হে সখা পর্ব-১৭+১৮+১৯+২০

0
256

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
সপ্তদশ পর্ব

সন্ধ্যার আকাশে হালকা লালচে আভা ছড়িয়েছে। গলা ছেড়ে ডাক দিয়ে নীড়ে ফিরছে পাখির দল। ছোট্ট মেয়েটা দ্রুত পায়ে হাটতে গিয়ে কখনো একটু দৌড়ে পথ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ গায়ের লাল টুকটুকে ফ্রকটায় ধুলো মাখামাখি। মায়ের ধমক জুটবে নিশ্চিত। গোসলের পর পরিষ্কার পোষাক গায়ে পরিয়ে দিয়ে মা বলেছিলো, নিজ ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে৷ কিন্তু প্রজাপতি ছোটাছুটি ছাড়া থাকতে পারে নাকি! আঘাতপ্রাপ্ত ডানা নিয়ে হলেও উড়বার চেষ্টা করে৷ ছোট্ট মেয়েটি সন্তপর্ণে সবার আড়ালে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো৷ সাবধানেই বৌ চি খেলাটা খেলছিলো। খেলা এই শেষ হলো বুঝি। কোথা থেকে দুষ্টু জেরিন আপুটা এসে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো৷ লাল জামাটায় ধুলো লেগে একদম সাদা হয়ে গিয়েছে। ছোট্ট মেয়েটি রেগেমেগে মাটিতে পরেই কান্না জুড়ে দিলো৷ বন্ধুরা ছুটে এসে ধরাধরি করে মাটি থেকে না তুলে দিলে ওখানেই গড়িয়ে গড়িয়ে কান্না চলতেই থাকতো৷
– তুই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলি কেনো?
– ধাক্কা দিলাম কখন! আমি দৌড়ে আসছিলাম, ও দেখতে পেয়েও সামনে থেকে সরেনি দেখেই তো পরে গেলাম। পাটকাঠির মতো শরীর। এই নিয়ে খেলতে আসে।
– আমি দেখেছি তুই ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছিস।
– বললেই হলো। খেলতে গেলে এমন একটু পরেটরে সবাই যায়। এসব ননীর পুতুল খেলতে আসে কেনো? এই তোর কান্না থামা তো। কালকে থেকে আর খেলতে আসবি না তুই। তোকে খেলায় নিবো না। এখন ভাগ এখান থেকে।

হালকা ধাক্কা মেরে ছোট্ট মেয়েটিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই মেয়েটি নিজের ক্ষুদ্র দু হাতে জেরিনকে উল্টোদিকে ধাক্কা মেরে বললো,
– তোমাদের সাথে খেলতে আমার বয়েই গেছে। আর আসবো না খেলতে৷

সামান্য ধাক্কায় জেরিন হুমড়ি খেয়ে পরে যেতেই বাচ্চারা হা হা করে হেসে উঠলো৷ ছোট্ট মেয়েটি সেই হাসি তামাশায় যুক্ত না হয়ে দ্রুত পা চালালো বাড়ির উদ্দেশ্যে। বেলা ডুবে যাচ্ছে, বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু বাড়ির সদর দরজায় এসে ওর পা থমকে গেলো। জেরিন ওর মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। এতো তাড়াতাড়ি এই মেয়ে এখানে কীভাবে এলো! ছোট্ট মেয়েটি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো নিজের মায়ের দিকে। মায়ের চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে। পাশে যেতেই শক্ত করে হাত ধরে জিজ্ঞাসা করা হলো,
– তুই ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিস?
শক্ত বাঁধনে আটকা পরে মেয়েটি ছটফট করতে করতে বললো,
– ও আগে ধাক্কা..

ঝড়ো বেগে একটি চড় আছড়ে পরলো গালে। মনে হচ্ছে গালটি যেনো আগুনে ঝলসে যাচ্ছে৷ তীব্র চিৎকার করে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করতেই মায়ের হাতটি ওর চোয়াল চেপে ধরে বললো,
– চুপ, একদম শব্দ করবি না। যতোটুকু প্রশ্ন করছি ততোটুকুর উত্তর দে৷ তুই ওরে ধাক্কা মারছিস কেন? খন্নাসী, অপয়া, অলুক্ষণে মেয়ে। যেখানে পা দিস, সেই জায়গাই ছারখার করে ফেলিস। ধাক্কা মেরে বাচ্চা মেয়েটার দাঁত ভেঙে ফেলেছিস!

ছোট্ট মেয়েটি অবাক হয়ে জেরিনের দিকে তাকালো। ওর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে। মেয়েটি ভাবলো, ওর এইটুকুনে দু হাতে এতো শক্তি যে জেরিন আপুর দাঁত ভেঙে গেলো!
মায়ের অনবরত আঘাতে গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে৷ মেয়েটি মায়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে হাতের বাধন হতে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। তা দেখে মা আরও রেগে গেলেন। পাশে রাখা ছিলো চুলায় আগুন জ্বালানোর লাকড়ি। কোনো কিছু না ভেবে সেটি তুলে নিয়ে আঘাত করতে উদ্যোত হলে জেরিনের মা এগিয়ে এসে আটকে দিলেন।
– থাক ভাবি, বাচ্চা মানুষ। এতো মাইরেন না। জেরিনের দাঁতটা আগে থেকে নড়তেছিলো। তাই হালকা আঘাত পাওয়ার সাথে উঠে গেছে। সময়ের আগে উঠে যাওয়ায় ব্যথা একটু বেশি হচ্ছে৷ প্রথমবার দাঁত উঠলো তো। রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গেছে। আমি এইজন্য নালিশ করতে আসি নাই৷ আপনার মেয়ে এখনো ছোটো আছে, এখনি বড়দের গায়ে হাত তুলছে। এই অভ্যাস থেকে গেলে সমস্যা। মেয়ে মানুষের এতো গরম মেজাজ মানায় না। একটু হাঁক-ডাক দিয়েন। তাহলেই হবে। মারামারি কইরেন না। পরে লোকে বলবে আমার জন্য আপনার মেয়েটা এতো মাইর খাইলো। চল রে জেরিন। আমরা বাড়ি যাই৷ এরপর থেকে মানুষ দেখে খেলতে যাবি৷

জেরিনরা চলে যেতেই ছোট্ট বাচ্চাটির চুল মুঠো করে ধরে মা আবার জিজ্ঞাসা করলো,
– ওই জানোয়ারের বাচ্চা, তোর এতো তেজ আসে কইত থেকে?
– ও আমারে আগে ধাক্কা মারছে।
– আবার মুখে মুখে তর্ক করে। যতোটুকু প্রশ্ন করছি, ততোটুকুর উত্তর দিবি৷ বেশি কথা কইলে জিহবা টান মাইরা ছিড়া নিবো। এই তুই বাইরে গেছিস কোন সাহসে? তোরে না ঘরে ঘুমাইতে কইছিলাম।

ছোট্ট মেয়েটির মুখে কোনো উত্তর নেই। কি জবাব দিবে সে? খেলতে গিয়েছিলাম, বললে মা রেগে গিয়ে আরেক দফা মারপিট শুরু করবে। এর থেকে মৌন থাকা ভালো। বেশি কথা মায়ের পছন্দ না। কিন্তু মা নিজে অতিরিক্ত কথা বলে। এখন যেমন বলতেছে,
– ধোয়া জামাটা মাত্র গায়ে দিয়ে দিছি। কোন ক্ষেতে গড়াগড়ি দিয়ে এমন হাল করছিস? চন্ডালের মতো সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরিস। মেয়ে মানুষ, ঘরে থাকবি। তা না করে কতোগুলা রাস্তার ছেলেমেয়ের সাথে ছুটাছুটি করে, মারামারি করে। এই মাস্তান হবি তুই?

চেলা কাঠের একটা আঘাত সপাং করে গায়ে এসে পরতেই ছোট্ট মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠে দৌড় দিলো নিজের ঘরের দিকে। পেছন পেছন মেয়েটির মা-ও ছুটছে।

‘কী হলো কথা বলছো না কেনো? এই শুনতে পাচ্ছো না? এই, এই?’
গুলিস্তা চোখ মেলে চাইলো। আশেপাশে তাকিয়ে সে কোথায় আছে বুঝার চেষ্টা করলো। তন্দ্রা ভাবটা কখন গাঢ় ঘুমে পরিণত হয়েছে টেরই পায় নি। গাঢ় ঘুম না হলে কেউ স্বপ্ন দেখে নাকি! আচ্ছা, ওটা তো পুরোপুরি স্বপ্ন ছিলো না।
– তুমি কি সত্যি ঘুমাচ্ছিলে?

গুলিস্তা সে প্রশ্নের উত্তর দিলো না। আশেপাশে তাকিয়ে রাতের ব্যস্ত নগরীর ছুটে চলা যানবাহন দেখতে লাগলো। জেরিনের সাথে দেখা হওয়ার পরপরই ওরা রিসিপশন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন রাত প্রায় দশটা পেরিয়ে গেছে। এতো দ্রুত ঘুম পাওয়ার কথা না৷ কোনো ফাংশন এটেন্ট করার অভ্যাস গুলিস্তার নেই৷ হয়তো এজন্যই অল্পতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে।
– এই পরিস্থিতিতে কেউ এতোটা স্বাভাবিক কীভাবে থাকতে পারে! তোমাকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তুমি কিছু বলছো না কেনো?

গুলিস্তা বার কয়েক চোখের পলক ফেলে বললো,
– কি বলবো?
– তোমার কি আসলেই মাথায় কোনো সমস্যা আছে? এতোদিন আমার শুধু সন্দেহ ছিলো, আজকে শিওর হয়ে গেলাম। একটা মেয়ে তোমার নামে এতোগুলা নোংরা অভিযোগ তুলে গেলো অথচ তুমি তাকে কিছু বললে না। আচ্ছা ঠিক আছে, ওখানে কিছু বলো নি। কিন্তু তুমি কি আমাকেও কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করছো না?

রেহবারের উত্তপ্ত মেজাজের কোনো প্রভাব গুলিস্তার উপর পরলো না। সে ভাবছে কতো দ্রুত বাড়ি পৌছাবে। জানালা দিয়ে রাস্তায় তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো, ওরা এখন কোথায় আছে। দু হাতে শক্ত করে স্টেয়ারিং চিপে ধরে রেহবার নজর রেখেছে সামনের দিকে। পাশে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালেই মেজাজ সপ্ত আসমানে উঠে যাচ্ছে। তার উপর ওর হেয়ালি আচরণ সেই আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। নিরবতা যে এতোটা বিরক্তির কারন হতে পারে, আগে জানা ছিলো না। কথা না বলেও মানুষকে অশান্তিতে রাখা যায়। এর ভুক্তভোগী রেহবার নিজেই।
– জাহিদ ছেলেটাকে তুমি চেনো?

গুলিস্তা ঘুরে তাকালো রেহবারের দিকে। জাহিদকে নিয়ে যখনি কোনো আলোচনা শুরু হয়, তা কোনদিকে মোড় নেয় তা গুলিস্তার জানা আছে। কথা শেষে সবাই গুলিস্তাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দেয়। রেহবারও কি তাই করবে? গুলিস্তা কি সেদিনের পুরো ঘটনাটা রেহবারকে বুঝিয়ে বলবে? এতে সে গুলিস্তাকে ভুল বুঝবে না৷ কিন্তু মাথার ভেতর কোথায় সুক্ষ্মভাবে ঝংকার তুলছে, “যতোটুকু প্রশ্ন করছি ততোটুকুর উত্তর দে৷”
– কথা বলছো না কেনো? উত্তর দেও।
গুলিস্তা সে কথা শুনতে পেলো কিনা কে জানে! ওর কানের কাছে মা অনবরত বলে চলেছে,
যতোটুকু প্রশ্ন করছি ততোটুকুর উত্তর দে৷ ওই তো মায়ের হাতে চেলাকাঠ৷ মারবে নাকি আবার!

গুলিস্তা ক্ষীণ স্বরে বললো,
– চিনি৷
– উনি যে ঘটনার কথাটি বললো। না মানে ওই যে স্কুল ফেরার পথে..। ওটা সত্য?

প্রশ্নটি করতে রেহবারের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন না করেও তো উপায় নেই। সত্যি জানতে হবে৷ মন খচখচ করছে৷ তবুও ক্ষীণ আশা রয়ে গেছে, হয়তো গুলিস্তা এমন কিছু বলবে যা রেহবারের আশংকাকে দূর করতে সাহায্য করবে। রেহবার চায়, সে ভুল প্রমাণিত হোক। অভিযোগের বিপরীতে গুলিস্তার সমস্ত যুক্তি তর্ক মেনে নিতে সে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। অথচ গুলিস্তা বললো,
– হ্যাঁ। সত্য।

সীটে হেলান দিয়ে গুলিস্তা চোখ বন্ধ করে নিলো। বিভীষিকাময় সেদিনের স্মৃতি সে মনে করতে চায় না। তবুও সবাই ওকে কেনো মনে করিয়ে দেয়! বারবার একই ঘটনার উল্লেখ করে কেনইবা ওকে যন্ত্রণা দেয়৷ বেশ তো ছিলো এই কয়েকটা মাস। আবার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। গায়ে ভীষণ ব্যথা। গুলিস্তা শক্ত করে চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ওদিকে রেহবার যেনো নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেছে৷ ভাগ্যিস রাস্তায় তেমন যানজট নেই। না হলে এতোক্ষণে কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতো নিশ্চিত। কারন রেহবারের দৃষ্টি সড়কের দিকে নেই। সে অবাক চোখে চেয়ে আছে গুলিস্তার দিকে। যে খুব স্বাভাবিকভাবে নিজের অপকর্মের স্বীকারোক্তি দিয়ে এখন চোখ বুজে নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়ার পায়তারা করছে।
বাকিটা পথ একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। বাড়ির সামনে আসতেই, রেহবার ধমকে উঠলো,
– নামো গাড়ি থেকে।

গুলিস্তা ধীরেসুস্থে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে সোজা বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।
গাড়ি পার্ক করে রেহবার কিছুক্ষণ এলোমেলো ভাবে পায়েচারি করলো। এখন কি করা উচিত? মায়ের সাথে কথা বলবে? এতো শখ করে ছেলের বিয়ে দিয়েছে! গুলিস্তাকে নিজের মেয়ের মতোন আদর করে৷ এখন এমন কথা শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে। দূর দেশে থেকে অযথা অস্থিরতায় ভুগতে থাকবে৷ মাকে সেই কষ্ট দিয়ে স্বার্থপরতার পরিচয় দিতে ইচ্ছে করলো না।
গুলিস্তার সাথে কথা বলা যায়। কিন্তু রেহবার নিশ্চিত, কথা বলতে গেলে সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে৷ বউয়ের গায়ে হাত তোলার মতো জঘন্য অপরাধ সে করতে চাইছে না। আর যে ব্যক্তির অপরাধবোধ নেই, তাকে কি বলা যেতে পারে! নিজের বিশ্রী অতীত স্বামীর সম্মুখে এসে গেছে, এই নিয়ে ওর কোনো চিন্তা নেই, ভয় নেই। এলোমেলো চিন্তার কোনো কূল কিনারা খুঁজে না পেয়ে রেহবার নিজের ঘরের দিকে গেলো। যদিও গুলিস্তার সামনাসামনি হওয়ার ইচ্ছে একদম নেই। তবুও কীসের আশায় যাচ্ছে কে জানে!
সে যে আশায় আসুক না কেনো, তাতে পুরো জল ঢেলে দিলো গুলিস্তা। রেহবার অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো গুলিস্তা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে অলরেডি ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে৷ রেহবার আর সেখানে এক মুহুর্ত রইলো না। উল্টোপথে ফিরে গেলো গাড়ির দিকে৷ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে তবুও ফিরবে না এই বাড়িতে, এই মেয়ের কাছে।

(চলবে)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
অষ্টাদশ পর্ব

সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে অভিযোজন ক্ষমতা বিদ্যমান। বিরুপ পরিবেশের সাথে লড়াই করতে করতে যারা টিকে যায়, তারাই বেঁচে থাকার স্বাদ ভোগ করে। জীবনে পরিবর্তন আসবেই, তা মেনে নিয়ে নিজেকে খানিকটা ভেঙেচূড়ে নতুন করে গড়ে নিতে হয়। আঁধারে বসবাস করতে করতে গুলিস্তাও একসময় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কীভাবে টিকে থাকতে হয়, ভালো থাকতে হয় বুঝে গেছে। যে স্মৃতিগুলো ওকে ভীষণ পীড়া দেয়, সেগুলো এখন আর মনে করে না। ভুলে গিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করে।
গতকাল রিসিপশন থেকে ফিরে এসে সেই যে ঘুমিয়ে পরেছিলো, এক ঘুমে সকাল এসে গেছে। চোখ মেলে ভোরের আলোয় স্নান করে ভালো থাকার প্রত্যয় নিয়ে নতুন দিন শুরু হলো। বিছানার অপরপাশের জায়গাটুকু ফাঁকা। রেহবারের খোঁজে দ্রুত হলরুমে এসেও ওর দেখা মিললো না। চিন্তিত মনে কিচেনে গিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরী করে নিলো। ডাইনিং টেবিল খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করতে করতে বারংবার ঘড়ির দিকে চোখ তাকানো।
রেহবার ফিরতে ফিরতে প্রায় নয়টা বেজে গেলো। অফিসে যেতে হবে। ফ্রেশেনআপ হতে বাড়ি ফেরা৷ ডাইনিং টেবিলে গুলিস্তাকে দেখে ক্ষীণকাল চিন্তা ভাবনা করে নিলো। এভাবে দু’পক্ষই চুপচাপ থাকলে সমাধান মিলবে না। গুলিস্তা তো চিরকাল মৌনব্রত পালন করে অনায়াসে দিন কাটিয়ে দিতে পারবে কিন্তু রেহবার? ওর পক্ষে এভাবে দিন পার করা অসম্ভব। একটা রাত কেটেছে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে৷ বাকি দিনগুলো এহন যন্ত্রণা ভোগ করার কথা ভাবলেই শ্বাস আটকে যাবার যোগাড়।
রেহবারকে দেখে গুলিস্তা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরলো। ও নিশ্চয়ই এখনো ব্রেকফাস্ট করেনি। শুকনো মুখে বসে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। সকালের অনেকটা পেরিয়ে গেছে৷ ওর নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে৷ তাই বললো,
– ফ্রেশ হয়ে আসছি।

সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে রেহবার নিজের ভাবনা চিন্তায় নিজেই অবাক হলো৷ সে এখনো গুলিস্তার খাওয়া নিয়ে ভাবছে। এতোকিছুর পরেও মেয়েটার জন্য মন উগ্রীব হয়ে উঠছে। কখন এতোটা ভালোবেসে ফেললো ওকে!

জোর করে খাবার টেবিলে বসলেও এখন রেহবারের মেজাজের পারদ তিরতির করে উপরে উঠে যাচ্ছে। গুলিস্তা অন্যসব দিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই নাস্তা খাচ্ছে, আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে৷ অথচ রেহবারের মুখে সব বিস্বাদ ঠেকছে। ওকে অশান্তির সাগরে ফেলে দিয়ে একটা মানুষ এমন আয়েশ করছে, ভাবতেই সারা গা জ্বালা করে উঠলো। নাস্তার প্লেট সামনে থেকে সরিয়ে টেবিলে দু হাত রেখে লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। কখনো এমন কথা মুখে আনতে হবে, স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। তবুও পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বলতেই হচ্ছে।
– তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং বুঝার চেষ্টা করবে। আমার বিনীত অনুরোধ, সব বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকবে না।

রেহবারের শান্ত কন্ঠ, চোখে মুখে কঠোরতা। গুলিস্তার ভড়কে যাওয়া উচিত ছিলো কিন্তু সে ভড়কালো না। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে স্বাভাবিকভাবে বললো,
– বলুন।

রেহবার মনে মনে কথা গুছিয়ে রেখেছিলো। গতরাত রাস্তায় গন্তব্যহীন ড্রাইভ করে যেসব ভেবেছিলো, যেভাবে কথা গুছিয়ে নিয়েছিলো এখন সেগুলো এলোমেলো লাগছে। তবুও আজ বলতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে ও নিজেই মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে যাবে নিশ্চিত।
– দেখো, আমি তোমার মতো সকল পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে পারি না। এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও কিছুই হয়নি এমনভাবে দিন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ের পর থেকে আমি অনেক কিছু ইগনোর করে গেছি কিন্তু গতকালের ঘটনাটি ইগনোর করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি এতোটাও মহানুভাব নই যে তোমার সম্পর্কে এসব জানার পরও আমি তোমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে হেসেখেলে সংসার করবো। মানুষের অতীত থাকতেই পারে। মেয়ের পরিবার সেটা লুকিয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে সেটিও স্বাভাবিক। এখানে ভুল আমাদেরও রয়েছে, আমরাও কোনো খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করিনি। এ পর্যন্ত সবকিছু আমি মেনে নিতাম যদি আমাদের সম্পর্কটাকে তুমি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে৷

বিয়ের পর থেকে গুলিস্তার ঠান্ডা স্বভাব, নির্লিপ্ততার কথা ভেবে রেহবারের গলা শুকিয়ে এলো। সামনে থাকা পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে বললো,
– তুমি বুঝতে পারছো, আমি কোন অস্বাভাবিকতার কথা বলছি?

গালে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ ভেবে গুলিস্তা জবাব দিলো,
– নাহ।

রেহবার মনে মনে ভীষণ অবাক হলেও মুখে বাঁকা হেসে বললো,
– তোমার থেকে এমনটাই উত্তর মিলবে, এ আর নতুন কি! শুনো মেয়ে, বিয়ের পর থেকে তুমি আমাকে প্রতিনিয়ত অপমান করে গেছো। তোমার প্রতি আমার অনুভূতিকে, আমার ভালোবাসাকে, আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কে তুমি অপমান করেছো। তোমার মনে অন্য কারো বাস, অথচ দিনের পর দিন আমার সাথে ছিলে, আমার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছো। এসব ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে উঠছে। এতোদিন তুমি কীভাবে নীরব ছিলে? আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি। আরে তুমি তো এমন এক আজব প্রানী যে, আমাদের কাউকে বুঝতেও দেওনি। আগ্রহ প্রকাশ না করলেও, অনাগ্রহও দেখাওনি কখনো। আমরা বুঝতাম কীভাবে? আমার নিজের এখানে কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও অপরাধবোধে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। একটা মেয়ের সম্মতি না থাকার পরেও আমি তাকে ছুঁয়েছি। আমার পবিত্র ছোঁয়ায় তার নিশ্চয়ই গা গুলিয়ে উঠতো। মনে মনে রক্তাক্ত হতো প্রতিক্ষণ। তুমি ভাবতেও পারবে না, নিজের কাছে সবসময় স্বচ্ছ থাকা মানুষটির জন্য এই অপরাধবোধের অনুভূতিটুকু কতোটা যন্ত্রণার।
যাক গে সেসব কথা। যে নিজে চোখ বন্ধ করে থাকে, তাকে দুনিয়ার আলো দেখানো সম্ভব নয়। আমার নিজেরও আর কোনো ইচ্ছা নেই৷
তবে তোমাকে বলে রাখি, কাজটি তুমি একদম ঠিক করোনি। বিয়ের পরে আমাকে জানাতে পারতে।
সেসব কথাও না হয় বাদ দিলাম। ওগুলো এখন অতীত। কিন্তু গতকাল তুমি যে কাজটি করছো, সেটা কি ঠিক ছিলো? তোমার থেকে কোনো এক্সপ্লেইনেশন পাওয়ার অধিকার কি আমি রাখি না? অথচ তুমি নীরব রইলে।
– আমি তো উত্তর দিলাম।

রেহবার আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে দেখলো গুলিস্তা নিজের দুটো হাতের আঙ্গুল কচলে যাচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে। যেনো এই বিষয়ে কথা বলতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। মেয়েটা তাহলে সামান্য হলেও ন্যায় অন্যায়ের জ্ঞান রাখে৷ ওর অস্বস্তি দেখে রেহবারের খানিকটা ভালো লাগলো। সে নিজে অপরাধবোধে মরে যাচ্ছে আর এই মেয়ে এতো এতো অন্যায় করেও মাথা উঁচু করে চলাফেরা করে যাচ্ছিলো। নিজের অপকর্মের লজ্জা, অপরাধবোধে না ডুবা পর্যন্ত রেহবার ওকে কিছুতেই ক্ষমা করবে না। খানিকটা প্রতিশোধের নেশায় ভেতরটা বুদ হয়ে রইলো। সাইলেন্ট ট্রিটমেন্ট ও একাই করতে পারে না। একই অস্ত্র রেহবার নিজেও ব্যবহার করবে ওর বিপক্ষে। নিজের ভুল মেনে নিয়ে, অন্যায় স্বীকার করে যদি খানিকটা কেঁদেকেঁটে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবেই রেহবার পুনরায় ভেবে দেখবে। না হলে নিজের সিদ্ধান্তে সে বদ্ধ পরিকর।
খানিকটা কড়া সুরেই আলোচনার সমাপ্তি টেনে বললো,
– অনেক ভেবেচিন্তে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার দিকে তাকালে, তোমার আশেপাশে থাকলে আমার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। তোমার দেওয়া ধোঁকা, তোমার করা অন্যায় আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। আমার কিছুদিন সময় দরকার। নিজেকে বুঝাতে, নিজের মনের কথা বুঝতে আমি কিছুদিন স্থির মস্তিষ্ক নিয়ে দিন কাটাতে চাই। তোমার সংস্পর্শে সেটা সম্ভব নয়। তাই আমি ঠিক করেছি, তুমি কিছুদিন তোমার বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকবে। আমাদের দুজনেরই কিছুদিন সময় নেওয়া উচিত। তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নেও রাতের বাসে তুলে দিয়ে আসবো।

গুলিস্তা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
– আমি একা যাবো?
– হ্যাঁ। টিকিট বুক করা হয়ে গেছে৷ রাত দশটার বাস ছাড়বে। রেডি হয়ে থেকো।

রেহবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোর্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মনে অদ্ভুত শান্তি লাগছে। চ্যালেঞ্জিং কোনো ক্লাইন্ট মিটিং শেষ হওয়ার পর যেমন ভারহীন লাগে, তেমন লাগছে।

এদিকে গুলিস্তা অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে রেহবারের যাওয়ার পাণে চেয়ে আছে৷ ওর তো আরও কিছু বলার ছিলো। মানুষটা না শুনে চলে গেলো কেনো?
ও কখনো একলা জার্নি করেনি। রাতের বাসে একলা কীভাবে এতোটা পথ পাড়ি দিবে? বিয়ের পর প্রথমবার বাবার বাড়ি যাচ্ছে। জামাই ছাড়া মেয়ে একলা কীভাবে নাইয়র যাবে! বাড়ির লোকজন জানতে চাইলে কী জবাব দিবে? পাড়ার লোকজন শুনলে আবার একগাদা কথা ছড়াবে। সেসব কীভাবে সামলাবে?
কতোদিন থাকবে সেটাও তো বলে গেলো না। সেই হিসেব করে প্যাকিং করতে হবে তো নাকি! গুলিস্তা চলে গেলে রেহবারের খাওয়া দাওয়ার কী হবে সেটাও একটা চিন্তা। মালা এমনিতেই ফাঁকিবাজ মেয়ে। কাজে আসে না ঠিকমতো৷ গুলিস্তা না থাকলে সে আরও ফাঁকিবাজী করবে।

ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ের কাপে ঝটপট চুমুক দিয়ে গুলিস্তা শক্ত করে কোমড়ে আঁচল গুজে নিলো। এখন অনেক কাজ গুছাতে হবে। ফ্রিজ থেকে গরুর গোশতের পুরো প্যাকেট বের করে বরফ ছাড়তে দিলো। এগুলো কষিয়ে পটে ভরে রেখে দিলে রেহবার গরম করে খেয়ে নিতে পারবে। ও যেহেতু নিজে রাঁধতে পারে, তাই ভাতটুকু গরম গরম রেঁধে নিতে সমস্যা হবে না। কিন্তু অফিস থেকে ফিরে ভাত তরকারী রান্না করে খাওয়ার কষ্ট ওকে দিতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্ত শরীরে একটুও রাঁধতে ইচ্ছে করে না। ঝামেলা হবে অফিস থেকে ফেরার পর কফি খাওয়া নিয়ে। ক্লান্ত শরীরে নিজে কফি বানিয়ে খেতে মানুষটার যা কষ্ট হবে! এই ভেবে গুলিস্তার মন কেমন করে উঠলো। কেবিনেটের একদম সামনের দিকে কফির পট, চিনি, কফি মগ গুছিয়ে রেখে দিলো।

প্যাকিং করতে গিয়ে সে আরেক ঝামেলা। কাবার্ড ভর্তি শাড়ি। কোনটা রেখে কোনটা নিবে ভেবে পাচ্ছে না। ছোট একটা কাপড়ের ব্যাগে রাফ ইউজের দুটো শাড়ি ও আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষার করলো রেহবারের ফেরার।

দুপুরের খাবার খেতে রেহবার এলো না। রোজ সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরতো অথচ আজকে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো রেহবার এলো না। এইটুকু সময়ে গুলিস্তা পুরো বাড়ি গুছিয়ে নিয়েছে। ঘরের প্রতিটি কোণা পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা যাতে অন্তত সপ্তাহ খানিক ঘর এলোমেলো না হয়।
সন্ধ্যা থেকে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে পার করলো। কখনো সদর দরজায় চেয়ে রইলো। অবশেষে রেহবার এলো রাত নয়টা পেরিয়ে। সদর দরজা পেরিয়ে রেহবারের গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করতেই গুলিস্তার মুখে হাসি ফুটলো। চটজলদি সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে সে হাসি লুকিয়ে ফেলে স্বাভাবিকভাবে রেহবারের সামনে দাঁড়ালো। ওর দিকে তাকিয়ে রেহবার বললো,
– রেডী হওনি এখনো?
– এই তো হচ্ছি।

অফিসের পোশাক না ছেড়ে শুধুমাত্র ল্যাপটপের ব্যাগটি জায়গা মতো রেখে বিছানায় বসলো৷ গুলিস্তাকে বিদায় করে একেবারেই ফ্রেশ হয়ে নেওয়া যাবে। চোখ বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে মাত্র, গুলিস্তা এসে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
– আপনার কফি।

এই মেয়ে এখনো কফি নিয়ে পরে আছে! অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। ওর সাথে কোনো কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। নীরবে কফির মগ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিলো। গুলিস্তা আবার প্রশ্ন করলো,
– টেবিলে খাবার দিয়ে দিবো?

রেহবারের ইচ্ছে করলো বলতে,“কিছু করতে হবে না৷ তুমি শুধু আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও।”
বিদায়বেলায় আর রুক্ষ আচরণ করতে মন সায় দিলো না। “আর মাত্র কিছুক্ষণ সহ্য করো।” মনকে বুঝিয়ে অনাগ্রহ নিয়ে বললো,
– এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি দ্রুত রেডী হয়ে নেও। বের হতে হবে।

মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে চলে যেতে গিয়েও ফিরে তাকিয়ে বললো,
– কোন শাড়িটা পরবো?

সংসার জলে ভেসে যাচ্ছে এমন সময় এরকম প্রশ্ন শুধুমাত্র গুলিস্তাকে দিয়েই সম্ভব। সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে ওর মধ্যে কোনো ভীতি কিংবা দুঃশ্চিন্তা, কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না। দু চোখ কয়েক সেকেন্ড বন্ধ রেখে নিজেকে শান্ত করে নিয়ে রেহবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চেঞ্জিং রুমে প্রবেশ করে একটা কম্ফোর্টেবল শাড়ি নিয়ে এসে গুলিস্তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার বিছানায় বসে কফির কাপ হাতে নিলো। শাড়ি হাতে নিয়ে গুলিস্তা খুশি মনে রুম হতে বিদায় নিলে রেহবার পুরো ঘরে সচেতনভাবে দৃষ্টি ঘুরালো। চেঞ্জিং রুমে গুলিস্তার পোশাক-পরিচ্ছদ আগের মতোই রয়ে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর মেয়েলি জিনিসপত্র এখনো বিদ্যমান। গুলিস্তা কি তাহলে প্যাকিং করেনি? সোফার পাশে একটি ছোট ব্যাগ দেখে রেহবারের আগ্রহ জন্মালো। ব্যাগ খুলে নিশ্চিত হলো এটি গুলিস্তা সাথে নেওয়ার জন্য গুছিয়েছে। ব্যাগে স্বল্প পরিমাণ পোশাক দেখে রেহবারের মনে হলো গুলিস্তাকে আরও কিছু পোশাক নিতে বলা উচিত। কিন্তু মনের মধ্যে বিতৃষ্ণা চলে এলে আগ্রহ এমনিতেই কমে যায়। সে যা ইচ্ছে করুক। রেহবার ওকে যতোটুকু সম্ভব বুঝিয়ে বলেছে। এরপরেও না বুঝে অবুঝের মতো কার্যকলাপের দায় রেহবার নিজের কাঁধে নিবে না।

গুলিস্তা রেডি হয়ে বেরিয়ে এলে রেহবার নিজেই কাপড়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। একজন ভদ্র লোক কখনো নিজে খালি হাতে হেঁটে, মহিলা মানুষের হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিতে পারে না। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে ডাইনিং টেবিলে গুলিস্তার মোবাইলটি দেখতে পেয়ে রেহবার জানতে চাইলো,
– মোবাইল রেখে যাচ্ছো কেনো?

গুলিস্তা ঝটপট সেটা হাতে তুলে নিলো।
মা কিনে দিয়েছিলো বলে রেখে যাচ্ছে নাকি? প্রশ্ন মনের মধ্যে রেখেই ঘর ছাড়লো। গাড়িতে বসে রেহবারের খেয়াল হলো, গুলিস্তা ওকে ডিনারের কথা বলেছিলো। তার মানে মেয়েটা নিজেও কিছু খায়নি। অন্য সময় হলে হয়তো একটু ভালো লাগতো। কিন্তু এই মুহুর্তে এইসব ন্যাকামি মনে হলো। দীর্ঘপথ জার্নি করতে হবে জেনেও না খেয়ে থাকার বোকামি করতে তো রেহবার ওকে করতে বলেনি। নিজে থেকে এসব আদিখ্যেতা করলে নিজেকেই ভুগতে হবে৷

ব্যস্ত নগরীর কোনো ক্লান্তি নেই। একদল দিনে জেগে রাতে ঘুমায়৷ আরেকদল রাতে জেগে উঠে৷ তাই নাগরিক জীবন সদা সজীব। বাসস্ট্যান্ডে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি বাস। যাত্রীর কোলাহলে মুখরিত বাসস্ট্যান্ড। গাড়ি থেকে নামতেই গুলিস্তা অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো। ওর দিকে তাকিয়ে রেহবারের মনে পরলো ওদের বিয়ের রাতের কথা। এয়ারপোর্টে নেমে তখনও এভাবে অবাক হয়ে চেয়েছিলো ব্যস্ত শহরের দিকে।
যান্ত্রিক জীবনে কেউ কারো জন্য অপেক্ষায় থাকে না। সবাই নিজের তাগিদে ছোটাছুটি করছে। বাস ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। যাত্রীরা বাসের সামনে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নিজের সীটে বসে পরেছে, কেউবা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে ব্যস্ত। অফিস ফেরত ক্লান্ত চাকুরীজীবি একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে৷ বৃহস্পতিবার রাত, বাড়ি ফিরে যাওয়ার আনন্দ ঢাকা পরে গেছে দিনভর অফিসের ফাইলের ক্লান্তিতে৷
রেহবারের পিছু পিছু গুলিস্তা ভীরু পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে। জানালার পাশের সীট নেওয়া ছিলো। গুলিস্তাকে বসিয়ে দিয়ে সীটের উপরের ফাঁকা জায়গায় ব্যাগ রেখে ওকে বললো,
– নামার সময় মনে করে ব্যাগ সাথে নিবে।

গুলিস্তা মাথা দুলিয়ে সায় জানালো।
– তুমি বসো, আমি একটু আসতেছি৷

ওকে বাসে রেখে বাসস্ট্যান্ডের পাশের দোকান থেকে কিছু স্ন্যাকস, কেক, খাবার পানি কিনে নিলো। বোকামির জন্য না খেয়ে বাসে তো উঠে গেলো। দূরের পথের জার্নি। রাত কেটে যাবে জেগে থেকে। ক্ষুধা পাবে নিশ্চয়ই। ক্ষুধায় আধমরা হয়ে গেলেও এই মেয়ে বাস থেকে নেমে খাবার কিনে নিতে পারবে না। বাসের দিকে ফিরে যেতে গিয়ে খেয়াল করলো, গুলিস্তা চঞ্চল চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ওকে খুঁজছে। রেহবার ইচ্ছে করে খানিকক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো। গুলিস্তা চাতক পাখির মতো তাকিয়েই আছে। রেহবারকে দেখতে পেয়ে তবেই স্থির হয়ে নিজের সীটে বসলো।

গুলিস্তার পাশের সীটে বসে পানির বোতল, কেকের প্যাকেট সহ বাকি খাবারগুলো গুছিয়ে রেখে দিলো। পকেট হতে কিছু ক্যাশ বের করে গুলিস্তার হাতে দিয়ে বললো,
– এগুলো রাখো। প্রয়োজনে খরচ করবে।

টাকাগুলো যত্ন সহকারে পার্সে রেখে গুলিস্তা রেহবারের দিকে তাকালো। আরও কিছু শোনার আগ্রহ সেই চোখে৷ রেহবারের তো আর কিছু বলার নেই। গুলিস্তার আগ্রহভরা চাহনিতে থমথমে খেয়ে রেহবার দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।
– বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে৷ সাবধানে যাবে।

এক পা এগুতেই বাঁধা পেয়ে ফিরে তাকাতে হলো। গুলিস্তা ওর কোর্টের হাত টেনে ধরেছে৷ ফিরে তাকাতেই ডাগর ডাগর চোখ দুটোর দেখা মিললো।
– বাস থেকে নেমে বাড়ি যাবো কীভাবে?

সরল প্রশ্নটি রেহবারকে দ্বিধায় ফেলে দিলো। সে কি আদোও ঠিক কাজ করছে? একটু বেশি নিষ্ঠুর আচরণ হয়ে যাচ্ছে না?
গুলিস্তার হাতটি নিজের হাতে জড়িয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।
– বাস বগুড়ায় থামবে। সুপারভাইজারকে বলে দিচ্ছি, বগুড়ায় পৌঁছে গেলে তোমাকে জানিয়ে দিবে। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। বাসস্ট্যান্ড থেকে বেশি দূর নয় তোমাদের বাড়ি৷

গুলিস্তা যদি একবার বলতো, আমি একা এতোদূর যেতে পারবো না। রেহবার কোনোকিছু না ভেবে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। কিন্তু গুলিস্তা বললো,
– আচ্ছা।

বাস থেকে নেমে রেহবার অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। গুলিস্তার পাশের সীটের যাত্রীটিকে না দেখা পর্যন্ত স্বস্তি মিলছে না। গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে একটি মেয়ে বাসে উঠে পরলো। গুলিস্তার পাশের সীটে বসে মিষ্টি হেসে বললো,
– এটা আমার সীট। একটু হলে বাস মিস করে ফেলতাম। রাস্তায় যা জ্যাম পরেছে আজ!

রেহবার দূর থেকে লক্ষ্য করলো। ধীরে ধীরে দৃষ্টি সীমা পেরিয়ে মিলিয়ে গেলো লাল রঙা বাসটি। রেহবার তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাওয়া বাসটিতে কেউ একজন ছিলো, যাকে রেহবার ভীষণ ভালোবেসেছিলো। যার সাথে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন বুনেছিলো। চায়ের কাপে নিশ্চুপ রাত্রিটা না হয় রেহবার একা একা বকবক করে কাটিয়ে দিতো। পাশে থাকতো পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত মেয়েটা। যে একদৃষ্টিতে রেহবারের দিকে তাকিয়ে থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনতো। তবুও তো কেউ একজন থাকতো রেহবারের পাশে। এখন একলা বাড়িতে সে কীভাবে রবে?

(চলবে)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
উনবিংশ পর্ব

হিমালয় পর্বতের কাছাকাছি হওয়ায় উত্তরবঙ্গে শীতের আগমন ঘটে ডিসেম্বরের শুরুতে। দূর পাল্লার বাসগুলো সারারাত যাত্রা করে গন্তব্যে পৌছায় ভোরবেলা৷ বাস থেকে নেমে যাত্রীদের থাকে ঘরে ফেরার তাড়া। যানবাহনের সংকটের কারনে এই সুযোগে যাত্রীদের কাছ থেকে একটু বেশি অংকের ভাড়া আদায় করে নেওয়া যায়। শীতের ভোরে লেপের নিচের আরামদায়ক ঘুম ছেড়ে বদিয়ার তার ভ্যানগাড়ি নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে বসে আছে। গায়ে তার ফুটপাত থেকে কেনা মোটা সোয়েটার। খুব একটা শীত লাগছে না। তবুও বউটা ঘর ছাড়ার সময় চাদর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে৷ আজকে বাসে তেমন একটা যাত্রী নেই৷ যারা নেমেছিলো, তারা ইতোমধ্যে অটোতে করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। বদিয়ার হতাশ হয়ে ভ্যানগাড়ির প্যাটেলে পা দিয়ে চাপ দিতেই আবছা কুয়াশায় একটি নারী অবয়ব দেখতে পেলো। এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টিতে বাহনের খোঁজ করছে। আঁধারে আশার আলো দেখতে পেয়ে ভ্যান রেখে বদিয়ার সেদিকে এগিয়ে গেলো। নারী অবয়বটি দৃষ্টিসীমায় আসতেই পরিষ্কার হলো নারীটির মুখের আদল। ওকে চিনতে পেরে বদিয়ার অবাক হয়ে শুধালো,
– তুই আকবার বাড়ির ছোট মাইয়া না?

গুলিস্তা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ধীরেসুস্থে উত্তর দিলো,
– হ্যাঁ৷
– শুনছিলাম তোর নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। অনেকদিন পর বাপের বাড়ি আইলি। একা আসছিস? জামাই সাথে আসেনি?
– নাহ।
– বাড়ি যাবি তো? আয়, আয়। আমি পৌছায় দেই।

গুলিস্তার হাত থেকে কাপড়ের ব্যাগটি নিজের হাতে নিয়ে বৃদ্ধ বদিয়ার অতি উৎসাহে ভ্যানগাড়িতে রেখে দিলো। ভ্যানের একপাশে বসে গুলিস্তা শীতে কাঁপছিলো। এদিকে এতো ঠান্ডা পরেছে কে জানতো! মনে হচ্ছে অন্য দেশে চলে এসেছে। বদিয়ার তার ব্যাগ হতে নিজের চাদরটা বের করে পরম যত্নে গুলিস্তার গায়ে জড়িয়ে দিলো। মেয়েটাকে দেখলেই নিজের মেয়ের কথা মনে পরে যায়৷
– তুই এখনো চুপচাপ থাকিস! শ্বশুরবাড়ির লোক কিছু বলে না?

ফাঁকা রাস্তায় ভ্যানগাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধ বয়সে চুপচাপ থাকতে ইচ্ছে করে না। কারনে অকারণে, পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথে আলাপ করতে বসে যায় বদিয়ার।
– মাগো, পরেরবাড়িতে টিকে থাকা অনেক কষ্ট৷ এতো সহজ সরল হইলে, লোকে তোরে পায়ের তলায় পিষ্যা চইলা যাবে৷ তোর মায়ে কেন যে এমনে হুট কইরা বিয়া দিয়া দিলো। শুনলাম, মেলা দূরেই নাকি শ্বশুরবাড়ি?

গুলিস্তা জবাব দিলো,
– সিলেটে।
– তোর মায়ে খোঁজ খবর নিতে যায়?
– নাহ।
– কী পাষাণ মায়ের মন! বাচ্চাকাল থাইকা মাইয়াটারে মারপিট আর ধমকের উপরে রাখছে৷ শ্বশুরবাড়ির লোক কেমন, আম্মা? মারপিট করে?
– নাহ। সবাই ভালো।
– মন দিয়া সংসার করবি আম্মা। মাইয়ার মানুষের আসল ঘর স্বামীর বাড়ি। তোর তো বাপের বাড়ি থাইকাও নাই।

গুলিস্তা যখন বাড়িতে পৌছালো, দিদার আড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে মাত্র। গুলিস্তাকে ভ্যান থেকে নামতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বদিয়ার ব্যাগ নামিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললো,
– বাসস্ট্যান্ডে আম্মারে দেইখা সাথে কইরা নিয়া আইলাম।

উত্তরে দিদার কিছু বললো না। বদিয়ারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গুলিস্তাকে বললো,
– ভিতরে যা।

গুলিস্তাকে দেখে পুরো বাড়িতে নিস্তব্ধতা নেমে এলো হুট করে৷ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত গুলিস্তাকে বৈঠকখানার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে সীমা বেগম রাখে ফুঁসছেন। তার একপাশে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে শর্মী। সীমা বেগম বললেন,
– ওরে জিগাও, এখানে কেন আসছে?

শর্মী অনেক সাহস সঞ্চার করে মিনমিনিয়ে বললো,
– সারারাত জার্নি করে আসছে। ওরে ঘরে নিয়ে যাই আম্মা৷ পরেও আলাপ করা যাবে।
– পরে কি আলাপ ওর সাথে! জামাই ছাড়া মেয়ে একলা বাপের বাড়ি আসছে৷ সারা গ্রামে হৈ হৈ পরে যাবে৷ কয়জনের মুখ বন্ধ করবা তুমি। আল্লাহ জানে কী অকাম ঘটায় আসছে৷

গুলিস্তার দিকে তাকিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে জানতে চাইলো,
– ওই কথা কস না কেন?

গুলিস্তার পৃথিবীতে একমাত্র আতংকের নাম সীমা বেগম। মায়ের মুখটা কল্পনা করেই সে ভয়ে কেঁপে উঠে। ছোটবেলা থেকেই মায়ের অকারণ রোষের স্বীকার হতে হয়েছে। সীমা বেগমের সামান্যতম মেজাজের হেরফের হলেই তার খেসারত দিতে হতো গুলিস্তাকে। গুলিস্তা সবসময় চেষ্টা করতো মায়ের দৃষ্টি হতে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে৷ ঘরের এক কোণায় চুপটি করে বসে থাকতো যাতে ওর নিঃশ্বাসের শব্দও মায়ের কান অব্দি না পৌঁছায়। গুলিস্তার কথার আওয়াজে সীমা বেগমের মানসিক শান্তি নষ্ট করে দেয়। ছোট্ট মেয়েটা একসময় কলকল করে অনর্গল কথা বলতো। সীমা বেগম একদিন ভয়ংকরভাবে ওর গলা চিপে ধরে বলেছিলো,
– এতো আনন্দ আসে কই থেকে? আমার সুখের জীবনটা পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসে৷ রাক্ষসী একটা। তোর মুখ থেকে আর একটা আওয়াজ বের হইলে গলা টিপে একদম মেরে ফেলবো।

মায়ের অতর্কিত আক্রমণ থেকে সেদিন দিহান বাঁচিয়ে নিয়েছিলো বলে গুলিস্তা এখনো শ্বাস নিচ্ছে।
তবে উচ্ছ্বসিত সেই বাচ্চাটি ওখানেই কোথাও হারিয়ে গেছে। ছোট্ট গুলিস্তার প্রতিটা দিন কেটেছে আতংকে।

মায়ের সামনে কেন যাস তুই? নিজের ঘরে থাকবি খাওয়া-দাওয়া করবি। মায়ের সামনে যাবি না। অযথা কথা বলতে থাকলে মায়ের হাতে একদিন মারা পরবি নিশ্চিত৷
দিহানের সতর্কবার্তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গিয়ে গুলিস্তা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিয়েছে নীরবতার পথে। অনেক বছর পর শর্মী যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে এলো, আদুরে মেয়েটাকে কাছে টানার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু ততোদিনে একলা জীবনে ভীষণ ভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে গুলিস্তা। ওর মানসিক সমস্যার আভাস পেলেও কোনো সাহায্য করতে পারেনি শর্মী।

গুলিস্তা মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
– কিছু করি নাই আমি।
চকিতে সীমা বেগম সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দিলেন গুলিস্তার গালে।
– এখন মিথ্যা কথ বলাও শিখছিস! ওই জামাই কই তোর? সাথে আসে নাই কেন?

গুলিস্তা কান্নাভেজা কন্ঠে জবাব দিলো,
– বাসে তুলে দিয়ে গেলো তো।
যাত্রাকালে মা-বোনের অহেতুক বাক্যালাপে বিরক্ত হয়ে উঠেছে দিদার।
– আমার দেরী হইতেছে৷ আমি বের হইলাম আম্মা। ও যখন এসেই গেছে, এগুলা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে৷ এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে কন।

সকালের নাস্তার জন্য গুলিস্তাকে নিচে নামতে দেওয়া হলো না। নাস্তার প্লেট সাজিয়ে শর্মী আলিয়ার হাতে পাঠিয়ে দিলো গুলিস্তার ঘরে৷ নিজের ছোট ঘরটাতে বসে আপনমনে চারপাশ দেখছিলো গুলিস্তা৷ আলিয়া এলো নাস্তা নিয়ে। পরনে তার তাঁতের শাড়ি, নাকে নাকফুল, হাতে একজোড়া স্বর্ণের চিকন চুড়ি। গুলিস্তা অবাক হয়ে আলিয়ার নতুন বেশভূষা দেখছে। আলিয়া লাজুক হেসে ওর পাশে বসে বললো,
– অবাক হচ্ছিস দেখে! হবারই কথা। তোকে তো জানানোই হয়নি। তোর বিয়ের কয়েকদিন পরেই আব্বার মাথায় কী ভূত চাপলো কে জানে! একদিনের আলাপেই তোর দাউদ ভাইয়ের সাথে বিয়ের আয়োজন করে ফেললো। তেমন বড়সড় কোনো আয়োজন না। কাজী ডেকে বাড়ির সদস্যের সামনে কবুল বলা আর রেজিস্ট্রি পেপারে দুটো স্বাক্ষর। হয়ে গেলো বিয়ে। তখন থেকে এখানেই আছি।

গুলিস্তা গোলগাল চোখে তাকিয়ে আছে আলিয়ার দিকে। ওর নিজের ভাই ও চাচাতো বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অথচ ও জানতেও পারেনি।
– কী রে? বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না জানিস! দানিশ ভাইয়ার বিয়ের আগে আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে, এটা কখনো কল্পনাও করিনি। আব্বার অহেতুক জেদের কারনে এই প্রথম একটা ভালো কাজ হলো।

নিজের কথায় নিজেই খিলখিলিয়ে হাসছে আলিয়া। সে হাসির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গুলিস্তা নীরবে নাস্তার প্লেট টেনে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।

কানে কানে কথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরেছে। পাড়ার মহিলারা পেয়ে গেলো আলোচনার নতুন টপিক৷ নাইয়রীকে দেখতে আসার নাম করে আকবর বাড়িতে পাড়ার মহিলাদের আনাগোনা ক্রমেই বাড়তে থাকলো। সীমা বেগমের মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার জন্য এটি যথেষ্ট। বাড়িতে বাইরের মানুষের অহেতুক যাতায়াত উনার পছন্দ নয়। এ বাড়িতে দুটো ছেলের বউ রয়েছে। কখন কোন দুষ্ট মহিলা এসে বাড়ির বউয়ের মাথায় কূটনীতি ঢুকিয়ে দিয়ে যাবে কে জানে!

– আমাদের গুলিস্তার এমন রাজ কপাল কে জানতো! চোখের সামনে লাথি ঝাটা খেয়ে বড় হলো মেয়েটা। বসতে বললে বসে, উঠতে বললে উঠে। ওরে নিয়ে আমাদের কী না চিন্তাটা হতো খালাম্মা! এমন আধপাগল মেয়েটাকে পরের বাড়িতে কেমনে পাঠাবেন! কতোবার ভেবেছি, এই মেয়ে নিয়ে আপনার বহুত কষ্টে দিন কাটবে। অথচ দেখেন, আল্লাহ ওরে রাজকপাল দিয়ে দুনিয়ায় পাঠাইছে। শুনলাম বেশ বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। কেমন চুপেচাপে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন খালাম্মা। কেউ টেরই পাইলাম না। জামাই যে দেখবো সেই সুযোগটাও কেউ পাই নাই।

সীমা বেগম বুঝেন আলোচনা কোনোদিকে মোড় নিচ্ছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে পানের বাটি এগিয়ে দেন মহিলাদের দিকে। হাসি মুখে বলেন,
– ছেলের মা-ভাই বিদেশ যাবে। ওদের বড় তাড়া ছিলো। ভালো ঘর দেখে আমরাও আর আপত্তি করি নাই। মেয়ের বিয়ে তো একসময় দিতেই হতো। হাদিসেও ওতো আয়োজন করে বিয়ে দিতে না করা আছে। এই জন্য আরকি।
– তা অবশ্য ঠিক। গুলিস্তা দেখি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ভালোই সুন্দর হইছে। তো জামাইকে দেখছি না যে? সাথে আসে নাই?
– ব্যবসায়ী মানুষ। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। শ্বশুরবাড়ি এসে থাকার সময় আছে নাকি!
– সেকি কথা খালাম্মা! মেয়ে প্রথমবার নাইয়র আসছে। একলা পাঠায় দিছে ওরা? এ কেমন মানুষ! শ্বশুরবাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়নি তো আবার? আজকাল মানুষ একটু ঝামেলা মনোমালিন্য হতেই বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কয়েকদিন চুপচাপ থাকার পর একদিন হঠাৎ করে আসে তালাকনামা। কোনো ঝুট ঝামেলা নাই। সব হয় চুপিচাপে।
– আরেহ কী যে বলো তোমরা! অশুভ কথা কও কেন! দোয়া করো মেয়ে আমার সুখে শান্তিতে থাকুক। জামাই বড় ভালো মানুষ। বাড়ির মেয়ে বাড়িতে পৌছায় দিয়ে গেছে। সে নিজে সময় বাইর করতে পারে নাই তো কী হইছে। মেয়ে আমার কয়েকটা দিন বাপের বাড়িতে হাসি আনন্দে কাটাচ্ছে। দুদিন পরে এসে আবার নিয়ে যাবে।

সীমা বেগমের উত্তরে মহিলারা সন্তুষ্ট হয় না। মায়ের পাশে চুপটি করে বসে থাকা গুলিস্তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। এটা ওটা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে সন্ধ্যা নামলে বাড়ি ফিরে যায়। ওরা চলে গেলে সীমা বেগম মেয়ের মাথায় চাটি মেরে জানতে চান, আর কতো মিথ্যা কথা বলাবি?
খাটের উপর রাখা নারকেল পাতার ঝাড়ু দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দেন গুলিস্তার পিঠে৷ চাপাস্বরে গালি দেন। জানতে চান মেয়ে হঠাৎ করে এভাবে চলে এলো কেনো? পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মান সম্মান খুইয়ে কী আনন্দ পাচ্ছে? গুলিস্তা অবাক হয়ে জানতে চায়,
– আমি কি করেছি?

সুযোগ বুঝে শর্মী সীমা বেগমের আক্রোশ থেকে বাচিঁয়ে নেয় ওকে। নিজের ঘরে পৌছে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– কেনো আবার এলে বলো তো! ফিরবে কবে তুমি?
– এইতো কয়েকদিন।
– জামাইকে আসতে বলছো না কেনো?
– এসে যাবে।
– কল দিয়ে আসতে বলো।
– ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জ শেষ।
– চার্জার কোথায়?
– ও বাড়িতে রেখে এসেছি।

শর্মী হতাশ হয়ে কপালে হাত দিয়ে গুলিস্তার পাশে বসে। সপ্তাহ খানেক ধরে একই কাহিনী ঘটে যাচ্ছে। পাড়ার মহিলাদের আগ্রহের কমতি নেই। রোজ কেউ না কেউ এসে সীমা বেগমের মেজাজ বিগড়ে দিয়ে যায়। আর উনি চড়াও হয় গুলিস্তার উপর। সন্ধ্যা বেলার চায়ের আগে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় রোজ হজম করে যাচ্ছে মেয়েটা। হাতের কাছে যা পায়, তাই দিয়ে আঘাত করে নিজের গায়ের জ্বালা মিটায় সীমা বেগম।রোজ এমন নির্যাতনের চিত্র দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে শর্মী।
– আমার ফোন থেকে একটা কল করে আসতে বলো তাকে। সংসার জীবনে একটু আধটু ঝামেলা সবার হয়। এভাবে হাত পা ছেড়ে বসে থাকলে চলে?

গুলিস্তা অবাক চোখে তাকালো শর্মীর দিকে।
– কোনো ঝামেলা হয়নি তো। বিশ্বাস করো।

শর্মী হিসাব মিলাতে পারে না। বউকে একলা বাপের বাড়ি পাঠিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার মানে শর্মী জানে। কিন্তু এসেছে থেকেই গুলিস্তার একই কথা বলে যাচ্ছে। কোনো ঝামেলা হয়নি।
– আমাকে ফোন নাম্বারটা দাও। আমি আসতে বলি৷
– নাম্বার মুখস্ত নেই৷
শর্মী হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ায়। যোগাযোগের সব রাস্তা আপাতত বন্ধ। কারো কাজ থেকে ফোন নাম্বার যোগাড় করা সম্ভব নয়৷ যতোক্ষণ না সীমা বেগম নিজে উদ্যোগ নিচ্ছেন।

– রাতের খাবার ঘরে পাঠিয়ে দিবো। ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার নেই।
গুলিস্তার ঘর থেকে বের হতে হতে শর্মীর কপালের ভাঁজ আরও গভীর হয়। আর কতোদিন এভাবে চলবে।

সকালে নাস্তার টেবিলে তড়িঘড়ি করে নাস্তা পরিবেশন করছে শর্মী ও আলিয়া। আলিয়া খুব একটা ভালো রাধতে পারে না। শর্মীর সাথে থেকে ওর কাজে সাহায্য করে। টেবিলে বিরক্ত মুখে বসে আছে দিদার। গ্রাম থেকে বাঁধাকপি নিয়ে একটা ট্রাক আসার কথা ছিলো। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা আড়তে পৌঁছে গেছে। অথচ সে এখনো বাড়িতে বসে নাস্তার অপেক্ষা করছে।
– সামান্য নাস্তা তৈরি করতে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। সারাদিন করো কি বাড়িতে বসে বসে?

স্বামীর কথায় শর্মী কোনো উত্তর দিলো না। আজ ঘুম থেকে উঠতে খানিকটা দেরী হয়ে গিয়েছে। নাস্তা পরিবেশন করা শেষে চেয়ারে ধপাস করে বসে আলিয়া বললো,
– ভাবী আর আমি মিলে দৌড়ে দৌড়েও কাজ করে কূল পাচ্ছি না। রান্নার কাজ দেখতে অল্প মনে হলেও এ অনেক ঝামেলার কাজ।

রুটি মুখে দিয়ে দিদার বললো,
– ঘরে তো আরেকজন আছে। ওরে ডাক দেও নাই কেন? সারাদিন শুয়ে বসে না থেকে কাজে একটু আধটু হাত লাগালেও তো পারে৷ এভাবে ঘরে বসে আর কতো অন্ন ধ্বংস না করবে?

ছেলের কথা শুনে সীমা বেগম মুহূর্তেই নিজের খাট থেকে উঠে ফুঁসতে ফুঁসতে গুলিস্তার ঘরের দিকে গেলেন। শর্মীর চোখে পরলেও সে স্বামীর কাছ থেকে সরে যেতে পারলো না৷ হাত মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো গুলিস্তা। চিলের মতো আচানক সীমা বেগম হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো সেই চিরুনী। শক্তপোক্ত চিরুনী দিয়ে অনবরত বাহু ও পিঠে আঘাত করতে লাগলেন। গুলিস্তার ঘুমের ঘোর তখনো ঠিকমতো কাটেনি। অতর্কিত হামলায় চিৎকার করে উঠে। সীমা বেগম আরও রেগে গিয়ে বললেন,
– জন্মের পর থেকে একদন্ড শান্তিতে থাকতে দেস নাই আমারে। দেখেশুনে ভালো ঘরে বিয়ে দিলাম, দুদিন না যেতেই সেখান থেকে চলে এসে আবার আমার ঘাড়ে চেপে বসছিস। তোর জন্য এখন ছেলের সংসারেও অশান্তি। ছেলে আমারে বড় বড় কথা শোনায়। আমারে অন্ন দেখায়। ফিরে না এসে কোথাও ডুব দিয়ে মরতে পারলি না হতভাগী।

গুলিস্তার আর্তনাদে বাড়ির সকলে এসে ভীড় জমিয়েছে ওর ঘরের দরজায়। সীমা বেগমের শরীরে যেন অসুর ভর করেছে। একের পর এক আঘাত করতে দেখে শর্মীর গলা শুকিয়ে এলো। পাশে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দিদারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– কখন যে কী বলো বসো তুমি! কথা বলার আগে একটু ভেবেও দেখো না।

দিদার বুঝতে পারছে না সে ভুল কী বলেছে! গুলিস্তা সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকে। এর থেকে রান্নাঘরে এসে ভাবীদের সাথে রান্নায় একটু সাহায্য করলে কী এমন সর্বনাশ হয়ে যাবে? সে অবাক হয় বললো,
– আশ্চর্য! আমি কী এমন বললাম!
– সে যাই বলো! সকালবেলা মাকে রাগিয়ে দিলে তুমি, আর ভুগতে হচ্ছে ওকে। যাও গিয়ে থামাও তোমার মাকে।
– এসব ঝামেলায় আমি নাই। আমার দেরী হচ্ছে।

দিদার তস্তপায়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। শর্মী, আলিয়া দুজনের কেউ সামনে যাওয়ার সাহস পেলো না। উপায় না দেখে শর্মী হঠাৎ ছুটে গেলো দিহানের ঘরে। দিহান তখনো ঘুমাচ্ছিলো। জোরালো ডাকে চোখ মেলে তাকাতেই শর্মী হন্তদন্ত হয়ে বললো,
– মায়ের মাথাটা মনে হয় পুরো বিগড়ে গেছে। সকালবেলা মেয়েটাকে কীভাবে মারা শুরু করছে। তুমি একটু থামাও না ভাই। না হলে মেয়েটা আজকে মরেই যাবে।

দিহান বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে গুলিস্তার ঘরের দিকে গেলো। গুলিস্তা তখন ফ্লোরে লুটিয়ে পরে কাঁদছে। সীমা বেগম হাঁপিয়ে গেলেও দু পা দিয়ে একটু পর পর লাথি মেরে যাচ্ছেন গুলিস্তার ক্লান্ত দেহে। মাকে এক হাতে টেনে ধরে দিহান বললো,
– সকাল সকাল কী শুরু করছো তোমরা! শান্তিতে একটু ঘুমাইতেও দিবা না। তুমি যাও তো এখান থেকে।

সীমা বেগমের দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। মেয়েটাকে আজকে একটু বেশি মেরেছেন কিনা। সেগুলো হাতের উল্টোপিঠে মুছে ফেলে দিহানকে বললেন,
– এই জঞ্জালটাকে বিদায় করার ব্যবস্থা কর। এতোদিন পাড়া পড়শী জীবনটা অতিষ্ঠ করে ফেলছিলো। এখন তো ঘরের ছেলে অশান্তি করা শুরু করছে। ওর জামাইরে এসে বউ নিয়ে যাইতে ক।
– কেমনে আসতে বলবো! ফোন নাম্বার নাই আমার কাছে।
– ওর শ্বাশুড়িকে ফোন দে। যেমনে পারিস যোগাযোগ কর। এই মাইয়ারে আমি আর এক মুহুর্ত আমার ঘরে রাখবো না।
– আমি দেখতেছি।

দিহান ও সীমা বেগম বেরিয়ে যেতেই শর্মী ঘরে ঢুকে আগলে নিলো গুলিস্তাকে। মুখ ও হাতের অনেক জায়গায় কেটে গেছে। দ্রুত ক্ষত স্থান পরিষ্কার করতে হবে৷

আম্বিয়া খাতুনের ফোন নাম্বার ম্যানেজ করা না গেলেও রাহিলের ফোন নাম্বার ছিলো দিহানের কাছে৷ উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে দিহানকেই কল দিতে হলো। সীমা বেগম চতুর মানুষ। ফোন দিয়ে হাসি মুখে কুশলাদি বিনিময় করার পর বললেন,
– আসলে জামাইকে কল দিয়ে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম তোমাকে ফোন দিলে খোঁজ পাওয়া যাবে। বিরক্ত করলাম না তো?

রাহিল অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। বিয়ের পর এই প্রথম গুলিস্তার বাবার বাড়ি থেকে কেউ যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো। রাহিল অবশ্য এসব ব্যাপারে তেমন আগ্রহ পায় না। সে বললো,
– ভাইয়ের সাথে আমার গত কয়েকদিন তেমন কথা হয়নি। মা হয়তো বলতে পারবে৷

আম্বিয়া খাতুন নিজেও অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,
– রেহবারের সাথে কি দরকার বেয়াইন?
– তেমন জরুরি কিছু না। জামাইর সাথে কথা না হওয়ায় মেয়ে আমার অস্থির হয়ে আছে৷ মুখে কিছু না বললেও আমি তো মা, আমি বুঝি৷ তাই ভাবলাম এই সুযোগে জামাইকে আসতে বলি। এসে ঘুরেফিরে গুলিস্তাকেও নিয়ে গেলো৷

আম্বিয়া খাতুন মনে হয় কথা বলতে ভুলে গেলেন। গুলিস্তা বগুড়া গিয়েছে অথচ তিনি জানেন না৷ ব্যস্ততার কারনে বেশ কয়েকদিন ধরে গুলিস্তার সাথে কথা হয়নি। তবে দুদিন আগেও তো রেহবারের সাথে কথা হলো। সে কিছু জানালো না কেনো?
– গুলিস্তা বগুড়ায় নাকি! জানতাম না বেয়াইন।
– কি আর বলবো আজকালকার ছেলেমেয়েদের কথা! নিয়মকানুন কিছুই মানতে চায় না। বিয়ের পর প্রথমবার নাইয়র এসেছে, তাও আবার একা। জামাই ছাড়া কেউ প্রথমবার বাপের বাড়ি আসে! গ্রামের ব্যাপার তো বুঝেনই। চারদিকে হাসাহাসি শুরু হয়ে গেছে। তাই বলছিলাম কি বেয়াইন, রেহবার যদি একটু সময় করে নিজে এসে গুলিস্তাকে নিয়ে যেতো তাহলে গ্রামের মানুষজনের মুখ বন্ধ করতে পারতাম।

ফোনের ওপাশ থেকে আম্বিয়া খাতুন ধমকে জানতে চাইলেন,
– গুলিস্তাকে একলা বগুড়ায় পাঠিয়েছো কী মনে করে? গ্রামের রীতিনীতি সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে? না জানি মেয়েটাকে কতো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে!

ক্লায়েন্টের সাথে একটানা মিটিং হতে খানিক ব্রেক মিলেছিলো রেহবারের। পাশের কফিশপে এসেছে কফি খেতে। গুলিস্তা বিহীন বাড়িটাতে একটা রাত ঘুমিয়ে কাটাতে পারেনি। পরের দিন সকালেই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজেকে কাজের মধ্যে পুরোপুরি ডুবিয়ে ফেলেছে। প্রিয় শহর সিলেট ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে ব্যস্ত নগরী ঢাকাতে। পেন্ডিং মিটিংগুলোতে একের পর এক নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। আম্বিয়া খাতুনের প্রশ্নের জবাবে ধীর কন্ঠে উত্তর দিলো,
– অফিসের কাজে ঢাকা আসতে হয়েছে। ও একা বাড়িতে কী করতো! তাই ভাবলাম বগুড়া থেকে ঘুরে আসুক। কাজ রেখে আমিও নিশ্চয়ই ওর পিছু পিছু বগুড়া ছুটে যাবো না।
– ওকে একা পাঠানো উচিত হয়নি। বিয়ের পর প্রথমবার বাবার বাড়ি গিয়েছে। এসব নিয়ে গ্রামে অনেক কথা হয়। ওসব তুমি বুঝবে না। তোমার শ্বাশুড়ি মা ফোন করে ছিলেন। তোমার সাথে নাকি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না তাই আমাকে জানালেন। তোমাকে বগুড়া যেতে বলেছেন।
– টানা মিটিং চলছে। বেশিরভাগ সময় ফোন বন্ধ থাকে। আমি প্রচুর ব্যস্ত, মা। একটু ফ্রি হয়ে নেই, তারপর যাবো।
– ব্যস্ততার মাঝে নিজের জন্য সময় বের করে নিতে হয়। তুমি বগুড়া যাবে এবং সেটি আজকেই। এ ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না।

অগত্যা বাধ্য হয়ে ভর দুপুরেই রেহবারকে বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হলো।

(চলবে..)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
বিংশ পর্ব

সকালে একগাদা মার খেয়ে পেট ভরে গেছে তাই মেয়েটা সকালে আর কিছু মুখে তুলেনি৷ রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকায় শর্মী নিজেও খোঁজ নেওয়ার সময় পায়নি৷ সীমা বেগম নিজেও গোঁ ধরে বসে আসেন, ছেলের সংসারের অন্ন আর মুখে তুলবেন না। শর্মী অনেক অনুরোধ করে, ক্ষমা চেয়ে দুপুরের দিকে ভাত খাওয়াতে পেরেছে। মাকে সামলে মেয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে আঁতকে উঠলো শর্মী। গুলিস্তা গায়ে ভীষণ জ্বর। বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে অনবরত কেপে যাচ্ছে পাতলা গড়নের শরীরটি। লেপ, কম্বলে শরীর মুড়ে দিয়ে সে ছুটলো রান্নাঘরে। গরুর গোশতে বড় আকারে আলু কেটে দিয়ে কষানো তরকারি গুলিস্তার ভীষণ পছন্দ। ঝাল দিয়ে রান্না করে ভাত মেখে নিজে হাতে একটু খাইয়ে দিলো। খালি পেটে ঔষধ খাওয়া যাবে না দেখে কষ্ট হলেও গুলিস্তা খানিকটা খেয়ে নিলো৷ ঔষধ খাইয়ে ঘর ছাড়তেই গুলিস্তা ছুটে গেলে বাথরুমে। পেটের মধ্যে যা ছিলো সবটুকু উগড়ে দিলো। ক্লান্ত শরীরটি টেনে বিছানায় নিয়ে আসার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই। নেহাত শর্মী ছিলো। কোনোরকম ধরে বিছানায় শুইয়ে দিতেই নিদ্রা পথে পাড়ি দিলো গুলিস্তা। দিনভর ছোটাছুটি করে শর্মী নিজেও ক্লান্ত৷ জলপট্টি দেওয়া দরকার কিন্তু শর্মীর দেহ আর সায় দিচ্ছে না। খানিকটা বিশ্রাম দরকার। গুলিস্তার শিয়রে বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া যায়৷

রেহবার যখন বগুড়া পৌছালো, তখন তপ্ত সূর্য ম্লান হতে চলেছে। শীতের আগমনের বার্তা স্বরুপ সূর্যটাও দ্রুত পালাই পালাই করে। তিক্ত অনুভূতি রেহবারের মন জুড়ে৷ আজকে একটা রফাদফা করে তবেই ফিরবে। রেহবার না হয় খানিকটা সময় চেয়ে ওকে বগুড়ায় পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এই মেয়ের এতো ভাব যে বগুড়া পৌঁছানোর পর একবার কল দিয়ে জানানোর প্রয়োজনটুকুও মনে করেনি। ভোর থেকে রেহবার ফোনের দিকে চেয়ে ছিলো। গুলিস্তা ঠিকমতো পৌছালো কিনা এই চিন্তায় রাতভর অস্থির ভাবে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কেটেছে। ভোর পেরিয়ে সকাল হলো, সকাল পেরিয়ে দুপুর। বাধ্য হয়ে রেহবার নিজেই কল দিয়েছিলো। মেয়ে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন যে, ফোনটা বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। রাগে, অপমানে রেহবারের ইচ্ছে করছিলো তখনি বগুড়ায় এসে জোরসে একটা ধমক দিতে।
নিজে ফোন বন্ধ করে রেখে ভাব দেখাচ্ছিলো আর এখন শ্বাশুড়ি-দেবর সবাইকে কল দিয়ে নালিশ করা হচ্ছে। পুরো বংশের রেফারেন্স নিতে পারবে তবুও রেহবারের নিকট মাথা নোয়াবে না। এসব নিয়ে যতোই ভাবছে, ততোই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
আজকে এখানেই সব সম্পর্ক চুকেবুকে দিয়ে ফিরে যাবে নিজ শহরে। অনেক হয়েছে ধৈর্যের পরীক্ষা।

রেহবারকে দেখে সীমা বেগম খানিকটা নড়েচড়ে বসলেন। ফোন করার পর এতো দ্রুত চলে আসবে এমনটা ভাবেননি তিনি। সকালবেলা যখন মেয়ের ঘর ছেড়েছিলেন, ওর অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিলো না। এখন কী অবস্থায় আছে কে জানে! জামাইয়ের সামনে মেয়েকে এমনভাবে হাজির করা তো যায় না। কাছাকাছি কোথাও শর্মীকেও দেখা যাচ্ছে না। রেহবারকে দরজা খুলে দিয়েছিলো আলিয়া। সীমা বেগমের নিকট পৌছে দিয়ে এই মেয়ে ছুটে গেছে রান্না ঘরে। সীমা বেগম ডাকলেন,
– আলিয়া, এই আলিয়া।
রান্নাঘর থেকে আলিয়া উত্তর দিলো, আসতেছি।
সামনে বসে থাকা রেহবারের দিকে তাকিয়ে সীমা বেগম একটু হাসার চেষ্টা করলেন।
– অল্প বয়সী মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনলে যা হয় আরকি। সারাক্ষণ ছোটাছুটি করে৷ স্থির হয়ে এক জায়গায় বসা এদের ধাতে নাই৷ অনেকটা পথ পাড়ি আসছো। তুমি বসো, রেস্ট নেও।

আশেপাশে নজর বুলিয়ে রেহবার বললো,
– গুলিস্তা কোথায়? ওকে দেখছি না।
– নিজের ঘরে আছে। তোমার আসার খবর পায়নি। ওরে তো জানানোই হয়নি যে তুমি আসতেছো। আমি লুকিয়ে সব ব্যবস্থা করছি। সারাদিন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাই ভাবলাম সারপ্রাইজ দেই।

হো হো করে হেসে উঠলেন সীমা বেগম। সেই হাসি রেহবার যোগ দিলো না। অস্থিরভাবে চতুর্দিকে তাকালো। বাধ্য হয়ে সীমা বেগম বললেন,
– খবর পাঠাইতেছি৷ ওই আলিয়া, শর্মী কই?
– জানি না। গুলিস্তার ঘরে গেছিলো। তারপর আর দেখি নাই। ওখানেই আছে মনে হয়।

রেহবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,
– আমি বরং নিজেই গিয়ে দেখা করে আসি৷ কোন ঘরটা?
– আরে তুমি যাইবা কেন! বসো, বসো। বড় বউমা ওরে নিয়ে আসতেছে।
– আমি নিজেই যেতে পারবো। ঘরটা দেখিয়ে দিন।

সীমা বেগম হাতের ইশারায় ঘর দেখিয়ে দিলেন। আজকাল হাঁটুর ব্যথাটা ভীষণ বেড়েছে। হাঁটাচলা করায় ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে। সকালের পর তো ঠিকমতো দাড়াতেই পারছেন না। পুরনো আমলের বাড়ি। বৈঠকখানা থেকে উপরের সবগুলো দেখা যায়৷ সিড়ি বেয়ে রেহবার ঘরের দিকে যাচ্ছে৷ সীমা বেগম অস্থিরভাবে ডাকতে থাকলেন, শর্মী, এই শর্মী…

দরজায় কড়া নাড়তেই শর্মীর ঘুম ভেঙে গেলো। ও ভাবলো আলিয়া এসেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দিলো,
– দরজা খোলা আছে।

দরজা খুলে রেহবারকে প্রবেশ করতে দেখে শর্মী কিছু মূহুর্ত স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো। একবার রেহবারের দিকে তাকায়, আরেকবার বিছানায় শুয়ে থাকা গুলিস্তার দিকে। রেহবার নিজেও অবাক চোখে গুলিস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে। এবেলা কে ঘুমিয়ে থাকে!
ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই শর্মী খানিকটা দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বললো,
– গায়ে ভীষণ জ্বর।

জ্বরের কারনে গুলিস্তার মুখমণ্ডল খানিকটা লালচে দেখাচ্ছে। শুষ্ক ঠোঁটগুলো যেনো রুক্ষ মরুভূমি। ঘুমন্ত গুলিস্তার পাশে বসে রেহবার আলতো করে গুলিস্তার গালে হাত রাখলো। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে গুলিস্তা খানিকটা কেঁপে উঠলেও ক্ষণকাল পরেই আবার শান্ত হয়ে গেলো। খুব নিকটে থাকায় গুলিস্তার মুখমণ্ডল জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষতগুলো রেহবারের নজড় এড়াল না। ডান ভ্রু এর পাশে একটা ক্ষত দেখা যাচ্ছে। তাজা রক্ত শুকিয়ে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সেই ক্ষত আঙ্গুল দিয়ে ছুতেই গুলিস্তা চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। অজান্তেই লেপের নিচ থেকে হাত বের করে রেহবারের আঙ্গুল সরিয়ে দিলো। রেহবার অবাক হয়ে খেয়াল করলো ফর্সা হাতে কিছু ক্ষত দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গা জুড়ে লালচে ত্বক। শক্ত কিছুর আঘাতে যেমনটা হয়। গা থেকে লেপটি খানিকটা সরিয়ে ওকে পর্যবেক্ষণ করে রেহবার অবাক চোখে শর্মীর দিকে তাকালো।
লজ্জায় শর্মীর ইচ্ছে করছে মাটিতে মিশে যেতে। ও মাথা নিচু করে বললো,
– মা মেরেছে।

রাগে রেহবারের মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে এসেছে। বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শর্মীর উদ্দেশ্যে বললো,
– ওকে একটু রেডি করে দিতে পারবেন? অসুবিধা না হলে ওর ব্যাগটা একটু গুছিয়ে দিন ভাবী।

রেহবারকে দ্রুত ঘর ছাড়তে দেখে শর্মী বলল,
– ওকে এখানে কেনো পাঠালে ভাই? এতোদিন ধরে একবার খোঁজ খবরও নিলে না।
জবাবদিহি করার মতো করে রেহবার বললো,
– আমি কল দিয়েছিলাম। ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
– চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। ভুলেই চার্জার রেখে এসেছে। ওকে একা পাঠানো উচিত হয়নি তোমার।
– মোটেও উচিত হয়নি। আর পাঠাবো না।

গুলিস্তার দরজায় বাইরে অপেক্ষমান কয়েক মিনিট রেহবারের নিকট কয়েক বছর মনে হলো। নিচ থেকে সীমা বেগমের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অনুভব করতে পেরেও সেদিকে তাকালো না। দরজা খুলে শর্মী উঁকি দিয়ে বললো,
– ভেতরে এসো।

কাপড় ভিজিয়ে গুলিস্তার মুখ হাত মুছে দিয়ে একটা সালোয়ার কামিজ পরিয়েছে। ঘুম ভেঙে গেলেও ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে গুলিস্তার। জ্বরের কারনে চোখ জ্বালা করছে। বেশিক্ষণ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা দায়। বিছানায় হেলাম দিয়ে সামনে তাকাতেই দরজা খুলে রেহবারকে প্রবেশ করতে দেখে গুলিস্তার চোখে জল জমতে শুরু করলো।
– হাঁটতে পারবে?

মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালেও উঠে দাড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো। রেহবারের হাত ধরে পতন ঠেকানো গেলেও এ অবস্থায় সিড়ি বেয়ে নিচে না সম্ভব নয়।
রেহবার বিনাবাক্যে ওকে কোলে তুলে নিলো। ওদের ধুপধাপ সিড়ি বেয়ে নামতে দেখে সীমা বেগম ভীষণ অবাক হলেন। কাঠিন্যে ভরা রেহবারের মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও এভাবে বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। কোথায় ভেবেছিলেন জামাইকে ডেকে এনে একটা দিন ভালোভাবে আপ্যায়ন করবেন, পাড়া প্রতিবেশীর নিকট জামাইকে উপস্থাপন করবেন। কিন্তু এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে পাড়ায় আরেক গুজব ছড়িয়ে পরবে। ওদের পেছনে কাপড়ের ব্যাগ হাতে শর্মী আসছে। ওকে দেখে সীমা বেগম বললেন,
– এই শর্মী, এসব কি হইতেছে? জামাই না মাত্র আসলো। এখনি কই যায়?
– চলে যাইতে আম্মা।
রেহবার ও শর্মী কেউ ক্ষণকাল এই মহিলার জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত নয়।

আকবর বাড়ির সামনে একটা চকচকে কার দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য অনেকের কাছে নতুন। পাড়ার ছোট বাচ্চারা গাড়ির আশেপাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছে। মহিলা সদস্যরা ধৈর্য্য ধরে গাড়ির মালিককে দেখার এবং পরিস্থিতি বুঝায় চেষ্টা করছে। গুলিস্তাকে কোলে নিয়ে রেহবারকে বের হতে দেখে মুহূর্তেই গুঞ্জন শুরু হলো।
গুলিস্তাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে রেহবার এক মুহুর্ত ব্যয় না করে নিজেও গাড়িতে বসে শর্মীকে বলল,
– ধন্যবাদ ভাবী।
– তোমার ফোন নাম্বারটা দাও তো ভাই। তোমার নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন আছে৷
– সেসবের আর প্রয়োজন নেই। কোনো উত্তর জানতে চাই না আমি।
– কিছু কথা জেনে নিলে গুলিস্তাকে বুঝতে সুবিধা হবে। ও খানিকটা অন্যরকম। এতোদিনে নিশ্চয়ই বুঝে গেছো। তবুও এতোদিন সহ্য করেছো, তারমানে তোমার যথেষ্ট ধৈর্য্য আছে।
নিজের কার্ড বের বের করে শর্মীর হাতে দিলে সে বললো,
– আমি সুযোগ বুঝে কল করবো। এখন দ্রুত বের হও৷
কয়েকজন মহিলাকে এগিয়ে আসতে দেখে শর্মী দ্রুত পায়ে বাড়ির ফিরে যেতে চাইলো। কিন্তু ততোক্ষণে দেরী হয়ে গেছে।
– ব্যাপার কী রে শর্মী? জামাই নাকি?

মুখে হাসি ফুটিয়ে শর্মী বললো,
– হ্যাঁ, চাচি৷
– এমনে চলে গেলো কেন? কখন আসছে? আমরা কেউ দেখলাম না।
– ব্যস্ত মানুষ। শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময় কই। গুলিস্তার জ্বর শুনে, কাজকর্ম ফেলে ছুটে আসছে।
– তোরা তো পারলে মেয়েটাকে মেরেই ফেলিস! বাপের বাড়ি আসতেই জ্বর বাধিয়ে ফেললো! অদ্ভুত!
– আমি যাই চাচি। ঘরে অনেক কাজ জমে আছে।

মহিলাদের এড়িয়ে গেলেও সীমা বেগমকে এড়িয়ে যাওয়া গেলো না। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শর্মীকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
– ঘটনাটা কি ঘটলো বড় বউ? খুলে কও তো।
– গুলিস্তার গায়ে ভীষণ জ্বর। জামাই বললো ডাক্তার দেখানো লাগবে। এতো জ্বর সত্ত্বেও ঘরে ফালায় রাখছি, এই নিয়ে সামান্য নারাজ হইছে আম্মা। বেশি কিছু না। যেমনেই হোক, গুলিস্তাকে দ্রুত ফেরত পাঠানো গেছে এটা তো ভালোই। তাই না আম্মা?

সীমা বেগম গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। শর্মী সেখানে আর দাঁড়ালো না। দ্রুত রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলো।

(চলবে..)