হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব-১১

0
758

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
ভার্সিটিতে গিয়ে ফাঁকা লিফটে উঠে কাঙ্খিত ফ্লোরের বোতামে প্রেস করার পর লিফটের দরজা বন্ধ হচ্ছে হুট করে আধ বন্ধ হওয়া দরজা খুলে গেলো আর জারিফ লিফটে প্রবেশ করলো। প্রিয়া আচমকা জারিফকে দেখে থতমত খেয়ে সালাম দিয়ে চুপচাপ লিফটের কোনার দিকে চলে গেলো। জারিফের হুট করে হাসি পেলো কিন্তু হাসলো না। হাসি চেপে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে দরজার দিকে মুখ করে পকেটে হাত গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাঙ্খিত ফ্লোরে লিফট থামার পর জারিফ নেমে গেলো আর প্রিয়া হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কিন্তু এদিকে সে বেমালুম লিফট থেকে নামার কথা ভুলে গেছে। লিফট উপরের ফ্লোরে উঠার পর নিজের কপাল চাঁ*পড়ে বিড়বিড় করে,

“সবই কপাল! ধ্যাত ভাল্লাগে না।”

এটা বলে উপরের ফ্লোরে নেমে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো অথচ সে লিফট দিয়েও নামতে পারতো!

সারাদিনের ক্লাস শেষে লাঞ্চ করে একটু হাত পা মেলে বসেছে। একটু পর বাড়ি ফিরবে। প্রিয়া আয়ানের দিকে তাকালো অতঃপর ওর পাণ্ডুর মুখশ্রী দেখে ভ্রুঁকুটি করে বলে,

“কী হয়েছে তোর? চোখ মুখ বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেনো?”

আয়ান জোরপূর্বক হেসে বলে,
“আরে কিছু না। ভাবছিলাম ক্লাস টেস্ট তো এসে পরছে কিন্তু পড়া হয়নি কিছু। তাই একটু…”

“পড় পড়। ব্রিলিয়ান্ট পোলা। তুই না পড়লে আমাদের কে দেখাবে!”

সবাই সমস্বরে হেসে উঠলো। রাদ ও সাদ আয়ানের হাসির আড়ালে লুকানো ব্যথা আন্দাজ করতে পারে। আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। বিষয়বস্তু প্রিয়ার বিয়ে। প্রিয়াকে শুক্রবার ছেলেপক্ষ আবার দেখতে আসবে আর ওর বিয়েতে কে কি পরবে সেসব। তারপর বাড়ির জন্য রওনা করে।

_________

পরেরদিন জারিফের ক্লাসে জারিফ প্রিয়াকে একটা পড়া বিষয়ক প্রশ্ন করলে প্রিয়া জবাব দিতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে জারিফ গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“ফাঁকিবাজি করলে চলবে না। পড়ালেখা ভালো করে করতে হবে। দেখতে দেখতে দুইটা উইক চলে গেছে। ক্লাস টেস্ট নিতে হবে সাথে মিড আসছে। সিম্পল পড়া ছিল এটা।”

তারপর প্রিয়াকে বসতে বললে প্রিয়া বসে বিড়বিড় করে বলে,
“আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অতো পড়তে হবে না। পরীক্ষার সময় টুকটাক পড়ে নিবো। আর আমার গ্যাং তো আছেই।”

আবারও ক্লাসে মনোযোগ দিতে চাইল। জারিফ প্রিয়াকে আরেকবার দেখে পড়ানোতে মন দিলো। জারিফ মনে মনে ভাবে,

“এতো ফাঁকিবাজ মেয়ে আমার বউ হবে ভাবতেও অস্বস্থি হচ্ছে। তার রেজাল্ট খারাপ হলে আমি ডিপার্টমেন্টে কি বলব!”

______

আজ শুক্রবার। সকাল থেকে প্রিয়াদের বাড়িতে ভীড় লেগে আছে। প্রিয়ার মামা, চাচা, ফুফুরা এসেছে। সাথে ছোটো বড়ো কাজিনরা। প্রিয়ার এক বিবাহিত কাজিন ইফা, প্রিয়ার সাঁজ সজ্জার দায়িত্ব নিয়েছে যে কিনা প্রিয়ার ফুফাতো বোন। সকাল উঠিয়ে ওর মুখ, হাত-পায়ে কিসব ফেসিয়াল জিনিসপত্র লাগিয়ে বসিয়ে রেখেছে। রাহা প্রিয়ার এই অবস্থার ছবি তুলছে আর এই ঘর থেকে ওই ঘরে ঘুরছে। কাজিন চারটা ভাই যেগুলোর একটা প্রিয়ার থেকে একটু বড়ো আর দুইটা ছোটো। এগুলো ওর মামাতো ভাই আর আরেকটা প্রিয়মেরও বড়ো যে কিনা ওদের চাচাতো ভাই। তার বউ প্রিয়ার মা-চাচিদের সাথে রান্নার কাজে হাত দিয়েছে। আর কিছু পিচ্চি পিচ্চি বোন আছে সেগুলো ঘরময় দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে।

প্রিয়া হাত-পা, মুখ ধুয়ে একেবারে গোসল সেরে এসে বলে,

“ইফাপু, আমি এসব আর লাগাবো না। শীতের মধ্যে আমাকে বারবার পানির ছোঁয়া লাগাতে হচ্ছে। আমি একটু ঘুমাবো। যাও তো তোমরা যাও। টেনশনে আমার কলিজা শুকিয়ে আসছে আর তারা আমার রূপচর্চা করছে!”

“একটু টুকটাক করেই এই অবস্থা! তাহলে অনুষ্ঠানের সময় সপ্তাহ জুরে যে পার্লারে দৌঁড়াতে হবে সেটা!”

“অতো পারব না বাবা! এখন তোমরা দয়া করে যাও। এতো উৎসবমুখর পরিবেশ দেখে মাথা ব্যাথা করছে। ঘুমাব একটু।”

ইফা প্রিয়াকে মেডিসিন নিতে বলে তার স্বামীর খোঁজ করতে চলে যায়। রাহা এসে প্রিয়ার পাশে বসে তারপর বলে,

“তোমার একটা দেবর থাকলে আমি সেটাকে বিয়ে করব। আহা! তারপর দুইবোনে মিলে মুভি দেখব।”

“আজকে যদি জামাই আমার পছন্দ না হয় তো আমি তোর মুভি দেখা জন্মের মতো ঘুঁ*চিয়ে দিবো মনে রাখিস। যা ভাগ।”

রাহা ঠোঁট উলটে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে একটু কান্নার অভিনয় করে বলে,

“সত্যি বলছি আপু, সবাই জিজুর ছবি দেখে বলেছে জিজু একটা ছেলে হুর!”

“ছেলে হুর! সেটা আবার কি?”

রাহার উদ্ভট কথার বিনিময়ে প্রিয়া প্রশ্ন করলে রাহা জবাব দেয়,

“আরে সুন্দর মেয়েদের হুরপরীর সাথে তুলনা করলে সুন্দর ছেলেদেরও ছেলেহুর বলাই যায়! নাহলে পরীরর মেইল ভার্সনটা জ্বি*ন! এখন হুরজ্বি*নের থেকে ছেলেহুর কথাটা মানায়।”

প্রিয়া বিরক্তিতে নিজের কপাল চেপে ধরে চিৎকার করে বলে,

“বের হ আমার রুম থেকে। এখন গিয়ে দোয়া-দুরুদ পড় যাতে তোর উপর ঝড় না বয়। বের হ।”

রাহা ভদ্র বাচ্চার মতো সুরসুর করে বেরিয়ে গেলো। প্রিয়া দরজা লক করে জানালার পর্দা টেনে বারান্দার দরজার পর্দা টেনে ভেজা চুলগুলো বালিশের উপর এলিয়ে দিয়ে কম্বল পেঁচিয়ে ঘুম দিয়েছে।

_______

জারিফের বাড়িতে অতো তোড়জোড় নেই। জায়েদ সাহেব তার ভাইকে জানিয়েছেন আর তার বোনকে একটু আগে জানিয়েছেন যে জারিফের জন্য মেয়ে দেখতে যাবেন। জারিফের ফুফি সেই রংপুর থাকেন। অতোদূর থেকে এখন চাইলেও আসতে পারবেন না। প্লেনে করে আসা গেলেও সেটা জমিলা বেগমের স্বভাব বিরুদ্ধ। জমিলা বেগম কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিজের কথার মাধ্যমে যা জায়েদ সাহেব নিজের বোনের কথায় বুঝেছে তাই আর আকদের কথাটা বলেননি।

জারিফের চাচা, খালা, মামারা এসেছেন। উনাদের ছেলে-মেয়েরা কেউ দেশের বাহিরে বা কেউ অনেক দূরে আছে চাকরিসূত্রে তাই জারিফের সব কাজিন আসতে পারেনি। দুইটা কাজিন ভাই যারা ইউনিভার্সটিতে পড়ে আর স্কুল পড়ুয়া একটা কাজিন বোন ফিহা এসেছে। জারিফ নিজের রুমে বসে কিসব কাজ করছে তাই ওকে কেউ বিরক্ত করছে না। তামান্না ফিহার কাছে তুতুলকে ধরিয়ে দিয়ে গোছগাছ করছে। জুম্মার পরপরই প্রিয়াদের বাড়িতে যাবে। তামান্নার মা-বাবা ও বড়ো ভাই এসেছেন। তামান্নার বড়োভাই এবার মাস্টার্সে পড়ছে সাথে জব করছে।

_______

জুম্মার নামাজের পর জারিফরা প্রিয়াদের বাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি ও বিভিন্ন রকমের মিষ্টান্ন ও ফল নিয়ে হাজির হলো সাথে কাজিও। প্রিয়াকে সাঁজাতে তামান্না ও ফিহা জিনিসপত্র নিয়ে প্রিয়ার ঘরে গেলো। প্রিয়াকে ডার্ক ওয়ান রঙের হালকা কাজের বেনারসিটা পড়ায়। তারপর হালকা সাঁজগোজ করিয়ে ড্রয়িংরুমে আনে। প্রিয়া মাথা নিচু করে চোখ-মুখ খিঁচে রেখেছে। বরের মুখ দেখবে তাই ভয় হচ্ছে। প্রিয়াকে জারিফের বরাবর সোফায় বসায়। জারিফের মা তরুণীমা বেগম প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“মাশাআল্লাহ্। অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে মা। আমার ছেলেকে এবার দেখো। দুজনকে মানাবে ভালো।”

প্রিয়া আঁড়চোখে দেখতে চেষ্টা করলো। লজ্জায় মুখ তুলতে পারছে না। তামান্না অপেক্ষা করছে প্রিয়ার রিয়াকশনের। সে প্রিয়াকে শুনিয়ে জারিফকে বলে,

“জারিফ দেবরজি, তোমার দুলহান তো লজ্জায় তোমাকে দেখতে পারছে না। একটু লজ্জা ভাঙাও!”

রাহা, প্রিয়মরা হেসে উঠলো। জারিফ নামটা শুনে প্রিয়ার বুকের ভিতর ধক করে উঠে। তাড়াহুড়ো করে চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করা যেনো গলার কাঁ*টা মনে হচ্ছে। সামনে তার ডিপার্টমেন্টের স্যারকে দেখে অক্ষিগোলক কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এদিকে জারিফ ভাবশূণ্য! সে প্রিয়ার সাথে একবার চোখাচোখি করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। যেনো যা হচ্ছে তা কোনো অবাক বা হতবাক করা বিষয়ই না।

জারিফের বাবা কাজিকে বলে উঠেন,
“কাজি সাহেব, বিয়ে পড়ানো শুরু করেন।”

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।