কুটি করে বললাম

-‘ আশ্চর্য আমি কেন পাগল হতে যাব?

-‘ কারণ তোরা দুজনই সাইন্সের স্টুডেন্ট। আর আমি তো কমার্সের স্টুডেন্ট, এইজন্য আমার সাথে খুব একটা পেরে উঠতে পারেনি। তোর এসএসসির আগে যেমনে ধরে বেঁধে তোকে পড়তে বসাতো, জাস্ট চিন্তা কর ইন্টারে কি করবে ভাই? একবার কি হয়েছিল জানিস, আদ্রিশ ভাইয়ের এমন পাগলের মতো পড়া দেখে বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, ‘ভাই আপনি কি পৃথিবীতে নতুন? আর কেউ তো এমনে পড়ে না।’ তখন সে আমায় উত্তরে ‘ছাগল’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।

শেষোক্ত কথাটা বলতে গিয়ে মুখটা গম্ভীর হয়ে এলো আলভি ভাইয়ার। আমি হাসি চেপে রাখতে না পেরে শব্দ করে হেসে ফেললাম। আলভি ভাইয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল

-‘ তোর ভাইকে ছাগল বলেছে বলে কোথায় তুই প্রটেস্ট করবি তা না তুই দাঁত কেলিয়ে হাসছিস?

আমি চুপ হয়ে গেলাম তবুও আমার হাসি পাচ্ছে ভীষণ। আলভি ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলল

-‘ আদ্রিশ ভাই সবচেয়ে বেশি পাগল হয়ে গিয়েছিল কবে জানিস?

আমার না সূচক মাথা নাড়ালাম। আলভি ভাইয়া তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল

-‘ ভাই যেবার মেডিক্যাল অ্যাডমিশন দিবে, সেবার যে কি পাগলের মতো পড়ত। খাইতে গেলেও পড়ত, ওয়াশরুমে গেলেও পড়ত এমনকি ঘুমানোর মধ্যেও বিড়বিড় করে পড়ত। আর আমারে খালি বলত, ‘আলু এই এমসিকিউগুলা ধর তো আমারে।’ সে কি একটা অবস্থা, বাড়িতে একেবারে হুরুস্থল পড়ে গিয়েছিল। মানে চিন্তা কর, একটা মানুষ এমনে কেমনে পড়তে পারে? মেন্টাল না হইলে তো জীবনেও সম্ভব না।

আমি বিদ্রুপের সহিত বললাম

-‘ তুই জানিস না ভাইয়া, ডাক্তাররা এমনই পাগলই হয়! ব্যাটা নির্ঘাত কোনো পাগলের ডাক্তার। লজ্জায় হয়তো বলতে পারেনি আমাদের। ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছি উনার তো আবার লজ্জা বলতে কিছুই নেই।

আলভি ভাইয়া এবার স্বাভাবিক গলায় বলল

-‘ তবে পাগল হলেও মেধাবী ছিল নয়তো কেউ এমনি এমনি সাইত্রিশ তম হয়না ডিএমসির মতো একটা জায়গায়!

আমি মাথা নাড়ালাম। যতো নিন্দাই করিনা কেন নিঃসন্দেহে সে একজন মেধাবী ছাত্র ছিল। এমনকি সে আমার পড়াশোনা নিয়েও যথেষ্ট পজেসিভ। তার এই জিনিসটা আমার ভালো লাগে। পড়াশোনার ব্যাপারে সে সর্বদা আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা মানুষ আসলে সবদিক দিয়ে খারাপ হয়না, কিছু ভালো গুণও থাকে তার মাঝে।

আদ্রিশ ভাইয়া সম্মন্ধে তীব্র সমালোচনার পর আমিই নিজ থেকে বললাম

-‘ থাক বাদ দে তো, শুধু শুধু পাগলের প্রলাপ বকে কি লাভ?

-‘ হ্যাঁ তাই তো। থাক বাদ দেই।

প্রসঙ্গ পাল্টাতে তাই আমি বললাম

-‘ রিশতা আর অরনী ঠিকভাবে পৌঁছেছে ওদের দাদু বাড়িতে?

-‘ হ্যাঁ আদ্রিশ ভাই গিয়েছে ওদের ড্রপ করতে। তোকেও তো কত করে যেতে বললাম কিন্তু তুই তো গেলি না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খানিকটা আলসে ভঙ্গিতে বললাম

-‘ ওতো দূরের পথে আমার যেতে মন চায়না ভাইয়া।

-‘ কোথাও না গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকবি তাহলে?ঘরে থেকে থেকে তো ফার্মের মুরগি হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন। সন্ধ্যায় বের হব আমরা। আমাদের সাথেই তুই যাবি ব্যাস এটাই আমার শেষ কথা।

কথাবার্তার পাঠ এখানেই মুলতুবি করে আলভি ভাইয়া উঠে চলে যায় তার ঘরে। আমি আবারও ডায়রিটা সামনে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম, নাহ কিছু নেই। একইরকম দেখতে একদম নতুন ডায়রি। ব্যাটা কত বড় শেয়ানা, ডায়রিটাই পাল্টে ফেলেছে। পরক্ষণেই কিছু একটা নজরে পড়তেই মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল আমার। তপ্ত শ্বাস ফেলে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে।

আমার প্রিয় মেহরুন রঙের একটা সফট কটনের থ্রিপিস পরে মাথায় বেশ খানিকটা ওড়নাটা টেনে নিলাম। আয়নায় নিজেকে একবার পরোখ করে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। মা, মামনির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আলভি ভাইয়ার সাথে চলে এলাম। গাড়ির কাছে আসতেই দেখা হলো এক রমনীর সাথে। প্রথম দেখাতেই তাকে চিনতে আমার একটুও অসুবিধে হয়না, ইনি সেই আয়ুশী ভাবি। আলভি ভাইয়া এগিয়ে গিয়ে আয়ুশীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল

-‘ মেহু, ও হচ্ছে আয়ুশী, আমার বেস্টফ্রেন্ড। আর আয়ুশী ও হচ্ছে আমার বোন।

আমি তো আয়ুশীকে আগে থেকেই চিনি। সত্যিটা বলে দিলেই তো পারত, এতে এতো ভণিতার কি দরকার ছিল!

আমার মনের কথাটা কেড়ে নিয়ে গাড়ির জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে আদ্রিশ ভাইয়া অধরের কোণে বাঁকা হাসির রেখা ফুটিয়ে ঠাট্টার ছলে বলল

-‘ ছেলে মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারেনা, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ কিন্তু তুই। প্রথমে ক্লাসমেট থেকে জাস্টফ্রেন্ড, তারপর জাস্টফ্রেন্ড থেকে বেস্টফ্রেন্ড, এরপর তো ডিরেক্ট গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে ফেললি। এখন শুধু বউ বানানোটাই বাকি।

আচমকা আমার সামনে আদ্রিশ ভাইয়া হতে এমন বাক্যচয়ন শুনতে হবে তা হয়তো কল্পনা করেনি আলভি ভাইয়া বা আয়ুশীর কেউই। আয়ুশী লজ্জা পেল ভীষন। আলভি ভাইয়াও গলা কাখারি দিতে আদ্রিশ ভাইয়ার পাশের সিটটাতে বসে পড়ল। আমি আর আয়ুশী গিয়ে পেছনের সিটে বসে পড়লাম। কোথাও ঘুরতে গেলে আমার সাথে প্রত্যেকবার অরনী বা রিশতা থাকে কিন্তু এবার নেই বলে কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। তবে আয়ুশী ভাবি অন্যরকম মানুষ। একই ইয়ারে পড়ার সুবাধে মেয়েটা আলভি ভাইয়ার বয়সীই হবে। তবে আয়ুশী ভাবি বেশ কথারু এবং চটপটে স্বভাবের। আমিও কিছুটা খুব মিশুক প্রকৃতির। ঘন্টা দুয়েকের এই পরিচয়ে আমাদের বন্ধুত্ব মনে হচ্ছে যেন কতকালের!

গাড়ি এসে থামল ব্রিজের কাছে এসে। আমরা সবাই নেমে পড়লাম চট করে। দুপুরের ভ্যাপসা গরম ভাবটা মিলিয়েছে কিছুটা। প্রান্তর ছুঁয়ে এখন ধেয়ে আসছে মাতাল করা হাওয়া। আকাশে আজ পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে। চারপাশে কেমন ঝলমল করছে রঙ বেরঙের আলোয়। আমার কাছে ভালোই লেগেছে পরিবেশটা।
আলভি ভাইয়া আর আয়ুশী ভাবি নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে। আমি আর কাবাব মে হাড্ডি হলাম না ওদের মাঝে।

চোখ বুঁজে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিলাম, ভেতরটা যেন শীতল হয়ে এলো। দূর অন্তরীক্ষের পানে চোখ রেখে প্রকৃতি বিলাশে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

আদ্রিশ তার প্রেয়সীর পানে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল পলকহীনভাবে। ইশ শত অনুভূতি নিজের মাঝে চেপে রাখাটা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে তো তার জন্য। তার ধারণা, “এটুকু বয়সে প্রেম জিনিসটা একেবারেই বেমানান, এসব কারণে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। আগে পড়াশোনা তারপর সব। অন্ততপক্ষে মেয়েদের পড়াশোনা করে নিজের পায়ে আগে দাঁড়ানো উচিত। পিচ্চি এই মেয়েটার ভালোর জন্যই তো এমন করে অথচ সে কত অবুঝ!” এজন্য কতটা দূরে সরে থাকতে হচ্ছে তাকে। কথাটা ভেবেই এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।

#চলবে~