হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-২৯

0
115

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২৯.
শরৎকাল!আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে স্বচ্ছ মেঘগুচ্ছ।নিজ ঘরের বারান্দা থেকে আকাশের এই মনোরম রুপ দর্শন করছে তন্দ্রা।চোখে মুখে উদাসীনতার গাঢ় ছাপ!সৌন্দর্যে পূর্ণ আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তন্দ্রা।তখনই দরজায় নক করার শব্দ ভেসে আসে।খানিক চমকায় সে।পাশে রাখা ওড়না গায়ে জড়ায় অতি দ্রুত।একটু পরেই মিনিকে দেখতে পায় তন্দ্রা।দরজা চাপানো ছিল তাই ধাক্কা দিতেই তা খুলে গেছে।মিনি দুষ্টমিষ্টি করে হাসতে হাসতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।মিনিকে দেখে চোখমুখ স্বাভাবিক করে তন্দ্রা।সুক্ষ্ম একটা হাসি ফুটায় ওষ্ঠকোণে।তার পাশে এসে ধপ করে বসে পরে মিনি।তারপর তন্দ্রার দিকে তাকায় গাঢ়ভাবে।তার এরুপ আচরণ দেখে ভ্রু নাচায় তন্দ্রা।সন্দেহপূর্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-এমন করছিস কেন?পাগল -টাগল হয়ে গেলি নাকি?

– হ্যা!আমার পছন্দের প্রিয় মানুষের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে সেই শোকে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

মিনির হেয়ালিপূর্ণ বাক্যে চোখ উল্টে তাকায় তন্দ্রা।পরক্ষণেই সে মনে মনে গম্ভীর হয়ে আসে।মিনির দিকে তাকায় পূর্ণদৃষ্টিতে।মেয়েটার চোখেমুখে কি এক উজ্জ্বল দ্যুতি!প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাওয়ার অনুভূতি বুঝি এতই প্রখর হয়?

গোপন শ্বাস ফেলে তন্দ্রা।সেই অনুভূতির সাথে পরিচয় হওয়ার কি তার কোন উপায় আছে?সে যে রিক্তকে পছন্দ করে!
উঁহু!পছন্দ নয় ভালোবাসে।এটা আদো সে কখনো তাকে বলতে পারবে?নাহ।আবার তার উপর রিক্ত বেকার।পরিবার সচ্ছল হলেও সে নিজে কিছু করে না।ছেলে দায়িত্ববান,চরিত্রবান হলেও আমাদের সমাজে তো আগে ছেলের নিজের ইনকামকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।তন্দ্রা যদি কোনভাবে রিক্তকে বলেও দেয় সে তাকে ভালোবাসে তবে কি রিক্ত তাকে মানবে?আর যদি মেনেও নেয় তবে কি তার পরিবার বিয়ের জন্য রাজি হবে?

ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা আবার উদাস হয়ে যায়।তখনই মিনি তাকে পাশ থেকে মৃদু ধাক্কা মারে।চকিতে তাকায় তন্দ্রা।তারপর সে নিজের উপরেই ভ্রু কুঁচকায় মনে মনে।আশ্চর্য বার বার এত চমকাচ্ছে কেন সে?

-শোন একটা কথা বলি।আমি চাচা আর চাচিকে একটা ব্যাপারে কথা বলতে শুনেছি।

মিনির কন্ঠে রহস্যের গন্ধ পেয়ে তার চেপে ধরে তন্দ্রা।তারপর কৌতুহল নিয়ে সুধায়,

-কি ব্যাপারে?

-তোর বিয়ের ব্যাপারে!

মিনির কথা শেষ হতেই তন্দ্রার চোখে মুখে থাকা হাসির ঝিলিক ধপ করে নিভে যায়।করুন চোখে সে মিনির দিকে তাকায়।পরপরই চোখ সরায় অন্যদিকে।কি এক আশংকায় তার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠে।
.
ধরিত্রীতে সূর্যোদয় হয়ে গেছে অনেক আগেই।তবে আজকে এখনো কারো কারো উঠার তাড়না নেই।এখনো প্রতিদিন ব্যস্ত হয়ে কর্মস্থান,শিক্ষাপ্রতিস্থান কিংবা কোচিং-প্রাইভেটে ছোটা মানুষগুলো দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে!কেননা আজকে হলিডে।
হোস্টেলে থাকতে শুক্রবারে বেলা করো উঠলেও বিয়ের পরে ৬ টার দিকেই ঘুম বিসর্জন দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে ত্রয়ী।কিন্তু আজ ব্যাতিক্রম!আজ ঘড়িতে দশটার কাটা পেরিয়ে গেলেও বিছানা ছেড়ে উঠেনি সে।বলতে গেলে উঠতে পারেনি।ভোররাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসার পর এখনো সে শুয়ে আছে।সুপ্তের ঘুম ভোররাতেই।কিন্তু ত্রয়ীর সাথে সাথে সেও এখন আধশোয়া হয়জ্বরে ত্রয়ীর দেহের প্রচন্ড তাপে ঘুম থেকে উঠে জলপট্টি দিয়েছে সে।একপর্যায়ে তাকে জাপ্টে ধরে রেখেছে ত্রয়ী।

অসুখ হলে আমাদের মন প্রিয়জনকে কাছে চায়।ত্রয়ীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।সুপ্তকে জাপ্টে ধরে শুয়েছে সে।হঠাৎ হঠাৎ পীড়ায় কেঁদে উঠলে সুপ্তের হাতের আলতো ছোঁয়া যে তার আবশ্যক।
এখনও সুপ্তের বা হাত ত্রয়ীর দখলে।সুপ্ত একদৃষ্টে ঘুমন্ত ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে আছে।তখনই দরজা ধাক্কানোতে তার নজর সরে।দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসে মিনির গলার স্বর।সে দরজায় মৃদু আঘাত করতে করতে বলছে,
-সুপ্ত ভাই আর ত্রয়ী ভাবি আজ কি এখনো তোমাদের সকাল হয়নি?ডাইনিং এ সকলে অপেক্ষা করছে তো!
সুপ্ত সেভাবেই বসে থেকে বলে,

-তোর ভাবীর জ্বর এসেছে।সবাইকে খেয়ে নিতে বল।আমি একটু পরে যেয়ে রুমে খাবার নিয়ে আসবো।

দরজা ধাক্কানো থামে সহসা।শোনা যায় মিনির চিন্তা মিশ্রিত কন্ঠ,

-জ্বর কি বেশি?ভাবী কি বেশি অসুস্থ?

-এখন কমেছে।তুই গিয়ে সবাইকে বল আমরা পরে খাবো।

ওপাশ থেকে আর কোন শব্দ শোনা যায় না।সুপ্ত ত্রয়ীর থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয় সে।তারপর অর্ধভেজা তোয়ালে বেলকনিতে নেড়ে দিয়ে এসে ত্রয়ীর পাশে বসে।শান্ত স্বরে ডেকে উঠে,

-ত্রয়ী!ঘুম ভাঙে না?

সময় নিয়ে পিটপিট করে তাকায় ত্রয়ী।ভ্রুযুগল কুঁচকে আসে তার।সুপ্ত বলে,

-উঠো ফ্রেশ হয়ে আসো।খেয়ে ওষুধ খাবে।

ত্রয়ী সময় নিয়ে উঠে বসে।তারপর বিছানা থেকে নামতে নিলেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে তার।পরতে পরতে পাশে দাড়ানো সুপ্তকে অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরে সে।সুপ্ত বিচলিত কন্ঠে সুধায়,

-মাথা ঘুরায়?

মাথা উপর-নিচ করে হ্যা বোঝায় ত্রয়ী।সুপ্ত তাকে আচমকা কোলে তুলে নেয়।আকস্মিক ঘটনায় চট করে সুপ্তের পানে তাকায় ত্রয়ী।জ্বরের তোড়ে ওষ্ঠযুগল রাঙা বর্ণ ধারন করেছে।বিষন্ন মুখজোড়ায় তাকিয়ে সুপ্তের মনে অনেক ইচ্ছে চেপে বসলো।এইযে রক্তাভ ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছা জাগছে তার মনে।সুপ্ত সবকিছুকে মাথা ঠেকে ঝেড়ে দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।তারপর ত্রয়ীকে ফ্রেশ করে এনে বিছানায় বসিয়ে রুম থেকে বেরোয় সে।
সুপ্ত খাবার নিয়ে এসেছে দুজনের জন্য।কিন্তু ত্রয়ী খুব সামান্যই খেয়েছে।একটু খেতেই বমির জন্য ওয়াশরুমে দৌড়াতে হয়েছে তাকে।সুপ্ত চিন্তিতমুখে নিজের খাবার শেষ করে তারপর নিচে প্লেট রাখতে যায়।
ত্রয়ী বিছানায় শুয়ে একটু চোখ বুজতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠে।বিরক্ত মুখে ফোন কাছে স্ক্রিনে তাকাতেই দেখে ‘ক্রাশখোর মহিলা’ নামটা জ্বলজ্বল করছে।ত্রয়ী ফোন রিসিভ করতেই ওপরপাশ থেকে বহ্নির কন্ঠ ভেসে আসে।

-তুই আমার উপর রাগ করে আজ কলেজে আসিস নি তাই না?দেখ আমি কিন্তু..

বহ্নির কথার মাঝেই ত্রয়ী বিরক্তস্বরে বলে,

-আরে ভাই আমি অসুস্থ।ভোররাতে জ্বর উঠেছে।এখন কমলেও কিছু খেতে পারছি না।মাথা ঘুরাচ্ছে,যা খাচ্ছি তাই বমি হয়ে যাচ্ছে আর তুই আসিস এটা ভেবে যে আমি তোর কথায় রাগ করে কলেজ যাইনি!

অপর পাশে নিরবতা ছেঁয়ে যায়।একটু সময় পার হতেই বহ্নির উত্তেজিত কন্ঠ শোনা যায়।

-কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত!এসব সুখবর দেওয়ার সংকেত বুঝলি?

ত্রয়ী এদিকে মনে মনে কিছুর হিসেব কষে।পরপরই অক্ষিকোটর বিরাট আকার ধারণ করে তার।দ্রুত তাকায় ক্যালেন্ডারের দিকে।ওপরপাশ থেকে বহ্নির কথা শোনা যাচ্ছে।

-কি হলো?চুপ করে আছিস যে। কথা মিলে গেছে তাই না?
যেদিন কলেজ আসবি আমার জন্য মিষ্টি নিয়ে আছিস।

ত্রয়ী ঠোঁট চেপে ধরে বলে উঠে,

-পিরিয়ড মিসড!বাট আ’ম নট শিউর।
.
দুদিন গত হয়েছে।বাড়ির রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে নানান খাবারের সুগন্ধ।ত্রয়ী রুম থেকে বেরিয়ে ধীরে সুষ্ঠে সিঁড়ি বেয়ে নামে।রান্না ঘরের আঙিনায় পা রাখতেই মিসেস সুহৃদের গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসে,

-বাড়িতে সাহায্য করার মানুষের অভাব পরেনি যে তোমাকে রান্নাঘরে আসতে হবে!

সহসা থেমে যায় ত্রয়ীর পা।আমতা আমতা কন্ঠে সে সুধায়,

-আপনি কি করে বুঝলেন আমি এসেছি?

-নুপুর বাড়িতে একমাত্র তুমিই পরো ত্রয়ী।

তৎক্ষনাৎ জিভে আলতে কামড় বসায় ত্রয়ী।রান্নাঘরে পা রাখতে রাখতে বলে,

-আমি তে এমনিই আসলাম দেখতে!

দুইদিন আগে ত্রয়ীর গায়ে আবার জ্বর আসায় ডাক্তারের নিকট নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।বেশ কিছু টেস্ট করার পর ডাক্তারের কেবিনে বসে সুপ্ত আর ত্রয়ী।সুপ্তের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হলেও ত্রয়ী স্বাভাবিক ভাবে চুপচাপ ছিল।ডাক্তার রিপোর্টগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে সুপ্তের দিকে তাকায়।হালকা হেসে বলে,

-কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার সুপ্ত রেহনেওয়াজ।সি ইজ প্রেগন্যান্ট!

কথাটুকু শোনার পর চোখ বুঁজে নেয় ত্রয়ী।যেন এই কথা শোনার প্রতিক্ষায় ছিল সে।চোখ বুঁজে থাকা ত্রয়ীর সুপ্তের মুখে ফুটে উঠা অনন্য হাসি দেখার সৌভাগ্য হয় না!
সেইদিন রাতে বাড়িতে ফিরে সুপ্তের সে কি যত্ন!যেন ত্রয়ী হাত নাড়ালেও তার বাচ্চা ব্যথা পাবে।যত্নশীল মানুষটা আরো যত্ন হয়ে উঠলো এক লহমায়।ত্রয়ীকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাসুলভ কেমন আচরণ!
মনে পরলে হাসে ত্রয়ী।তারপর শাশুড়ীর কথামতো তন্দ্রার রুমে যেয়ে দেখে সে তৈরি হলো কি না।আজকে তন্দ্রাকে দেখাদেখির পালা।
রুমে থমথমে মুখশ্রীতে বসে আছে তন্দ্রা।তার পাশে তাকে তৈরি হতে বলছে মিনি প্রায় একঘন্টা ধরে।অথচ সে একটু পরে পরেই নাক টানছে!তারপর জোর করে তাকে ওয়াশরুমে পাঠায় মিনি ড্রেস চেঞ্জ করার জন্য।তখনই নুপুরের শব্দের আগমনী ধ্বনি তুলে রুমে প্রবেশ করে ত্রয়ী।রুমে শুধু মিনিকে দেখে প্রশ্ন করে,

-ওই কই?

মিনি ওয়াশরুমের দিকে ইশারা করে।পরপরই মুখ টিপে হেসে ত্রয়ীর নিকটে এসে ফিসফিসয়ে বলে,

-একটু পর পর কাঁদছে জানো?

-কাঁদুক!একটু পরেই কান্না কই উধাও হয়ে যাবে।

দুইমিনিট পরেই বেরিয়ে আসে তন্দ্রা।ড্রেসিং টেবিলের সামনে ধপ করে বসতে বসতে বলে,

-বাড়িতে আইনজীবী,ফিউচার ডাক্তার,শিক্ষিত মানুষজন থাকা সত্বেও আমার সাথে অন্যায় হচ্ছে!

চলবে…