হে সখা পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
330

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
৪৮

আমার মেয়ে, আমার মেয়ে বলে চিল্লালেও কাজের বেলায় লবডঙ্কা। রিনাতের মতো করেই বাবার কাঁধে সকল দায়িত্ব পরেছে নিনাতের৷ ওই শুধু মেয়ের ক্ষুধা পেলে খাইয়ে দিয়ে গুলিস্তার দায়িত্ব শেষ। প্রথম কয়েকদিন ক্ষুধায় দিন রাত এক করে কান্নাকাটি করতো নিনাত। কৌটা দুধ গুলিয়ে খাওয়ানো হলো৷ তাতে পেট খাবার হয়ে সে আরেক কান্ড কাহিনী। অনেক খোঁজ খবর করে মেডিসিনের সাহায্যে গুলিস্তার বুকের দুধ নামানো হলো। ব্যাপারটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে গুলিস্তা৷
সেদিন বার্থ সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে গুলিস্তার সেকি কান্না। রেহবারের সাথে করা বাজে আচরণের জন্য আত্মগ্লানিতে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। গুলিস্তার বারবার মাফ চাওয়া দেখে বেচারা রেহবার নিজেও অস্বস্তিতে পরে গিয়েছিলো। তাছাড়া, রেহবার বরাবর গুলিস্তার কান্নারত মুখশ্রীর সামনে দুর্বল হয়ে পরে৷ রাগ, অভিমান, অভিযোগ সব তখনই হুড়মুড় করে ছুটে পালিয়েছিলো৷

সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আম্বিয়া খাতুন নিজের ফোন হাতে নিয়ে বিমূঢ় হয়ে রইলেন৷ হোয়াটসঅ্যাপে রেহবারের মেসেজ এসেছে৷ একটা ছবি৷ রিনাতের পাশে ঘুমিয়ে আছে ছোট একটি শিশু। গায়ের লালচে রঙ, পাতলা চামড়া দেখেই অভিজ্ঞ আম্বিয়া খাতুন বুঝতে পেরেছেন এ কোনো সদ্য জন্মানো নবজাতক। এমন ছবি হঠাৎ কেনো পাঠালো রেহবার? তড়িঘড়ি করে ফোন লাগালেন৷

ভিডিওকলে রেহবারের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। রিনাতকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছিলো দাদীকে দেখতে পেয়েই রিনাত ছো মেরে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে বললো,
– আমার বোনকে দেখেছো? কী সুন্দর না? বাবা ওর নাম রেখেছে রেহনুমা৷ তবে আমরা সবাই ওকে নিনাত বলে ডাকবো। আমার নামের সাথে মিলিয়ে, নিনাত।

একমাত্র নাতির উচ্ছ্বাসের সামনে মন খারাপ আড়াল করলেন আম্বিয়া খাতুন। কপালে চিন্তার রেখে ওমনি রইলো। শুধু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
– খুব সুন্দর নাম। রিনাত, নিনাত। নাম শুনেই বুঝা যাচ্ছে দু ভাই বোন।

ছেলের হাত থেকে ফোন নিয়ে রেহবার বললো,
– তোমার খাওয়া শেষ হয়েছে। রুমে গিয়ে ব্রাশ করে শুয়ে পরো। বাবা দাদীমার সাথে কথা বলে আসছি।

রিনাত চলে যেতেই রেহবার তাকালো চিন্তিত মায়ের দিকে। মুখে তার প্রশ্ন, অবিশ্বাস, অভিযোগ, হতাশা৷
– কি হচ্ছে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে কেউ? ছবির বাচ্চাটা কে?
– আমার মেয়ে।

রেহবারের সহজ উত্তর। আম্বিয়া খাতুনের গলার স্বর উঁচু হলো।
– হঠাৎ মেয়ে এলো কোথা থেকে? আকাশ থেকে টুপ করে পরেছে?
– আকাশ থেকে বাচ্চা পরে নাকি! আমার বউ নিয়ে এসে দিয়েছে৷

রেহবারের খামখেয়ালি কথায় আম্বিয়া খাতুনের ভীষণ রাগ হলো। তবে ছেলের চোখে মুখে দুষ্টু হাসি দেখে বেশি কিছু বলতে পারলেন না। হতাশা জড়ানো গলায় প্রশ্ন করলেন,
– দত্তক নিয়েছিস? যদি নিয়ে থাকিস আমাকে বল৷ আমি এতোটা অমানবিক নই যে তোকে বাঁধা দিবো৷
– নাহ৷ দত্তক নেবো কেনো! নিনাত আমাদের মেয়ে৷
– রেহবার, আমি তোর মা। তোর থেকে বেশি দুনিয়া দেখেছি। তোর বউ না গর্ভবতী হলো, না ডেলিভারি হলো। অথচ এক দিনে জলজ্যান্ত বাচ্চা নিয়ে হাজির! কীভাবে? আমাকে বুঝিয়ে বল৷

মায়ের প্রশ্নে রেহবার কোনো উত্তর দিতে পারলো না৷ পাশের চেয়ারে আতংকিত মুখে চেয়ে আছে গুলিস্তা।ওরা জানে আম্বিয়া খাতুনকে মানানো এতো সহজ হবে না। কিন্তু এখানে রেহবারই বা কি বলার আছে। আম্বিয়া খাতুন আবার ডাক দিলেন,
– রেহবার?

রেহবারের মাথা নত হলো। সমস্ত সাহস, শক্তি খুইয়ে অনুরোধের সুরে মায়ের কাছে আরজি জানালো,
– এর বেশি আমার কাছে জানতে চেয়ো না মা। আমি বলতে পারবো না৷ তোমাকে মিথ্যে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ সত্যিটাও এখন জানানোর সময় আসেনি৷ প্লিজ মা৷

আম্বিয়া খাতুন বিচক্ষণ মানুষ। রশিতে কখন কতোটা বল প্রয়োগ করতে হয়, কখন ছেড়ে দিতে হয় উনি জানেন। ছেলেকে বেশি ঘাটালেন না।

রাহিল যখন শুনলো ভাইয়ের ঘরে নতুন সদস্য এসেছে। তাও আবার বংশের প্রথম মেয়ে! খুশিতে আত্মহারা হলো। অতঃপর সন্দিহান সুরে জানতে চাইলো,
– কিন্তু মেয়ে হলো কীভাবে?

আম্বিয়া খাতুন ভারী বিরক্ত হলো। এত বড় ছেলেকে কি এখন বুঝাতে হবে কীভাবে হয়েছে!
– যেভাবে হয়।
– আরে নাহ, নাহ। ওসব বলিনি। ভাবীর প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে তুমি কখনো কিছু বলোনি। এখন হঠাৎ বাচ্চার কথা বললে। আমার একটু আশ্চর্য হওয়া স্বাভাবিক, তাই না?
– আমিও জানতাম না।
– কিহ?
– রেহবার কাউকে জানায়নি।
– ওয়াও! ভাই ভীষণ চুপারুস্তম হয়েছি দেখছি৷ এমন একটা সুসংবাদ এতো মাস লুকিয়ে রেখেছে!

**

চারদিকে ভ্যাপসা গরম। সারাদিন সূর্যের তাপে খাঁ খাঁ করছিলো চারপাশ৷ বিকালের দিকে সূর্যকে ঢেকে খানিকটা মেঘ জমেছে আকাশে। এতে রোদ আড়াল হলেও প্রকৃতি শীতল হয়নি। বরং গরম বেড়েছে। ভ্যাপসা গরমে সকলের অস্থির অবস্থা। অফিস থেকে ফিরেছে রেহবার। ওর জন্য দ্রুত হাতে লেবুর শরবত বানিয়ে ঘরে নিয়ে গেলো গুলিস্তা। গিয়ে দেখে অফিসের কাপড় তখনো ছাড়েনি রেহবার। বিছানার উপর অবহেলায় পরে আছে ল্যাপটপ ব্যাগ। সোফার হাতলে ঝুলছে খুলে রাখা কোর্ট। শার্টের হাত কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে মেয়েকে সু এর উপর দাঁড় করিয়ে ঘর জুড়ে হাঁটছে রেহবার।
– এই তো আমার মা-টা হাঁটতে শিখেছে।

বাবার কথা শুনে খিলখিলিয়ে হাসে নিনাত। গায়ে সুতি কাপড়ের পাতলা সাদা জামা। পাড়টুকু লাল টুকটুকে। সাথে সাদা প্যান্ট। বাবড়ি চুলগুলো রাবারব্যান্ড দিয়ে ঝুটি করে বাধা। বাবার পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে এক পা উঁচু করে আবার থপাস করে নিচে ফেলে। বাবার হাতে ধরে থাকা হাত দুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। হামাগুড়ির অধ্যায় শেষে আজকাল হাঁটতে চাইছে দুষ্টু মেয়েটা৷ যখনি সুযোগ পায় কোমড় সোজা করে দাঁড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করে। যে ভালো করে দাঁড়াতেই পারে না, সে নাকি হাঁটবে! সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হয়। কিন্তু রিনাত ও রেহবার থাকতে মেয়েকে আটকানো অসম্ভব। বোনের দু হাত ধরে একটুখানি দুরত্বে বসে থাকে রিনাত। থপাস থপাস করে পা ফেলে হুড়মুড় করে ভাইয়ের বুকে এসে আছড়ে পরে নিনাত৷ আর বাবা অফিস থেকে ফিরলে, তার পলিশ করা কালো কুচকুচে জুতার উপরে পা রেখে আরেকদফা হাঁটার প্র‍্যাকটিস হয়ে যায়।

সোফার সামনের টেবিলে শরবতের গ্লাস রেখে রেহবারের কোর্টটি হাতে তুলে নিলো গুলিস্তা। চেঞ্জিং রুমে রেখে এসে রেহবারকে বললো,
– এখনো পোষাক ছাড়োনি! গরম লাগছে না?

মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে গুলিস্তাকে দেখে চওড়া হাসলো রেহবার।
– মেয়েকে হাঁটা শিখাচ্ছি। এতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে আমার আম্মুটা!

রেহবারের মনে পরে এই তো সেদিন প্রথমবার ছোট্ট দেহটিকে বুকে আগলে নিয়েছিলো। দুপুরবেলা ভরপেট খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলো রেহবার। সারাদিন চিন্তায় এবং সিটি করপোরেশনে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে বড্ড ক্লান্ত সে। টানা ঘুমিয়ে সন্ধ্যায় বিছানা ছাড়লো। রিনাতের পুরোনো বেবি ক্র্যাডলে শুয়ে হাত পা নড়াচড়া করছিলো নিনাত৷ কাছে দাঁড়িয়ে দু চোখ ভরে মেয়েকে দেখলো রেহবার। যেনো মুখস্ত করে নিতে চাইছে মেয়ের আদল। ফিরে যাওয়ার জন্য পিছু ঘুরতেই দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে গুলিস্তা। সরু চোখে তাকিয়ে আছে রেহবারের দিকে৷ খোঁচা মারতে ভুলেনি রেহবার। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিলো,
– তোমার মেয়েকে গিলে ফেলবো না। এভাবে তাকানো বন্ধ করো।

রাত পর্যন্ত রিনাতের ঘরে ওকে পড়িয়ে, হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করে, ডিনার করিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে তারপর ঘরে এসেছিলো রেহবার।
গুলিস্তা তখন বিছানায় একপাশে ঘুমাচ্ছে। মাঝখানে রিনাতের সেই পুরনো বেডে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে নিনাত। পুরনো দৃশ্য তবে নতুন অনুভূতি। আগে এভাবে ঘুমাতো রিনাত। তারপর বেশ কয়েক বছর হলো রিনাতের রুম আলাদা করা হয়েছে৷ দুজনে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে রাত পার হয়ে যেতো। এতো বছর পর দুজনের মাঝখানে আরও একজন ঢুকে পরেছে। অজান্তেই মুখে হাসি ফুটলো রেহবারের। ফুড়ফুড়ে মেজাজে মেয়ের পাশে ফাঁকা স্থানটি শুয়ে ঘুমিয়ে পরলো। মাঝরাতে উহ উহ মৃদু শব্দে রেহবারের ঘুম ভেঙে গেলো। পাশ ফিরে দেখলো চোখ মুখ কুচকে কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে গুলিস্তার কন্যা। অথচ গুলিস্তা তখন বালিশে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমের রাজ্যে সাঁতার কাটছে। মেয়ের বুকের উপর হাত রেখে রেহবার ফিসফিসিয়ে বললো,
– কাঁদে না বাবা। মাম্মাম ঘুমাচ্ছে। কাঁদলে ঘুম ভেঙে যাবে।

কিন্তু সেসব শুনলো না ছোট নিনাত। ঠোঁট উল্টে কান্না শুরু করে দিলো। লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো রেহবার। আগেপিছে কিছু না ভেবে নিনাতকে কোলে তুলে নিলো। ঘরময় হেঁটে, কোলে দোল দিয়ে মেয়েকে চুপ করানোর চেষ্টা করলো। কান্না খানিকটা থামলেও পুরোপুরি শান্ত করা গেলো না। রেহবার বুঝলো এভাবে কাজ হবে না। নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে। আশেপাশে খুঁজে দুধের পট, ফিডার আবিষ্কার করলো। তারপর সেইগুলো নিয়ে সেই গভীর রাতে রেহবার গিয়েছিলো কিচেনে। পানি গরম করে, দুধ গুলিয়ে,ফিডারে ভরে ঠান্ডা করে তারপর মেয়েকে খাইয়েছে। তবেই না আবার ঘুমের রাজ্যে ফিরে গিয়েছিলো গুলিস্তার ছিচকাদুনে মেয়ে।

গুলিস্তার এগিয়ে দেওয়া শরবতের গ্লাসটি হাতে নিয়ে ঠান্ডা শরবত পান করে ক্লান্তি মিটিয়ে নিতে চায় রেহবার। শার্টের বোতামগুলো আস্তেধীরে খুলে দিতে থাকে গুলিস্তা। উন্মুক্ত হয় রেহবারের পেটানো শরীর৷ বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে কাঠিন্য বাড়ছে৷ নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে চর্বির জমার সুযোগ পায়নি৷ অথচ গুলিস্তার মনে হয় সে নিজে বেশ মুটিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত কয়েক গ্রাম করে ওজন বাড়ছে নিশ্চয়ই। বোতাম খোলা শেষে হাত ঘড়িটি খুলে নিয়ে বললো,
– ফ্রেশ হয়ে নাও৷

মেয়েকে বিছানার উপর বসিয়ে রেখে রেহবার চলে গেলো ওয়াশরুমে।

তখনি দরজায় নক করে প্রবেশ করলো রিনাত৷ মায়ের সামনে এসে বললো,
– আমার পড়া শেষ। নিনাতকে দেও। বাইরে থেকে হেঁটে আসি।

রিনাতকে সাথে নিয়ে রোজ বিকালে বাইরে হাঁটতে বের হতো রেহবার। খোলা পরিবেশের সতেজ আবহাওয়া শিশুর জন্য অনেক উপকারী। নিনাতের ক্ষেত্রে সেই দায়িত্বটি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে রিনাত।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে চলেছে৷ এখন বাইরে বের হলে ফিরবে কখন? সামান্য চিন্তিত দেখালো গুলিস্তাকে৷ ছেলেকে মানা করার কাজটি আজ পর্যন্ত কখনো করেনি সে৷ পাছে যদি কষ্ট পায়! গুলিস্তার মনের ভাষা বুঝতে পারার বিদ্যা বাবার থেকে রপ্ত করেছে রিনাত৷ সেই সাথে মায়ের পেটে থাকাকালীন সময় তিতানের সাথে গুলিস্তার অনবরত কথা বলা, সুখ দুঃখ শেয়ার করার ঘটনাটি রিনাতের পক্ষে কাজ করেছে অনেকখানি৷ মায়ের গর্ভে শুয়ে থেকে সেও মায়ের সুখ দুঃখের গল্প শুনেছে। তাই তো দৈবিকভাবেই মায়ের মন পড়তে পারার ক্ষমতা আয়ত্বে এসেছে রিনাতের। গুলিস্তার কাঁধে হাত রেখে নিশ্চয়তা দিলো,
– বেশি দূরে যাবো না। কাছাকাছি একটুখানি হেঁটে ফিরে আসবো৷

গুলিস্তা সায় দিতেই নিনাতকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো রিনাত৷ এদিকে ওয়াশরুম থেকে ফিরে মেয়েকে দেখতে পেলো না রেহবার।
– নিনাত কোথায়?
– ওর ভাইয়ের সাথে হাঁটতে গিয়েছে।

ক্লান্ত শরীরটা অর্ধেক এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়৷ হাঁটু ঝুলছে ফ্লোরে৷ সোজা হয়ে শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে মুখ করে আছে গুলিস্তা। মাথার চুল মুছতে থাকা ভেজা তোয়ালা নিঃশব্দে পাশে কোথাও রেখে দিয়ে রেহবার এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে। গুলিস্তার পাশে শুয়ে এক হাতে ভর দিয়ে ওর মুখের উপর ভেজা চুলগুলোর পানি ছিটিয়ে দিলো। ডানে বামে মাথা ঘুরাতেই ভেজা চুলে জমে থাকা পানিগুলো ঝরঝর করে পরে ভিজিয়ে দিলো গুলিস্তার মুখ। চোখ বন্ধ করে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকা গুলিস্তা চমকে উঠলো। ভড়কে বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলে বাঁধা পরলো রেহবারের হাতে বাঁধনে। সদ্য স্নান সেড়ে আসায় রেহবারের গা থেকে ভেজা একটা গন্ধ আসছে৷ চুল হতে মৃদু শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। ভেজা ত্বকে খানিকটা শীতলতা। গুলিস্তার শরীর জুড়ে শিহরণ ছড়িয়ে পরলো। সোজা হয়ে থাকা মুখটি একপাশে কাত করে দৃষ্টি এড়াতে চাইলো। কিন্তু রেহবার এক হাতে ওর মুখটি সোজা করে গভীর চোখে চাইলো গোলাপি ওষ্ঠের দিকে৷ শীতল হাতের পরশে আরামে চোখ বুঝে এলো গুলিস্তার। তখনি অনুভব করলো রেহবারের শীতল ওষ্ঠদ্বয়ের ছোঁয়া।
গুলিস্তার নিচের ঠোঁটে একটি পানির ফোটা চিকচিক করছে। ভীষণ টানছিলো রেহবারকে। ধীরে ধীরে মুখ নামিয়ে রেহবার নিজের ঠোঁট দিয়ে পুরোপুরি শুষে নিলো পানিটুকু। যেনো আজন্মের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। তিরতির করে কাঁপতে থাকা হাতে গুলিস্তা রেহবারের টিশার্টের কলার জড়িয়ে ধরলো। রেহবারের হাত থেকে ছাড়া পেতেই দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পূরণ করতে থাকলো অক্সিজেনের অভাব । লজ্জায় লাল হতে থাকা গাল দুটোর দিকে তাকিয়ে রেহবার মুচকি হাসলো। বিয়ের এতোদিন পরেও নতুন বউয়ের মতো লাজে রাঙা হলে স্বামী কেনো উতলা হবে না? নিজেই আকর্ষণ বাড়িয়ে পরে দোষ হয় রেহবারের। এ কেমন অন্যায়!
গালে চুমু দিতেই হাত দিয়ে দূরে ঠেলে দিতে চাইলো রেহবারকে৷ একহাতে হাতটি ধরে নিজের মুখের সামনে এনে তাতেও চুমু দিলো রেহবার৷ এক কাপ কফি চাওয়ার মতো করেই স্বাভাবিক গলায় বললো,
– একটু আদর করতে দেও তো। অহেতুক ঠেলাঠেলি করো না।

চলবে..

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
৪৯
বগুড়া থেকে অনেকদিন পর কল এসেছে রেহবারের ফোনে। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এ মুখো হয় না কেউ। আজকে হঠাৎ দিহানের কল দেখে রেহবার সতর্ক চোখে তাকালো গুলিস্তার দিকে। সবাই তখন নাস্তার টেবিলে খাবার খেতে ব্যস্ত। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। রেহবার সন্তপর্ণে চেয়ার ছেড়ে উঠে আড়ালে চলে গেলো।
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। টেবিল গুছাচ্ছিলো গুলিস্তা। নিনাতকে পাশে বসিয়ে সোফায় অপেক্ষা করছে রিনাত৷ বাবা ফিরলেই স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। রেহবার ফিরে এলো দ্রুত পায়ে। ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গুলিস্তার হাত থেকে সবজির বাটি নিয়ে আবার টেবিলে রেখে দিলো। ওটা ফ্রিজে তুলে রাখতে যাচ্ছিলো গুলিস্তা। রেহবারের এমন আচরণে সে অবাক হলো। প্রশ্ন নিয়ে তাকালো রেহবারের দিকে। রেহবার ওর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে আবদ্ধ করে নমনীয় গলায় বললো,
– আমাদের বগুড়া যেতে হবে।

ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হলো গুলিস্তার। শেষ কবে বগুড়া গিয়েছিলো মনে করার চেষ্টা করলো। হবে অনেক বছর। রেহবার রাগ করে ওকে বগুড়া পাঠিয়ে দিলো তারপর একদিন হুট করে গিয়ে এক প্রকার তুলে নিয়ে এলো। তারপর আর কখনো ও মুখো হয়নি। গুলিস্তা নিজেও কখনো বগুড়ার নাম মুখে নেয়নি। ভুলেই গিয়েছিলো ওর একটা বাপের বাড়ি আছে। বাড়িতে থাকতে থাকতে একঘেয়েমি লাগলে আশেপাশে কোথাও ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। রিনাতের জন্মের পর আরেকবার ফ্লোরিডাও গিয়েছিলো। তবুও বগুড়ায় কখনো নয়। তাহলে আজ কেনো বগুড়া যাওয়ার কথা উঠলো?
– কেনো?

শুকনো ঢোক গিলে রেহবার বললো,
– দিহান ফোন করেছিলো। তোমার মা অসুস্থ। উনাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে৷ তোমাকে দেখতে চাইছেন।

অবস্থা যে খুব একটা ভালো নয়, সেটা আর বলা হলো না। তোমাকে দেখতে চাইছেন, এইটুকু কথাতেই গুলিস্তার ভীত নড়ে উঠলো। হাজার হোক, মা তো। সন্তানের মনের ভেতর মায়ের যে জায়গাটি রয়েছে সেটি কেউ নিতে পারে না। মা বেঁচে না থাকলেও মায়ের সেই জায়গাটি আজন্ম ফাঁকা পরে রয়। আমরা যতোদিন বাঁচি, মনের মধ্যে মায়ের স্নেহ, মমতা প্রত্যাশী সেই জায়গাটুকু বেঁচে রয়।
চোখ না কাঁদলেও গুলিস্তার মন কাঁদলো। তিরতির করে কাঁপলো ঠোঁট। ফুলে উঠলো নাকের ডগা।
ওকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো রেহবার।
অল্প সময়ের মধ্যে ছোট একটি ব্যাগ গুছিয়ে ফেলে নিনাতকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পরলো বাড়ি থেকে। পিছু পিছু আসছে গুলিস্তা ও রিনাত। মায়ের হাতটি নিজের হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে রিনাত৷ হোক সে হাতের জোর কম, কিন্তু ভরসা আছে অফুরন্ত।

বগুড়ায় পৌছে ওরা সরাসরি হাসপাতালে চলে এলো। বেসরকারি হাসপাতালের সাদা ফ্লোরটাও ঝকঝকে দাঁত নিয়ে হাসছে। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে পুলকিত হওয়ার সময় কারো নেই। নেই তেমন পরিস্থিতি। দৌড়ে আইসিইউ এর সামনে পৌঁছাতেই অনেকগুলো চেনা অচেনা মুখের দেখা মিললো। আইসিইউ থেকে খানিক দূরে রাখা চেয়ারগুলোতে বসে প্রহর গুনছে সকলে। গুলিস্তাকে দেখে খুশি হওয়ার পরিবেশ এটি নয় তবুও মনে মনে খুশি হলো শর্মী। স্বামী সন্তান নিয়ে গুলিস্তার ভরা সংসার। মুখে মা হারানোর ভয় থাকলেও শরীর জুড়ে সুখের আভাস। এই দুর্দিনেও শর্মীর মুখে এক চিলতে হাসি দেখা দিলো। মেয়েটাকে দেখে কে বলবে, এটা সেই গুলিস্তা! মাটির দিকে চোখ রেখে হাঁটতো। ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকতো। ক্ষুধায় মরমর অবস্থা হলেও কখনো মুখ ফুটে বলতো না, ভাবী খেতে দেও।

সকলে নীরবে স্বাগত জানালো গুলিস্তাকে। ফাঁকা চেয়ারগুলোতে বসে পরলো রোগীর পরিবারের নতুন সদস্যরা৷ ঘন্টাখানেক পরেই গুলিস্তার ডাক পরলো। আইসিইউ এর ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেছে৷ হসপিটাল গাউন পরে, স্যানিটাইজ করিয়ে গুলিস্তা ও রেহবারকে ভেতরে ঢুকানো হলো। নিনাত ও রিনাত তখন শর্মীর দায়িত্বে। বাকি সদস্যরা কাছে গিয়ে উৎসুক নয়নে দেখছে গুলিস্তার ছেলেমেয়েকে।

হৃৎব্যধি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সীমা বেগম। বয়সের সাথে সাথে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগ। আইসিইউ এর বেডে শুয়ে কখনো চেতনাহারা হয়ে পরছেন৷ কখনো চেতনায় থাকলেও স্মৃতিশক্তি বড্ড নড়বড়ে। মায়ের শরীরে বার্ধক্যের চিহ্ন গুলিস্তার ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে৷ স্মৃতির কোঠরে কিছুক্ষণ আগেও মায়ের শক্তপোক্ত শরীরের একটি প্রতিচ্ছবি ছিলো। যা এখন বড্ড পাংশুটে, নড়বড়ে। কাছে গিয়ে অনেক কষ্টে ঠোঁট নাড়িয়ে গুলিস্তা ডাক দিলো,
– মা, মা?

সীমা বেগম দুর্বল চোখ মেলে তাকান৷ গুলিস্তা ভেবেছিলো এক্ষুণি একজোড়া কঠিন চোখ ওকে ভস্ম করে দিতে চাইবে৷ কিন্তু এর পরবর্তী যে চোখ জোড়ার দেখা মিললো, তা না দেখাই বোধহয় ভালো ছিলো। খুব দুর্বল, নমনীয়, ব্যথাতুর দৃষ্টি চিরচেনা মায়ের। এ দৃশ্য কি মেনে নেওয়া যায়? তবুও মানিয়ে নিতে হয়। কান্না গিলে ফেলে গুলিস্তা মানিয়ে নিলো। মায়ের সামনে এখনো হাসতে বড্ড ভয় করে। মাকে ছুঁতে ভয় করে৷ এই যে এখন মুখের, হাতের কুচকানো চামড়ায় হাত বুলিয়ে মাকে অনুভব করতে ইচ্ছে করছে। গায়ে নাক ডুবিয়ে মা, মা ঘ্রাণটুকু বুক ভরে নিতে মন চাইছে৷ যেনো বাকিটা জীবন এই ঘ্রাণটুকু লুকিয়ে বাঁচিয়ে মনে রাখতে পারে৷ কিন্তু এর কিছুই সে করতে পারলো না।
পাশে দাঁড়িয়ে রেহবার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। সে এসেছে গুলিস্তার দেখভালের জন্য। এ বাড়ির কোনো সদস্যের কাছে গুলিস্তা নিরাপদ নয়।

চোখের সামনে মেয়েকে দেখে সীমা বেগম এক হাত বাড়িয়ে মেয়েকে ছুঁতে চাইলেন। কিন্তু দুর্বল হাতটি সামান্য উপরে উঠাতেই শরীরের শক্তি নিঃশেষ হতে চললো। হাতটি নিচে পরে যাওয়ার আগেই খপ করে ধরে ফেললো গুলিস্তা৷ দু হাতে আগলে নিলে গালে ছোঁয়ালো মায়ের হাত৷ দু চোখে অঝোর ধারায় বর্ষা নেমেছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে তৃষ্ণার্ত বুক।
মেয়ের ছোঁয়া পেতেই সীমা বেগমের মস্তিষ্ক হতে প্রলেপ খানিকটা সরে গেলো৷ ধীরে ধীরে চিনতে পারলেন মেয়েকে। ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটলো৷ ধীর কন্ঠে বললো,
– তুই আসছিস! কখন এলি?

শেষ কবে মায়ের কন্ঠে নমনীয়তা শুনেছে মনে পরছে না গুলিস্তার। এই মাকে পুরোই অচেনা লাগছে ওর কাছে। তবুও মেনে নিলো। মা তো মা-ই। এই তো মায়ের হাতের ছোঁয়ায় মমতা। শরীরে মা, মা ঘ্রাণ। হাতে আলতো চুমু এঁকে গুলিস্তা বললো,
– একটু আগেই এসেছি৷ তুমি কেমন আছো মা?
– আমি? আছি ভালো। এই বন্ধ ঘরে একা ফেলে সবাই চলে গেছে।
– কেউ চলে যায়নি। আমরা সবাই আছি তোমার কাছে৷ ওই দরজার ওপাশেই আমরা সকলে আছি। তুমি একটু সুস্থ হও, তোমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো।

সীমা বেগম শুনলো মনোযোগ দিয়ে৷ চোখের পলক বার কয়েক ফেলে আবার বললো,
– তুই কখন এসেছিস?

গুলিস্তা তাকালো রেহবারের দিকে। বড্ড দিশেহারা দৃষ্টি। রেহবার সামান্য এগিয়ে এসে বললো,
– আমরা একটু আগেই এসেছি।
– কে কে এসেছো?

এবার গুলিস্তা উত্তর দিলো।
– আমি, রেহবার, আমার ছেলে মেয়ে।
– তোর ছেলেমেয়েও আছে?
– হ্যাঁ, মা। এক ছেলে, এক মেয়ে৷
– আলহামদুলিল্লাহ। ভরা সংসার৷

রেহবার বললো,
– আমাদের জন্য দোয়া করবেন। শুনেছি অসুস্থ মানুষের দোয়া আল্লাহ দ্রুত কবুল করেন৷ আপনি তো আবার মা। মায়ের দোয়া আল্লাহ নিশ্চয়ই কবুল করবেন।

গুলিস্তা ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রেহবার পাত্তা দিলো না। সীমা বেগম বেশি কিছু বুঝলেন না। হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে বললেন,
– হ্যাঁ, হ্যাঁ। আল্লাহ কবুল করে নিক। সুখের সংসার হোক তোমাদের৷ সুখী হও।

খানিক থেমে শ্বাস টেনে নিলেন। তারপর বললেন,
– আমার নাতি নাতনি! ওদের ডাকো। দেখবো। ডাকো, ডাকো।

সেই যে জেদ ধরলেন, উনাকে আর থামানো গেলো না৷ রেহবার কিছুতেই ছোট্ট নিনাতকে আইসিইউতে নিয়ে যেতে দিবে না। ডাক্তারেরও অনুমতি নেই। কিন্তু গুলিস্তা বাঁধা মানছে না। ওর মা দেখতে চেয়ে, সে দেখাবেই। মানুষটা তার নিজের নাতি নাতনিকে দেখতে পারবে না, এটা কেমন কথা!

– সুস্থ হয়ে না হয় দেখবে৷
– সুস্থ হবে এই নিশ্চয়তা কীভাবে দিচ্ছো? আমার মায়ের যদি কিছু একটা হয়ে যায়?

আঁচল টেনে চোখের জল মুছলো গুলিস্তা৷ বাধ্য হয়ে রেহবার রাজি হলো। ডাক্তারের কাছে অনেক অনুরোধ করার পর সীমিত সময়ের জন্য অনুমতি পাওয়া গেলো। ভীত পায়ে রিনাত মায়ের সাথে প্রবেশ করলো কক্ষে৷ সেই প্রথমবারের মতো নানীকে দেখা। সাদা বেডে শুয়ে থাকা শুভ্র একটি জীর্ণশীর্ণ শরীর। নাতি নাতনিকে দেখে আনন্দিত হলেন সীমা বেগম। রিনাতের গালে, চুলে হাত ছুঁইয়ে বললেন,
– মাশাআল্লাহ। রাজপুত্রের মতোন ছেলে হয়েছে৷

নিনাতের গাল ছুঁয়ে আদর করে দিলেন। অবুঝ শিশুটি মায়ের আঁচল মুঠো করে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অপরিচিত ব্যক্তিটির দিকে৷

সেই রাতের শেষভাগে যখন চারদিক মুখোরিত হলো ফজরের আযানের ধ্বনিতে ,তখন সমস্ত মায়া কাটিয়ে পরপারে যাত্রা করলেন সীমা বেগম। আকবর পরিবারটি যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো নিমিষে।
চার ভাই মায়ের অন্তঃপ্রাণ ছিলো। মায়ের ছায়া উঠে যেতেই কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেলো৷ ততোদিনে চাচাদের সাথে গুলিস্তার ভাইদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে৷ সবাই নিজের আখের গুছিয়ে আলাদা জগতে ব্যস্ত। সীমা বেগমের দেহান্তের খবর শুনে দূর থেকে দুঃখ প্রকাশ করলো সকলে। কাছে কেউ এলো না সাহায্যের জন্য। হাসপাতালে আবার দৌড়াদৌড়ি করতে হলো রেহবারকে। ডাক্তার, নার্স, ওয়াডবয় সবার সাথে কথা হচ্ছে রেহবারের৷ অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে সীমা বেগমকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত রেহবার সবটা সামলে নিলো। মাঝেমধ্যে শোক সভায় এসে দেখেও যেতে হলো গুলিস্তাকে। এককোণে একান্তে বসে চোখের জল ফেলছে। দূর থেকে দেখে আবার ফিরে যায় রেহবার। এই মুহূর্তে কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার সময় যে নেই। মায়ের বিরহে কিছুক্ষণ না হয় শোক পালন করুক।

বাড়ি ফিরতেই দিদার নিজেকে সামলে নিলো। বাড়ির বড় ছেলে সে। কতোক্ষণ আর নিজেকে শোকের আবহে ডুবিয়ে রাখবে? তার কাঁধে যে অনেক দায়িত্ব৷ বাকি কাজের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিলেও রেহবারকে ছাড়লো না। বাদ জুম্মা দাফনকার্য সম্পন্ন করে জিরানোর একটু সময় পেলো রেহবার। গুলিস্তার খোঁজ করতে করতে চলে এলো কোণের সেই ছোট্ট রুমটিতে৷ জানালার পাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই৷ মনের দুঃখ যায়নি। আশেপাশে তাকিয়ে আর কাউকে দেখতে পেলো না রেহবার। গুলিস্তার কাছে জানতে চাইলো,
– ফুল, বাচ্চারা কোথায়?

উত্তর দিতে পারলো না গুলিস্তা। সকালে তো এখানেই ছিলো। এরপর কখন কীভাবে ঘর ছেড়্র বেরিয়েছে গুলিস্তা দেখেনি। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো রেহবার। সদ্য মা হারিয়েছে মেয়েটা। মনের অবস্থা ঠিক নেই। যদিও নিজে মা হিসেবে সন্তানের দায়িত্ব পালনে ফির ব্যর্থ হয়েছে। নিজ দায়িত্বের অবহেলার খবর গুলিস্তা নিজেও বুঝতে পেয়েছে। রেহবারের দিকে তাকাতেই সে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো। নিজেকে শ খানেক বকা দিয়ে গুলিস্তা নিজেও ছুটে বেরিয়ে এলো। খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে পাওয়া গেলো রিনাত, নিনাতকে। মৃত ব্যক্তির বাড়িতে উনুন জ্বালানো হয় না। তাই এদিকটা একদম ফাঁকা। শর্মী পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছিলো ওদের৷ বাবাকে দেখে নিনাত হেঁটে এগিয়ে আসতেই চাইলো। দু পা এগোতেই রেহবার ছো মেরে মেয়েকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। পিছে পিছে পৌঁছে গেছে গুলিস্তা। মায়ের চিন্তিত মুখশ্রী দেখে রিনাত বললো,
– নিনাতের ক্ষুধা লেগেছিলো। কাঁদছিলো খুব। বড় মামী আমাদের এখানে নিয়ে এসে খাবার দিয়েছে।

রিনাতের হাতে এক ঝোপা আঙ্গুর। সেগুলোর চামড়া ছাড়িয়ে নিনাতকে খাওয়াচ্ছিলো। ছেলের দিকে তাকিয়ে রেহবার বললো,
– তুমি কিছু খেয়েছো?

রিনাত মাথা নাড়িয়ে না জানালো।
– এসো, আমি খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

ছেলে মেয়েকে সাথে নিয়ে রেহবার চলে গেলো। খেয়ে না খেয়ে অনিদ্রায় রাত কেটে গেছে। আকবর পরিবারে সদস্য সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। দিদারের দুই ছেলে এক মেয়ে, দানেশ ও দাউদের ঘরে একটি করে ছেলে ও মেয়ে। দিহান বিয়ে করেছে মাত্র দু বছর হলো। এখনো কোনো সন্তান নেই। সীমা বেগমের মৃত্যুর খবর শুনে উনার বাবার বাড়ি থেকে কিছু লোকজন এসেছে। সব মিলিয়ে বাড়িতে তখন প্রায় তিরিশ জনেক মানুষ। এতো সব মানুষের জন্য খাবার যোগাড় করা একটু মুশকিল বটে। তবুও আতেফ আকবর ও আদিল আকবরের বাড়ি থেকে যথেষ্ট খাবার এসেছে। ভাতের সাথে বুটের ডাল, মুরগীর সাথে আলুর ঝোল। তাই দিয়ে একটু করে ভাত মুখে দিয়েছে সবাই। বেঁচে তো থাকতে হবে।

একদিন না পেরোতেই ঝাঁকে ঝাঁকে পাড়া প্রতিবেশী আসতে লাগলো আকবর বাড়িতে৷ এদিকে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ব্যস্ত কেনাকাটায়। তৃতীয় দিন বেশ বড়সড় আয়োজন করে লোকজন খাওয়ানো হবে৷ তাই নিয়ে যতো ব্যস্ততা। শোক, দুঃখ ভুলে সকলে যোগাড়ে লেগে পরলো। হাতে হাত মিলিয়ে সবজি কাটা, পেয়াজের খোসা ছাড়ানো, মশলা বাটা, আদা পিষা। বাড়ির আঙ্গিনায় গোল হয়ে বসেছে মহিলাদের দল। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিয়ের আয়োজন চলছে।

এসবের মাঝে গুলিস্তা নেই। সে তার ঘরটিতে চুপচাপ শুয়ে ছিল। রেহবার বাইরে গরুর গোশত কা টায় সাহায্য করছে মনে হয়। রাতে ঘুমানোর আগে একগ্লাস দুধ খাওয়ার অভ্যাস রিনাতের। হঠাৎ মনে পরতেই গুলিস্তা বিছানা ছেড়ে উঠলো। তাতেই ঘুম ভেঙে গেলো নিনাতের। অচেনা পরিবেশে সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে আছে বাচ্চা দুটো। বাবা-মা ছাড়া এখানে সবাই অপরিচিত। এর মধ্যে এই কয়েকদিন বাবাকে একদম কাছে পায়নি। মায়ের সাথে তেমন সখ্যতা না থাকলেও এই মুহুর্তে, মা একমাত্র ভরসা। গুলিস্তার সাথে সাথে নিনাতও বিছানায় দাঁড়িয়ে পরলো। হাত বাড়িয়ে মায়ের কোলে আসতে চাইছে৷ বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়েই ঘর ছাড়তে হলো গুলিস্তাকে। বাবার কড়া আদেশ, মাকে যেনো কখনো একা না ছাড়ে রিনাত। সবসময় মায়ের সাথে সাথে থাকতে হবে। আর রিনাত তো বাবার বাধ্য ছেলে। ঘুমকে একপাশে রেখে সেও মায়ের পিছু নিলু।
রান্নাঘরের কোথায় দুধে পাতিল রাখা হয়, গুলিস্তা জানে। এতোদিনেও শর্মীর স্টাইলেই গোছানো রয়েছে রান্নাঘর। এক গ্লাস দুধ ঢেলে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘরেই ফিরছিলো ওরা। পেছন থেকে কয়েকজন মহিলা হৈ হৈ করে ডেকে উঠলো৷ এখানের কয়েকজন তো গুলিস্তাকে বিয়ের পর দেখেই নি। প্রায় সাত আট বছর পর দেখলো মেয়েটাকে। ওদের ডাকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো গুলিস্তা। এখনো এদের কথার ছু রিকে প্রচন্ড ভয় পায় সে৷ মানুষকে কথা দিয়েই ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র ভাবে না পাড়ার মহিলাগুলো। হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পরে একজন মানুষকে মুহুর্তেই ঝাঝড়া করে দেয়৷ পালা করে সবাই প্রশ্নজালে জড়িয়ে ফেললো গুলিস্তাকে।
কবে এসেছে, মায়ের সাথে দেখা হয়েছে কিনা, শ্বশুরবাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলো। মনের আয়েশ মিটিয়ে যাবতীয় প্রশ্ন করলো, স্বামীর সব খোঁজ খবর নিলো। গুলিস্তা মোটা হয়েছে, সুন্দর হয়েছে, বেশ সুখে আছে মনে হচ্ছে, পাক্কা গৃহিণী হয়েছে৷
এমন কতোশত কথা। সেই সাথে সস্তা রসিকতা করতেও ভুললো না।

– কেউ কি ভেবেছিলো, হু? পাড়ায় মুখ লুকিয়ে চলা মেয়েটা একদিন স্বামীর ঘর করবে, সংসার করবে! আমরা তো ভেবেছিলাম, স্বামী ছুঁতেই ভ্যা ভ্যা করে কান্নাকাটি করতে শুরু করবে বোকা মেয়েটা। আদর, সোহাগ করার আগেই ভয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়ি এসে উঠবে৷ এখন দেখো তো, বিয়ে করে দিব্যি সংসার করতেছে৷ হ্যাঁ রে গুলিস্তা, জামাই তোকে বশে আনলো কেমনে? মানুষের সামনে বের হতেই লজ্জা পেতি, সেখানে বেটা ছেলের সামনে সব খুলে..

পাশ থেকে আলিয়া প্রতিরোধ করলো।
– ভাবী, চুপ করো। বাচ্চাদের সামনে কীসব বলতেছো! দেখেশুনে কথা বলবা না!
– বাচ্চা! ওহ হ্যাঁ। এই দুইটা তোর নাকি?

গুলিস্তা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে এই প্রথম রিনাতের খুব অস্বস্তি হলো। এক ঝাঁক মহিলার শকুনি দৃষ্টি তার দিকে চেয়ে। মায়ের পেছনে লুকিয়ে আড়াল হতে চাইলো।

– দুই দুইটা বাচ্চাও পয়দা করে ফেলছিস! তুই তো খেল দেখিয়ে দিলি৷ ব্যাডা মানুষের তলে পরলে মাইয়া মানুষ এমনিতেই সোজা হয়ে শোয়৷
– আহা ভাবী! তুমি আবার শুরু করলা! তা গুলিস্তা, ছেলে তো মাশাআল্লাহ তোর মতোই সুন্দর হইছে। কিন্তু মেয়ের চেহারা তো সাথে মিলে নাই। জামাইয়ের সাথেও মিল নাই। তোরা দুজনেই ফর্সা মানুষ। মেয়ের গায়ের রংটা সামান্য ময়লা। কার মতো হইছে?

গুলিস্তার চোখে তখন উপচে পরা জল। কচু পাতায় যেমন পানি টলমল করে। একটু দোল খেলেই গড়িয়ে পরবে ভাব। নিনাতকে ধরে রাখা হাতটা ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে। নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখার খুব চেষ্টা করছে গুলিস্তা। মেয়েটা যেনো হাত ফসকে পরে না যায়। আল্লাহর কাছে বারবার শক্তি চাইছে। কিন্তু কোনোকিছুতেই কাজ হচ্ছে না।

– আমার মায়ের মতো হয়েছে।
পেছনে থেকে ভেসে আসা আওয়াজে উৎসুক মহিলাদের দলটি সেদিকে তাকালো। বাচ্চারা ঘুমিয়েছে কিনা খোঁজ নিতে এসেছিলো রেহবার। আঙ্গিনায় একদল মহিলার সামনে নিজের স্ত্রীকে কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামীর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহুর্তেই রাগ উঠে গিয়েছিলো৷ মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে ওদের কথাবার্তা শুনে। নেহাৎ আত্মীয়ের বাড়িতে কোনো ঝামেলা করতে চায় না রেহবার৷ দ্রুত পায়ে গুলিস্তার কাছে এসে একহাতে ওকে আগলে নিয়ে হাত রাখলো ওর কাঁধে৷ অন্য হাতে ছেলে হাঁটুর সাথে জড়িয়ে নিলো।

– আমার মেয়ের গায়ের রঙ ময়লা কিংবা কালো নয়। ছোট বাচ্চা সারাদিনে রোদে, ময়লাতে খেলাধুলা করে তাই এমন দেখাচ্ছে। সস্নেহে তাকালে বুঝতে পারতেন৷ তাছাড়া রঙ কালো হলেও সমস্যা ছিলো না৷ আল্লাহর সৃষ্টি ফর্সা হলেও সুন্দর, কালো হলেও। যাকে যা ভালোবেসে আল্লাহ দেন।

রেহবারের কন্ঠ ভীষণ শীতল, চোখ মুখ কঠিন। উপস্থিত মহিলারা হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে রেহবারের রাগের তীব্রতা। তাই তো কিছু বললো না।
গুলিস্তার দিকে তাকিয়ে রেহবার বললো,
– ঘরে চলো। নিনাতের ঘুমানোর সময় হয়েছে।

গুলিস্তা তার দমে যাওয়া কন্ঠে আওয়াজ সঞ্চার করে বললো,
– ওকে একটু ধরো। তোমার কোলে নেও।

নিনাতকে কোলে নিতেই রেহবারের শরীরে নিজের ভার ছেড়ে দিলো গুলিস্তা। হালকা দুলে উঠলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো রেহবার। তিনটে মানুষ ওর উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ভেঙে পরা দেখে মন খারাপের সাথে সাথে নিজেকে নিয়ে খানিকটা গর্বও হলো৷ একজন স্বামী হিসেবে, একজন বাবা হিসেবে আর কি চাই তার!

– রিলেক্স! ধীরে ধীরে শ্বাস নেও। সব ঠিক আছে। আমি এসে গেছি।
কানের কাছে রেহবারের ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলোয় গুলিস্তার হারিয়ে যাওয়া সাহস ধীরে ধীরে ফিরে এলো। ওরা রুমে যাওয়া অবধি মহিলাগুলো আর একটা কথাও বলেনি।শুধু ড্যাবড্যাব করে চেয়েছিলো। চোখের আড়াল হতেই আবার সমালোচনার ডালি নিয়ে বসলো।

রেহবার আর বেশিদিন বগুড়ায় থাকেনি। পরেরদিন দাওয়াত শেষ হতেই রাতের বেলা রওনা দিয়েছে সিলেটের উদ্দেশ্যে। সীমা বেগমের বিদায়ের সাথে সাথে বগুড়ার সমস্ত পিছুটান চুকেবুকে গেছে। আর কখনো ফেরা হয়নি ও ই শহরে৷

চলবে….

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
৫০

স্কুলে সবাই নিনাতকে রেহনুমা বলে ডাকে। বাবার নামের সাথে মিলিয়ে রাখা নাম দ্বারা পরিচিত হতে পছন্দ করে নিনাত নিজেও।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে প্রবেশ করেছে বেশিদিন হয়নি। এখনো ছোট বাচ্চার মতো মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়া করে রেহবার৷ যেদিন নিজে খুব ব্যস্ত থাকে সেদিন স্কুলের গেটে এসে হাজির হয় রিনাত৷ গেট পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই রিনাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মন ভুলানো হাসি দিলো নিনাত। বোনের মুখের এই হাসিটির জন্য শত কষ্ট উপেক্ষা করতে পারে রিনাত।
রিনাত এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। দুপুরবেলা কলেজ ছুটি হলে সোজা বাড়ি ফিরে যায়। মায়ের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। চারটায় নিনাতের স্কুল ছুটি হয়৷ বাড়ি থেকে রিক্সায় বিশ মিনিটের পথ। ঠিক সাড়ে তিনটায় আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে নিনাতের স্কুলের উদ্দেশ্যে।

দুই বেণী দুলিয়ে ভাইয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
– তুমি কেনো আসতে গেলে! আমি কি এখনো ছোট আছি?

বোনের হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রিনাত বললো,
– ছোটই তো। সাইজে আমার অর্ধেক৷

ভাইয়ের বুক সমান উচ্চতার কাছে বরাবর হেরে যায় নিনাত৷ মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকালো৷ রিনাত ততোক্ষণে রিক্সা দাঁড় করিয়েছে৷ দুজনে রিক্সায় উঠে হুড তুলে দিলো। বাইরে তখন ধীরে ধীরে রোদ নামতে শুরু করেছে৷

ব্যস্ত জীবনে অভ্যস্ত রেহবার। চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায়। রিনাত যখন ছোট ছিলো, ওকে পড়াতে বসাতো। এখন ছেলে বড় হয়েছে। নিজের পড়া নিজেই পড়ে৷ নিনাতকেও সাহায্য করার প্রয়োজন হয় না। কোথাও আটকে গেলে রিনাত দেখিয়ে দেয়। ঘরে একলা বসে মন টিকছিলো না রেহবারের। সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখলো ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে রিনাত ও নিনাত বই পড়ছে। আগে দুজনে রিনাতের ঘরে পড়তো। এক বছর হলো নিনাতের ঘর আলাদা হয়েছে। দু ভাইবোন দুই রুমে ঘুমালেও পড়তে বসে একসাথে। খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলা, টিভি দেখা, ঘুরতে যাওয়া সবকিছুতেই দুজনে একসাথে। নিনাত যতটা ভাই নেওটা, রিনাতও বোন বলতে পাগল। এখনো নিনাতের আঙ্গুল ধরে হাঁটে।

বাচ্চাদের পড়াশোনায় ডিস্টার্ব না করে রেহবার চলে গেলো কিচেনে। সন্ধ্যার নাস্তা তৈরী করছিলো গুলিস্তা। রেহবারকে কিচেনে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
– কিছু লাগবে?
– উহু।
– চা করে দিবো?
– ব্যস্ত হচ্ছো কেনো! ঘরে একলা বসে বিরক্ত লাগছিলো। এজন্য নিচে এলাম।
– ওহ।
– কি রাঁধছো?
– ফুলকপির পাকোড়া বানাচ্ছি।
– আমি হেল্প করি।
– লাগবে না।
– তোমার থেকে ভালো পাকোড়া ভাজতে পারবো। তুমি ভুলে গেছো, আমি রান্না জানি।
– বাচ্চারা দেখছে। কি ভাববে বলো তো! তুমি কিচেনে কেনো আসতে গেলে? ওদের পাশে গিয়ে বসো।
– ছেলেরা কিচেনে আসতে পারবে না কোথায় লেখা আছে? ওরা এই কারনে হাসছে না। অন্য কারনে হাসছে৷ ওসব বাদ দেও। আমি ভাবছি রিনাতকে রান্না শেখাবো।

গুলিস্তা আঁতকে উঠলো। তাকালো রেহবারের দিকে৷ সেসব পাত্তা না দিয়ে গুলিস্তার অপরপাশে গিয়ে চুলায় চায়ের পাতিল বসিয়ে দিলো৷ ক্যাবিনেট থেকে চা তৈরির উপাদান নামিয়ে দিলো গুলিস্তা৷
– তুমি এমন কিছু করবে না?
– অবশ্যই করবো। টুকটাক রান্না শিখে রাখা জরুরি৷
– হাত কেটে গেলে, জ্বলে পুড়ে গেলে?
– রান্না শিখতে গেলে একটু ছ্যাকা সবাই খায়৷ দু চারবার হাত কা টে।
– কী বলছো এসব!

লতায় পাতায় কথা বাড়তে থাকে। ওদিকে তাকিয়ে নিনাত বললো,
– মা ঠিকই কথা বলে। শুধু আমাদের সামনে এলে কেমন চুপচাপ থাকে। দেখো এখন কেমন কথা বলছে!

নিনাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে রিনাত তাকালো কিচেনের দিকে। মা কেমন রাগী চোখে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। আর বাবা? চায়ের পানিতে মনোযোগ দিয়ে চা পাতা দিচ্ছে। ঠোঁটে লুকানো দুষ্টু হাসি৷ নিনাতের মাথায় গাট্টা মেরে রিনাত বললো,
– ফাঁকিবাজ। পড়া বাদ দিয়ে কিচেনে উঁকি ঝুঁকি মারছিস।
– পড়তে পড়তেই দেখছিলাম। শুধু আমাদের সাথেই মা এমন করে। ঠিকঠাক কথা বলে না, আদর করে না। বাবার সাথে কথা বলে, হাসে, রাগ দেখায়, অভিমান করে।
– মায়ের কাছে বাবার জায়গাটা স্পেশাল। বাবাকে ভরসা করে, ভালোবাসে। তাই বাবার সামনে জড়তা কাজ করে না।
– তার মানে সে আমাদের ভালোবাসে না?
– অবশ্যই বাসে৷ কোন মা তার সন্তানকে ভালোবাসে না! শুধু মায়ের ভরসার জায়গাটা আমরা এখনো জিততে পারিনি। যেদিন পারবো সেদিন মায়ের সমস্ত জড়তা কেটে যাবে।

রিনাতের উত্তর পছন্দ না হলেও নিনাত কিছু বললো না৷ শুধু বিড়বিড় করে বললো,
– কোন মা তার সন্তানকে ভালোবাসে না জানি না৷ তবে আমার মা আমাকে ভালোবাসে না এটা আমি অবশ্যই জানি। আমরা বন্ধুরাও জানে। শুধু তুমি জানো না।

সকালবেলা রেহবারের রুটিন হচ্ছে, নিজে রেডি হয়ে মেয়ের অপেক্ষা করা। আজও অপেক্ষা করছিলো। নিনাত এলো হেলেদুলে । বাবার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনি এগিয়ে দিয়ে বললো,
– চুল বেঁধে দেও।
রেহবার মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় দুটো বেণী করে দিতে লাগলো। রেহবারকে এটা রোজ করতে হয়।

নাস্তার টেবিলে সকলে খাচ্ছিলো, তখনি রেহবার কথাটা বললো,
– রাহিল চাচ্ছিলো রিনাতকে ওখানে নিয়ে যেতে৷ ওখানের কলেজে পড়াশোনা করলে অনেকটা এগিয়ে থাকবে।

গুলিস্তার মনে হয় কেউ আত্মা ধরে টান মারলো। মুখের খাবার গিলতে ভুলতে গেছে। রেহবার জানতো এমন প্রতিক্রিয়া আসবে৷ তাই আগে থেকেই উত্তর প্রস্তুত করে রেখেছে।
– আমি কিছু বলিনি। রিনাত এখন বড় হয়েছে। ওর জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত ওকে নিতে দেওয়া উচিত, তাই না? আমাদের ইচ্ছে ওর উপর চাপিয়ে দিতে পারি না।

এতেই কাজ হলো। গুলিস্তা সারাক্ষণ তো এই ভয়টাই পায়। না জানি কোন কথাতে, কোন কাজে বাচ্চাদের মনে কষ্ট দিয়ে ফেলে৷ ওদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, বিকাশে বিঘ্ন ঘটায়। তবে মায়ের মন ছেলের জন্য তো কাঁদবে। তাও আবার প্রথম সন্তান। গুলিস্তার তিতান। তাকে ছাড়া গুলিস্তা কীভাবে থাকবে!
রিনাত জানে, মা ওকে কতোটা চোখে হারায়। স্কুল থেকে ফিরতে দেরী হলে পথের দিলে চেয়ে থাকে৷ দুপুরবেলা রিনাত না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। একসাথে খাবে বলে৷ এসব কথা কখনো অবশ্য মুখ ফুটে বলেনি। রিনাত নিজে লক্ষ্য করেছে। যেমন ভাবে এই মুহুর্তে লক্ষ্য করলো মায়ের কাঁপতে থাকা চোখের পাতা ও থমকে যাওয়া হাত।

– দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই৷ তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না। চেষ্টা করলে দেশে থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়।

রিনাতের উত্তরে গুলিস্তার আটকে থাকা শ্বাস আবার স্বাভাবিক হলো। ওদিকে নিনাত মুখ কুচকে আফসোসের সুরে বললো,
– এতো বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করছো, ভাই! আমি হলে একলাফে রাজি হয়ে যেতাম।
– তোর সময় আসুক তখন দেখা যাবে৷
– আমি যাবোই৷

লাঞ্চের জন্য টিফিনবক্স হাতে নিয়ে আরেকদফা চোখ মুখ কুচকে গেলো নিনাতের। তারপর বাবা ও ভাইয়ের সাথে স্কুলের দিকে রওনা দিলো।

টিফিন পিরিয়ডে আজকে আবার নিনাতের খাবারের বাটির দিকে তাকিয়ে সবাই হেসে উঠলো। রোজ একই খাবার নিয়ে আসে নিনাত। ভাত, তরকারি, সালাদ। সেই ব্যাকডেটেড খাবার। আজকাল এসব কে খায় স্কুলের টিফিনে!
বিশাল বড় ক্যান্টিনের একটি টেবিলে দশজন ক্ষুদে শিক্ষার্থী একসাথে বসেছে খাবার খেতে৷ নিনাতের ঠিক অপরপাশে বসে থাকা তূর্য বললো,
– তোর মা আর কিছু রাঁধতে পারে না? ঝোলে ভরা তরকারি আর সাদা ভাত। এসব কে দেয়! ক্ষ্যাত টাইপের চয়েজ। আমার মা কিন্তু এসব ব্যাপারে ভীষণ পারদর্শী। একেকদিন একেক আইটেম প্যাক করে দিয়ে আমাকে চমকে দেয়। কি দিয়েছো, জিজ্ঞাসা করলে বলে, সিক্রেট কিছু৷ লাঞ্চ আওয়ারে সারপ্রাইজড হয়ে যাবে৷ সত্যি আমি সারপ্রাইজড হয়ে যাই। ফ্রাইড রাইস, প্যানকেক, স্যান্ডউইচ, ফ্রুটস সালাদ এমন কতো খাবার যে টিফিনে দেয়! কতোগুলোর তো নামই জানি না আমি৷ আমাকে কিছু বলতে হয় না। আমি কি চাই মা বুঝে যায়।

পাশ থেকে জেমি ফোড়ন কাটলো,
– মম বলেছে রেহনুমার মম একদম গোবেচারা টাইপের মানুষ। একবার পার্কে দেখেছিলো উনাকে৷ ওর বাবা নাকি ভীষণ স্মার্ট। মম বলেছে, ওমন স্মার্ট পুরুষের পাশে ওমন আনকালচার মহিলাকে একদম মানায় না। কেমন ভীত, তটস্থ হয়ে চলাচল করে। দেখে একদম স্বাভাবিক মনে হয় না৷ আচ্ছা রেহনুমা, তোমার মায়ের কি সত্যি সমস্যা আছে? আমরা কখনো উনাকে দেখিনি। তুমি নিয়ে আসো না কেনো?

গাল ফুলিয়ে নিনাত ওরফে রেহনুমা জবাব দিলো,
– কোনো সমস্যা নেই। কী ধরনের সমস্যার কথা বলছো তোমরা?

ওপাশ থেকে উৎস বললো,
– তোমার মা, প্যারেন্টস মিটিং এ আসে না। তোমাকে কখনো পিক করতে আসতে দেখিনি। সবসময় তোমার বাবা আসে। স্কুলের প্রথমদিন আমার বাড়ির সকলে এসেছিলো আমাকে গুড লাক উইশ করতে। তোমার সাথে কেউ আসেনি?
– এসেছে তো। বাবা আর ভাই এসেছিলো।
– সেই তো। ওর মা কিন্তু আসেনি। আমি বলছি শোনো, ওর মায়ের কোনো সমস্যা আছে। এই উনি তোর আসল মা তো? নদীর ধারে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে নাকি? দিদি আমাকে প্রায় বলে আমাকে নাকি বাবা মা নদীর ঘাটে কুড়িয়ে পেয়েছে৷

তূর্যের কথায় সকলে হেসে উঠলো৷ নিনাতের বাটি সরিয়ে রেখে সবাই নিজের কিছুটা খাবার অফার করলো ওকে। চুপচাপ সেগুলো খেয়ে নিলেও নিনাতের মাথার মধ্যে লাভা ফুলেফেঁপে উঠে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

চাপিয়ে রাখা লাভা হড়বড়িয়ে বেড়িয়ে এলো বাড়ি ফিরতেই। সোফার উপর স্কুল ব্যাগ রেখে ডাইনিং টেবিলের উপর ঠাস করে টিফিনবক্সটি রাখলো নিনাত৷ রিনাত ততোক্ষণে নিজের ঘরে চলে গিয়েছে। বাইরে থেকে এসে গোসল না করলে ওর ভালো লাগে না। কিচেনে কিছু একটা করছিলো গুলিস্তা। ডাইনিং থেকে জোরালো শব্দ পেতেই এগিয়ে গেলো। কোমড়ে দিয়ে রাগে ফুঁসছে নিনাত। গুলিস্তা কিছু বললো না। ধোয়ার জন্য বক্সটি হাতে নিয়ে বুঝলো খাবার সবটাই রয়ে গেছে। তবুও কোনো রা করলো না। চুপচাপ কিচেনে চলে গেলো। তাতেই যেনো আরও ক্ষেপে গেলো নিনাত৷ কিচেনে গিয়ে মায়ের হাত থেকে বক্সটি নিয়ে কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে উঠলো,
– কি দিয়েছো এগুলো তুমি? টিফিনে ডাল ভাত কে খায়? এমন আলকালচার, ব্যাকডেটেড কেনো তুমি?

মেয়ের অভিযোগ শুনে মাথার ভেতর দুলে উঠলো গুলিস্তার। কর্কশ কন্ঠে বুকের ভেতরটা ভেঙে চূড়ে গেলো। উঁচু কন্ঠস্বর গুলিস্তাকে আঁধারের দিকে টেনে নিয়ে যায়। হতভম্ব হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।
– কথা বলছো না কেনো? সবসময় এমনভাবে এড়িয়ে যাও, যেনো আমরা দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয়। তোমার বাড়িতে থাকতে এসেছি৷

গুলিস্তার বোধহয় হাটু কাঁপছে৷ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একরত্তি মেয়েটাকে অচেনা কোনো দানব ভ্রম হচ্ছে। অনেক কষ্টে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারলো শুধু।
– তাহলে কি দিবো লাঞ্চে?
– বাচ্চাকে লাঞ্চে কি দিবে সেটাও তুমি জানো না। আমার পছন্দের খাবার কোনটা সেটাও নিশ্চয়ই বলতে পারবে না। প্রতিদিন লাঞ্চবক্সের অর্ধেক খাবার ওভাবেই ফিরে আসে সেটাও তুমি খেয়াল করোনি। কখনো জানতে চেয়েছো, আমি লাঞ্চ শেষ করিনি কেনো? আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা? কি লাঞ্চ দিবে বুঝতে পারছো না, তাহলে আমার থেকে জেনে নিতে। একবার জিজ্ঞাসা করতে, নিনাত তুমি কি খেতে চাও? লাঞ্চে কি নিয়ে যাবে? কিন্তু না, সে প্রশ্ন তুমি করবে না৷ প্রশ্ন কীভাবে করবে! তুমি তো আমাদের সাথে কথাই বলো না। তোমার জন্য আমাকে কতোটা সাফার করতে হচ্ছে, তুমি জানো?

গুলিস্তা আসলে জানে না। মেয়ে হঠাৎ এভাবে রেগেমেগে চিল্লাচিল্লি কেনো করছে গুলিস্তা বুঝতে পারছে না৷ রেহবার আসলে জিজ্ঞাসা কর‍তে হবে। মেয়েকে কি কেউ কিছু বলেছে? গুলিস্তাকে নীরব, নিশ্চল চেয়ে থাকতে দেখে নিনাতের ইচ্ছে হলো নিজের মাথাটা নিজেই দেয়ালে ঠুকে দিতে। ঠাস করে বক্সটি রাখলো বেসিনের উপর৷ রাগে দুঃখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।

– লোকে কতো লেইম কথাবার্তা বলে তোমাকে নিয়ে৷ তুমি আমার স্কুলে যাও না, প্যারেন্টস মিটিং এটেন্ট করো না। আমাদের সাথে ঘুরতে যাও না। আমার ফ্রেন্ডদের সাথে কখনো দেখা করোনি, কথা বলোনি৷ সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে নিজের মতো করে থাকো৷ কিন্তু আমাদের বাইরে বের হতে হয়। তোমার জন্য আমাদের লোকের কথা শুনতে হয়, অপদস্ত হতে হয়, ছোট হতে হয়।
আমার বাবাকে কথা শুনতে হয়৷ বাবার জন্য লোকে দুঃখ করে৷ আহারে! স্মার্ট মানুষটার ভাগ্যে কেমন ভ্যাবলা একটা বউ জুটেছে৷ আমাকে স্কুলে হাসির পাত্র হতে হয়৷ কোন জগতে থাকো তুমি? বাচ্চাদের নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা নেই। কেমন মা তুমি? বাচ্চাকে রেডি করে দেওয়া, চুল বেধে দেওয়া, খাইতে দেওয়া, ঘুম পাড়ানো এসব কার কাজ? অবশ্যই মায়ের। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বাবা করেছে৷ রোজ স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, পড়াশোনা করানো সবকিছু বাবা করেছে৷ তুমি কি করেছো? শুধু জন্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ। এছাড়া কোন দায়িত্বটা পালন করেছো তুমি? কখনো কাছে টেনে নিয়েছো? আদর করেছো কিংবা পাশে এসে বসেছো? কিছু করো না তুমি। কিচ্ছু না৷ তুমি আস্ত একটা হোপলেস পারসোন। তুমি মা হিসাবে ভীষণ বাজে। একজন মানুষ হিসেবে তো একদম শূন্যের ঘরে তোমার অবস্থান।

গুলিস্তা এমনিতেই কথা খুঁজে পায় না৷ বাচ্চাদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় কে জানে! ওসব রেহবার ভালো পারে। দুটো কথা বলতেই ছেলেমেয়ের মুখে হাসি ফুটে৷ আনন্দ উপচে পরে। সে দৃশ্য দূর থেকে মন ভরে দেখে গুলিস্তা৷ এই যে এখন এমন অস্থির হয়ে আছে, কেঁদেকেঁটে একাকার অবস্থা। চিৎকার করে গলার স্বর বসিয়ে ফেলেছে। গুলিস্তা বুঝতে পারছে না কি বলে সান্ত্বনা দিবে, কি করে মেয়েকে থামাবে! মস্তিষ্ক ব্লাংক হয়ে গিয়েছে৷
এতো এতো অভিযোগের বিপরীতে কোনো উত্তর না পেয়ে নিনাত ধৈর্য্যহারা হলো। হাতের কাছে চামচের ঝুড়ি ছিলো। সেটা হাত দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো ফ্লোরে। মুহুর্তেই ঝনঝন শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার দশা৷ গুলিস্তা আঁতকে উঠে দু পা পিছিয়ে গেলো। নিনাত আরো দু কদম এগিয়ে এসে শাসিয়ে উঠলো,
– কিছু বলছো না কেনো? একদম চুপ করে থাকবে না তুমি। কথা বলো। কিছু একটা ব..

– নিনাত, কী হচ্ছে এসব!
রিনাতের রাগী কন্ঠস্বরে থমকে গেলো নিনাত।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ড্রয়িং রুম থেকে শব্দ কানে এলো। বাতাসে ভেসে আসা কিছু আবছা শব্দ। তবে কেউ চিৎকার করছে এটা স্পষ্ট। খানিক অবাক হলো রিনাত৷ এ বাড়িতে উঁচু স্বরে কথা বলা বারণ। বাবাকেও কখনো গলার স্বর উঁচু করতে দেখেনি সে। একদিন বাবা বলেছিলো, জোরালো শব্দে মাম্মাম ভয় পায়। প্যানিক করে৷ দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই স্পষ্ট হলো নিনাতের কন্ঠস্বর। যা অবাক করে দিয়েছিলো রিনাতকে। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো ছোট্ট নিনাতের রুদ্ররূপ। প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুলে গিয়েছিলো রিনাত৷ এরপর ফ্লোরে স্টিলের চামচগুলো ঝনঝন করে শব্দ সৃষ্টি করলো। ঘোর কাটলো রিনাতের। রাগে নিজের কন্ঠও উঁচু করতে বাধ্য হলো।
– কী ধরনের আচরণ এটা? কোথায় শিখেছো এসব? মাম্মামকে স্যরি বলো।
– কিন্তু ভাই?

রিনাতের উপস্থিতির কথা ভুলেই গিয়েছিলো নিনাত। মায়ের অন্তঃপ্রাণ একনিষ্ট ভক্ত। তার থেকে এমন প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিলো। নিনাতের যন্ত্রণা সে নিশ্চয়ই বুঝবে না। রাগের চেয়েও ভাইয়ের প্রতি অভিমান গাঢ় হলো।
– স্যরি বলো এক্ষুনি।
– আমি ভুল কিছু বলিনি। শী ডাজেন্ট কেয়ার ফর আস। শী ডোন্ট লাভ আস। স্বার্থপর, ভীষণ স্বার্থপর একটা মানুষ।

সবকিছু বিরক্ত লাগছে নিনাতের। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণ প্রিয় ভাইকেও। মায়ের দোষত্রুটি বাদ দিয়ে শুধু তাকেই ধমকে যাচ্ছে। সে ভুল কি বলেছে? কোন অভিযোগটা মিথ্যে? সেসব বিবেচনা না করে এক মুহুর্তেই নিনাতকে পর করে দিলো। তুই থেকে তুমি হয়ে গেলো নিনাত। সব ছেড়েছুড়ে দৌড়ে নিচের ঘরে চলে গেলো নিনাত। বন্ধ হলো ঘরের দরজা।

শেষ বিকালের দিকে অফিস ছুটি হওয়ার আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা তখনি ফোন এলো রেহবারের ফোনে।
– বাবা, একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবে?

রিনাতের কথায় রেহবারের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। এমন আবদার আগে কখনো করেনি রিনাত।
– আসছি। কোনো সমস্যা হয়েছে? বাবাকে বলো।
– উহু। তেমন সিরিয়াস ইস্যু না। তুমি ধীরে সুস্থে এসো।

নিনাত সেই যে দরজা বন্ধ করেছে আর খুলছে না। বার কয়েক ডেকে ফিরে এসেছে রিনাত। এদিকে বেডরুমের সেই ব্যালকনিতে বসে হাঁটুতে মুখ গুজে নিঃশব্দে কাঁদছে গুলিস্তা। শুধু কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীরটা। একজন হেরে যাওয়া মানুষের আর কিইবা করার থাকে। জীবনটা এতো কঠিন কেনো এটাই ভাবছে৷
রিনাত ধীরপায়ে এসে মায়ের কাছে বসলো। মাথা ঠেকালো মায়ের হাঁটুতে৷ ফিসফিসিয়ে বললো,
– তোমার তিতান তোমাকে খুব ভালোবাসে । আর তিতান এটাও জানে মাম্মামও তিতানকে খুব ভালোবাসে। শুধু প্রকাশ করে না। তিতান চালাক, তাই বুঝতে পারে। নিনাত এখনো ছোটো আর ভীষণ বোকা। ওর মাথায় গোবর ভরা৷ তাই ও বুঝতে পারে না। আরেকটু বড় হতে দাও, ও নিজেই বুঝে যাবে।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো দুজনে৷ একসময় হেরে যাওয়া কন্ঠস্বরটি জানতে চাইলো,
– তিতান, মা হিসেবে আমি কি খুব খারাপ?

ছেলেদের নাকি কাঁঁদতে নেই? খুব কষ্ট পেলেও নাকি ওরা কাঁদতে পারে না? রিনাত অবশ্য সেসব জানে না। বুঝ হওয়ার পর থেকে স্মৃতি হাতড়ে খুব কষ্ট পাওয়ার কোনো স্মৃতি ওর নেই। কিন্তু আজ মায়ের মুখে প্রিয় নামটি প্রকাশ্যে শোনার খুশিতে নাকি মায়ের হেরে যাওয়া প্রতিবিম্বের সাক্ষী হয়ে রিনাতের দু চোখ পেয়ে জল গড়িয়ে পরলো। দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বললো,
– উহু, তিতানের কাছে তুমি সেরা মা৷
– ও আমাকে বাজে বলেছে, হোপলেস, শুণ্য মানুষ বলেছে। আমার জন্য তোদের ছোট হতে হয়। লোকের কথা শুনতে হয়। মানুষ হাসি তামাশা করে। ছিঃ কি বিশ্রী!

দু হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে ফেললো গুলিস্তা৷ কান্না চেপে রাখতে গিয়ে রিনাতের গলায় অসম্ভব ব্যথা হচ্ছে। ঢোক গিলতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে৷ মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷ গুলিস্তা ওভাবেই বসে কাঁদতে থাকলো। প্রতিটি কান্নার শব্দ রিনাতের বুক চিরে ঝাঁজরা করে দিচ্ছে।
তবুও কোনো রকমে অস্ফুট স্বরে অনুরোধ করলো,
– মাম্মাম, ও মাম্মাম। এভাবে কেঁদো না৷ নিনাতের হয়ে আমি স্যরি বলছি। ও যা বলেছে রাগের মাথায় বলেছে। একটা কোথাও সত্যি নয়৷ তুমি বুঝতে পারছো? এসব মিথ্যে। আমি তোমাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব করি৷ বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসে।

ঘরে প্রবেশ করতেই কান্নার শব্দ পেয়েছে রেহবার। এক প্রকার ছুটেই এলো ব্যালকনিতে। ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বিধস্ত হয়ে বসে আছে গুলিস্তা। কতো বছর পর মেয়েটাকে এভাবে কাঁদছে? শেষবার কেঁদেছিলো মায়ের মৃত্যুতে। তাও এতোটাও ভেঙে চূড়ে যায়নি তখন। অশান্ত গুলিস্তাকে শান্ত করতে বুকে জড়িয়ে আগলে ধরেছে রিনাত। ছেলে কি খুব বড় হয়েছে ? এ বছর মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। ছোটই তো। ওইটুকুনি ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে কি কারনে এভাবে চোখের জল ফেলছে? জন্মের পর থেকে যাকে বুকে আগলে বড় করেছে, সামান্য আঘাত পেতে দেয়নি সেই কলিজার টুকরো ছেলেকে কাঁদতে দেখছে রেহবার। জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মুহুর্তটির সাক্ষী হতে হলো এই বয়সে এসে। বুকের ভেতর হাড়গুলো মনে হয় ভাঙলো। তা না হলে এতো যন্ত্রণা হবে কেনো।

আতংক একপাশে সরিয়ে রেখে রেহবারও যোগ দিলে মা ছেলের দলে। ছেলের পিঠে হাত ছোঁয়াতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ওই ডাগরডোগর চোখে মুক্তোর দানার মতো অশ্রু। কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য!
– কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?

রিনাত কিছু বললো না৷ নাক টেনে, চোখ মুছে কান্নামিশ্রিত স্বরে বললো,
– মাম্মাম কাঁদছে।

দু হাত দিয়ে পরম যত্নে ছেলের চোখের জল মুছিয়ে দিলো রেহবার।
– বাবা দেখছি, কান্না বন্ধ করো। তুমি নিজের ঘরে যাও। আমি আছি এখানে।

রিনাত চলে যেতেই রেহবার আসন পেতে বসলো। গুলিস্তার নিচু করে রাখা মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো,
– ফুল। আমার দিকে তাকাও। কাঁদছো কেনো? তাকাও না প্লিজ।

গুলিস্তা মাথা তুলছে না দেখে সামান্য জোর খাটিয়ে মাথা উঁচু করালো। কেঁদেকেঁটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। চোখের ভাষায় হতাশা। সব হারিয়ে ফেলার চিহ্ন। সেই সাথে নিজের ধ্বংসের ছাপ। গুলিস্তার এমন রুপ বহু বছর আগে একটু একটু করে পিছনে ফেলে এসেছে ওরা। তাহলে এতোদিন পর কোথা থেকে এলো? কীভাবে এলো? রেহবার বেশ ভয় পেলো। কিছু বলার মতো সাহস হারিয়ে গেছে ওই চোখে চেয়ে। তাই নীরবে কাছে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। গুলিস্তা প্রতিবাদ করলো না, জড়িয়েও ধরলো না। পুতুলের মতো রেহবারের বুকে নিস্তেজ হয়ে পরে রইলো। কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে গেছে। খানিক পরে বিড়বিড় করলো,
– স্মার্ট লোকের ভ্যাবলা বউ।

রেহবার শুনলো কিন্তু কিছু বুঝলো না। প্রশ্নার্ত্মক দৃষ্টি মেলে তাকালো গুলিস্তার দিকে। গুলিস্তার মুখে ক্লেশমাখা সামান্য হাসি। অনুসন্ধানী দৃষ্টি রেহবারের মুখের দিকেই। সামান্য অপ্রস্তুত হলো রেহবার।
– কি বলছো বুঝতে পারছি না। কার ভ্যাবলা বউ?

ওভাবেই বুকের উপর মাথা রেখে এক হাত উচু করে তর্জনী নির্দেশ করলো রেহবারের দিকে।
– স্মার্ট লোক

তারপর নিজের দিকে আঙ্গুল ঘুরালো। সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে বললো,
– ভ্যাবলা বউ।

রেহবার অপ্রস্তুত মুখে সামান্য হাসি টেনে বললো,
– কীসব বাজে কথা! কে বলে এসব? আমার সুন্দরী, গুণবতী বউ। ভীষণ আদরের, ভালোবাসার বউ।
– মিথ্যে কথা। তুমি আমাকে সবসময় মিথ্যে বলেছো, ধোঁকা দিয়েছে। লোকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তোমার পাশে আমাকে মানায় না। কোথায় তুমি আর কোথায় আমি! তোমার ভীষণ আফসোস হয়। ভ্যাবলা, বোকা বউ নিয়ে সংসার করতে হচ্ছে। আমি অনেক অনেক রান্না পারি না, তোমার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না, বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে পারি না, তোমার যত্ন নিতে পারি না। আমি কিচ্ছু পারি না। তুমি বলো, স্বীকার করো।

রেহবার অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে নতুন গুলিস্তাকে। ভেঙে চূরে যাওয়া একটা মানুষ। হীনমন্যতায় আপাদ মস্তষ্ক ডুবে আছে। কোথাও কি একটু ক্ষীণ আশা অবশিষ্ট আছে? গভীর চোখে গুলিস্তার চোখে মুখে অনুসন্ধান চালাচ্ছে রেহবার। ওভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকতে দেখে গুলিস্তার ভীষণ দুর্বল হাতটি রেহবারের শার্টের কলার আকড়ে ধরলো।
– বলো, সত্যটা স্বীকার করো। আর কোনো মিথ্যে বলবে না তুমি।

ধ্যান ভাঙ্গলো রেহবারের। গুলিস্তার চোখ গড়িয়েছে নতুন জলের ধারা। রেহবার তা সযত্নে মুছে দিলো।
– কে বলে এসব বাজে কথা? তোমার মাথায় এসব কীভাবে এল? কে ঢুকালো?

গুলিস্তা উত্তর দেয় না। রেহবারের চোখে কিছু খুঁজতে থাকে৷
তারপর? তারপর মাথাটা আরেকটু ভালোভাবে রেহবারের বুকের উপর এলিয়ে দিয়ে দেহের ভার ছেড়ে দেয়। চোখ দুটো বুজে বলে,
– আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে রেহবার৷ আমি এমন কেনো বলো তো? আমি কেনো সবার মতো স্বাভাবিক হতে পারি না? বিশ্বাস করো, আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। অস্বস্তি হয়, ভয় করে। আমার জন্য সবাইকে ভুগতে হয়। এতোদিন তুমি ভুগেছো, এখন আমাদের সন্তানেরা ভুগছে। এসব আমি আর নিতে পারছি না। আমার কিছু ভালো লাগছে না৷ একটু স্বস্তি চাই৷ মুক্তি চাই৷ খোদা আমাকে উনার নিকট একটু আশ্রয় দিক৷ যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যেতে চাই৷ বেঁচে থাকার আর একটুও ইচ্ছে নেই আমার। এক জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি। আর আমার আর কিছু পাওয়ার বাকি নেই৷ এই যন্ত্রণা থেকে নিজেও মুক্তি পেতে চাই সাথে তোমাদেরও।

চলবে…