হে সখা পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0
148

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
৪৫

তিতানের বয়স যখন ছয় মাস, গুলিস্তা ও রেহবারকে অকূল দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে আম্বিয়া খাতুন ফিরে গেলেন রাহিলের কাছে। ছুটি পেয়ে দেশে এসেছিলো রাহিল। একমাস থেকে মাকে নিয়ে ফিরে গেছে। গুলিস্তা অবাক হয়ে দেখেছিলো, মাত্র কয়েকদিনে রাহিলের সাথে রিনাতের কী দারুণ সখ্যতা গড়ে উঠেছে! অথচ সে মা হয়েও ছেলের সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না। সারাক্ষণ ভয় কাজ করে, এই বুঝি ব্যথা দিয়ে ফেলবে। এই বুঝি ওর দ্বারা ছেলের কোনো ক্ষতি হয়ে গেলো।
আম্বিয়া খাতুন যাওয়ার আগে নিজের ঘরে আসবাবপত্র সরিয়ে সেটাকে রিনাতের খেলার ঘর বানিয়ে দিয়ে গেছেন। পুরো ঘরে কোনো ফার্নিচার নেই। ফ্লোরের উপর তোষক বিছিয়ে বিছানা পাতা। ঘর জুড়ে রিনাতের খেলনা ছড়ানো। রিনাত মাত্রই হামাগুড়ি দিতে শিখেছে তাই এই ব্যবস্থা। ফাকা ঘরে সে যেনো অবাধে চলাচল করতে পারে। গুলিস্তা বলে গেছেন, তুমি শুধু ছেলের পাশেপাশে থেকো। সময়মতো খাইয়ে দিও। বাইরের খাবার কি কি খাওয়াবে, কীভাবে খাওয়াবে আমি দেখিয়ে দিবো৷

দিনের বেশিরভাগ সময় এই ঘরের বন্ধ দরজার ভেতর কেটে যায় মা ছেলের। রিনাত আপনমনে খেলে আর তাকিয়ে থাকে ছেলের দিকে৷ কখনো সখনো ফিসফিসিয়ে ডাকে, তিতান?
রিনাত খিলখিলিয়ে হাসে। মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আসে মায়ের কাছে। গুলিস্তার চোখ মুখ ছুয়ে ডাকে, মাম্মাম, মাম্মাম।

আধো আধো বুলিতে যতোবার মাম্মাম ডাকে গুলিস্তার চোখ ততোবার সিক্ত হয়ে উঠে। মা ছেলের এই লুকোচুরি খেলা চলে বন্ধ দরজার আড়ালে। এসব খবর রেহবার জানে না। ও বেচারা সারাদিন অফিসে বসে চিন্তা করে, না জানি ছেলেটা একলা কি করছে! ঘরে ফিরে কোনো রকম পোষাক পালটে ছেলেকে নিয়ে আবার ছুটতে হয় বাগানে। প্রতিদিন নিয়ম করে বাবা-ছেলে এক ঘন্টা সময় কাটায় বাড়ির বাগানে। রেহবার পারলে সারাদিন ছেলের সাথে সময় কাটায়। কিন্তু সেটা যেহেতু সম্ভব হয় না, তাই অফিস থেকে ফিরে পুরোটা সময় ছেলের কাছাকাছি থাকে। সেই সময়টা গুলিস্তা রান্না করে, ঘর গুছায়, অন্যান্য যাবতীয় কাজ করে।

রিনাতকে কোলে নিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় যথারীতি আজকেও রেহবার প্রস্তাব দিলো,
– তুমিও চলো আমাদের সাথে।
– নাহ। আমার কাজ আছে। তোমরা যাও।
– ছেলেকে একটু সময় দেও৷ এমন চলতে থাকলে ছেলে ভুলেই যাবে ওর মাকে।

গুলিস্তা উত্তর দেয় না। ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে রেহবার নালিশ করে৷
– তোর মা আমাকে শাস্তি দিচ্ছে। বাচ্চা চেয়েছিলাম। আমার হাতে বাচ্চা ধরিয়ে দিয়ে এখন মজা নিচ্ছে। মাঝখানে কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে তোকে। মা থেকেও যেনো নেই।

রিনাত এখন হাটতে শিখেছে। বাবার হাত ধরে এক পা দু পা করে চলতে থাকা শিশুটি এখন কারো সাহায্য ছাড়াই হাটতে পারে। রেহবারের অফিস থেকে ফেরার সময় হলে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে সিড়ির সামনে। তবে সিড়িতে পা রাখে না। শান্ত ছেলেটা বাবার একনিষ্ঠ এবং বাধ্যগত। যেদিন থেকে বাবা বলেছে,
রিনাত, সিড়িতে নামবে না বাবা। পরে গিয়ে ব্যথা পাবে।

ছোট্ট রিনাত বাবার সকল কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বাড়িতে ঢুকে রেহবারের প্রথম দেখা হলো গুলিস্তার সাথে। ক্লান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে ব্যাগ এগিয়ে দিলো গুলিস্তার হাতে। এরপর ধুপধাপ সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
– আমার বাবাটা কেমন আছে?

শুক্রবার অফিস বন্ধ। নিজেকে সময় দিতে এইদিন রেহবার একটু লং শাওয়ার নেয়। আজও ভর দুপুরের ঠান্ডা পানির নিচে গা ডুবিয়ে বাথটাবে শুয়ে দিছো। বাইরে থেকে অনেকক্ষণ ধরে রিনাতের কান্নার আওয়াজ আসছে। প্রথম কিছুক্ষণ এড়িয়ে গেলেও আর চুপ করে থাকা গেলো না। রেহবার ভেবেছিলো গুলিস্তা যেহেতু বাইরে আছেই সে অন্তত ছেলেকে সামলাতে এগিয়ে আসবে। কিন্তু বরাবরের মতোই হতাশ হলো৷
ওয়াশরুম থেকে দ্রুত বের হয়ে দেখলো ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে বসে কাদছে রিনাত। হাতে ভাঙা খেলনা। কাদতে কাদতে চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখছে গুলিস্তা। মেজাজ খারাপ হলেও চুপচাপ ছেলের কাছে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো।

– এতোক্ষণ ধরে কাঁদছে বাচ্চাটা, তুমি কোথায় ছিলে?
– এখানেই।
– চুপ করাচ্ছিলে না কেনো?

গুলিস্তাকে মনে হয় কেউ চুরি করতে বলেছে এমনভাবে তাকালো রেহবারের প্রশ্নে।
– কান্নায় ব্যাঘাত ঘটালে কষ্ট পেতো না? কেউ কাঁদতে চাইলে তাকে কাঁদতে দিতে হয়। আমি কাঁদতে নিলে মা ধমকে উঠতো। কাঁদতে না পেরে আরোও বেশি খারাপ লাগতো।

রেহবার হতাশ হলো। রিনাত তখনো হেচকি তুলে নিচু স্বরে কাঁদছে। ছেলেকে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,
– ও এখনো অনেক ছোটো ফুল। কান্না করতে না পেরে কষ্ট পাওয়ার বয়স ওর এখনো হয়নি৷ এভাবে অনবরত কাঁদতে থাকলে শ্বাস আটকে বাচ্চা মা রাও যেতে পারে।

ছেলেকে কোলো নিয়ে স্টাডিরুমে চলে গেলো রেহবার। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গুলিস্তার বুকটা ভারী হয়ে এলো। ইশ! ছেলেটা কতোক্ষণ ধরে কাঁদছিলো!

– বাবা, আরেকটা খেলনা কিনে এনে দিবে। এভাবে কাঁদে না বাবা।
ছেলেকে টেবিলের উপর বসিয়ে চোখ মুখ মুছে দিয়ে রেহবার তাকালো দরজার দিকে। ওখানে গুলিস্তা দাঁড়িয়ে আছে। কিছু না বললেও রেহবার জানে সে কেনো দাঁড়িয়ে আছে।
– কান্না থেমেছে। এখন ঠিক আছে। চিন্তা করো না।

পুরোটা দিন ছেলেকে নিজের কাছে রাখলো রেহবার। সে বুঝে গেছে রিনাতের সকল দায়িত্ব ওকেই নিতে হবে। বাবা হওয়ার পাশাপাশি মায়ের ভূমিকাও পালন করতে হবে।

রাতে ঘুমানোর সময় গুলিস্তা অপলক তাকিয়ে রইলো ছেলের দিকে। ওর মতোই দেখতে ছোট্ট একটা মুখ। প্রথম যেদিন দেখেছিলো, নাকটা সামান বোচা ছিলো। এখন অবশ্য গুলিস্তার নাকের মতোই খাড়া তরতরে নাক হয়েছে। দুজনের মধ্যে পার্থক্যের একটি হচ্ছে, একই চেহারার গুলিস্তা মেয়ে, রিনাত ছেলে।
ওপাশে কাত হয়ে ঘুমানো রেহবারের দিকে তাকিয়ে চুপিচুপি ছেলেকে বুকে টেনে নিলো গুলিস্তা। কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
– তিতান, মাম্মাম ভীষণ স্যরি। মাম্মামটা খুব বোকা, তাই না? কিচ্ছু বুঝে না। কিচ্ছু পারে না। মাম্মাম স্যরি।

রিনাত যেদিন প্রথম স্কুলে গেলো, বাপ-ছেলের সে কী উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা! সকালে ঘুম থেকে উঠে নতুন জামা পরালো ছেলের গায়। নিজেও নতুন স্যুট প্যাট গায়ে জড়ালো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাপ ছেলে একসাথে চুল চিরুনী করেছে, সেই দৃশ্য দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছে গুলিস্তা। চোখে মুখে উচ্ছ্বাস না থাকলে বুক করছে দুরুদুরু। দেখতে দেখতে ছেলেটার পাঁচ বছর হয়ে গেলো। এইতো সেদিন ছোট্ট দেহটাকে দেখে গুলিস্তা ভয় পেতো। কী করে সামলাবে সবকিছু! গুলিস্তাকে অবশ্য কিছু সামলাতে হয়নি। দু হাতে সবকিছু সামলে নিয়েছে রেহবার৷ ছেলের যাবতীয় দায়িত্ব একাই সামাল দেয় সুনিপুণভাবে। ছেলেও তেমন বাবার অন্তঃপ্রাণ। দূর থেকে প্রাণ ভরে তাকিয়ে থেকে নিচে নেমে এলো গুলিস্তা। রেহবারের নির্দেশনা অনুযায়ী ছেলের পছন্দের খাবার দিয়ে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। বাবার হাত ধরে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো রিনাত। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
– কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?

কালো প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট। পায়ে সাদা কেডস। রাজপুত্রের থেকে কম দেখাচ্ছে না গুলিস্তার ছেলেকে। হেসে উত্তর দিলো গুলিস্তা,
– সুন্দর।
– থ্যাঙ্কিউ মাম্মাম। বাবা আর আমি ড্রেস মিলিয়ে পরেছি।

পছন্দের খাবার দেখে আরেক দফা খুশি হলো রিনাত। বাবার হাতে ভরপেট খেয়ে বেরিয়ে পরলো স্কুলের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে মায়ের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। ছেলেকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গুলিস্তা তাকালো রেহবারের দিকে। রেহবার কিছু বলছে না। ওর মুখে চাপা আনন্দ। ছেলের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন আজকে। মনের কথা বুঝতে বরাবর অপারদর্শী গুলিস্তা। তাই ছেলের আবদার পূরণ করতে হয় রেহবারকে। কারো থেকে উত্তর না পেয়ে গুলিস্তা নিজেই প্রশ্ন করলো,
– কিছু বলবে?
রিনাত আরেকটুখানি এগিয়ে এলো। নিজের গাল এগিয়ে দিয়ে বললো,
– স্কুলের প্রথম দিন, আদর করে দেও মাম্মাম।

গুলিস্তা অপ্রস্তুত হলো ভীষণ। সত্যিই তো আজকের দিনে ছেলেকে একটু কাছে টেনে নেওয়া দরকার ছিলো না? ফ্লোরে হাটু মুড়ে বসে ছেলেকে কাছে টেনে নিলো। কপালে, গালে চুমু দিয়ে বললো,
– মন দিয়ে ক্লাস করো। আল্লাহ হাফেজ।

মায়ের আদর পেয়ে খুশিতে সবগুলো দাঁত বের করে হাসি দিলো রিনাত। ছুটে গেলো গাড়ির দিকে। ছেলে বেড়িয়ে যেতেই স্ত্রীকে কাছে টেনে নিলো রেহবার। লুকোচুরি এই খেলা সে দারুণ উপভোগ করে। কপালের পরিবর্তে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁলো। লাজে রাঙা হলো গুলিস্তার মুখ। বুকে হাত দিয়ে সামান্য শক্তি প্রয়োগ করলো। ছুটতে চাইলো রেহবারের বাঁধন থেকে। রেহবার ছাড়লো না। কোমড় জড়িয়ে ধরে আরও কাছে নিয়ে এসে বললো,
– তুমিও সাথে গেলে পারতে। ছেলে প্রথমবারের মতোন স্কুলে যাচ্ছে। বাবা-মা দুজনে সাথে গেলে ও খুশি হতো।

গুলিস্তা ঠোঁট উল্টালো। বছরের প্রথম দিনে স্কুল জুড়ে অভিভাবকদের ঢল নামবে। এতো লোকজন, ভীড়ের মাঝে গুলিস্তার যেতে ইচ্ছে করা না। কিন্তু ছেলে কি সত্যিই আশা করেছিলো, মাম্মাম ওর সাথে যাবে? কী জানি গুলিস্তার মাথায় আসেনি৷

– আমি যাচ্ছি না বলে ও কি মন খারাপ করেছে?

গুলিস্তার প্রশ্নে রেহবার হাসলো। নিজের ছেলে সেভাবে বড় করেনি রেহবার। বাবার মতোই বুঝদার রিনাত। মায়ের সমস্যা অনেকখানি বুঝতে পারে৷ মায়ের সাথে জেদ করে না, অকারণ আবদার করে না। মায়ের সাথে বেশি সময় কাটাতে পারে না বলে কখনো মন খারাপ করে না। কখনো সখনো বাবার কাছে প্রশ্ন করলে রেহবার আদর করে বুঝিয়ে বলে।
মাম্মাম তোমাকে খুব ভালোবাসে৷ শুধু প্রকাশ করে না৷ মন থেকে অনুভব করলেই সে ভালোবাসা বুঝা যায়।

– উহু। আমাদের ছেলে অনেক বুঝদার৷ দেখো না স্কুলে যাওয়ার জন্য কতো এক্সাইটেড হয়ে আছে।

বাইরে থেকে রিনাত ডাকছে, বাবা এসো দেরী হয়ে যাচ্ছে।

আসছি বলে, হাসিমুখে বেরিয়ে গেলো রেহবার৷ ওদের গাড়িটি যতোক্ষণ দেখা গেলো সদর দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো গুলিস্তা।

চলবে..

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
৪৬

সেবার গ্রীষ্মের তাপদাহ শেষে যখন বর্ষা আসি আসি করছে একদিন এক গোধুলিবেলায় জন্ম হয়েছিলো রিনাতের। ছয় বছর পেরিয়ে আজও প্রকৃতিতে বর্ষাকাল। জুন মাসের পনেরো তারিখ, রেহবার পুত্রের জন্মদিন। রাতে ঘুমিয়ে পরার কারনে ছেলেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয়নি। তাই তো সকাল হতেই ছেলের ঘরে হাজির হয়েছে রেহবার। কিন্তু ঘরের ভেতর এক বিরল দৃশ্য তাকে থমকে দিলো।
ঘুমন্ত ছেলের পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে গুলিস্তা৷ নিঃশব্দে স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়ালো রেহবার। সন্তানের প্রতি গোপন স্নেহের এমন অনেক দৃশ্য রেহবারের দৃষ্টিতে পরলেও সেসব নিয়ে কথা বাড়ায় না রেহবার। পাছে গুলিস্তার অস্বস্তি হোক আবার। স্বামীর উপস্থিতি টের পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো গুলিস্তা। হাতে ধরে রাখা পাঞ্জাবীটি রেহবারের হাতে দিয়ে বললো,
– ওর পছন্দ হবে?

গাঢ় নীল রঙা পাঞ্জাবীর গলায় ও বুকে সুতোর কাজ। হালকা নকশার কারনে আরও বেশি সুন্দর লাগছে।
– খুব সুন্দর। তুমি কিনেছো?

মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো গুলিস্তা। ছেলের পছন্দ হবে কিনা সেই চিন্তায় এতোক্ষণ অস্থির লাগছিলো। শপিংমলে গিয়ে কেনাকাটা করা হয়ে উঠে না গুলিস্তার। বাড়িতে বসে অনলাইনে যা একটু কেনাকাটা করা হয়। খুব প্রয়োজন না পরলে সেটাও করে না। শুধু প্রতিবছর ছেলের জন্মদিনে একটা পাঞ্জাবী কিনে রেহবারের হাতে তুলে দেয়। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। ছেলের দিকে তাকিয়ে মন খারাপের সুরে বললো,
– কতো দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে!

রেহবার কিছু বলার সুযোগ পেলো না। তার আগেই গুলিস্তা বেরিয়ে গেলো। ছেলের পাশে বসে মাথায় আদুরে পরশ দিয়ে ছেলেকে ঘুম থেকে তুললো রেহবার। পিটপিট করে চাইলো রিনাত। বাবার মুখ দর্শনে হাসি ফুটলো মুখে।

– শুভ জন্মদিন, বাবা।

বিছানা ছেড়ে বাবার কোলে বসে জড়িয়ে ধরলো রিনাত।
– থ্যাঙ্কিউ বাবা।

আশেপাশে তাকিয়ে মাকে খুঁজে না পেয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
– মা চলে গেছে?
– এই মাত্র বেরিয়ে গেলো।

ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে উত্তর দিলো রেহবার। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত রিনাতের ভারী মন খারাপ হতো। জন্মদিনেও মা একটু আদর করে পাশে ডেকে নেয় না। কিন্তু বাবার মুখে সে শুনেছে প্রতিবছর তাকে জন্মদিনের প্রথম শুভেচ্ছা মা জানায়। ও যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন এসে অনেক অনেক আদর করে যায়। রিনাত জেগে থাকলে আদর দেখাতে মায়ের লজ্জা লাগে, অস্বস্তি হয়। তাই তো গতবছর জন্মদিনে গভীর রাত পর্যন্ত না ঘুমিয়ে মায়ের অপেক্ষায় জেগে ছিলো রিনাত। গুলিস্তা এসেছিলো ঠিক বারোটায়। ঘুমন্ত ছেলের পাশে বসে মাথা ভর্তি চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলো অনেকক্ষণ। কপালে, গালে চুমু দিয়েছে ভালোবেসে। ফিসফিসিয়ে বলেছিলো, শুভ জন্মদিন তিতান৷
তারপর হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে বন্দী করে বসেছিলো অনেকটা সময়। পুরোটা সময় ঘুমের ভান ধরে মায়ের আদর উপভোগ করেছে রিনাত। এইটুকু বয়সে অনেক কিছু সে বুঝতে পারে। সবই তার বাবার শিক্ষা ও প্রচেষ্টায়।
মায়ের অনেক সিক্রেট সে শুনেছে বাবার থেকে। মাকে কিন্তু বুঝতে দেয় না। বাবা ছাড়া অন্য কারো সাথে এসব নিয়ে কখনো কথা বলে না৷ এটা বাবা-ছেলের সিক্রেট টপিক। এই যে প্রতিবছর গুলিস্তা ছেলের জন্য কাপড় কিনে রেহবারের হাতে পাঠিয়ে দেয়, এটা জানে রিনাত৷ প্রথমদিকে খানিক মন খারাপ হতো। কেনো এমন লুকোচুরি? বাবার সামনে তো ঠিকই নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করে। রিনাতের সামনে আসতে কীসের ভয়? পাঞ্জাবী হাতে দিয়ে সাবধানী গলায় বলে দেয়, ওর পছন্দ না হলে পাল্টে এনে দিবে কিন্তু। অথচ ছেলের জন্য সবসময় সেরাটা কিনেছে গুলিস্তা। তবুও তার মন সন্দিহান। আত্মবিশ্বাসের যে বড়ই অভাব। তবে এখন এসব বিষয় বড্ড উপভোগ করতে শুরু করেছে রিনাত। যতো বড় হচ্ছে ততোই নিজের মাকে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে৷ বাবার কোলো ঠিকঠাকভাবে বসে গলা জড়িয়ে ধরে রেখে বললো,
– আমার পাঞ্জাবী দিয়েছে?

ছেলেকে নিয়ে রেহবারের ভীষণ গর্ব হয়। দেখতে গুলিস্তার মতো হলে কী হবে, স্বভাবে হয়েছে একদম বাবার কার্বন কপি৷ কপালে চুমু দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে রেহবার জবাব দিলো।
– হ্যাঁ। ওই তো বিছানার উপর।

বাবাকে ছেড়ে ঝটপট পাঞ্জাবী হাতে তুলে নিলো রিনাত। মুখে ফুটলো হাসি।
– ওয়াও! এটা কী সুন্দর বাবা!

ছেলের মুখের হাসি রেহবারের সকল মন খারাপ দূর করে দেয়। মা ছেলের দুরত্ব কখনো কখনো রেহবারকে ভীষণ ভাবায়। মনটা তখন ভার হয়ে উঠে৷ কিন্তু রিনাতকে যখন অল্পতে বাধনহারা খুশিতে ভাসতে দেখে তখন স্বস্তি হয়। এই তো সব ঠিক আছে।
– তোকে আমার হিংসা হচ্ছে বুঝলি? আমার বিয়ে করা বউ এতোদিনেও আমার জন্য কিছু কিনলো না। অথচ প্রতিবছর তোর জন্য বাজারের সেরা পাঞ্জাবী খুঁজে নিয়ে আসে। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি।

বাবার দুঃখবিলাশে রিনাত বেশ মজা পেলো। নাটকীয় সুরে বললো,
– কারন মাম্মাম আমাকে বেশি ভালোবাসে৷ সবচেয়ে বেশি। আমি ঝটপট ফ্রেশ হয়ে এসে পাঞ্জাবী গায়ে দিচ্ছি। তোমার থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম দেখাবে, দেখে নিও।

হয়েছেও তাই। পাঞ্জাবী গায়ে বাবা-ছেলেকে সিড়ি বেয়ে নামতে দেখে গুলিস্তা স্তব্ধ হয়ে গেলো। আকাশ থেকে দুটো তারা খসে পরেছে যেনো। দুজনের গায়ে পাঞ্জাবী। হাতে হাত রেখে হাসতে হাসতে সিড়ি বেয়ে নামছে।
সন্তানের উপর মায়ের নজর নাকি বেশি লাগে, মনে হতেই ঝট করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো গুলিস্তা। তাই বলে কি রিনাত ছেড়ে দিবে? মোটেও না। সে হেলেদুলে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে অতি উৎসাহে মাকে জানালো,
– আমার নতুন পাঞ্জাবী। বাবা এনে দিয়েছে। কতো সুন্দর দেখেছো? আমাকে মানিয়েছে না?

ছেলের অভিনয়ে রেহবার মুচকি হাসে। চেয়ার টেনে বসে পরে নাস্তা খাওয়ার উদ্দেশ্যে। ওদিকে গুলিস্তা আমতাআমতা করে নজর লুকিয়ে বাঁচিয়ে জবাব দেয়,
– ভীষণ মানিয়েছে। তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।
– থ্যাঙ্কিউ।

নাস্তার ফাঁকে রেহবার জানায় আজকে ফিরতে খানিক দেরী হবে। রিনাত একটা খেলনা গাড়ি কিনে দেওয়ার বায়না ধরেছে। স্কুল শেষে বাইরে লাঞ্চ করে মার্কেটে যাবে খেলনা কিনতে। গুলিস্তাকে সাথে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সে নাকচ করে দেয়। রেহবার ও রিনাত বেরিয়ে গেলে একা একা পুরো বাড়িতে ভূতের মতো পায়েচারি করে গুলিস্তা। মালা আজকে আসেনি। ঘর গুছিয়ে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে হতো কিন্তু শুধুমাত্র নিজের জন্য কিছু রাধতে ইচ্ছে হলো না। ফ্রিজে বাসি তরকারি আছে তাই দিয়ে একটু ভাত ফুটিয়ে খেয়ে নিলেই দিন কেটে যাবে।
ঘরদোর গুছানো শেষ হলে একা বাড়িতে মন টিকছিলো না গুলিস্তার। বাড়ির পেছনের বাগানে অনেকদিন হলো হাঁটতে যাওয়া হয় না। তাই দরজা বন্ধ করে ফোন হাতে নিয়ে এই বিকেলবেলা বেরিয়ে গেলো বাড়ির পেছনের নির্জন বাগানে।
ফলের গাছগাছালির সাথে নিম, মেহগনির মতো গাছে ভরে আছে বাড়ির পেছনটা। ইদানিং রেহবার ব্যস্ত থাকায় কিছু আগাধা জন্মেছে পুকুরপাড়ের চারপাশে৷ বাগানের শেষদিকে ছোট্ট পুকুরটি অবহেলায় পরে আছে। বর্ষায় পানি জমে দুকূল ভরে উঠে৷ গ্রীষ্মের তাপদাহে সেই জল শুকিয়ে এসে ঠেকে তলানিতে। সপ্তাহ খানিক আগে বৃষ্টি নেমেছিলো শহরজুড়ে। তাতেই মরোমরো ঘাস, আগাছাগুলো প্রাণ ফিরে পেয়ে আরও ঝলমলিয়ে উঠেছে৷ সেসবের মাঝখান দিয়ে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেলো গুলিস্তা।
পুকুরপাড়ে মাঝারি আকৃতির একটা জাম্বুরা গাছ আছে। লাল টকটকে সেগুলোর দানা। খেতে ভারী মিষ্টি। দানাগুলো খুলে বাটি ভরে রিনাতের সামনে রেখে দিলে ও মুখ মজা করে খায়৷ জাম্বুরাগুলো পেকেছে কিনা, তারই খোঁজ করতে যাচ্ছে গুলিস্তা৷

নির্জন হলেও নিজের বাড়িতে ভয়ডর তেমন লাগে না গুলিস্তার৷ তবে বিনা বাতাসে লম্বা লিকলিকে আগাছাগুলোর নড়াচড়া গায়ে শিরশির অনুভূতি ছড়ালো। বুকের ভেতর ধক করে উঠলেও তেমন একটা পাত্তা দিলো না গুলিস্তা৷ তপ্ত আবহাওয়ায় শুষ্ক প্রকৃতি। কোথাও একটি গাছের পাতাও নড়াচড়া করছে না৷ এমন সময় আগাছা নড়েচড়ে উঠার প্রশ্নই আসে না। মনের ভুল ভেবে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলো।
পুকুরপাড়ে যেতে পশ্চিমের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হয়। দক্ষিণে ঘন কাশবন, উত্তরে কয়েকটা কলাগাছ অবহেলায় পরে আছে। লতায় পাতায় চারদিক অন্ধকার করে তুলেছে। নিচের দিকে পাতাগুলো কেটে ফেললে জায়গাটা পরিষ্কার দেখাবে৷ ব্যাপারটা মনে মনে টুকে নিলো গুলিস্তা। রেহবারকে জানাতে হবে।
পুকুরপাড়ের কাছাকাছি প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিলো এমন সময় দক্ষিণ দিকে হতে শনশন শব্দ ভেসে এলো। যতোই মৃদু শব্দ হোক, এই নির্জন বনের নিস্তব্ধতায় সেই শব্দ কানে পৌঁছাতেই গুলিস্তার মেরুদণ্ড বয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো৷ উৎসুক দৃষ্টি গিয়ে থামলো ঘন কাশবনের দিকে। অনেকটা জায়গা দখল করে আছে সবুজ পাতাগুলো। উচ্চতায় প্রায় গুলিস্তার সমান। ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখতে পেলো কিছু একটা নড়াচড়া করছে ঘন কাশবনের ভেতর। ঠিক নড়াচড়া নয়, মনে হচ্ছে কিছু একটা কাশবনের ভেতর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। কাছে গিয়ে একবার দেখবে কিনা খেয়াল এলো মনে। ততোক্ষণে নড়াচড়া থেমে গেছে। গুলিস্তা সতর্ক দৃষ্টি মেলে চারদিকে তাকালো। নাহ, কোথাও কিছু নেই।
সব দ্বিধা পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলো পুকুরপাড়ের দিকে৷ কিন্তু গুলিস্তা খেয়াল করলো না, কাশবন ধরে এগিয়ে যাওয়া রাস্তাটা গিয়ে ঠেকেছে সোজা পুকুরপাড়ে৷

****

রিনাতকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে রেহবার গেলো অফিসে। কাজের পরিসর বাড়ায় অফিসের লোকজন বেড়েছে। বিল্ডিং এর উপরতলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিতে হয়েছে৷ কর্মক্ষম লোকজন নিয়োগের কারণেই ছেলেকে যথেষ্ট সময় দিতে পারে রেহবার। না হলে অফিস সামলে বাড়িতে সময় দেওয়া চারটেখানি কথা নয়৷ তবুও আজ এ মিটিং, কাল ও মিটিং তো লেগেই আছে। রিনাতের স্কুল ছুটি দেয় দুপুর বারোটায়৷ ঘড়ি ধরে নির্দিষ্ট সময়ে ছেলের স্কুলগেটের সামনে হাজির হয়েছে সে। রিনাত বের হলো ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে৷ সাথে ওর বন্ধু ফয়েজ। ফয়েজকে নিতে এসেছে ওর মা। রিনাতকে দেখে গাল টেনে কিছু একটা বললেন। পাশেই আইসক্রিম বিক্রেতার কাছ থেকে দুটো আইসক্রিম কিনে নিয়ে একটি তুলে দিয়েছেন রিনাতের হাতে৷ গাড়িতে বসে সবটা দেখলো রেহবার। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার শিক্ষা যেনো ঠিকঠাক পায় সেইদিকে রেহবার যথেষ্ট খেয়াল রাখে। ফয়েজ মায়ের সাথে রিক্সায় উঠে বসতেই রিনাত এগিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসলো। বাবার দিকে তাকিয়ে মুখভঙ্গি বুঝার চেষ্টা করলো। মিষ্টি হেসে বললো,
– ভ্যানিলা আইসক্রিম। আন্টি জোর করে হাতে তুলে দিলেন। না নিলে মন খারাপ করতো৷ খাই, বাবা?

বিনিময়ে হাসি ফেরত দিয়ে রেহবার অনুমতি দিলো। শপিং কমপ্লেক্সের নয়তলায় ফুডকর্ণার সেখান থেকে কিছু স্নেকস খেয়ে ছেলের জন্য কেনাকাটা করতে শুরু করলো। গুলিস্তার জন্য দুটো শাড়ি, টুকটাক প্রসাধনী নিলো। সাথে নিজের জন্যেও কিছু কেনাকাটা করলো। রিনাতের জন্য ওর পছন্দের রিমোট পরিচালিত খেলনা স্পোর্টস কার। শপিং শেষে লাঞ্চ সেরে নিলো। পার্কে ঘুরাফেরা করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সূর্য ঢলে পরতে শুরু করেছে৷
বাড়ি সীমানায় যে লোহার গেটটি রয়েছে সেটা হাট করে খুলে রাখা। অথচ যাওয়ার সময় বন্ধ করে গিয়েছিলো রেহবার। কপাল কুচকে পেছন ফেলে আসা খোলা দরজার দিকে তাকালো।
ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজালেও গুলিস্তা দরজা খুললো না। ক্লান্ত রিনাত একবার দরজার দিকে তাকায় আরেকবার বাবার দিকে। মনে মনে খানিক বিরক্তবোধ করলেও ছেলের সামনে হাসিমুখ ধরে রেখে ওয়ালেট থেকে এক্সট্রা চাবি বের করে নিজেই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। হলরুম জুড়ে একটু বেশিই নিস্তব্ধতা। রিনাতকে নিজের রুমে যেতে বলে গুলিস্তাকে বেশ কয়েকবার ডাকলো। গুলিস্তা সাড়া দিলো না। পকেট হতে ফোন বের করে ফোনে কল দিলো। উপরে বেডরুম থেকে রিংটোনের আওয়াজ ভেসে এলো। ফোন কানে রেখেই দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো রেহবার। ফ্লোরের একপাশে পরে অনবরত বেজে যাচ্ছে গুলিস্তার ফোনটি। রুমে কোথাও সে নেই। হৃৎপিন্ড অশান্ত কোনো ঘোড়ার গতিতে ছুটতে থাকলেও খুব ধীরপায়ে রেহবার কক্ষের মধ্যকার দুরত্ব অতিক্রম করলো। দরজা ঠেলে নিঃশব্দে প্রবেশ করলো ব্যালকনিতে। সতর্ক দৃষ্টি চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিতেই এককোণে গুলিস্তাকে দেখতে পেলো। গলার কাছে আটকে থাকা শ্বাস টুকু কোনোরকমে টেনে নিয়ে বুকে অক্সিজেন ভরলো। আলতো স্বরে ডাক দিলো,
– ফুল, ফুল?

এলোমেলো চুল, খসে পরা আঁচল, হালকা রক্তাক্ত শরীর। হাঁটু গেড়ে বসে মাথা এলিয়ে দিয়েছিলো হাঁটুতে। রেহবারের ডাকে মুখ তুলে তাকালো। লাল চোখজোড়া, কাঁপতে থাকা ওষ্ঠদ্বয়। বিভৎস সেই দৃশ্য দেখে রেহবার নিজেও ধপ করে বসে পরলো মেঝের উপর। গুলিস্তার হাতে হাত রাখতে গিয়ে নজরে এলো বাম হাতের ফর্সা ত্বকের উপর নখের আঁচড়। সেখান থেকে গড়িয়ে পরেছে রক্ত। বিভ্রান্ত রেহবার চোখে মুখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালো গুলিস্তার দিকে। দেখতে পেলো ভীত, ত্রস্ত এক হরিণীকে। যার চোখ বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পরছে অশ্রুকণা৷ রেহবার কিছু বলতে নিয়েও গলায় স্বর ফুটে কোনো আওয়াজ বের হলো না।

চলবে…

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
৪৭

এইটুকু বয়সেও নিজের কাজ নিজে করতে শিখেছে রিনাত। কাজে সে যথেষ্ট পারদর্শী। শপিংব্যাগগুলো টেবিলের উপর রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। মায়ের দেওয়া পাঞ্জাবীটি গা থেকে খুলে হ্যাংগারে ঝুলিয়ে রাখলো। ঘরের সাধারণ পোশাক পরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে গিয়েও মায়ের কথা মনে পরায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। কিচেনে গিয়ে মায়ের দেখা পেলো না। বাধ্য হয়ে বাবা-মায়ের বেডরুমের সামনে এসে বার কয়েক কড়া নাড়লো। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো আওয়াজে পেলো না। ফিরে যেতে গিয়েও দরজা খুলে সামান্য উঁকি দিলো ভেতরে। কেউ নেই। পুরো ঘর ফাঁকা। দুটো মানুষ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো! কৌতুহলী রিনাত ঘরে ঢুকে মাকে ডাকলো। মাম্মাম, মাম্মাম?
কেউ উত্তর দিলো না। বাবাকে ডাকলো। তবুও কেউ সাড়া দিলো না। কী যেনো ভেবে ব্যালকনিতে চলে গেলো। এক কোণায় বাবা-মাকে বসে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। মায়ের ক্রন্দনরত মুখশ্রী দেখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালো বাবার দিকে। কিন্তু বাবার চোখে মুখেও প্রশ্নের ছাপ। ছোট রিনাত মায়ের কাছে গিয়ে এক হাত বাড়িয়ে মাকে ছুঁতে চাইলো। তাতেই বিদ্যুৎ বেগে পেছনে ছিটকে সরে গেলো গুলিস্তা। একদম দেয়াল ভেঙে আরও দূরে সরে যেতে চাইছে। রিনাত বড্ড ভয় পেলো। বাবার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকলো মায়ের দিকে।
একহাতে ছেলেকে আগলে রেহবার প্রশ্ন করলো,
– কি হয়েছে ফুল? ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি রেহবার। এই এদিকে তাকাও।

গুলিস্তা তাকালো না। দু হাত আরোও গুটিয়ে নিলো বুকের কাছে। বাবা ছেলে নিশ্চুপ দৃষ্টি বিনিময় করলো। খুঁজে পেলো না কোনো উত্তর। রেহবার হাত বাড়িয়ে দিতেই খেয়াল করলো ভয়ে আরও বেশি কুঁকড়ে যাচ্ছে গুলিস্তা। পাশ থেকে রিনাত হাতের আঙ্গুল উঁচু করে প্রশ্ন করলো,
– মাম্মাম, তোমার কোলে ওটা কি?

ছেলের আঙ্গুল লক্ষ্য করে রেহবারও তাকালো। এতোক্ষণে রেহবাবের নজরে এলো গুলিস্তা কিছু একটা কোলে আকড়ে নিয়ে বসে আছে৷ সকল ভয়কে উপেক্ষা করে দ্রুত গুলিস্তার নিকট পৌঁছে গেলো রেহবার।
– সব ঠিক আছে। আমাকে দেখতে দেও৷ যাস্ট রিলেক্স, ওকে?

রেহবারের কথায় হয়তো একটু ভরসা পেলো। খানিকটা শীতল হলো গুলিস্তার শরীরের গড়ন৷ কোলে সামান্য উঁকি দিয়ে যা দেখলো তাতেই রেহবারের শ্বাস ছুটে যাওয়ার দশা। হাত বাড়িয়ে গুলিস্তার কোল থেকে কাপড়ে মুড়ে রাখা টোপলাটি সম্মুখে নিয়ে এলো। সত্যিই তাই৷ একটা বাচ্চা৷ আস্ত একটা মানব শিশু গুলিস্তার কোলে। রেহবার কি বলবে, কীভাবে রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারলো না৷ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো গুলিস্তার দিকে৷ চমকেছে রিনাত নিজেও৷
সকলের ধাতস্থ হতে অনেকক্ষণ সময় লাগলো। ঘন্টা খানিক পর গুলিস্তা নিজেও কিছুটা স্বাভাবিক হলো। ঘুমন্ত শিশুটিকে কোলে নিয়েই হালকা দুলাচ্ছে৷ রিনাত ততোক্ষণে বাবার কোলে বসে চুপটি করে সাদা তোয়ালেতে প্যাঁচানো একটি জীবন্ত পুতুলকে দেখছে৷ ছোট ছোট হাত পা। চোখ বন্ধ করে শুধুই ঘুমাচ্ছে। ঢোক গিলে, হালকা কেশে গলার স্বর স্বাভাবিক করলো রেহবার। জানতে চাইলো,
– কার সন্তান? কোথায় পেলে?

গুলিস্তা চুপচাপ তাকিয়ে আছে শিশুটির দিকে৷ রেহবার আবার প্রশ্ন করলো।
– আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কিছু বলো। কার বাচ্চা এটা?
– আমার মেয়ে।

গুলিস্তার অতি শীতল কন্ঠস্বর। সেদিন যেমন বলেছিলো আমি বাচ্চা নিবো না, তেমন। রেহবার ভড়কালো। সাবধান হলো।
– কোথায় পেলে?
– কোথাও না।
– বাচ্চার বাবা মা কোথায়?
– ও আমার মেয়ে৷

হেয়ালি কথাবার্তা শুনে কার না রাগ হবে! রেহবারেরও হলো। কর্কশ কন্ঠে চিল্লিয়ে উঠলো,
– আর ইউ ম্যাড? আর ইউ ইভেন লিসেনিং ইউর সেলফস? কার না কার বাচ্চা নিয়ে এসে বসে আছো! নিজেও বিপদে পরবে আমাদেরও ফেলবে। কোনো পাখির ছানা তুলে নিয়ে আসোনি তুমি। আস্ত একটা মানুষের বাচ্চা তোমার কোলে। এর পরিমাণ কি হতে পারে বুঝতে পারছো? এতোটা বোকা নিশ্চয়ই তুমি নও। বাচ্চার অভিভাবক মিসিং কেস করবে৷ তল্লাশি চলবে৷ অপহরণের অপরাধে জেল পর্যন্ত হতে পারে৷

এই প্রথম বাবার কন্ঠ উঁচু হতে শুনলো রিনাত৷ তার কাছে এ যেনো চরম আশ্চর্যের কিছু। সব ভুলে অবাক চোখে বাবাকে দেখলে লাগলো। ছেলের এমন দৃষ্টির কবলে পরে রেহবার কিছু মুহূর্তের জন্য থমকালো৷ নিজ আচরণে নিজেই লজ্জিত হলো। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ধাতস্থ করলো নিজেকে।
– লিসেন ফুল, মাথা ঠান্ডা করে ভাবো। ঠিক আছে? কি হয়েছিলো আমাকে বলো। আমি সব ঠিক করে দিবো। ওকে সহিসালামত ওর বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবো।

এবার গুলিস্তা চিৎকার করে উঠলো।
– বললাম না আমার মেয়ে।
– এই পাগল মেয়ে, ও কীভাবে তোমার মেয়ে হয়? আকাশ থেকে টপকে পরেছে? ফেরেশতা এসে দিয়ে গেছে? কোনটা বলো? নিজের পাগলামির কারনে আমাকে, আমাদের ছেলেকে বিপদে ফেলতে চলেছো।

সেসব কথা গুলিস্তা কানে তুললো না। চিৎকারের কারনে শিশুটির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে৷ চোখ মুখ খিঁচিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করবে বলে। এক হাতে দোল দিয়ে আরেক হাতে বুকের উপর আস্তে আস্তে চাপড়াতে লাগলো গুলিস্তা।
– আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না। চলো ওকে থানায় দিয়ে আসি। পুলিশ ওর বাবা মাকে খুঁজে বের করবে।

রেহবার হাত বাড়িয়ে শিশুটিকে নিতে গেলে গুলিস্তা একপাশে বেঁকে বসলো। রেহবারের মাথায় জেদ চেপে গেলো। গুলিস্তার কোল থেকে শিশুটিকে নিয়েই ছাড়বে। জোর করে নিতে গেলেই গুলিস্তা এক হাতে শিশুটিকে বুকে আগলে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে আক্রমণ করে বসলো। রেহবারের হাতে খামচি দিলো, এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগলো। এতে সে নিজের দেহেও আঘাত পাচ্ছে। এলোমেলো চুলে টান পরছে, ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ছোট্ট রিনাত একপাশে দাঁড়িয়ে বিমূঢ় হয়ে সেসব দেখলো কিছুক্ষণ৷ এরপর ছোট দু হাতে বাবার শার্টের হাত ধরে বাবাকে ধামানোর চেষ্টা করে বলতে লাগলো,
– বাবা, ছাড়ো। মাম্মাম ব্যথা পাচ্ছে। বাবা থামো প্লিজ। বাবা, থামো।

রিনাতের কান্নার শব্দে রেহবার হুশ ফিরে পেলো হয়তো। থেমে গিয়ে তাকালো ক্রন্দনরত ছেলের দিকে৷ ডাগর ডাগর আঁখিদ্বয়ে জল টইটম্বুর। যার কারন সে নিজেই। ইশ্! কী অনাসৃষ্টি কান্ডকারখানা! রেহবার থেমে যেতেই গুলিস্তা তার অবশিষ্ট সামান্য শক্তি ব্যয় করে ধাক্কা দিয়ে নিজের সামনে থেকে রেহবারকে সরালো।

– ও আমার মেয়ে। খবরদার আমার মেয়েকে আমার থেকে নিতে আসবে না। এর ফল ভালো হবে না কিন্তু।

এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে রিনাতের ঘরে ডুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। রেহবারের মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে সময় নিলো অনেকক্ষণ। এরপর যখন গুলিস্তাকে খুঁজতে রিনাতের রুমে গেলো, দরজা বন্ধ পেলো। অনেক ডাকাডাকির পরেও গুলিস্তা দরজা খুললো না। এতোক্ষণ মাথায় অনেক অজানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আর এখন সব ছাপিয়ে মস্তিষ্কে জায়গা দখল করে নিলো গুলিস্তার চিন্তা।
ধীরে ধীরে রাত নামলো। রেহবার আবার ডাকতে গেলো।
– ফুল, বাইরে বের হয়ে কিছু খেয়ে নেও। তোমার ক্ষুধা লাগেনি?

গুলিস্তা কোনোকিছুর উত্তর দেয় না৷ বাধ্য হয়ে নিজেই টুকটাক রান্না করে ছেলেকে নিয়ে নিজের কক্ষে শুয়ে পরলো। সারারাত ঘুম এলো না। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে খোলা চোখে ভাবতে লাগলো ভবিষ্যতের কথা। গুলিস্তা কিছুতেই বাচ্চাটিকে ছাড়বে না। ও খুব একটা জেদ করে না৷ আবদারও করে খুব সামান্য। কিন্তু যখন জেদের পর্যায়ে নেমে পরবে, কার্যসিদ্ধি না করে পিছু হটবে না। তাই সব ভুলে রেহবার ভাবতে লাগলো কী করে সবকিছু সামাল দিবে। রিনাত নিজেও জেগে ছিলো অনেক রাত পর্যন্ত। একদিনে অনেক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। বাবা-মায়ের নতুন রুপ সামনে এসেছে৷ জন্মদিন পরিণত হয়েছে রঙ্গদিনে। ধাক্কা সামলাতে একটু সময় তো লাগবেই।

পরদিন সকালে রেহবার ঘুম থেকে উঠে দেখলো ডাইনিং টেবিলে গুলিস্তার জন্য ঢেকে রাখা খাবার ওভাবেই পরে আছে। সারারাত না খেয়ে ছিলো ভাবতেই বুকে চিনচিনে ব্যথা হলো। আচ্ছা, ও কি ঘুমিয়েছিলো? নাকি সারারাত ভয়ে সেটে ছিলো?

– তোমার মেয়েকে তোমার থেকে ছিনিয়ে নিবো না। ও তোমার কাছেই থাকুক। রুম থেকে বের হয়ে নাস্তা খেয়ে নেও। সারারাত না খেয়ে আছো। ফুল, শুনতে পাচ্ছো? আরে কিছু তো বলো।

রেহবারের কথায় গুলিস্তা কিছু বলে না। বাধ্য হয়ে নিজের ঘরে ফিরে যায় রেহবার। রিনাতকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। ফ্রেশ করিয়ে নাস্তা খাওয়ায়। বাচ্চাটা বেশ ভয় পেয়েছে। কেমন শুকনো মুখে চুপচাপ বসে আছে। এই প্রথম মাকে ভায়োলেন্ট হতে দেখেছে। কোলে বসিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ বুকে চেপে রইলো রেহবার। বুঝাতে চাইলো বাবা আগের মতোই আছে৷ রিনাত হয়তো বুঝলো। কিছুটা সহজ হলেও মায়ের কষ্টে মুখ ভার করেই থাকলো। মাকে বেশি ভালোবাসে কিনা!

ছেলের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে রেহবার বললো,
– বাবা একটু জরুরি কাজে এখন বাইরে যাবে। তুমি একা থাকতে পারবে না?

জবাবে রিনাত মুচকি হাসে। বন্ধ দরজার দিকে ইশারা করে বলে,
– একা কোথায়? মাম্মাম আছে না! তুমি নিশ্চিতে যাও৷

সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো রানু। রেহবারের পাংশুটে মুখের দিকে চেয়ে বড় মায়া হলো। কয়েক বছর পর পর বেচারার উপর সমুদ্রের বিশাল ঢেউ আছড়ে পরে। শ্বাস আটকে যাওয়ার মতো গভীর, বৃহৎ ঢেউ। রেহবার হয়তো ভয় পায়, খানিকটা টলে উঠে কিন্তু হার মানে না, হেরেও যায় না। ঠিকই সাঁতরে বেরিয়ে আসে। যাত্রাপথে একটু সাহায্য করে রানু। এবারও করলো। চাপাকন্ঠে বললো,
– আমার পরিচিত একজন মানুষ আছে। আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু রেহবার বুঝতেই তো পারছেন ব্যাপারটা ইল্লিগ্যাল। বাচ্চাটির অভিভাবক যদি এসে বাচ্চা দাবী করে তাহলে খুব বড় বিপদে পরে যাবেন।

রেহবার নিজেও জানে, জুয়ো খেলায় নিজেকে সহ পুরোপুরি পরিবারকে বাজি ধরতে যাচ্ছে সে। তবুও সে অনৈতিক কাজটি করতে রাজি হলো। রানুর পরিচিত সেই মানুষটি একজন সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার। সিটি করপোরেশনের মা ও প্রসূতি সেক্টরের দায়িত্বে আছেন। তিরিশ হাজার টাকার বিনিময়ে দুশ্চিন্তা মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিলেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে দ্রুত ফিরে এলো রেহবার। অন্যায়ের রাস্তা যতো সংক্ষিপ্ত করা যায় ততোই মঙ্গল। টাকা ব্যাগে ভরে মহিলাটি দ্রুত কাগজ কলম নিয়ে বসে পরলেন। অনেক হিসাবনিকাশ করে দক্ষ হাতে গুলিস্তার নামে একটি টিকা কার্ড তৈরি করে ফেললেন নিমিষেই। সিল স্বাক্ষর দিয়ে রেহবারের হাতে তুলে দিয়ে আরেকটি কক্ষে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে একজন সদ্য যুবক কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে। রেহবারকে দেখে বিশাল হাসি দিয়ে বললো,
– ইমারজেন্সি বার্থ সার্টিফিকেট লাগবে শুনলাম। জুঁই আপা নিজেই তাগিদ দিলেন। আজকাল তো বাবা মায়েরা বাচ্চার রেজিষ্ট্রেশন করতেই চায় না। ওই যখন স্কুল ভর্তি করানো লাগে তখন দৌড়ে আসে। আপনি কোন দরকারে সার্টিফিকেট নিতে আসছেন?

রেহবার কিছু বললো না। টিকা কার্ডটি এগিয়ে দিলো।

– এটা লাগবে না। আপনার কাছেই রাখেন। এই ফর্মটা পূরণ করে জুই আপার থেকে একটা স্বাক্ষর নিয়ে আসেন।

ফর্মে বাচ্চার নামের জায়গাটি পূরণ করতে গিয়ে রেহবার অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। নাম তো রাখা হয়নি। হঠাৎ করে কি নাম লিখবে? এই মুহূর্তে গুলিস্তাকে কল দিলে সে যে রিসিভ করবে না এটা জানা কথা। তাই নিজেই একটা নাম বসিয়ে দিলো।
অবশেষে সরকারি খাতায় রেহবার-গুলিস্তা দম্পতির ঘরে আরেকটি সন্তানের নাম রেজিস্টার হলো। যার নাম রেহনুমা নিনাত।

সকালে হালকা নাস্তা খাওয়ার পর স্কুল ছুটি হতেই রিনাতের প্রচুর ক্ষুধা পায়। ছেলেকে স্কুল থেকে পিক করতে গেলে রেহবার সবসময় সাথে কিছু খাবার নিয়ে যায়। বার্গার, স্যান্ডউইচ কিংবা চিকেন ফ্রাই। আজকে স্কুল যাওয়া হয়নি রিনাতের। তাই বলে অভ্যাস তো পাল্টায়নি। বারোটা বাজতেই পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়ানো শুরু করে দিলো। বাড়িতে বাবা নেই। মা-ও বন্ধ দরজার ওপারে। গুটি গুটি পায়ে কিচেনে গেলো। হাতের কাছে খাবারের কোনো পট পেলো না। যা আছে সব উপরের কেবিনেটে। টুলের সাহায্যে ফ্রিজের সবকটা ড্রয়ার চেক করেও কোনো খাবার পাওয়া গেলো না। কিছু ফল আছে, যা রিনাতের পছন্দ নয়। অনেক ভেবেচিন্তে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছোট হাত দিয়ে সামান্য শব্দ করলো। তারপর ডাকলো,
– মাম্মাম, কিচেন কেবিনেট থেকে বিস্কিটের পটটা বের করে দেও না। অনেক উপরে আমি নাগালে পাচ্ছি না।

মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মন খারাপের সুরে আবদার করলো রিনাত। সে জানে, এ দরজা খুলবে না। তার আবদারও পূরণ হবে না। বাবার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বাবা নাকি মা, কার উপর অভিমান হলো কে জানে! চোখে জল এসে ভীড় জমালো। ছলছল চোখ নিয়ে ফিরে যেতে থাকলো কিচেনের দিকে।
খট শব্দ করে খুলে গেলো রুমের দরজা৷ চিন্তিত মুখে বেরিয়ে এলো গুলিস্তা। ছেলের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ভারী মন খারাপ হলো। এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো,
– তুমি কিচেনে গিয়েছো?

মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো রিনাত। সেই মুহূর্তে ছেলের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো গুলিস্তা। যা সে কখনো দেখতে চায়নি। ঝট করে কাছে টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেললো ছেলেকে।
– খিদে পেয়েছে?
– হুম।
– একটু বসো। আমি কিছু তৈরি করে দিচ্ছি।

ঘাড় ঘুরিয়ে চিন্তিত দৃষ্টিতে ঘরের দিকে তাকালো গুলিস্তা। ওখানে ওর মেয়ে একলা শুয়ে আছে।

ফ্রিজ থেকে মেরিনেট করে রাখা চিকেন বের করে চিকেন ফ্রাই করছে। সেই সাথে ফ্রোজেন করে রাখা কাবাব ভেজে নিচ্ছে। কিচেনের এককোনায় বসে মায়ের ব্যস্ত হাতে রান্না করার দৃশ্য উপভোগ করছে রিনাত। হঠাৎ কি হলো কে জানে, হুট করে প্রশ্ন করে বসলো,
– তোমার খুব মন খারাপ?

থমকে ছেলের দিকে তাকালো গুলিস্তা। কিন্তু কিছু বললো না। চিকেন ফ্রাইগুলো উল্টে দিতে লাগলো মনোযোগ দিয়ে।

– তুমি এখন আর আমাকে তিতান বলে ডাকো না কেনো?

এবার ভারী চমকালো গুলিস্তা। চোখ দুটো বড় করে ছেলের দিকে তাকালো। তিতান নামের খবর রিনাত জানলো কি করে? সে যে কখনো সখনো আদর করে ছেলেকে তিতান ডাকে সে কথা রেহবারকে পর্যন্ত জানায়নি। রিনাত বুঝতে শেখার পর থেকে গুলিস্তা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ছেলে বড় হচ্ছে, নিজের পছন্দ-অপছন্দ তৈরি হচ্ছে। গুলিস্তার কোন আচরণের প্রভাব ওর উপরে কতোটা পরবে কে জানে! রিস্ক নিতে চায়নি গুলিস্তা। রেহবারের হাতে সবটা ছেড়ে দিয়ে নিজে আড়ালে থেকেছে। হ্যাঁ, লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলেকে এখনো তিতান বলে ডাকে, তবে সে খবর রিনাতের জানার কথা নয়।

মাকে চমকাতে দেখে বেশ মজা পেলো রিনাত। হেসে কুটিকুটি হলো৷
– বাবার ফোনে ভিডিও দেখেছি। আমি তখন অনেক ছোটো। ফ্লোরে হামাগুড়ি দিয়ে তোমার কাছে এলাম। তুমি ফ্লোরে শুয়ে বই পড়ছিলে। আমি গিয়ে হাত দিয়ে থাবা মেরে বইটা তোমার মুখের উপর ফেলে দিয়েছিলাম। তুমি বই তুলে আবার পড়তে শুরু করলে, আমি আবার থাবা মেরে ফেলে দিলাম। তুমি রাগ দেখিয়ে বলেছিলে, তিতান খুব দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো তুমি। মাম্মাম, বকা দিবো কিন্তু।

রেহবারের ফোনে এমন ভিডিও থাকতে পারে ভাবতেই পারেনি গুলিস্তা। কখন রেকর্ড করেছিলো? গুলিস্তা টেরই পায়নি। তারমানে রেহবার জানে! ইশ্! কী লজ্জাজনক ব্যাপার!

রিনাতকে খাইয়ে দুপুরের রান্নার আয়োজন করছিলো গুলিস্তা। ওর মেয়ে তখনো ঘুমাচ্ছে। সামান্য লিকুইড দুধ খাওয়া হয়েছিলো এগারোটার দিকে৷ তারপর থেকে ঘুমাচ্ছে৷ এই ফাঁকে রান্না সেড়ে নিতে চাইলো গুলিস্তা৷ মুরগির গোশত কষিয়ে মাত্রই সেদ্ধের পানি দিয়েছে, তখনি রেহবার এলো। কিচেনে গুলিস্তাকে দেখে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো। গুলিস্তা নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রেহবার প্রশ্ন করলো,
– রিনাত কোথায়?
– উপরে।

রেহবার চলে গেলো ছেলের খোঁজে। তখনি গুলিস্তার মনে পরলো মেয়েকে ঘরে রেখে এসেছে৷ রেহবার যদি নিয়ে যায়? চুলার আঁচ কমিয়ে হুড়মুড় করে সেদিকে ছুট লাগালো। ততোক্ষণে রেহবার পৌঁছে গেছে রিনাতের ঘরে। গুলিস্তা গিয়ে দেখলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গভীর ভাবে কিছু একটা দেখছে রেহবার। কৌতুহল নিয়ে রেহবারের পিছনে দাঁড়িয়ে গুলিস্তাও ভেতরে তাকালো।

ছোট্ট শিশুটির একপাশে শুয়ে আছে রিনাত। অপরপাশে কোলবালিশ দিয়েছে, যাতে পরে না যায়। একহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে বোনকে। শিশুটিও ছোট এক হাত উঠিয়ে দিয়েছে রিনাতের হাতের উপর। দুই ভাইবোনের এভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর দৃশ্যটি রেহবারের মনে দাগ কেটে গেলো। ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটিয়ে সেদিকে চেয়ে থেকেই পেছন থেকে টেনে সামনে আনলো গুলিস্তাকে। বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলো। হাতে তুলে দিলো রেহনুমা নিনাতের বার্থ সার্টিফিকেট। বাবার জায়গায় রেহবারের নাম, মায়ের জায়গায় গুলিস্তা।

চলবে…