হে সখা পর্ব-২১+২২+২৩

0
139

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
একবিংশ পর্ব

জীবনের অস্থিরতম মুহুর্তে রেহবারের বিরক্তবোধ করা উচিত। অথচ রেহবারের বিরক্ত লাগছে না৷ বরং ভীষণ ভালো লাগছে। রাস্তার দু ধারে সবুজ গাছপালা, চারদিকে মৃদুমন্দ বাতাস, পাশের সীটে ঘুমন্ত প্রিয়তমা। ছোট্ট জীবনে এর থেকে বেশি আর কি চাই! গনগনে মেজাজ নিয়ে বগুড়ায় উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও ফিরতি পথে মন এখন ভীষণ ফুরফুরে। বগুড়ার সনামধন্য আকবর বাড়ির মানুষগুলো উপর মেজাজ চটে ছিলো কিছুক্ষণ আগ মুহুর্ত পর্যন্ত। তারপর ভাবলো, অযথা ওই মানুষগুলো কথা ভেবে নিজের মেজাজ খারাপ করার কী দরকার!
পথিমধ্যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গুলিস্তাকে হালকা নাস্তা খাইয়ে প্রয়োজনীয় ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে। এর পর থেকে সীটে হেলান দিয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ড্রাইভিং করার পাশাপাশি কিছুক্ষণ পরপর ঘুমন্ত গুলিস্তার দিকে তাকাচ্ছে রেহবার। সালোয়ার কামিজ গায়ে ওকে হাইস্কুল পড়ুয়া কিশোরী মনে হচ্ছে। বাড়িতে সারাক্ষণ শাড়ি পরে ঘুরাঘুরি করতো। লম্বা চওড়া শারীরিক কাঠামোয় শাড়ি পরিহিতা গুলিস্তাকে তখন ওতোটা ছোট মনে হয় না।
বগুড়া থেকে সিলেটের পথটুকু আধোঘুমে, আধো জাগরণে কেটে গেছে গুলিস্তার৷ মাকে ফোন করে গুলিস্তাকে নিয়ে আসার খবর দেওয়া, মালাকে দিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করানো সবকিছু রেহবার একা হাতে সামলিয়েছে। রাতের বেলা সামান্য রান্না করে গুলিস্তাকে খাইয়ে যখন নিজে ঘুমাতে গেলো, তখন বেশ রাত হয়ে গেছে।

গত রাতে পূর্বপাশের জানালাটা বন্ধ করে দিলেও পর্দা টেনে দেওয়া হয়নি। চোখে মুখে আলোর ছটা এসে পরছে। ভীষণ বিরক্ত হয়ে গুলিস্তা চোখ খুলে তাকালো। ক্ষণিক বাদে বুঝতে পারলো, এটা বগুড়ার সেই ছোট ঘরটি নয়। পাশ ফিরলে দেখতে পেলো রেহবার বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভেঙে এমন দৃশ্য গুলিস্তার নিকট ভ্রম মনে হলো। সে তো নিজের বাড়িতে ছিলো। রোজকার মতো মায়ের হাতে মার খেয়ে জ্বরে কুপোকাত। ফ্লোর থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে ছিল। এরপর? কিছু মনে করতে পারলো না। এটা কল্পনা নাকি বাস্তবতা? পরীক্ষা করে নিতে ধীর গতিতে ঘুমন্ত রেহবারের দিকে হাত বাড়ালো। ওর দিকে মুখ করে ঘুমাচ্ছিলো রেহবার। গালে আলতো হাতের ছোঁয়া পেয়ে চকিতে চোখ মেলে তাকালো। রাতের দিকেও গুলিস্তার গায়ে হালকা জ্বর ছিলো। বারবার ঘুম থেকে জেগে জ্বর চেক করতে হয়েছে। ঘুমালেও মস্তিষ্কের মধ্যে কোথাও চিন্তাটা রয়ে গেছে। তাই তো হালকা ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো। রেহবার চোখ মেলে তাকাতেই গুলিস্তা দ্রুত হাত সরিয়ে নিতে গেলে, রেহবার খপ করে হাতটি ধরে ফেললো। টান দিয়ে গুলিস্তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখলো, জ্বর এখনো রয়ে গেছে কিনা?
– জ্বর কেটে গেছে বলে বিছানা ছেড়ে কোথায় ছুটছিলে?
ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে রেহবার আরাম করে চোখ বন্ধ করে নিলো। রেহবারের বুকে আটকা পরে গুলিস্তা বললো,
– ঘুম ভেঙে গেছে। আর ঘুম আসবে না।
– না আসুক। জেগে জেগে আমাকে পাহারা দেও।

টানা কাজ করার পর অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে রেহবার। মূল উদ্দেশ্য গুলিস্তার সাথে সময় কাটানো। শর্মীর সাথে কথা বলে নিলে সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যেতো। কিন্তু শর্মীর সাথে আর যোগাযোগ হয়নি।

সেদিন জেরিনের কথা শুনে রেহবার মনে কষ্ট পেয়েছে। যতোই বলুক, গুলিস্তার অতীত নিয়ে ওর কোনো সমস্যা নেই। মনের মধ্যে কিছু একটা খচখচ করতেই থাকে। তাই রেহবার ঠিক করেছে, সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করবে। গুলিস্তা নিজে থেকে স্বাভাবিক আচরণ না করলে ট্রিকস অবলম্বন করে হলেও ওকে দিয়ে স্বাভাবিক আচরণ করিয়েই ছাড়বে। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে গুলিস্তার হাতে ফোনের চার্জার ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– ফোনে পর্যাপ্ত চার্জ দিয়ে রাখবে। আর কখনো যেনো চার্জারের অভাবে ফোন বন্ধ হয়ে না যায়। সেদিন আমি কতোবার ফোন করেছি, কোনো আইডিয়া আছে তোমার?

গুলিস্তা মিনমিন করে জবাব দিলো,
– বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

সারাদিন দুজনে মিলে রান্না করলো, ঘরবাড়ি গুছালো, বাগানের ফুল গাছে পানি দিলো। বিকালের দিকে গুলিস্তার ক্ষতস্থান গুলোতে ঔষধ লাগিয়ে দেওয়ার সময় রেহবার বললো,
– তুমি কি এখনো ছোট বাচ্চা আছো নাকি! এখনো মায়ের হাতে মাইর খাও। কী হাস্যকর ব্যাপার!
– মা হয় তো।
– মা বলেই ন্যায় অন্যায় বিচার না করে মারবে! একজন পরিণত মানুষের গায়ে হাত তোলা রীতিমতো অন্যায়, অনৈতিক কাজ৷ মুখ বুঝে সহ্য করাও অন্যায়। আর কখনো অন্যায়কে প্রশয় দিবে না। আমি কখনো গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করলেও প্রতিবাদ করবে। মনে থাকবে?

রাতের ঘুমানোর সময় রেহবার তখনো ল্যাপটপে কাজ করছিলো। সব গুছিয়ে গুলিস্তা রুমে ফিরে এলে ল্যাপটপটি সরিয়ে রেখে গুলিস্তার কোলে মাথা রেখে আবদার করলো,
– চুলে হাত বুলিয়ে দেও তো। মাথা ধরেছে ভীষণ।

গুলিস্তা বিনাবাক্যে রেহবারের চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়া শুরু করলো। পুরোটা সময় রেহবার নির্নিমেষ চেয়ে রইলো গুলিস্তার মুখের দিকে। গুলিস্তা কখনো সেই চোখে চোখ রাখে, আবার কখনো অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নেয়।
– বাবার বাড়িতে দিন কেমন কাটলো?
– ভালো।
– মিথ্যুক কোথাকার! দেখতেই তো পাচ্ছি কতো ভালো দিন কেটেছে৷ মুখে হাতে চোট পেয়েছো, জ্বরে বেহুশ হয়ে পরে ছিলে।

অপ্রস্তুত হয়ে গুলিস্তা মাথা নিচু করে ফেললো। গুলিস্তার হাত দুটো টেনে নিজের বুকের উপর চেপে ধরে রেহবার জানতে চাইলো,
– একা নাইয়র যেতে নেই, এই কথাটা আমাকে বলোনি কেনো? মা আমাকে কতোগুলো বোকা দিয়েছে জানো?

রেহবারের কথা শুনে গুলিস্তা বেশ অবাক হলো৷ আন্টি বকাও দেয় নাকি? ওকে তো কখনো বকা দেয়নি।
– বাড়িতে জানতে চায়নি, আমি সাথে যাইনি কেনো?
– চেয়েছে।
– কি বলেছো?
– কিছু বলিনি।
– কেনো বলোনি?
– জানি না যে।
– তোমার সেই প্রতিবেশির কথা শুনে রেগে গিয়েছিলাম, তাই সাথে যাইনি। এ আবার বুঝতে পেরেছো?

গুলিস্তা উত্তর দিলো না। এক পাশে মাথা বাঁকিয়ে জানালো সে বুঝতে পেরেছে। রেহবার এতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সহজে বুঝতে না পারলে সে এখন থেকে গুলিস্তাকে প্রতিটি কথা, প্রতিটি অনুভূতি কথায় প্রকাশ করে বুঝিয়ে দিবে৷ গুলিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে রেহবার বললো?
– ঘুম পেয়েছে?

গুলিস্তা মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালে রেহবার হেসে বললো,
– কাল দিনরাত মিলে যতো ঘুমিয়েছো! আর কোথা থেকে ঘুম আসবে! আজকে বরং জেগে জেগে আমাকে গল্প শোনাও।

গুলিস্তার দু হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে জানতে চাইলো,
– জাহিদের সাথে সেদিনের ঘটনাটা বলো তো শুনি।

গুলিস্তা থমকে গিয়ে রেহবারের হাত থেকে নিজের হাত দুটো সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু রেহবার আরও শক্ত করে বুকের সাথে চিপে ধরে রইলো।
– তুমি তো শুধু প্রশ্নের উত্তর দিতে জানো। ঠিক আছে, প্রশ্ন করেই জেনে নিচ্ছি। জাহিদকে কীভাবে চিনতে?
– একই পাড়ায় থাকতাম। ছোটবেলায় একসাথে খেলতাম।
– তুমি ওকে পছন্দ করতে?

গুলিস্তা মাথা দুলিয়ে না জানালো৷ রেহবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকায় তা দেখতে পেলো না। আবার প্রশ্ন করলো,
– পছন্দ করতে?
– নাহ।
– তাহলে তোমাদের প্রেমের গুঞ্জন ছড়ালো কীভাবে? ও তোমাকে পছন্দ করতো?
– রাস্তাঘাটে বিরক্ত করতো। বান্ধবীদের দিয়ে চিঠি পাঠাতো। চিঠি নিতে না চাইলে বান্ধবীরা সেই চিঠি মায়ের হাতে দেওয়ার ভয় দেখাতো।
– সেদিনও বিরক্ত করছিলো?

হটাৎ হেঁচকি তুলে গুলিস্তার দেহ কেঁপে উঠলো। রেহবার দ্রুত উঠে বসে দেখলো গুলিস্তা কাঁদছে। নিচের ঠোঁট দাঁতের ফাঁকে চিপে ধরেছে৷ এই প্রথম ওকে এভাবে কাঁদতে দেখলে রেহবার বিচলিতবোধ করলেও নিজেকে ধাতস্থ করে দু হাত বাড়িয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো,
– কী করেছিলো?

নিজের বা হাত দেখিয়ে দিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,
– হাত ধরে টানাটানি করতেছিলো। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হইনি, তাই সরাসরি বিয়ে করতে বলতেছিলো। বিয়ে করে রেখে ট্রেনিং করতে যাবে।

অসময়ে রেহবারের খুব হাসি পেলো। সে ফিক করে হেসেও ফেললো। গুলিস্তা কান্না বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে। এখানে হাসির কি হলো? জবাবদিহিতার মতো করে রেহবার বললো,
– অল্প বয়সের আবেগে কী সব পাগলামি করে মানুষ! কোন ক্লাসে পড়তে তখন?
– এইটে।
– ও তোমার হাত ধরে টানাটানি করছিলো আর তুমি দাঁড়িয়ে রইলে! ডান হাত দিয়ে জোরসে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো।
– ভয় পেয়ে গেছিলাম।
– এখন দাও দেখি।

ওর বাম হাতের কব্জি ধরে মুখ সামান্য এগিয়ে নিয়ে রেহবার অপেক্ষা করলো। গুলিস্তা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
– কি দিবো?
– থাপ্পড় দিবে। এভাবেই তো হাত ধরেছিলো। তুমি উল্টো হাতে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেও। কই? দেও, দেও।

রেহবারের কোনো কথায় গুলিস্তা অসম্মতি জানায় না। কখনো প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা সামান্য ‘না’টুকুও বলে না। আজকে হয় না বলবে, না হলে সাহস করে থাপ্পড় দিয়ে সেদিনের ট্রমা কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠবে। রেহবারকে অবাক করে দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে গুলিস্তার ডান হাত রেহবারের গাল ছুঁলো।
– এটা থাপ্পড় ছিলো? মানুষ মশা মারতেও এর থেকেও বেশি শক্ত প্রয়োগ করে। তোমার শরীরে এতটুকুও শক্তি নেই!

গুলিস্তা ঘুমিয়ে গেলে রেহবার খুব সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলে বসে নিজের অফিসের কাজ করছিলো। হঠাৎ ফোন কেঁপে উঠল। এতো রাতে আননোন নাম্বার থেকে কল আসতে দেখে বুঝে নিলো এটা কে হতে পারে। ঘর থেকে বেরিয়ে স্টাডিরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

চলবে…

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
দ্বাবিংশ পর্ব

ব্যবসায়িক কাজে দিদারকে শহরের বাইরে যেতে হয়েছে। সারাদিন কাজে কর্মে ব্যস্ত থাকার কারনে শর্মীর ইচ্ছে থাকলেও সময় করে উঠতে পারেনি। বাড়ি ভর্তি মানুষজন। দিনের বেলা কাজ না থাকলেও কেউ না কেউ আশেপাশে থাকে। আজকে রাতে দিদারের অনুপস্থিতিতে অপেক্ষিত সুযোগ এলো। সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো শর্মী। তারপর কল করলো রেহবারের ফোন নাম্বারে৷ ফোন রিসিভ হতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইলো,
– গুলিস্তার জ্বর কমেছে? কেমন আছে ও?

আকবর বাড়ির এই একজন সদস্যকেই রেহবারের পছন্দ। কথাবার্তা, চালচলনে বেশ অমায়িক মনে হয়েছে শর্মীকে। গুলিস্তাকেও ভীষণ স্নেহ করেন এই ভদ্র মহিলা।
– এখন আর জ্বর নেই। ভালো আছে ও।
– ঘুমাচ্ছিলে বুঝি? অসময় বিরক্ত করলাম। আসলে দিনের বেলা ফোন করার সম্ভব হতো না। লুকিয়ে কথা বলা ছাড়া উপায় নাই।
– জেগেই ছিলাম৷ অফিসের কিছু কাজ করছিলাম।
– বেশি সময় কথা বলতে পারবো না, ভাই। গুলিস্তাকে নিয়ে তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে, আমি জানি। ও আসলে অন্যসব স্বাভাবিক মেয়ের মতো না। ওর বয়সটা বাড়লেও, মন থেকে ও এখনো ছোট বাচ্চার মতোই। নিজের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবে না। যে যাই বলে তাতেই সম্মতি জানায়। ওকে দোষ দিয়ে লাভ নাই। আমাদের বাড়িতে যেকোনো মেয়েরই অবস্থা এমন। মেয়েদের আলাদা কোনো মতামত নেই। অভিভাবক যা ঠিক করবে, তাতেই সম্মতি জানাতে বাধ্য থাকতে হবে৷
– অন্য সবার থেকে ওকে একটু বেশি শাসন করা হচ্ছে না? আপনার শ্বাশুড়ি ওর নিজের মা তো?

রেহবারের প্রশ্নে শর্মী হেসে ফেললো।
– নিজেরই মেয়ে৷ আসলে সমস্যার শুরু আমার শ্বাশুড়ি মায়ের থেকেই। চার ছেলের পর অনেক বছর বাদের অনাকাঙ্খিত প্রেগন্যান্সির কারনে অনেকটা ভেঙে পরেছিলেন। গ্রামের মানুষের হাসাহাসি, কটুক্তিমূলক বাক্যে বিভ্রান্ত হয়ে এবরশনের চেষ্টাও করেন। বিধাতার দয়ায় গুলিস্তা স্বাভাবিকভাবেই জন্ম গ্রহণ করলেও ততোদিনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন আমার শ্বাশুড়ি। গ্রামের মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে তেমন একটা সচেতন নয়। ডেলিভারির পর পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন ধীরে ধীরে ভয়াল রুপ নেয়। উনার খিটখিটে মেজাজ, আক্রমনাত্মক আচরণ কেউ আমোলে নেয়নি। এর উপর হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন আমার শ্বশুর। সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেন আমার শ্বাশুড়ি। গুলিস্তার প্রতি অনীহা বেড়ে গিয়ে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। সামান্য কারনে গুলিস্তাকে মারপিট করতে থাকেন, বকাবকি করেন। তাই মায়ের হাত থেকে রক্ষা করতে এক পর্যায়ে একঘরে করে দেওয়া হয় ছোট মেয়েটিকে।
– সমস্যার শুরু তাহলে উনার থেকে!
– হ্যাঁ। উনার কারনেই গুলিস্তা স্বাভাবিক শৈশব পায়নি। মানসিক বিকাশের বয়সে ওর দিন কেটেছে আতংকে। ঘরে কথার বলার মতো কেউ ছিলো না, বাইরেও যেতে দেওয়া হতো না। কৈশোরের কৌতূহলকালীন সময়েও কাউকে পাশে পায়নি।
একলা ঘরে মন মরা হয়ে দিন কেটেছে। ধীরে ধীরে ও নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, কথা বলা এবং মানুষের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। জীবনের প্রতি ওর আগ্রহ নেই বললেই চলে। আমি যখন প্রথম এ বাড়িতে এলাম তখন তো ও ঘরের ভেতরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো। ওকে দেখে আমার ভীষণ ভয় হতো৷ না জানি কখন নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। ডিপ্রেশনে মানুষ প্রায় নিজের জীবন নিজেই কে*ড়ে নেয়।
– ও সু*ইসাইডাল নয়৷
– সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবানী, গুলিস্তা এমন নয়। এতো কিছুর পরেও ওর মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যায়নি। এর মানে হচ্ছে, ও ভীষণ লড়াকু। একটু সাহায্য পেলেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে৷ ও একা একা অনেক কিছু সহ্য করেছে, লড়াই করেছে। কাউকে পাশে পায়নি। তুমি ওকে একটুখানি সাহায্য করো। দীর্ঘ সময় বদ্ধ ঘরে, অসুস্থকর পরিবেশে কাটানোর পর হঠাৎ করে ওর থেকে স্বাভাবিক আচরণের প্রত্যাশা করা উচিত নয়। ওকে কিছুটা সময় দেও। খানিকটা বুঝার চেষ্টা করো। আমার বিশ্বাস যথাযথ কাউন্সিলিং নিলে ও দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
– আপনি চিন্তা করবেন না। ওকে সুস্থ করার জন্য যা কিছু করা সম্ভব আমি করবো। তবুও যদি সুস্থ না হয়, তাতেও আমার সমস্যা নেই৷ ও এখন আমার দায়িত্ব। নিজ দায়িত্বের কোনো অবহেলা করবো না।
– শুধু দায়িত্ব থেকেই ওকে সাহায্য করছো?
– আপনি যদি ওর প্রতি আমার অনুভূতি নিয়ে সামান্যতম দ্বিধায় ভুগছেন, তাহলে বলে রাখি। আমি আমার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসি, ভাবি।

রেহবারের কথা শুনে ফোনের অপরপাশে শর্মী খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো। বিয়ের পর গুলিস্তার ফিরে আসায় রেহবারের উপর ভরসার ভীতটি নড়বড়ে হয়ে উঠেছিলো। খুব জানতে ইচ্ছে করলো, ভালোবাসলে মাঝপথে একলা ছেড়ে দিলো কেনো? অন্যের বৈবাহিক জীবনের সব রহস্য উদঘাটন করতে নেই। নিজের কৌতুহল দমিয়ে রেখে মন খুলে দোয়া করলো,
– তোমরা সুখী হও। দোয়া করি।
– আপনি কীভাবে এই জেলখানায় ফেঁসে গেলেন, বলুন তো?
– সবই ভাগ্যের ফের৷ বাবা মা বিয়ে দিয়ে দিলো, এসে গেলাম এই জেলখানায়৷

শর্মী খানিকটা হেসে গুমোট আবহাওয়া স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।
– আজ রাখছি। মাঝেমধ্যে কল দিয়ে তোমাকে বিরক্ত করবো। কিছু মনে করো না। মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়৷

***

ল্যাপটপের স্ক্রীনে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকা রাহিল ও আম্বিয়া খাতুনের দিকে চেয়ে রেহবার অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
– এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?

আম্বিয়া খাতুন নিজেকে সামলে নিলেও রাহিল বললো,
– তুমি শিওর, ওই মহিলা ভাবীর নিজের মা? আমার তো মনে হচ্ছে ভাবীর শ্রদ্ধেয় পিতা মহাদয়ের অন্য কোথাও চক্কর ছিলো। ভাবী সেই পক্ষের মেয়ে৷ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা গেলো। তারপর বেচারা বাবা সদ্য জন্ম নেওয়া অবুঝ সন্তানকে এনে তুলে দিলো প্রথম স্ত্রীর হাতে। আজ থেকে ওর দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। নিজের সন্তান মনে করে ওকে বড় করো।

আম্বিয়া খাতুন ছেলের মাথায় চাটি মেরে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
– আজগুবি গল্প বানানো বন্ধ কর। সারাক্ষণ সিনেমা দেখে মাথাটা পুরো গেছে।

রাহিলকে থামিয়ে দিয়ে রেহবারকে বললেন,
– সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। দীর্ঘদিন ধরে রোগ পুষে রাখলে সে রোগ নিরাময় করতে একটু বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে তোকে প্রচুর ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে৷ তোর কাছে একটি কথা জানতে চাইবো রেহবার। ভেবে উত্তর দিবি
গুলিস্তাকে বিয়ে করায় তোর কি এখন আফসোস হচ্ছে?

গুলিস্তার মানসিক সমস্যা সম্পর্কে যা কিছু জানা ছিলো সবটাই আম্বিয়া খাতুন এবং রাহিলকে ভিডিও কলের মাধ্যমে জানিয়েছে রেহবার। ওর একার পক্ষে গুলিস্তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। পুরো পরিবার এগিয়ে এলো, সহজেই একটা ব্যবস্থা করে ফেলা যাবে। গুলিস্তার দীর্ঘ চিকিৎসা, কাউন্সিলিং এবং মানসিক সাপোর্ট এর প্রয়োজন। এই নিয়ে কথা হচ্ছিলো পারিবারিক অনলাইন মিটিং এ।
মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে এক মুহুর্ত দেরী করলো না রেহবার।
– আফসোস কেনো হবে মা! সত্যি বলতে আমি খুব একটা বিচলিত বোধও করছি না৷ বরং এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে। বিয়ে করলাম, সুখের সংসার করলাম। ব্যাপারটা কেমন সাদামাটা হয়ে যেতো না?
– এই কঠিন মুহূর্তগুলো, ধেয়ে আসা বিপদগুলো আমাদের বেঁচে থাকার প্রকৃত স্বাদ দেয়। যতো বেশি সমস্যার মুখোমুখি হবে, জীবন ততো বেশি রঙিন হয়ে উঠবে। একাধারে সুখে দিন কাটলে জীবনের প্রতি বিরক্তি এসে যায়। তাই তো দুঃখ আসে, বিপদ আসে। যা ক্ষণস্থায়ী। এই কথা সারাক্ষণ মাথায় রাখবি। কখনো হতাশ হবি না৷

মায়ের সাথে কথা বললে যেকোনো দুশ্চিন্তা নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। মা যেনো ম্যাজিক পার্সোন। যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখার চমৎকার গুণ রয়েছে ইতিবাচক চিন্তাধারী এই মানুষটির। এমন মায়ের সন্তান হিসেবে জন্ম নেওয়ার সুযোগ প্রদান করায় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিনিয়ত শুকরিয়া জানায়।

পারিবারিক আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো গুলিস্তাকে দ্রুত মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। ডাক্তার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলো রাহিলকে। এই সুযোগে আম্বিয়া খাতুন আবদার করলেন, গুলিস্তার চিকিৎসা যেনো ফ্লোরিডায় করানো হয়। দেশে তেমন ভালো কোনো সাইকোলজিস্ট পাওয়া মুশকিল। ফ্লোরিডা এলে উন্নত চিকিৎসাও পাওয়া যাবে। আবার দীর্ঘদিন পর পুরো পরিবার একসাথে সময়ও কাটাতে পারবে।

কথা বলা শেষে রেহবার ঘড়ির দিকে তাকালো। ডিনারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। মোবাইলটি হাতে নিয়ে গুলিস্তাকে ফোন করলো। স্টাডিরুম থেকে গলা ছেড়ে হাঁক দিয়েই গুলিস্তা ছুটে চলে আসবে। তবুও আজকাল ওকে ইচ্ছে করেই বিরক্ত করতে ভালো লাগে। ও বিরক্ত হয় কিনা বুঝা যায় না। তবুও রেহবার ইচ্ছে করে খোঁচায়।

সারাক্ষণ ছোট এই ডিভাইসটি নিজের সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ভীষণ অপছন্দ গুলিস্তার। তবুও রেহবারের আদেশ, ফোন যেনো কাছছাড়া না হয়৷ রান্না শেষ করে ডাইনিং টেবিলে খাবার গুছিয়ে রাখছিলো, এমন সময় বিকট শব্দে ফোন বেজে উঠলো। ব্যস্ত হাতে ফোন তুলে নিয়ে দেখলো রেহবারের কল। অবাক হয়ে দোতলার স্টাডিরুমে তাকিয়ে কল রিসিভ করলো।
– রান্না শেষ তোমার?
– হ্যাঁ। মাত্র শেষ হলো।
– এখনি খেতে ইচ্ছে করছে না। একটা কাজ করো। এক কাপ কফি দিয়ে যাও।
– দিচ্ছি।

কফি চাইতে কল করার কী প্রয়োজন, ভেবে পেলো না। একটু পরেই তো ডিনারের জন্য ডাকতে যেতো, তখন বললেই হতো। বেশি ভাবনা চিন্তা না করে দ্রুত কফি বানিয়ে স্টাডিরুমের দিকে গেলো৷
কফির কাপ হাতে নিয়ে রেহবার ওকে বসতে বলেছে। ডেস্কের অপরপাশে অযথা বসে থেকে নখ খুটছে গুলিস্তা। রেহবার ধীরে সুস্থে কফির কাপে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করে চলেছে। গুলিস্তা বুঝতে পারছে না, ওকে এভাবে বসিয়ে রাখার কারন কি? ওকে উশখুশ করতে দেখে রেহবার ভীষণ মজা পাচ্ছে। কাজের তো বাহানা মাত্র। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গুলিস্তাকে নিজের কাছাকাছি রাখা। ল্যাপটপের দিকে মুখ করে চোরাচোখে গুলিস্তা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। কখনো মাথা নিচু করে বসে কোলের মধ্যে রাখা হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলছে, আবার কখনো ডানপাশের দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, রেহবারের পেছনে থাকা জানালা দিয়ে অন্ধকার দেখছে কিন্তু ভুলেও রেহবারের দিকে তাকাচ্ছে না। রেহবারও নাছোড়বান্দা। প্রয়োজন হলে আজকে রাতের অর্ধপ্রহর এভাবেই বসে কাটিয়ে দিবে তবুও এর শেষ দেখে ছাড়বে। খানিকবাদে কফির কাপ খালি হয়ে গেলে রেহবার সেটা পাশে রেখে দিলো। ক্ষণিকেই গুলিস্তা উঠে দাঁড়িয়ে কফির কাপ হাতে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই রেহবার অবাক হয়ে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো?
– নিচে।
– এখানে বসতে বলেছি না তোমাকে? বসো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও চেয়ারে বসে গুলিস্তা মিনমিন করে বললো,
– বসে কি করবো?
– আমাকে দেখো৷

রেহবারের স্বাভাবিক উত্তর। কফির কাপ হাতে নিয়ে সেটা নাড়াচাড়া করে কয়েক মিনিট অতিবাহিত হলে গুলিস্তাকে বাধ্য হয়ে বলতেই হলো,
– খাবারগুলো ডাইনিং এ রেখে এসেছি। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো রেহবার৷ গুলিস্তার কথায় মাথা তুলে ঘড়ির দিকে তাকালো। নয়টা পেরিয়ে গেছে। অনুরোধের সুরে জানালো,
– আর দু মিনিট। কাজ প্রায় শেষ।

( চলবে..)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ত্রয়োবিংশ পর্ব

মানুষ স্বভাবতই কৌতুহলপ্রবণ। জানার আগ্রহ মানুষকে পৌঁছে দিয়েছে গুহা থেকে বিলাস বহুল বহুতল ভবনে। তবে জানার আকাঙ্ক্ষা সবসময় সুফল বয়ে নিয়ে আসে না। এই যেমন রেহবারের কথাই ভাবুন। বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই মা-ভাই বিদেশে রওনা দিলো। সেই থেকে গুলিস্তা এই বড় বাড়িটিতে একাই দিন কাটিয়েছে। দিনের কয়েক প্রহর মালা সাথে থাকলেও রেহবারের কর্মব্যস্ত জীবনের কারনে গুলিস্তাকে একা একাই থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়েছে। রেহবার অবশ্য তখনো জানতো না, একলা থাকার অভ্যাস গুলিস্তার আজন্ম আয়তব করা। কিন্তু এখন যেইনা গুলিস্তার মানসিক অবনতি সম্পর্কে জেনেছে, ওমনি গুলিস্তাকে নিয়ে ওর চিন্তার শেষ নেই। গত কয়েকদিন বেচারা অফিসেই যায়নি। কিন্তু ওয়ার্ক ফ্রম হোম কয়দিন সম্ভব! আজকে বাধ্য হয়ে অফিসে যেতেই হচ্ছে।
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা গুছিয়ে নিচ্ছিলো রেহবার৷ আশা করা যাচ্ছে, খুব দ্রুত ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারবে। ইতোমধ্যে গুলিস্তার পাসপোর্টের আবেদন করা হয়ে গিয়েছে। সনামধন্য একজন সাইকোলজিস্টের খোঁজ পেয়েছে রাহিল। আজ রাতে রেহবারের সাথে অনলাইন মিটিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই যাচ্ছে শুধু পরিবর্তন নেই গুলিস্তার আচরণে। এজন্য অবশ্য রেহবার নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা সাজিয়েছে। আগে নিজের কাজগুলো নিজে করার চেষ্টা করতো। যতোটা সম্ভব গুলিস্তার উপর হতে কাজের প্রেসার কমানোর প্রয়াস। কিন্তু আজকাল সে বড্ড অলস হয়ে গেছে। সে কোনো কাজে গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করে, ফুল, এই ফুল…
গুলিস্তা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করে না। বিনাবাক্যে আদেশ পালন করে৷ যে রেহবার একজন অর্গানাইজড পার্সোন ছিলো, সে এখন পুরোই এলোমেলো। গোসল করতে গিয়ে তোয়ালে নিতে ভুলে যায়, চেঞ্জিং রুমে দাঁড়িয়ে দ্বিধায় ভুগে কোন শার্টটি পরবে, সামনে পরে থাকা হাতঘড়িটিও খুজে পায় না, অফিস থেকে ফিরে গাড়ির চাবি কোথায় রেখেছে জানে না। সবকিছুতেই এখন তার ফুলের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। শাওয়ার নিয়ে বাথরুমের দরজাটি হালকা খুলে একটু উঁকি দিয়ে বাইরে তাকালো। গুলিস্তাকে ডাকতে যাবে তখনি চোখের সামনের দৃশ্য দেখে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। দরজার সামনে গুলিস্তা নিজেই দাঁড়িয়ে আছে তোয়ালে হাতে। অপ্রস্তুত হেসে হাত বাড়িয়ে তোয়ালা নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ‘মেয়ে চালাক হয়ে গেছে দেখছি।’

শরীরের নিম্নভাগে একটি তোয়ালে পেচিয়ে অন্য একটি তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে রেহবার বের হলো। চেঞ্জিং রুমে আরেক চমক অপেক্ষা করছিলো। সেখানেও রেহবারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে গুলিস্তা। সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে গিয়ে কিছুক্ষণ পরপর ‘ফুল, এই ফুল’ ডাকের কারনে রান্নায় মনোযোগ দেওয়া যায় না। তাই তো আজ দ্রুত ঘুম থেকে উঠে রান্নার কাজ শেষ করে ঘরে এসে বসে ছিলো। রেহবারের উন্মুক্ত শরীরের দিকে নজর পরতেই গুলিস্তা মাথা নিচু করে নিলো। তা দেখে রেহবারের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি উঁকি দিয়েছে। গুলিস্তার হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– চুলগুলো মুছে দেও।

রেহবার বসেছে টুলের উপর। ওর পেছনে খানিক দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছে দিচ্ছে গুলিস্তা। খানিক পরপর রেহবার পেছনে দিকে ঝুকে গুলিস্তার গায়ের উপর হেলান দেওয়ার চেষ্টা করছে। উদরে রেহবারের উন্মুক্ত পিঠের ছোয়া পেতেই গুলিস্তা খুব সাবধানে সরে যায়। তা বুঝতে পেরে রেহবার আবার একটু হেলে যায়। এবারও গুলিস্তা সরে গেলে রেহবার একটু বেশি ঝুকে গিয়ে মাথা ঠেকালো গুলিস্তার বুকে। চকিতে সরে গিয়ে গুলিস্তা তোয়ালে ছুড়ে দিলো রেহবারের দিকে। হড়বড়িয়ে বললো,
– হয়ে গেছে।

চেঞ্জিং রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে নিলে পেছন থেকে রেহবার বললো,
– আরে আমার কাপড়চোপড় বের করে দিয়ে যাও।

ঝড়ের বেগে হাতের কাছে যা পেলো সেখান থেকে একটি শার্ট, স্যুট প্যান্ট বের করে টুলের উপর রেখে ছুটে বেরিয়ে এলো গুলিস্তা।
নাস্তার টেবিলে খাবার খেলো নীরবে। খাওয়া শেষে গুলিস্তা উঠে যেতে নিলে রেহবার নতুন আদেশ জারি করলো।
– চট করে রেডি হয়ে নেও। আমার সাথে অফিসে যাবে।

গুলিস্তা তার জীবনকালে এতো অবাক মনে হয় কখনো হয়নি। কথা বলতেই ভুলে গেলো। অফিস যাবে মানে! অফিসে ওর কি কাজ? দিনদিন এই লোকের মতিভ্রম হচ্ছে নাকি। বগুড়া থেকে ফেরার পর থেকেই কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। সারাক্ষণ গুলিস্তার আশেপাশে ছায়ার মতো ঘুরতে থাকে। গুলিস্তার ভীষণ অস্বস্তি হলেও, কিছু বলে না। উনার বাড়ি, উনি সেখানে খুশি থাকবে। কিন্তু এবার অত্যাচারের মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেলো না! গুলিস্তা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
– অফিস! আমি যাবো?
– হ্যাঁ। আমার সাথে তুমিও যাবে।
– আমি তো কোনো কাজ জানি না।
– কাজ জানতে হবে না। যাও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেও। দেরী হয়ে যাচ্ছে।

গুলিস্তার মাথা ভনভন করছে। অফিসে কতো লোকজন থাকবে! ওখানে গুলিস্তার কী কাজ? রাগে, দুঃখে কান্না পাচ্ছে। ফাজলামি পেয়েছে নাকি! যখন যা মন চাচ্ছে হুকুম জারি করছে। ও অফিসে গেলে বাড়িতে কে থাকবে, দুপুরের রান্না করা এখনো বাকি। তাছাড়া একজন এসএসসি পাস মানুষকে দিয়ে অফিসের কি কাজ হবে? কতোশত প্রশ্ন গুলিস্তার মাথায় উঁকিঝুকি দিচ্ছে৷ এসব ভাবতে ভাবতে সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। ঝটপট রেডি হয়ে নিচে নামতে রেহবার কিছু না বলে ওর হাত ধরে ঘর ছাড়লো। বাড়ির সদর দরজায় ঝুললো বড় একটি তালা।

বহুতল ভবনটির চতুর্থ ফ্লোরে রেহবারের অফিস। সব মিলিয়ে অর্ধশত মানুষের কর্মসংস্থান এই ফ্লোরটিতে৷ গুলিস্তাকে নিয়ে আসার খবর এই মধ্যেই লিতুনকে জানানো হয়েছে৷ অফিসের সবাই সতর্ক হয়ে নিজ আসনে বসে থাকলেও আড়চোখে তাকাচ্ছে বস এবং তার স্ত্রীর দিকে। অফিসে প্রবেশ করা মাত্রই গুলিস্তার হাঁটু দুটো কেঁপে উঠলো। চারপাশে এতো মানুষজন! তাদের সামনে দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে হচ্ছে৷ তীব্র নার্ভাসনেসের কারনে শরীরের ভার ধরে রাখা দায়। মনে হচ্ছে এখনি পরে যাবে৷ তখনি একটা শক্ত হাত ওর হাতে হাত রাখলো। আলোর দিশারী হয়ে রেহবার ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গুলিস্তা নিচের দিকে তাকিয়ে কোনো রকম হেঁটে চললো। কোথায় যাচ্ছে কিছু জানে না।
– ভেতরে এসো।
রেহবারের ডাকে সামনে তাকিয়ে দেখলো ওরা কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে।

রেহবারের কেবিনটি বেশ ছিমছাম, পরিপাটি৷ মাঝখানে ডেস্ক এবং চেয়ার রাখা। একপাশে কেবিনেট। সেখানে কিছু ফাইল গুছিয়ে রাখা। অপরপাশে ওয়াশরুম ও কিচেন স্পেস৷ দেয়ালে কিছু পেইন্টিং ও দেয়াল ঘড়ি দেখা যাচ্ছে৷ গুলিস্তা খেয়াল করে দেখলো রেহবারের ডেস্কের ঠিক অপরপাশে একটি সোফা সেটও রয়েছে৷ সেখানে বসতে গেলে রেহবার ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজের ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসতে বললো।
যথাযথ নিয়মে অফিসের কার্যক্রম চললেও সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম ব্যক্তিটি গুলিস্তা। অনেকেই কৌতুহলী চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে, এই ব্যাপারটি ওকে অস্বস্তি বোধ করাচ্ছে। লিতুনকে কাজের শিডিউল বুঝিয়ে দিয়ে রেহবার নিজেও কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। কাজের ফাঁকে গুলিস্তাকে লক্ষ্য করছিলো। ওর উদ্দেশ্যে ছিলো গুলিস্তা ধৈর্য্যের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। চুপচাপ অফিসে চলে এলেও দীর্ঘক্ষণ এভাবে বসে থাকা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ওর ধৈর্যের পরীক্ষা কর‍তে গিয়ে রেহবার নিজেই হেরে গেলো। মেয়েটা ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। একজন মানুষ কতোটা নার্ভাস হলে এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় দরদর করে ঘামে! এই ভেবে রেহবারের খানিকটা খারাপ লাগলো। সামনে থাকা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
– পানি খাও। গরম লাগছে? এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দিবো?

পানি পান করে গুলিস্তা উল্টো হাতে কপালের ঘাম মুছে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো।
সামনে থাকা ল্যাপটপটি সরিয়ে রেহবার খানিকটা ঝুঁকে গুলিস্তার কপালে দু আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিলো। ব্যথা পেয়ে কপালে হাত দিয়ে গুলিস্তা অবাক চোখে তাকাতেই রেহবার হেসে বললো,
– মাথার মধ্যে কি চলছে? কিছু জানতে ইচ্ছে করলে প্রশ্ন করো। আমি বাঘ না ভাল্লুক যে তোমাকে খেয়ে ফেলবো? এতো ভয় পাও কেনো?

এদিক ওদিক তাকিয়ে গুলিস্তা জবাব দিলো,
– কিছু চলছে না।
– অবশ্যই কিছু চলছে৷ কি কি প্রশ্ন আছে করে ফেলো দেখি।

গুলিস্তার মনে অনেক অনেক প্রশ্ন ঘুর পাক খাচ্ছে। কোনটা রেখে কোনটা আগে বলবে? প্রশ্ন করা উচিত হবে কিনা তাও জানে না। গুলিস্তার কথা যদি রেহবারের অবান্তর মনে হয়, তবে কি সেও মায়ের মতো রেগে যাবে? ইতস্তত বোধ করলেও অনেকক্ষণ পর খানিকটা ভয় নিয়ে প্রশ্ন করলো,
– আমি বাড়ি ফিরে যাই?
– বাড়িতে একা কি করবে!
– দুপুরের রান্না করতে হবে।
– আমরা মাত্র দুজন মানুষ। দুজনে বাইরে আছি। রান্নার কি দরকার! বাইরে খেয়ে নিবো।
– এখানে বসে থেকে কি করবো?
– বসে থাকতে ইচ্ছে না করলে হেঁটে বেড়াও। ওখানে কিছু বই রাখা আছে, বই পড়ো। কিচেন থেকে আমার জন্য কফিও করে আনতে পারো।

ইচ্ছা না থাকলেও মাথা নেড়ে সায় দিতে হলো। কয়েকটা দিন গুলিস্তার ভীষণ বাজে কেটেছে৷ অস্বস্তিতে গাট হয়ে রেহবারের সামনে বসে থাকতে হয়েছে৷ মাঝেমধ্যে রেহবার ওকে দিয়ে টুকটাক কাজও করিয়ে নিয়েছে। নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ চলছিলো। ক্লায়েন্ট তাদের ডিমান্ড ও প্রেফারেন্স মেইল করেছে। ল্যাপটপটি গুলিস্তার দিকে এগিয়ে দিয়ে রেহবার বললো,
– এখানে যে কোটেশনগুলো রয়েছে এই নোটপ্যাডে লিখে ফেলো।

গুলিস্তা মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো। রেহবার সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখছে৷ সে চাইলে লিতুনকে দিয়ে কাজটা করাতে পারতো, তা করলো না।
গুলিস্তা অনেকক্ষণ নিজের দাঁতে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। কম্পিত হাতে নোটপ্যাড কলম তুলে নিয়ে লিখতে শুরু করলো। কখনো লেখা বাঁকা হলো, বানান ভুল হলো, লেখার সৌন্দর্যও হারালো৷ পরপর কয়েকবার চেষ্টার পর যখন লেখা শেষ হয়েছে, বারবার রিভিশন দিয়ে নিলো।
নোটপ্যাডের লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে রেহবার। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
– তোমার হাতের লেখা চমৎকার। আর আমার হাতের লেখা দেখো, কেমন আঁকাবাঁকা। কী যে লিখি, মাঝেমধ্যে আমি নিজেই বুঝি না৷

রেহবারের চোখে মুখে মুগ্ধতা দেখে ভীষণ ভালো লাগলেও সেটা প্রকাশ করার মাধ্যম জানা নেই। তবুও ভালো লাগায় ভেতরটা বুদ হয়ে রইলো। সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না রেহবারের পরবর্তী আদেশে।
– ডানদিকের ডেস্কে যে ভদ্রলোক বসে আছেন, উনি এই প্রজেক্টের মূল দায়িত্বে আছেন৷ উনাকে এই কাগজটি দিয়ে এসো।
– আমি যাবো!

গুলিস্তা মনে হয় আকাশ থেকে নিচে পরে গেলো। এতোদিন তাও রেহবারের আগেপিছে ঘুরে কোনোরকমে দিন কেটে গেছে। এখন বাইরের পরিবেশের মুখোমুখি কীভাবে হবে! রেহবার মনে হয় গুলিস্তার বিস্ময়কে তেমন পাত্তা দিলো না। ব্যস্ত হয়ে বললো,
– যাও, নিয়ে যাও। ফিরে এসে এই ফাইলগুলো গুছিয়ে রাখবে।

শাড়ির আঁচলে গলার ঘাম মুছে গুলিস্তা চারপাশে নজর বুলিয়ে নিলো। কী বোর্ডের খটখট শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ কানে আসছে না। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। গুলিস্তাকে দেখে কয়েকজন সামান্য হেসে নীরব অভ্যর্থনা জানালো। তা দেখে হকচকিয়ে গিয়ে অন্য পাশে তাকালো গুলিস্তা। প্রজেক্ট হেড গুলিস্তা দেখে নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো।
– আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেনো ম্যাম! আমাকে বললে আমি নিজে চলে আসতাম৷

গুলিস্তা কোনো জবাব দিলো না। কাগজটি ডেস্কের উপর রেখে উল্টোদিকে ফিরে রেহবারের কেবিনের দিকে ছুটে গেলো। প্রজেক্ট হেড অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো বুঝতে পারছে না। অতল গহ্বর থেকে উনাকে উদ্ধার করলো লিতুন। রেহবার ওকে গুলিস্তা সম্পর্কে হালকা কিছু ধারণা দিয়েছে। গুলিস্তা চরমভাবে সোশ্যাল এনজাইটিতে ভুগছে। পরিচিত অপরিচিত কারো সাথেই সহজে মিলেমিশে যেতে পারে না। নোডপ্যাডে লিখিত কোটেশনগুলো উনাকে বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটি লিতুন সামলে নিলো। রেহবার ওকে আগেই মেইল পাঠিয়ে দিয়েছিলো।

(চলবে…)