#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২৭.
-আপনি এখন পুরোপুরি সুস্থ তো রিক্ত ভা..ই?
রিক্ত মিসেস সুহৃদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সদর দরজার দিকে এগোতেই পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠের প্রশ্নে থমকে দাঁড়ায়।তাকে দাঁড়াতে দেখেই মনে মনে জিহ্বায় কামড় দেয় তন্দ্রা।রিক্তের সাথে কথা বলার ছুতোয় সে এই প্রশ্ন করেছে।কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল রিক্ত কেমন হেসে হেসে আড্ডা দিলো,গল্প করলো। যে কেউ বুঝে যাবে সে সুস্থ হয়ে গেছে।সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা একটু বোকা বোকা হয়ে গেল না।
রিক্ত তন্দ্রার দিকে গাঢ় চোখে তাকায়।সুপ্ত আর তন্দ্রা আপন ভাইবোন হলেও তাদের মধ্যে অনেক তফাৎ।সুপ্ত বিচক্ষণ আর তন্দ্রা একটু বোকা,ভীতু টাইপ।রিক্ত সময় নিয়ে উত্তর দেয়,
-হুম ভালো।তোর কি অবস্থা?পড়াশোনা কেমন চলছে?
তন্দ্রার অধরে সুক্ষ হাসি ফুটে উঠে।সে প্রশ্নের জবাব দেয় রয়েসয়ে।তারপরই রিক্তের কন্ঠে উচ্চারিত আসি শব্দখানা কর্ণগোচর হয় তার।রিক্ত ধীরে ধীরে সদর দরজা পেরিয়ে যায়।তন্দ্রা চেয়ে থাকে।আজকাল রিক্ত কেমন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে নাহ?আগে তো কত কথা বলতো!তন্দ্রার মনের এককোণে অভিমানের মেঘ জমে।সে ঠোঁট ফুলিয়ে সিঁড়ির দিকে দ্রুত পা চালায়।তারপর সিঁড়ির বড় বড় ধাপ বেরিয়ে দোতলায় নিজের রুমে যায়।ড্রয়িং রুমে আসতে আসতে সবটায় লক্ষ্য করে সুপ্ত।হাতের বৃদ্ধা ও তর্জনী আঙ্গুলের মাঝে মোবাইল ফোন দোলাচ্ছে সে।আরেকহাত প্যান্টের পকেটে পুরে রাখা।এতক্ষণ বাগানেই ছিল সে।ঠোঁট কামড়ে কিছু ভেবে ভ্রু কুঁচকায় সুপ্ত।তারপর নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
রুমে এসে প্রথমেই তার চোখ ত্রয়ীকে খুঁজে।স্নিগ্ধ রমনীকে দেখে চোখ জুড়াতে চায় প্রতিবার।কিন্তু রুমের কোথাও ত্রয়ীকে দেখতে না পেয়ে কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পরে সুপ্তের।রান্নাঘরে তো নেই!রুমেও নেই!তাহলে কোথায় গেল?
সুপ্ত ফোন ঘেটে ত্রয়ীর নাম্বারে ডায়াল করে।স্কিনে জ্বলজ্বল করে ফেলে উঠে ‘প্রলয়ংকারী’ নামটা।মুহুর্তেই ঘরেই ফোন বেজে উঠে ত্রয়ীর।দেখতে পায় বিছানার এক কোনায় ত্রয়ীর ফোন জ্বল জ্বল করছে।সুপ্ত ফোন কেটে দেয়।কিছু একটা ভেবে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে।পা বাড়ায় ছাদের দিকে।
আকাশে আজ পূর্ণচন্দ্র!চাঁদ মামা তার সম্পূর্ণ রুপ নিয়ে আকাশে গোল রুপোর থালার মত অবস্থান করছে।সুপ্ত ছাদে পা রেখেই দ্রুত আশেপাশে তাকায়।অদূরেই ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে থাকা এক মানবীর অবয়ব দেখে তার অশান্ত হৃদয়ে প্রশান্তি ছড়ায়।ইস!কিছু সময়েই কেমন অশান্ত,চিন্তায় ভরে গিয়েছিল মন।
সুপ্ত ধীরে ধীরে পা বাড়া সেদিকে।রমনী একমনে চাঁদের দিকে তাকিয়ে। দিন-দুনিয়ার ধ্যান ধারনা নেই।সুপ্ত কোন প্রকার শব্দ না করেই পেছনে এসে দাড়ায়।তারপর কন্ঠে কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলে উঠে,
-আক্কেল-জ্ঞান নেই তোমার?এভাবে না জানিয়ে ছাদে এসেছো কেন?ওদিকে তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে গেল মানুষ!
আচমকা পুরুষালী ধমকের স্বরে চমকে উঠে ত্রয়ী।এতক্ষণ কপোল স্পর্শ করে রাখা হাতখানা নামিয়ে পেছনে ফিরে তাকায় অবাক চোখে।কাচের চুড়ির শব্দ ভেসে আসে তাতে।সুপ্ত তখন গম্ভীর চোখে পকেটে দুহাত পুরে তার দিকে তাকিয়ে।লম্বা চওড়া মানুষটার মুখের দিকে তাকাতে ত্রয়ীকে সামান্য উঁচু করে তাকাতে হয়।ত্রয়ী চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে,
-আমাকে খুঁজছে?আমি তো মাকে বলেই এসেছি একটু ছাদে যাচ্ছি!কই দেখি সরে দাড়ান তো আমি নিচে যাই।
ত্রয়ী সুপ্তকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই সুপ্ত ত্রয়ীর হাত ধরে ফেলে।তারপর একটানে তাকে নিজের সামনে এনে ফেলে।ত্রয়ীর চোখে মুখে বিস্ময়!সুপ্তের চোখের গম্ভীর দৃষ্টি পাল্টে যায় মুহুর্তেই।
ত্রয়ী এখন তার সামনে বাহুডোরে বন্দি।চাঁদের অকৃত্রিম জোসনা এসে পরছে দুজনের মুখ জুড়ে।ত্রয়ী সুপ্তের দিকে তাকিয়েছে অবাক হয়ে।তার দু অধরের মাঝ খানে কিছুটা ব্যবধান।ত্রয়ী সময় নিয়ে বলে,
-নিচে যাই।চিন্তা করবে?
সুপ্ত কিছু বলে না।চুপচাপ চোখের দৃষ্টির বিচরণ ঘটায় ত্রয়ীর মুখশ্রী জুড়ে।ত্রয়ী ভ্রু বাঁকিয়ে সুপ্তের এরুপ দৃষ্টি অবলোকন করে।পরপরই দৃষ্টি সরায় অন্যদিকে।পুরুষের এমন দৃষ্টির সামনে চোখ তুলে রাখতে পারে এমন সাহস কোন রমনীর?
ত্রয়ী অন্যদিকে তাকিয়ে পলক ঝাপটায় বার কয়েক।সুপ্ত তাকে আরো কাছে টেনে নেয়।কোমড়ের কাছে তার মৃদু স্পর্শ।ত্রয়ীর কানের কাছে তার মুখ নিয়ে ফিসফিসয়ে বলে উঠে,
-প্রলয়ংকারী!
সহসা চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় ত্রয়ী।কানের কাছে সুপ্তের বলা কথা দামামার মতো বাজে।কেমন গায়ে কাটা দিয়ে উঠে কথা খান।ত্রয়ীর মনে হলো যদি সুপ্ত ফিসফিসয়ে এ শব্দ না বলে উচ্চস্বরে মাইক মেরে বলতে তবুও বোধহয় এমন শিহরণ হতো না।
ত্রয়ীর প্রতিক্রিয়া দেখে সুপ্ত আলগোছে হাসে।তারপর ধীরে ধীরে ত্রয়ীকে বন্ধন থেকে মুক্ত করে।সময় নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায় দুজনে।
সুপ্তের দৃষ্টি সামনে কোথায়।ত্রয়ী আড়চোখে তার দিকে তাকাতে তাকাতে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।চাঁদের আলোয় লোকটাকে দেংতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।পরনের আকাশি শার্ট সাদা মনে হচ্ছে।ত্রয়ী তাকিয়েই রয়,একদৃষ্টে।
সময় যেতেই ত্রয়ী কৌতুহল পূর্ণ কন্ঠে সুধায়,
-আমাকে প্রলয়ংকারী বলে সম্মোধন করলেন কেন?
ত্রয়ীর প্রশ্নে সুপ্ত অন্যদিকে তাকিয়ে হাসে।তারপর তাকায় তার অর্ধাঙ্গিনীর পাপড়ি ঘেরা কৌতুহল পূর্ণ আঁখিতে সুপ্ত চোখ ডুবায়।হঠাৎ ত্রয়ীর খোঁপা করে রাখা চুল খানা খুলে দেয় সুপ্ত।মৃদু বাতাসে দুলে উঠে খোলা চুল।পরপর পুরু ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে সুপ্ত বলে উঠে,
-গ্রীষ্মের একদুপুরে জ্যামে আটকে যখন আমি প্রায় বিরক্ত।একটু খোলা বাতাসের আশায় গাড়ির জানালা নামিয়ে দিয়েছিলাম তখন নুপুরের আওয়াজে পাশ ফিরে তাকাই।একটা সাদা ওড়না এসে বারি খায় আমার মুখে।বিরক্ত আমি আরো বিরক্ত হয়ে উঠি।তবে মেয়েটির সেদিকে হুশ নেই!সে নিজ মনে কোলে একটা বাচ্চা আর হাতের মুঠোয় একজন বালিকাকে নিয়ে খুব সন্তর্পণে রাস্তা পার হচ্ছে। সাদা জামা আর খয়েরী ওড়না পরিহিতা সে রমনীকে দেখে মনে হলো ভরা গ্রীষ্মে একরাশ স্নিগ্ধতা।মুগ্ধ হয়ে তাকে ক্যাপচারড করে নিলাম।ধীরে ধীরে সে পা বাড়ালো আমার ব্যাচেলার লাইফে।সে এসেছিল প্রলয়ার মত আমার অনুর্বর হৃদয়ে প্রেমের বীজ বপন করতে।
সুপ্তের সমস্ত কথা ত্রয়ী মন দিয়ে শুনে।তার এই মুহুর্তে মনে হয় এ যেন এক স্বপ্ন!এত ভালো ভাগ্য তার?ত্রয়ী পরপরই নিজের বোকা ভাবনায় হাসে।দৃষ্টি দেয় সুপ্তের পানে জবাবে দৃষ্টি সামনে।
এইযে তারা এখন একে অপরকে ভালোবাসি না বলেই অনুভব করছে তাদের মাঝে ভালোবাসার কোন কমতি নেই।দুজনের হৃদয় দুজনের জন্য ব্যাকুল!
ত্রয়ী আলগোছে সুপ্তের হাতের মধ্যে নিজের হাত গলিয়ে দেয়।মাথা রাখে সুপ্তের কাঁধে।মনে মনে বলে,
-আপনার হৃদয়ে আমার জন্য যে প্রেমের বীজ বুনন হয়েছে তার অনন্তকাল থাকুক।অঙ্কুরিত হোক এমন মনোমুগ্ধকর মুহুর্ত হয়ে।
মূল্য দিয়ে যদি মুহুর্ত কেনা যেত! তবে মানুষ সবথেকে বেশি এটাই ক্রয় করতো।
এইযে যেমন আজকের পূর্ণ চন্দ্রের রাতে সুপ্তের পাশে বসে চন্দ্রবিলাস করছে।এমন সুখময়,প্রেমময় মুহুর্ত কি সম্ভব হলে হাতছাড়া করতো ত্রয়ী?কস্মিনকালেও না!
রুপোর থালার মতো চাঁদের দিকে তাকিয়ে ত্রয়ী আলগোছে সুপ্তের কাঠে মাথা রাখে।সুপ্ত আড়চোখে তাকিয়ে স্মিত হেসে ত্রয়ীর হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নেয়।ত্রয়ী চোখ বুঁজে নেয়।মনে মনে প্রার্থনা করে এমন মুহুর্ত জীবনে বার বার আসুক।মানুষটা তার পাশে অবলম্বন হয়ে সবসময় থাকুক,সবসময়!
চলবে…
#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২৮.
বিশাল জানালার ধারে পাতানো খাটে শুয়ে আছে তন্দ্রা।জানালাটা খুলে রাখায় বাইরের চাঁদের আলো এসে অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষটাকে আবছা আলোয় ভরে তুলেছে।বিছানায় নিদ্রাহীন এপাশ ওপাশ করছে তন্দ্রা।নামের মতই তার জীবনে ঘুৃম খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।তবে কি এক কারণে আজ নেত্রজোড়ায় ঘুমের ছিটেফোঁটা নেই!
এপাশ ওপাশ করতে করতে এবার বুঁজে রাখা চোখ খুলে ফেলে তন্দ্রা।বালিশের পাশ হাতড়ে মোবাইল নিয়ে ফেসবুক স্কল করতে শুরু করে।একপর্যায়ে মেসেঞ্জারে ঢুকে প্রিয় আইডিটার পাশে সবুজ বর্ণের বাতি দেখে কপাল কুঁচকায় সে।ঠোঁট কামড়ে কনভারসেশনে প্রবেশ করে সে।কিছু প্রয়োজনীয় কথাবার্তা রয়েছে তাও অনেক আগের!সবগুলোতেই সুপ্তের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার তাড়না!তন্দ্রা মেসেজগুলো পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তারপর সময় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে গোটা গোটা অক্ষরে কিছু শব্দ টাইপ করে।রাত দুইটা বাজে এখন!
চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে তন্দ্রা মেসেজ খানা সেন্ট করে।ভেসে উঠে একটা সাধারণ বাক্য,
-ঘুমাও নি?এত রাতে কি করছো?
মেসেজ সেন্ট করে তন্দ্রা ডাটা অন রেখেই ফোন অফ করে রাখে।সে জানে এত রাতে উত্তর আসা তো দূর মেসেজ সিনও হবে না।কিছুসময় নিয়ে চোখ বুঁজতেই মেসেজের টুংটাং আওয়াজে একপ্রকার চমকে উঠে সে।বিছানার পাশে অবহেলায় পরে থাকা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে সে।কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ ওপেন করতেই দেখে ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসে।
-নাহ!গুগুল ঘাটছি!
-ওহ!
-হুম।
ব্যাস এতটুকুই!কথাবার্তা বাড়ানোর যেন কোন প্রবণতায় নেই লোকটার মাঝে।তন্দ্রা মনে মনে অভিমান করে।সে তাকে জিজ্ঞেস করেছে লোকটারও নিশ্চয়ই তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করার উচিত ছিল।তারপর তারও ভ্রু কুঁচকে আসার কথা তন্দ্রাকে এত রাতে অনলাইনে দেখে।
তন্দ্রার মুখখানা পাংশুটে হয়ে আসে।একটু আগে চোখে মুখে উজ্জল্য ছড়ানো নূর হারিয়েছে চিরতরে।বিছানায় মোবাইল অনাদরে রেখে হাঁটুমুড়ে বসে সে।দুই হাঁটুতে মাথা রেখে বাইরের চাঁদের দিকে তাকায়।বাইরের কোমল আলো তন্দ্রার চোখেমুখে পরছে।তন্দ্রা বড় আবেশে পুরো গায়ে জোছনা মেখে নিচ্ছে।
ফের মেসেজোর টোনে মাথা তুলে হাতড়ে মোবাইল হাতে নেয় তন্দ্রা।এলোচুল কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে ভাসতে থাকা কিছু শব্দ পড়ে কৌতুহল নিয়ে।
-তুই এখনো জেগে কেন?ঘুমা!রাত জাগা ভালো নয়।
দ্রুত মেসেজ টাইপ করে তন্দ্রা।যেন একটু দেরি হলেই আর রিক্তের সাথে তার আর কথা হবে না।
-তবে তুমি কেন এত রাত জেগে আছো শুনি?তুমিও ঘুমোও।
মেসেজ ডেলিভারি হওয়ার পাচ মিনিট পর মেসেজ আসে।
-কাল ইন্টারভিউ আসে সেটারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
-ওহ।
-হুম
এরপর আর কোন কথা হয় না দুজনের।রিক্ত অফলাইন হয়ে যায়।মোবাইলটা মাথার কাছে নিয়ে অজানা অপেক্ষারত তন্দ্রার চোখে কখন যেন তন্দ্রা ভর করে।গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে পরে সে।বাইরের চাঁদের আলো তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।
.
প্রকৃতিতে সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে।অন্ধকার হারিয়ে একটু একটু করে আলোকিত হচ্ছে সব।ঘুমে আচ্ছন্ন ত্রয়ী নড়াচড়া করার বৃথা চেষ্টা করছে কারো বাহুডোরে।সাধারনত এই সময়টাতেই তার ঘুম ভাঙে।তবে আজ ঘুমের পরিমাণ বেশি হওয়ায় চোখ মেলে তাকাতে পারছে না।নড়াচড়া করতে করতে একপর্যায়ে ক্ষান্ত হয় ত্রয়ী।তা অনুভব করে জেগে থাকা সুপ্ত মৃদু হেসে উঠে।ধীরে ধীরে ওষ্ঠদ্বয় ত্রয়ীর ললাটের নিকট এসে প্রেমময় স্পর্শ এঁকে দেয়।ঘুমের মাঝেই ভ্রু কুঁচকায় ত্রয়ী।তা দেখে নিঃশব্দে হেসে উঠে সুপ্ত।শুভ্র দাঁত উঁকি দেয় সেই ফাঁকে।হাতের জোর বাড়িয়ে ত্রয়ীর বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় আরো।কিছু সময় পরপর পিট পিট করে চোখ খুলে তাকায় ত্রয়ী।ফের বন্ধ করে নিয়ে আধো আধো চোখে তাকায়।সুপ্তের ফর্সা,চাপদাড়ি ওয়ালা সুদর্শন সদ্য ঘুম থেকে উঠা মুখশ্রী দৃশ্যমান হয় সর্বপ্রথমেই।একদন্ড তাকিয়ে বুকের মাঝে আবার গুটিসুটি মেরে ঘুমানোর চেষ্টা করে ত্রয়ী।পরক্ষণেই কানে ভেসে আসে সুপ্তের গাঢ় কন্ঠ,
-ঘুম ভাঙে না বউ?
‘বউ’ শব্দখানা সুপ্তের কন্ঠে শুনলে ত্রয়ীর অন্তস্থল জুড়িয়ে আসে।আরো আবেশে চোখ বুঁজে পরে রয় ত্রয়ী।তবে পেটে সুপ্তের হাতের এলোমেলো স্পর্শ অনুভব করতেই চট করে উঠে বসে সে।বড় বড় চোখে তাকিয়ে চোখ থেকে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করে।সুপ্তের ওষ্ঠকোণে ততক্ষণে দুষ্টু হাসির বিচরণ।ত্রয়ী কৃত্রিম চোখ রাঙিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে।তারপর থ্রি-পিচ নিয়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়।
খয়েরী রঙের থ্রিপিচ গায়ে জড়িয়ে ত্রয়ী বেরিয়ে আসতেই সুপ্ত ওয়াশরুম দখল করে নেয়।মাথার চুল আঁচড়ে তাতে আবার তোয়ালে পেঁচিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পরে ত্রয়ী।কিন্তু কিছুসময় যাওয়ার পর সে কিছু একটা মনে করে ঘর থেকে বেরিয়ে পরে।যাওয়ার আগে বিছানার এককোণে থাকা সাদা ওড়না গায়ে জড়িয়ে নেয় ভালোভাবে।
ত্রয়ী ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই নিস্তব্ধ ড্রয়িংরুম জুড়ে তার পায়ের নুপুরের আওয়াজ ভেসে উঠে।ত্রয়ী বড় বড় পা ফেলে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে বাগানের দিকে চোখ দেয়।সাথো সাথে মিস্টার সুহৃদ অর্থাৎ ত্রয়ীর শশুরের সাথে সাক্ষাৎ হয় তার।তিনি হয়ত বাগান থেকে ফিরছেন।
বয়স হওয়ায় জগিংয়ের জন্য বাইরের বের হন না সুহৃদ রেহনেওয়াজ।বাড়ির লাগোয়া বাগানেই চক্কর কাটেন।ওনাকে দেখে ত্রয়ী আস্তে করে সালাম দেয়।সালামের উত্তর দিয়ে সুহৃদ রেহনেওয়াজ ত্রয়ীর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দেয়।ভদ্রলোককে দিনে খুব কম চোখে পরে ত্রয়ীর।অবসরে সবসময় উনি ঘরের ভেতর বই পড়েই কাটান।বেশ গম্ভীর টাইপ মানুষ!
ত্রয়ী হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,
-বাবা চা খাবেন?
-না না থাক।সুপ্তের মা উঠলে ওই করে দিবে।তুমি তো এসময় উঠে পড়তে বসো।তোমাকে কষ্ট করে চা বানাতে হবে না।
ত্রয়ীর সাথে ভদ্রলোকের তেমন কথা বা দেখা সাক্ষাৎ হয় না বলেই চলে।সেক্ষেত্রে উনার তো জানার কথায় নয় ত্রয়ী এসময় উঠে বই পড়ে!
বাড়তি চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ত্রয়ী আন্তরিক হেসে বলে উঠে,
-বাবা আমি চা করতেই এসেছি।যদি আপনি চা খান তো আমি করে দিই।নাকি আপনিও আপনার ছেলের মত চা খান না?
-না না ওর মত স্বভাব না আমার।চা,কফি সব মুখে রুচে!ঠিকাছে।বানাও।
সম্মতি পেয়ে ত্রয়ী প্রফুল্ল মনে চা বানাতে শুরু করে।তারপর দুকাপ শশুরের ঘরে দিয়ে আরো দুকাপ নিয়ে নিজেদের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ত্রয়ী।
সুপ্ত ততক্ষণে একেবারে গোসল ছেড়ে গায়ে অফ হোয়াইট রঙের টিশার্ট জড়িয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে।নুপুরের আওয়াজ কানে বাজতেই রুমে আসে সে।সাথে সাথে ত্রয়ী এককাপ চা সুপ্তের হাত ধরিয়ে দিয়ে বলে,
-তবুও আমার চায়ের কাপে ভাগ বসাবেন না জনাব।
সুপ্ত গাঢ় চোখে তাকিয়ে ত্রয়ীর দিকে সামান্য ঝুকে পরে।অদ্ভুত কন্ঠে বলে,
-পুরো ত্রয়ী মেহরোজে ভাগ বসানোর অধিকার আদায় করেছি।এতো কেবল সামান্য এক কাপ চা!
.
ক্লাসের শেষের দিকে চুপচাপ ক্লাসে বসে ফোন চাপছে ত্রয়ী।তখনই তার থুঁতনি ধরে নিচদিক হয়ে থাকা মুখখানা উঁচু করে নিজের দিকে ঘোরায় বহ্নি।বহ্নি গালে হাত দিয়ে তা সিটে দিয়ে রেখেছে।তার এমন আচরণে ভ্রু উচিয়ে কি হয়েছে বোঝায় ত্রয়ী।প্রতিত্তোরে বহ্নির দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।পরক্ষণেই বলে,
-তোকে দেখছি।
উত্তর শুমে চোখ উল্টায় ত্রয়ী।বলে,
-সর!ঢং করিস না।প্রতিদিনই দেখিস।
-প্রতিদিন দেখেও এটা দেখলাম তো সুপ্ত রেহনেওয়াজ তোর মাঝে কি দেখলো!
এবার মোবাইলে চলতে থাকা ত্রয়ীর হাত খানা থেমে যায়।সে।পূর্ণচোখে তাকায় বহ্নির পানে।তখনই বহ্নির চাপা উত্তেজিত কন্ঠস্বর কানে আসে তার।
-লোকে কি বলাবলি করছে জানিস?বলছে যে তোর জন্যই নাকি ওই আরসালান চৌধুরী ব্যাক্তিগতভাবে শত্রুতা করেছে সুপ্তের সাথে!এটা কি সত্যি দোস্ত?
আরসালানের নাম শুনতেই ত্রয়ীর মন বিছিয়ে উঠে।সে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।ক্লাস শেষ।সকলে বেরিয়ে পড়ছে।গায়ের এপ্রোন খুলে হাতে নেয় ত্রয়ী।বহ্নিকে পেছনে ফেলে সামনে এগোয়।
ক্লাসরুম থেকে বেরুতেই বহ্নির কন্ঠ শুনে থামে সে।বহ্নি কাছে এসে বলে,
-রাগ করলি?এসব কিন্তু আমি মন থেকে বলিনি!লোকে বলাবলি করছে তাই জিজ্ঞেস করালাম আরকি।
-যা বলছিস তা সত্যই।তবে এখন এসব শেষ।তাই এব্যাপারে কিছু আমাকে বলিস না।
কথাটুকু বলে ত্রয়ী হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে।গেট বেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত গাড়ি চোখের সামনে না দেখে আনমনেই হেঁটে সামনে এগুতে থাকে ত্রয়ী।চোখমুখ বিছিয়ে আসে।ভ্রুযুগল বেশ কুঁচকানো।কিছুদূর হাঁটার পর গায়ে প্রচন্ড ধাক্কা অনুভব করে একপ্রকার পরে যেতে নেয় ত্রয়ী।নিজেকে কোন রকম সামলে সামনে তাকায় ত্রয়ী।মেজাজা তুঙ্গে উঠে গেছে তার।
যে ধাক্কা দিয়েছে সে যেতে যেতে পেছন ফিরে হাসছে।ত্রয়ী চিৎকার ছুঁড়ে,
-দাঁড়ান।
সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পরে লোকটা।যুবকটি দাঁড়াতেই তার দিকে তেড়ে এগিয়ে যায় ত্রয়ী।সামনে এসে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠে,
-কি হলো এটা?এভাবে ধাক্কা দিলেন কেন?
-কেন মজা লাগেনি?
কথার উত্তরে এমন কিছু শুনে কিরমির করে তাকায় ত্রয়ী।এমনিতেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে ছিল।এমন কথায় রাগ তার মস্তিষ্কের সমস্ত শিরা দপদপ করে জ্বলে উঠে।অগ্নি দৃষ্টি আর কন্ঠে অসম্ভব তেজ নিয়ে ত্রয়ী বলে উঠে,
-অনেকদিন জুতোর বাড়ি গালে পরে না নাহ?পায়ের জুতোখান খুলবো?ট্রাস্ট মি চাপার সব কয়টা দাঁত নড়বড়ে করে দেওয়ার সামর্থ্য আছে আমার।
ত্রয়ীর মুখের এমন কথায় লোকটার মুখে লেগে থাকা হাসি দপ করে নিভে যায়।অদূরেই গাড়িতে বসে থাকা রিক্তের চোখ কপালে উঠে।সুপ্ত একদৃষ্টে বাইরে ত্রয়ীকে দেখছে।চোখ মুখের প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না।রিক্ত ত্রয়ীকে দেখতে দেখতে বলে,
-ভাই ভাবী তো ধানিলঙ্কা!রেগে গেলে কিভাবে সামলাস তুই?
সুপ্ত অদূরে দাঁড়ানো রাগান্বিত রমনীকে দেখে নিজের মনেই বলে উঠে,
-সে যেমন পাথরের ন্যায় কঠিন তেমনি ফুলের ন্যায় নরম!
চলবে…