হে সখা পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
153

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ষটত্রিংশ পর্ব

রেহবার ঘুমিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। গুলিস্তা এখনো রেহবারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ বন্ধ চোখ, শান্ত মুখশ্রী। ফ্যানের বাতাসে দু চারটে চুল উড়োউড়ি করছে কপাল জুড়ে। গুলিস্তা হাত বাড়িয়ে চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিলো কিন্তু নিজের হাত রেহবারের মুখ থেকে সরিয়ে নিলো না৷ ধীরে ধীরে রেহবারের গাল ছুঁলো। ছুঁলো চোখের পাতা, নাকের ডগা, শক্ত চিবুক। তাতেও মন ভরলো না। নিজের বালিশ ছেড়ে এগিয়ে এলো রেহবারের দিকে। আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো রেহবারের কপালে।

ঘুমের মাঝেই মুখের উপর কারো গভীর নিঃশ্বাস অনুভব করলো রেহবার৷ সেই অনুভূতির ধাক্কা সামলে উঠতেই কপালে ঠোঁটের স্পর্শ তাকে নীরব থাকতে দিলো না৷ চোখ মেলে তাকালে গুলিস্তার চোখে চোখ পরলো। দুটো মুখ খুব কাছাকাছি। চোখাচোখি হতেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো গুলিস্তা। নীলচে আলোয় লজ্জিত সেই মুখশ্রীর লালচে আভা স্পষ্ট বুঝা গেলো না৷ রেহবার অপলক তাকিয়ে রইলো গুলিস্তার দিকে। ও কি ঘুমের ঘোরে এসব করছে? কিন্তু আচরণ স্বাভাবিক লাগছে যে। রেহবারের সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে৷ রেহবারকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গুলিস্তা সামান্য সরে এলো৷ মাথা রাখলো রেহবারের প্রশস্ত বাহুতে৷ দ্বিধাহীন দৃষ্টি মেলালো রেহবারের দৃষ্টিতে।

– ঘুমাও নি?
– ঘুম আসছে না৷
– তার মানে তুমি ঘুমের ঘোরে নেই?

প্রশ্নটি গুলিস্তার বোধগম্য হলো না। কপালে ভাঁজ ফেলে সরু চোখে তাকিয়ে রেহবারের কথা বুঝার চেষ্টা করলো।

– তোমার অস্বস্তি হয় এমন কোনো কাজ আমার দ্বারা হবে না। আমি এভাবেই ঠিক আছি৷ কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তুমি শুধু আমার পাশে থাকলেই চলবে। আর কিছু চাই নাই। তাই জোর করে কাছে আসতে হবে না।

সেদিনের ঘটনার পর এক বিছানায় পাশাপাশি থাকলেও রেহবার কখনো গুলিস্তার খুব কাছাকাছি যায়নি। সবসময় চেষ্টা করতো দুজনের মাঝখানে বিস্তর দুরত্ব বজায় রাখতে৷ কখনো হাত বাড়িয়ে মাথায় বিলি কেটে দিয়েছে কিংবা ভালোবেসে কপালে এঁকেছে চুম্বন৷ এর বেশি কিছু গুলিস্তা পায়নি। গুলিস্তা নিজেও এতোদিন সহজ হতে পারেনি৷ আসলে এসব নিয়ে ভাবার সময়ই তার হয়নি৷ নিজের টালমাটাল মনকে সুস্থির করতেই সে হাঁপিয়ে যাচ্ছিলো। আজ এইতো একটু আগেই মন থেকে চাহিদা অনুভব করলো বলেই এগিয়ে এলো৷ ঘুমন্ত রেহবারকে দেখে হুট করে কাছে আসার তাড়না অনুভব হয়েছে তাই এসেছে। এর বিপরীতে রেহবারের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে এতোকিছু গুলিস্তা ভাবেনি। ভাবতে সে জানেও না। এখন রেহবারকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে প্রশ্ন জাগছে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত হলো কিনা?

– আপনি রাগ করেছেন? স্যরি, ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম৷

অনেক কষ্টে রেহবার তার হাসি চাপিয়ে রাখলো৷ দু ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরার পরেও গুলিস্তা ওর দুষ্টু হাসি দেখতে পেয়ে অবাক হলো। এখানে হাসার কি হলো? আজব মানুষ।

– কখনো হাসছেন, কখনো বকছেন। আপনাকে বুঝি না আমি। ধুর!

রাগ করে নিজের জায়গায় ফেরত যেতে চাইলো গুলিস্তা। রেহবার ওকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে নিজের আরও কাছাকাছি নিয়ে এলো।

– রাগ করিনি। আমি শুধু তোমাকে বুঝার চেষ্টা করছি। কাছে আসতে যে চাইছো, সেটা কি মন থেকেই চাইছো?

লজ্জায় গুলিস্তা মুখ লুকালো রেহবারের বুকে। ফিসফিসিয়ে বললো,
– আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছিলো। কেউ ঘুমালে এতো সুন্দর লাগবে কেনো!
– কাছে গেলে যদি আবার আমাকে অনুভূতিকে, আমার ভালোবাসাকে অপমান করো তাহলে একদম ভেঙে গুড়িয়ে যাবো। একবার সামলে নিয়েছি। দ্বিতীয়বার পারবো না।

রেহবারের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো যা তার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ খুব ভালোভাবেই করলো। রেহবারের বুক থেকে মাথা তুলে গুলিস্তা সরাসরি তাকালো রেহবারের চোখে৷ কী তীব্র যন্ত্রণার ছাপ সেখানে! খুব কাছাকাছি আসার মুহূর্তে রেহবারের সেই আকুতিভরা বাক্যগুলোর কথা মনে পরছে। কী গভীরভাবে ডেকেছিলো! একবার তাকাও ফুল। কিন্তু সে সাড়া দেয়নি। খুব কি অপমান করেছিলো? হবে হয়তো। এজন্যই রেহবার দূরে থাকে। স্বামী হিসেবে অন্য সকল দায়িত্ব পালন করলেও কখনো নিজের দাবী নিয়ে সামনে আসেনি। সেই অপমান, সেই কষ্ট থেকেই এ দূরত্ব। এতোদিন গুলিস্তা বুজতেই পারেনি৷

রেহবারের চোখে চোখ রেখে গুলিস্তা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো রেহবারের ঠোঁটের দিকে। নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো রেহবারের ঠোঁটে। মুখ ফুটে সে কিছু বলতে পারবে না। রেহবার তার স্পর্শ থেকে বুঝে নিক, কতোটা তীব্রভাবে সে চাইছে রেহবারকে।

রেহবার কখনো ভাবেনি গুলিস্তা নিজে উদ্যোগী হবে। এতোটা অবাক হয়েছে যে ঠোঁটের ছোঁয়া ঠিকঠাকভাবে উপভোগ করতেই পারলো না। গুলিস্তা ঠোঁট সরিয়ে নিতেই ধ্যান ভঙ্গ হলো। শক্ত বাঁধনে আটকে দিলো ওকে। গুলিস্তার চিবুকে এক হাত রেখে অন্য হাতে ওকে আরও কাছে টেনে নিলো। যতোটা কাছাকাছি থাকলে দুজনার মধ্যে বিন্দুমাত্র দুরত্ব না থাকে। আলতো করে ওর ঠোঁট ছুঁলো। যেই ছোঁয়া ধীরে ধীরে আগ্রাসী হয়ে ছড়িয়ে পরলো পুরো শরীর জুড়ে। এই প্রথম গুলিস্তা অনুভব করলো তার শরীর জুড়ে ভালোবাসার অসহ্য মিষ্টি যন্ত্রণা। যার থেকে দূরে যাওয়া যায় না, আবার খুব বেশিক্ষণ সহ্যও করা যায় না।

****

গতরাতে বারংবার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় সকালে ঘুম ভাঙ্গছে না কোনোভাবেই। চোখজোড়া বন্ধ রেখেই বেড টেবিল থেকে ফোনটি হাতড়ে নিলো। কোনোরকম চোখ মেলে লিতুনের ফোন নাম্বারটি খুঁজে ডায়াল করে আবার চোখ বুঝলো।
ঘুম জড়ানো কন্ঠে লিতুনকে জানালো আজ অফিস যেতে দেরী হবে৷ সে যেনো ম্যানেজ করে নেয়। রেহবার গিয়ে সরাসরি মিটিং এটেন্ট করবে৷

গুলিস্তা ঘরে এসে দেখলো রেহবার তখনো ঘুমাচ্ছে। বিছানার একপাশে বসে এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে ধীর কন্ঠে ডাকলো,
– কতো বেলা হয়ে গেলো, আপনি উঠবেন না?

রেহবার ওভাবেই উত্তর দিলো,
– তুমি আমাকে রাতে ঘুমাতে দেও নি। এখন ঘুম পাচ্ছে৷

লজ্জায় রাঙা হলো গুলিস্তার মুখ। মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
– আপনার মিটিং আছে না?
– হুম। আরেকটু পরে উঠছি। ঘুমাতে দেও আর কিছুক্ষণ।

দেরী ঘুম থেকে উঠার ফলস্বরুপ এখন নাস্তা খেতে হচ্ছে গ্রোগাসে। কোনোদিকে না তাকিয়ে শুধু মুখে খাবার তুলে নিচ্ছে। নাস্তার প্লেট সামনে নিয়ে রেহবারের কাজকর্ম দেখছে গুলিস্তা৷ রেহবার কিছু বলছে না দেখে নিজেই ডাকলো,
– রেহবার?
– বলো

স্বল্প কথায় রেহবার উত্তর দিলো।
– পাখির জন্য কোনো নাম খুঁজে পাচ্ছি না তো।
– পাখি হারিয়ে যাচ্ছে না। ওতো তাড়া নেই।

রেহবারের দায়সারা উত্তরে গুলিস্তার উত্তেজনা চাপা পরে গেলো। মন খারাপ হলো ভারী। কোনো কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলো৷
তাড়াতাড়ি খাওয়ার কারনে গলায় খাবার আটকে যাচ্ছে৷ পানির গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে পানি পান করলো। গ্লাস নামিয়ে রাখতে গিয়ে খেয়াল হলো, গুলিস্তা ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মুখে জমিয়ে রাখা পানিগুলো ধীরে সুস্থে গিলে ফেলে বললো,
– ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে খুঁজো৷ এতো চাপ নিচ্ছো কেনো?

খাবার প্লেট সরিয়ে রেখে মন ভার করে গুলিস্তা বললো,
– আমার মাথায় শুধু শাকসবজির নাম আসতেছে৷
– তবে সেখান থেকেই একটা নাম দিয়ে দেও।

রেহবারের কন্ঠে দুষ্টামির সুর৷ গুলিস্তার বেশ রাগ হলো। গলায় তেজ নিয়ে বললো,
– কি নাম দেবো? আলু, পটল, ঢেঁড়স, টমেটো, গাজর?

পাখির এমন ধারা নাম শুনে রেহবার ফিক করে হেসে ফেললো। তা দেখে গুলিস্তা মুখ ফুলিয়ে বললো,
– আপনি কি আমার সাথে ফাজলামি করছেন? আমি কিন্তু জরুরি আলোচনা করছি৷

রেহবার এগিয়ে এলো গুলিস্তার দিকে। ওর ফুলকো গালে চটাস চটাস করে দুটো চুমু খেয়ে বললো,
– এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কোনো হেল্প করবো না। তুমি নিজে থেকে নাম চুজ করবে। এতে যদি আলু, পটল, গাজর নাম রাখতে হয়। তাতেও আমি রাজি৷ তবুও তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে হবে৷

নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে গুলিস্তার সামনে ধরে বললো,
– কিছুই তো খেলে না। নেও, হা করো দেখি। আমার খুব তাড়া আছে আজকে।

গুলিস্তা বিনাবাক্যে রেহবারের হাতে খাবার খেতে লাগলো।

গুলিস্তাকে সাথে নিয়ে রেহবার অফিসের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। ওকে নিজের কেবিনে নিয়ে গিয়ে রেহবারকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হয়েছে৷ মিটিং রুমে ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করছে৷ তাই গুলিস্তাকে বেশি সময় দিতে পারলো না৷ ডেস্ক, চেয়ার এবং সোফার উপরে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন রঙের ফাইল। কক্ষের একপাশে দাঁড়িয়ে সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলো গুলিস্তা৷ শেলফের মধ্যে এলোমেলো করে পরে আছে আরও কিছু ফাইল। কীভাবে গুছাবে রেহবার কিছুই বলে যায়নি। রেহবারের ফেরার অপেক্ষা করবে কিনা বুঝতে পারছে না। এর মাঝে হঠাৎ করে দরজায় শব্দ হলো। চমকে সেদিকে তাকালো গুলিস্তা। কেউ একজন নক করছে। কিন্তু গুলিস্তা কোনো উত্তর দিলো না। অযাচিত লোকজন ওর পছন্দ নয়। শখ করে নাচতে নাচতে অফিসে চলে এলো এখন প্যারা সামলাও। ফিরে যাবে কি না ভাবতে লাগলো। কক্ষের ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে দরজা সামান্য খুলে ভেতরে উঁকি দিলো লিতুন। গুলিস্তা দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। তাকিয়ে আছে লিতুনের দিকে৷ চওড়া হেসে লিতুন ভেতরে প্রবেশ করে বললো,
– কোনো হেল্প লাগবে ম্যাম?

মাথা দুপাশে দুলিয়ে গুলিস্তা না জানালো। তা দেখে লিতুন বললো,
– স্যার পাঠিয়ে দিলেন আমাকে। আপনার কোনো হেল্প লাগবে কিনা দেখার জন্য।

গুলিস্তা কিছু বললো না। নীরবে চেয়ে রইলো লিতুনের দিকে। বিভ্রান্ত দেখালো লিতুনকে এরপরে কি করা উচিত ভেবে পেলো না। ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে ঠোঁটের হাসি। তবুও হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,
– তাহলে আমি চলে যাবো?

গুলিস্তা এবার ঘাড় কাত করে সায় জানালো। দ্রুত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো লিতুন। ম্যাম কেমন অদ্ভুত আচরণ করে৷ বরফের ন্যায় কঠিন মুখশ্রী, শীতল স্বভাব। লিতুন উনার মনোভাব বুঝতে পারে না। তাই চেষ্টা করে যতোটা সম্ভব দূরে থাকতে৷ বসের বউ বলে কথা৷ উল্টোপালটা কিছু ঘটিয়ে ফেললে চাকরী নিয়ে টানাটানি পরে যাবে।

লিতুন চলে যেতেই গুলিস্তা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো৷ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ডেস্কের দিকে। একটি চেয়ার থেকে ফাইলগুলো তুলে রেখে নিজে সেখানে বসে পরলো। একটি নীল রঙা ফাইল হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো। ফাইলের গায়ে ক্লায়েন্টের কোম্পানির নাম লেখা। একে একে সবগুলো ফাইল ঘেটে দেখা গেলো সবগুলোতেই বিভিন্ন নাম লেখা রয়েছে৷ গুলিস্তা ঝটপট উঠে দাঁড়ালো। শেলফ থেকে ফাইলগুলো নামিয়ে সবগুলো জমা করলো ডেস্কের উপর৷ এরপর নাম দেখে ইংরেজি অ্যালফাবেটের ক্রম অনুযায়ী শেলফ গুছিয়ে ফেললো।

গুলিস্তার কাজ সম্পন্ন করার গতি বরাবরই বেশি। যেকোনো কাজ খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে৷ তবুও শেলফ গোছাতে প্রায় দু ঘন্টা লেগে গেলো। পাশের ওয়াশরুম থেকে ভেজা কাপড় নিয়ে এসে ডেস্ক চেয়ার পরিষ্কার করে নিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে এলো৷ ক্লান্ত শরীর চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে রেহবারের অপেক্ষা করতে লাগলো।

মিটিং শেষ হওয়ার কথা ছিলো দুপুর বারোটায়। এরপর লাঞ্চ ব্রেক। তারপর আরেকটা মিটিং। কিন্তু মিটিং শেষ হতে হতে প্রায় দুপুর দুটো বাজতে চললো৷ প্রজেক্টটি পেলেও রেহবারের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। সবাইকে লাঞ্চে যেতে বলে তিক্ত মেজাজ নিয়ে দ্রুত নিজের কেবিনে ফিরে গেলো। আলতো ভাবে দরজা খুলে দেখলো এক হৃদয় শীতল করে দেওয়া দৃশ্য৷ রেহবারের চেয়ারে হাত পা ছড়িয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে গুলিস্তা৷ গায়ের কোর্ট খুলে রেখে টাইয়ের নট ঢিলে করে নিলো। ডেস্কের অপরপাশে বসে এসির রিমোট হাতে নিয়ে তাপমাত্রা আরও নামিয়ে দিলো। ক্ষুধা লাগলেও সে অপেক্ষা করতে লাগলো গুলিস্তার ঘুম ভাঙার।

একপাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে। ঘাড়ে হাত দিয়ে চোখ মেলো তাকালো গুলিস্তা। ওর ঠিক সামনে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে রেহবার। গুলিস্তা দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।

– আপনি কখন এলেন?

ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে গুলিস্তার দিকে তাকালো রেহবার। ঘুম থেকে উঠার কারনে ওর চোখ মুখ খানিকটা ফুলে আছে। ভীষণ আদুরে দেখাচ্ছে। দৃষ্টি সরিয়ে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। তিনটা বাজে।

– বেশিক্ষণ হয়নি। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে তাই আর ডিস্টার্ব করি নি। ঘুম হলো?
– কখন ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতে পারিনি। আপনি লাঞ্চ করেছেন?
– নাহ। তোমার অপেক্ষা করছিলাম। চলো সামনের রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খেয়ে নেই।
– বাইরের খাবার? আপনি খেয়ে নেন। আমি বাড়ি গিয়ে খাবো। গায়ে ধূলোবালি জমে আছে। গোসল করে তারপর খাবো। রান্না করাই আছে।

রেস্টুরেন্টে অনেক মানুষের ভীড়ে খাবার খেতে পারে না গুলিস্তা। এই কথাটি রেহবারের মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে৷ ধীরে ধীরে আড়ষ্টতা কাটলেও কিছু অভ্যাস এখনো থেকে গেছে। সেগুলো থেকে গুলিস্তা নিজেই মুক্তি পেতে চায় না। এখনো অপরিচিত মানুষের সামনে নার্ভাস হয়ে পরে। যেটুকু কথাবার্তা বলে, চঞ্চলতা দেখায়, মন খুলে নিজেকে জাহির করে তা শুধু রেহবারের সামনে। এতে অবশ্য রেহবারের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ওরা দুজন ভালো থাকলেই চলবে। বাকি দুনিয়া নিয়ে চিন্তা নেই।

রেহবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। খুলে রাখা কোর্ট হাতে নিয়ে বললো,
– চলো। বাড়ি গিয়েই খাই। আমারও মনে হয় গোসল করে নিতে হবে৷ যা গরম পরেছে। ঘেমে একাকার হয়ে গেছি৷

গুলিস্তা অবাক হয়ে বললো,
– আপনার মিটিং?
– শুরু হতে দেরী আছে৷ দ্রুত ফিরে আসবো। এক ঘন্টায় লাঞ্চ কমপ্লিট হবে না?

গুলিস্তা হালকা হেসে রেহবারের সাথে কক্ষ থেকে বের হলো। এক ঘন্টা কেনো, রেহবারের জন্য সে এক মিনিটে খাবার হাজির করে ফেলতে পারবে।

গুলিস্তার হাত ধরে গাড়ির দিকে যেতে যেতে লিতুন কে মেসেজ করলো রেহবার। মিটিংটি যেনো এক ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়।

(চলবে…)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
সপ্তত্রিংশ পর্ব

রাতে ঘুমানোর সময় গুলিস্তার ঘুম আসছে না৷ মাথায় শুধু ঘুরছে তোতা পাখিটির নামকরণের চিন্তা। রেহবার তার নিজের জায়গায় চোখ বুজে শুয়ে পরেছে। ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে গুলিস্তা ভাবতে লাগলো কি নাম রাখা যায়৷ ওকে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকতে দেখে রেহবার চোখ বন্ধ রেখে মুচকি হাসলো।

এক হাতে পাতলা শরীরটিকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরে বললো,
– এখন আপাতত বিরতি নেও। এটা ঘুমের সময়৷ সকালে উঠে আবার ভাবতে শুরু করো।

গুলিস্তা তার মন খারাপ লুকিয়ে রাখতে পারলো না৷ উদাসভাবে বললো,
– আমার ঘুম আসছে না।

ওর গলায় গভীর চুমু দিয়ে তারপর সেখানে নিজের নাক ঘষতে ঘষতে রেহবার তার সম্মোহনী কন্ঠে প্রস্তাব রাখলো,
– আমার কাছে ঘুম পাড়ানোর অনেকগুলো টেকনিক আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে দুষ্টু টেকনিক অবলম্বন করে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। দিবো?

রেহবারের বুকে মুখ লুকিয়ে গুলিস্তা সে প্রস্তাব নাকচ করে কোনোরকম বললো,
– আমার মনে হয় ঘুম চলে এসেছে। খুব ঘুম পাচ্ছে৷

রেহবার তখনো ঘুমাচ্ছিলো। গুলিস্তার ঘুম ভেঙে গেলো হঠাৎ করেই। চোখ মেলে ঘুমন্ত রেহবারকে আলতো করে ডাকতে লাগলো,
– রেহবার, রেহবার? শুনুন না।

ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় রেহবারের কপালে ভাঁজ পরলো। কপাল কুচকে বন্ধ চোখেই নিজের গাল থেকে গুলিস্তার হাতটি নামিয়ে তাতে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,
– এতো সকালে উঠতে হবে না৷ আরেকটু ঘুমাও৷

গুলিস্তাকে কাছে টেনে নিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রেহবার আবার ঘুমিয়ে গেলো। উচ্ছ্বাসে ভাটা পরায় ঠোঁট ফুলিয়ে রেহবারের গলায় মুখ গুজে কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো গুলিস্তা। অস্থির মন নিয়ে কি ঘুমানো যায়? রেহবারের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতেও ইচ্ছে করছে না। তাই নিজের সাথে নিজেই ফিসফিসিয়ে বললো,
– পাখির জন্য আমি নাম খুঁজে পেয়েছি৷

ওকে অবাক করে দিয়ে রেহবার তার ঘুমঘোর কন্ঠে জবাব দিলো,
– গুড জব।

নাম জানতে চাইলো না। এ কেমন হেয়ালি! গুলিস্তার ভীষণ অভিমান হলো। মন খারাপ করেই বললো,
– আপনি নাম জানতে চাইবেন না?
– বলো শুনছি৷
– আমি ওর নাম রেখেছি তিতান।

ওকে আরেক দফা অবাক করে দিয়ে মাথায় আলতো চুমু একে দিলো রেহবার।
– খুব সুন্দর নাম৷

এই বলে আবার ঘুমিয়ে গেলো৷ এতোটুকু প্রশংসা বাক্যে গুলিস্তার কী যে আনন্দ হলো! ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে মেয়েটাও হারিয়ে যেতে লাগলো ঘুমের দেশে।

রেহবার অফিস চলে যাওয়ার পর হাতের কাজগুলো দ্রুত গুছিয়ে এক কাপ চা নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলো গুলিস্তা। ঝুলন্ত দোলনায় আরাম করে বসে সরু চোখে পাখিটির দিকে চাইলো। পাখিটিও খাঁচার ভেতর থেকে চোখ বড় করে তেড়িয়ে এলো একটুখানি। খাঁচার প্রাচীরে আটকে গিয়ে বোধ হয় ভীষণ রাগ করলো। ডেকে উঠলো গলা ছেড়ে। তা দেখে গুলিস্তা হেসে বললো,
– আমাকে দেখলেই ওমন তেড়ে আসিস কেনো? আমি তোর শত্রু?

রেহবার বলেছিলো গ্রে প্যারোড অনেক চালাক৷ মানুষের কথা বুঝে, তাদের মতো কথা বলে। গুলিস্তার কথার জবাবে তোতা পাখিটি কি যেনো বললো। গুলিস্তার মনে হলো পাখিটি ওর কথায় সম্মতি জানালো।

– আমি তোর শত্রু হলে তোর জন্য এতো কষ্ট করে নাম খুঁজে বের করতাম? অবশ্য তোর কথা ভেবে নাম খুঁজিনি৷ রেহবার বলেছিলো তাই খুঁজেছি। তোর কি নাম রেখেছি জানিস? তিতান৷ তিতান নামের মানে জানিস?

তিতান কোনো আগ্রহ দেখালো না। গুলিস্তাকে লেজ দেখিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলো। তা দেখে গুলিস্তার চক্ষু চড়ক গাছ। এভাবে উপেক্ষা করলো! চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে তেড়ে এলো তিতানের খাঁচার দিকে।

– এই এই, তুই আমাকে লেজ দেখিয়ে চলে আসলি! এতো দেমাক! নেহাৎ রেহবার আমার উপর তোকে কথা শেখানোর দায়িত্ব দিয়েছে। সেজন্য তোর সাথে সেধে কথা বলছি। তা না হলে আমার বয়েই গেছে তোর সাথে অযথা কথা বলতে। আমাকে ভাব দেখাচ্ছে, হুহ!

তিতানের দিকে একটি আঙ্গুল উঁচু করে ওকে শাসাচ্ছিলো গুলিস্তা৷ সেসবের তোয়াক্কা তিতান করলো না৷ মাটির হাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গুলিস্তার আঙ্গুলে ঠোকর বসালো। আহ শব্দে আর্তনাদ করে গুলিস্তা এক পা পিছিয়ে গেলো। রাগে সারা গা রি রি করছে। তিতানের সামনে এলে গুলিস্তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না৷ কেমন বাচ্চা হয়ে যায়৷ হঠাৎ তিতানের এমন কাজে অবাক হয়ে গোল গোল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
– তোর এতো বড় সাহস! আমাকে কামড় দিলি! ইচ্ছে তো করছে এখনি ঘাড় মটকে দেই। মারকুটে কোথাকার!

অফিসের ব্যাগ রেখে ধীর পায়ে ব্যালকনিতে এলো রেহবার৷ অনেকক্ষণ কলিংবেল চাপার পরেও গুলিস্তা দরজা খুলে দেয়নি৷ তাই এক্সট্রা চাবি দিয়ে নিজের বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়েছে রেহবারকে। গুলিস্তাকে কিচেনে দেখতে না পেয়ে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো, ও ব্যালকনিতে রয়েছে৷ সেখানে গিয়ে দেখলো কোমড়ে হাত দিয়ে রাগে ফুসছে গুলিস্তা। চোখে মুখে রাগের ছটা দেখে রেহবারের কী যে আনন্দ হলো! সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গেলো এক পলকে৷ রাগে টগবগ করতে থাকা গুলিস্তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আমার শান্ত ফুলটাকে কে এতো রাগিয়ে দিলো?

গুলিস্তার তখন রাগে পাগলপ্রায় অবস্থা। রেগেমেগে রেহবারের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বললো,
– এই বেয়াদব পাখিটাকে এক্ষুণি বের করে দিন। কতো বড় সাহস আমাকে ভাব দেখায়! আমার সাথে ঝগড়া করে, মারামারি করে। বর্বর, অসভ্য একটা।

গুলিস্তা অভিযোগ করলে তিতান কেনো চুপ থাকবে! সেও সমান তালে অভিযোগ করতে লাগলো। একনাগাড়ে বেশ কিছুক্ষণ চিল্লিয়ে শান্ত হলো অবশেষে। ওর ডানা ঝাপটে লাফালাফি করতে থাকা দেখে গুলিস্তা ও রেহবার দুজনেই অবাক। গুলিস্তা এগিয়ে গেলো খাঁচার দিকে৷ তিতানের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে ওকে শাসালো। রেহবারের দিকে ফিরে বললো,
– দেখেছেন কেমন ঝগড়ুটে৷ সারাক্ষণ আমার সাথে এমন করে৷ একটু আগে আমাকে ঠোকর দিয়েছে৷ আপনার আঙ্গুল দিয়ে দেখুন, কীভাবে কামড়ে নিবে৷

রেহবারের হাত ধরে ওকে খাঁচার সামনে নিয়ে গেলো। নিজে হাতে রেহবারের ডান হাতের তর্জনী এগিয়ে ধরলো তিতানের দিকে। কিন্তু তিতান কি করলো? সে আদুরে বাচ্চার মতো রেহবারের আঙ্গুলে নিজের মাথা ঠেকিয়ে আদর নিতে লাগলো। গুলিস্তা মুখ হা করে তাকিয়ে সে দৃশ্য দেখছে। তা দেখে রেহবার হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। এই দুজনের মাঝে ভাব জমাতে তাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে। গুলিস্তার রাগ কমাতে ওর মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলো।

– ওর নাম যেনো কি?
– তিতান।
– তিতানের মানে কি?

গুলিস্তা বেশ আগ্রহ নিয়ে রেহবারের দিকে তাকালো। হালকা হেসে বললো,
– চাঁদ যেমন পৃথিবীর একটি উপগ্রহ তেমনি শনি গ্রহের একটি উপগ্রহ হচ্ছে টাইটান। টাইটান থেকে তিতান নামটি এসেছে।

গুলিস্তা যে সামান্য নাম খুঁজতে এতো গবেষণা করবে তা রেহবার ভাবেনি। অথচ নাম খোঁজার কথা শুনে কেমন আতংকিত হয়ে পরেছিলো। চিন্তায় রাতের ঘুম পর্যন্ত উড়ে গিয়েছিলো। ওর নার্ভাসনেস দেখে রেহবার কল্পনাও করেনি দিনশেষে গুলিস্তা এমন অর্থবহ একটি নাম রাখবে। ওর মধ্যে প্রতিভা আছে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাবে তা কাজে লাগাতে পারে না।

গুলিস্তার দিকে ফিরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে নাকে নাক ঘষে আদুরে কন্ঠে বললো,
– আবার সেই চাঁদ।
– পঁচা হয়েছে না নামটা?

গুলিস্তাকে দ্বিধান্বিত দেখালো। ওর দু গালে হাত রেখে সরাসরি চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে রেহবার জানালো,
– ভীষণ সুন্দর নাম। পছন্দ না হয়ে উপায় আছে! আ’ম প্রাউড অফ ইউ।
– আমার পছন্দের নামটা অপাত্রে দান করে দিলাম। এই ঝগড়ুটে পাখিটাকে কিনা আমার পছন্দের নামে ডাকতে হচ্ছে! কী দুর্ভাগ্য! একটা নম্র ভদ্র পাখি আনলেন না কেনো?
– ইচ্ছে করে এমন ঝগড়ুটে পাখি নিয়ে এসেছি। ওর সাথে কোমড় বেধে ঝগড়া করতে করতে তোমার দিন কেটে যাবে। সন্ধ্যা নামলে আসি এসে হাজির হবো। তখন তোমার পুরো মনোযোগ আমার।

রেহবার এতো কিছু ভেবে উপহার দিয়েছে ভাবতেই গুলিস্তা অবাক হলো। এমনিতেই সারাদিন কাজে কর্মে কেটে যায়। অলস দিন কাটলেও গুলিস্তার বিরক্ত লাগে না। ওসব অনুভূতি ওর নেই বলেই এতোদিন জানতো। তবে আজকাল কেনো যেনো রেহবারের প্রতিক্ষায় বসে থাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল নামতেই অদ্ভুত এক হাহাকার তৈরি হয় মনে। কখন ফিরবে রেহবার? বারবার একই প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খায়। হঠাৎ গুলিস্তার খেয়াল হলো আজকে সে রেহবারের অপেক্ষায় নিজেকে পোড়ায়নি। তিতানের সাথে ঝগড়া করতে করতে কীভাবে সময় কেটে গেছে বুঝতেই পারেনি। রেহবার কখন এসেছে সেটাও খেয়াল করা হয়নি। রেহবারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় গুলিস্তার মনের কোণ ভরে উঠলো। সরাসরি চোখের দিকে তাকালো হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় নিয়ে।

– আপনি অনেক ভালো।

পুলকিত হলো রেহবারের চিত্ত। গুলিস্তাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে গালে, চিবুকে, গলায় আলতো করে চুমু দিতে দিতে আবদার করলো,
– গিফটের বদলে আমারও কিছু চাই।
– কি?
– তুমি সম্মোধন। যদি তোমার খুব বেশি সমস্যা না হয় আরকি৷

রেহবারের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করছে গুলিস্তা। তা দেখে রেহবার বললো,
– মানে আমাকে সারাক্ষণ আপনি, আপনি না ডেকে তুমি করে বললেও তো পারে৷ আপনি শুনলে কেমন দূরের মানুষ মনে হয়।

হঠাৎ লজ্জায় লাল নীল হতে থাকা গুলিস্তা মাথা নিচু করে বললো,
– বড়দের আপনি সম্বোধন করতে হয়৷

এমন উত্তর শুনে রেহবার অবাক হয়ে বললো,
– বাই এনি চান্স, তুমি কি আমাকে বুড়ো বলতে চাইছো? খুব বেশি বড় কিন্তু নই। মাত্র আট বছরের পার্থক্য। এতেই আমি বুড়ো হয়ে গেলাম। আজব!

গুলিস্তা থমথমে খেয়ে গেলো। উল্টো ভাবছে কেনো মানুষটা! ঝটপট প্রতিবাদ জানালো।
– সে কথা কখন বললাম! বুড়ো হতে যাবেন কেনো আপনি! কী দারুণ ইয়ং, হ্যান্ডসাম চেহারা! দেখতে মাশা আল্লাহ কতো সুন্দর!

মিষ্টি হেসে গুলিস্তার ঠোঁটে আলতো করে চুমু দিয়ে রেহবার বললো,
– আবার আপনি! আচ্ছা ওয়েট।

হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে গমগমে কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
– আমি রেহবার সজ্ঞানে আমার স্ত্রী গুলিস্তাকে, আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করার অনুমতি দিচ্ছি। এখন থেকে সে আমাকে তুমি ডাকলে তা বেয়াদবি বলে গণ্য হবে না৷ সে চাইলে আমাকে খুব আদর করে তুইও ডাকতে পারে। আই ডোন্ট মাইন্ড।

এমন অদ্ভুত এনাউন্সমেন্ট শুনে লজ্জায় রাঙা গুলিস্তা রেহবারের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

চলবে…

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
অষ্টাত্রিংশ পর্ব

গুলিস্তার দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে তিতানের সাথে ঝগড়া করে। ঝগড়াটা যদিও একপাক্ষিক। তিতান ওর বাজখাঁই কন্ঠে কিছু একটা ঝকঝক করে বলে, যা দেখে গুলিস্তার মেজাজ বিগড়ে যায়। তবুও সে তিতানকে কথা শেখানোর চেষ্টা করে৷ কিন্তু দুষ্টু পাখিটি নিজের মনের বাদশা। যখন মন চায় কথা শোনে, যখন চায় না তখন গুলিস্তাকে পাত্তাই দেয় না।
সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেলে একদিন রেহবার জিজ্ঞাসা করলো,
– তিতানের কি খবর? কথা শিখেছে?
– সে হচ্ছে নবাবজাদা। নিজের মন মর্জি মতো কাজ করে। আমাকে দেখলেই ঝকঝক করতে আরম্ভ করে দেয়। কথা শিখবে কখন?
– চেষ্টা চালিয়ে যাও৷ একটু সময় লাগবে৷

রাতের অবসর সময়ে দুজনে মিলে তিতানের কাছে গেলো৷ নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজের চাপে এই কয়েকদিন রেহবার অনেক ব্যস্ত ছিলো। বাড়িতে ঠিকমতো সময় কাটাতে পারেনি৷ ব্যালকনির পর্দা সরাতেই ওদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে তিতান তার ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ডেকে উঠলো,
– ফুল, ফুল, ফুল…

গুলিস্তার চোখ পারলে কপালে উঠে যায়। এতোদিন চেষ্টা করেও একটা কথা বলাতে পারেনি৷ আজকে রেহবারকে দেখে কেমন নাটক করছে দেখো। রেহবার ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
– তুমি শিখিয়েছো?

মাথা উপর নিচ করে সম্মতি জানালো গুলিস্তা। সেই প্রথমদিন থেকে সে তিতানকে বলতো, বল তো ফুল।
তিতান কিছু বলতো না৷ ভাব দেখিয়ে নিজের খাঁচায় চলে যেতো। এখন হঠাৎ করে স্পষ্টভাবে ফুল ডেকে অবাক করে দিলো। এড়িয়ে চলার মিথ্যে নাটক করলেও সে গুলিস্তার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।
রেহবার একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে তিতানকে বললো,
– ও শুধু আমার ফুল। একদম ফুল নামে ডাকবি না।

এরপর গুলিস্তার দিকে ফিরে বলল,
– অন্য কিছু শেখাও।

গুলিস্তা ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে রইলো। কেউ কথা শুনতে চায় না, কেউ আবার কথা শেখাতে বলে এখন আবার নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। আচ্ছা ঝামেলা হলো তো।

গুলিস্তার নিরন্তর পরিশ্রমে তিতান অনেক শব্দ শিখেছে। ওর সাথে বকবক করতে গুলিস্তার মাথা ধরে যায়। তবুও সে তিতানের সাথে কথা বলে। ব্যালকনির গ্রিলে একটা পোকা এসে বসেছিলো৷ সেটা খপ করে ধরে তিতানের দিকে এগিয়ে দিলো গুলিস্তা৷ পোকাটিকে মুখে পুড়ে বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে তিতান। ওর মখমলের মতো পালকে হাত বুলিয়ে গুলিস্তা বললো,
– এই এক মাসে তোর সাথে যতো কথা বলেছি, আমার সারাজীবনে মনে হয় এতো কথা বলিনি৷ নিজেকে বাচাল মনে হচ্ছে৷

তিতান তার ডানা দুটো ঝাপটে বললো,
– বাচাল, ফুল বাচাল।
– এই তোকে না বলেছি ফুল ডাকবি না। রেহবার শুনলে রাগ করবে।

তিতান বেশ মজা পেলো। গাছের ডালে বসে আবার বলে উঠলো,
– রাগ করবে, রাগ করবে৷
– ধুর ছাই! কোনো কথা শুনে না। ঘাড় ত্যাড়া কোথাকার!

ঘর থেকে রেহবারের ডাক ভেসে আসতেই গুলিস্তা সেদিকে চলে গেলো। গিয়ে দেখে রেহবার আম্বিয়া খাতুনের সাথে কথা বলছে। ফোনটি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– মা কথা বলবে তোমার সাথে।

তিতানকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরায় আজকাল আম্বিয়া খাতুনের সাথে যোগাযোগ কমে এসেছে। এ নিয়ে সামান্য নারাজ হয়েছিলেন আম্বিয়া খাতুন। রেহবার বুঝিয়ে বলেছে। গুলিস্তার পক্ষে একসাথে দুদিকে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়৷ এ ধরনের মানুষদের একসাথে বহুকাজের দিকে মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হয়। সামাজিকতা রক্ষার মতো কঠিন কাজে এরা বরাবর পিছিয়ে পরে৷

ফোন হাতে নিয়ে কথা বলতে বলতে গুলিস্তা ব্যালকনিতে চলে গেলো৷ সেদিকে তাকিয়ে খানিকটা হেসে নিলো রেহবার। মা শুধু শুধু মন খারাপ করছিলো৷ অথচ গুলিস্তা আগের মতো আগ্রহ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে৷
খানিকটা বাদে গুলিস্তা ফিরে এসে রেহবারের দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ব্যাক ক্যামেরা অন করে দেও?

রেহবার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গুলিস্তার মুখের দিকে। ফোন হাতে নেওয়ার কথাও ভুলে গেছে৷ নিশ্চলভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গুলিস্তা আবার বললো,
– মা তিতানকে দেখতে চাইছে৷ ওর কথা শুনবে। কই অন করে দেও।

রেহবারের ঘোর কেটে গেলো। ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ ব্যাক ক্যামেরা অন করে গুলিস্তাকে ফিরিয়ে দিলো। সেটি নিয়ে গুলিস্তা দ্রুত পায়ে ব্যালকনির দিকে চলে গেলো। পেছন ফিরে হতবিহ্বল রেহবারকে দেখলো না। এদিকে রেহবার ভাবছে, ও কি বুঝতে পারছে না এই প্রথম তুমি সম্মোধন শুনে রেহবারের শ্বাস আটকে গিয়েছিলো? মেয়েটা শান্ত নদীর মতো এসে রেহবারের সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেলো। কিচ্ছু বুঝতেই পারলো না।

তিতানের সামনে ফোনটি ধরে গুলিস্তা বললো,
– মাকে হাই বলো তিতান।

“হাই মা” বলে তিতান এগিয়ে এলো ফোনের দিকে। একবার “হাই মা” বলে আর ফোনের ক্যামেরায় ঠোকর দেয়। তা দেখে আম্বিয়া খাতুন ও গুলিস্তা দুজনেই হেসে উঠলো।
তিতানের সামনে থেকে সরে আবার রেহবারের কাছ থেকে ফন্ট ক্যামেরা অন করে ব্যালকনিতে ফিরে এসে ঝুলন্ত দোলনায় আরাম করে বসলো। আম্বিয়া খাতুন ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন,
– ভালো আছো তো?

ঘাড় একপাশে কাত করে গুলিস্তা বললো,
– হুম।
– সব ঠিকঠাক?
– হ্যাঁ।
– তিতানের সাথে ভালোই সময় কাটছে দেখছি৷ আমি আবার চিন্তা করছিলাম, একা একা বাড়িতে না জানি কীভাবে দিন কাটছে।

প্রতিউত্তরে গুলিস্তা কিছু বললো না। শুধু হাসলো। ওদিকে তিতান তখনো চিল্লিয়ে যাচ্ছে, হাই মা। গুলিস্তা সেদিকে তাকিয়ে ধমক দিলো,
– হয়েছে৷ এবার থাম।

আম্বিয়া খাতুন হাসলেন। মনের কোণে লুকানো ইচ্ছেটির বহিঃপ্রকাশ করে বললেন,
– আমি বলি কি, এবার একটা বাচ্চা নেও। সংসারে থিতু হয়ে গিয়েছো। এটাই উপযুক্ত সময়।

গুলিস্তা চমকালো, থমকালো। তোতলানোর কারনে কথা আটকে গেলো।
– বাচ… বাচ্চা? আমি?
– হ্যাঁ। তোমার বয়সটা যদিও একটু কম। কিন্তু রেহবারের কথাও তো ভাবতে হবে৷ বাচ্চা বড় হতে হতে ও বুড়ো হয়ে যাবে।

কথার মাঝখানে গুলিস্তা হঠাৎ করে কল ডিসকানেকট করে দিলো। আম্বিয়া খাতুন ভাবলেন নেটওয়ার্ক প্রবলেম। এদিকে ফোন হাতে নিয়ে গুলিস্তা নিশ্চল বসে রইলো। বাচ্চা নিয়ে নেও বললেই তো আর বাচ্চা নেওয়া যায় না। একটা বাচ্চার সাথে আরও অনেক দায়িত্ব আপনাআপনি চলে আসে।

রাত বাড়ছে অথচ গুলিস্তা ঘরে ফিরে এলো না দেখে রেহবার খুঁজতে এলো। তিতান ঘুমিয়ে পরেছে ওর নিজের বাসায়। গুলিস্তাকে একা চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো।

– কথা হলো?
– কেটে গেছে। নেট প্রবলেম মেবি।
– আবার কল দিতে। দেও আমি কল দিয়ে দিচ্ছি৷
– কথা শেষ। কল দিতে হবে না৷
– ওহ। আচ্ছা ঠিক আছে। এখানে বসে আছো কেনো? ঘরে চলো। ঘুমাবে না? রাত অনেক হয়েছে।

ছেলে মেয়ের বিয়ের পরে মায়েরা অতি উৎসাহী হয়ে পরে, নাতি-নাতনির জন্য৷ নিজ সন্তানের ঘর আলো করে আরেকটি সন্তান আসবে। এ যেনো তাদের জীবনরেখা পরিপূর্ণ করে। আম্বিয়া খাতুন স্বপ্ন দেখছেন রেহবার ও গুলিস্তাকে নিয়ে৷ টোনাটুনির ছোট্ট সংসারে আরেকজন সদস্যদের আগমন হলে মন্দ হয় না৷ হিসাব মতে বাবা হওয়ার জন্য রেহবারের এখন উপযুক্ত বয়স। গুলিস্তার বয়স কম হলেও সে শারীরিকভাবে যথেষ্ট সুস্থ। শক্তপোক্ত বাড়ন্ত শরীর। আশা করা যাচ্ছে, কোনো প্রকার কমপ্লিকেশন দেখা দিবে না। আনন্দে উনার চোখ চিকচিক করতে লাগলো৷ মনের সুপ্ত ইচ্ছের কথা শুধু গুলিস্তাকে বলে ক্ষ্রান্ত হলেন না। সুযোগ বুঝে রেহবারের কাছেও প্রস্তাব উপস্থাপন করলেন৷ গুলিস্তা যেহেতু এখন মোটামুটি সুস্থ এবার তাহলে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করাই যায়। মায়ের সঙ্গে গোপন আলাপে রেহবারের মনেও সুপ্ত ইচ্ছে জেগে উঠেছে৷ বাবা হওয়ার স্বপ্ন কোন পুরুষের থাকে না? এখানে তো রেহবার আপাত মস্তক একজন ফ্যামিলি পারসোন। মনের কথা মনে রেখে সুযোগ খুঁজছিলো গুলিস্তার সাথে কথা বলার জন্য। যা দ্রুত পেয়েও গেলো।

মাস শেষে ঘরের বাজার-সদাই সব শেষ হয়েছে৷ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একসাথে কিনে ফেলার চেষ্টা করে গুলিস্তা। অন্যদিন মালাকে সাথে নিলেও এইদিনে রেহবার সাথে থাকে। একসাথে যেহেতু অনেক কিছু বেশি পরিমাণে কেনা হয়, বাজারের ব্যাগ অনেক ভারী হয়ে যায়। সেগুলো বহন করে গাড়িতে তোলা আবার গাড়ি থেকে কিচেন পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য রেহবারের সাহায্যের প্রয়োজন পরে। সকাল সকাল নাস্তা করে দুজনে বেরিয়ে পরলো গ্রোসারিশপের উদ্দেশ্য। ওদের বাড়ির ফুলের বাগানে অনেক ফুল ফুটেছে। চারদিক ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে৷ হেঁটে যাওয়ার সময় রেহবার হাত বাড়িয়ে কয়েকটি চিত্রক ফুল ছিড়ে নিলো। গুলিস্তা আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এগিয়ে গেছে৷ পেছনে রেহবার থেমে গেলেও সে টের পায়নি। হঠাৎ লম্বা বেণীতে টান পরায় থমকে পেছনে তাকালো। হাতের মুঠোয় বেণীর নিম্নাঞ্চল চেপে ধরে রেহবার দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। গুলিস্তা ফিরে তাকালেও বেণী ছাড়লো না। চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো। এক হাতে বেণী ধরে ধীর পায়ে পেছনের দিকে চললো গুলিস্তা। রেহবারের কাছে পৌঁছাতেই সে ভীষণ যত্ন করে বেণীর ভাঁজে ভাঁজে গুজে দিলো বেগুনি রঙা চিত্রক ফুল। বেণী সামনে এনে ফুলগুলো দেখে গুলিস্তা লাজুক হাসলো। তা দেখে ওর ঠোঁটে আলতো চুমু দিয়ে রেহবার এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে৷

রেহবারের ইচ্ছে ছিলো সুপারশপে না গিয়ে মার্কেট থেকে কেনাকাটা করবে৷ এতে বাইরের পরিবেশের সাথে গুলিস্তার কিছুটা হলেও সখ্যতা বাড়বে।

– প্রতিবার একই শপ থেকে কেনাকাটা না করে অন্যগুলো থেকেও কেনা উচিত। এতে পার্থক্য বুঝা যায়। আজকে মেইন মার্কেটে যাবে?

মুহূর্ত ব্যয় না করে গুলিস্তা সে প্রস্তাব নাকচ করে দিলো।
– না, না। আমরা সুপারশপেই যাবো। অন্য কোথাও আমি যাবো না।
– আরে একদিন গিয়ে তো দেখো৷
– নাহ, আমি যাবো না। আমাকে সুপারশপে নামিয়ে দিয়ে আপনি যান।

রেহবার আর কথা বাড়ালো না। পুরোটা রাস্তা গুলিস্তা আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলো। সুপারশপের পার্কিং এ গাড়ি থামা মাত্রই গাড়ি থেকে নেমে গুলিস্তা চলে গেলো গ্রোসারি সেকশনে৷ রেহবারের অপেক্ষা পর্যন্ত করলো না। রেহবার হতাশ হয়ে গাড়ি পার্ক করে রেখে গুলিস্তার পিছু নিলো। কেনাকাটা শেষে কাউন্টারে বিল পে করার সময় চুলে টান অনুভব করতেই গুলিস্তা আহ শব্দ করে পেছন ফিরে তাকালো। কাউন্টারের পাশেই বেবি ফুড সেকশন। সেখানে একজন ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়ে কিছুটা একটা খুঁজছেন। উনার কোলো একটু ছোট্ট শিশু৷ সে তার ছোট এক হাতে গুলিস্তার লম্বা বেণী শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে৷ গুলিস্তা তাকাতেই ফিক করে হেসে উঠলো। স্নিগ্ধ হাসির সাথে উঁকি দিলো খরগোশের মতো সদ্য গজানো দুটো দাঁত। মায়াবী সেই হাসি দেখে গুলিস্তা তার ব্যথা ভুলে গিয়ে নিজেও হাসলো। এতে উৎসাহ পেয়ে শিশুটি তার অন্য হাতে চুল ধরার চেষ্টা করছে। আধো আধো বুলিতে উচ্চারণ করলো,
– ফুল, ফুল।

ততোক্ষণে রেহবার এগিয়ে এসেছে। অপরিচিত একজন মানুষকে দেখে শিশুটি খানিক ভয় পেলো। মায়ের সাহায্য পেতে ডাকলো,
– মাম্, ফুল, ফুল।

ভদ্র মহিলা পেছনে ফিরে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন। গুলিস্তার ব্যথাতুর মুখশ্রী দেখে অস্থির হয়ে পরলেন।
– স্যরি, স্যরি। ছেলেটা আজকাল যা দুষ্টু হয়েছে।

ততোক্ষণে গুলিস্তার সাহায্যের জন্য রেহবার ওর বেণী আগলে ধরেছে৷ যেনো চুলের গোড়ায় টান না পরে৷ ভদ্র মহিলা ছেলের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন,
– কাম্য, কী ধরনের বেয়াদবি এটা। আন্টির চুল ছাড়ো। উনি ব্যথা পাচ্ছেন।

ছোট্ট কাম্য সেসব শুনলো না। সে মায়ের গালে হাত রেখে আবার বললো,
– মাম্, ফুল।

গুলিস্তা খুব সাবধানে কয়েকটা চিত্রক ফুল চুলের ভাঁজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাম্যের দিকে এগিয়ে দিলো। সামনে পছন্দের ফুল দেখতে পেয়ে চুল ছেড়ে দিয়ে ফুলগুলো মুঠো ভরে নিলো কাম্য৷ চুল ছেড়ে দেওয়ায় ভদ্র মহিলা ও রেহবার দুজনে স্বস্তির শ্বাস ফেললো।

– স্যরি। ও কখন এই কাজ করলো আমি খেয়ালই করিনি৷ আপনি কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন?

ভদ্র মহিলার কথায় গুলিস্তা দুদিকে মাথা দোলালো। বিল পে করা সম্পন্ন হয়ে যাওয়ায় লাইনে দাঁড়ানো পেছনের ক্রেতা তাড়া দিলো। আদুরে শিশুটির লুচির মতো ফুলকো গালে চট করে চুমু দিয়ে গুলিস্তা হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো সুপারশপ ছেড়ে ।
বাড়ি ফেরার পথে ড্রাইভিং করতে করতে রেহবার বললো,
– বাচ্চাটা ভীষণ কিউট ছিলো, তাই না?
– হ্যাঁ অনেক।
– আমার তো ছেড়ে আসতেই ইচ্ছে করছিলো না।
– আমারও।
– আমরা একটা বেবি নিলে কেমন হয়?

অবাক হয়ে গুলিস্তা ঘাড় ঘুরিয়ে রেহবারের দিকে তাকালো। রেহবারের দৃষ্টি সামনের দিকে। তাই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
– আমি বাচ্চা নিবো না।

রেহবার হুট করে গাড়িতে ব্রেক কষলো। ফাঁকা রাস্তায় এমন হঠাৎ করে গাড়ি থামানোর ফলে খুব একটা সমস্যা হলো না। তবে সামনে ঝুঁকে পরতে পরতেও গুলিস্তা কোনো রকম রক্ষা পেলো। রেহবার অবশ্য এতো কিছু খেয়াল করলো না। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
– বাচ্চা নিবে না মানে? কয় বছর অপেক্ষা করতে হবে?
– কখনো নিবো না৷
– মজা করছো?
– মজা করবো কেনো?
– কেনো নিবে না?
– পছন্দ নয় তাই।
– আর এই সিদ্ধান্ত তুমি একা একা নিয়ে ফেললে? এখানে আমার কিছু বলার থাকতে পারে, এটা ভাবলে না?

গুলিস্তা কিছু বললো না। চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকলো। পেছন থেকে গাড়ির হর্ণ ভেসে আসলে নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে রেহবার আবার গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো।
দিনটি শুক্রবার। রেহবারের অফিস বন্ধ। অন্যদিন বাজার-সদাই নিয়ে এসে সেগুলো গুছিয়ে রাখতে রেহবার সাহায্য করতো। কিন্তু আজকে ব্যাগগুলো কিচেনে পৌঁছে দিয়ে আর কোনোদিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। গুলিস্তা হতাশ চোখে সে দৃশ্য দেখে বাজার-সদাই গুছিয়ে রাখায় ব্যস্ত হয়ে পরলো।

রেহবারের সারাদিন কাটলো স্টাডিরুমে। কাজের কাজ কিছু করছে না, তবুও ল্যাপটপের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকদিন পর আজকে ভীষণ রকম মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কেমন ফট করে বলে দিলো বাচ্চা নিবে না৷ ওর বলার ভঙ্গি দেখে রেহবার বুঝে গেছে এটি মুখ ফসকে বলে ফেলা কোনো কথা নয়৷ গুলিস্তা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস এবং এটি তার অনেকদিনের সিদ্ধান্ত। কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেহবার জানে না৷ এমন একটি সিদ্ধান্ত সে একা কীভাবে নিলো এটা ভেবে রাগ লাগছে। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে দু হাতের উপর মাথা রেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিলো সেই মুহূর্তে দরজায় মৃদু আওয়াজ হলো। মুখ তুলে চেয়ে দেখলো গুলিস্তা দাঁড়িয়ে আছে। রেহবারের সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিয়ে বললো,
– খেতে আসুন।

রেহবার কিছু বললো না৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুপুর দুটো বাজে। এক ঘরে, এক স্থানে এতোক্ষণ ধরে বসে আছে ভেবে অবাক হলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে গুলিস্তাকে পাশ কাটিয়ে প্রস্থান করলো নীরবে।

চলবে…