হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-০৯

0
56

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৯.
গ্রামে আরো একদিনের মতো থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে ত্রয়ী ও সুপ্ত।সকাল সকাল বেরিয়ে পরেছে বাড়ির উদ্দেশ্য।ঢাকায় এসে জ্যামে আটকে পরে দুজনে।সুপ্ত বিরক্ত চোখে সামনে তাকিয়ে দেখছে জ্যাম ছাড়তে আর কতক্ষণ লাগতে পারে।ত্রয়ী আশেপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।তার মুখেও বিরক্তি লেপ্টে।এতক্ষন ধরে জ্যামে কখনো আটকা পরেনি সে।হোস্টেল থেকে মেডিকেল কলেজ খুব একটা দূরে ছিল না।রিক্সা দিয়ে যাওয়ার সময় যদি কখনো জ্যামে আটকে পরতো তবে হেঁটে হেঁটেই চলে যেত কলেজ অবধি।কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়।
আস্তে আস্তে জ্যাম ছাড়ছে দেখে খুশি হয় সুপ্ত।তখনি হুট করে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ত্রয়ী।ত্রয়ীর এহেন কাজে ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকায় সুপ্ত।ততক্ষণে ত্রয়ী দৌড়ে ফুটপাত অবধি চলে এসেছে।মিনিটের মাঝে আবার দৌড়ে ফিরে আসে।তবে সে সেখান থেকে একা আসেনি।সুপ্ত ত্রয়ীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে হাতে ছোট একটা বিড়ালের বাচ্চা।সুপ্ত বিস্ফোরিত চোখে ত্রয়ী দিকে চায়।ত্রয়ীকে বলে উঠে,

-ওকে যেখান এনেছো সেখানেই রেখে এসো যাও।

ত্রয়ী সুপ্তের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কেন?

-আমি এসব পছন্দ করি না।

-আপনি পছন্দ করেন না সেটা আপনার ব্যাপার।আমি তো ওকে আমার সাথেই নিয়ে যাবো।

সুপ্ত কিছু বলতে যাবে তার আগেই ত্রয়ী বলে উঠে,

-মনে দয়া মায়া কিছু রাখুন।ও এভাবে রাস্তায় থাকলে বেশিদিন বাঁচতে পারবে না।এখনো বেশ ছোট।গাড়ি স্টার্ট দিন জ্যাম ছেড়ে গেছে।

সুপ্ত ত্রয়ীর দিকে একপলক তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।বাড়িতে পৌঁছানোর আগ অবধি আর কিছু বলে না তারা।বিড়াল ছানাটা ডাকতে ডাকতে চুপ হয়ে গেছে এখন।ত্রয়ীর হাতের উষ্ণ আদরে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পরেছে।সেটা থেকে মুচকি হাসে ত্রয়ী।ছানাটাকে একহাতে আগলে অপর হাতে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সে।দুদিন পরে শশুরবাড়িতে পৌছে দোতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ত্রয়ী।তারপর গুটি গুটি পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে।
তারা যে এসে পৌঁছেছে তা এতক্ষণে বাড়ির ভেতরে সকলে জেনে গেছে।মিসেস সুহৃদ রান্না করছিলেন।খুন্তি হাতেই চলে এসেছেন বাড়ির বড় বউকে আবার বাড়িতে স্বাগত জানাতে।শাশুড়ীকে দেখে হেসে সালাম করে ত্রয়ী।মিসেস সুহৃদ নিজেও হেসে সালামের উত্তর দেয়।তারপর ত্রয়ীর হাতের দিকে নজর আসে উনার।ত্রয়ী এতক্ষণ সুপ্তের সাথে গলাবাজি করলেও এবার মনে মনে শঙ্কিত।যদি শাশুড়ী মাও সুপ্তের ন্যায় বলে উঠে উনারর এসব পছন্দ নয়।কিন্তু ত্রয়ীর ভাবনাকে ভুল প্রমানিত করে মিসেস সুহৃদ বলে উঠে,

-সুপ্ত তোমায় এটা আনতে দিলো?আমরা কেউ ওর জন্য এসব পুষতে পারি না।ছোট বেলা বিড়াল ছানা ভয় পেতো ও।তারপর বড় হয়ে পছন্দ করে না।

ত্রয়ী গোপনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে।মিসেস সুহৃদ বেশি কথা না বলে ত্রয়ীকে রুমে যেয়ে ফ্রেশ হতে বলে।ত্রয়ী দোতলার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় খেয়াল করে সুপ্ত মায়ের সাথে কুশল বিনিময় শেষে ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেল।
ত্রয়ী রুমে ঢুকে একটা বাক্সের মত জিনিসে বিড়াল ছানাটাকে রেখে রান্নাঘরে আসে।যেহেতু ক্যাটফুট নেই তাই বিড়াল ছানাটাকে এখন ভাতই খেতে দিতে হবে।বিড়াল ছানাকে খাইয়ে তারপর পড়তে বসে ত্রয়ী।এই দুদিনে বই ধরা হয়নি একদম।
পড়তে পড়তে দুপুর হয়ে আসছে খাওয়ার জন্য নিচে আসে ত্রয়ী।তখনই দেখে বেলা এখনো এই বাড়িতেই আছে।খেতে খেতে সকলে আলাপ আলোচনা করছিল।পরশু মিনিকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।
.
যথারীতি আরেকটা কেস জেতার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আদালত থেকে বের হয় সুপ্ত।পরনে ইন করা সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট।কালো কোর্টটা হাতের ভাঁজে ঝুলিয়ে রাখা।মুখে সাফল্যের মৃদু হাসি নিয়ে সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করতে ব্যস্ত তার পা যুগল।হঠাৎ মেয়েলি স্বরে হাঁটার গতি কমায় সুপ্ত।সুপ্তের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট নিঝুম এসে সুপ্তের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলে,

-কংগ্রাচুলেশনস স্যার।

সুপ্ত গম্ভীর হয়ে থ্যাংকস জানায়।তারপর বলে,

-এন্ড অলসো থ্যাংক ইউ ফর দ্যাট এই কেসের পেছনে আপনার পরিশ্রমটা বেশি ছিল।

নিঝুম মুচকি হেসে সুপ্তের পানে তাকায়।ফর্সা, সুঠাম গড়নের পুরুষটির আশেপাশে বেশিক্ষণ থাকলে যে কোন মেয়ে মুগ্ধ হয়ে পরবে।তবে পাত্তা পাবে না একটুও!
সুপ্ত ততক্ষণে তার গাড়ির নিকট পৌঁছে গেছে তবে নিঝুম দাঁড়িয়ে পরেছে সিঁড়ির মাঝেই।এখন অবধি সুপ্ত কাজের বাহিরে একটা কথাও বলেনি তার সাথে।হঠাৎ করে নিঝুমের চেহারার এক্সপ্রেশন পাল্টে যায়।সুপ্তের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সে বলে উঠে,

-বিশ্বাস করুন সুদর্শন পুরুষ আপনাকে বাজেভাবে ফাঁসাতে আমার বড্ড হৃদয় পুড়বে।

ক্লাসে পৌঁছে ত্রয়ীর চোখজোড়া বহ্নির সন্ধানে ব্যস্ত।লাস্ট বেঞ্চে চোখ পরতেই ত্রয়ী বহ্নিকে দেখতে পায়।কানে ইয়ারফোন গুঁজে ছ্যাকা খাওয়া মহিলাদের মতো বসে আছে।ত্রয়ী দ্রুত হেঁটে ওর পাশে এসে বসে।বহ্নি ওর দিকে ঢং করে করুন চোখে চায়।বহ্নি ত্রয়ীর উদ্দেশ্য বলে উঠে,

-ও মাইয়া রে মাইয়া রে তুই অপরাধী রে!আমার যত্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরায়া দে!

ত্রয়ী আচমকা বহ্নির গালে ঠাস করে চড় বসায়।তারপর কটমট করে তাকিয়ে বলে,

-তোর ড্রামা বন্ধ কর ফাজিল।দুইদিনের নোটগুলো দে আমাকে।

বহ্নি গালে হাত দিয়ে বিস্ফোরিত নজরে ত্রয়ীর দিকে তাকায়।তারপর বিস্ময় নিয়ে বলে উঠে,

-তুই আমাকে এভাবে মারতে পারলি ভাই?

-এই তোর লজ্জা করে না?

বহ্নি বরাবরের মতো দাঁত কেলিয়ে হেঁসে বলে উঠে,

-নাহ!

ত্রয়ী বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে তাকায়।গত পাঁচবছর যাবত বহ্নি নামক প্রানীটির জঘন্য অভিনয় সহ্য করে আসছে সে।এ মেয়ে দুই দিন পরপর ক্রাশ খায় আর তার ক্রাশ ওর মন ভেঙে চূর্ণ করে দিয়ে বিয়ে করে ফেলে।এইতো রুম মেডের কেসে আদালতে গিয়ে সুপ্তের উপর ক্রাশ খেয়েছিল।এখন তারও বিয়ে হয়ে গেছে তাও আবার বান্ধবীর সাথে!

ক্লাস শুরু হওয়ায় চুপচাপ মনোযোগ দেয় ত্রয়ী।বহ্নি ইয়ারফোন খুলে রেখে দেয়।আজ ক্লাস নিচ্ছে ডাক্তার সয়ন।দ্যা মোস্ট ফেমাস পার্সন অফ কলেজ।আজকে ক্লাসরুম একদম কানায় কানায় পূর্ণ তার কারনও হচ্ছেন ডক্টর সয়ন।
বহ্নি হঠাৎ ত্রয়ীর কানে ফিসফিসয়ে বলে উঠে,

-ভাই তো নাহয় ক্রাশের বিয়ে হয়ে যাওয়ার ব্যাথা ভুলে যাবো। বাট সয়ন স্যারের কি হবে?তোর বিয়ে হয়ে গেছে এটা জানার পর উনি নিশ্চয়ই বাপ্পারাজের সেই বিখ্যাত ডায়লগ দিবে,”এ হতে পারে না।এ আমি বিশ্বাস করি নাহ।”

ত্রয়ী না চাইতেও ফিক করে হেসে উঠে।মুখ টিপে হাসতে হাসতে এখনকার মতো বহ্নিকে তার মুখটা বন্ধ রাখতে বলে সে।
ক্লাস শেষে বহ্নির থেকে নোটগুলো নিয়ে বাইরে বেরোয় ত্রয়ী।তবে পুরুষালি এক সম্মোধনে সে না চাইতেও দাড়িয়ে পরে।

-মিস রুপান্জেল!

ত্রয়ী পেছন না ফিরেও বুঝতে পারে লোকটি কে,ডাক্তার সয়ন।একবার ক্লাসে ঘুমিয়ে পরেছিল ত্রয়ী আর সেদিন ছিল সয়নের ক্লাস।সেদিন থেকে সয়নের ত্রয়ীর উপর নজর পরেছে আর সেদিন থেকে তাকে রুপান্জেল সম্মোধনটি শুনতে হচ্ছে।
ত্রয়ী পেছন ফেলে তাকাতেই সয়ন বলে উঠে,

-শুনলাম হোস্টেল নাকি ছেড়ে দিয়েছো?হঠাৎ এই পদক্ষেপ?

-হোস্টেল কেন ছেড়ে দিয়েছি এটা আপনাকে বলতে হবে?আমার বিয়ে হয়েছে শশুর বাড়িতে থাকি তাই হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি।

মনে মনে উক্ত কথাখান বললেও মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করে না ত্রয়ী।ছোট করে বলে,

-এমনিই।

সয়ন ত্রয়ীর দিকে এগিয়ে এসে দুঃসাহসিক একটা কান্ড করে বসে।ত্রয়ীর এলোচুল গুঁজে দেয় কানের পিঠে।এহেন কাজে বেশ রাগ্বানিত হয় ত্রয়ী।রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে দুপা পিছিয়ে আসে তৎক্ষনাৎ।ত্রয়ীর এই ব্যবহারে অপ্রস্তুত হয়ে পরে সয়ন।তার ধারনা ছিল সে যেমন ত্রয়ীকে ভালোবাসে ত্রয়ীও হয়তো তাকে পছন্দ করে।তাই দুঃসাহসিক এই কার্য করেছে সে।ত্রয়ী বজ্রকন্ঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে গম্ভীর এক পুরুষালী আওয়াজ ভেসে আসে,

-কোন মেয়ের গায়ে হাত দেওয়ার আগে জেনে নেওয়া উচিত সে হয়তো কারো সহধর্মিণী।নাকি আপনি এভাবেই মেয়েদের অস্বস্তিতে ফেলতে ভালোবাসেন মিস্টার সয়ন?

ত্রয়ী তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরে চায়।দৃষ্টিতে ভেসে উঠে ইন করা শুভ্র শার্ট ও কালো প্যান্ট পরিহিত এক যুবক।ত্রয়ীর মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে,

-সুপ্ত!

চলবে..