হৃদয়ে লাগিল দোলা পর্ব-১২+১৩

0
157

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১২

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গরম চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়ে আবারও সকালের প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। নিঃসন্দেহে আমি একজন প্রকৃতিপ্রেমী! বেলা হয়েছে বেশ। রৌদ্রের তাপ প্রচন্ড। বৃষ্টির যেন কোনো নাম-ই নেই। চারিদিকে শুধু খরা আর খরা। আমি চা প্রেমী তাই এমন কাঠপোড়া গরমেও চা খাই!

হুট করে পেছন থেকে একজোড়া হাত এসে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে। ধাক্কার ফলে আমার হাতে থাকা কাপের গরম চায়ের কিছুটা অংশ এসে আমার হাতে পড়ে। আমি ‘উহু’ করে উঠলাম। পেছন থেকে রিশতা এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল

-‘ সরি সরি, এই আমি ইচ্ছে করে করিনি বনু। আমি তো তোকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম।

আমি ওর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে চায়ের কাপটা সেখানেই ফেলে, আমার ঘরে চলে এলাম। রিশতা দ্রুত দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফের ট্রেটা নিয়ে এলো। আমি ততক্ষণে ঠান্ডা পানির ছিঁটা দিতে থাকলাম, যাতে ফোস্কা না পড়ে যায় হাতে। জ্বালা করছে ভীষণ হাতে, চা বেশ গরমই ছিল! রিশতা এসে আমার পাশে বসল। আমার হাতটা টেনে নিয়ে আলতো হাতে বরফ ঘসল। মেয়েটা আমায় বড্ড ভালোবাসে। একদম আপন বোনের মতোই!

আমার দিকে ফিরে অনুনয়ের সুরে বলল

-‘ সরি বনু, তোর হাতে যে গরম চায়ের কাপ ছিল তা আমি খেয়াল করিনি রে। আগে দেখলে এমনটা হতো না।

আমি শান্ত স্বরে বললাম

-‘ সমস্যা নেই, এটুকুতে কিছু হবেনা। আচ্ছা বাদ দে এসব। কেমন ঘুরলি তোদের দাদু বাড়িতে? আরও কটাদিন তো থাকতে পারতিস।

রিশতা মন খারাপের সুরে বলল

-‘ তোকে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না রে। আমাদের সেই ছোট থেকে একসঙ্গে ঘুমানোর অভ্যেস। জানিস কাল রাতে আমি একটুও ঘুমোতে পারিনি। তোকে কত করে বললাম আমাদের সাথে যেতে, তুই তো গেলি না।

রিশতার কথা শুনে আমারও মন খারাপ হলো কিছুটা। আমারও তো ঘুম হয়নি তেমন। এজন্যই রিফ্রেশের জন্য চা খাচ্ছিলাম।

আমি এবার কিছু একটা ভেবে বললাম

-‘ কাল তো তোদের সাথে ঘুরতে যেতে পারিনি তাই আজ চল আমরা তিনজন মিলে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।

রিশতা অবাক হয়ে বলল

-‘ কোথায় ঘুরতে যাবি? মামিরা তো আমাদের একা কোথাও ছাড়বে না, তাহলে?

আমি ভাবলেশহীনভাবে বললাম

-‘ আরে একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে।

রিশতা এবার মৃদু স্বরে বলল

-‘ শোন এভাবে তো আমাদের কখনো ছাড়েনি আজও ছাড়বেনা। আমরা এক কাজ করি, আমাদের সাথে সেফটির জন্য আলভি ভাইয়া বা আদ্রিশ ভাইয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই।

আমি দ্বিমত পোষণ করে দৃঢ় চিত্তে বললাম

-‘ না কাউকে নেওয়া চলবেনা। আমরা তিনজনই যাব। গাড়িতেও যাবনা। পায়ে হেঁটে বা রিকশা অথবা অটোতে করে যাব তবুও কাওকে নিবনা। আর তাছাড়া আমরা এবার কলেজে উঠতে চলেছি , এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। আমরা কি ছোট শিশু যে একা একা বাইরে বের হতে মানা।

-‘ তবুও সাথে কাউকে নিলে ভালো হতো।

-‘ তোর যাওয়ার দরকার হলে চল, নাহলে আমি একাই যাব।

আমার এমন দৃঢ় মনোভাব দেখে রিশতা অবশেষে রাজি হয়, এখন শুধু অরনীকে মানানোর পালা।

রিশতা গিয়ে অরনীকে ডেকে আনে। অরনী ছাঁদের সিড়িতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল এতোক্ষণ। মেয়েটা ইদানিং ফোনে যেন কার সাথে কথা বলে হেসে হেসে। আমাদের কাউকে দেখলেই ওমনি ফোন রেখে দেয়। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘বান্ধবীদের সাথে কথা বলছিল।’ আমি বা রিশতাও তো আমাদের বান্ধবীদের সাথে কথা বলি কই কাউকে দেখলে তো ফোন রেখে দিয়ে চোর চোর ভাব করিনা! আমার কাছে ওর এই বিষয়টা মোটেও ভালো ঠেকেনি। আচ্ছা অরনী আবার প্রেম টেম করছে না তো! ও তো এমন মেয়ে নয় তবে?

আদ্রিশ ভাইয়া একবার বলেছিল, ‘এই বয়সটাই খারাপ। এটা পড়াশোনার বয়স, প্রেমের নয়। কিন্তু যদি এই বয়সে কখনোভাবে প্রেম নামক জিনিসটা একবার জীবনে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে যায় তবে তার সর্বনাশ নিশ্চিত!’ আমি জানিনা এই কথাটা কতটুকু যৌক্তিক কারণ আমার সাথে এমন ঘটনা ঘটার সুযোগই হয়নি কখনো।

আমার এসব ভাবনার মাঝেই ডাক দিল অরনী। অরনীর ডাকে আমি ভাবনার সাগর থেকে উঠে এলাম।
অরনী ভ্রু কুটি করে বলল

-‘ হুট করে তোর আবার এমন খেয়ালীপনা চাপল কেন? শোন মেহরুন, আমি বলি কি, একারা একারা কোথাও যাওয়ার দরকার নাই। দিনকাল তো ভালো না। আর তাছাড়া আদ্রিশ ভাই এসব জানলে খবর আছে।

আমি কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে বললাম

-‘ এখানে আবার আদ্রিশ ভাইয়াকে জানানোর কি আছে? উনি কি আমাদের গার্ডিয়ান?

-‘ আমাদের না হোক তোর তো…

অরনীকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললাম

-‘ চুপ কর তুই। এতো ভণিতা ভালো লাগছে না আমার। গেলে চল, না গেলে না। তবে আমি যাব। এখন তোরা ভাব কি করবি তোরা?

কথাটা বলে উঠতে নিলে, আমার হাত ধরে ফেলে অরনী। বলল, ‘আমার সাথে যাবে ওরা।’

আমি খুশি হলাম। হাসি মুখে বললাম

-‘ তবে বিকেলের দিকে যাওয়া যাক।

বিকেলের দিকে…🌅

দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যে যার ঘরে রেস্ট নিতে চলে যায়। আমরাও রেডি হয়ে বেরিয়ে এলাম। দরজা খুলে যেই বের হতে যাব ওমনি মামনি পেছন থেকে বলে উঠল

-‘ কাউকে কিছু না বলে কোথায় যাচ্ছিস তোরা?

আমি পেছন ফিরে আলতো হেসে জবাব দিলাম

-‘ এই তো মামনি কাছে পিঠেই যাচ্ছি ঘুরতে। এই যাব আর এই চলে আসব।

মামনি রাজি হলেন না। বললেন

-‘ আদ্রিশকে বলছি তোদের নিয়ে যেতে।

আমি দ্বিমত পোষণ করে বললাম

-‘ না, আদ্রিশ ভাইয়া গেলে আমি যাবনা।

মামনি ভ্রু কুচকে বললেন

-‘ দুদিন আগেই তো তোরা ঘুরে আসলি, তাহলে?

-‘ কালকে তো সাথে আলভি ভাইয়া ছিল। আজ তো নেই।

-‘ তো আদ্রিশ গেলে কি সমস্যা? তোদের মাঝে কি ঝগড়া হয়েছে?

আমি না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললাম

-‘ এমনিই আরকি। আর তাছাড়া আমরা তিনজন তো এখন বড় হয়েছি। আর আমি একা যাচ্ছি না, রিশতা আর অরনীও তো যাচ্ছে আমার সাথে। তুমি এমন করো না, প্লিজ মামনি।

মামনির হয়তো আমার কথা পছন্দ হয়নি। তবুও বলল

-‘ যাচ্ছিস সাবধানে যা। তবে সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরবি।

আমি মাথা নাড়ালাম। তা দেখে তিনি আর কথা না বলে তার ঘরে দিকে পা বাড়াল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ভেবেছিলাম হয়তো যেতে দিবেনা, কিন্তু সম্মতি পেয়ে বেজায় খুশি হয়ে গেলাম। রিশতার দিকে ফিরে তাই ভাব নিয়ে বললাম

-‘ দেখেছিস এই মেহরুন ইবনাত খানের কত পাওয়ার!

নতুন একটা পার্ক হয়েছে। রিকশায় করে তিনজন মিলে আমরা সেখানেই গেলাম। পার্কটা বেশ সুন্দর। ছোট ছোট বাচ্চারা এসে খেলছে এখানে, কেউ দোলনায় চড়ছে, কেউ বিভিন্ন রাইডে চড়ছে। আমরা গিয়ে দোলনায় বসে দোল খেলাম কিছুক্ষণ। ভালোই লাগছে ভীষণ। মন মাতানো ঠান্ডা হওয়া বইছে চারপাশে। আমরা আমাদের পছন্দের ফুচকা, ঝালমুড়ি, হাওয়াই মিঠাই খেলাম। একটু ঘুরাঘুরি করার পর নজর পড়ল ‘পার্কসাইড ক্যাফের’ দিকে। পার্কের ঠিক অপজিটেই এই ক্যাফেটা। আমি রিশতার হাত ধরে সে পথেই রওনা দিলাম। পেছন পেছন অরনীও এলো।

ক্যাফের পরিবেশ বেশ সুন্দর! এখানে এসেই যে জিনিসটা সর্বপ্রথম নজরে এলো তা হলো বেশিরভাগই এখানে কাপলরা বসে রয়েছে। ‘পার্কসাইড ক্যাফে’ না দিয়ে ‘কাপলদের মিলনমেলা’ নাম দিলেই বোধ হয় ভালো হতো বেশ। ওদের দেখে আমার আফসোস হলো, ইশ একটা প্রেমিক থাকলে তাকে নিয়ে আজ এখানটায় আসতে পারতাম! কিন্তু আমার কি পোড়া কপাল, এই কাপলদের দেখে আমার বুকটা হাহাকার করে উঠল। মাথা থেকে এসব উদ্ভট চিন্তা বাদ দিয়ে তিনজন বসে পড়লাম টেবিলে। তিনজন তিন রকম ফ্লেভারের মিল্কসেক আর ফালুদা ওর্ডার করলাম।

গল্প করতে করতে খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেড়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। আশপাশ থেকে তখন মাগরিবের আযান ভেসে আসে।

রিশতা এবার আমার হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল

-‘ এই রে, সন্ধ্যের আগে মামি বলেছিল বাড়ি ফিরতে। এখন তো সন্ধ্যের পথে। কি হবে এখন?

আমি এদিকে রিকশা দেখছি। মাগরিবের আযান পড়ায় রাস্তায় লোকজন কমতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। রিকশা পেতে বিলম্ব হওয়াতে, আমি হতাশ হলাম কিছুটা। হাঁটতে হাঁটতে আমরা বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। পার্কের কাছে পিঠে লোকজনের আনাগোনা থাকলেও এখানটাতে কোনো লোকজন নেই, রিকশাও নেই। শুধু আমরা তিনজনই। আমরা আমাদের মতো হাঁটছিলাম এমন সময় আমার ওড়নায় টান পড়ায়, আমি পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম কয়েকটা বখাটে দাঁড়িয়ে বিশ্রীভাবে হাসছে আর আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। রিশতা ভয় পেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে। একজন তো এসে অরনীর হাত ধরে টানতে থাকে। আরেজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল

-‘ আরে ঐ মাইয়্যাডারে ছাড়, এইডারে ধর, এইডাতো এক্কেবারে ডাশা মা*ল।

বিশ্রী এই বাক্যটা আমার কর্ণকুহুরে ঠেকতেই আমার পুরো শরীর জ্বলে ওঠে যেন। এদিকে রিশতা ভয়ে কান্না জুড়ে দেয়। আমায় এখন ভয় পেলে চলবেনা, মনে সাহস রাখতে হবে। মেয়ে মানুষ অবলা বলেই, এদের মতো হিংস্র অমানুষগুলো আক্রমণ করে। কিন্তু আমায় তো এখন শক্ত থাকতে হবে। আদ্রিশ ভাইয়া বলেছিল,’যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে আর মনে সাহস রাখতে।’ মনে মনে নিজেকে সাহস জুগিয়ে, আমি এদিক ওদিক খুঁজতে থাকি কিছু আছে কি না। কয়েকটা ইটের কুঁচো আর ধুলোবালি নজরে পড়তেই মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে আমার। আপাতত এগুলো দিয়েই কাজ চালাই তারপর দেখছি। নিচু হয়ে একহাতে বালি আরেকহাতে ইটের কুঁচো তুলে নিলাম, রিশতাকেও বললাম তাই করতে। কাঁপা কাঁপা হাতে ও তুলে নিল ওগুলো। বখাটেগুলো আমাদের কাছে আসতেই আমরা ইট পাথরের কুঁচো আর ধুলোবালিগুলো ওদের চোখেমুখে ছুঁড়ে দিলাম। ওরা চোখেমুখে হাত দিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে বিশ্রীভাবে গালি দিল। ওদের মধ্যে দুজন দৌড়ে চলে এলো আমাদের কাছে। আমার হাত ধরতে নিলেই মাথায় থাকা হিজাবের পিন খুলে একজনের চোখে ফুটিয়ে দিলাম। আরেকজনের নাক বরাবর ঘুষি দিলাম। ওরা নাক, চোখ চেপে বসে পড়ল।

আমরা সুযোগ বুঝে দৌড় শুরু করলাম। রিশতা, অরনী আমার সামনে আর আমি পেছনে। হুট করে পায়ের সাথে কিছু জড়িয়ে যাওয়ায় মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম। ওঠার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলামনা। পায়ে ব্যথা করছে ভীষন, হয়তো পা মচকেছে। পেছন ফিরে দেখলাম ওরা এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

তবুও খুব কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালাম। এই পা নিয়ে দৌড়ানোর মতো শক্তি নেই আমার। তবুও খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে শুরু করলাম। হঠাৎ মনে হলো পেছন থেকে কেউ ছুরিকাঘাত করেছে আমায়। খেয়াল করে দেখলাম, আমার পিঠের কার্নিশে, চামড়া ভেদ করে ছুরি বিঁধেছে। গলগল করে রক্ত গরিয়ে পড়ছে সেখান থেকে। আমি এসব কাটাছেঁড়া, রক্ত দেখতে পারিনা, ফোবিয়া আছে আমার। অসহনীয় যন্ত্রণায় আমার নেত্র হতে কয়েক ফোঁটা জল গরিয়ে পড়ল। লোকগুলো এসে ঘিরে ফেলল আমায়। আমার জীবনের প্রদীপ তবে এভাবেই নিভতে চলল। আদ্রিশ ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে ভীষন। আমি না থাকলে কি সে ভালো থাকবে? তাকে নিয়ে জমানো কথাগুলো আর বলা হলোনা তবে। জেদ না করে মামনির কথা শোনা উচিত ছিল আমার। চোখ মেলে রাখতে পারলাম না আর, চোখের পাতা বুঁজে আসছে বারবার। শুধু শুনতে পেলাম সামনে থেকে রিশতা, অরনীর আর্তনাদ, আর পেছন থেকে লোকগুলোর বিশ্রী হাসি। এতোকিছু করেও হেরে গেলাম তবে, বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। আমার জীবনের অঙ্কটা এমন অমীমাংসিতই রয়ে যাবে তবে…

#চলবে~

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১৩

চিৎকার করতে করতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম আমি। ঘামে ভিজে একেবারে জুবুথুবু অবস্থা হয়েছে আমার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেন! বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিলাম। আমার বুক ধরফর করছে ভীষণ। হৃদপিন্ড এতো জোরে বিট করছে যেন মনে হচ্ছে লাফিয়ে বেড়িয়ে পড়ার উপক্রম! দোয়াদুরুদ পড়ে বুকে কয়েকবার ফুঁক দিলাম। মাথার উপরে থাকা সিলিং ফ্যানটা ফুল স্পিডে চলছে কিন্তু তবুও আমি ঘামছি অনবরত।

পুরো ঘর জুড়ে এখন আবছা আবছা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আশেপাশে এলোমেলো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজেকে নিজের ঘরেই আবিষ্কার করলাম। প্রচণ্ড ভয়ে থরথর করে কাপছি এখনো। আমি এখনও বেঁচে আছি তাহলে? এতোক্ষণ যা দেখেছি তা নিছক স্বপ্ন ছিল তবে? সত্যিই কি ভয়ংকর স্বপ্ন! একেবারে জীবন্ত মনে হয়েছিল! এই বুঝি টুপ করে ঝরে গেল আমার তর তাজা প্রাণটা! নিজেকে ধাতস্থ করতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। স্বপ্ন নিছক স্বপ্নই হয়। কিন্তু আমার কাছে এখনো বাস্তব মনে হচ্ছে। এর রেশ কাটেনি এখনো আমার।

আমার চিৎকার শুনে ইতোমধ্যে বাড়ির সকলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে আমার ঘরে। ঘরের আলো জ্বালাতেই আমাকে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে দেখে তাদের ঘুম উবে যায়। সবার চোখেমুখে ফুটে উঠল চিন্তার ভাঁজ। আমি ভীতসন্ত্রস্ত চিত্তে তাকালাম একবার সবার পানে। মা এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আমি ভয়ে জাগটে ধরি মাকে। মামনি এসে পানিভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমি তা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পুরোটুকু গলায় ঢেলে নিলাম। তারপর জোরেজোরে শ্বাস নিতে থাকলাম আমি।

আলভি ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে এসে চিন্তাগ্রস্থ চিত্তে বলল

-‘ কি হয়েছে মেহু, এই মাঝরাতে এভাবে চিৎকার করছিস কেন?

অতিরিক্ত ভয় পাওয়ার কারণে আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। নির্বিকার হয়ে তাই মায়ের বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম। মাথাটা ধরেছে ভীষন। সবটা কেমন ওলোট পালোট লাগছে। একটা স্বপ্ন এতোটা জীবন্ত কীভাবে হতে পারে? যদিও স্বপ্নে যা দেখেছি তা পুরোটাই অবাস্তব ছিল। তবুও ভয় পেয়েছি ভীষণ।

আলভি ভাইয়াদের সাথে ঘুরাঘুরি করে, ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গিয়েছিল। আমরা ব্রিজ থেকে ঘুরে আবার পার্কে টুকটাক ঘুরে ফিরে হালকা খাবার খেয়ে চলে এসেছিলাম। রাত হয়ে যাওয়ায় ক্যাফেতে আর যাওয়া হয়নি, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাই। এজন্য বাইরে থেকে দেখেই ফিরে এসেছিলাম আমরা। বাসায় ফিরে আর খাওয়া দাওয়া হয়নি। ঘরে এসে ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল, ঘুমও আসছিল না। তাছাড়াও অরনী আর রিশতাও ছিলনা বিধায়, আমার আজ একা একা খুব বোরিং লাগছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একটা সিরিজ দেখা যাক। তো সেখানে একটা সিন ছিল এমন, যেটা আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। আর তাছাড়াও পার্কের ঐ রোডটায় বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, দোকানপাট থাকায় প্রায় সবসময়ই কোলাহলপূর্ণ থাকে, ফলে ঐ রাস্তায় একা পেয়ে ক্ষতি হবার সম্ভাবনাও খুব একটা নেই বললেই চলে। কেউ কিছু বললেও কেউ না কেউ তা দেখবেই। অতএব স্বপ্ন অবাস্তবই হয়। স্বপ্ন আসলে মুলত তিন ধরনের হয়ে থাকে। একটা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আরেকটা শয়তানের পক্ষ থেকে আর সর্বশেষ আমরা যা দেখি, বা যা নিয়ে সারাক্ষণ কল্পনায় মগ্ন থাকি তা-ই দেখি। এজন্য গুরুজনেরা বা পরহেজগার ব্যক্তিরা সবসময় ঘুমানোর আগে ‘আয়াতুল কুরসি’ পড়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেন। আর দূষ্স্বপ্ন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বিভিন্ন আমল রয়েছে, যেগুলো পড়লে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। তবে আজ সিরিজ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, খেয়ালই ছিল না। ক্লান্তির কারণে আজ এশার নামাজটাও মিস হয়েছিল।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার পাশে এসে বসল। আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত স্বরে বলল

-‘ মেহু, ঠিক আছিস তুই? তোকে এমন লাগছে কেন? কি হয়েছে আমাকে বল।

আমি আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে ফিরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম

-‘ খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি ভাইয়া।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো হেসে বলল

-‘ বোকা মেয়ে, সামান্য স্বপ্ন দেখে কি কেউ এতো ভয় পায়? স্বপ্ন স্বপ্নই হয়। কখনো বাস্তব হয়না।

আমি ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে বললাম

-‘ তোমার সাথে এমন ঘটলে তখন বুঝতে ভাইয়া, ঠিক কেমন লাগে!

আদ্রিশ ভাইয়া অধরের কোণে হালকা হাসি ফুটিয়ে কিছুটা রসিকতা করে বলল

-‘ এমনভাবে চেঁচালি ভেবেছিলাম তো জ্বিনে আছোড় করেছে তোকে। পরে শুনলাম স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছিস। তো কি দেখেছিস স্বপ্নে? প্লিজ ডিসক্রাইব আস। আমরা অধীর আগ্রহে বসে আছি আপনার মূল্যবান বক্তব্যের জন্যে।

আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে স্বপ্নে দেখা সবকিছু বলে ফেললাম।

সবটা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া হো হো করে হেসে ফেলল। বিদ্রুপ করে আমায় বলল

-‘ আরেকটু ঐসব ছাইপাঁশ দেখ, আর এসব উদ্ভট উদ্ভট স্বপ্ন দেখ। উজবুক কোথাকার। মানে সিরিয়াসলি সামান্য একটা স্বপ্ন দেখে এতো ভয় পায় মানুষ! তা তুই যখন বিপদে পড়লি তখন তোর হিরো এন্ট্রি নিয়ে তোকে বাঁচাতে আসেনি?

আমি ভয় পেয়েছি। আমার জীবন মরণ নিয়ে টানাটানি পড়ে গিয়েছিল। এমন ভয়ানক স্বপ্ন দেখে ভয়ে যদি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত তখন কি হতো আমার? কোথায় শান্তনা দিবে তা না করে আমায় নিয়ে ঠাট্টায় মেতে উঠেছেন তিনি! ওনার থেকে এমন কথা শুনে কষ্টের সাথে সাথে আমার রাগও হলো ভীষণ।

মামনি ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল আদ্রিশ ভাইয়াকে।
আমার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল

-‘ ভয় নেই মা। আজ রাতটায় আমি তোর সাথে ঘুমাব। কতো করে বললাম, তোর সাথে আমি ঘুমাই তা তো শুনলি না।

আদ্রিশ ভাইয়া পাশ থেকে বলে উঠল

-‘ স্বপ্নকে স্বপ্ন মনে করে উড়িয়ে দিলেও, একটা জিনিস মনে রাখিস, মায়েদের কথা অমান্য করলে এমনই বিপদে পড়তে হয়।

আমি শুনলাম। ভয়ের রেশটা কেটেছে এখন খানিকটা। নিছক স্বপ্ন ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম বিষয়টা। তবে আদ্রিশ ভাইয়ার কথাটা মাথায় রাখলাম। তার বলার ধরন ভালো না হলেও, সে আজ পর্যন্ত যা বলেছে তা আমার ভালোর জন্যই বলেছে।

আদ্রিশ ভাইয়া এবার ঠাট্টার ছলে বলে উঠল

-‘ আম্মু ওর সাথে থাকছো থাকো তবে সাবধান! এরপর দেখা গেল আবার কি স্বপ্ন দেখল তখন তোমাকে খাট থেকেই ফেলে দিল।

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমি চটে গেলাম এবার। সবসময় এমন ঠাট্টা মশকরা ভালো লাগেনা আমার। থমথমে গলায় বললাম

-‘ স্বপ্ন কখনো সত্যি হয়না। এটা আমিও জানি। তবে যদি সত্যিই যদি বাস্তব হতো তখন তো আমি মরেই…

আমার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই আদ্রিশ ভাইয়া আমায় থামিয়ে, ধমক দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল

-‘ খবরদার বলছি, এসব উলোটপালোট কথা আর কখনো বলবিনা একদম। কথায় কথায় শুধু মরে যাব মরে যাব, করিস কেন? আমাদের কথা কি একটুও ভাবিসনা তুই? বলি, তোর যখন এতোই মরার শখ তাহলে আমার কাছে আয়, তোর গলাটা টিপে দেই একটু। তুই তো জীবনেও বুঝবি না, তোকে আমি ঠিক কতোটা ভালো…।

শেষোক্ত কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় আদ্রিশ ভাইয়া।

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে মামনি চোখ গরম করে বলল

-‘ আচ্ছা দেখছিস তো মেয়েটা বেশ ভয় পেয়েছে, আর তুই ওর সাথে এমন ব্যবহার করছিস? অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন। যা নিজের ঘরে যা।

মামনির কথায় আদ্রিশ ভাইয়া আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। গটগট পায়ের আওয়াজ তুলে নিজের ঘরে চলে যায়। একে একে সবাই যে যার ঘরে চলে যায়। মা এসে লবণ পানি খাইয়ে দেয় আমায়। মামনি দোয়াদুরুদ পড়ে ফুঁ দিয়ে দেয়। কিন্তু ঘুম এলো না আর। তবে শেষরাতের দিকে চোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম এসে হাজির হয়। বুঁজে আসে দুই নেত্রের পল্লব। তবে আমার অধরের কোণে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি। আদ্রিশ ভাইয়ার অনুভূতিগুলো সম্মন্ধে সব জানা হয়ে গেছে আমার। কিভাবে জানলাম পরে বলবো নাহয়, এখন একটু ঘুমিয়ে নেই🥱

#চলবে~