হে সখা পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
134

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
চতুর্বিংশ পর্ব

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেহবার চুল চিরুনী করছে। সেই সাথে দেখছে দরজা থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া গুলিস্তাকে। মেয়েটা কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু বলছে না। এই নিয়ে কয়েকবার দরজার সামনে এসে আবার ফিরে গেছে। রেহবারের এতোটা অনুপ্রেরণামূলক আচরণের পরেও কিছু বলতে দ্বিধা করছে ভেবে খানিকটা মন খারাপ হলো। ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেও খাবারের নাড়াচাড়া করতে দেখে রেহবার নিজেই জানতে চাইলো,
– কি বলতে চাইছো বলে ফেলো। এতো ভাবনা চিন্তা করার দরকার নেই৷ কখনো কখনো আমাদের হুট করে কিছু কাজ করে ফেলতে হয়। এতো ভেবে চিন্তে জীবন চলে নাকি!

কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। তারপর মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললো,
– অফিস না যাই?
– আচ্ছা, যেতে হবে না।

রেহবারের স্বাভাবিক উত্তর শুনে গুলিস্তা অবাক হলেও ভাবলেশহীন কন্ঠে জানতে চাইলো,
– সত্যি?
– হ্যাঁ যেতে ইচ্ছে না করলে যাবে না। তবে এখন আমরা অফিসে নয়, অন্য কাজে বাইরে যাবো। তৈরী হয়ে নেও।

পাসপোর্ট অফিসের সামনে এসে গুলিস্তা আরেকুদফা অবাক হলো। কিন্তু রেহবারের পিছু পিছু ভেতরে প্রবেশের পর ওকে যা যা করতে বলা হলো বিনাবাক্যে সেগুলো মেনে নিলো। ফটোসেশন, আই স্ক্যানিং, ফিংগারপ্রিন্ট এর প্রক্রিয়া শেষ হলো দ্রুত। কাগজপত্র যা কিছু প্রয়োজন ছিলো সেগুলো রেহবার জমা দিয়ে দিয়েছে। দ্রুত কাজ শেষ করে ওরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রেহবার ভেবেছিলো গুলিস্তা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবে, পাসপোর্টের ব্যাপারে জানতে চাইবে। সেসবের কিছু হলো না। পথের ধারে ফুচকার দোকান চোখে পরায় রেহবার গাড়ি থামালো।
গাছের নিচে চেয়ার টেবিল পাতানো। সেখানে বসে এক প্লেট দই ফুচকা অর্ডার করলো। পুরোটা সময় গুলিস্তা খুব আগ্রহ নিয়ে রেহবার ও ওয়েটারের কথোপকথন শুনলো।

– তোমাকে খুব সহজে বোকা বানিয়ে বিপদে ফেলা যাবে, এটা জানো?
গুলিস্তা মাথা দুলিয়ে না জানালো। তা দেখে রেহবার হেসে বললো,
– তোমাকে একটি অপরিচিত জায়গায় নিয়ে গেলাম, তুমি বিনাবাক্যে চলে গেলে। জানতেও চাইলে না কোথায় নিয়ে যাচ্ছি! ওখানে তোমাকে যা যা করতে বলা হলো, তা চুপচাপ মেনে নিলে। কেনো ছবি তুললো, আই স্ক্যান করলো কিছুই জানো না। তোমার মধ্যে কোনো কৌতূহল নেই, সতর্কতাও নেই। এসব কালেক্ট করে তোমাকে যেকোনো বিপদেও ফেলতে পারে।
– আপনি সাথে ছিলেন তো।
– কাউকে চোখ বুজে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। পরিচিত অপরিচিত কারো উপরেই এতোটা নির্ভরশীল হবে না। পাসপোর্ট অফিসে কেনো যাচ্ছি এটা আমাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো। এখনো কিন্তু কিছু জানতে চাচ্ছো না। অথচ মনে ঠিকই প্রশ্ন জেগেছে৷

ধরা পরে যাওয়ায় গুলিস্তা মাথা নিচু করে ফেললো।

– আমরা ফ্লোরিডা যাচ্ছি। মায়ের সাথে দেখা করতে। সামনের মাসের মধ্যেই যেতে পারবো মনে হচ্ছে।

গুলিস্তা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। এতোদিন তো দেশের মানুষদের কোনোরকম সহ্য করে নেওয়া গেছে। এখন ফটরফটর করে ইংরেজি বলা মানুষদের কীভাবে ফেস করবে! গুলিস্তার মনে হলো সে ধুলোর সাথে মিশে যাচ্ছে।

এরমধ্যে ওয়েটার ফুচকার প্লেট নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো। রেহবার নিজে বাইরের খাবার তেমন একটা খায় না। যথা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তার জানা মতে মেয়েদের ফুচকার প্রতি প্রচন্ড দূর্বলতা রয়েছে। তাই গুলিস্তাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে এসেছে। এই মেয়ে তো নিজে কখনো কিছু আবদার করবে না।
– নেও, খাওয়া শুরু করো।

ফুচকার প্লেট নিজের দিকে টেনে নিয়ে গুলিস্তা ভেবে পাচ্ছে না, আগে কোনটা খাবে। চামচ হাতে বাটির মধ্যে থাকা তরল নাড়াচাড়া করে পাশে রাখা পুরের দিকে তাকালো। কেমন অদ্ভুত সব জিনিসপত্রে প্লেট ভরিয়ে ফেলেছে। ওকে উদাসভাবে খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রেহবার জানতে চাইলো,
– খাচ্ছো না কেনো?
– কীভাবে খাবো?

গুলিস্তা মিনমিনে কি বললো রেহবার শুনতে পেলো না। শুধু দেখতে পেলো গুলিস্তা মাথা ঝুঁকিয়ে চিবুক একদম বুকের সাথে মিলিয়ে ফেলেছে। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
– কী সমস্যা?

ক্ষণিকেই মস্তিষ্কে নতুন সন্দেহ উদিত হলে সন্দিহান গলায় বললো,
– এক মিনিট, তুমি কি আগে কখনো ফুচকা খাওনি? আমার জানামতে ফুচকা দেখলেই মেয়েরা হামলে পরে। রাহিল পর্যন্ত ফুচকা বলতে পাগল।

লজ্জায়, অপমানে গুলিস্তার কান্না পেলো। সে মাথা নিচু করে রেখেই মাথা দুদিকে দোলালো। রেহবার হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে ফুচকার প্লেট নিজের দিকে টেনে নিলো। শার্টের স্লিভল গুটিয়ে হাত ধুয়ে পুর দিলো ফুচকার ভেতর। টকে চুবিয়ে গুলিস্তার মুখের সামনে ধরে বললো,
– দেখি মুখ খোলো। বড় করে হা করবে৷ এটা পুরোটা একসাথে খেতে হয়৷

রেহবারের দুষ্টু, মিষ্টি, বিরক্তিকর আদেশ পালন করতে করতে পুরো একটা মাস কেটে গেছে।
দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করতে হবে তাই অফিসের জরুরি কাজগুলো গুছিয়ে নিতে এই কয়েকটা দিন অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে। তবুও কাজের ফাঁকে গুলিস্তার খবর নিতে কখনো ভুলেনি।প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েকবার ফোন দিয়ে গুলিস্তার খবর নিতো। সময় মতো খাবার খেয়েছে কিনা, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, কখনো অযথা ফোন দিয়ে জানতে চাইতো গুলিস্তা এখন কি করছে। রেহবারের উত্তাল ঝড়ের বিপরীতে গুলিস্তা বরাবরই ধীর, শান্ত।
এখন যেমন বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে চুপটি করে। বিছানার উপর বড় দুটো লাগেজ খুলে সেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে রাখার কাজটি রেহবার নিজেই করছে। বগুড়া যাওয়ার সময় গুলিস্তাকে প্যাকিং এর কাজ দেওয়ায় ভালোই খেসারত দিতে হয়েছিলো। ফোন প্রায় ফেলে রেখে যাচ্ছিলো৷ চার্জার তো রেখেই গিয়েছিলো। তাই এবার আর কোনো রিস্ক নেয়নি। গুলিস্তার কী কী প্রয়োজন সেগুলো ওকে দিয়ে আনিয়েছে। তারপর সেগুলো নিজেই রিচেক করে লাগেজে ভরছে৷
– আর কিছু নিতে চাইলে এখনি বলো।
– কিছু নেই।
– প্রয়োজনীয় কিছু ফেলে যাচ্ছো কিনা আরেকবার ভেবে দেখো।
গুলিস্তার মনে হলো, সে নিজের প্রশান্তি এখানে ফেলে যাচ্ছে। চাইলেও সে কথা রেহবারকে বলা সম্ভব নয়।

সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ঢাকা থেকে দুবাই এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। রেহবার ও গুলিস্তা সেই বিমানেই যাত্রা করেছে। গুলিস্তার মনে হচ্ছে কেউ তার দেহ থেকে প্রাণটা কেড়ে নিয়ে যেতে চলেছে। রেহবার ওর অনুভূতি বুঝতে পারলেও তেমন একটা পাত্তা দিলো না। না চাইতেও এইটুকু অস্বস্তিতে ওকে ফেলতেই হচ্ছে। কিন্তু জার্নির পুরোটা সময় নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করে ওর খারাপ লাগাটুকু ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে।
ফ্লাইটে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে কয়েকবার হয়েছে, তাই এবার তেমন একটা অসুবিধা হলো না। শুধু গায়ের অদ্ভুত পোষাকটা সামান্য প্যারা দিচ্ছ। এমনিতেই সালোয়ার কামিজ ও শাড়ি পরে অভ্যস্ত গুলিস্তা। বিয়ের পর বরাবর শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে। মা, ভাবীদের থেকে এমনটাই শিখেছে সে৷ আজকেও বিকালে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে যাচ্ছিলো তখন একটি নতুন শাড়ি আলমারি থেকে বের করেছে মাত্র। কোথা থেকে রেহবার এসে সেটি আবার আলমারিতে তুলে রেখে দিলো। হাতে একটি শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে সেটি পরতে বললো। সেই পোষাক পরে গুলিস্তার হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গিয়েছে। চেঞ্জিং রুমের পা সমান লম্বা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়া বাকি ছিলো মাত্র। এদিকে রেহবার একটু পর পর দরজায় কড়া নেড়ে যাচ্ছে।
– কই? হলো তোমার? আরেহ আর কতোক্ষণ লাগবে! তাড়াতাড়ি বের হও। আমাকেও তো রেডি হতে হবে নাকি!

বাধ্য হয়ে চেঞ্জিং রুম ছেড়ে বেরিয়ে রেহবারের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু করছিলো। কিন্তু রেহবার ওর দিকে তাকালো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে।

– গায়ে ঠিকঠাক হয়েছে দেখছি! আমি তো ভাবছিলাম বড় সাইজ নিয়ে ফেললাম কিনা! ওমন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াও।

ঢিলেঢালা একটা প্যান্ট এর সাথে লম্বা শার্ট পরে গুলিস্তার প্রাণ যায় যায় দশা। আর সে কিনা সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তবুও রেহবারের আদেশে একটুখানি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে ওর চোখের দিকে তাকালো। সেখানে বরাবরের মতোই মুগ্ধতা। হালকা হাসি বিনিময় করে চেঞ্জিং রুমে চলে গেলো। গুলিস্তাকে দিয়ে গেলো আত্মবিশ্বাসী হওয়ার একটুখানি মন্ত্রণা।

জানালার পাশের সীটে বসে নিজের গায়ের অদ্ভুত পোষাকটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে গুলিস্তা। ফুল স্লিভস শার্ট পুরো শরীর ঢেকে রেখেছে। ঢিলেঢালা আরামদায়ক কাপড় হওয়ায় খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। তবুও গড়পড়তা বাঙালি মন। বসে থাকার কারনে শার্টটি হাঁটুর নিচে উঠে এসেছে। সেটি বারবার টেনে নিচে নামানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেটি খেয়াল করে রেহবার ওর হাত দুটো নিজের দিকে টেনে নিলো।
– এমন উসখুস না করে শান্ত হয়ে বসো। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে৷ প্রচুর এনার্জি দরকার হবে। যেকোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানাবে। একদম মনের মধ্যে চেপে রাখবে না।

দুবাই এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছালো তখন বাংলাদেশ সময় রাত বারোটা ত্রিশ মিনিট। ঘুমে গুলিস্তার চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। ওদের পরবর্তী ফ্লাইটের তখনো তিন ঘন্টা সময় বাকি। গুলিস্তাকে চেয়ারে বসিয়ে রেহবার ছুটে গেলো খাবার আনতে। এদিকে ব্যস্ত এয়ারপোর্টে এতো রাতেও মানুষজন গিজগিজ করছে। হঠাৎ গুলিস্তার পাশের চেয়ারে একজন পুরুষ এসে বসলো। কেতারদুস্ত ভদ্র লোক। পাশে বসেই মুখে হাসি টেনে অভ্যর্থনা জানালো,
– হাই।

এ কেমন ভদ্রলোক হলো! বসার আগে অনুমতি পর্যন্ত নিলো না। অপরিচিত পুরুষ মানুষের সান্নিধ্যে গুলিস্তার আত্মা কেঁপে উঠলো। আঁতকে উঠে নিজের আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে রেহবারকে খুজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না। এদিকে সেই ভদ্রলোক পরে গেলেন দ্বিধায়। মেয়েটি কোনো সমস্যায় পরলো না তো আবার? তিনি নিজেও দাঁড়িয়ে পরে গুলিস্তার কাছে জানতে চাইলেন,
– কোনো সমস্যা? সমস্যা হলে বলতে পারো? তুমি একা এসেছো? কাউকে খুঁজছো?

একেরপর এক প্রশ্ন করেও ভদ্রলোক কোনো উত্তর পেলেন না। এদিকে নিজের সামনে ফটফট করে ইংরেজি বলা লোকটিকে গুলিস্তার সুবিধা মনে হচ্ছে না। দু হাত নাড়িয়ে কি যে বলছে সেই জানে! কথা বলতে বলতে একদম গুলিস্তার কাছে চলে এসেছে। ভয়ে গুলিস্তা দু পা পিছিয়ে গেলো। এখন কি সে উল্টোদিকে ফিরে একটা ভোঁ দৌড় দিবে? আগে এমন গায়ে পরা লোক দেখলে সে দৌড়ে বাড়ি চলে যেতো কিন্তু এখান তো দৌড়ে বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র গন্তব্য রেহবার। যাকে সে হারিয়ে ফেলেছে। নিজের লাগেজ, ব্যাগপ্যাক ওখানে রেখেই গুলিস্তা সেখান থেকে দ্রুত পায়ে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু সে এক পা এগুলো সেই ভদ্রলোকও ওর পিছনে এক পা এগিয়ে যাচ্ছেন। অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছেন,
– আর ইউ ওকে? হোয়াটস রং উইথ ইউ? হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং? ইউ নিড এনি হেল্প?

গুলিস্তা জানে না সে কখন কান্না করতে শুরু করছে। শুধু জানে এই মুহুর্তে এই মানুষটির থেকে নিরাপদ দূরত্বে যেতে হবে। সে পেছন না ফিরে আরও দ্রুত পা চালালো।

( চলবে..)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
পঞ্চবিংশ পর্ব

প্লেনে যে খাবার দেওয়া হয়েছিলো সেটি গুলিস্তা ছুয়েও দেখিনি। এর মাঝে বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী ডিনার টাইম পেরিয়ে গেছে। গুলিস্তা নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত। সেই চিন্তা করেই কিছু হেভি স্নেকস নিতে খানিকটা দেরী হয়ে গেলো। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই ভীতু মেয়েটার প্রাণ যায় যায় দশা৷ রেহবার দ্রুত পা চালিয়ে ওয়েটিং এরিয়ায় এসে সাক্ষী হলো সুনসান নীরবতার। চকিতে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো গুলিস্তার খোঁজে। না বলে কোথায় যাওয়ার মতো মেয়ে সে নয়৷ রেহবারের কথা অমান্য করে আসন ছেড়েছে মানে চাপে পরে বাধ্য হয়ে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। এতো বড় বিমানবন্দরে এলোমেলোভাবে ওকে খুঁজে বেড়ানো বোকামি। রেহবার দ্রুত ভাবতে লাগলো।
প্রথম অপশন, বাথরুমে গিয়েছে। দীর্ঘ জার্নির পর বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
দ্বিতীয় অপশন, এখান থেকে উঠে যেতে বাধ্য হয়েছে।
প্রথম অপশন ধরে রেহবার বাথরুমে চেক করে নিরাশ হলো।
অতএব দ্বিতীয় অপশন নিশ্চিত। গুলিস্তা বসেছিলো বামপাশের প্রথম চেয়ারটিতে। এখান থেকে উঠে সে এতোটা ঘুরে ডানদিকে যাবে না। এ ধরনের মানুষেরা সবসময় ঝামেলা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। যে পদ্ধতিতে নিজের কাজ খুব সহজে সম্পন্ন করা যায়, সেই পদ্ধতিটি তারা বিনা বিবেচনায় অবলম্বন করে। অতএব গুলিস্তার এখান থেকে উঠে যেতে হলে সে সোজা বামদিকের রাস্তা ধরেই এগিয়েছে।
নিজেদের লাগেজ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সেখানেই ফেলে রেখে রেহবার ছুটতে থাকলো বামদিকে রাস্তা ধরে।
দূর থেকে গুলিস্তাকে চিনতে ওর বেশি সমস্যা হলো না। বারবার নিজের চারপাশে নজর বুলিয়ে, গন্তব্যহীন চলার কারনে বেশিদূর যেতে পারেনি গুলিস্তা। অপরিচিত সেই ভদ্রলোক এখন আর কিছু বলছে না। শুধু সতর্ক ভাবে ওর পেছনে হেঁটে চলেছে। ওর কাছে কী চাই কে জানে! এর মধ্যে পেছনে থেকে কেউ উচ্চস্বরে ডাক দিলো,
– ফুল…

গুলিস্তার মনে হলো সে ভুল শুনেছে। এমনিতেই অনেকক্ষণ ধরে মনে প্রাণে রেহবারকে ডেকে চলেছে। রেহবারের স্মৃতি মাথায় মধ্যে গিজগিজ করছে। তাই হয়তো মতিভ্রম হচ্ছে। কিন্তু সামনে তাকিয়ে দেখলো আশেপাশের মানুষজন সবাই ওর দিকেই চেয়ে আছে। তখনি পেছন থেকে আবার সেই কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
– এই ফুল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? আরে থামো বলছি।

গুলিস্তা অবাক হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো রেহবার ছুটে আসছে ওর দিকে। সামান্য কালক্ষেপণ না করে গুলিস্তা উল্টোদিকে ছুটে গিয়ে রেহবারের বুকে আছড়ে পরলো। দু হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বুকে মুখ গুজে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলো।

অপরিচিত ভদ্রলোক এতোক্ষণে খানিকটা নির্ভার হলেন। তবুও শিওর হওয়ার জন্য জানতে চাইলেন,
– হু ইজ শি টু ইউ?

তিরতির করে কাঁপতে থাকা গুলিস্তার পাতলা গড়নের নরম শরীরটি নিজের বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরেছে রেহবার। এক হাতে গুলিস্তার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অন্য হাতটি পরম নির্ভরশীলতায় মাথার উপর রেখেছে। ভদ্রলোকের কথায় তার সুন্দর হাসিটি হেসে বললো,
– শি ইজ মাই ওয়াইফ।
– আই থট শি লস্ট হার ওয়ে। সি ওয়াজ বেহেভিং উইয়ার্ড। সো আই ফলো হার।
– থ্যাংকস ফর ইউর হেল্প।
– টেক এ গুড কেয়ার অফ ইউর ওয়াইফ।
– আই উইল। হ্যাভ এ সেইস জার্নি।

রেহবার ভেবেছিলো দেখা হলে তার মুষড়ে যাওয়া ফুলকে একটুখানি বকে দিবে। এভাবে না বলে অচেনা জায়গায় একা একা চলা ফেরা করার দুঃসাহস হয় কী করে! কিন্তু বুকে আছড়ে পরা এই ফুলকে দেখে মন শান্ত হয়ে গেছে। বকা দেওয়া তো দূরের কথা বরং দু হাতে আগলে ধরে একটু আদর করে দিতে ইচ্ছে করছে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে রেহবার ধুতনি ঠেকালো গুলিস্তার মাথায়। আদুরে কন্ঠে জানতে চাইলো,
– ভয় পেয়ে গিয়েছিলে?

বুকের মাঝেই গুলিস্তা মাথা উপর-নিচ করে হ্যাঁ জানালো।
– ভেবেছিলে আমাকে হারিয়ে ফেলেছো?
– হু।
গুলিস্তার মনের কথা বুঝতে পারলেও মুখের সম্মতি রেহবারকে আলাদা প্রশান্তি দেয়। তাইতো বুঝতে পেরেও বারবার জানতে চায়।

প্রায় ছয় ঘন্টা পর দুবাই থেকে ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো রেহবার ও গুলিস্তা। গুলিস্তাকে বেশ ফুরফুরে দেখালেও রেহবারের ভীষণ ঘুম পেয়েছে। ওয়েটিং লবিতে রেহবারের কাঁধে মাথা রেখে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়ার কারনে গুলিস্তার চোখে এখন আর তেমন ঘুম নেই। আগ্রহী দৃষ্টিতে আশেপাশের মানু্ষজনকে দেখছে৷ পুরো প্লেনে ওরা দুজনই এশিয়ান। গুলিস্তাকে এভাবে তাকাতে দেখে রেহবার বললো,
– ঘুমানোর চেষ্টা করো। এভাবে টানা ১৬ ঘন্টা বসে থাকতে কষ্ট হবে।

গুলিস্তা ওর চোখ দুটো গোল গোল করে রেহবারকে ফিসফিফিয়ে বললো,
– ১৬ ঘন্টা এভাবে বসে থাকতে হবে! এতোক্ষণ কি করবো?
– ব্যাগ থেকে দুটো স্লিপিং আই মাস্ক বের করে একটি গুলিস্তাকে পরিয়ে দিয়ে বললো,
– ঘুমাও।

দু চোখে আঁধার নেমে আসায় গুলিস্তা চোখের সামনে থেকে দ্রুত সরিয়ে ফেললো কাপড়টি। রেহবারের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেও স্লিপিং আই মাস্কে চোখ ঢেকে সীটে হেলান দিয়েছে। গুলিস্তা আর কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো।
গাঢ় অন্ধকারের মাঝে মিটমিট করে কিছু আলো দেখা যাচ্ছে। যেনো ভূমির মধ্যে একখন্ড রাতের আকাশ। অমাবস্যার রাতে তারারা যেমন জ্বল জ্বল করে। পুরো প্লেন নীরবে ঘুমের দেশে পারি জমালেও গুলিস্তার চোখে ঘুম নেই। সীটের সামনে রাখা স্ক্রীনে খুব ধীর গতিতে একটি প্লেন পৃথিবীর মানচিত্রের একটি স্থান থেকে আরেকটি স্থানের দিকে যাচ্ছে। গুলিস্তা খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁজেও আশেপাশে কোথাও নিজের দেশকে দেখতে পেলো না৷ বাড়ি থেকে কি খুব দূরে চলে এসেছে? বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই ফাঁকা হয়ে গেলো। যেনো সে একলা কোনো সুনসান পাথারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কষ্টের কারন জানা নেই৷ বড় বড় শ্বাস ফেলেও যখন হৃদপিণ্ডের গতি নিয়ন্ত্রণে এলো না, তখন পাশে ঘুমন্ত রেহবারের দিকে তাকালো। গাঢ় শ্বাসের শব্দ জানান দিচ্ছে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। গুলিস্তা খুব সাবধানে রেহবারের হাতে নিজের হাত রাখলো। আঙুলের মাঝে নিজের আঙুল রেখে মাথা রাখলো রেহবারের ঘাড়ে। গাঢ় ঘুমের মাঝেও রেহবার হাতের বাধন শক্ত করে ধরতে ভুলে গেলো না। একটু নিচু হয়ে শুয়ে কাধে মাথা রাখার জন্য গুলিস্তার জন্য ঘুমের জায়গাটি আরামদায়ক করে দিলো। ঘুম না এলেও রেহবারের সান্নিধ্যে এখন আর ওতোটা খারাপ লাগছে না।

কয়েক ঘন্টা বাদে একজন রূপবতী বিমানমালা ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে এলো। খাবারের দুটো প্যাকেট সীটের সামনে রেখে হাস্যজ্বল মুখে জানতে চাইলো,
– উড ইউ লাইক টু টেক সাম ড্রিংকস ম্যাম?

রেহনার তখনো গভীর ঘুমে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে মন চাইলো না। তাই গুলিস্তা নিজেই মাথা দুলিয়ে না জানালো। ওর লাজুক মুখটি বিমানবালার ভীষণ ভালো লাগলো। সে নিজের কন্ঠে আরেকটু আন্তরিকতা মিশিয়ে বলল,
– উই হ্যাভ ব্লাডি মেরি, মিমোসা, জিন এন্ড টনিক, ওয়াসাবি মারটিনি, জালাপেনো মার্গারিটা, ওয়াইন। হুইচ ওয়ান ইউ লাইক টু টেস্ট?

গুলিস্তা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বুঝার চেষ্টা করলো মেয়েটি কি বলছে? কিন্তু একটি শব্দও বোধগম্য হলো না৷ ওদিকে বিমানবালা বেশ আগ্রহ নিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করছে৷ ওর কোনো তাড়া নেই। যেনো অন্ততকাল এখানে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে গুলিস্তার উত্তরের অপেক্ষা করতে পারবে। উপায় না দেখে গুলিস্তা খুব ধীরে রেহবারের গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। রেহবারের ঘুম ভাঙ্গা তো দূরের কথা তার মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তনও দেখা গেলো না। বিমানবালা নিজেও গুলিস্তার কাজকর্ম বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। গুলিস্তা বাধ্য হয়ে বার কয়েক রেহবারের কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকলো,
– রেহবার, রেহবার?

রেহবারের মনে হচ্ছে সে কোনো স্বপ্নে দেখছে। মেঘের ভেলায় আরাম করে শুয়ে আছে, চারদিকে শীতল বাতাস। পাশে বসে গুলিস্তা ভালোবেসে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকছে, রেহবার, রেহবার…
রেহবার জানে এসব কল্পনাতেই সীমা বদ্ধ। তার মুষড়ানো ফুল কখনো তাকে ডাকেনি। এখন ডাকবে? তাও আবার নাম ধরে! এই সৌভাগ্য রেহবারের নেই। কাঁধের অনবরত মৃদু আঘাতে রেহবারের স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটলো। ঘুম ভেঙে কিছুটা ধাতস্থ হতেই বুঝতে পারলো পাশ থেকে নারী কন্ঠ ওর নাম ধরে ডাকছে। যেই কন্ঠটি তার স্ত্রীর। চোখ হতে দ্রুত মাস্ক সরিয়ে অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে গুলিস্তার দিকে তাকালো। এভাবে রেহবারের ঘুম ভাঙানোর কারনে গুলিস্তার অনুশোচনা হচ্ছে। তাই ব্যথিত মুখে রেহবারকে বললো,
– খাবার দিতে এসেছে।

সুখের স্বপ্ন ভেঙে রেহবার বাস্তবিকতায় পদার্পণ করে বিমানবালার দিকে তাকাতেই সে হেসে আবার ড্রিংকস অফার করায় রেহবার সে প্রস্তাব ভদ্র ভাবে নাকচ করে দিলো। মনে মনে বিমানবালাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতেও ভুললো না। উনার কারনে আজ প্রথমবার নিজের নামটি গুলিস্তার মুখে শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। রেহবারের কন্ঠে সেই মধুর ডাকটি বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

– ঘুমাওনি?
– নাহ।
– একা একা বোর হচ্ছিলে বুঝি! আমাক ডেকে দিতে৷

গুলিস্তা কিছু বলছে না দেখে রেহবার বললো,
– চলো খেয়ে নেই।

ফ্লোরিডার মিয়ামি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে চমৎকার ঝলমলে দিনের দেখা পাওয়া গেলো। দীর্ঘ জার্নিতে ক্লান্ত গুলিস্তার চোখ মুখ যেনো ঝলসে গেলো ঝলঝল কর‍তে থাকা আলোয়। ঘড়িতে তখন স্থানীয় সময় সকাল এগারোটা। গুলিস্তার মনে হচ্ছে ওর গায়ে আর বিন্দু মাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। কোমড়ের ব্যথায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। রেহবারের দু হাতে দুটি লাগেজ, গুলিস্তার কাধে ব্যাগপ্যাক। ওরা এয়ারপোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই উচ্ছ্বসিত রাহিলের দেখা মিললো। সে এক ছুটে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরেছে।৷ গুলিস্তা হকচকিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে অবাক চোখে তাকালো। রেহবারকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় রাহিল হাসি মুখে বিস্ময়াভিভূত গুলিস্তাকে বললো,
– হাই পিচ্চি ভাবী। আমাকে চিনতে পেরেছো?

একপাশে মাথা বাকিয়ে গুলিস্তা জানালো সে চিনতে পেরেছে।
গাড়িতে বসে রেহবার পানির বোতল এগিয়ে দিলো গুলিস্তার দিকে। শুভ্র মুখটি একদম নেতিয়ে পরেছে৷ চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। মাথার লম্বা বেণুনী হতে চুল খুলে এসে মুখের উপর এলোমেলো হয়ে পরে আছে। রেহবার দু হাতে এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বললো,
– আর মাত্র এক ঘন্টা৷ এর পর বাড়ি গিয়ে হট শাওয়ার নিয়ে লম্বা ঘুম দিবে। একটুখানি অপেক্ষা করো। ততোক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেস্ট নেওয়ার চেষ্টা করো।

(চলবে..)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ষড়বিংশ

ডা. রুবাইয়া রানু, বয়স পয়ত্রিশ বছর। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া রানুর বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বাবা মায়ের সাথেই পাড়ি জমায় ফ্লোরিডায়। এখানেই পড়াশোনা শেষ করে সাইকোলজিস্ট হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রায় দশ বছর ধরে। স্থানীয় একজন নিউরো সার্জন এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন৷ ঘরে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানও রয়েছে৷ দীর্ঘ সময় ফ্লোরিডায় বসবাস করার পরও মাঝেমধ্যে এই শহরটিকে ভীষণ অচেনা মনে হয়। নিজ দেশ, দেশের বাতাস, রাস্তায় বিরক্তিকর জ্যাম, কড়া রোদ ভীষণ মনে পরে। তখন সাগর পাড়ে এলোমেলো হেঁটে অশান্ত মনকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা দু’টোই শুধুমাত্র একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে৷ এখন তাও তিন বছরের মেয়ের সাথে টুকিটাকি বাংলা কথা বলার চেষ্টা করা হয়। মনে সুক্ষ্ম ইচ্ছা রয়েছে, অন্তত মেয়েটা বাংলা শিখুক। মা-মেয়ে পরন্ত বিকেলে একসাথে বসে মাতৃভাষায় মনের আলাপ করা যাবে। আজকাল কেনো যেনো মায়ের ভাষাটাকে অনেক মনে পরে। একলা ঘরে নিজের সাথে বাংলায় কথা বলে মনের আশ মেটায়। ফ্লোরিডায় প্র‍্যাক্টিস শুরু করার পর এই প্রথমবারের মতোন রানুর কাছে বাঙালি কোনো রোগী এসেছে চিকিৎসা নিতে। বাংলায় কারো সাথে আলাপ করতে পারবে এই খুশিতে ভীষণ অস্থির লাগছে৷ রানু তবুও নিজেকে প্রাণপণে শান্ত রেখে হাসি মুখে তাকালো সামনে বসে থাকা যুবকের দিকে। যুবক একটি অবান্তর আবদার করে বসেছে। তাই এখন সে নিজেই অস্বস্তিতে ভুগছে৷ কারন সে নিজেই বুঝতে পারছে, এভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। স্ত্রীর প্রতি এমন ভালোবাসাকে রানু ভীষণ সম্মান করে। স্ত্রী তার স্বামীর কথা ভেবে চিন্তিত হচ্ছে এমনটা অহরহ দেখা গেলেও স্ত্রীর জন্য স্বামীর উদ্বিগ্ন হওয়ার চিত্র খুব কম দেখা মিলে। মনে মনে খুশি হলেও রানু তার সুরেলা কন্ঠে সুধালো,
– আপনি বলতে চাইছেন, আমি আপনার স্ত্রীর চিকিৎসা করবো কিন্তু তাকে জানাতে পারবো না যে আমি তার চিকিৎসক।
– ও আসলে এখন পর্যন্ত কিছু জানে না। বলার সুযোগ পাইনি। কীভাবে বলবো, ব্যাপারটা ও কীভাবে নিবে সেটা বুঝতে পারছি না।
– রোগীকে না জানিয়ে কীভাবে চিকিৎসা করবো? আপনার সাথে আমার অনলাইনে কথা হয়েছে আজ প্রায় একমাসের বেশি সময় হলো। এতোদিনেও আপনি কিছু জানাতে পারেননি! আশ্চর্য! আসলে আপনি নিজেই ভয় পাচ্ছেন। আপনি কি আজকে একা এসেছেন আমার সাথে দেখা করতে? আপনার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে আসার কথা ছিলো।
– ও সাথে এসেছে। ওয়েটিং রুমে বসে আছে।
– কি বলে সাথে নিয়ে এসেছেন?
– আমার এক কলেজ ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।

রেহবার হালকা হেসে জবাব দিলো। রানু বুঝতে পারছে না, রোগীকে না জানিয়ে তার চিকিৎসা কীভাবে করাবে!

গুলিস্তা বসে আছে একটি নিরিবিলি কক্ষে। ফ্লোরিডায় এসেছে আজ তিনদিন হলো। প্রথমদিন ঘুমিয়েই কেটে গেছে৷ দ্বিতীয় দিন সবার সাথে পরিচিত হওয়া, আম্বিয়া খাতুনের সাথে আশেপাশে ঘুরতেই দিন পেরিয়ে গেলো। আজ সকালে রেহবার এসে বললো, এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তুমি ঘরে বসে বোর হবে। চলো আমার সাথে বাইরে থেকে ঘুরে ফিরে আসবে। আসতে ইচ্ছে না করলেও গুলিস্তাকে আসতে হলো। শহরের পাশে সমুদ্রের তীরে একটি কটেজ। বাইরে থেকে দেখে কারো বাড়ি মনে হয়। ভেতরটাও বাড়ির মতোই। চতুর্দিকে গাছপালা আর মাঝেখানে কটেজ। কটেজের প্রায় সবখানে ইনডোর প্লান্ট এবং অদ্ভুত কিছু পেইন্টিং দেয়ালে টাঙ্গানো। ভেতরে প্রবেশ করার পর রিসিপশনে একজন সুশ্রী মেয়েকে দেখে গুলিস্তা অনুধাবন করতে পেরেছে, এটি কোনো বাড়ি নয়। দু তলা বিশিষ্ট কটেজটির নিচের পুরোটা জুড়ে হলরুম। একপাশে ওয়াশরুম ও কিচেনের ব্যবস্থা রয়েছে। হলরুমে বসার জন্য নান্দনিক সোফা, টুল, চেয়ার রয়েছে। একটি সোফায় গুলিস্তাকে বসিয়ে রেখে রেহবার চলে গেছে উপরের ফ্লোরের কোনো একটি কক্ষে। সেই থেকে গুলিস্তা এখানে বসে আছে। সময় অবশ্য খারাপ কাটছে না। আশেপাশে অপরিচিত গাছ, পেইন্টিং এবং কক্ষের নান্দনিক সাজসজ্জা দেখে সময় কীভাবে কেটে গেছে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ গুলিস্তার পাশে একটি মেয়ে এসে বসলো৷ গুলিস্তা তখন মনোযোগ দিয়ে একটি পেইন্টিং দেখছিলো। পাশে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে চকিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিদেশের সাদা চামড়ার মানুষগুলোর সাথে সাক্ষাৎ এর অভিজ্ঞতা মোটামুটি মন্দ। এয়ারপোর্টের ঘটনার পর এদের দেখলেই ভয় লাগে। পাশের মেয়েটিকে অবশ্য ইউরোপীয়ান বলে মনে হচ্ছে না। শার্ট, প্যান্ট পরিহিতা মেয়েটির চেহারায় বাঙালীয়ানার ছাপা রয়েছে। এতোকিছু না ভেবে গুলিস্তা ব্যস্তভাবে রেহবারের খোঁজে চারপাশে চোখ বুলালো। নাহ, কোথাও নেই।

– আমি কি তোমাকে বিরক্ত করলাম?

অপরিচিত মেয়েটির মুখে বাংলা শুনে গুলিস্তা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি মিষ্টি হেসে আবারও বললো,

– আমি বসা মাত্রই তুমি দাঁড়িয়ে পরলে, তাই ভাবলাম বিরক্ত হলে বুঝি। আসলে একা চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাই তোমাকে দেখে গল্প করতে চলে এলাম। তুমি কি এখনি চলে যাবে?

গুলিস্তা মাথা দুলিয়া না জানালে মেয়েটি ওর হাত ধরে ওকে বসিয়ে দিলো।

– তাহলে বসো এখানে। কিছুক্ষণ গল্প করি। তুমি করে বলছি দেখে কিছু মনে করো না। তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট হবে।

জবাবে গুলিস্তা কিছু বললো না। ওকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেও মেয়েটি নিজের মতো কথা বলতেই থাকলো।

– আমার নাম রুবাইয়া রেনু। তোমার নাম কি?
– গুলিস্তা।

মাথা নিচু রেখেই গুলিস্তা অল্প কথায় উত্তর দিলো।

– বাহ। চমৎকার নাম। গুলিস্তা নামের মানে কি?
– জানি না।
– ওহ। ব্যাপার না। গুগল করে জেনে নেওয়া যাবে। তুমি এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছো? কী সমস্যা তোমার?

গুলিস্তা খুবই অবাক হলো। সে ডাক্তার দেখাতে আসবে কেনো? এটাকে দেখে তো কোনো ভাবে হাসপাতাল মনে হচ্ছে না। এই মহিলার মাথায় কোনো সমস্যা আছে নিশ্চয়ই। অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে খেজুরে আলাপ শুরু করে দিয়েছে৷ গুলিস্তার ভীষণ বিরক্ত লাগছে। এখান থেকে চলে গেলে শান্তি মিলতো। কিন্তু এয়ারপোর্টের ঘটনার পর সে সাহস হচ্ছে না। রেহবারকেও দেখা যাচ্ছে না। কোন বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছে কে জানে! এখনো ফিরে আসার নাম নেই।

– কী হলো? কথা বলছো না কেনো? ডাক্তারের সাথে দেখা করেছো নাকি অপেক্ষা করছো এখনো? তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট কখন?

রানুর অনধিকার চর্চায় যতোটা বিরক্ত হলো, তার থেকে বেশি বিরক্ত হচ্ছে রেহবারের ফিরে না আসায়। গুলিস্তা তার কোলের উপর রাখা পার্সটি শক্ত করে চিপে ধরে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে পাশের চেয়ারটিতে বসলো। রানুর প্রচন্ড হাসি পেলেও তা চেপে গিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে মুখ হা করে গুলিস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো। গুলিস্তা কিন্তু ভুলের তার দিকে ফিরে চাইছে না। এতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী রানু নয়। সেও নিজের চেয়ার ছেড়ে গুলিস্তার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,

– তুমিও সবার মতো আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো। কেউ আমার সাথে কথা বলতে চায় না। ভেতরের ওই পচা ডাক্তারটাও বলছে আমার নাকি মানসিক সমস্যা আছে। তুমিই বলো, আমাকে দেখে তোমার পাগল মনে হচ্ছে?

রানুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থেকে গুলিস্তা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। রানুর চোখ দুটো ছলছল করছে। এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। তা দেখে গুলিস্তা চাপা স্বরে বললো,

– এতো কথা বলতে হয় না। পাগলেরা সারাক্ষণ কথা বলে।

আবার সিড়ির দিকে তাকালো রেহবারের খোঁজে। রানু কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো ভীষণ মায়াবী মেয়েটিকে। যার ভীতু, অস্বস্তিকর আচরণে রানু খুব মজা পাচ্ছে। রেহবারের সাথে কথা বলার পর ভেবেছিলো, গুলিস্তার দায়িত্ব সে নিতে পারবে না। রোগীকে না জানিয়ে চিকিৎসা প্রদান সম্ভব নয়। কিন্তু এইটুকু সময়ে মেয়েটার সাথে আলাপ করে ভীষণ ভালো লাগলো। আগ্রহ জন্মেছে। রানু তার রিনরিনে কন্ঠে আদর মেখে জানতে চাইলো,

– কে বলেছে শুধু পাগলরাই সারাক্ষণ কথা বলে?

গুলিস্তা তাকালো রানুর দিকে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না যদিও। কিন্তু এড়িয়ে গেলে মেয়েটা একটুতেই কেঁদেকেটে একাকার করে দিতে পারে। পটলচেরা চোখের মনি দুটো ভীষণ কালো। চোখে হালকা করে কাজল দেওয়া। এমন সুন্দর চোখে জল দেখতে একটুও ভালো লাগবে না। গুলিস্তা পরেছে ভীষণ ফ্যাসাদে। নিজের উপর একটু জুলুম করে মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,

– মা বলেছে।
– আর কি বলেছে?

গুলিস্তা উত্তর দিলো না। রানু নিজেই শুধালো,

– প্রয়োজনের বাইরে কথা বলতে বারণ করেছে? চুপ থেকে নিজের অনুভূতিগুলোকে বুকের মাঝে দাফন করে দিতে বলেছে?

মাথা আরেকটু নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে গুলিস্তা আস্তে করে উত্তর দিলো,

– হ্যাঁ।

প্রথমবার যখন স্কুলে পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো, গুলিস্তা তার ছোট পা দুটো দিয়ে দৌড়ে মায়ের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো। গলা ফেটে চিল্লিয়ে ডাকছে, মা, ও মা। সীমা বেগম দরজা খুলে বেরিয়ে ঠাস করে একটি চড় বসিয়ে দিলেন গুলিস্তার বাম গালে।

– অসভ্যের মতো চিল্লাচিল্লি করতেছিস কেন? কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে। এমন ধুপধাপ করে হাঁটাচলা করা কই শিখছিস? মেয়ে মানুষ হাঁটবে আস্তে, ধীরে সুস্থে। যেনো মাটিও ব্যথা না পায়।

ব্যথায় গুলিস্তার চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরছে কিন্তু শব্দ করে কান্না করা বারণ। সে নিজের মার্কশীট মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আশাভরা নিষ্পাপ দুটো মায়াবী জল ভরা চোখ সীমা বেগমের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু সীমা বেগম সেসবের তোয়াক্কা না করে মার্কশীটটি হাতে দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।

– ফাস্ট হয়েছিস তো কি হয়েছে? এতো নাচানাচি করার কি আছে? একটুতেই হি হি করে হাসে, একটুতেই গলা ছেড়ে কাঁদে, পটরপটর করে কথা বলতে থাকে। অসহ্য মেয়ে একটা। যা দূর হ আমার সামনে থেকে।

মেঝে থেকে কাগজটি তুলে গুলিস্তা আরেকবার তাকালো মায়ের দিকে। তিনি বিরক্তভরা চোখে তাকিয়ে আছেন। ঘুরে নিজের ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিলেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে গুলিস্তা নিজের ঘরের দিকে গেলো। সেই দিনের পর থেকে কোনো খুশির খবর সে কাউকে জানায়নি। কারন আর কোনো কিছু ওকে খুশিই করতে পারেনি।

হাতের উপর কারো আলতো ছোঁয়ায় গুলিস্তার ঘোর কাটলো। রানু তার স্নেহের হাতটি বাড়িয়ে গুলিস্তার হাতের উপর রেখে বললো,

– ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে হয়। না হলে চেপে রাখা অনুভূতির নিচে চাপা করে কখন মনটা মারা যাবে, টেরই পাবে না। কারো অনুভূতি বুঝতে পারার কোনো যন্ত্র এখন পর্যন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। তাই তোমার অনুভূতি তুমি প্রকাশ না করলে, সামনের ব্যক্তিটি সে কথা কখনোই জানতে পারবে না। তাছাড়া অনভূতি চেপে রাখার অনেক ক্ষতি আছে। এই যেমন ধরো, আমার এখানে বসায় তুমি ভীষন বিরক্ত হচ্ছো। সে কথা তুমি যদি আমাকে বলে দিতে, তাহলে কিন্তু আমি তোমাকে এতো বিরক্ত করতে পারতাম না। প্রথমেই লেজ গুটিয়ে বিদায় নিতে হতো। কিন্তু সে কথা তুমি বললে না। যার ফল স্বরূপ এতোক্ষণ আমার বকবক সহ্য করতে হলো। ব্যাপারটা কি ভালো হলো?

রানু হাসি মুখে কথাগুলো বলে ভ্রু উঁচু করে গুলিস্তার প্রতিক্রিয়া জানার অপেক্ষা করছে কিন্তু গুলিস্তা একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। রানু খিলখিল করে হেসে বললো,
– কী? আমার হাসি পছন্দ হয়েছে? তুমি চাইলে প্রশংসা করতে পারো। আমি একদম রেগে যাবো না। এমনিতেই আমি যেখানেই যাই, হাসির প্রশংসা পাই।

লজ্জা পেয়ে গুলিস্তা মাথা নিচু করে বললো,
– আপনার হাসি সুন্দর।
– থ্যাংকিউ। তুমিও কিন্তু দেখতে ভীষণ আদুরে। ইচ্ছে করে গাল দুটো টেনে একটু আদর করে দেই।

নিজের প্রশংসা শুনে গুলিস্তা একটুও লজ্জা পেলো না। একটু হাসলো না, বিরক্তও হলো না। রানু সুক্ষ্মভাবে ওকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। নিজের দু হাতের আঙ্গুল নিয়ে আনমনে খেলছে গুলিস্তা। ও কিছু একটা ভাবছে। মাথায় কোনো জিজ্ঞাসা ঘুরছে কিন্তু সেটি প্রকাশ করছে না। কিছুক্ষণ পরে হয়তো অন্য প্রশ্নের মতো এই প্রশ্নটিও গুলিস্তার মনের নিচে চাপা পরে হারিয়ে যাবে চিরতরে। রানু ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,

– এতো কিছু না ভেবে কি জানতে ইচ্ছে করছে, বলে ফেলো। দেখবে হালকা লাগবে।

গুলিস্তা ভীষণ অবাক হলো, রানু কীভাবে বুঝলো সে প্রশ্ন করতে চায়? কিন্তু ওর চোখে মুখ একদম স্বাভাবিক। রানুর চোখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে ভুগতে লাগলো। জানতে চাইবে কি চাইবে না? রানু আবার বললো,

– বলো।
– আপনার রাগ হয় না? কেউ প্রশংসা করলে? মানে হাসির। আপনার হাসির।

নিজের সাথে কতোটা লড়াই করে প্রশ্নটি করতে হয়েছে, সেটা শুধু গুলিস্তাই জানে। রানু শুধু একটু অনুমান করতে পারছে। একটা সহজ প্রশ্ন। কেউ আপনার হাসির প্রশংসা করলে আপনার রাগ হয় না? অথচ গুলিস্তা সেটি সাজিয়ে বলতে পারলো না। যেনো সে ভুলেই গিয়েছে কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়। রানু তার আগ্রহকে আটকিয়ে রাখতে পারলো না। আনমনে প্রশ্ন করে বসলো,

– কতোদিন পর কারো কাছে কিছু জানতে চাইলে?

গুলিস্তা ওর প্রশ্ন বুঝতে পারলো না। শুধু তাকিয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করলো। সহজ করে দিতে রানু বললো,

– কিছু জানতে ইচ্ছে করলে প্রশ্ন করো না কেনো? এমন কতো প্রশ্ন মনের মধ্যে আটকে রেখেছো? কেনো রেখেছো? এই যে আমাকে প্রশ্নটি করলে, কতদিন পর এভাবে নিজের আগ্রহ প্রকাশ করলে। মনে করতে পারবে? মা অযথা প্রশ্ন করতে বারণ করেছে বলে, তুমি একেবারেই প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিয়েছো। এটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হলো! নিজের মনের মধ্যে খুঁজে দেখো তো এমন কতো প্রশ্ন সেখানে জমে আছে।

রানুর একের পর এক ছেড়ে দেওয়া প্রশ্নে গুলিস্তার মাথার মধ্যে মৌমাছিগুলো এলোমেলো উড়তে শুরু করেছে। ভোঁ ভোঁ শব্দ হচ্ছে। রানু কি সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে? পাচ্ছে না হয়তো। শুনতে পেলো এভাবে অনবরত প্রশ্ন করে যেতো না। ও এখন কি বলছে, গুলিস্তা শুনতে পাচ্ছে না। মাথার ভেতর শব্দ ধীরে ধীরে বাড়ছে। কিন্তু মস্তিষ্ক কিছুতেই থামছে না। দ্রুত ছুটে যাচ্ছে সেই সব অধ্যায়ের দিকে যেখানে গুলিস্তা যেতে চায় না। এলোমেলো প্রশ্নরা হুড়মুড় করে সমস্ত দেয়াল ভেঙে ছুটে আসছে। দূরে কোথাও একটি ছোট মেয়ে কাঁদছে। অভিমানী কন্ঠে জানতে চাইছে,

মা, তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না কেনো? মারছো কেনো? জেরিন আপুই তো আগে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। তুমি আমাকে বকছো কেনো? তুমি আমার মার্কশীটটি ফেলে দিলে কেনো? আমি ফাস্ট হওয়ায় খুশি হওনি? আমার স্কুলের সবাই দৌড়ায়, হাওয়ার গতিতে ছুটে। আমাকে এতো আস্তে চলতে হবে কেনো? আমার সারাক্ষণ তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। তুমি আমার কথা শুনলে রেগে যাও কেনো? জানো আজকে স্কুলে কি হয়েছে? এই দেখো টিচার এই হাতে বেত দিয়ে ভীষণ জোরে মেরেছে। দেখো কেমন লাল হয়ে আছে। তোমার কাছে একটা মলম আছে না, ওটা লাগিয়ে দিবে? মা দেখো, সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছি। কতোটা কেটেছে দেখেছো? একটু ফুঁ দিয়ে দেও না। তুমি ফুঁ দিলে এক্ষুণি ব্যথা দূর হয়ে যাব।

একই সাথে অনেকগুলো প্রশ্ন, হৃদয় বিদারক কান্নার আওয়াজ, অভিমানী কণ্ঠস্বর। গুলিস্তার আর নিতে পারলো না। দু হাতে কান চেপে ধরে লুটিয়ে পরলো রানুর গায়ের উপর।

(চলবে…)