হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-০১

0
69

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
#সূচনা_পর্ব

১.
বিয়ের দিন রাতে সদ্য বিবাহিত স্বামী ও তার কাজিন বেলাকে একসাথে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় ত্রয়ী মেহরোজ।তার পরনে এখনো বিয়ের লাল-খয়েরী রঙের ভারী লেহেঙ্গা। অক্ষিকোটরে দৃশ্যমান দামি শুভ্র পাঞ্জাবি পরে বর সেজে সুদর্শন সেই যুবকটিই যে তার সদ্য বিবাহিত স্বামী তা মেনে নিতে হৃদয়ে অসহ্য দহন হচ্ছে ত্রয়ীর।সেই কলঙ্কিত স্থানে সে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না।যন্ত্রমানবীর ন্যায় হেঁটে চলে তাদের জন্য সুসজ্জিত বাসর ঘরের দিকে।বাসর ঘর!কথাটা ভাবতেই তাচ্ছিল্য ভরে উঠে ত্রয়ীর মন।

সেই বরাদ্দকৃত কক্ষ,যেখানে সফল এডভোকেট সুপ্ত রেহনেওয়াজ ও তার মিসেসের জন্য বাসর সাজানো হয়েছে।কক্ষটির সামনে আসতেই আড়ষ্টতায় জড়িয়ে যায় ত্রয়ী।সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো বাসরঘর অবধি নতুন বধু একা এসেছে।এজন্য লজ্জায় সিটিয়ে যাচ্ছে ত্রয়ী।দরজার কাছাকাছি আসতেই ত্রয়ী দেখতে পায় সুপ্তের কাজিনরা সকলে বসে আছে।ওদের মধ্যে মিনি নামের একজন ত্রয়ীকে বলে উঠে,

-“এসো ভাবি এসো।যাও যাও জলদি রুমে ঢুকো।দেখ বাসর ঘর পছন্দ হয় কি না।”

ওদের দুষ্টমিষ্টি কথায় লজ্জায় মাথা নুয়ায় ত্রয়ী।সুপ্তের কাজিনরা ভেতরে প্রবেশের জায়গা করে দিলে ধীরে সুষ্ঠে ভেতরে প্রবেশ করে সে।কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করতেই মুখশ্রীর লজ্জাভাব অদৃশ্য হয়ে যায় ত্রয়ীর।অজানা কারণে অক্ষিকোটরে অশ্রু জমা হয়,মানস্পটে ভেসে উঠে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য।হাতমুষ্টিবদ্ধ করে চোখ বুঁজে ত্রয়ী।

এদিকে আচমকা বেলা জড়িয়ে ধরায় অবাক হয়ে যায় সুপ্ত।কিন্তু বেলার অস্ফুটস্বরে বলা কথাখানা শোনার পরেই হেঁচকা টানে নিজের থেকে তাকে সরিয়ে দেয় সে।বেলার হাত এবার তার শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি।রাগে কঠোর হয়ে আসা মুখশ্রী দেখে শুকনো ঢোক গিলে বেলা।তার ভীত মুখশ্রী দেখে সুপ্তের রাগ কমার পরিবর্তে যেন তরতর করে বেড়ে যায়।দাঁতে দাঁত চেপে সে একপ্রকার চিৎকার করে বেলার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-“তোর মাথা ঠিক আছে বেলা?হোয়াট ওয়াজ ইউ ডুয়িং?আমি বিবাহিত এটা তোর জ্ঞাত হওয়ার পরেও কিভাবে ভালোবাসার দাবি নিয়ে তুই আমাকে জড়িয়ে ধরিস!

কথাটুকু সম্পন্ন করে মুঠোয় বন্দি হত খানা ঝাড়া মেরে ছেড়ে দেয় সুপ্ত।তারপর গাট গাট পায়ে বেরিয়ে আছে বেলার রুম থেকে।বেলার মুখনিসৃত আর একটি শব্দও সে কর্ণগোচর করবে না।
বেলার রুমে সে এসেছে বেলার পাঠানো ভয়েজ মেসেজ শুনে।যেখানে বেলা ভীতু কন্ঠে তাকে সাহায্যের জন্য তার রুমে আসতে বলছে।তারপর যেই সুপ্ত রুমে আসলো অমনি বেলা তাকে জড়িয়ে ধরেছে।
উক্ত ঘটনায় ক্রোধান্বিত হয়ে সুপ্ত তার নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ায়।হাতে থাকা ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখে ১ টা বেজে গেছে প্রায়।নিজ কক্ষের সামনে পৌছাতেই তাকে বিরাট কাজিন গোষ্ঠীর সম্মখীন হতে হয়।তাদের দাবি সুপ্তকে ভেতরে প্রবেশের জন্য মোটা অংকের টাকা দিতে হবে।
কাজিনদের মাঝে সুপ্তের বোন তন্দ্রাও ছিল।সে সুপ্তকে স্পষ্টভাবে বলে দেয়,

-“ভাইয়া যদি আমাদের দাবি করা টাকার এক পয়সাও তুৃমি কম দিয়েছো তো আজ তোমার বাসর ক্যান্সেল।আর যদি কোনভাবে ভেতরে ঢুকেও পর তাহলে…”

-“তাহলে আমরা সকাল অবধি এখানেই বসে থাকবো।বুঝেছো ভা-ই-য়া।”

তন্দ্রার মুখের জবাব কেঁড়ে নিয়ে বাকি বাক্যটুকু নিজের মতামত অনুসারে সমাপ্ত করে দেয় বর্ণ।
সুপ্ত ওদের সবার দিকে একে একে তাকায়।সকলেই মাথা নাড়িয়ে বোঝায় টাকা ছাড়া তারা এখান থেকে এক পাও নড়বে না।সুপ্ত ওষ্ঠকোণে সুক্ষ্ম হাসি বজায় রেখে ক্রেডিট কার্ড বের করে।তারপর বর্ণের হাতে তা ধরিয়ে দিতেই ওরা সুপ্তকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়।
সুপ্ত ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লক করতেই মেয়েলি কন্ঠে তাচ্ছিল্যময় বাক্য কানে আসে,

-“প্রেমিকা তাহলে সবে বিদায় দিল আপনাকে?”

শব্দের উৎস অনুসরণ করে তাকাতেই সুপ্তের চক্ষুদ্বয়ে মুগ্ধতা বিরাজ করে।তার ঘরের বিশাল আরশির সামনে দাঁড়িয়ে বঁধু সেজে দাড়িয়ে আছে অংশু।নবোঢ়াকে সুসজ্জিত খাটে উপবিষ্ট থাকার জায়গায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে সুপ্তর মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা না দিলেও অংশুর প্রশ্ন মস্তিষ্কে এসে ঠেকতেই ভ্রুযুগল কুঁচকে আসে তার।অংশু তখন বুকে হাত গুঁজে তার দিকেই তাকিয়ে।দুচোখে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।সুপ্ত তার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ত্রয়ীর মুখশ্রী জুড়ে দৃষ্টি বুলায়।তারপর বলে,

-“বিয়ের আগে কারো সাথে সম্পর্ক করা হারাম।আর তাই এই হারাম কাজ থেকে আমি দূরে থেকেছি।আর কিছু?তোমার প্রশ্নের উত্তর ক্লিয়ার?এন্ড হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দিস কুয়েশ্চন?”

সুপ্তের সত্য জবাবও ত্রয়ীর দেখা অসত্যের কাজে ফিকে পরে যায়।ফের তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে তার মুখে।তবুও ত্রয়ী শান্ত কন্ঠে বলতে শুরু করে,

-“মিথ্যা বলবেন না।আই নো দ্যা ট্রু।আপনার কাজিন বেলার সাথে আপনার সম্পর্ক তাই না?”

শেষাক্ত কথাখান বলার সময় ত্রয়ীর কন্ঠ রাগে কাঁপছিলো।ত্রয়ীর মুখে একথা যেন একদম আশা করেনি সুপ্ত।তার স্বাভাবিক মুখমন্ডল হঠাৎ থমথমে হয়ে আসে।সুপ্ত কন্ঠে বিষদ শান্ত ভাব এনে জিজ্ঞেস করে,

-“কিসের ভিত্তিতে তুমি এই কথা বলছো ত্রয়ী?”

-“আপনাকে তার তাকে আমি একসাথে জড়াজড়ি অবস্থায় দেখেছি মিস্টার।আমার বলতেই ঘেন্না লাগছে!”

বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে যখন দুজন নারী-পুরুষ আবদ্ধ হয় তখন সেই সম্পর্ক হয়ে উঠে পাকের মধ্যে জন্ম নেওয়া সদ্য পুষ্পিত পঙ্কজের ন্যায় পবিত্র, শুদ্ধ।তবে ত্রয়ী ও সুপ্তের সেই পবিত্র সম্পর্কের শুরুতেই যেন অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে ত্রয়ীর মনে।
সুপ্ত রেহনেওয়াজকে ত্রয়ী সর্বপ্রথম দেখে আদালতে।মেডিকেল কলেজের এক মেয়ের রেপের ক্যাসে ডিফেন্স লয়ার ছিল সুপ্ত।মেয়েটি ত্রয়ীর রুমমেড থাকায় সে সহ আরো তিনজন মেয়ে সেদিন উপস্থিত ছিল আদালতে।সেদিন সুপ্তের সাবলীল তেজি কন্ঠে বিমোহিত হয়েছিল ত্রয়ীর মন।অল্প বয়সেই ওকালতির দক্ষতায় সুনাম কুড়ানো সুপ্তের উপর ক্রাশিত ছিল তার সহচারীরা।লম্বা সুঠাম দেহের সুদর্শন লয়ার সুপ্ত রেহনেওয়াজ ছিল মেয়েদের আড্ডাখানার প্রধান বিষয়বস্তু।তারপর হঠাৎ কিছুদিন আগে ত্রয়ীকে দেখতে আসা পাত্রের স্থানে স্বয়ং সুপ্তকে দেখে চক্ষু চরকগাছ হয়ে গিয়েছিল ত্রয়ীর।তবে তার বাবা-মা রাজি থাকায় সে বিয়েতে অমত করার কোন অপশন পাইনি।বিখ্যাত রেহনেওয়াজ পরিবার থেকে আসা মেয়ের বিয়ের সমন্ধ ত্রয়ীর মধ্যবিত্ত বাবা মার না করার কোন কারণ নেই।তার উপর পাত্র সুপুরুষ,সুদর্শন বটেই।
ত্রয়ীর কথায় সুপ্তর নিভে যাওয়া রাগ ফের জেগে উঠে।বেলার বেহায়াপনার কারনেই যে আজ তার চরিত্র নিয়ে কথা উঠছে সেটা বুঝতে পেরে সমস্ত রাগ গিয়ে পরে বেলার ঘাড়ে।তবে এই মুহুর্তে সৃষ্টি হওয়া ভুল বোঝাবুঝি মেটানো দরকার।তাই সে অংশুর উদ্দেশ্য বলতে শুরু করে,

-“লিসেন ত্রয়ী,তুমি যা দেখছো তা একটা মিসআন্ডাস্টেনিং।বেলার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”

-“আপনার উচিত ছিল যা বোঝাবেন তাই বুঝবে টাইপের মেয়ে বিয়ে কথা তাহলে আপনাকে আজকে এরকম ফ্যাসাদে পরতে হলো না।”

ত্রয়ীর প্রতিটি শব্দে যে রাগের বর্শা নির্গত হচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে সুপ্ত।ত্রয়ীর দৃষ্টি,রাগ্বান্তিত মুখশ্রী দেখে যে সে একদমই নিরহ টাইপের মেয়ে নয় তা বুঝতে একদমই কষ্ট হচ্ছে না সুপ্তের।তবে মেয়েটা কি এবার বেশি বাড়াবাড়ি করছে না।মায়ের পছন্দ করা মেয়ের মুখে তার চরিত্র নিয়ে ভুলভাল কথা শুনে সুপ্তের সেই সুপ্ত রাগী স্বভাব ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে যা তার প্রফেশনাল লাইফে লুকায়িত।এদিকে ত্রয়ী চুপ করে থাকার মেয়ে নয় তার জবান আবার চলছে,

-“আপনি একই সাথে দুটি মানুষের জীবন নষ্ট করেছে মিস্টার রেহনেওয়াজ।আমার আর আপনার সো কন্ড প্রেমি…”

হাতের আঙ্গুল সুপ্তের দিকে উঁচিয়ে কথা বলছিল ত্রয়ী।হঠাৎ সুপ্ত সেই হাত ধরে পেছনে নিয়ে দুহাতে ত্রয়ীর দুহাত চেপে ধরে।বিস্ময়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় ত্রয়ীর।সুপ্তের বুক বরাবর হাইট হওয়ায় সে মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে।ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে বিস্ময়ে।ত্রয়ীর হাতদুটোয় আরো চাপ দিয়ে সুপ্ত বলে উঠে,

-“আই সে দিস ইস লাই দ্যাট মিনস ইটস রিয়েলি লাই, ত্রয়ী।নো ম্যাটার হোয়াট ইউ থিংক!তোমার চোখে দেখা,কানে শোনা সব ভুল,সব!”

সুপ্তের দাঁতে দাঁত চেপে বলা কথাটায় যেন ত্রয়ীর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কিছু বলবে তার আগেই সুপ্তের একহাত তার ওষ্ঠ চেপে ধরে।সুপ্ত এবার ফিসফিসয়ে বলে উঠে,

-“নো মোর ওয়ার্ডস মিসেস সুপ্ত রেহনেওয়াজ!নো মোর ওয়ার্ডস!”

কথাটা শেষ হতেই সুপ্ত ত্রয়ীকে তার বাধন থেকে মুক্ত করে দেয়।মাথায় সাথা শুভ্র বর্ণের পাগড়ি ছুঁড়ে মারে ফুলে ফুলে সজ্জিত বিছানায়।এক নিমিষেই বিছানার মধ্যে লাল গোলাপের পাপড়ির মাঝে সাদা পাপড়ি দিয়ে লেখা ‘সুপ্ত+ত্রয়ী’ অস্তিত্বহীন হয়ে যায়।আচমকা বিকট শব্দে দরজায় আওয়াজ হতেই ত্রয়ীর বোধগম্য হয় সে চলে গেছে কক্ষের বাইরে।
বাহিরের শীতল হাওয়া হঠাৎ উতপ্ত হয়ে ঝড়ো হাওয়ায় পরিনত হয়।বৃষ্টি আগাম বার্তা নিয়ে তারা বয়ে বেড়াচ্ছে।সেই ঝড়ো হাওয়া গায়ে মাখিয়ে সুপ্তর অন্তর সত্তা বলে উঠে,

“অন্যের নামে মিথ্যা মামলা চুকানো সুপ্ত রেহনেওয়াজ তোর মানেই মিথ্যে মামলা ঠুকে দিলো তোর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী।এর মীমাংসা তুই কিভাবে চুকাবি?”

চলবে…