হে সখা পর্ব-৫৩ এবং শেষ পর্ব

0
186

#হে_সখা
অক্ষরময়ী
অন্তিম পর্ব

দুঃশ্চিন্তায় রিনাতের মাথার ভেতর তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে বসে হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। তবুও চোখ মুখ স্বাভাবিক করে বসে আছে ব্যালকনিতে। গুলিস্তা পানি দিচ্ছিলো মানিপ্লান্টের গাছে। সেও স্বাভাবিক। আজ অনেকক্ষণ সময় ব্যয় করছে পানি দেওয়ার কাজে। গাছে পানি দেওয়া তো বাহানা মাত্র। সে দৃষ্টি রাখছে সদর দরজায়।
রিনাতের দৃষ্টি ঘড়ির কাটায়, গুলিস্তার সূর্যের দিকে। সূর্য নিজের জায়গা থেকে আরেকটু খানি পশ্চিমের দিকে হেলতেই গুলিস্তা ফিরে এসে টি টেবিলের উপর থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিলো। কল করলো রেহবারের ফোনে। ওপাশে রিসিভ হওয়া মাত্রই যান্ত্রিক স্বরে বললো,
– তোমার মেয়ে এখনো বাড়ি ফিরে নি। খুঁজে নিয়ে এসো।

রিনাত চমকে পেছনে তাকালো। মা টের পেলো কীভাবে? ওর চোখে মুখে কি দুঃশ্চিন্তার ছাপ বুঝা যাচ্ছে? রেহবার কিছু বলার আগেই গুলিস্তা ফোন কেটে দিয়ে আবার নিজের কাজে ফিরে গেলো।
লুকানোর আর কিছু বাকি নেই। মা যেহেতু জেনেই গেছে তাই রিনাত আর বসে রইলো না। একেরপর এক কল করতে থাকলো রিনাতের ফোনে৷ বিকাল পাঁচটা পেরিয়ে সাড়ে পাঁচটা বাজতে চললো এখনো ঘরে ফিরেনি নিনাত। বাড়ি ফিরতে আধা ঘন্টার বেশি কখনোই লাগে না।
সময় গড়াতে লাগলো সেই সাথে বাড়লো রিনাতের অস্থিরতা।

– মাম্মাম, আমি না হয় একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে আসি।

ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে জানাল রিনাত। অনেকদিন পর ঘর ছেড়ে ছেলের পিছু পিছু এলো গুলিস্তা৷ সিড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে ছেলেকে এগিয়ে যেতে দেখছে৷ কানে ফোন চেপে ধরে ড্রয়িংরুম পার হতেই রিনাতের পা থমকে গেলো। দ্রুত পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো নিনাত৷ ভালো করে লক্ষ্য করে নিশ্চিত হলো সবকিছু স্বাভাবিক এবং নিনাত একদম সুস্থ৷ প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো রিনাতের। কোনো বিপদ আপদ আলহামদুলিল্লাহ ঘটেনি। তাহলে দেরী হলো কেনো?

– তোর কোনো ধারণা আছে, বাড়িতে মানুষগুলো কতোটা টেনশন করছে? এতোক্ষণ দেরী হলো কেনো? কোথায় গিয়েছিলি? বড্ড সাহস হয়েছে আজকাল। কতোক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছিলাম৷ ফোন কোথায় তোর?

স্কুল শেষে ফোনটা আর সাইলেন্ট মুড থেকে নরমাল মুডে করা হয়নি। প্রতিদিন স্কুলে প্রবেশ করে ফোন সাইলেন্ট করে রাখে আবার বের হয়ে রিক্সায় বসে নরমাল মুডে ব্যাক করে। আজকে যেহেতু রিক্সায় বসা হয়নি৷ ওর দেরি হচ্ছে দেখে বাড়ির লোকেরা টেনশন করছিলো নাকি? নিনাত মাথা উঁচু করে সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা গুলিস্তাকে দেখলো৷ দেবীর দর্শন হলো যে! সেও কি চিন্তা করছিলো! না হলে আজ ঘর ছেড়ে বের হলো কেনো! অথচ চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখে তাকিয়ে আছে। যেনো কিছুই হয়নি৷
চোখে চোখ পরতেই গুলিস্তা নিজের ঘরের দিকে ফিরে যেতে লাগলো। রিনাতের প্রশ্নের উত্তর দিলো না নিনাত। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সিড়ির দিকে৷
– প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না কেনো? ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস? নিনাত, এ কেমন বেয়াদবি! এই মায়ের ঘরে কেনো যাচ্ছিস তুই?

ততোক্ষণে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেছে নিনাত৷ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই যাচ্ছিলো গুলিস্তা৷ এরমধ্যে দস্যুর মতো হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করে দরজা লক করে দিলো নিনাত৷ হতভম্ব গুলিস্তা প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুলে গেলো। নিনাত হাঁপাচ্ছে। দৌড়ে সিড়ি পেরিয়েছে। ওদিকে দরজার বাইরে রিনাতের চিৎকার ভেসে আসছে,
– দরজা খোল নিনাত। এই দরজা লক করেছিস কেনো?মায়ের সাথে তোর কীসের কথা? আবার যদি কোনো কান্ড ঘটিয়েছিস, তবে খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। ভাই প্রচন্ড রাগ করবো বলে দিচ্ছি। দরজা খোল।

নিনাত বাঁকা হাসলো। সবাই কতোটা চিন্তা করে এই মানুষটাকে নিয়ে। এই মুহুর্তে সবাই নিনাতকে ভয় পাচ্ছে। তাদের ভালোবাসার জায়গা, তাদের দূর্বল জায়গায় নিনাত আবার আঘাত করে না বসে।

– তুমি আমার জন্য টেনশন করছিলে নাকি?

তাচ্ছিল্যের সুরে জানতে চাইলো নিনাত। যেনো সে জানে, গুলিস্তা তার পরোয়া করে না।

– হাহ! তুমি আমার জন্য চিন্তা করবে কেনো? তুমি থাকো নিজের জগতে। নিজের যা ইচ্ছে হয় তাই করো। কেউ তোমাকে কোনো প্রশ্ন করে না। সব মেনে নেয়। প্রচন্ড ভালোবাসে যে তোমাকে।

ঝাঁজালো কন্ঠে কথাগুলো বললেও নিনাতের গলা কাঁপছে। একটি ভ্রু কি সামান্য উচু করলো গুলিস্তা? করেছেই তো। মেয়ের কন্ঠের পরিবর্তন টের পেয়েছে। দরজার সামনে থেকে সরে বিছানার দিকে গেলো।
– এই, এই কোথায় যাচ্ছো তুমি? তোমার সাথে আমার কথা আছে। প্রশ্ন আছে। সেগুলোর উত্তর দিবে তুমি?

নিনাতের তেজী কন্ঠের বিপরীতে গুলিস্তা কিছু বললো না। বিছানার একপাশে পা ঝুলিয়ে বসলো। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
– এখানে এসে বসো।

নিনাত এগিয়ে গেলো তবে বসলো না। ঘাড়ের ব্যাগটা ছুড়ে মারলো বিছানায়। পিঠ ব্যথা ধরে গেছে৷ টেবিলের উপরে থাকা গ্লাসটা নিয়ে পানি খেলো। ঘরময় পায়েচারি করে বলতে লাগলো,
– আমার কি মনে হয় জানো, তুমি সবার কেয়ার করো, ভালোবাসো। শুধু আমাকে ছাড়া। বাবার সাথে তুমি একদম সহজ, স্বাভাবিক। ভাইও মা বলতে পাগল। বাদ পরে গেলাম শুধু আমি। বাবা বলে তুমি সহজে কারো সাথে মিশতে পারো না৷ আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করার ভয়ে আমাদের থেকে দূরে থাকো। কিন্তু, কিন্তু, আমি জানি এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে৷ তুমি আমার সাথে সহজ হতে চাও-ই না। আমাকে ভালোই বাসোনা। বাসবেই বা কেনো! আমি তোমার নিজের মেয়ে হলে না বাসতে।

কাছে কোথাও বুঝি বজ্রপাত ঘটলো৷ এমনটাই মনে হলো গুলিস্তার। অবাক চোখে তাকালো নিনাতের দিকে। নিনাতের চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে। অথচ সেই ব্যাপারে নিনাত নির্বিকার। তীব্র ক্ষোভ চোখে, মুখে। অস্থিরভাবে এপাশ থেকে ওপাশে হাঁটছে৷ গুলিস্তার ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিতে৷ ছোটবেলায় সবাই ঘুমালে রাতে চুপিচুপি যেভাবে বুকে জড়িয়ে রাখতো। সেসব করা হলো না৷ উত্তরের অপেক্ষায় নিনাত চেয়ে আছে৷ কিছু বলা দরকার। কিন্তু এমন মুহুর্তে মানুষকে কীভাবে সান্ত্বনা দিতে হয়?

– বাজে কথা।

মায়ের কথায় স্বল্প কথায় নিনাতের মন ভরলো না। মায়ের বুকটা যে এই মুহূর্তে খুব দরকার। চেনা জগতটা মিথ্যে হয়ে গেছে। নিজেকেই সবচেয়ে বড় মিথ্যে মনে হচ্ছে ওর। ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো। গুলিস্তার হাঁটুতে থুতনি রেখে গুলিস্তার চমকিত মুখটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলো,

– বাবা বলে তুমি নাকি সিদ্ধান্ত নিয়ে ভয় পাও। ইনস্টেন্ট মোমেন্টে কি ডিসিশন নিতে হবে বুঝতে পারো না। কিছু চুজ করতে পারো না। তাহলে সেদিন কিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে? সেদিন কীভাবে কারো সাহায্য না নিয়ে আমাকে পেতে চেয়েছিলে? একা একটা ভয়ংকর প্রাণির সাথে লড়াই করেছো আমাকে বাঁচাতে। তখন তোমার ভয় করেনি কেনো? তখন তোমার জড়তা কোথায় ছিলো? কেনো বাঁচিয়েছিলে আমাকে? কেনো নিজের বুকে টেনে নিয়েছিলে? আরেকজনের পাপকে কেনোই বা মেয়ের পরিচয়ে বড় করেছো? বলো, প্লিজ বলো। আমি উত্তর খুঁজে খুঁজে শেষ হয়ে যাচ্ছি।

গুলিস্তার মাথা ঘুরছে ভনভন করে। মেয়ে এসব কোথা থেকে জানলো? গুলিস্তা নিজে আজ পর্যন্ত কাউকে জানায়নি৷ তাহলে? আর একজন শুধু জানে সেদিনের ঘটনা। নাহ, নাহ। সে কীভাবে বলবে! গুলিস্তা দ্রুত হিসাব মেলাতে চায়৷ কিন্তু পারে না৷ মেয়ের কান্না বাড়তেই আছে৷ হাউমাউ করে কাঁদছে। সেই সাথে বার বলছে, কথা বলো৷ আমার প্রশ্নের উত্তর দেও। বাইরে থেকে অস্থির রিনাতের কন্ঠ আসছে,
– কী হচ্ছে ভেতরে! তোমরা কি করতেছো? কাঁদছে কে? এই নিনাত, মাম্মাম?

গুলিস্তা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ছোটবেলায় খুব কান্না করলে রেহবার বলতো বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দেও। হাঁটাহাঁটি করো। গুলিস্তা তাই করতো। ছোট্ট নিনাত সত্যি চুপ হয়ে যেতো৷ কিন্তু এখন তো মেয়ে বড় হয়েছে৷ রেহবার, হ্যাঁ রেহবার। ওর কাছে সব সমাধান থাকে। ফোন হাতে নিয়ে দ্রুত কল করলো। রেহবার তখন বাড়ির পথেই আসছিলো। রিনাত দ্রুত আসতে বলেছে। দ্রুত আসতে বলা মানে কোনো অঘটন ঘটা৷ সেরকম কিছু শোনার জন্যই রেহবার কল রিসিভ করলো। গুলিস্তা বললো,
– বাড়ি আসো। তাড়াতাড়ি আসো। আমার মেয়ে কাঁদছে।

– তোমার মেয়ে নই আমি। আমি তোমার কেউ নই। কারো কেউ নই আমি।

নিনাতের অসহায় চিৎকার রেহবারের কানেও পৌঁছালো। আবার কি হলো কে জানে! সেদিন এতো করে বুঝালো তবুও। গুলিস্তা দিশেহারা। রেহবারের থেকে তার উত্তর চাই।
– জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিবো? সেই ছোটবেলার মতো। কিন্তু এখন তো বড় হয়ে গেছে! কি করবো বলো। এই কিছু বলো, অনেক কাঁদছে তো।

এতো চাপের মাঝে রেহবারের পাগল হওয়া বাকি৷ হতাশ কন্ঠে জানালো,
– তাই করো।

পা ছাড়িয়ে নিয়ে গুলিস্তা নিজেও ফ্লোরে বসলো। নিনাতকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সত্যি সত্যি পিঠে হাত বুলিয়ে বাচ্চাকে বুঝানোর মতো করে বললো,
– হুস, হুস। কাঁদে না৷ মা আছি তো৷

নিনাতের কান্না কমলো না বরং বাড়লো। বুকের ভেতরের হাহাকারটা কমে গেছে। বেড়েছে অপরাধবোধ, আত্মগ্লানি। মানুষটা এতো সহজ সরল কেনো? কী নির্মল, পবিত্র! অথচ কয়েকদিন আগেও নিজের মূর্খতার পরিচয় দিয়ে কতোটা খারাপভাবে হার্ট করেছিলো! লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে নিনাত।

বাড়ির এক্সটা চাবীগুলো রেহবারের স্টাডিরুমে থাকে৷ সেগুলোর সাহায্যেই রুমের লক খোলা হলো। ফ্লোরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নিনাত। বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে গুলিস্তা। রেহবারকে দেখে সেই আগের মতো করে ঠোঁট উল্টে বললো,
– থামছে না তো। তুমি দেখো না।

রেহবার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– আমার মা-টা কাঁদছে কেনো? কেউ বকেছে? আবার কেউ কিছু বলেছে? বাবা সেদিন বলেছিলো না, লোকের কথা পাত্তা দিতে নেই। সেসব ভেবে মন খারাপ করা চলবে না। তোমার জীবন তুমি তোমার মতো করে চালাবে। যা তোমার কাছে ঠিক, তা হাজার লোকে ভুল বললেও তুমি বিশ্বাস করবে না। ঠিক মেনে নিয়েই এগিয়ে যাবে। দেখবে একদিন পুরো পৃথিবী তোমার কথা মেনে নিতে বাধ্য হবে৷ তুমিই ঠিক, তারা সেটা স্বীকার করবে।

নিনাত মনে মনে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকলো, কিছু শোনেনি সে। আজ কারো সাথে দেখা হয়নি। স্কুল থেকে সোজা বাড়ি ফিরিছে। মায়ের সাথে এখনো অভিমান চলছে। যার দ্রুত নিষ্পত্তি টানবে সে।

রাতের বেলা মেয়েকে নিয়ে ছাদে হাঁটতে গেলো রেহবার। পূর্নিমার চাঁদের আলোয় ওখান থেকে পুকুরপাড় পর্যন্ত সবটা দেখা যাচ্ছে। ওদিকে তাকিয়ে নিনাতের মন ভার হলো। বাবাকে অপেক্ষা করতে বলে ধুপধাপ নিচে চলে এলো।

– মা ছাদে এসো৷ চাঁদ দেখবো।
বই রেখে গুলিস্তা তাকালো মেয়ের দিকে। কে বলবে, শেষ বিকেলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিলো এই মেয়ে। এখন কোমড়ে হাত রেখে আদেশ জারি করে বেড়াচ্ছে। যেতে ইচ্ছে না করলেও বিছানা থেকে নামলো। মানা করায় যদি মন খারাপ করে?

পুরো পরিবার একসাথে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলো উপভোগ করছে। পুকুরের জলের দিকে নির্দেশ করে নিনাত বললো,
– ইশ! এই চাঁদটা এতো সুন্দর কেনো? তাকালেই মন ভরে যায়। মনটা এক নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। সকল অস্থিরতা ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে দূর আকাশের ওই একরত্তি চাঁদ। অনেকক্ষণ ধরে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে মনের ভেতর কেমন হাহাকার করে। তবুও তাকিয়ে থাকার লোভ সামলানো যায় না। চাপা দুঃখভরা একটা প্রশান্তি আছে চাঁদের মাঝে। তাকালেই মনে হয়, পুরো পৃথিবীতে আমি একা একজন মানুষ। যাকে সঙ্গ দিতে বন্ধু হিসেবে হাজির হয়েছে চাঁদ। যেনো ও আমার অজানা সব দুঃখের সাথী।

মেয়ের মুখে চাঁদের অসাধারণ বর্ণনা শুনে গুলিস্তা। এতোটা বয়স হলো, তবুও সে নিজেই চাঁদের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারলো কই! এখনো মাঝেমধ্যে মাঝরাত্রে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করে ওরা দুজনে। রেহবারের দিকে তাকাতেই দেখলো সেও গুলিস্তার দিকেই তাকিয়ে।

– মা দেখো, পুকুরের পানিতে আরেকটা চাঁদ।

মেয়ের উচ্ছাসিত কন্ঠস্বর শুনে গুলিস্তা খুশি হয়। মনোযোগ দিয়ে মেয়ের উচ্ছাসিত মুখের আদলটা মনের কুঠুতিতে এঁকে নেয়। যেখানে এতোদিন একটা শিশু ছিলো। যার বেশি হাসা বারণ, কাঁদা বারণ, উচ্ছাসিত হওয়া বারণ।

– কালকে আমাকে হাঁটতে নিয়ে যাবে ওখানে?
নিনাতের কথায় রেহবার সানন্দে রাজি হলেও গুলিস্তার চিন্তা হলো। ওই পুকুরপাড়ে কেনো যেতে চাইছে? এতদিন বাচ্চাদের ওদিকে কখনো যেতে দেওয়া হতো না।

পরদিন সকালে মেয়েকে নিয়ে হাঁটতে বের হলো রেহবার। আগাছা পরিষ্কার করা হয়েছে কয়েকদিন আগেই। রাস্তাঘাট ঝকঝকে হয়ে আছে। পুকুরপাড়ের ময়লা সিড়িতে ধুপ করে বসে পরলো নিনাত। এখান থেকেই জীবনের গল্পটা শুরু হয়েছিলো৷ রেহবার বসলো মেয়ের পাশে। বাবার কাঁধে মাথা রেখে, নিনাত বলতে থাকলো,
– জানো বাবা, গতকাল স্কুল শেষে একজন মহিলা হুট করে আলাপ করতে এলো।

পুরো গল্পটা শুনে রেহবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে জলের দিকে। ওখানেই পরেছে বাবা-মেয়ের ছায়া। সরাসরি চোখের দিকে তাকাতেই পারছে না কেউ। তাই জলে তৈরি প্রতিবিম্ব যোগাযোগের মাধ্যম হলো। মেয়ের চোখে অনেক প্রশ্ন। সবগুলো বুঝতে পারছে না রেহবার।
– তুমি জানতে?

অতীত রোমন্থন করে রেহবার পুলকিত হলো, শিহরিত হলো। কী দিন কেটেছে সব!
– রিনাতের জন্মদিন ছিলো। তোমার মা যেহেতু ভীড় পছন্দ করতো না, তাই আমরা বাবা-ছেলেই ঘুরতে বেড়িয়েছি। ফিরে এসে দেখি ব্যালকনিতে তোমাকে কোলের মধ্যে লুকিয়ে ফুল কাঁপছে। রক্তাক্ত, ভীত, ত্রস্ত ৷ বাচ্চাটা কে, কোথায় পেলে প্রশ্নের জবাবে শুধু বলেছিলো, আমার মেয়ে৷ আর কিছুই জানায়নি। তোমাকেও কোলছাড়া করেনি। সেসব নিয়ে ফুলের সাথে আমার মনোমালিন্য হলো৷ তবুও সে তোমাকে ছাড়বে না। তখন বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছি৷ তারপর ধীরে ধীরে একটা পুতুলের বাবা হয়ে উঠলাম। পুরুষ মানুষ বাবা হয় হুট করে। সন্তানের মুখ দেখে, সন্তানকে কোলে নিয়ে। মেয়েরা মা হয় ধীরে ধীরে৷ একটু একটু করে গর্ভের সন্তানকে অনুভব কর‍তে করতে। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে আমরা দু’জনে মা বাবা হয়েছি হুট করে৷ এই মুহুর্তে ফুলকে নিয়ে আবার গর্ব হচ্ছে। ভাগ্যিস সেদিন লড়েছিলো৷ না হলে আমার মা-টাকে কোথায় পেতাম! শী ইজ রিয়েলি সামথিং। অ্যা ব্লেসিং ফর মি।

বাবা-মেয়ে সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়াতেই লক্ষ্য করলো দূর ছাদ থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে গুলিস্তা। নিনাত বললো,
– তাড়াতাড়ি ফিরে চলো। মা অপেক্ষা করছে৷

****

আজ নিনাতের তেরোতম জন্মদিন৷ পুরো বাড়ি হালকা সাজে সজ্জিত। কিচেনে দরদর করে ঘামছে গুলিস্তা৷ রেহবার, রেহবার বলে ডেকে উঠলো।
রেহবার এসে দেখে কোমড়ে আঁচল গুজে দাঁড়িয়ে আছে গুলিস্তা। রেহবারকে দেখে বললো,
– খেয়ে বলোতো কেমন লাগছে।

ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গরমে লালচে হয়ে আসা গালে চুমু দিয়ে রেহবার জানালো,
– খানিকটা নোনতা।

পেছনে ঘুরে বুকে খানিক ধাক্কা দিয়ে বললো,
– পায়েস খেতে বলেছি। সবসময় দুষ্টামি।
– ওহ। আগে বলবে তো।
সহাস্যে জবাব রেহবারের।

– সব তো রেঁধে ফেললাম, কেমন হয়েছে কে জানে! তুমি কি সবগুলো একটুখানি করে খেয়ে দেখবে? ট্রে সাজিয়ে তুমি নিয়ে যাবে কিন্তু৷ আমি পারবো না৷

চিন্তায় ঘামতে থাকে গুলিস্তা। মুখে ভয়ের ছাপ। জন্মদিনের কেক কাটার সময় ছু রির উপরে একটু হাত রেখেছিলো রেহবারের পাশে দাঁড়িয়ে। কেক কেটে সবাইকে বন্টন করে দিয়েছে মালা৷ নুডলস, চিকেন উইংস, চিকেন ফ্রাই, হোমমেড পিৎজ্জা, মিনি বার্গার, কাপকেক, স্যান্ডউইচ ইত্যাদি খাবারে ভর সবার প্লেট। বাচ্চারা আয়েশ করে খাচ্ছে।

– চিকেন ফ্রাইটা ভীষণ ক্রিপসি। দারুণ খেতে৷ কোথা থেকে এনেছো এটা? কোন রেস্টুরেন্ট?
বান্ধবীর কথায় হালকা হাসে নিনাত৷ গর্বের সাথে বলে,
– ঘরের বানানো। আমার মা বানিয়েছে।

জন্মদিন উপলক্ষে উপস্থিত বন্ধুরা অবাক চোখে তাকায়। কতো কতো কথা শুনেছে নিনাতের মায়ের নামে! উনি এতো ভালো রান্না করে নাকি!
– এইসব আইটেম আন্টি তৈরি করেছে?
– হ্যাঁ।
– একা একা?
– বাবা সামান্য হেল্প করেছিলো। নুন, ঝাল চেখে দেখে।

হাসতে হাসতে জবাব দেয় নিনাত। পায়েসের বাটি ট্রেতে সাজিয়ে ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে গুলিস্তা। সাথে রেহবার আছে তবুও হাতের তালু প্রচন্ড ঘামছে। হাঁটু কাঁপছে ঠকঠক। এই বুঝি ট্রে পরে গিয়ে ফ্লোরে সব মাখামাখি হয়ে যাবে। গুলিস্তার হাত থেকে ট্রে নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো রিনাত৷ তখনি বাচ্চারা গুলিস্তাকে খেয়াল করলো। হালকা গোলাপি শাড়িতে গোলাপি ত্বকের মায়াবী একজন মহিলা। চেহারায় কেমন মমতা ছড়ানো৷ সবাই অবাক চোখে তাকায়৷

– আন্টি, নিনাত বলছিলো, এসব খাবার আপনি একা বানিয়েছেন!

আঁচলে হাত মুছে লাজুক হাসে গুলিস্তা৷ ক্লাসের ফাজিল ছেলেটা তূর্য৷ সেও লাজুক হেসে বলে,

– আন্টি আপনি কী সুন্দর! আপনার হাসিটা তো পুরোই মায়াবী।
– এখানেও শুরু হয়ে গেলো তোর! আন্টি হয় আমাদের৷

বাচ্চাদের খুনসুটিতে সময় পেরিয়ে যায়৷ পুরো বাড়িময় বাচ্চাদের কোলাহলে ভর্তি ছিলো পুরোটা দিন। গুলিস্তা ভেবেছিলো এতো কোলাহলে ওর ভীষণ অস্বস্তি হবে। কিন্তু হয়নি। মনে হচ্ছিলো ঘরে অনেকগুলো রিনাত, নিনাত কথা বলছে, ছুটছে। রাতের দিকে এখন শুধু শরীরটা ভারী ক্লান্ত লাগছে৷ বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিচ্ছে। ওদিকে কিচেনের কি অবস্থা কে জানে! দুই বাচ্চাকে সাথে নিয়ে এঁটো থালাবাসন পরিষ্কার করছে রেহবার। গুছাতে গিয়ে সব অগোছালো না করলেই হয়।
গুলিস্তা একপাশে কাধ হয়ে শুলো। তখনি ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলো রিনাত। বিছানায় উঠে বসতেই হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে এগিয়ে এলো রিনাত। পানির গ্লাস হাতে নিনাতও এসেছে। সারাদিন পোলাও, চিকেন আর মশলার গন্ধে খিদে মরে গেছে গুলিস্তার। এসবের গন্ধে গা গুলাচ্ছে। তাই রাতে কিছু খায়নি সে। রিনাতের হাতে খাবারের প্লেট দেখে চোখ মুখ কুচকালো। মায়ের পাশে বসে হেসে প্লেট থেকে ঢাকনা সরালো রিনাত৷ ধোয়া উঠা গরম সাদা ভাত, গরুর গোশত ভুনা। গুলিস্তা অবাক হয়ে তাকাতেই রিনাত বললো,
– রাইস কুকারে ভাতটা আমি রান্না করেছি৷ অল্প মশলায় তরকারিটা বাবা রেঁধেছে। দেখি হা করো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি৷ খালি পেটে ঘুমাতে নেই।

গুলিস্তার চোখ টলমল করছে। আশেপাশে তাকিয়ে রেহবারকে খুঁজলো। নিনাত বুঝতে পেরে বললো,
– বাবা কিচেন ক্লিন করছে৷

জলে ভরা ঘোলা চোখে গুলিস্তা খাবার মুখে নিলো৷ বাচ্চারা ঠিকমতো খেয়েছে কিনা জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে আছে৷ এদিকে রেহবারও আসছে না। কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়? এদের জিজ্ঞাসা করা কি ঠিক হবে?
– উউউউ.. ওই খাবারগুলো তোমার বন্ধুরা খেয়েছে? মানে ওদের পছন্দ হয়েছে?

হাত কচলে ইনিয়েবিনিয়ে জানতে চাইলো গুলিস্তা৷

– পছন্দ হবে না আবার! সব চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। যাওয়ার সময় তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দেয়ালে তোমার তৈরি করা ওয়ালমেটগুলো দেখে ওরা তো অবাক। এগুলো তুমি নিজের হাতে তৈরি করেছো বিশ্বাসই করছিলো না।
– এখন আর তোমাকে ক্ষেপাবে না? মা নিয়ে বাজে কথা শোনাবে না?

গোল গোল চোখে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় গুলিস্তা। খুব আশা নিয়ে প্রশ্ন করেছে। মেয়ের চিন্তায় সারাক্ষণ অস্থির ছিলো কিনা। সেদিনের কথা ভুলেনি গুলিস্তা৷ তাই ঘটা করে নিনাতের জন্মদিনের আয়োজন করেছে৷ স্কুলের বন্ধুদের দাওয়াত করে খাইয়েছে। নিনাতের খুব মন খারাপ হলো। সেদিনের কষ্ট আজও মায়ের মনে রয়ে গেছে নিশ্চয়ই। উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– একবার ক্ষেপিয়ে দেখুক দেখি৷ ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিবো। আমার মাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলা! কেনো বলবে?
– আমি একটু অন্যরকম কিনা!
– তুমি অন্যরকম নও। আমাদের কাছে মা হিসেবে তুমিই সেরা।

রিনাত নিনাতের কথায় গুলিস্তা লজ্জা পায়। চোখ ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেহবার। মুখে তার কৌতুকে হাসি৷ একদা একদিন সেও এভাবে উত্তর দিয়েছিলো,
– তুমি অন্যরকম নও। স্ত্রী হিসেবে তুমি আমার কাছে সেরা।

সেই স্বীকারোক্তি আজও বদলায়নি। বদলায়নি সেই অনুভূতি। রেহবারের চোখে মুখে লেগে থাকা গর্বের হাসি যেনো বলছে, আমাদের এই অনুভূতিগুলো কখনো বদলাবে না। তুমি যেমনটা আছো, তেমনি থাকো। আমাদের কাছে এই তুমিটাই সেরা, তুমিটাই প্রিয়।

(সমাপ্ত)