হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-২৩+২৪

0
122

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২৩.
-স্বামী কারাগারের ভেতরে,আমার কাছে এই মুহুর্তে বন্দি তুমি।নারী,অবলা তুমি।অথচ কন্ঠে এত তেজ!আ’ম ইমপ্রেসড!

ত্রয়ী আরসালানের মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে তীক্ষ্ণভাবে তাকায়।তারপর বলে উঠে,

-আমার তেজের কারণ আমার স্বামী নয় যে উনি সাথে না থাকলে আমি দুর্বল হয়ে পরব।আর পুরুষের কি এত অহংকার!যখন তার সৃজন অবলা নারীর গর্ভেই হয়!

আরসালান তার দাঁড়ির উপর হাত বুলিয়ে ত্রয়ীর উদ্দেশ্য বলে উঠে,

-নামের মতই তোমাকে বর্ণনা করার জন্য সৌন্দর্য,বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতা তিনটি শব্দ আবশ্যক।

নিজের নামে প্রশংসা শোনার পর বুকে হাত গুঁজে নেয় ত্রয়ী।শক্ত কাঠকাঠ কন্ঠে বলে উঠে,

-কিন্তু আপনাকে বর্ণনা করার জন্য একটা শব্দই এনাফ।কাপুরষ!এই একটি মাত্র শব্দ ডিজার্ভ করেন আপনি।

ত্রয়ীর মুখ নিসৃত অপমানসূচক বাক্য শুনে হাত মুঠি করে উঠে দাড়ায় আরসালান।শক্ত মুখে ত্রয়ীর পানে তাকিয়ে বলে উঠে,

-আমাকে রাগিও না।সিংহ গর্জে উঠলে কি হয় জানো না বুঝি?

-অন্যের স্ত্রীর উপর নজর দিয়ে তাকে অপহরণ করে নিয়ে আসাকে কাপুরুষতা বলে আরসালান চৌধুরী।অথচ আপনি নিজেকে সিংহ বলে দাবী করছেন!কান খুলে শুনুন আমাকে এই মুহুর্তে যেতে দিন নয়তো…

-নয়তো কি?

কথাখান বলেই বিশ্রিসুরে অট্টহাসিতে ফেটে পরে আরসালান।ত্রয়ী একটা শুকনো ঢোক গিলে।সে মনে মনে হালকা হালকা ভয় পেলেও তা প্রকাশ করবে না।ত্রয়ী কিছু বলবে তার আগেই আরসালান গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,

-এত কাঠ খড় পুড়িয়ে সুপ্তকে জেলে পুরলাম।তোমায় অপহরন করে নিয়ে আসলাম এমনি এমনি যেতে দেওয়ার জন্য?অবশ্যই না।

ত্রয়ী শাড়ির আঁচল খামছে ধরে রাগে।আরসালানের দিকে ঘৃণ্য ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় সে।হঠাৎ আরসালান উঠে দাঁড়ায়।ত্রয়ীর দিকে এগুতে নিলেই ভ্রু কুঁচকে পিছিয়ে যায় ত্রয়ী।ডাগর ডাগর আঁখি পল্লব থেকে মুক্তোর ন্যায় অশ্রুকণা বেরিয়ে কপোল ছোঁয়।আরসালান সেদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

-শেষ!সব তেজ শেষ?চোখ দিয়ে তো জল বেরিয়ে পরলো।

-মুর্খ আপনি আরসালান।অশ্রু শুধু দূঃখের জন্য বেরোয় না।অশ্রু অতিরিক্ত রাগের বহিঃপ্রকাশও হয়।আমার প্রচন্ড ঘৃনা আর রাগ হচ্ছে আপনার উপর।আপনি একটা জঘন্য মানুষ!হয়ত মানুষ বললেও ভুল হবে।

ত্রয়ীর কথার শোনার পর দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে এগোয় আরসালান।ত্রয়ী দ্রুত চোখ বুলায় আশেপাশে।সামনের ট্রি টেবিলে থাকা ফলের থালায় ছুড়ি দেখে দ্রুত হাতে নেয় সেটা।রিনরিন শব্দে ঝংকার তুলে হাতের কাঁচের চুড়ি।আরসালান তা দেখে তার গতি মন্থর করে।ত্রয়ী গর্জে বলে উঠে,

-কাছে আসার চেষ্টাও করবেন না।আপনার মত ঘৃন্য প্রানীকে হত্যা করার সুযোগ পেলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব!

ত্রয়ীর কথা শুনে আরসালান আরো ক্ষেপে যায়।প্রবল আক্রোশে ত্রয়ীর পানে এগুতেই এক নারী কন্ঠ কানে এসে বারি খায় তার।অপ্রস্তুত হয়ে শব্দের উৎসের খোঁজে সিঁড়ির দিকে তাকায় সে।তার সাথে সাথে ত্রয়ীও তাকায়।

-আরসালান!এটা কি করছো তুমি?কে এই মেয়ে?তুমি ওকে ধরে নিয়ে এসেছো কেন?

আরসালানের মা কণা চৌধুরী ব্যতিব্যস্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে আরসালানের উদ্দেশ্যে কড়া কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারেন।বিরক্তিতে চ সূচক আওয়াজ করে আরসালান।ত্রয়ী তীক্ষ্ণ চোখে কনা চৌধুরীর দিকে তাকায়।
ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরিহিতা মহিলা বেশ লম্বা।চোখে মুখে রাজকীয় ভাব মিশে।হাতে মোটা মোটা সোনার বালা,পরিপাটি সাজগোছ।কণা চৌধুরী ত্রয়ীর সামনে এসে দাঁড়ালে ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকায় ত্রয়ী।কনা চৌধুরী কৌতুহল নিয়ে তাকে প্রশ্ন করে,

-কে তুমি মেয়ে?

-সেটা আপনার ছেলেকে প্রশ্ন করুন যে আমাকে অপহরণ করে এখনে এনেছে।

ত্রয়ীর শক্তপোক্ত জবাবে ভদ্রমহিলা লজ্জাবোধ করেন।লজ্জায় মস্তক হেট হয়ে আসে তার।রাগ নিয়ে আরসালানের পানে চান তিনি।আরসালান মায়ের রাগকে তেমন পাত্তা না দিয়ে বলে উঠে,

-আপনি উপরে যান।এখানে…

কথা শেষ হতে না ধরেই আরসালানের গালে কনা চৌধুরীর থাপ্পড় পরে।আচমকা এমন হওয়ায় চমকিত হয়ে মায়ের পানে তাকায় আরসালান।গালে একহাত আপনা আপনি উঠে এসেছে তার।ত্রয়ী শূন্য চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে।হাতে শক্ত করে ছুড়ি ধরে রেখেছে সে।

-এই থাপ্পড় তোমার গালে আরো আগে দেওয়া উচিত ছিল আমার।ছিহঃ!আমার ভাবতেই লজ্জা লাগে যে তোমার মত ছেলেকে জন্ম দিয়েছি আমি।

-ওটা জানোয়ার হবে।

ত্রয়ীর কথা কনা চৌধুরীর রাগে আরো ঘি ঢেলে দেয়।ত্রয়ী ঘুরে যেই চলে যেতে নিবে ওমনি আরসালান দ্রুত গতিতে এসে ত্রয়ীর খোলা কেশের একাংশ মুঠোয় নিয়ে নেয়।আকস্মিক আক্রমণে সুক্ষ্ম আর্তনাদ করে উঠে ত্রয়ী।ঘাড় ঘুড়িয়ে ঘৃনিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরসালানের পানে।তা দেখে বাঁকা হেসে উঠে আরসালান।
কনা চৌধুরী অবাক হয়ে তাকায় ছেলের কান্ডে।একজন মহিলা তার দিকে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
কনা চৌধুরী তখনই খুব শান্ত একটা হুমকি ছুঁড়েন আরসালানের উদ্দেশ্যে,

-যদি তুমি মেয়েটিকে এক্ষুনি যেতে না দাও আরশ।আমি আত্মহত্যা করব।এটা আমার প্রতিজ্ঞা!এবার তুমি চিন্তা কর কোনটা বড়।তোমার লালসা নাকি তোমার মা!

আরসালান মায়ের দিকে তাকায় গাঢ় চোখে।কনা চৌধুরীর মুখশ্রী বেশ শক্তপোক্ত।হঠাৎ উনি সত্যিই এমন কিছু করবেন।নিজের মাকে বেশ ভালো করেই জানে আরসালান।উনার কথার নড়চড় হবে না।ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,

-আজ তুই বেঁচে গেলি কিন্তু পরবর্তীতে…

-পরবতীতে কি হবে সেটা কালকে দেখা যাবে।

কথাটুকু শেষ করে ত্রয়ী আরসালানের হাতের মুঠোয় থাকা চুলগুলোর দিকে তাকায়।চুলের প্রায় বেশিরভাগ অংশই আরসালানের হাতের মুঠোয়।ত্রয়ী বেশ সন্তর্পণে ছুড়ি চালায় আরসালানের ধরে থাকা হাতের অগ্রাংশের কেশে।নিঠুর মানবী শখের চুল কেটে ফেলে এক লহমায়।
তারপর আরসালানের চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,

-ঘৃনার পরিমাণ এতটাই বেশি আরসালান চৌধুরী যে আপনার ছোঁয়া চুলও আমি বহন করব না।

ত্রয়ী ঘুরে চুলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।আরসালান হাতের মুঠোয় বিছিন্ন কেশ নিয়ে তেজস্বিনী এক অপরুপার চলন দেখে।ত্রয়ীর প্রতিটি পদক্ষেপে যেন ক্রোধাগ্নি ঝড়ে পড়ছে।কণা চৌধুরী হঠাৎ ত্রয়ীর পেছনে ছুট লাগান।ততক্ষণে ত্রয়ী মহলের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে।কনা চৌধুরী ডেকে উঠলে ত্রয়ী থেমে দাড়ায় তনে পেছনে তাকায় না।কনা চৌধুরী তার নিকটে এসে অপরাধী কন্ঠে বলে উঠে,

-আমাকে ক্ষমা করে দিত তুমি।আমার গর্ভের সন্তান এমন কুকর্ম করে বেড়াচ্ছে অথচ আমি কিচ্ছু করতে পারছি না।মা তো!কোন কিছু করব ভাবলেই সদ্য জন্মানো সেই নিষ্পাপ আরশের চেহারা মনে ভেসে উঠে।

-মানুষ জন্মের সময় ফুলের মতো নিষ্পাপ হৃদয় নিয়ে জন্মায়।তারপর ধীরে ধীরে তাতে পচন ধরে!

ত্রয়ী এবার একটু ঘুরে কনা চৌধুরীর দিকে তাকায়।কনা চৌধুরী আবছা আলোয় ত্রয়ীর সেই তেজস্বী মুখশ্রী দেখতে না পেলেও সে যে ঘুরে তার দিকেই তাকিয়েছে তা বুঝতে পারে।
ত্রয়ী কণা চৌধুরীকে একবার আপাদ মস্তক দেখে বলে,

-আপনাকে দেখে আমার শিক্ষিত,সচেতন বলেই মনে হচ্ছে।কিন্তু আপনার সন্তান পশুতে পরিণত হয়েছে এটা একজন মা হিসেবে আপনার ব্যর্থতা না দুর্ভাগ্য তা জানি না।একজন মা না হয়ে একজন মানুষ হয়ে চিন্তা করবেন আপনার ছেলের ঠিক কি শাস্তি হওয়া উচিত।একজন মেয়ের নিষ্পাপ জীবন চলে গেছে আপনার ছেলের লালসার শিকার হয়ে।অপমানে আত্ন হত্যা করেছে মেয়েটি।আমার কথা তো বাদই দিলাম!

কথাটুকু বলে আর এক মুহুর্ত দাড়ায় না ত্রয়ী।আর না দেখে ভদ্রমহিলার মনে কিরূপ পরিবর্তন এলো।দ্রুত ত্যাগ করে এই মহল,তার আঙিনা।এ যেন জাহান্নামের ন্যায়!পাপীর ছোঁয়ায় সিক্ত!
.
দশটা বেজে এগারেটা বাজার পথে।এখনো বাড়িতে পৌছাইনি ত্রয়ী।সকলে চিন্তিত মুখে ড্রয়িং রুমে বসে আছে।একটু পর পর কেঁদে উঠছে তন্দ্রা।মিসেস সুহৃদ সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন ছেলের নামে এমন অপসংবাদ শুনে।ওনাকে নিকের রুমে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে।তারমাঝে আবার ত্রয়ী এখনো বাড়ি ফিরছে না।কোথায় গেছে তাও স্পষ্ট নয়।মিনি তন্দ্রার ম্পিঠে মৃদু হাত বুলাচ্ছে।পাশেই বেলা বসে আছে রাগান্বিত মুখ নিয়ে।সুপ্তের বাবা আর বর্ণ একটু আগে থানায় গিয়েছে।
কলিং বেলের আওয়াজে সকলে সদর দরজার দিকে তাকায় সকলে।মিনি তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয় এই আশায় যে ত্রয়ী এলো বুঝি।দরজা খুলে কমলা রঙে আবৃত রমনীকে দেখে শান্তি পায় সে।কিন্তু ত্রয়ী থমথমে মুখশ্রী দেখে কিছু না বলেই তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয় মিনি।সে ভেতরে ঢুকতেই বেলা তার উপর হামলে পরে যেন তারই অপেক্ষায় ছিল সে।

-এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

ত্রয়ী কিছু না বলে সিঁড়ির দিকে এগোয়।শাড়ির আচল অবহেলায় মেঝেতে লুটেছে।বিধ্বস্ত চেহারা,শক্ত মুখশ্রী।ত্রয়ীর পাত্তা না দেওয়াকে গায়ে মাখে বেলা।ফের বলে উঠে,

-কালা হয়ে গিয়েছো?শুনতে পারছো না কি বলছি?কোথায় গিয়েছিলে?এখানে এতজন তোমার জন্য চিন্তা করে বসে আছে আর তুমি কিরকম আচরণ করছো!নাকি সুপ্ত ভাই জেলে যেতেই তোমার আসল চেহারা বেরিয়ে পরেছে?

ত্রয়ী সিঁড়িতে পা রাখতেই ত্রয়ীর হাত ধরে ফেলা বেলা।

-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যেতে পারবে না তুমি।

ত্রয়ী একটা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে।তারপর পেছনে ঘুরে আচমকা চড় বসায় বেলার গালে!

চলবে…

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২৪.
স্তব্ধ পুরো ড্রয়িংরুম।উপস্থিত সকলে নিস্তব্ধ হয়ে ত্রয়ী আর বেলার দিকে তাকিয়ে আছে।কি হয়েছে বোধগম্য হতেই বেলার হাত আপনা আপনি তার কপোল স্পর্শ করে।অবাক লোচনে তাকায় সামনে থাকা ত্রয়ীর দিকে।রাগের দরুন সবেগে উঠানামা করছে ত্রয়ীর বক্ষাংশ।চোখে মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ।মেঝে ছুঁই ছুঁই শাড়ির আঁচল কাঠে তুলে নেয় ত্রয়ী।তারপর বেলার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে,

-নিজের সীমার মধ্যে থেকো।আমাকে যা ইচ্ছে তা বলার রাইট আমি কাউকে দেইনি।

বেলার হাত এখনো গালেই রয়েছে।সে বিস্ময় মিশ্রিত কন্ঠে ত্রয়ীকে প্রশ্ন করে,

-তুমি আমাকে থাপ্পড় মারলে?

-আরো আগেই মারার উচিত ছিল আমার।আমি সত্যিই তোমাকে থাপ্পড় মেরেছি।বেশ শব্দ হয়েছে!আর এখানে উপস্থিত সবাই দেখেছে।

বেলার বিস্ময় এবার তার রাগে পরিনত হয়।একপ্রকার চেঁচিয়েই ব’লে উঠে,

-কোথায় গিয়েছো জিজ্ঞেস করতেই তোমার গায়ে লেগে গেছে।আমার গায়ে হাত তুললে তুমি!

-আওয়াজ নিচে বেলা।তুমি আমার চরিত্রে আঙুল তুলেছো!আমি থানাতেই গিয়েছিলাম।সুপ্তের কাছে!উনার প্রতি না তোমার এত প্রীতি!তাহলে এখন একটা মিথ্যা অপবাদ রটার পরই তুমি তাকে সুপ্ত ভাই বলে সম্মোধন করতে শুরু করে দিয়েছো।যেখানে এতদিন তোমার মুখে সুপ্তের পরে ভাই শব্দটার কোন অস্তিত্বই ছিল না।

বেলা কি বলবে খুঁজে পায় না।ত্রয়ীর তর্ক আর রাগান্বিত কন্ঠের কাছে সে হেরে যায়।চেঁচামেচি শুনে নিচে নামেন মিনির মা।তাকে দেখতেই বেলা হইহই করে উঠে,

-দেখো ছোট মামী তোমাদের বাড়ির বউ আমাকে থাপ্পড় মেরেছে।আমি কি এমন বলেছি তাকে।শুধু এতটুকুই জিজ্ঞেস করেছি যে কোথায় গিয়েছিলে? আসতে কেন দেরি হলো?

বেলার নেকা নেকা কথার প্রতিত্তোরে ত্রয়ী বলে,

-আমি কোথায় গিয়েছি এটা তোমাকে বলতে বাধ্য নই।তুমি এবাড়ির কেউ নও।এ বাড়ির কেউ জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই বলব।

তন্দ্রা বেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

-তুমি নিজের দোষটা কেন স্বীকার করছো না?তুমি ভাবীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলোনি।থাপ্পড় মেরেছে বেশ করেছে!

ত্রয়ী আর কিছু বলে না।সকলের দিকে একবার তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পরে।দোতলায় নিজের ঘরে এসে দরজা লক করেই সুপ্তের ল্যাপটপ বের করে।সুপ্তের কথামত পাসওয়ার্ড লিখতেই লক খুলে যায়।কিছুক্ষণ টেপাটিপির পরই কাঙ্ক্ষিত ভিডিও সামনে আসে তার।কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ভিডিও চালু করে সে।পুরোটা ভিডিও দেখার পর ত্রয়ীর ওষ্ঠে অনন্য হাসি ফুটে উঠে।তার এই মুহুর্তে মন হচ্ছে তার থেকে ভাগ্যবতী স্ত্রী এ জগতে মনে হয় দ্বিতীয়টি নেই!

ভিডিওটা নেটে আপলোড করে ল্যাপটপ অফ করে রেখে দেয় ত্রয়ী।বিছানা থেকে উঠে আরশির সামনে এসে দাঁড়ায় সে।একদৃষ্টে তাকায় নিজের দিকে।খুঁটিয়ে দেখে নিজেকে।তারপর তাকায় অবিন্যস্ত হয়ে থাকা চুলের দিকে।কোমড় অবধি লম্বা চুল এখন কেবল পিঠের মাঝামাঝি হয়ে গেছে।সমান করে কাটতে গেলে আরো ছোট হয়ে আসবে!

ত্রয়ী চোখ বুঁজে নেয়।অশ্রু গড়ায় কাজল ঘেরা আঁখি থেকে।ধপ করে বসে পরে মেঝেতে সে।তারপর তার ক্রন্দনে মুখরিত হয় কক্ষটি।মেঝেতে একের পর এক অশ্রু দানারা পতিত হয়ে ভিজিয়ে তুলে।অনেল বর্ষ পর এমনভাবে কাঁদছে ত্রয়ী।অথচ আজ তার পাশে এমন কেউ নেই যে তাকে আলিঙ্গন করে তার মনের সমস্ত কষ্ট শুষে নিবে!

ত্রয়ী চলে যাওয়ার পরেই রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে আসে আরসালান।এই মুহুর্তে মায়ের উপর বিরক্ত হয়ে আছে সে।আরসালান পরনের সাদা পাঞ্জাবি খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারে।তারপর একটা নাম্বারে ডায়াল করে সে।তিনবার রিং হওয়ার মাথায় ওপর পাশের ব্যাক্তি ফেন রিসিভ করে।ফোন রিসিভ করতেই আরসালানের কানে ভেসে আসে উচ্চস্বরে গান বাজনার আওয়াজ।সে বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,

-নিঝুম?

ক্লাবে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নাচে ব্যস্ত নিঝুমের কান অবধি সেই আওয়াজ পৌঁছায় না।ফোন কানে ধরে ভ্রু কুঁচকে সে আরসালানের কথা শোনার চেষ্টা করছে।কিন্তু তীব্র গানের কারনে কোন কিছু শুনতে পারছে না সে।
আরসালান বাঁকা হেসে বলে উঠে,

-কাজ বেশ ঠিক মতো করেছিস তুই।কালকে এসে তোর পাওনা নিয়ে যাবি।

কথাটুকু বলেই আরসালান ফোন কেটে দেয়।তার ওষ্ঠকোনে লেপ্টে থাকা বাঁকা হাসিটা চওড়া হতে হতে পৈশাচিক অট্টহাসিতে পরিনত হয়।মনের আশ মিটিয়ে হেসে নিয়ে সে বলে উঠে,

-সুপ্ত রেহনেওয়াজ!কারাগারের ওপারে বসে নিশ্চয়ই ভাবছিস কেন আরসালান চৌধুরীর পিছনে লাগতে গেলাম।মান সম্মান সব গেল আমার!

হঠাৎ শক্ত হয়ে আসে আরসালানের জবান।সে বলে উঠে,

-আজ তোর মান সম্মান গেছে,কাল তোর বউও আমার হবে।আজ শা*লী বাগে আসেনি তো কি হয়েছে?কে বলতে পারে কাল কি হয়!

আসলেই কাল কি হবে তা আমরা কেউ বলতে পারি না।ঠিক তেমনিই পৈশাচিক আনন্দে মেতে থাকা আরসালানের বোধগম্য হলো না কাল কি হতে চলেছে!নিজেকে সর্ব বুদ্ধিমান বলে উল্লাস করতে লাগল সে।বুঝলো না কালকের সূর্যোদয় তার জন্য সংকট নিয়ে আসতে চলছে।
.
সকাল বেলা থানার সামনে চেচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙে আসে সুপ্তের।সারা রাত নিদ্রাহীন থেকে ভোর বেলা একটু চোখটা লেগে এসেছিল তার।বসা থেকে উঠে কারাগারের কপাট ধরে দাঁড়ায় সে।বাইরে দৃষ্টি রেখে বোঝার চেষ্টা করে কি হচ্ছে!
এরই মাঝে বিরক্তমুখে ইনস্পেকটর কে থানায় ঢুকতে দেখা যায়।সে এসে কারাগারের দরজা খুলে দিতেই সুপ্ত অবুঝের ন্যায় সুধায়,

-দরজা খুলে দিলেন যে ইন্সপেক্টর?

ইনস্পেকটর তার দিকে তাকায় শান্তভাবে।তারপর বলে,

-উপর থেকে অর্ডার এসেছে উকিল সাহেব।আপনি তো নির্দোষ!ভিডিও টাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।এটা নিয়েই বিক্ষোভ করছে জনগন।উপরমহল চাপ সইতে না পেরে অর্ডার দিয়েছে!

টিভির দিকে তাকিয়ে সুপ্তকে ইশারা করে সেদিকে তাকাতে বলে ইন্সপেক্টর।
সুপ্তের ঠোঁটের কোনায় মুদু অদৃশ্য হাসি লেপ্টে।টিভিতে তাকাতেই
গোপন ক্যামেরায় ধরা পরা সেই দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়।সুপ্ত সেদিকে তাকায় গর্বের সহিত।
ক্যামেরায় বন্দি হওয়া দৃশ্যটি এরকম,

নিঝুম নিজে নিজে তার জামা কাপড় ছিড়ছে আর ক্রন্দনের স্বরে সুপ্তের থেকে বাঁচার আকুতি করছে।তার থেকে কিছুটা দুরে সুপ্ত দাড়িয়ে আছে।সুপ্তের কন্ঠের বিস্ময়সূচক প্রশ্ন ভেসে আসছে,

-এটা আপনি কি করছেন মিস নিঝুম?

পুরোটা না দেখেই সুপ্ত ইন্সপেক্টরের দিকে তাকায়।তারপর অতিশান্ত স্বরে বলে,

-বাড়িতে ফোন করা যাবে?

বেলকনিতে বসে একদৃষ্টে কোথায় তাকিয়ে আছে ত্রয়ী।পরনে হালকা গোলাপি রঙের জর্জেটের শাড়ি।মাথার চুল ছেড়ে দেওয়া।যা আজ কেবল পিঠ অবধি।ত্রয়ীর মুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই।একদম থমথমে মুখশ্রীতে কোথায় তাকিয়ে আছে সে।কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলার আওয়াজে আড়চোখে তাকায় ত্রয়ী।কয়েক সেকেন্ড যেতেই পুরুষালী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তার দেহ।চোখ বুঁজে নেয় ত্রয়ী।মুদুস্বরে বলে উঠে,

-ওয়েলকাম ব্যাক মিস্টার সুপ্ত।

সুপ্ত হঠাৎ খেয়াল করে ত্রয়ীর মাথার চুল কেবল মাত্র পিঠ অবধি।ত্রয়ী নিজেকে সুপ্তের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রুমে আসে।পেছন পেছন আসে সুপ্ত।ভ্রু কুঁচকে তাকায় ত্রয়ীর পানে।ত্রয়ী কাবার্ড থেকে টিশার্ট বের করতে করতে বলে,

-আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।আমি খাবার নিয়ে আসছি।

-তোমার চুল?

-কেটে ফেলেছি।

-কেন?

-অপবিত্র কারোর স্পর্শ রাখতে নেই!

চলবে..